হঠাৎ হাওয়া,পর্বঃ১১,১২
সুমনা ইসলাম
পর্বঃ১১
মাথায় ভালোভাবে ওড়না টেনে নিরু নিধিদের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। মাকে বলাতে প্রথমে মানা করলেও নিরুর জেদের কাছে হার মেনে যেতে দিতে রাজি হয়েছেন। তিনি প্রথমে যেতে দিতে চাননি এই ভাবে যে যদি উনারা তার মেয়েকে কোনো কটু কথা শোনায় তখন তো মেয়েটা মন খারাপ করবে। সাধারণত কোনো মেয়ে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে গেলে মেয়েটার বান্ধবীকেই দোষী করা হয়। তাদের সে বিষয়ে কেন জানালো না এসব বিষয় নিয়ে রাগারাগি হয়। নিরুও সেই ভয়েই এতদিন ওবাড়িতে যায়নি।
দু’মিনিটও লাগলো না নিধিদের বাসায় আসতে। তবে নিরু কলিংবেল চাপবে না-কি চাপবে না এ নিয়ে দ্বিধায় আছে। জড়তাও কাজ করছে। বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলিংবেলে চাপ দিয়েই দিলো নিরু।
মিনিট পেরোনোর আগেই দরজা খুলে দিল নিধির মা। তার চোখ-মুখ দেখেই বোঝা গেল তিনি নিরুকে দেখে খুব একটা খুশি হননি।
নিরু শুকনো ঢোক গিলে সৌজন্যসূচক হেসে বললো, “কেমন আছো কাকিমা?”
রাশেদা বেগম বিনিময়ে হাসলেন একটু।
“আল্লাহ ভালোই রেখেছে। তুই কেমন আছিস? শ্বশুরবাড়িতে দিনকাল কেমন কাটছে?”
“এইতো ভালোই।”
রাশেদা বেগম দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বললেন, “আয়, ভেতরে আয়। আজ এতদিন পরে এলি যে?”
নিরু একটু কাচুমাচু করে বললো, “এমনি দেখতে এলাম তোমাদের। অনেকদিন হলো আসা হয় না। তোমরা আমার উপর রাগ করে আছো তাই-না?”
রাশেদা বেগম শান্তস্বরে বললেন, “সেটাই কী স্বাভাবিক নয়?”
নিরু কোনো উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো, “নিধির সাথে তোমাদের আর যোগাযোগ হয়েছিল?”
নিধির কথা উঠতেই ছলছলে দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি। যতই রাগ থাকুক, মেয়ে হয় তো তার। কতটা দিন হয়ে গেল মেয়েটার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। কোথায় আছে তা-ও জানেন না।” উনি মাথা না সূচক মাথা নাড়িয়ে চোখ মুছে নিলেন।
নিরু অপরাধী ভঙ্গিতে বললো, “আমার উচিত ছিল তোমাদের ব্যাপারটা জানানো। কিন্তু নিধি আমাকে ওয়াদা করিয়েছিল যাতে কাউকে কিছু না বলি। পরীক্ষার পরে ও নিজেই তোমাদের জানাতে চেয়েছিল। কিন্তু কোথা থেকে কী হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। রাগ করে থেকো না প্লিজ।”
এতক্ষণ মনের মাঝে রাগ থাকলেও আর সেটা ধরে রাখতে পারলেন না তিনি। মনে মনে আওড়ালেন, “এখন নিরুর উপর রাগ করে থাকলেই তো আমার মেয়েটা ফিরে আসবে না। শুধু শুধু এই মেয়েটার মনে কষ্ট দিয়ে কী লাভ?”
রাশেদা বেগম নিরুকে আশ্বস্ত করে বললেন, “তোর উপর আর রাগ নেই আমার। আমার মেয়েটা কী আর ফিরে আসবে না রে? কতদিন হলো ওকে দেখি না। কোথায় আছে ও? তোর সাথে ওর কথা হয়েছিল নিরু?”
