হঠাৎ হাওয়া,পর্বঃ০৯,১০

হঠাৎ হাওয়া,পর্বঃ০৯,১০
সুমনা ইসলাম
পর্বঃ০৯

পরেরদিন সকালবেলায়ই নিরুর শ্বশুর-শাশুড়ি গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরে এল। নিরু দুজনকেই সালাম দিল। ফারহানের মা ওকে জড়িয়ে ধরে বললো, “কেমন আছো মা?”

নিরুও তার শাশুড়িকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরলো। দুজনের সাথেই কুশল বিনিময় করে বললো, “আপনারা রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন। অনেকটা রাস্তা জার্নি করে এসেছেন। ক্লান্ত লাগছে নিশ্চয়ই?”

ফারহানের মা রুমের দিকে যেতে যেতে বললো, “ফারহান অফিসে চলে গেছে?”

“জ্বি, এইতো কিছুক্ষণ আগেই বেরোলো।”

ফারহানের মা আর কিছু না বলেই ফ্রেশ হতে চলে গেলেন। বয়সের ভারে ক্লান্তি যেন একটু বেশি-ই।

___________________

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। নিরু ওর শাশুড়ি মায়ের সাথে বসে গল্প করছে। গ্রামের পরিবেশ কেমন সেখানে কেমন দিনকাল কেটেছে এসব নিয়েই কথা বলছেন মিসেস মুক্তা। আর নিরু অধীর আগ্রহ নিয়ে সেসব শুনছে।

কথায় কথায় মিসেস মুক্তা বললেন, “এর পরের বার যখন যাবো তখন তোমাকে আর ফারহানকেও সাথে করে নিয়ে যাবো। এবারই তো সকলে বউ দেখতে চেয়েছিল। সবার মুখেই শুধু এক কথা, নতুন বউকে কেন নিয়ে আসলে না। নতুন বউ দেখবো৷ ছেলেদের মধ্যে ফারহান সবচেয়ে ছোট হওয়ায় বরাবরই অনেক আদরের ও। তাই ওর বউ দেখার জন্যও সবাই এত উতলা হয়ে আছে। বিয়েতে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল সবাইকেই কিন্তু সবাই-ই তো আর অত দূর থেকে আসতে পারেনি।”

“মা, ওখানে কী দাদা-দাদিও আছে?”

মিসেস মুক্তা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “না, মা মানে আমার শাশুড়ি মারা গেছেন আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে। তার মারা যাওয়ার কিছুদিন পরে বাবাও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান। এখন সেখানে শুধু ফারহানের বড় কাকা আর ফুপু থাকেন।”

“ওহ।”

নিরু একটু থেমে ইতস্তত করে বললো, “মা, আমি একটু বাবার বাড়িতে যেতে চাই যদি আপনারা অনুমতি দেন তো।”

ফারহানের মা একটু হেসে বললেন, “এতে এত ইতস্তত করার কী আছে? কম দিন তো হলো না এসেছো। সেই যে বৌভাতের দিন গিয়েছিলে তারপরে তো আমরা গ্রামে গেলাম। আমি ফারহানকে বলে দেবো। ও না-হয় কাল তোমাকে নিয়ে যাবে।”

নিরু খুশি হয়ে ওর শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরলো। খুব বেশি-ই আনন্দ হচ্ছে। কতদিন পর বাবা-মা, ভাইয়ার কাছে যাবে। শুধু ফোনে কথা বলে কী আর সাধ মেটে?

___________________

আজ সন্ধ্যার পরপরই বাসায় ফিরলো ফারহান। আগে বাবা-মায়ের সাথে দেখা করে তারপর রুমে এল। নিরু বারান্দায় বসে আছে। বাইরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখেমুখে খুশির ঝলক বিদ্যমান।

ফারহান নিজেও হেসে প্রশ্ন করলো, “আজ এত খুশি খুশি লাগছে কেন আমার বউকে?”

নিরু হাসিমুখে বললো, “আমাকে বাড়িতে নিয়ে যাবেন? আমি মাকে বলেছি মা বলেছে যেতে।”

ফারহান একটু মন খারাপ করে বললো, “তোমাকে ছাড়া থাকতে হবে আমার?”

“কেন? আপনিও তো যাবেন আমার সাথে। আমি কী একা একা যাবো না-কি?”

“একা যাবে না। আমি-ই নিয়ে যাবো। কিন্তু তোমার সাথে তো আর থাকতে পারবো না। আমার অফিস তোমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে। যাওয়া-আসা ঝামেলা। আর শ্বশুরবাড়িতে থাকতে কেমন লাগবে না?”

