হঠাৎ হাওয়া,পর্বঃ১৩,১৪

হঠাৎ হাওয়া,পর্বঃ১৩,১৪
সুমনা ইসলাম
পর্বঃ১৩

সিয়াম হাতে থাকা সিগারেটের শেষ অংশটুকু মেঝেতে ফেলে একহাতে নিধির কোমর জড়িয়ে ধরলো শক্ত হাতে। যে স্পর্শ ভালোবাসার প্রকাশ পাচ্ছে না বরং প্রকাশ পাচ্ছে হিংস্রতা।

সিয়াম চোয়াল শক্ত করে বললো, “তোর জীবন নষ্ট করেছি আমি? তুই-ই বুঝিস না তোকে কত্ত ভালোবাসি আমি।”

নিধি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো, “ভালোবাসো না তুমি আমায়। কখনো ভালোবাসোই নি। আমাকে ভালোবাসলে এখন তুমি নিরুকে কেন পেতে চাইছো?”

“শুরু থেকেই ওকে পেতে চাইতাম আমি। পছন্দ করতাম ওকে। কিন্তু তুই মাঝখান থেকে এসে পড়লি। তাই ভাবলাম একসাথে না-হয় দুই বান্ধবীকেই পাওয়া যাবে। একটা বিয়ে করে আরেকটা বিয়ে ছাড়া।” বলেই বিশ্রি ভাবে হাসলো সিয়াম।

নিধির গা জ্বলে যাচ্ছে ওর হাসি দেখে। রাগে গজগজ করতে করতে বললো, “ডিভোর্স দেব আমি তোমাকে। থাকবো না আমি তোমার সাথে।”

“আমার সাথে না থেকে আর কোথায় যাবি? এই বাড়িতে? পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে আবার যদি ডিভোর্স নিয়ে এবাড়িতেই ফিরে আসতে হয় তাহলে তোর বাবা-মায়ের মান-সম্মান কিছু থাকবে? ভালোভাবে থাকতে পারবি এই সমাজে?”

নিধি এবার দমে গেল। আর কী বলবে সে? বলার মতো আর কী-বা আছে তার? বাবা-মায়ের কথা ভেবেই তো এতদিন এই জানোয়ারটার সাথে ছিল। কম অত্যাচার তো সহ্য করতে হয়নি থাকে। মানসিক শারীরিক সবদিক দিয়েই অত্যাচারিত হতে হয়েছে থাকে। সবার চিন্তা বাদ দিয়ে তো একবার পালিয়েই আসতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি। সিয়াম ধরে ফেলেছিল। এমনভাবে মেরেছিল যে কয়েকদিন বিছানায় পড়ে ছিল নিধি। নাহলে আরো কয়েকদিন আগেই এবাড়িতে আসতো ওরা।

নিধিকে কিছু বলতে না দেখে সিয়াম তাচ্ছিল্য হেসে বললো, “কী হলো? একটু আগের এত তেজ নিমিষেই ফুস হয়ে গেল?”

নিধি এবারেও কিছু না বলে জোর করে সিয়ামের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। বারান্দার দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বারকয়েক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কান্না আসছে তার। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু পারছে না। মা-বাবা যদি শুনে ফেলে এই ভয়ে।

কিছুক্ষণ বাদেই নিধি অসহায় কণ্ঠে বললো, “কেন করতে চাইছো এমন? নিরু আর ফারহান ভাই একে অপরকে অনেক ভালোবাসে। কেন ওদের মাঝে বাঁধা হতে চাইছো। থাকতে দাও না ওদেরকে ওদের মতো। আমরা আমাদের মতো থাকি৷ একটা সুন্দর জীবন কী আমি পেতে পারি না? তোমাকে ভালোবাসা কী এতটাই অপরাধ হয়ে গেছে আমার?”