নিরু মন খারাপ করে বললো, “না। সেদিনের পর থেকে আর ওর সাথে কোনো যোগাযোগ নেই।”
নিরু আর রাশেদা বেগমের কথার মাঝেই কলিংবেল বেজে উঠলো। রাশেদা বেগম উঠে যাওয়ার আগেই নিরু উঠে বললো, “তুমি বসো কাকিমা, আমি দেখছি।”
নিরু দরজা খুলে দিতেই দেখলো অপরপাশে নিধি দাঁড়িয়ে। তার মুখটা মলিন। নিরুকে দেখেই শক্তহাতে জড়িয়ে ধরলো।
নিরু প্রথমে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলেও পরমুহূর্তে সে-ও জড়িয়ে ধরলো নিধিকে। নিধির শরীরের কাঁপুনি অনুভব করতে পেরে অস্থির হয়ে বললো, “এই নিধি, নিধি, কাঁদছিস কেন তুই?”
নিধি কিছু না বলে কাঁদতে লাগলো। মনে মনে শতবার ক্ষমা চেয়ে নিল নিরুর কাছে। অস্ফুটস্বরে বললো, “ক্ষমা করে দিস আমাকে নিরু। তোর জীবনটা বাঁচানোর কোনো উপায় আমার জানা নেই। আমার জীনটা তো নষ্ট হয়েই যাচ্ছে। তোর না জানি কী হয় এখন।”
অস্ফুট হওয়ায় কিছুই বুঝতে পারলো না নিরু। প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “কী বলছিস তুই?”
নিধি কিছু বলার আগেই পেছন থেকে কারো ডাক শুনতে পেল। ডাকটা আর আরো নয় তার স্বামী সিয়ামের। লোকটাকে স্বামী বলতেও ঘৃণা হয় তার।
ততক্ষণে নিধির মা-ও এসে দাঁড়িয়েছে দরজার কাছে। মেয়েকে একদৃষ্টিতে দেখছে সে। কতদিন পরে দেখলো।
নিধি নিজেকে সামলে নিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “মা, ক্ষমা করে দাও আমায়। ক্ষমা করে দাও।”
নিধির মা কিছু না বলে মেয়েকে আলতো হাতে জড়িয়ে নিলেন। এখন কীভাবে রাগ দেখাবেন তিনি? রাগের চেয়ে মমতাটাই তো বেশি প্রকাশিত হচ্ছে।
সিয়াম এসে সালাম করলো তার শাশুড়িকে। মৃদু হেসে নিরুকে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছো?”
নিরু জোরপূর্বক হেসে উত্তর দিল, “জ্বি, ভালো। আপনি কেমন আছেন?”
লোকটা কেমন করে যেন হেসে বললো, “অনেক ভালো।”
নিরু নিধির থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে এল। বলে গেছে বিকালে আবার যাবে। এখন ওরা একটু ব্যক্তিগত সময় পার করুক।
নিরু চলে যেতেই সিয়াম নিধিকে নিয়ে ওর রুমে চলে এল। দরজাটা আটকে দিয়ে শক্তহাতে নিধির চুলের মুঠি ধরে রাগী স্বরে বললো, “কী বলছিলি তখন নিরুকে? হ্যাঁ? খুব সাহস বেড়ে গেছে তাই-না?”
নিধি ব্যথা পেয়ে কুকিয়ে উঠে বললো, “সিয়াম, ছাড়ো। লাগছে আমার।”
“লাগুক। কী বলতে চেয়েছিলি তখন?”
নিধি মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে বললো, “কিছু না, কিছু বলিনি। ছাড়ো প্লিজ।”
সিয়াম না ছেড়ে উল্টো আরো জোরে ধরে বললো, “একে-তো তোর জন্যই আসতে এত দেরি হয়েছে। এখন এর মধ্যে যদি ঝামেলা বাঁধাস তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।”
“তোর চেয়ে খারাপ আর কেউ আছে না-কি? আমি বলেছিলাম আমাকে অত্যাচার করতে যে আমার জন্য দেরি হয়েছে? তোকে মারলেও হয়তো আমার শান্তি হবে না।” মনে মনে আওড়ালো নিধি। মুখে বলতে পারলো না। সে সাহস যে তার নেই। এসব কথা যদি সিয়ামের সামনে বলে তাহলে হয়তো এখনি ওকে খুন করে দেবে।
__________________
আধভেজা চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিরু। হালকা বাতাসে থেকে থেকে উড়ছে চুলগুলো। সেদিকে নিরুর খেয়াল নেই। সে আনমনা হয়ে সন্ধ্যার ধূসর-লাল আকাশ দেখতে ব্যস্ত। গোসলের পর ভেজা চুল বেঁধেই নিধিদের বাসায় গিয়েছিল সে তাই এখনো চুল ভেজাই আছে। কিছুক্ষণ আগে এসেই চুলগুলো ছেড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছে। পাখিরা ডানা ঝাপটে নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। সূর্য তার সোনালী আভা ত্যাগ করে তলিয়ে গেছে কিছুক্ষণ হলো।
ফারহান রুমে নিরুকে না দেখে বারান্দায় যেতেই দেখলো তার প্রিয়তমা খোলা চুলে একদৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোমর পর্যন্ত লম্বা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে। ফারহান তাকে পেছন থেকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে বললো, “মন খারাপ না-কি আমার নিরুপাখির?”
