হারানো সুর (৫)
সানজিদা ইসলাম সেতু
বসার ঘরের এক কোনায় বসে আছে বিন্দু। গালে রক্তের দাগ। ভয়ে কুঁকড়ে গেছে ও। ওর সামনে পরে আছে অর্পণ সিকদার এর ডেডবডি। বৃত্তর হাত রক্তে লাল, এলোমেলো চুল,ফ্যাকাসে মুখ।
বৃত্ত উঠে এসে বিন্দুর হাত ধরে।
‘কাজি সাহেব নতুন করে কাবিন লিখুন। এখনই আমাদের বিয়ে হবে।’
আহসান সাহবে রেগে গিয়ে বৃত্তকে চর মারে,
‘আমার মেয়ের সাথে আমি তোমার বিয়ে কিছুতেই দেব না। দরকার পরলে ওকে কেটে সাগরে ভাসিয়ে দেব, তাও তোমার মতো খুনি ছেলের সাথে বিয়ে দেব না।’
‘আপনি যদি বিন্দুর বাবা না হতেন তাহলে আপনাকে আপনার এ কথার দাম দিতে হত।’
কি হল কাজি সাহেব, কাবিন লেখা হয়েছে?’
‘হ্যাঁ, হয়েছে।’
‘বিন্দু, এখানে সিগনেচার করে দাও।
বিন্দু টেক দ্যা পেন।
বিন্দু..’
‘আপনি খুন করেছেন!’
‘তো আর কি করতাম? ও তোমাকে আমার থেকে কেড়ে নিতে চাইছিল। আর.. আর আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না।’
‘তো যে আমাকে আপনার থেকে আলাদা করতে চাইবে আপনি তাকেই এভাবে মেরে ফেলবেন?’
‘ আমাদের মাঝে যে আসবে, যে তোমাকে অামার থেকে কেঁড়ে নিতে চাইবে তাকেই আমি শেষ করে দেব,মেরে ফেলব।’
‘সাইকো আপনি। আপনি কাউকে ভালো বাসতে পারেন না। আপনি আমাকেও ভালোবাসনি।’
বৃত্ত বিন্দুর গলা চেপে ধরে,
‘আমার ভালোবাসা নিয়ে একদম প্রশ্ন করবে না। তোমাকে আগেও বলেছি আজ আবারও বলছি, তুমি শুধু আমার, শুধু অামার।’
‘আপনি সাইকো। আপনি আমাকে ভালো বাসেন না, একের পর এক আঘাত করে গেছেন, করছেন।’
‘আমি অার কোনো কথা শুনতে চাই না, সিগনেচার করে দাও। ‘
‘করব না।’
‘তুমি কি চাও, তোমার এ স্বীদ্ধান্তের কারণে তোমার পরিবারের কোনো ক্ষতি হোক?’
বিন্দু দু পা পিছিয়ে যায়। হাতের মুঠোয় থাকা স্লিপিং পিলস গুলো পরে। বৃত্ত রাগি চোখে বিন্দুর দিকে তাকায়।
‘এগুলা কিসের মেডিসিন?
কি হলো চুপ করে আছ কেন?
বিন্দু কিছু জিজ্ঞেস করছি অামি।’
‘আমি বলছি বৃত্ত ভাইয়া। ওগুলো স্লিপিং পিলস।’
রিজভীর কথা শেষ হতেই বৃত্ত আবার বিন্দুর গালে চড় মারে। এবারের চড়টা বেশ জোরেই হয়ে গেছে, ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়ে গেছে।
বৃত্ত বিন্দুর হাতে কলম আর নিজের এক হাতে বীনা আর অন্য হাতে ছুড়ি নেয়, সেই ছুড়ি যেটা দিয়ে অর্পনকে মেরেছে।
‘শেষ বারের মতো বলছি সিগনেচার কর। তোমার হাত না চললে আমার হাত কিন্তু অবশ্যই চলবে।’
বোনের গলায় ছুড়ি দেখে বিন্দু কাবিননামায় সিগনেচার করে দেয়। বৃত্ত বীনাকে ছেড়ে দেয় আর নিজেও সিগনেচার করে নেয়।
‘চল বিন্দু।’
‘কোথায়? ‘
‘আমার সাথে চল, গেলেই জানতে পারবে।’
‘আপনার মতো নোংরা, খুনি মানুষের সাথে আমি কোথাও যাব না।
আপনার সাথে যাওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া আমার কাছে অনেক সুখকর।’
‘আমার হাতের আরেকটা চর সহ্য করার মতো শারীরিক অবস্থা তোমার নেই। তাই ভালোভাবে বলছি, চল আমার সাথে।’
‘আপনার সাথে কেউ যাবে না, আপনি আমাদের সাথে যাবেন।’
বৃত্ত ঘুরে দাড়িয়ে দেখে পুলিশ দাড়ানো।
‘অর্পণ সিকদারকে খুনের অভিযোগে আপনাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।’
