হঠাৎ_হাওয়া,১৮,১৯

#হঠাৎ_হাওয়া,১৮,১৯

(১৮)

যে ডক্টর মায়ার বাবার অপারেশন করেছেন তার কেবিনে মায়া আপাতত বসে আছেন তিনি আরেকটা অপারেশন করে মায়ার সাথে দেখা করবেন, মায়ার বাবার এখনো জ্ঞান ফেরেনি। এদিকে মায়া থরথর করে কাপছে ওর হাত পা পুরো ঠান্ডা হয়ে গেছে, ইচ্ছে করছে এখান থেকে ছুট্টে বের হয়ে যেতে, মায়া কিছুক্ষণ মোচড়া মোচড়ি করে ভাবলো চলে যাবে এক্ষুনি ও এখান থেকে চলে যাবে বাবার তো অপারেশন শেষ হয়েছে, মায়া দরজা খুলে বের হতে গিয়েই থমকে গেলো,
—পালাচ্ছো নাকি মায়া?
মায়া আমতা আমতা করে বলল,
—না আসলে, আবির ভাই আপনি তো আসতে খুব দেরি করছিলেন আমি একটু ওয়াশরুমে যাব ভাবছিলাম, তাই আরকি….
—এখন ওয়াশরুমে যেতে চাও?
—না, না ঠিক আছে আমি পরে যাবো,
—এসো বসো,
আবির গায়ের এপ্রোন টা খুলে চেয়ারে রেখে বসলো,মায়া মাথা নিচু করে আছে মাথা তোলবার সাহস ওর হচ্ছে না আবির শান্ত চোখে মায়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
—কেমন আছো মায়া?
মায়া মাথা নিচু করে রইলো,ও কি বলবে?ভালো আছি? সহজ একটা উত্তর এর পর আর পালটা প্রশ্ন হবে না এরকম একটা জবাব?নাকি সত্যি? আচ্ছা সত্যি কি? এই যে মায়া ভালো নেই একটুও ভালো না ওর জীবন ঠিক দুবছর আগেই থমকে আছে?নিয়ম করে সকাল দুপুর রাত হয় কিন্তু মায়ার কিছু যায় আসে না? অনেকদিন হলো মায়া একটু শান্তিতে ঘুমুতে পারে না,বুকের মধ্যে খুব বড় একটা অংশ জমাট বেধে আছে, ঠিক মতো নিঃশ্বাস ফেলতে পারে না, একথা কি মায়া বলবে? মায়ার এসব কথা কি কেউ শুনবে? বিশ্বাস করবে?মায়া খুব বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
—ভালো।
—এই ভালোটুকু বলতে এত সময় কেন লাগলো মায়া?
—আপনারা কেমন আছেন আবির ভাই?
—আমরা বলতে কারা মায়া?
মায়া কিছু বলতে পারলো না চুপ থাকলো,
—মিষ্টি চার মাস হলো কন্সিভ করেছে।
মায়ার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো মনে হলো কতদিন ভালো কিছু শোনে না, মায়া খুব সুন্দর করে একটু হাসলো
—কংগ্রাচুলেশনস, আমি খুব খুশি হয়েছি।নিরব ভাইয়া আর পুষ্প আপু কি বিয়ে করেছে?
—হ্যা বছর দেড়েক হলো ওরা এখন স্পেনে আছে নিরব ওখানে এক হসপিটালে স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডি করতে গেছে পুষ্পও ওর সাথে আছে নেক্সট মান্থে ফিরবে হয়তো ওরা।
—ওহ! পুষ্প আপুর বাবা তাহলে সবটা মেনে নিয়েছে?
—না
—তাহলে?!
—তুমিতো জানো পুষ্প কি জেদী মেয়ে, অনেক কাহিনী বেশ ভালোই ঝামেলা হয়েছিলো ওদের বিয়েতে, কিন্তু পুষ্প নিরবকে শক্ত করে আকড়ে ধরেছিলো।ছেড়ে দেয় নি।
—যাক ভালোই হয়েছে আঙ্কেলও একসময় মেনে নেবেন,
—হ্যা হয়তো,ধ্রুব আপাতত দেশেই আছে,এই হসপিটালেই, বিয়ে শাদী করেনি ওর ভাব দেখে মনে হয় না ওর কপালে বিয়ে আছে
মায়া হেসে বলল,
—এখনো কি কোনো চুমকির দেখা পায় নি?
—ওর আর পাওয়া,ওহ ভালো কথা দিহানের দিন পনের পর বিয়ে তুমি এটেন্ড করবে নাকি?
মায়া মৃদু হেসে বলল,
—আমি চলে যাবো,আবির ভাই। এই শহর আমার ভালো লাগে না।
—আর কারো কথা শুনবে না?
মায়া উঠে দাড়ালো ওর খুব ইচ্ছে করছে জানতে কথা আর হিমালয় বিয়ে করেছে কি না! কতদিন বিয়ে করেছে ওরা?ওদের সংসার টা কি খুব সুন্দর স্বপ্নের মত!? হিমালয় কি কথা আপুকে তুমুল ভালোবাসে,পাগল করা ভালোবাসা! মায়ার দম বন্ধ হয়ে এলো ওদের কথা শোনার সাহস মায়ার নেই, চলে যাওয়াই ভালো ওকে ফিরে যেতেই হবে।তবে দরজা পর্যন্ত আর যাওয়া হলো না মায়ার তার আগেই জ্ঞান হারালো,