নিরু দৃষ্টি সামনে রেখেই বললো, “এত তাড়াতাড়ি এলেন যে আজ?”
“অফিসে রংয়ের কাজ চলছে তাই দুপুর পর্যন্ত অফিস টাইম ছিল আজ। তাই তাড়াতাড়িই চলে এলাম৷ কাল তোমাকে নিয়ে একেবারে যাবো। আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এখনো পেলাম না।”
“কী?”
“মন খারাপ তোমার?”
“না। জানেন আজ নিধি এসেছে।”
“তাহলে তো তোমার খুশি হওয়ার কথা। এমন মুখ ভার করে রেখেছো কেন?”
“ওর কথা-বার্তা কেমন যেন লাগছিলো। তাছাড়া ও এসেই কেমন করে কাঁদছিলো।”
ফারহান মৃদু হেসে বললো, “আরে অনেকদিন পর দোখা হয়েছে তাই হয়তো কেঁদেছে। এতে এত ভাবার কী আছে? ওর বরও সাথে এসেছে।”
“হ্যাঁ।”
“ওহ, আচ্ছা।”
“একটা কথা বলি?”
“হুম, বলো। এত অনুমতি নেয়ার কী আছে?”
নিরু আবদারের সুরে বললো, “আমি আরো দুটো দিন থাকি? নিধি তো সবেমাত্র আজই এসেছে। ওর সাথে তো তেমন সময় কাটানোই হয়নি। আমরা কাল চলে গেলে ও কবে চলে যাবে টেরই পাবো না। আর দেখা না-ও হতে পারে।”
ফারহান নিরুর দিকটা ভেবে বললো, “আচ্ছা, তবে আর দুই দিনই কিন্তু।”
নিরু খুশি হয়ে ফারহানকে জড়িয়ে ধরে বললো, “থ্যাংক ইউ সো মাচ। আপনি এত্ত এত্ত ভালো।”
ফারহান আলতো স্বরে হেসে নিরুকে বাহুবন্ধনে জড়িয়ে নিল। ছোট ছোট আবদার পূরণ করাতেও কত খুশি মেয়েটা। এরকম হাসিমুখ দেখতে পেলে তো শত-শত আবদারও পূরণ করতে রাজি ফারহান। তার নিরুপাখিকে হাসতে দেখার আনন্দ যে অনেক।
এতক্ষণ একটু মন খারাপ থাকলেও এখন ভীষণ ভালো লাগছে নিরুর। মনে মনে ফারহানকে ধন্যবাদ জানালো। সাথে অভিযোগও ছিল অবশ্য- সে আরেকটু আগে আসলে মন তাড়াতাড়ি ভালো হতো। আগে না এসে অপরাধ করেছে বটে।
ফারহান নিরুকে ছেড়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল। তারপর গেল নাহিদের সাথে আড্ডা দিতে। তারা বাড়ির সামনেই একটা চায়ের দোকানে যাবে। এ কয়দিনে দুজনের মাঝে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বয়সে দুজন প্রায় কাছাকাছি তাই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই তাদের ক্ষেত্রে বেশি মানানসই। নিরু তো তাদের এই মিল দেখে ভীষণ খুশি। তার ভাই যে ফারহানকে মন থেকে মেনে নিয়েছে এর চেয়ে বেশি খুশি আপাতত আর নেই। দুজনে কী সুন্দর আড্ডা দেয়, ঘুরে বেড়ায়। মনে হয় দুই বন্ধু একসাথে আছে।