সিয়াম কিছু না বলে আরেকটা সিগারেট জালিয়ে পুনরায় ধোঁয়া উড়ানোতে মন দিল।

নিধি নীরবে চোখের পানি ফেলে রুমে চলে আসলো। সে জানে এখন সিয়ামের সাথে কথা বলে কোনো উত্তরই পাওয়া যাবে না। উল্টো বেশি রাগ করলে তার গায়ে-ও হাত তুলতে পারে। এবাড়িতে তা মোটেও শোভনীয় ব্যাপার হবে না।

__________________

পরেরদিন বিকালবেলায় উঠানে বসে শাশুড়ীর সাথে চায়ে চুমুক দিচ্ছে নিরু। সকালবেলায়ই এবাড়িতে ফিরে এসেছে সে। ফারহান তাকে দিয়েই অফিসে চলে গেছে। এরমাঝে আর ফোনে কথা হয়নি তাদের। সারাদির শাশুড়ীর সাথেই কেটে গেছে নিরুর। এখনো তার সাথেই বসে আছে। উঠানটা খুব একটা বড় নয়। তারই একপাশে একটা বড় কাঁঠাল গাছ। আরেকপাশে একটা আম গাছ। নিরুর মনে হচ্ছে একটা ছোট্ট বাগান থাকলে মন্দ হতো না। ছাঁদে অবশ্য কয়েকটা গাছ আছে। ফারহান এনে দিয়েছিল সেদিন। নিরুর অবর্তমানে তার শাশুড়ী-ই এ কয়দিন সেসবের যত্ন নিয়েছে।

নিরু মনে মনে ভাবছে, “উনি আজ আসলে বলতে হবে আরো কয়েকটা গাছ এনে দিতে। একটা বাগান করাই যেতে পারে। উনি নিশ্চয়ই এনে দিবেন।”

সন্ধ্যা পেরোতেই নিরু রান্নাঘরে চলে গেল রাতের রান্না করতে। ওর শাশুড়ীও সাহায্য করতে চেয়েছিলেন কিন্তু নিরু তাকে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। এতদিন তো অনেক করলো এবার না-হয় ও-ই সংসারের হালটা ধরুক। আর কতকাল সামলাবেন তিনি। কম কষ্ট করতে হয়নি তাকে।

নিরু রান্নাঘরে থাকাকালীনই ফারহান অফিস থেকে বাড়িতে ফিরলো। নিরুকে রান্নাঘরে দেখে সে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিজেও রান্নাঘরে এল।

নিরু ফারহানকে রান্নাঘরে দেখে ভ্রু কুচকে বললো, “কী ব্যাপার? আপনি রান্নাঘরে কেন? কী চাই?”

ফারহান পাশের চেয়ারটায় আয়েশ করে বসে বললো, “আমার বউ এখানে থাকলে আমি কী রুমে বসে মশা মারবো? আমারো তো এখানেই থাকা উচিত তাই-না? বউকে রান্নায় একটু সাহায্য করা উচিত।”

“রান্না করতে পারেন আপনি যে সাহায্য করবেন?”

“অবশ্যই পারি। ডিম ভাজতে পারি আমি।”

নিরু ফারহানের কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেললো। হাসতে হাসতেই বললো, “ডিম সবাই ভাজতে পারে। এ আর এমন কী? আপনি শুধু ডিম ভাজার পাওয়ার নিয়ে আমাকে সাহায্য করতে চাইছেন?”

ফারহান উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “আচ্ছা তাহলে বলো কী করতে হবে। একদম ঠিকঠাক করে দেব।”

“কিচ্ছু করতে হবে না আপনাকে। আপনি রুমে যান। আপনাকে এখানে দেখলে মা কী ভাববেন?”

“কিছুই ভাববে না। মা এখানে আসবে কেন? মাকে তো আমি রুমে দেখে এলাম।”

“এসেও পড়তে পারে। না আসলেও আপনি রুমে যান।”

ফারহান আবারো বসে বললো, “উঁহু, আমি এখানেই বসে থাকবো আর এটাই ফাইনাল।”

নিরু আর কিছু না বলে রান্নায় মনোযোগ দিল। সে জানে এখন ফারহানকে শতবার বললেও কোনো লাভ হবে না। তারচেয়ে বরং বসেই থাকুক। যেতে হবে না রুমে।

কিছুক্ষণ বাদেই নিরু রান্নাবান্না শেষে রুমে চলে এল। ফারহানও তার পিছু পিছু এল। নিরু ভ্রু কুচকে বললো, “এরকম পিছু পিছু আসছেন কেন আপনি? পাশাপাশি আসুন। আপনারই তো বউ আমি। পাশাপাশি আসলে ইভটিজিং এর মামলা দেব না।” বলেই মৃদুস্বরে হাসলো নিরু।

ফারহানও হাসলো। নিরুর একবাহু জড়িয়ে বললো, “আমাকে এখনো আপনি আপনি করে কেন বলো?”