জ্ঞান ফিরে মায়া দেখলো সাহিত্য বুকে হাত বেধে দাঁড়িয়ে আছে,
—তুই জিজ্ঞেস করেছিলি না স্টেশনে যে তুই প্রতিবন্ধী কি না আমি বলছি তুই আসলে প্রতিবন্ধী, তুই হলো বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু
—শিশু?
—এক থাপ্পড়ে দাত খুলে ফেলব মুখে মুখে কথা বললে,খাওয়া দাওয়া করিস তুই ঠিক মতো?মরতে চাস? মরতে চাইলে বল, এক কাজ কর ওঠ সিড়ি বেয়ে এই ১০ তলা হসপিটালের ছাদ থেকে তোকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেই,
—সিড়ি বেয়ে না উঠে লিফটে যাওয়া যাবে না?না মানে শরীর দুর্বল তো, তাই বলছিলাম আর কি
সাহিত্য কটকট করে তাকিয়ে থেকে বলল,
—মামার যে ডক্টর অপারেশন করেছে সে স্পেশালি তোকে ট্রিট করছে কেন?
—ওইটা আবির ভাইয়া হিমালয়ের বন্ধু।
—বাহ! বেশ তো ডাক্তারে ডাক্তারে দেশ দুনিয়া ভইরা গেছে, সারাজীবন তো ফ্রি ট্রিটমেন্ট করা যাবে, তুই তো খুব লাকি রে!

মায়া পাশ ফিরে শুয়ে মুখে চাদর টেনে নিলো দ্রুত এখান থেকে ফিরে যেতে হবে, খুব দ্রুত।
তবে দ্রুত আর মায়ার ফেরা হলো না ওর বাবার অনুরোধে এবার এমন কিছু ছিল মায়া সহজে ছাড়া পেলো না এ কদিন একবারো মায়া ওর বাসায় আসেনি ফুপির বাসাতেই ছিলো আজ ওর বাবাকে রিলিজ করায় বাসায় এসেছে সাহিত্য এসে সব গুছিয়ে দিয়ে গেছে বাবাকে তার ঘরে দিয়ে খাওয়া শেষ করে ওষুধ দিয়ে মায়া নিজের ঘরে এলো, সবকিছু একদম পরিপাটি ঠিক যেমন মায়া রেখে গিয়েছিলো, জীবনের সবচেয়ে সুন্দর আর সবচেয়ে বিস্বাদ স্মৃতি এখানে মায়ার এই ঘরে, মায়া জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলো তবে দীর্ঘশ্বাসই বেরিয়ে এলো,চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো, যদি সেদিন হিমালয়ের মা না আসতেন বা ও যদি সেদিন বাসায় না থাকতো! তাহলে কতকিছু অন্যরকম হতো! হিমালয়ের সাথে মায়ার বিয়ের তারিখ যেদিন ঠিক হলো, মায়া ঘরে আসতেই হিমালয় ওর পিছু পিছু এসে ওকে জড়িয়ে ধরে কেদে ফেললো,মায়া একদম অবাক হয়ে গেলো এই কঠিন মানুষ টার ভেতরটা কত্ত নরম! মায়া ফিক করে হেসে বলল,
—কি ব্যাপার? আপনার কি আফসোস হচ্ছে নাকি কাদছেন কেন!
হিমালয় কিছু বলল না শুধু মায়াকে জড়িয়ে ধরে রইলো শুধু যাওয়ার সময় বলল,
—আমার সাতাশ বছরের জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া তুমি।অনেক কিছু আমি পারি না আর আজকাল তার মধ্যে অন্যতম একটা হচ্ছে তোমাকে মাথা থেকে বের করতে, এক সেকেন্ডের জন্যেও না।
হিমালয় কিছু তীক্ষ্ণ সুখকর কথা বলে বেরিয়ে গেলো।
যেদিন বিয়ে তার ঠিক আগের দিন হিমালয়ের মা এলেন, মায়ার বাবা একটু বিস্মিত হয়ে বললেন
—ভাবি আপনি?
—মায়া বাসায় আছে ভাইজান?
—হ্যা উপরে
—আচ্ছা আচ্ছা বিয়ের কিছু প্লান ওর সাথে করতে হবে তো তাই…আমি উপরে যাচ্ছি।