নিরু এমনি এমনি বসে থেকে বিরক্ত হওয়ায় সিঁড়ি বেয়ে চিলেকোঠার ঘরে চলে গেল। আস্তে করে দরজাটা খুলতেই মাকড়সার জাল পড়লো সামনে। অনেকদিন হলো ঘরটা খোলা হয় না। ছোটবেলার কত-শত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই ঘরে।
নিরু মাকড়সার জাল একহাতে সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো। ছোটবেলার অধিকাংশ সময় এই ঘরেই কেটেছে নিরুর। সারাক্ষণ এখানে বসে বসে পুতুল খেলেছে। কখনো কখনো তো রাতে এখানেই ঘুমিয়ে পড়তো। তখন অবশ্য সাধারণ রুমের মতোই ছিল কিন্তু এখন কিছু পুরনো জিনিসপত্র দিয়ে ভরে আছে। তাই দেখতে একটু অন্যরকম লাগছে।
নিরু হাত দিয়ে ছোট ছোট খেলনাগুলো স্পর্শ করে দেখছে। মনে মনে ভাবছে, “আবার যদি ফিরে যাওয়া যেত সেই সময়টায়! কতই না রঙিন ছিল চারিপাশ! সবকিছুই রঙিন লাগতো। মাথার মধ্যে কোনো চিন্তা, ঝুটঝামেলা কিচ্ছু ছিল না। আলাদা এক জগৎ ছিল।”
কিন্তু শত চাইলেও যে সে জগতে আর ফিরে যাওয়া যাবে না। সময় সে তো পেরিয়েই গেছে। তাকে কী আর পূর্বের জায়গায় ফিরিয়ে নেয়া যায়? কখনোই সম্ভব নয়।
ভাবতে ভাবতেই তীক্ষ্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিরু। সবকিছু দেখে ঘরটায় আবার তালা দিয়ে বেরিয়ে এল। এখানে বসার মতো কোনো পরিস্থিতি নেই নাহলে কিছুক্ষণ বসে থেকে কাটানো যেত।
নিরু রুমে এসে হাত-মুখ ধুয়ে নিল। বেশ ধুলাবালির মধ্যে ছিল। কিছুক্ষণ পরেই ফারহান ফিরে এল। নিরু তখন ফারহানের জামা-কাপড় গোছাচ্ছিল।
ফারহান বিছানায় বসে বললো, “তুমি ভার্সিটি বাদ দিচ্ছো কেন বলো তো?”
নিরু কাজ করতে করতেই বললো, “এখান থেকে ভার্সিটি অনেক দূরে না সেজন্য। যাওয়ার সময় না-হয় আপনি নিয়ে গেলেন কিন্তু আসার সময় একা একা এতটা পথ আমি আসতে পারবো না। এক সপ্তাহেরই তো ব্যাপার। এই কয়দিন না গেলে তেমন কিছু হবে না।”
“অনেক কিছু হবে। কতগুলো ক্লাস মিস গেল তোমার।”
“আমি দৃষ্টির থেকে সব নোটস নিয়ে নেব। আচ্ছা একটা কথা শুনুন।”
“হুম বলো।”
“কাল তো শুক্রবার তাই-না?”
“হুম।”
“কাল আমরা ঘুরতে যাবো। নিয়ে যাবেন তো? আমি, আপনি, নিধি আর ওর বর। না করবেন না প্লিজ।”
ফারহান মৃদু হেসে বললো, “আচ্ছা, যাবো। কোথায় যাবে?”
নিরু খুশি হয়ে বললো, “সেটা কালকে আমি আর নিধি ঠিক করে নেবো।”
চলবে__??