“তুমি বলতে লজ্জা লাগে।”

ফারহান এবার আলতো হাতে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে বললো, “এখনো এত লজ্জা?”

নিরু কিছু না বলে মাথা নোয়ালো।

ফারহান ওর মুখটা উপরে তুলে নাকে নাক ঘঁষে বললো, “চেরি ফল।”

নিরু হেসে ফেললো এবার। মাঝেমাঝে ফারহান এমনভাবে বলে যে না হেসে পারা যায় না।

ফারহান নিরুকে ছেড়ে বললো, “যাও হাত-মুখ ধুয়ে আসো। ঘেমে তো অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে।”

নিরু ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এল। সে নিজেই ফারহানকে বলতে চেয়েছিল ছেড়ে দিতে যাতে সে ফ্রেশ হতে পারে কিন্তু তার আগে ফারহান নিজেই বললো।

নিরু ফ্রেশ হয়ে আসতেই ওরা গিয়ে বাবা-মায়ের সাথে ডিনার করে এল। বাবা এখন ড্রয়িংরুমে বসে টিভিতে নিউজ দেখছেন আর মা তার সাথে ঝগড়া করছেন সিরিয়ালে দেয়ার জন্য। কিন্তু রায়হান সাহেব কিছুতেই সিরিয়ালে দেবেন না। এই নিয়ে বেঁধে গেছে ঝগড়া। মাঝখান থেকে না রায়হান সাহেব নিউজ দেখতে পারছেন আর না সিরিয়াল দেখতে দিচ্ছেন।

নিরু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এসব দেখে মুখ চেপে হাসছে। ফারহান তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে বললো, “মা-বাবার ঝগড়া দেখে হাসছো?”

নিরু মাথা নেড়ে সায় জানায়। এখনো তার ঠোঁটের কোণে হাসি লেগেই আছে।

ফারহান নিজেও হেসে বললো, “বাবা-মা এরকমই। ছোটবেলা থেকে এসব কাহিনী দেখেই বড় হয়েছি। আর কিছু নিয়ে ঝগড়া হোক বা না হোক মায়ের সিরিয়াল দেখা নিয়ে প্রতিদিন একবার হলেও ঝগড়া হবেই।”

নিরু হাসতে হাসতে রুমের ভেতরে চলে এল। বিছানা ঝাড়তে লাগলো। ঘুম পাচ্ছে প্রচুর। ফারহান অফিসের কিছু কাজ করতে বসলো। আর নিরু বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়লো। কাল থেকে আবার ভার্সিটিতে যাবে। এক সপ্তাহ যাবৎ ভার্সিটিতে যাচ্ছে না।

এগারোটার পরে ফারহান কাজ শেষ করে উঠে দেখলো নিরু ঘুমিয়ে গেছে। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে আছে। ফারহান ওকে সোজা করে দিয়ে কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে নিজেও ঘুমিয়ে পড়লো। কারো স্পর্শ পেয়ে নিরু এবার গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে রইলো। বাহ্যিক জগতের কোনো ধারণাই তার নেই এখন। কী সুন্দর নিচের ঠোঁট উল্টে ঘুমিয়ে আছে।

___________________

পরেরদিন সকালে নিরু রান্নাবান্না সেরে সবাই মিলে ব্রেকফাস্ট করে তৈরি হয়ে ফারহানের সাথে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। ফারহান আগের মতোই তাকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে তারপরে অফিসে চলে গেল।

নিরু খুশি মনে ভার্সিটির ভেতরে প্রবেশ করলো। কতদিন পর নতুন বান্ধবীদের সাথে দেখা হবে, আড্ডা হবে ভাবতেই ভালো লাগছে।

ক্লাস শেষে নিরু ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথে রওনা দেবে তার আগেই একটা মেয়ে তাকে পেছন থেকে ডাকলো। নিরু পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটাকে সে চেনে না। এর আগে কখনো দেখেছে বলেও মনে পড়ছে না। তাহলে সে ওকে চিনলো কী করে? মেয়েটাকে দেখে তো তার চেয়ে বয়সে বড়ই মনে হচ্ছে।

নিরু প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “আমাকে ডাকছেন? আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।”

অপরপাশে থাকা মেয়েটি হেসে বললো, “আমি শ্রাবণী।”

“আপনি আমাকে চিনেন? আমি আপনাকে চিনি বলে তো মনে হচ্ছে না।”

“ফারহান তোমাকে আমার কথা বলেনি?”