‘অফিসার এই বৃত্ত নিয়ে যান। এ অনেক ভয়ংকর।’
‘কনস্টেবল নিয়ে আস ওনাকে।’
‘আমাকে বেশিদিন আটকে রাখতে পারবেন না অফিসার।’
‘আপনি কোনো চিন্তা করবেন না আহসান সাহেব, এমন চার্জশিট রেডি করব যার ফাক কেটে বের হতে পারবে না।’
‘বিন্দুকে আপনাদের কাছে আমানত হিসেবে রেখে গেলাম। ঠিক সময়ে এসে নিয়ে যাব।
আসছি বিন্দু, খুব তাড়াতাড়ি আমি ফিরে আসব। চিন্তা কর না, এসেই তোমাকে নিয়ে যাব।’
‘তার আগে আমি মরে যাব।’
‘আমার অনুমতি ছাড়া মরতে পারবে না। যদি এমন কিছু করার চেষ্টা কর তাহলে তার পানিশমেন্ট কিন্তু তোমার ফ্যামিলি পাবে।
আমাকে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে তার মানে এই না যে অামি সারাজীবন জেলে কাটাব। খুব শীঘ্রই আমি ফিরব, তোমার কাছে।’
পুলিশ বৃত্তকে অার অর্পনের বডি নিয়ে যায়।
পুরো বাড়ি থমথমে। হঠাৎই বিন্দু জ্ঞান হারায়। পরেরদিন সকালে জ্ঞান ফেরে ওর। জ্ঞান ফেরার পরই ওর আচরন কেমন যেন বদলে যায়। হঠাৎ হাসে হঠাৎ কাঁদে, আবার কখনে বলে বৃত্ত ওকে নিয়ে যাবে, ওকে মেরে ফেরবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
কাজি সাহেব যখন বিন্দুকে বারবার কবুল বলতে বলছিলেন, তখন বৃত্ত ঘরে ঢোকে। সবার চোখের আড়ালে মম বৃত্তের রুমের দরজা খুলে দেয়। বৃত্তের পিছন পিছন অর্পনও আসে। ওদের দুজনের মধ্যে বেশ হাতাহাতি হয়। একপর্যায়ে টেবিলে উপর থাকা ছুড়িটা বৃত্ত অর্পনের পেটে ঢুকিয়ে দেয়, ছুড়ি টেনে বের করে বুকের উপর আরো কয়েকবার গেথে দেয়।
রিজভীর বাবা একজন ডক্টর। তিনি আহসান সাহেবকে বিন্দুকে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে বলে। আহসান সাহেব সে অনুযায়ী একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখায়। সে বলে,
‘অতিরিক্ত মেন্টাল প্রেশারের কারনে এমন হচ্ছে। মৃত্তিকা কোনো কিছুতে বেশ ভয় পেয়েছে, যার জন্য ওর হ্যালুসিলেশন হচ্ছে। ওকে একা রাখবে না। আর যা শুনলাম তাতে এটাই সাজেস্ট করব যে, আপনারা এখান থেকে দূরে কোথাও চলে যান। এখানে থাকলে ওনার সমস্যা আরো বাড়তে পারে। ‘
আহসান সাহেব মেয়ের কথা ভেবে স্বীদ্ধান্ত নেয় যে তিনি বাড়ি বেঁচে অন্য কোথাও চলে যাবে।
বৃত্তকে ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করছে ওর উকিল, কিন্তু কিছুতেই কিছু করতে পারছে না। এদিকে বিন্দুর অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। জলের দামে এখানকার সব কিছু বেঁচে দেবার সিদ্ধান্ত নেন আহসান সাহেব। পরিবারের সবাইকে তিনি দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেন। তিনি যেতে পারছেন না কারন তার চাকরি। আর মাত্র ১৩ দিন পর তার চাকরি শেষ, তারপরই রিটায়ার্ড।
১৩ দিন পর অনেক মিথ্যা সাক্ষ্য প্রমান দিয়ে বৃত্তকে ছাড়ানো হয়। কোর্ট থেকে বৃত্ত সোজা আসে কক্সবাজার, বিন্দুদের বাড়ি। পুরো বাড়ি খালি। জানতে পারে আহসান সাহেব সবটা বেঁচে এখান থেকে চলে গেছে। বৃত্ত যায় আহসান সাহেবের ব্যাংকে। বৃত্তকে দেখে আহসান সাহেব অনেকটাই ভয় পায়। কারন তিনি বৃত্তর যে রুপ দেখেছে তাতে তার ভয় পাওয়া স্বাভাবিক।
‘বিন্দু কোথায়?’