হিমালয়ের মাকে দেখে মায়া খুব খুশি হলো, মহিলাটা খুবই সহজ সরল যাকে দেখলেই মমতা নজরে আসে,তবে মায়ার খুশি বেশিক্ষণ থাকলো না
—আন্টি আপনি?আন্টি জানেন সেদিন আপনি যে আংটিটা আমায় দিয়েছিলেন ওটা কিন্তু আমি খুলে ফেলি নি,দেখুন দুটো আংটিই আমার হাতে আছে,
হিমালয়ের মা মায়ার খুব কাছে গিয়ে মায়ার মাথায় হাত রেখে বলল,
—মারে আজ আমি এই আংটিটা ফেরত নিতে এসেছি
মায়া একটু ভ্রু কুচকে তাকালো হিমালয়ের মা মায়াকে বিছানায় বসে হাতে হাত রেখে বলল,
—জানিস মায়া, এই পৃথিবী যদি আমাকে কিছু মাত্র দিয়ে থাকে তাহলে সেটা হিমালয়, আমার যখন বিয়ে হয় তখন সতের কি আঠারো বছর বয়স মামার বাড়িতে থাকতাম বাবা মা বেচে নেই বুঝিসই তো তাহলে আমার ছেলেবেলা কেমন সুখের ছিলো, যার সাথে বিয়ে হলো সেখানে স্বামী রুক্ষ মেজাজী ভোগপন্য শাশুড়ি কাছে আমি বিনি পয়সায় পাওয়া কাজের লোক, উনিশ বছরে যখন বুঝলাম আমার মধ্যে কারো অস্তিত্ব আছে সে শুধুই আমার তখন মনে হলো এবার বুঝি দুঃখ ঘুচলো, তবে পরিস্থিতি এমন ছিল যে আমার স্বামী জোর করে আমার সন্তান নষ্ট করালেন, ব্যাস দুঃখ আরো তীব্র হলো তারপরের ৭ বছরেও আর আমার সন্তান হলো না শ্বশুর বাড়ির জায়গা হারালাম,আমাদের এলাকায় কাজেম ভাই দের বাড়ি তিনি তার বিরাট বড়লোক বন্ধুর সাথে আমার জন্য সম্বন্ধ আনলেন বিপত্নীক, এক সন্তান আছে মাস ছয়েক বয়স,মানে বুঝিস তো তাদের একজন লিগ্যাল আয়া লাগবে,ছোট্ট বাচ্চাটাকে যেদিন আমার কোলে তুলে দেওয়া হয় সেদিন মনে হলো এই তো পেয়েছি সুখ আমায় স্বয়ং ধরা দিয়েছে, বেশ কিছু বছর আমার দ্বিতীয় স্বামীর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল না তিনি তার প্রথম স্ত্রীকে এতই ভালো বাসতেন যে শোক সামলে উঠতে উঠতে তার বছর লেগে যায় কিন্তু আমি সুখী ছিলাম স্বামী পাবার আগে আমি সন্তান পেয়েছিলাম আমার সন্তান হিমালয়! আমি ওর মা,
মায়ার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে, রেহেনা আহমেদ মায়ার হাত শক্ত করে ধরলেন,
—কাজেম ভাইয়ের কাছে আমার বিরাট বড় ঋণ মায়া, এই পৃথিবীতে এখন আমি আর হিমালয়ের বাবা বাদে তিনিই তৃতীয় ব্যাক্তি যে জানেন আমি হিমালয়ের সৎ মা, তোর সাথে হিমালয়ের বিয়ে হলে,কথা খুব কষ্ট পাবে তিনি হিমালয় কে জানিয়ে দেবেন মায়া, বাকি জীবন হিমালয়ের কাছে আমার সৎ মা পরিচয়ে বেচে থাকতে হবে,
হিমালয়ের মা মায়ার পা ধরে বসে পড়লেন
—মা তুই দয়া কর আমায়, এই বিয়েটা তুই করিস না আমি তোর কাছে আমার সন্তান চাচ্ছি মায়া আমার হিমালয়
মায়া কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে বসে রইলো ওর মাথার মধ্যে কিচ্ছু ঢুকলো না, মায়া জানে হিমালয়ের কাছে ওর মা কি! আর কতটা, মায়া এটাও জানে যে মায়ার কাছে হিমালয় কি! মায়া ভাবলো ওর সাথেই বারবার কেন এরকম হয় ওর কি দোষ! ওর কোথায় অন্যায় মায়া হিমালয়ের মায়ের সামনে মাটিতে বসে পড়লো, অনেকটা সাহস নিয়ে বলল,
—আপনি তো মহারাজ কে চেনেন আন্টি, উনি কখনোই আপনাকে….
—আমি জানি আমার হিমালয় কেমন কিন্তু মায়া আমি আমার স্বামীর কাছে দ্বিতীয় স্ত্রী হয়ে থাকতে পারলেও আমার সন্তানের কাছে কিভাবে দুই নম্বর হয়ে বেচে থাকব!
—আন্টি আমি মহারাজ কে ভালোবাসি
—কথাও হিমালয় কে খুব ভালোবাসে মায়া, সেই ছোটবেলা থেকে….কিন্তু হিমালয়…