এবার নিরু বুঝতে পারলো যে এটাই সেই শ্রাবণী যার কথা ফারহান ওকে বলেছিলো। নিরু সৌজন্যসূচক হেসে বললো, “জ্বি, বলেছিলো। আমার খেয়াল ছিল না৷ আপনি হঠাৎ এখানে?”

“আসলে আমি এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। তো হঠাৎ তোমাকে দেখে দাঁড়িয়ে যাই। অনেকদিন আগেই শুনেছি ফারহান বিয়ে করেছে। তোমাকে ছবিতে দেখলেও বাস্তবে তেমন সামনা-সামনি দেখা হয়নি। আর ফারহানের বউয়ের সাথে আলাপ করার ইচ্ছা ছিল অনেক তাই তোমাকে দেখেই ডাকলাম। কিছু মনে করো না।”

“না,আমি কিছু মনে করিনি।” নিরু মুখে এসব বললেও মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে। অবাকও হয়েছে বটে। কেননা সে ফারহানের কথাগুলো শুনে ভেবেছিল মেয়েটা বোধহয় ভীষণ উগ্র, উশৃঙ্খল। কিন্তু সামনে থেকে তো এ পুরোই শৃঙ্খলতার ডিব্বা। নিরু এটা ভেবেই বিরক্ত হচ্ছে যে তার এত ওর সাথে আলাপ করার ইচ্ছা কেন? আর এমনভাবে ফারহান ফারহান করছে মনে হচ্ছে মেয়েটা ওর বউ বা বয়সে বড় একজন মানুষ। হুহ।

চলবে__??

হঠাৎ হাওয়া
সুমনা ইসলাম
পর্বঃ১৪

শ্রাবণী হাসিমুখে বললো, “কেমন চলছে তোমাদের বিবাহিত জীবন?”

নিরু ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বললো, “জ্বি আলহামদুলিল্লাহ আপু। বেশ ভালোই চলছে।”

শ্রাবণী নিচুস্বরে বললো, “ফারহান তোমাকে ভালোবাসে প্রচুর তাই-না?”

নিরু শুনতে না পেয়ে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “কিছু বললেন?”

শ্রাবণী না সূচক মাথা নেড়ে বললো, “না, কিছু না। আমি যাচ্ছি। দেরি হয়ে যাচ্ছে।” বলেই শ্রাবণী গটগট শব্দ তুলে চলে গেল। নিরু ভ্রু কুচকে তাকালো তার যাওয়ার পানে। কোথা থেকে হঠাৎ করেই চলে এল আবার হঠাৎ করেই কেমন চলে গেল।

নিরু মনে মনে বললো, “যাক গে। তাতে আমার কী। আমি বাসায় যাই। দেরি হয়ে গেল।” নিরু হেঁটেই বাড়ির পথে রওনা দিল। আশেপাশে তেমন রিকশাও নেই। মাঝেমাঝে দু-এক জন এলেও তারা ওদিকে যেতে চাচ্ছে না। এখন দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করার চেয়ে হেঁটে চলে যাওয়াই ঢের ভালো।

_____________

নিরু বাড়িতে এসেই আগে শাওয়ার নিয়ে নিল। তারপরে একবার ফারহানকে কল করলো দুপুরে খেয়েছে না-কি জিজ্ঞেস করতে।

ফারহান কল রিসিভ করে বললো, “হ্যালো? হঠাৎ এসময়ে কল। তুমি বাসায় পৌঁছেছো তো ঠিক মতো।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, এসেছি। আপনি দুপুরে খেয়েছেন না-কি এটা জানতেই কল করলাম।”

“হুম, খেয়েছি আমি। তুমি এখনো খাওনি?”

