#হঠাৎ_হাওয়া,০২,০৩
(২)
পুরো ট্রেনে শুনশান নিরবতা সবাই টুকটাক ঘুমিয়ে পড়েছে,মায়া দ্বিতীয়বার খুব বড় একটা দীর্ঘশ্বাস নিতেই হিমালয় বলল,
—এত্ত বড় দীর্ঘশ্বাস নেওয়ার মত কিছুই হয় নি ওঠার পর থেকেই দেখছি বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছ কারণ টা কি?
মায়া চমকে উঠলো, বেশ ভয় পেয়েছে ও আশা করেনি কেউ জেগে আছে মায়ার বুকের মধ্যে খুব ধুক ধুক করছে,
—আরে কি সমস্যা ভয় পেয়েছ নাকি?
—আপনি ঘুমান নি?
মেয়েটার কণ্ঠটা ভয়ংকর রকমের সুন্দর এই মেয়েটার কথায় এক অদ্ভুত মায়া আছে, কেমন তীক্ষ্ণ এক ধার আছে, একজন মেয়ের কণ্ঠ এত সুন্দর হতে পারে হিমালয় তা কখনো ভাবে নি মেয়েটার গানের গলা নিশ্চয়ই সুন্দর।
—হ্যা ঘুমিয়েছি তো আমার ঘুমের ঘোরে কথা বলার অভ্যেস আছে সেই অভ্যেস থেকে তোমার সাথে কথা বলছি।
মায়া একটু দমে গেলো নিজের বোকামির ওপর নিজেই হেসে ফেলল।কিন্তু ও হুট করে ভয় পেয়ে গেছে এখনো কেমন গা কাপছে ওর এই এক বদ অভ্যেস অল্পতেই ভয় পেয়ে যায়।মায়া একটু আমতা আমতা করে বলল
—ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমি একটু আপনাকে ছুতে পারি?
হালকা একটা আলো আছে ঠিক গাঢ় জোৎস্না নয় কেমন যেন একটা ম্লান আলো সেখানে শুধু অবয়ব বোঝা যাচ্ছে মায়া বুঝলো,হিমালয় ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে,
—চাইলে হ্যান্ডশেক করতে পারো কিন্তু প্লিজ ছুয়ে দিলে ভয় চলে যাবে এরকম কথা ভেবে ছোয়ার দরকার নেই।
মায়া একটু ইতস্তত করে হাতটা বাড়িয়ে বলল,
—মানুষের কিছু কিছু বিশ্বাস থাকে যা থেকে সে বেড়িয়ে আসতে পারে না কখনোই পারে না আমি সেরকম একটা স্টুপিড গার্ল বলতে পারেন।
মায়া হিমালয়ের হাত ছুয়েই কেপে উঠলো কেন কে জানে!শুধু মায়া না হিমালয় ও কেপে উঠলো,
হিমালয় কণ্ঠে যথেষ্ট চিন্তা নিয়ে বলল,
—কি ব্যাপার তোমার হাত এত্ত ঠান্ডা কেন!এত ঠান্ডা মানুষের হাত কি করে হয়?!
—চিন্তা করার কিছু নেই আসলে ভয় পেলে বা টেনশন করলে আমার হাত পা খুব ঠান্ডা হয়ে যায়, আমার বমি পায় আমি খেতে পারি না খুব বেশি হলে সেন্সলেস হয়ে যাই, এগুলো নর্মাল এখন অভ্যেস হয়ে গেছে।
বলেই মায়া একটু নিঃশ্বাস ফেলল,
—আবার?
এবার মায়া হেসে ফেলল
—হাসছ কেন?
—আসলে মানুষের যখন অনেক চিন্তা হয় তখন মানুষের মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব হয় সেই অভাব টা পূরণ করতে মানুষ জোরে শ্বাস নেয় আর বিনিময়ে খুব বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে একে আমরা দীর্ঘশ্বাস বলি
—এটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা?