মায়া তাজ্জব হয়ে বসে রইলো মনে হচ্ছে এক্ষুনি দুনিয়া অন্ধকার হয়ে ও পড়ে যাবে, অদ্ভুত! ও ঠিকই বসে রইলো মধ্যমা থেকে আংটিটা খুলে রেহেনা আহমেদেএ হাতে দিয়ে বলল,
—আপনার ছেলে একান্তই আপনার আন্টি আমি অতি নগন্য আমার কোনো ক্ষমতা নেই আপনাদের সংসার নষ্ট করার।আপনি কাজেম আংকেলকে বলবেন আন্টি, কথা আপুকে আমিও খুব ভালোবাসি, কথা আপু আমায় বড় বোনের মত ভালোবাসা দিয়েছে,আমি দুদিন এসে কোনো অধিকার রাখি না তার পৃথিবীটা নষ্ট করে দেওয়ার।

চলবে….
সামিয়া খান মায়া

#হঠাৎ_হাওয়া (১৯)

অসম্ভব এখানে থাকলে মায়া পাগল হয়ে যাবে! মায়া দুইহাতে নিজের মাথা ধরে মেঝেতে বসে পড়লো,চোখ বন্ধ করতেই হিমালয়ের সেদিনের কথাগুলো কানে বাজতে লাগলো

—তুমি বিয়ের জন্য না করে দিয়েছ মায়া?
—হ্যা
—কেন?
মায়া চুপ করে আছে, হিমালয় ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে,চিৎকার করে বলল
—চুপ থাকবে না আমি জিজ্ঞেস করছি কেন?

দরজার বাইরে থেকে ওসমান চাচা মায়ার বাবাকে বলছে,
—ভাইজান, ডাক্তার আব্বা মামনিরে রাগ করতেছে,মামনি তো অসুস্থ হইয়া যাবে।
মায়ার বাবা ভীষণ বিধ্বস্ত হয়ে বলল,
—তোমার মামনিকে আমি ঠিক বুঝি উঠি না ওসমান, কিছু বলতেও পারি না,তাই যে পারে তাকে বাধা দিচ্ছি না।