‘বলব না।’
‘প্লিজ আঙ্কেল বলুন আমার বিন্দু কোথায়? ওকে আমার খুবই প্রয়োজন।’
‘তুমি যাই বল না কেন বিন্দুর খোঁজ আমি তোমাকে দেব না। তার জন্য তুমি যা খুশি তাই করতে পার।’
‘বেশ আপনি যখন ঠিক করেছেন বিন্দুকে আমার থেকে দূরে রাখবেন, লুকিয়ে রাখবেন। তখন আমিও বলছি, বিন্দুকে আমি ঠিকই খুজে বের করব আর ওকে আমার কাছে নিয়েও আসব। দেখি কি করতে পারেন?
আর একটা কথা, বিন্দু কিন্তু আমার লিগ্যাল ওয়াইফ। ডোন্ট ফরগেট ইট।’
এত কিছুর মধ্যে আহসান সাহেব ভুলে গেছিলেন যে, বিন্দু আর বৃত্তের বিয়ে হয়ে গেছে। এবার তার মাথায় নতুন চিন্তা ভর করেছে।
বৃত্ত অফিসে ফিরে গিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসে। ওর ঢাকা যাওয়ার দিন থেকে সমস্ত ফুটেজ দেখতে বসে। সেদিন ছিল শনিবার। ফুটেজ দেখে কেমন যেন খটকা লাগে তাই শুক্রবারের ফুটেজও দেখে। বিকালে বিন্দু বাড়ি থেকে বের হবার আগ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। সন্ধ্যা অবধি বিন্দু ওর সাথে ছিল। তার পরই ও ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দেয়। বিন্দু বাড়ি থেকে বের হবার আধঘন্টা পর একজন বৃদ্ধ বাড়িতে ঢোকে। বৃদ্ধকে দেখে বৃত্তর আকাশ থেকে পরার যোগার। বৃদ্ধ স্বয়ং ইখতিয়ার মজুমদার।
শুক্রবার বিকালে…..
‘আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না,কে আপনি?’
‘আমি ইখতিয়ার মজুমদার। আপনাদের সাথে কিছু কথা বলার আছে, সেজন্য ঢাকা থেকে আমাকে এ অসময়ে আসতে হয়ছে। ‘
‘প্লিজ বসুন, বসে আপনার সব কথা শোনা যাবে।’
‘যা বলার তা স্পষ্ট ভাবেই বলছি, আপনার মেয়ে মৃত্তিকাকে আমার নাতি বৃত্তর থেকে দূরে থাকতে বলুন। এতো সবারই ভালো।’
‘আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না।’
‘জানতাম বুঝবেন না। বড়লোক ছেলে দেখলে কোনে মেয়ের বাবাই সহজে কোনো কথা বুঝতে পারে না।’
‘আপনি কিন্তু আমার বাড়িতে এসে আমাকে অপমান করছেন।’
‘আমার নাতিকে ছাড়তে আপনি আর আপনার মেয়ে কত টাকা চান? নির্দ্বিধায় বলতে পারেন।’
‘আমার মেয়ে এমন কোনো কাজ করতে পারে না। আমি ওকে তেমন শিক্ষা দেই নি।’
‘তাই নাকি! তাহলে এই ছবি গুলো দেখুন, এগুলো নিশ্চয়ই মিথ্যা বলছে না?’
ছবি দেখে আহসান সাহেব বসে পরেন। ছবিতে বিন্দু বৃত্তকে জরিয়ে ধরে আছে।
‘এবার আপনি কি বলবেন? আশা করি আমি আপনাকে সবটা বুঝাতে পেরেছি। এই নিন ব্লাঙ্ক চেক, নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী অ্যামাউন্ট বসিয়ে নিবেন।’
ইখতিয়ার মজুমদারের কথা শুনে বৃত্তর পুরো শরীর রাগে কাঁপতে থাকে। নিজের রাগকে সামলে একে একে পরের ফুটেজ দেখা শুরু করে। ওদের বিয়ের পরে বিন্দুর অবস্থা দেখে বৃত্ত কেঁদে দেয়।
ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই। কিন্তু প্রিয় মানুষের কষ্টে যে তাদের চোখ বাঁধা মানে না।
এ সমাজ যেমন মেয়েদের জন্য কিছু কঠিন নিয়ম বানিয়েছে, তেমনই ছেলেদের জন্যও বানিয়েছে। তার মধ্যে একটা হল, ‘ পুরুষ মানুষদের কাঁদতে নেই।’
হায়রে সমাজ…
চলবে