হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(১২)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(২৩)
কুশল নিলাদ্রকে নিয়ে রায়হানুলের রুমে প্রবেশ করে। রায়হানুল বিছানার উপর স্থির হয়ে শুয়ে আছে। কুশল আর নিলাদ্র বিছানার কাছে যায়। কুশল রায়হানুলের পাশে বসে তার দিকে শান্ত দৃষ্টি স্থির করে বললো….
—“খুব অদ্ভুত তাই না! যেই মানুষটার মুখ থেকে কখনও আমার নাম উচ্চারণ করতে শুনি নি, যেই মানুষটাকে কখনও আমার মাথার উপর আদর ও দোয়ার হাত ছোঁয়াতে দেখি নি। সেই মানুষটার প্রতি এক অদৃশ্য টান কাজ করে। শুধু মাত্র একই বংশের, একই রক্তের সম্পর্কের জন্য এতো বেশি টান, মায়া, ভালোবাসা কাজ করাটা দেখতে ও শুনতে সত্যিই ভিষণ অদ্ভুত লাগে। এ বাড়ির মানুষগুলো তো অনেক আগেই বড় বাবার সুস্থ হওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন কিন্তু আমার মন কেনো তাতে সায় দেয় নি৷ আমার মন আজও বলে বড় বাবা একদিন না একদিন ঠিকই সুস্থ হয়ে উঠবেন। নিজের মুখ দিয়ে আমার নাম উচ্চারণ করবেন, আমার মাথায় ভালোবাসা ও দোয়ার হাত স্পর্শ করবেন। তুই পারবি তো দোস্ত আমার এই স্বপ্নটিকে বাস্তব রূপ দিতে?”
নিলাদ্র কুশলের পাশে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে এক হাত রেখে বললো…..
—“আমি আমার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করবো দোস্ত বড়বাবাকে পুরোপুরি ভাবে সুস্থ করে তুলতে।”
কুশল ওর কাঁধে নিলাদ্রের রাখা হাতের উপর নিজের বাম হাত রেখে শব্দ করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে। পরক্ষণেই কুশল রায়হানুলের পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললো…
—“তোকে একটা বিষয় জানানো উচিত বলে মনে হচ্ছে আমার। গতকাল মাঝরাতে আমার স্ত্রী তরুনিমা বড় বাবার রুমে এসেছিলো আর সে দেখেছিলো বড় বাবা নাকি অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছিলেন। কিছুসময় পর যখন আমরা সবাই বড় বাবার রুমে এসেছিলাম তখন বড় বাবাকে এখনের ন্যয়ই স্থির হয়ে থাকতে দেখেছিলাম। দীর্ঘ ২৮ বছরের মাঝে হুট করে বড়বাবার এমন অস্বাভাবিক আচারণের কথা তরুনিমাই প্রথম নোটিশ করেছিলো। এটাকে কি আমরা পজেটিভ সাইন হিসেবে ধরতে পারি?”
কুশলের এমন কথায় নিলাদ্র ওর কপালে চিন্তার কয়েকটা ভাজ স্পষ্ট করে বললো…..
—“আমার জানামতে কোনো দীর্ঘ সময় ধরে কো*মায় থাকা পেশেন্টের ক্ষণিক সময়ের জন্য অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপা-কাঁপি করার বিষয়টা কখনই তার সুস্থ হওয়ার পজেটিভ সাইন হিসেবে মনে করতে পারি না। তবে যদি রোগীর শরীরে বিরূপ প্রভাব ফেলতে কোনো কড়া ডোজের ঔষধ ইনজেক্ট করা হয় তখন রোগীর শরীর ক্ষণিক সময়ের জন্য অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপা-কাঁপি করতে পারে। আমি যেহেতু এই বিষয়টা নিয়ে পুরোপুরি ভাবে শিওর নই তাই তুই টেনশন করিস না।”
নিলাদ্রের মুখে এরূপ কথাগুলো শুনে কুশল কিছুসময় নিরব হয়ে থাকে। পরক্ষণেই কুশল রায়হানুলের রুম থেকে বের হতে হতে বললো……
—“তুই বড় বাবার কাছে থাক আমি একটু আসছি।”
এই বলে কুশল রায়হানুলের রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। নিলাদ্র রায়হানুলের পাশে বসে তার পালস এর গতি চেইক করে। কিছুসময় পর কুশল ওর হাতে একটা বড় আকারের চাইনিজ তালা আর চাবি নিয়ে রায়হানুলের রুমে প্রবেশ করে বললো…..