হঠাৎ হাওয়া
সুমনা ইসলাম
পর্বঃ১২
বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা রেস্টুরেন্টে এসেছে নিরু-ফারহান আর নিধি-সিয়াম। আজ সকাল থেকে চিন্তা করে তেমন কোনো জায়গার কথা মাথায় না আসায় রেস্টুরেন্টে আসার সিদ্ধান্তই নিয়েছিল ওরা।
চারজনে এক টেবিলে বসে আসে। নিরুর একপাশে ফারহান, আরেকপাশে নিধি আর সামনে বরাবর সিয়াম। নিধি আর নিরু দুজনেই শাড়ি পড়েছে। আর ফারহান, সিয়াম পাঞ্জাবী।
নিরু বেশ অস্বস্তি নিয়ে বসে আছে। কেমন যেন উশখুশ করছে। কারণটা হলো সামনে বসে থাকা সিয়াম। সে লোলুপ দৃষ্টিতে নিরুর দিকে ক্ষণে ক্ষণে তাকাচ্ছে আবার ফারহানের সাথে হাসিমুখে কথা বলছে। মনে হচ্ছে যেন তার চেয়ে ভালো ছেলে আর দুটো নেই।
কিছুক্ষণ যেতেই ফারহান ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। তবে কিছু বলতে পারছে না। নিরুকে নিজের পেছনের দিকে আড়াল করে বসিয়ে নিজে একটু সামনে এগিয়ে বসলো। এখন যদি সিয়ামকে কিছু বলে তাহলে তাদের নিজেরই সম্মান যাবে। শুক্রবার হওয়ায় মানুষজনে গিজগিজ করছে রেস্টুরেন্ট। তাছাড়া এখন নিধির সামনে যদি সিয়ামকে কিছু বলা হয় তাহলে স্বভাবতই তার খারাপ লাগার কথা। আর যাইহোক নিজের স্বামীকে যদি কেউ খারাপ বলে তাহলে সব স্ত্রীরই খারাপই লাগবে। সাথে অপমানিত-ও হবে। তারচেয়ে পরে একা পেলে উপযুক্ত জবাব দেয়া যাবে।
ফারহানের আচরণে নিরু মুচকি হাসলো। সবদিক বিবেচনা করে যে ও কোনো সিনক্রিয়েট করেনি এতেই ভালো লাগছে তার। তাছাড়া ওই নোংরা লোকের সাথে এখানে ঝামেলা করা মানেই নিধির বিপদ। এটা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে নিরু।
ফারহান হাসি-খুশি ভাবে কথা বললেও ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে যাচ্ছে। এই অসভ্য লোকটা তার নিরুপাখির দিকে ওভাবে তাকিয়ে ছিল এটা ভাবতেই রাগ হচ্ছে প্রচুর। তবুও নিজেকে সামলে নিচ্ছে।
খাবার আসতেই নিরু আবার আগের মতো বসলো। তাছাড়া তো আর কোনো উপায় ও নেই। অস্বস্তি নিয়েই খাওয়া শেষ করলো। একটু নিচুস্বরে ফারহানকে বললো, “বাসায় যাব।”
ফারহান নিরুর হাতে হাত রেখে আশ্বস্ত করে বললো, “হুম। এখনি যাবো। আমি বিল দিয়ে আসছি।”
ফারহান বিল দেয়া শেষ হতেই সবাই বেরিয়ে পড়লো।
রাস্তায় এসে ফারহান নিধি আর নিরুকে উদ্দেশ্য করে বললো, “তোমরা যেতে থাকো। আমরা পেছনে আসছি।”
নিরু ভ্রু কুচকে বললো, “কেন?”
ফারহান হেসে বললো, “থাকে না ছেলেদের মধ্যে কিছু প্রাইভেট কথা। ওসব শুনে তোমাদের কাজ নেই। তাইতো সিয়াম ভাই?”
সিয়াম কিছু না বুঝলেও মাথা নাড়ালো। নিরু আর সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নিধির সাথে কথা বলতে বলতে হাঁটতে লাগলো। গোধুলির সময়। এখন হেঁটে যেতেই ইচ্ছা করছে। আবছা আলোয় কাছের কোনো মানুষের সাথে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাওয়ার অনুভূতিটাই অন্যরকম। চারদিক আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে আসছে। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ বাতিগুলো একটা একটা করে জ্বলে উঠছে। আবার কোনো কোনোটা নষ্ট হয়ে আছে। পাখিরা ইতিমধ্যেই নীড়ে ফিরে গেছে।শুক্রবার হওয়ায় কর্মজীবী মানুষদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার তাড়া দেখা যাচ্ছে না। তবে রাস্তার পাশ ঘেঁষে, চলমান রিকশায় কয়েকজোড়া কপোত-কপোতীর দেখা মিলছে।
নিরুরা সামনে কিছুদূর এগিয়ে যেতেই ফারহানের চেহারায় কাঠিন্যতা ফুটে উঠলো।
ফারহান কিছু বলার আগেই সিয়াম বললো, “আপনি ওদের আগে পাঠিয়ে দিলেন যে? কি প্রাইভেট কথা?”
ফারহান যথাসম্ভব নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করে বললো, “আমার জানামতে আপনার একটা বউ আছে তাই-না?”
সিয়াম ভ্রু খানিকটা কুঞ্চিত করে বললো, “হ্যাঁ।”
ফারহান এবার চোয়াল শক্ত করে বললো, “তাহলে অন্যের বউয়ের দিকে নজর যায় কেন?”