—কি জানি জানিনা, আমি একটা ব্যাখ্যা দাড় করালাম।
—তুমি আর দীর্ঘশ্বাস ফেলবে না
—আরে মুশকিল তো আপনি তো এই নিয়ে খুব জ্বালাতন করছেন,একদম বাবার মতো ডিস্টার্ব করছেন।
বাবার মত কথাটা বলেই মায়া থেমে গেলো ও খুব ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো,আস্তে আস্তে মায়ার মন ভারী হয়ে আসছে ও সবটা গুলিয়ে ফেলছে এমনটা ও নাও করলে হতো বাবার সাথে কথা বললেও হতো বাবা সবটা বুঝতো, তাড়াহুড়ো করে ও এটা কি করল?মায়া আস্তে উঠে দাড়ালো এবং দৌড়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো,হিমালয় কিছু বুঝে উঠল না মেয়েটার কি হলো ও উঠে মেয়েটার পিছু নিলো।হিমালয় দেখলো মায়া ট্রেনের দরজা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে এই মেয়েটা কি লাফিয়ে নামার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে নাকি! হিমালয় মায়ার বাহু ধরে টেনে বলল
—পাগল নাকি কি করছ?!
—আমি নামব
—এখান থেকে নামতে চাইলে সোজা উপরে চলে যাবে
—উপরে মানে!
হিমালয় একটু বিরক্ত হলো মেয়েটা নিতান্তই ঘোরের মধ্যে বাড়ি ছেড়েছে একে এখন কি বোঝাবে,এ একেবারেই ছেলেমানুষ ধরণের মেয়ে
হিমালয় দরজার সাথে হ্যালান দিয়ে আড়িয়ে এক হাত দিয়ে দরজা আটকে মায়ার দিকে তাকালো তারপর বলল,
—তোমার যে ভাইয়ার সাথে বিয়ে ঠিক হলো তার সাথে যোগাযোগ করেছো? সে তোমার থাকার কোনো ব্যাবস্থা করে নি?
—তনয় ভাইয়া তো ফোন রিসিভ করছে না মনে হয় ব্যাস্ত,বাড়িতে কি একটা অবস্থা ভাবা যাচ্ছে!
হিমালয় মাথা নিচু করে ফেললো মেয়েটার কণ্ঠে অদ্ভুত ঘোর আছে…হিমালয় আস্তে জিজ্ঞেস করলো,
—বাসায় যেতে চাও নাকি?ব্যাবস্থা করব?
মায়া কিছুক্ষণ এদিকওদিক তাকাতাকি করলো তারপর বলল,
—না যেতে চাই না।
হিমালয় অবাক হয়ে বললো
—একটু আগেই না ট্রেন থেকে লাফিয়ে বাড়ি যেতে চাচ্ছিলে
—ভুল করছিলাম, মানুষ একবার যখন ভুল করে তারপর ভুল করতেই থাকে।
বলেই মায়া আবার একটা নিঃশ্বাস ফেললো তারপর হেসে ফেললো,হিমালয় অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো মেয়েটা অদ্ভুত মুহুর্তেই হাসছে মন খারাপ করছে কথা বলছে চুপ থাকছে!মায়া আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
—চলুন ভেতরে যাই নয়তো সবাই ভাববে আমি আবার আপনাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছি
হিমালয় হালকা হেসে বলল,
—সবাই জানে,হিমালয় আহমেদ কে কিডন্যাপ করা ওতো সহজ না আর তোমার মত একটা খুকি পক্ষে তো না ইই।
—আমি খুকি!
—অবশ্যই, একটু পরেই ভোর হবে তুমি ভেতরে গেলে যাও আমি যাচ্ছি না
—আমি আগে এসেছি আমি এখানেই থাকবো
হিমালয় বিড়বিড় করে বলল,
—আচ্ছা মুসিবত তো
—কিই বললেন?
—বললাম আমার পুশিক্যাট এর কথা খুব মনে পড়ছে
মায়া চুপ করে গেলো ওর মনটা খারাপ হয়ে গেলো মনে মনে ভাবছে কি হবার ছিলো আর কি হয়ে গেলো, মায়া আনমনে হিমালয়ের সামনে ট্রেনের দেয়ালে হ্যালান দরজা দিয়ে বাইরে তাকালো, আস্তে আস্তে অন্ধকার কেটে বাইরে ফর্সা হচ্ছে মায়া বাইরে তাকিয়ে আছে ওর চোখ ছলছল করছে, হিমালয় অবাক হয়ে মেয়েটিকে দেখছে, মেয়েটিকে সকালের প্রথম আলোয় কি চমৎকার লাগছে!