“না।”

“দুপুর সাড়ে তিনটা বাজে। এখনো না খেয়ে আছো। খাবে কখন? এভাবে চললে শরীর খারাপ করবে কিন্তু।”

“আরে আরে থামেন আগে। আমি তো বাসায় আসলাম একটু আগে। শাওয়ার নিয়ে বেরোলাম কেবল। এখন খাবো।”

“এত দেরি হয়েছে আজ?”

“হুম, রাস্তায় একজনের সাথে দেখা দেখা হয়েছিল তাই আরকি একটু দেরি হয়ে গেছে।”

“ওহ। এখন গিয়ে খেয়ে নাও। আচ্ছা কার সাথে দেখা হয়েছিল রাস্তায়?”

“বাসায় আসুন তারপরে বলছি। এখন অফিসে আছেন, কাজ করুন।”

“আরে শুধু নামটা তো বলো।”

“শ্রাবণী।”

“শ্রাবণী?”

“হুম।”

“কী কথা বলেছে তোমার সাথে?”

“তেমন কিছুই বলেনি। এমনি সংসার জীবন কেমন চলছে এসব জিজ্ঞেস করছিল।”

“ওহ।”

“হুম।”

“আচ্ছা, যাও আগে খেয়ে নাও। রাখছি।”

ফারহান কল কেটে ভাবতে লাগলো, শ্রাবণী কেন হঠাৎ করে আবার তাদের জীবনে ফেরত আসছে? কেন যোগাযোগ করছে? এর পেছনে কী তার কোনো উদ্দেশ্য আছে না-কি শুধুশুধুই? বিয়ের আগে গত কয়েকমাসে তো ভুলেও চোখের সামনে পড়েনি। ইমনের সাথে দেখা হলেও তাকে কখনো ওর সাথে দেখা যেত না।

ফারহান চিন্তা রেখে আবার কাজে মনোযোগ দিল। আন্দাজে এসব ভাবা বৃথা। পরে কিছু হলে তখন দেখা যাবে।

__________________

নিরু ডাইনিং টেবিলের কাছে আসতেই দেখলো ওর শাশুড়ী সব খাবার গরম করে ঢেকে রেখে গেছেন। হয়তো ও আসার আগেই খেয়েছেন তারা। নিরুর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। আগে যখন তার বাসার ফিরতে দেরি হতো তখন মা-ও এভাবে টেবিলে খাবার সাজিয়ে ঢেকে রাখতো। আর আজ শাশুড়ী মা রেখেছেন। দুজনেই তো মা। একজন সারা জীবনের আরেকজন বিয়ের পরের জীবনের।

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। চারিদিক নীরব। তেমন কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। হঠাৎ হঠাৎ নিশাচর প্রাণীদের ডাক শোনা যাচ্ছে। বেশ স্নিগ্ধ পরিবেশ। আকাশে এক ফালি চাঁদের দেখা মিলছে। মেঘে ঢেকে যাচ্ছে আবার কিছুক্ষণ বাদেই মেঘেদের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে। তাঁরা তেমন নেই বললেই চলে, সংখ্যা খুবই নগণ্য। একটু একটু হাওয়া বইছে। বর্ষা পেরিয়ে গেছে মাসখানেক হলো। তবুও বৃষ্টির রেশ কাটেনি। মাঝেমাঝে ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি পড়ে ধরণীতলে। সতেজতায় ছেয়ে যায় প্রকৃতি। আজও বোধহয় তেমনি সতেজতায় ছেয়ে যেতে বর্ষাকে আহ্বান জানিয়েছে প্রকৃতি। চাঁদটা ধীরে ধীরে কালো মেঘের আস্তরণে ঢেকে যাচ্ছে। গুটিকতক তাঁরাগুলোও আর দৃশ্যমান নয়। হারিয়ে গেছে বাষ্পরূপী জলরাশিদের মাঝে।

বারান্দায় দোলনায় বসে ফারহানের কাঁধে মাথা রেখে প্রকৃতির এই পরিবর্তন দেখছে নিরু। দোলনাটা গত পরশুই লাগানো হয়েছে। নিরু তো কাল এসে বারান্দার একপাশে এই দোলনা দেখে পুরো চমকেই গিয়েছিল। ফারহান তাকে চমকানোর জন্যই না জানিয়ে এ ব্যবস্থা করেছিল।

নিরু নিশ্চুপ হয়ে আছে দেখে ফারহান বললো, “কী হলো? এত শান্ত হয়ে আছো কেন?”