—“নিল…চল এখন। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে, বিশ্রামের প্রয়োজন আছে তোর।”
নিলাদ্র কুশলের কথানুযায়ী রায়হানুলের পাশ থেকে উঠে দাড়ায়। অতঃপর ওরা দু’জনেই রায়হানুলের রুমের বাহিরে চলে আসে। কুশল রায়হানুলের রুমের দরজা বাহির থেকে আটকিয়ে তালা লাগিয়ে দেয়। কুশলের এমন কাজে নিলাদ্র অবাক স্বরে প্রশ্ন করলো…
—“কি রে বড়বাবাকে ভিতরে রেখে তার রুমের দরজায় তালা লাগালি কেনো?”
কুশল নিলাদ্রের দিকে শান্ত দৃষ্টি স্থির করে বললো….
—“বড় বাবার ট্রিটমেন্ট চলাকালীন পুরো সময়টাতে তুই আর আমি ব্যতিত যেনো ৩য় কোনো ব্যক্তি বড় বাবার রুমে প্রবেশ করতে না পারে তাই এই কাজ করলাম।”
—“কিন্তু, বড় বাবা তো এখন তার নিজ বাসাতেই আছেন। এখানে থাকাকালীন তার চিকিৎসায় ব্য*ঘা*ত ঘটাবে এমন তো কেও এ বাসায় থাকার কথা না।”
—“যদি তোর ধারণা অণুযায়ী বড় বাবার শরীরে বিরূপ প্রভাব ফেলার উদ্দেশ্য নিয়েই গত রাতে কেও কড়া ডোজের ঔষধ তার শরীরে ইন*জে*ক্ট করে থাকে তাহলে অবশ্যই এমন কেও আছে আমাদের চারপাশে যে চায় না বড় বাবা সুস্থ হয়ে যাক। তাই পূর্ব থেকেই সতর্ক থাকা ভালো।”
নিলাদ্র আর কিছু বললো না৷ অতঃপর ওরা দু’জনে দু’জনের রুমে চলে যায়।
(২৪)
কুশল নিজের রুমে প্রবেশ করতেই দেখে তরুনিমা বিছানার উপর জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে। কুশল তরুনিমার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে তরুর পায়ের কাছে থাকা কম্বলটি টেনে ওর শরীরে দিয়ে দেয়। সেইসময় তরুর হাতের সাথে কুশলের হাত স্পর্শ হতেই সাথে সাথে সে হাত সরিয়ে নেয়। পরক্ষণেই কুশল তরুর কপালে, গালে হাত রেখে চিন্তিত স্বরে বললো…
—“ওর শরীর তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।”
কুশল লক্ষ্য করে এতো ভাড়ি কম্বল তরুর শরীরে জড়িয়ে দেওয়ার পরেও সে কাঁপছে। তাই কুশল আলমারি থেকে আরো ১টি কম্বল বের করে ভালো ভাবে তরুর শরীরে জড়িয়ে দেয়। অতঃপর কুশল রুম থেকে বেড়িয়ে নিচে এসে একটা বাটি নিয়ে আবারও রুমে যায়। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে দুইটি রুমাল বের করে বেডসাইড টেবিলের উপর রাখা পানির বোতল থেকে বাটিতে পানি ঢেলে নিয়ে তরুর মাথার পাশে বসে জলপট্টি দিতে শুরু করে। বেশ কিছুসময় ধরে জলপট্টি দেওয়ার ফলে তরুর শরীরের তাপমাত্রা অনেকটা কমে যায়। কুশল তরুর দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো….