স্টেশন থেকে নেমে ওরা সবাই হালকা ফ্রেশ হয়ে একটা চায়ের দোকানে বসলো, সাজ ধুয়ে ফেলার পর মায়াকে অনেক স্নিগ্ধ লাগছে, নিরব বরাবর চুপ থাকলেও বলে উঠলো
—সাজ তুলে ফেললে যে একটা মেয়েকে এতটা চমৎকার লাগতে পারে আমি কখনো ভাবিনি!
মায়া লজ্জা পেয়ে একটু মাথা নিচু করে ফেললো
নিরবের বন্ধুরা সবাই যতটা না মায়াকে দেখে মুগ্ধ হলো তারচেয়ে বেশি নিরবের প্রশংসা শুনে অবাক হলো, নিরব পারতপক্ষে কথাই বলে না! সবাই নিরবের দিকে চেয়ে আছে দেখে নিরব বলল,
—এত অবাক হওয়ার কি আছে! তোমরা এমন ভাব করছ আমি বোবা আর হঠাৎ করেই আজ কথা বলছি,
পুষ্প আড় চোখে নিরবের দিকে তাকিয়ে মুখ ফুলিয়ে রইলো।
মায়া এতক্ষণ চায়ের কাপটা হাতের মধ্যে নিয়ে বসে ছিল, মুখে দিতেই পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো ও চা টা রেখে দিলো, মনে পড়লো কাল সারাদিন ও কিছুই খায় নি।ধ্রুব খেয়াল করে বলল,
—তুমি কি সারাদিন কিছু খেয়েছিলে?
মায়া ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে দেখলো দেখতে আধুনিক হলেও ছেলেটার বাচনভঙ্গিতে কোনো ভান নেই মায়া একে একে সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো, ওদের মধ্যে নিরব একমাত্র সম্পূর্ণ ফরমাল ড্রেসে, আবির মুডি ধরণের, কথার একটা সুন্দর ব্যাক্তিত্ব আছে সব দারুণ ম্যানেজ করতে পারে, পুষ্প খুব দুরন্ত বয়সের সাথে ছেলেমানুষি যায় নি আর হিমালয় একে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কখনো নরম তো কখনো ভাব নিচ্ছে, ধ্রুব মায়ার জবাবের আশা ছেড়ে দিয়ে বললো
—আমাদের সবাইকে পর্যবেক্ষণ শেষে কি সিদ্ধান্ত নিলে?
মায়া চমকে উঠলো, সবাই মায়ার দিকে তাকিয়ে ধ্রুব আবার বলল,
—তুমি মেয়েটা যে এতটা শাখা না তা বোঝাই যাচ্ছে,এর আগে সিলেট এসেছো?
মায়া এবার জোর দিয়ে বলল,
—হ্যা!
—বেশ আমাদের দেখে কি মনে হলো আমাদের সাথে যাওয়া যায়?
মায়া একগাল হেসে বলল,
—খুব যায়
মায়া লাফিয়ে উঠে বলল,
—গেট রেডি ফর এন এমেইজিং ট্রিপ,
সামনে এগোতেই মায়া শাড়ির সাথে পেচিয়ে হোচট খেয়ে নিজেকে সামলে নিলো,ওমনি সবাই হেসে ফেললো।
চলবে….
সামিয়া খান মায়া
#হঠাৎ_হাওয়া (৩)
শুকতারা রিসোর্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মায়া দেখছে ভোরের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে সব আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে মায়া ভেজা চুলগুলো মুছতে মুছতেই ওর চোখ ভিজে উঠলো, মায়া চোখ মুছে নিজেকে শক্ত করলো তারপর রিসোর্টের মধ্যেই হাটাহাটি করতে লাগলো বনাক কোর্টের উপর দাঁড়িয়ে মায়ার মনটা ভালো হয়ে গেলো চারিদিকে সবুজের হাতছানি, দূরে সুরমা নদী, মেঘালয় রেঞ্জ! মায়ার মনটা দারুণ ফুরফুরে হয়ে গেলো,আনমনে মায়ার চোখে মুখে আনন্দ ফুটে উঠলো, মায়া প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ভাবলো এই রিসোর্টের পাশেই তো হযরত শাহপরাণের মাজার ও কি একবার ঘুরে আসবে নাকি রিসোর্টের সামনের টিলাটায় একবার যাবে, মায়া আনমনেই রিসোর্টে চক্কর লাগাতে লাগলো ও নিচে নামতে নামতে খেয়াল করলো পাশের রেস্টুরেন্টে সম্ভবত কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে দেখে তো বিয়ে মনে হচ্ছে, মায়া দেখলো একজন বয়স্ক লোক চোখমুখ শক্ত করে দাড়িয়ে আছে সম্ভবত কোনো অসুবিধা হয়েছে মায়া একটু এগিয়ে গিয়ে লোকটার কাছে দাড়ালো, মায়া একটু গলা খাকারি দিয়ে বলল,
—আঙ্কেল কোনো সমস্যা?