হিমালয় এবার ভেঙে পড়ল,মায়াকে এভাবে ও কখনোই নির্বিকার থাকতে দেখেনি,মায়ার কাছে একদম কাছে গিয়ে বলল
—এই মায়া, কি হয়েছে বলো প্লিজ কোথায় সমস্যা তুমি এমন করছ কেন?তুমি আমাকে বলো আমি সব ঠিক করে দেব,
—আপনি শুধু এটুকু করুন এখান থেকে চলে যান আর কক্ষনো আসবেন না,কানাডাতে যাচ্ছেন খুব পড়াশোনা করুন জীবনে খুব সফল হন।
হিমালয় মায়ার দুই বাহু ধরে মায়ার খুব কাছে গিয়ে বলল,
—আমি শুধু তোমাকে চাই মায়া শুধু তোমাকে
—আমি চাই না।
হিমালয় অসহায় ভাবে মায়ার দিকে তাকিয়ে মেঝেতে বসে মায়ার পা নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে বলল,
—আমায় তুমি নিঃস্ব করে দিও না মায়া,আমি পাগল হয়ে যাবো
মায়ার শরীর কেপে উঠলো নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে একটু দূরে গিয়ে বলল
—এটা তো হিমালয় আহমেদ নয়,আপনি তো এত ছেলেমানুষ নন,আপনি স্ট্রং আত্মবিশ্বাসী একজন সামান্য মেয়ে কি করে আপনাকে নিঃস্ব করার ক্ষমতা রাখে।
হিমালয় বেশ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইলো দুজনেই নিঃশ্চুপ,
—তুমি কি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ মায়া?
মায়া দাত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বলল
—হু
—পরিষ্কার করে বলো
—হ্যা
হিমালয়ের কপালের রগ স্পষ্ট হয়ে উঠলো নিজের স্বকীয় ফিরে পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মায়ার কাছে গিয়ে ওর কোমর পেচিয়ে ধরে বলল,
—ভেরি গুড ভাগ্যিস বিয়ের আগে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ,মনে আছে তোমায় আমি বলেছিলাম আমায় কোনোদিন চলে যেতে দিও না,বাট ইউ ফুল!ইউ ডিসাইড টু লিভ মি!ওকে দেন গুড বাই।

হিমালয় আর এক মুহূর্ত না দাড়িয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেলো আর কক্ষনো, কক্ষনো ও মায়ার সাথে যোগাযোগ করে নি একবারের জন্যেও না!

সাহিত্য ফিরে এসে দেখলো মায়া নিজের ঘরে হাউমাউ করে কাদছে ও দৌড়ে মায়ার কাছে গিয়ে বলল
—কি হয়েছে! মায়া! এই মায়া কাদছিস কেন তুই!
মায়ার কান্না থামার কোনো নাম নেই,এদিকে সাহিত্য অস্থির হয়ে উঠেছে,মায়ার কান্না ও একটুও সহ্য করতে পারে না রীতিমত পাগলামি শুরু করে দিয়েছে
—মায়া আমায় বল কি হয়েছে আমি, আমি সব ঠিক করে দেব মায়া এই মায়া,তুই প্লিজ কান্না থামা,
মায়া কি করে বোঝাবে আর কিচ্ছু ঠিক হওয়ার নেই কোনোদিন আর ফিরবেনা সে!এই ঘরে এই ঘরেই তার সাথে বিচ্ছেদ হয়েছিল মায়ার এখানে দাড়িয়েই মায়া দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল!
সাহিত্য নিজেকে কন্ট্রোল না করতে পেরে পাশে থাকা ফ্লাওয়ার বাস্ক টা ছুড়ে ফেলতেই মায়া চমকে উঠলো নিজেকে সামলে উঠে দাড়িয়েই চোখ মুছলো,অদ্ভুত ওর সাথেই এরকম হয় ওর শান্তি মত কান্না করার ও কোনো জায়গা নেই!এতটাই হতভাগ্য ওর!মায়া ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে সাহিত্যের মাথায় হাত রেখে বলল,
—শান্ত হ এই দেখ আমি কাদছি না!ওষুধ খেয়েছিস তুই!
সাহিত্য জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে মায়া সাহিত্যের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল,
—প্লিজ, আমাকে মেরে ফেলিস না শান্ত হ, ডাক্তার তোকে উত্তেজিত হতে না করেছে,এত দায় নিয়ে আমি বেচে থাকতে পারি না আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে, কেন বলতো আমার কোনো কঠিন অসুখ হয় না! আমি কি এতটাই খারাপ যে সৃষ্টিকর্তাও আমাকে চান না!
সাহিত্য করুন চোখে মায়ার দিকে তাকালো,
—কঠিন অসুখ করলে কি হয় জানিস মায়া? এই যেমন ধর তোর ব্রেনে টিউমার হলো তুই পৃথিবীর কোথাও গিয়ে অপারেশন করতে পারবি না,এভাবেই থাকতে হবে যখন তুই জানতে পারবি একসময় এই টিউমার টা ব্লাস্ট করে তুই মারা যাবি তখন সব কিছু সুন্দর লাগে, তোর আশেপাশের সবচেয়ে নিষ্ঠুর মানুষটাকেও জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে, আরো কিছুদিন বেচে থাকতে ইচ্ছে করে প্রিয় মানুষটার খুব কাছে গিয়ে একটু নিঃশ্বাস নিতে ইচ্ছে করে…. আফসোস!