—“আমি তোমার স্বামী তাই তোমাকে স্পর্শ করার জন্য আমার তোমার কাছে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। যেহেতু তুমি আমাকে এখনও নিজের স্বামী রূপে পুরোপুরি ভাবে মেনে নিতে পারো নি তাই তোমার অনুমতি ব্যতিত তোমাকে স্পর্শ করা আমার উচিত হবে বলে আমার মনে হয় না। আজ তোমার অসুস্থতা আমায় বাধ্য করলো তোমায় স্পর্শ করতে। আমায় তুমি ক্ষমা করে দিও তরুনিমা।”
এই বলে কুশল কম্বলের নিচ থেকে তরুর একটা হাত বের করতেই দেখে হাত ঘেমে গিয়েছে। তাই কুশল তরুর উপর থেকে কম্বল দুটি সরিয়ে দেয়। এরপর বিছানা থেকে নেমে আলমারি খুলে একটি পাতলা কম্বল ও একটি পাতলা গামছা বের করে। কম্বলটি বিছানার উপর রেখে কুশল ওয়াশরুম থেকে গামছাটি ভিজিয়ে এনে তরুর কাছে বসে ওকে ধরে শোয়াবস্থা থেকে উঠিয়ে নিজের বুকের সাথে ওর পিঠ ঠেকিয়ে বসিয়ে দিয়ে তরুর দু’হাতের জামার হাতা গুটিয়ে দেয়। এরপর ভেজা গামছাটি দিয়ে তরুর মুখ, গলা, ঘাড়, দু-হাতের ঘামগুলো মুছে দেয়।
শরীরের শুধু এতোটুকু অংশ মুছলেই হবে না, ভিতরের অংশগুলোও মুছতে হবে। তাই কুশল ভিজা রুমালটি দিয়ে নিজের চোখ বেঁধে নেয়। এরপর তরুর শরীরের ভেতরের সামনে ও পিছনের অংশ যত্নসহকারে মুছে দিয়ে ওর জামা ঠিক করে দিয়ে চোখের বাঁধন খুলে ফেলে। এরপর তরুকে আবারও আগের স্থানে শুইয়ে দিয়ে কুশল ওর পায়ের কাছে বসে দৃষ্টি অন্যদিকে স্থির রেখে ওর দুই’পা মুছে দিয়ে পাজামা ও নামিয়ে দেয়। কুশল বিছানা থেকে নেমে পাতলা কম্বলটি তরুর শরীরে জড়িয়ে দেয়৷ মূলত সন্ধ্যার পর পায়ে আ*ঘা*ত পাওয়ার কারণেই যে তরুর জ্বর এসেছে তা কুশল বুঝতে পেরেছে।
জ্বর যেনো আবার ফিরে না আসে তাই কুশল ওয়ারড্রবের উপর রাখা ফাস্টএইড বক্স থেকে জ্বরের আর ব্য*থা কমার ট্যবলেট নিয়ে তরুর পাশে এসে বসে। অতঃপর কুশল তরুকে ধরে আবারও নিজের বুকের সাথে ওর ঠেকিয়ে বসিয়ে ঔষধ দুটি ওকে খাইয়ে দিয়ে আগের ন্যয় শুইয়ে দেয়। তরুকে শুইয়ে দিয়ে কুশল বিছানা থেকে নামতে নিলে তরু ঘুমের মাঝেই কুশলের হাত চেপে ধরে বিরবিরিয়ে বললো…
—“যাবেন না প্লিজ….থাকুন না আমার পাশে…!”
কুশল আর উপায় না পেয়ে ওভাবেই তরুর হাতের মাঝে নিজের হাত রাখাবস্থাতেই বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে তরুর ঘুমে মগ্ন মায়া ভরা মুখশ্রীর উপর নিজের দৃষ্টি স্থির করে রাখে।
(২৫)
রায়হানুলের রুমের দরজার সামনে তরুনিমার দেখা সেই দুই ছায়ামানব এসে দাঁড়াতেই দেখে রায়হানুলের রুমের দরজায় তালা দেওয়া। ছায়া মানবের মাঝে ১ম ছায়া মানব নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে দরজায় লাগানো তালার উপর স্বজোরে একটা ঘু*ষি দিয়ে বসে। যার ফলে সেখানে শব্দের সৃষ্টি হয়। ১ম ছায়া মানবের এমন কাজে ২য় ছায়া মানব যেনো হতভম্ব হয়ে যায়। তৎক্ষনাৎ ২য় ছায়া মানব ১য় ছায়া মানবের অন্য হাত ধরে টানতে টানতে অন্ধকারের মাঝে মিলিয়ে যায়। রায়হানুলের দরজায় লাগানো তালার উপর যে ১ম ছায়া মানবের হাতের র*ক্ত লেগে গিয়েছে তা ওরা দু’জন লক্ষ্য করে নি। কয়েক ফোঁটা রক্ত দরজার সামনে মেঝেতে পড়ে রয়েছে তাও ওরা লক্ষ্য করে নি।
চলবে ইনশাআল্লাহ…………..