লোকটা চোখমুখ কুচকে মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল
—না বলেই ভেতরে দিকে ঢুকতে লাগলো
মায়ার মাথায় দুষ্টুমি চেপে বসলো মায়া লোকটাকে অনুসরণ করে ভেতরে গিয়ে বললো
—আঙ্কেল এখানে কি কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে,?
লোকটা বেশ বিরক্ত হলো মায়ার কথার জবাব দিলো না,ভেতর থেকে একজন মহিলা বের হয়ে কাদো কাদো স্বরে লোকটিকে বলল,
—মিষ্টি তো রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়েছে খুলছে না
তারা দুজনেই খুবই আপসেট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মায়া এবার ওনাদের কাছে গিয়ে একটু কড়া সুরে বলল,
—কি সমস্যা? বলছেন না কেন? আপনারা কি জোর করে মেয়ের বিয়ে দিতে চাচ্ছেন না কি?
এবার মহিলাটি বলল,
—না মা আসলে আজ আমাদের মেয়ে মিষ্টির গায়ে হলুদ ও ওর ভাইয়া কে খুব ভালোবাসে ওর ভাইয়ার ইচ্ছে ছিল বিয়ে ঢাকাতেই হবে কিন্তু ছেলেপক্ষ চায় বিয়ে সিলেটেই হবে দিহানের বাবা তো আমাদের জোর করে নিয়ে এসেছেন কিন্তু দিহান আসে নি আর মিষ্টি এখন জেদ করে আছে ভাইয়া না এলে ও কিছুতেই ঘর খুলবে না।
মায়া ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—আপনি কি একটু আমায় মিষ্টির ঘরের সামনে নিয়ে যাবেন?
লোকটি এবার চোখ কুচকে বলল
—তুমি সেখানে গিয়ে কি করবে
মায়া ভ্রু কুচকে মিষ্টির বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
—কিছুই তো বোঝেন না দেখছি যা আপনি করেন নি তাই করবো।
মিষ্টির মা মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
—এই লোকটা সবসময় এরকম করে তুমি এসো আম্মু আমার সাথে,
মায়া মিষ্টির রুমের দরজার সামনে এসে দাড়ালো একটু নক করতেই ভেতর থেকে কেউ বলল,
—প্লিজ মা বিরক্ত করবে না আমার কথার কোনো নড়চড় হবে না
মায়া নরম কণ্ঠে বলল,
—মিষ্টি আমি মায়া, তোমার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন দরজা টা খোলো
মিষ্টির মা অবাক হয়ে মায়ার দিকে তাকালো ওপাশ থেকে মিষ্টি তড়িঘড়ি করে দরজা খুললো ভীত চোখে বলল,
—কোথায় বাবা কোথায়?!
মায়া ভেতরে গিয়ে মিষ্টিকে নিয়ে দরজা লাগিয়ে বলল,
—প্রশ্ন পরে করবে তোমার বাবা একদম পারফেক্ট আছে, দরজা খুলছিলে না তাই একথা বলেছি।
মিষ্টি ভ্রু কুচকে মায়ার দিকে তাকালো,মায়া সে নজর উপেক্ষা করে বলল,
—তোমার ভাইয়াকে কল লাগাও দেন স্পিকার অন করো
—ভাইয়া ফোন রিসিভ করবে না
—আচ্ছা বেশ নম্বর দাও
মিষ্টি তেমন কিছু না বলে নম্বর টা দিলো মায়া ওর ফোন থেকে কল করতে দুবার রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ হলো,ওপাশ থেকে কেউ একজন বলল
—হ্যালো কে?
—আমি মায়া
—কে মায়া
—সেটা আপনি চিনবেন না
—আপনার বোন দরজা আটকে বসে আছে ভেতরে কোনো সাড়াশব্দ নেই হয়তো কোনো দূর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে,
—হোয়াট!
মিষ্টি চোখ বড়বড় করে মায়ার দিকে তাকিয়ে আছে।মায়া একটু চুপ থেকে বলল,
—আপনি কি আসতে পারবেন?