এবার মায়াও কেদে ফেললো সাহিত্যের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে তার মধ্যেই ও একটু বাকা করে হাসলো,
—আমায় করুণা করিয়া না প্লিজ মায়া, আমি সহ্য করতে পারি না, আজকাল সবাই আমাকে করুণার চোখে দেখে এই যে আমি মাকে এত কঠিন কঠিন কথা বলি মা প্রতিবাদ করতে গিয়েও থেমে যায় আমি দেরি করে বাড়ি ফিরলে কেউ কিছু বলে না আমার বন্ধুরা আমায় পচায় না, এরা সবাই আমাকে পদে পদে বুঝিয়ে দেয় আমি আর বেশিদিন থাকবোনা, বিশ্বাস কর মরে যাওয়ার থেকেও এই কষ্ট বেশি, একমাত্র তুই ছিলি যে আমাকে স্বাভাবিক ভাবে নিতি,আমি তোকে ভালোবাসি বললেই তুই প্রতিবাদ করতি তুই আমায় অপমান করতি, তবে আজকাল তুইও….

মায়া অসহায়ের মত তাকিয়ে রইলো সাহিত্যের দিকে,তারপর মাথা নিচু করে বলল,
—কেন বল তো!আমার কাছের মানুষ গুলো দূরে চলে যায়! আমাকে কি বিধাতা একা করেই পাঠিয়েছেন! বিশ্বাস কর একা থাকার মত বড় অভিশাপ আর কিচ্ছু নেই!
—আমি তোর কাছের মানুষ মায়া….
মায়া মৃদু হেসে বলল,
—বিকেলে তোর এপোয়েন্টমেন্ট আছে না?
সাহিত্য ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—হু
—আমি যাবো তোর সাথে
—না!
—কেন!
—তুই ডাক্তারদের কাছে খুব ফেমাস তুই গেলেই সবাই তোর সাথে গল্প করতে বসে যায় এমন ভাব আসমান থেকে ডাক্তারদের দেবী মাটিতে পা রাখছে! অসহ্য খুব অসহ্য!
মায়া মুখ বিকৃত করে বললো
—ওহ! ইউ আর গেটিং জেলাস!
—তুই একটা ভাঙ্গা গেলাস, হেহ তোরে দেইখা আমি জেলাস হবো?তোর আছে টা কি?গান গাইতে গেলে কাউয়ার মত কাউ কাউ করস রান্নাও তো শিখস নাই রান্না করতে গেলে বাড়ি ঘরে আগুন ধরায় দিস এলাকার মানুষরে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা লাগে, আর যাও একটু চেহারা তাও দিন দিন যাইতেছে, পারিস ওই একটু পড়ালেখা ওই ধুয়ে কি পানি খাবি? হেহ!
মায়া আহত হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
—তোর মত বেয়াদব আমি আর একটাও দেখি নাই
—তার জন্য চোখ থাকা লাগে
মায়া বিরক্ত হয়ে উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল,
—ভাবছিলাম দুপুরে তোর প্রিয় গরুর কালাভুনা দিয়ে তোকে ভাত খেয়ে যেতে বলব,বাট সরি টু সে তুই এখন বাড়ি যেতে পারিস আমি বিকালে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সময় তোর বাসা থেকে তোকে পিক করে নেব।
—কিইহ! কালাভুনা!
—গেট আউট
—ইয়ে মানে মায়া শোন তুই খুব ভালো চা বানাস
—আমি কিছু শুনতিছি না
—আর তুই ভালো কবিতাও লিখিস মাঝে মাঝে
—গোসলে যেতে হবে বাই…
—মায়া শোন একজন মৃত্যু পথযাত্রীর মুখের সামনে থেকে কালাভুনা কেড়ে নিয়ে তুই খেতে পারবি তোর পেট খারাপ হবে না!?
মায়া থমকে দাড়ালো, প্রচন্ড বিরক্তি আর হতাশা নিয়ে বলল,
—আর কতভাবে বলতো আমায় কষ্ট দিবি?
—মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সর্বভাবে, তাও আমার কষ্টের কাছে তোর কষ্ট কিছুই না আমার আক্ষেপ আমৃত্যু দেবী অপ্রাপ্তির।

চলবে….
সামিয়া খান মায়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here