সিয়াম কিছু বলার আগেই ফারহান আবারো রাগী কিন্তু নামানো স্বরে বললো, “নিজের বউ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করুন। অন্যের বউয়ের দিকে নজর দিতে যাবেন না। পরে দেখবেন যে চোখ দিয়ে নজর দেবেন সে চোখই আর আস্ত রইলো না। তখন ব্যাপারটা কেমন হবে?”
সিয়াম রাগে গজগজ করতে করতে বললো, “আমাকে চিনিস তুই? এসব কথা বলার সাহস পাচ্ছিস কোথা থেকে?”
ফারহান দ্বিগুণ রেগে বললো, “তুই যে গুন্ডা সেটা আমার আগে থেকেই জানা আছে। তবে আমিও কিন্তু অবলা কোনো মানুষ নই। স্টুডেন্ট লাইফে মারামারি কম করিনি। তবে সেটা শুধুমাত্র তোদের মতোই কিছু লম্পট মানুষদের সাথে। মানুষ হওয়ারও যোগ্য না তোরা। বয়সে বড় ভেবে একটু সম্মান দিয়েই কথা বলছিলাম তবে সেটা ডিজার্বই করিস না তুই। যাইহোক যা বললাম সেটা যেন মাথায় থাকে। নাহলে নিজের বউকে কীভাবে রক্ষা করতে হয় সেটা কিন্তু আমার জানা আছে। তোর বউয়ের অপমানিত হওয়ার কথা চিন্তা করে তখন কিছু বলিনি। নাহলে ঝামেলা একটা হয়েই যেত।” বলেই ফারহান হনহন করে ছুটে চললো সামনের দিকে। এখানে আর একমুহূর্ত দাঁড়ানোর ইচ্ছা তার নেই।
সিয়াম রাগে পাশের দেয়ালে একটা বাড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল।
নিরুরা কিছুদূর এগিয়ে ফারহানদের দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে ওরাও দাঁড়িয়ে আছে। কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছে।
ফারহান ওদের কাছে যাওয়ার আগেই মুখভঙ্গি স্বাভাবিক করে নিল।
নিরু ফারহানকে দেখে বললো, “কী এত কথা বলছিলেন? কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি।”
ফারহান একটু হেসে বললো, “তেমন কিছু না। চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
ওদের কথা বলার মাঝে সিয়ামও এসে দাঁড়িয়েছে। সে ওদের সাথে না গিয়ে বললে, “নিধির হয়তো পা ব্যথা করছে। তোমরা যাও। আমি ওকে নিয়ে রিকশা করে আসছি।” বলেই কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিধির হাত ধরে পাশে দাঁড় করানো রিকশায় উঠে পড়লো।
নিধি রিকশায় ভালোভাবে বসে বললো, “এভাবে নিয়ে এলে কেন? আর এত ভালোবাসা কবে হলো আমার প্রতি যে পা ব্যথা না হতেই এত চিন্তা।”
সিয়াম রাগান্বিত স্বরে বললো, “তোর সাথে এখন কথা বলার মুড নেই আমার। চুপচাপ বসে থাক না-হয় ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেব। আর ভালোবাসার কথা বলছিস? সেটা তোর প্রতি কোনোকালেই ছিল না আমার।”
নিধি কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইলো। কান্নাও এখন আর আসে না। এর চেয়ে আরো কত খারাপ ব্যবহার করে সে। এটুকুতে কী-বা যায় আসে।
এদিকে সিয়াম চলে যেতেই স্বস্তির শ্বাস ফেললো নিরু। ফারহানের একহাত জড়িয়ে হাঁটতে লাগলো আপন মনে। কোনোদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। শুধুমাত্র মনের শান্তি আছে। আর ফারহানের দৃষ্টি তো নিরুতেই সীমাবদ্ধ। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে পাশে থাকা নারীটির দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই নিরুর খোপা থেকে খুলে আসা সামনের ছোট চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিল। নিরু মিষ্টি হেসে তার দিকে তাকালো।
ফারহান শীতল স্বরে বললো, “তুমি এত সুন্দর কেন নিরু?”
নিরু লজ্জামিশ্রিত হেসে বললো, “আপনার দেখার দৃষ্টি সুন্দর। তাই আপনার চোখে আমাকে সুন্দর লাগে।”
নিরু একটু থেমে আবারো বললো, “আপনি আমাকে ভালোবাসেন তাই আমাকে সুন্দর লাগে। ভালোবাসার মানুষের সবই তো সুন্দর তাই-না?”