—আমি আমি এক্ষুনি আসছি! মিষ্টি!
—দুঃখিত এরকম কিছুই হয় নি, মিষ্টি একদম ঠিক আছে
—কিইইহ! আপনি কে! আমার সাথে মশকরা করছেন?হাও ডেয়ার ইউ
—এরকম বাজে মশকরা করার জন্য আমি খুবই দুঃখিত তবে একটু ভেবে দেখুন এরকম হওয়াটা কি খুব অস্বাভাবিক? আপনি অহেতুক জেদ ধরে ঢাকায় বসে আছেন কাল আপনার ছোট বোনের বিয়ে,আপনি তো জানেন সে আপনাকে কত ভালোবাসে আজ যদি মিষ্টি এরকম কিছু করে তাহলে কি সেটা খুব অস্বাভাবিক হবে?
অপরপাশে নিরবতা…. মায়া একটু থেমে বললো
—আপনি মিষ্টির বড় ভাইয়া কাল মিষ্টির জীবনের বিশেষ দিন আপনি নিজের জেদের জন্য আপনার বোনের এতবড় একটা দিনে তার পাশে থাকবেন না? মিষ্টির শ্বশুর বাড়ির সবাই তো এ নিয়ে সারাজীবন মিষ্টিকে কথা শোনাতে পারে সবার চোখে মিষ্টি ছোট হয়ে যাবে, বাবার উপর রাগ করে আপনি আপনার বোনের অসম্মান করবেন?
ওপাশে কোনো কথা নেই।মায়া ছোটো করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল
—আপনি কি শুনছেন?
—শুনছি
মায়া ফোনটা মিষ্টি কে দিয়ে বললো একবার তোমার ভাইয়া কে ডাকো দেখো সে তোমার ডাক অগ্রাহ্য করবে না মিষ্টি মায়ার থেকে ফোন টা নিয়ে কান্নামাখা কণ্ঠে বলল,
—তুই আসবি না ভাইয়া?
—আমি আসছি ৪ ঘন্টার মধ্যে আমি তোর সামনে থাকবো।
মিষ্টি আর মায়া দুজনেই একটু হাসলো।
কথা আর হিমালয় কর্টেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে কথা হিমালয়ের পাশে ঘেষে বলল,
—তোর কি মন খারাপ?
হিমালয় দৃষ্টি পাহাড়ের দিকে রেখে বলল,
—তুই আমাকে এত বুঝিস কি করে?
কথা একটু হেসে বললো
—সেটা তুইও জানিস
হিমালয় কথাকে একটু পেছনে রেখে সামনে এগিয়ে বলল,
—ওই মেয়েটাকে তো অনেক্ষণ দেখছি না
—মায়া
—হুম
ধ্রুব ওদের কাছে আসতে আসতে বলল,
—আমিও অনেক্ষণ মায়াকে দেখিনি কোথায় গেলো বলতো!
তখনই আবির এসে বললো
—তোরা যে কেন এত ঝামেলার জড়াস আমি বুঝি না যে মেয়ে বাড়ি থেকে পালায় সে সব জায়গা থেকেই পালাতে পারে,
নিরব আস্তে বলল,
—তুমি তো জানো আবির মেয়েটা কেন পালিয়েছে
আবির ঝাঝালো কণ্ঠে বলল,
—কারণ মেয়েটা একটা স্টুপিড, ও ওর কথাগুলো ওর বাবাকে বললেই পারতো গাধা একটা ও জানে আজকাল রাস্তায় কত বিপদ! সবাই তো তোদের মত ভালো না
কথা পশ্রয়ের সুরে বলল,
—মেয়েটা নিতান্তই ছোট মানুষ
মায়া ওদের পেছনে এসে হালকা কেশে বলল,
—অনেক হয়েছে মায়া নিয়ে আলোচনা, আপনারা কি আজ কোথাও যাবেন নাকি এখানেই থাকবেন আমি কিন্তু বেড়াতে এসে বসে থাকতে পারবো না।
হিমালয় মায়ার দিকে তাকিয়ে দেখলো কাল রাতের মতো পরিণত লাগছে না আজকে মেয়েটাকে সদ্য কিশোরীর মত লাগছে তবে চমৎকার! হিমালয় চোখ ফিরিয়ে নিলো, ধ্রুব মায়ার কাছে গিয়ে বলল,
—তা আপনি গিয়েছিলেন কোথায় মিস চুমকি
মায়া নিজের জামার গলাটায় হাত দিয়ে বলল,
—ইশ কলার নেই
তাও একটু ভাব নিয়ে বলল,
—সমস্যা সমাধান করতে,
বলেই নিজের চুল গুলো সামনে থেকে পেছনে ছুড়ে মারলো,আবির চোখমুখ শক্ত করে বিড়বিড় করে বলল,
—নিজেই তো আস্ত এক সমস্যা
মায়া চোখ সরু করে মাজায় হাত রেখে বলল,
—এই যে আবির ভাই আমি কিন্তু রেগে যাবো এভাবে বিধিয়ে কথা বললে হুম।
আবির চোখ বড় বড় করে বলল
—ভয় দেখাচ্ছো পিচ্চি মেয়ে?