“প্রকৃতির পরিবর্তন দেখছি। সবকিছুই পরিবর্তন হয়। মানুষও পরিবর্তন হয়। আমরাও একদিন পরিবর্তন হয়ে যাবো তাই-না?”

“আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হবে। বয়স বাড়বে। জীবনযাত্রার পরিবর্তন হবে। আমাদের ভালোবাসারও পরিবর্তন হবে।”

নিরু মাথাটা কাঁধে রেখেই উপরদিকে তাকিয়ে ফারহানের চোখে চোখ রেখে শঙ্কিত স্বরে বললো, “আপনি আমাকে আর এখনকার মতো ভালোবাসবেন না?”

ফারহান নিরুর নাক টেনে হাসিমুখে বললো, “আরো বেশি ভালোবাসবো। তবে শর্ত আছে একটা।”

নিরু ভ্রু কুঁচকে বললো, “কী শর্ত?”

“আমাকেও আরো বেশি বেশি ভালোবাসতে হবে।”

নিরু মুচকি হেসে আবারো ফারহানের এক বাহু জড়িয়ে কাঁধে মাথা দিয়ে রইলো আর ফারহান ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

বেশ কিছুক্ষণ যেতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। এখনই ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়বে মনে হচ্ছে।

নিরু উচ্ছ্বসিত হয়ে ফারহানের দিকে তাকাতেই ফারহান বললো, “একদম ভিজতে চাইবে না কিন্তু। আমি এ কথা শুনবো না।”

নিরু আবদার করে বললো, “প্লিজ ভিজবো। কী সুন্দর বৃষ্টি পড়ছে। একটু ভিজলে কিচ্ছু হবে না।”

“জ্বর আসলে কী হবে? জ্বল আসলে তো তোমার কোনো দিকে হুশ থাকে না। আবোল তাবোল বকতে শুরু করে দাও। একবারেই বুঝেছি আমি।”

“ওইবার তো এমনিতেই জ্বর এসেছিল। বৃষ্টিতে তো ভিজিনি। আর আপনি একা ছিলেন বলে সামলাতে পারেন নি। তখন তো মা-বাবা গ্রামে ছিল। এবার মা আছে। জ্বর আসলে সামলে নিবে।”

“মা আছে বলে কী তুমি ইচ্ছে করে জ্বর আনাবে না-কি?”

“এটা আবার কখন বললাম আমি? ধুর… আপনার সাথে কথা বলতে বলতে বৃষ্টিই থেমে যাবে। চলুন না ভিজি। জ্বর আসবে না আমার।”

ফারহান একটু হেসে বললো, “আচ্ছা ভিজবো। তবে একটা শর্ত।”

নিরু গোমরা মুখ করে বললো, “আপনার সব কথাতেই শুধু শর্ত আর শর্ত। বলুন কী শর্ত। শুনবো আমি।”

“তুমি করে বলতে হবে। তাহলে ভিজবো।”

নিরু আঁড়চোখে একবার তাকালো ফারহানের দিকে। ফারহান গা ছাড়া ভাব নিয়ে বললো, “যেভাবেই তাকাও না কেন আমার শর্ত না মানলে আমি এখান থেকে এক পা ও নড়বো না। তোমাকেও নড়তে দেব না।”

নিরু মনে মনে বললো, “এতদিন তো তুমি করে বলতে চাইলেও মুখে আসতো না। আপনি বলতে বলতে অভ্যাস হয়ে গেছে। এবার মনে হচ্ছে মুখে আনতেই হবে। আর কতকালই বা আপনি বলবো। আমারই তো বর।”

ফারহান নিরুকে ভাবতে দেখে বললো, “ভাবা শেষ তোমার? বৃষ্টি কিন্তু কমে যাবে।”

নিরু ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে বললো, “যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে আজকে রাতে মনে হয় না কমবে।”

ফারহান হাই তুলে বললে, “সারারাত বৃষ্টি হলেই বা কী? তুমি তো শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে।”

“এই আপনার কী ঘুম পাচ্ছে না-কি?”