ফারহান মাথা নাড়িয়ে নিরুর মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়ে বললো, “এবার একদম বউ বউ লাগছে। আমার বউ।”
নিরু লজ্জায় মাথা কিছুটা নোয়ালো।
ফারহান ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে নিরুর মাথাটা উপরে তুলে বললো, “তুমি এখনো এত লজ্জা পাও কেন বলো তো।”
নিরু আশেপাশে তাকিয়ে বললো, “আপনি রাস্তায় কী শুরু করেছেন বলুন তো?”
“বেশি মানুষজন তো নেই আর কী এমন করলাম? জাস্ট ঘোমটা দিয়ে দিলাম।”
“হয়েছে চলুন।”
নিশ্চুপ হয়ে ওরা দুজন সামনের দিকে চলতে লাগলো। হঠাৎ করে নিরু বললো, “শুনুন।”
“হুম, বলো।”
“আমি কালই ওই বাসায় ফিরে যেতে চাই।”
“তুমি না কালই বললে দুদিন পরে যাবে।”
“আমার আর ভালো লাগছে না এখানে থাকতে। এখানে থাকলে নিধির কাছে যেতে ইচ্ছা করবে। আর ওই লোকটার মুখোমুখি হতে হবে। তার দৃষ্টি আমার মোটেও সুবিধার লাগছে না। কেমন যেন একটা। থাকতে চাই না আমি এখানে। কালই ফিরে যাব।”
“আচ্ছা, তাহলে কাল সকালে তোমাকে বাড়িতে দিয়ে তারপরে আমি অফিসে চলে যাবো।”
“আচ্ছা।”
আরো বিভিন্ন কথা বলতে বলতে ওরা বাড়িতে পৌঁছে গেল। রাস্তা কখন ফুরিয়ে গেছে টেরই পায়নি।
ফারহান রুমে এসেই বিছানায় শুয়ে পড়লো। নিরু ভ্রু কুঁচকে বললো, “এই আপনি ফ্রেশ না হয়েই শুয়ে পড়লেন কেন? তাড়াতাড়ি উঠুন। ফ্রেশ হবেন আগে।”
ফারহান না উঠে নিরুর হাত ধরে টান দিল। নিরু টাল সামলাতে না পেরে সোজা এসে ফারহানের বুকের উপর পড়লো। নিরু মাথা তুলে উঠতে চাওয়ার আগেই ফারহান ওর মাথা বুকের সাথে চেপে ধরে বললো, “চুপচাপ শুয়ে থাকো। নড়বে না। শান্তি লাগছে।”
নিরু আর কিছু না বলে চুপটি করে রইলো। তার নিজেরও উঠতে ইচ্ছা করছে না।
___________________
সিয়াম বাড়িতে এসেই একের পর এক সিগারেট খেয়েই চলেছে। আর নিধি বিছানায় বসে আছে। দিন দিন জীবনটা অসহ্য হয়ে যাচ্ছে তার। এভাবে চলতে থাকলে কবেই না জানি মানসিক অত্যাচারের জেরে মৃত্যু হয় তার। সিয়ামের কাছ থেকে এর জবাব চাইতে খুব করে ইচ্ছা করে কিন্তু সাহসে কুলিয়ে উঠতে পরে না। তার ভুলের কারণেই তো তার জীবন এখানে এসে পৌঁছেছে। সে তো নিজেই সিয়ামকে প্রপোজ করেছিল। ভালোবাসার কথা চেপে না রেখে বলে দিয়েছিল। সিয়ামও রাজি হয়ে গিয়েছিল। ভালোই চলছিল সম্পর্ক। সম্পর্কের বয়স যদিও খুব কম ছিল। মাত্র ছয় মাস। তবুও সিয়াম শুরুতে ভালোবাসা দেখিয়েছে প্রচুর। তাই তো নিধি আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল ওর সাথে। তবে কেন এখন নিরুকে চায় সে? কেন ওর জীবনটা এভাবে নষ্ট করছে?
নিধি সিয়ামের সামনে গিয়ে আজ সাহস করে বলেই ফেললো, “কেন আমার জীবনটা নষ্ট করছো তুমি? কী ক্ষতি করেছি আমি তোমার?”
চলবে__??