মায়া আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
—আমি কি ডাইনী বুড়ি যে ভয় দেখাবো?
ওমনি অন্য সবাই হেসে ফেললো, পুষ্প মুখ গোমড়া করে দাড়িয়ে রইলো দূরে ধ্রুব এগিয়ে এসে বলল,
—ওয়েট ওয়েট তুমি আবিরকে ভাইয়া বললে!
—হ্যা তো!
—প্লিজ আমি সুন্দরী মেয়েদের মুখে ভাইয়া ডাক সহ্য করতে পারি না আমার পেট খারাপ হয়ে যায়
মায়া মাথা চুলকে বলল,
—তবে দুটো এমোডিস খেয়ে নেবেন!
—না তুমি অবশ্যই আমাকে ভাইয়া বলবে না, আমাকে তুমি নাম ধরেই ডাকবে
—তাতে কিন্তু খুব লাভ হবে না,
—সে পরে দেখা যাবে
—আচ্ছা, তাহলে আমি কাকে কি ডাকবো?আমি কিন্তু নিরব ভাইয়া কে ভাইয়াই ডাকবো
নিরব একগাল হেসে বলল
—অবশ্যই
পুষ্প মনে হয় খুশি হলো এবার ও এগিয়ে এসে নিরবের পাশে দাড়ালো।
মায়া এবার হিমালয়ের কাছে গিয়ে বলল,
—আর আপনাকে কি ডাকবো মহারাজ?
ধ্রুব পেছন থেকে বলল,
—ওর এটিটিউড রাজকুমারের মতোই তুমি ওকে মহারাজ রাজকুমার একটা ডাকলেই হলো।
মায়া বলল,
—আপনারা কি আজ সত্যি কোথাও বের হবেন না!
হিমালয় মায়ার দিকে তাকিয়ে বললো সবাই রেডি হও আজ খাদিমনগড় ঘুরে আসি, হিমালয়ের বলতে দেরি আছে মায়ার দৌড় লাগাতে দেরি নেই।ওরা জীপে খাদিমনগর জাতীয়উদ্যানে এলো মায়া, জীপ থেকে নামতে গিয়ে একবার জামায় বেধে হোচট খেয়েছে,হিমালয় বাহু না ধরে ফেললে নিশ্চিত আছাড় খেয়ে মানসম্মান যেতো, মায়া আকাবাকা রাস্তা পার হয়ে চা বাগান ঘুরে ঘুরে দেখছে ধ্রুব ওর ক্যামেরা নিয়ে প্রকৃতির ছবি তুলছে ফাকে ফাকে মায়ার ছেলে মানুষিরও, পুষ্প নিরবের পাশে হাটতে হাটতে বলল,
—নিরব তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে
নিরব বরাবরের মত চুপ রইলো, পুষ্প নিরবের হাত ধরে ওকে থামিয়ে বলল
—আমার কথা শোনো
—বলো,শুনছি তো
—তুমি সামনে কি করবে ভেবেছো
—হ্যা এই ট্রিপটার পর পুরোপুরি ক্যারিয়ার নিয়ে পড়বো আগামী দুবছর আমি নিজেকে সময় দেবো
—তারপর?
—তারপর মানে?
—প্লিজ নিরব আমার ধৈর্যের আর পরীক্ষা নিও না তুমি কি বুঝতে পারো না আমাকে?