“সেরকমই৷ ভাবছি ঘুমাতে যাবো।”

নিরু একটু সময় নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বললো, “চলো না ভিজি।”

ফারহান ভ্রু খানিকটা কুঁচকে বললো, “আমি কী ঠিক শুনেছি? মনে হয় ভুল শুনেছি। আরেকবার বলো তো।”

নিরু এবার চোখ পাকিয়ে তাকালো ফারহানের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো, “চলো না একটু বৃষ্টিতে ভিজি।”

ফারহান হেসে ফেললো এবার। নিরুর এমন চেহারা দেখে হাসি পাচ্ছে তার। ভীষণ হাসি পাচ্ছে।

নিরু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “হাসছেন কেন আপনি?”

ফারহান কপাল কুচকে তাকাতেই একটু হেসে বললো, “হাসছো কেন তুমি?”

“তোমার ওইরকম রাগী চেহারাটা দেখে হাসি পাচ্ছিলো। সে কথা বাদ দাও আগে বলো তো এই অসময়ে বৃষ্টিতে ভেজার জন্য এত বায়না করছো কেন তুমি?”

নিরু উঠে দাঁড়িয়ে ফারহানের হাত ধরে টানতে টানতে বললো, “ভিজতে ভিজতে বলবো। আগে চলো ছাদে যাই।”

ফারহানও অগত্যা তার পিছু পিছু ছাদে চলে আসলো।

ছাদের মেঝেতে বসে আছে দুজন। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো তাদের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে। দুজনেই চোখ বন্ধ করে আছে। পানিতে এতক্ষণ রীতিমতো লাফালাফি করেছে নিরু। তাই এখন ক্লান্ত হয়ে মেঝেতে বসে আসে। এতক্ষণ বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে উপভোগ করছিল আর এখন উপভোগ করছে প্রকৃতিটা। খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে মুখোরিত পরিবেশে একজোড়া কপোত-কপোতী পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। দুজনের মুখই একে অপরের বিপরীতে। দুজনেই ভাবছে অপর পাশের মানুষটির মনের অনুভূতি কেমন।

বৃষ্টির একনিষ্ঠ শব্দের মাঝে ছেদ ঘটিয়ে নিরু ফারহানের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো, “অনুভূতি কেমন?”

ফারহান বিমোহিত স্বরে বললো, “অন্যরকম। একদম অন্যরকম। এরকম অনুভূতির সাথে কখনো পরিচয় হয়নি আমার। নিজেকে মুক্ত মুক্ত লাগছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ বোধহয় আমিই। বাইরের জগতের কোনো চিন্তাই মাথায় আসছে না।”

নিরু মুচকি হেসে বললো, “আমি এর আগেও কয়েকবার এরকম অসময়ে বৃষ্টিতে ভিজেছি। তখন এরকম অনুভূতি হতো। অন্যসময় হলে মনে হতো এই বুঝি মা বকবে। এক প্রকার টেনশন নিয়েই ভিজতাম। কিন্তু এসময়ে কেউ টেরই পেতো না৷ তাই অনুভূতিটা এরকম ছিল। জিজ্ঞেস করেছিলে না এই অসময়ে ভিজতে চাচ্ছি কেন? এই অনুভূতির সাথে তোমাকে পরিচয় করানোর জন্যই এত ঘটা করে বৃষ্টিতে ভেজা।”

ফারহান এবার নিরুর দিকে ঘুরে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওর কথাগুলো শুনছিলো। নিরুর কথা শেষ হতেই বললো, “আমার জীবনের বেশিরভাগ শ্রেষ্ঠ মুহূর্তগুলোই কিন্তু তোমার সাথে জড়িত। সবচেয়ে শ্রেষ্ট মুহূর্ত ছিল তোমার সাথে দেখা হওয়া। তোমার সাখে দেখা না হলে তো এতগুলো শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত পাওয়াই হতো না। অনেক অনেক ধন্যবাদ আমার জীবনে আসার জন্য।”

নিরু ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বললো, “তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ আমাকে ভালোবাসার জন্য।”

চলবে__??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here