নিরব এবার সরাসরি পুষ্পের দিকে তাকিয়ে বললো
—পুষ্প কিছু জিনিস বুঝেও না বুঝে না জেনে থাকতে হয়,
—আমি তোমাকে ভালোবাসি
নিরব এবার চোখ সরিয়ে সারি সারি বাগান পেরিয়ে দিগন্তে চোখ রাখলো।
—চোখ ফিরিয়ে নিও না
নিরব পুষ্পের দিকে না তাকিয়েই বললো
—ছোটবেলা থেকে আমি বৃত্তি উপবৃত্তির টাকা দিয়ে পড়ালেখা করেছি পুষ্প, ডাক্তারির কোচিং করার জন্য আমার মা তার একমাত্র সোনার চুড়ি জোরা বিক্রি করে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলো,
আমি তোমার মত সোনার চামচ মুখে,প্রাচুর্য আর প্রাপ্তির মধ্যে বড় হই নি পুষ্প, আমি যতদূর জানি তোমার বাবা বংশ, গৌরব এসব খুব মানেন,তোমার বাবার সাথে পাল্লা দেওয়ার মতো কোনো যোগ্যতাই আমার নেই।আমি মানছি হয়তো একসময় আমার অবস্থার পরিবর্তন হব্র কিন্তু তোমার বাবার কাছে আমি দিনমজুর পুত্রই থেকে যাবো।আর এটাও তোমার সামান্য মোহ একসময় কেটে যাবে।
অনেকগুলো কথা বলে ফেলেছে নিরব ও পুষ্পকে পেছনে রেখে সামনে এগিয়ে গেলো, মায়া পুষ্প আর নিরবকে খেয়াল করলো পুষ্প মুখ গোমড়া করে রইলো।হিমালয় এসে মায়ার কাছে দাঁড়িয়ে বললো
—ধ্যানে বসেছো নাকি?
মায়া বেখেয়ালে বলল,
—পুষ্প আপু নিরব ভাইয়া কে খুব ভালোবাসে না?
হিমালয় একটু চমকালো
—তুমি কি করে বুঝলে?
—নিরব ভাইয়াও পুষ্প আপুকে ভালোবাসে কিন্তু….
—কিন্তু কি?
মায়া হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে খুব উৎসাহে বললো
—আপনার মনে হয় না এদের একসাথে থাকা উচিত! বন্ধুর চেয়ে ভালো কি আর কোনো জীবনসঙ্গী হতে পারে?
হিমালয় ধীরে বললো
—জীবনসঙ্গী হওয়া এত সহজ না, ভালো বন্ধু যে জীবনসঙ্গী হিসেবে ভালো হবে এরকম না,
—কিন্তু এদের ক্ষেত্রে তো তাই
—সেটা এরাই ভালো বুঝবে
বলেই হিমালয় হাটা ধরলে মায়া হিমালয় কে ডাকে
—মহারাজ!
হিমালয় দাড়িয়ে যায় মায়া মাথা নিচু করে হিমালয়ের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে বলল,
—দুজন ভালোবাসার মানুষ এক আকাশের নিচে আলাদা আলাদা বেচে তো থাকে ভালো থাকে না, আপনি কি চান আপনার বন্ধুরা কষ্টে থাকুক?
বলেই মায়া দৌড়ে সেখান থেকে চলে এলো,
চা বাগান ঘুরে ওরা রেইনফরেস্ট, রাতারগুল ঘোরাঘুরি শেষ করে রিসোর্টে ফিরলো সন্ধ্যা নাগাদ মায়া এতক্ষণ বকবক করে মাথা খেয়ে ফেলেছে, পুষ্প একদম চুপচাপ। নিরব হিমালয় খেয়াল করলেও কিছু বললো না।সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর মায়া ওর কর্টেজের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো হিমালয়ের রুমের জানালা দিয়ে মায়াক্র দেখা যাচ্ছে, মায়া কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর অল্প পরিচিত কণ্ঠস্বরে পেছনে ফিরলো,মিষ্টি।হিমালয় দেখলো একটা মেয়ে সম্ভবত আজ মেয়েটার গায়ে হলুদ আর ওর পাশের একটা ছেলে মায়ার সাথে কথা বলছে,দিহান এগিয়ে মায়ার কাছে গিয়ে দাড়িয়ে বলল,
—তুমিই মায়া?
মায়া ছেলেটার দিকে এক নজর তাকিয়ে বললো
—আপনি মিষ্টির ভাইয়া?
দিহান হেসে মাথা নেড়ে বলল,
—হ্যা
হিমালয় বাইরে বেরিয়ে এলো…
চলবে….
সামিয়া খান মায়া