“কেমন আবার লাগবে? আমি তো আমার শ্বশুরবাড়িতেই আছি না-কি?”

“আরে সেটা কথা না। কথা হলো আমার অফিস নিয়ে।”

নিরু একটু মন খারাপ করে বললো, “তাহলে আমাকে দিয়েই চলে আসবেন আপনি?”

“হুম। কয়দিন থাকবে? বেশিদিন কিন্তু থাকা যাবে না বলে দিলাম।”

“এক সপ্তাহ তো থাকবোই।”

ফারহান অসহায় মুখ করে বললো, “এক সপ্তাহ? এত দিন থাকবো কীভাবে তোমাকে ছাড়া?”

“এতদিন কোথায়? মাত্র সাত দিন-ই তো। কতদিন পর যাবো আর এ ক’টা দিন থাকবো না? বিয়ের আগে যেভাবে থাকতেন এখনো সেভাবেই থাকবেন।”

“বিয়ের আগে তো আর বউ ছিল না। তাই একাই থাকতে পারতাম। এখন তো বউ আছে তাই একা থাকার কথা ভাবতে পারি না। তোমাকে প্রচন্ড মিস করবো।”

“আপনি আমাকে কালকে সকালে নিয়ে যাবেন কি-না সেটা বলুন তো আগে। আমার তো আবার গোছগাছ করতে হবে।”

“আচ্ছা নিয়ে যাবো। আমার বউ আমার কাছে আবদার করেছে সেটা রাখবো না তা কী হয়। তবে শর্ত হচ্ছে পাঁচ দিন থাকতে হবে।”

নিরু করুণ স্বরে বললো, “সাত দিন প্লিজ।”

“আচ্ছা আচ্ছা। এভাবে বললে মানা করবো কী করে?”

নিরু মেকি হেসে রুমে চলে গেল ব্যাগ গোছাতে। আর ফারহান বিছানায় বসে বসে তার কাজকর্ম দেখছে। নিরু ফারহানের জামাকাপড় ব্যাগে রাখতেই ফারহান বললো, “আমার জামাকাপড় ব্যাগে রাখছো কেন?”

“আপনি যদি হঠাৎ করে চলে যান তাহলে কী পড়বেন? সাতদিন বাসায় থাকবেন বলে তো মনে হয় না।”

“তুমি আমাকে এত বোঝো কী করে বলো তো।”

“এতদিনে এটুকু বুঝতেই পারি।”

ফারহান নিরুর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললো, “ভালোবাসো আমায়?”

নিরু কিছু না বলে বরাবরের মতোই চুপ করে রইলো।

ফারহান উত্তরের আশায় না থেকে নিরুকে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো। কবে নিজের মুখে বলবে?”

নিরু এবারেও কোনো উত্তর না দিয়ে চুপটি করে রইলো। সে নিজেও বুঝতে পারে যে তার মনে ফারহানের জন্য ভালোবাসার অনুভূতি আছে। কিন্তু বলতে পারে না। কোথাও একটা জড়তা এসে ভর করে। অনুভূতি গুলো স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ করতে পারে না।

______________________

পরেরদিন সকালবেলা ফারহান নিরুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে। ওকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে তারপরে অফিসে চলে যাবে। তাই একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়েছে।

নিরুকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে ফারহান চলে যেতে নিলেই নিরু ওকে আটকে দেয়। বাবা-মায়ের সাথে দেখা করে যেতে বলে। ফারহানও তাই করে। বিয়ের পর দ্বিতীয় বার শ্বশুরবাড়ি আসা হলো তার। সবার সাথে দেখা করে না গেলে ব্যাপারটা কেমন যেন অন্যরকম দেখায়।

ফারহান ভেতরে গিয়ে সবার সাথে কুশল বিনিময় করে নিরুকে বিদায় জানিয়ে অফিসে চলে গেল।
যাওয়ার সময় বলে গেছে সম্ভব হলে রাতে আসবে। আসার সম্ভাবনাই বেশি।

সারাদিন মায়ের সাথে গল্পগুজব করে কেটে গেল নিরুর। ফারহানের সাথেও ফোনে কথা হয়েছে টুকটাক।

_________________

রাত নয়টা বাজে। ফারহান এখনো আসেনি দেখে নিরু ভাবছে ফারহান হয়তো আজকে আর আসবে না। তাই মিস করার পরিমানটাও বেড়ে গেছে। সারাদিন অন্যান্য দিনের মতো হলেও এখন ফারহানের শূন্যতা অনুভব করছে। অন্য দিনগুলোতে তো এমনিতেও দিনে বাড়িতে থাকে না কিন্তু সন্ধ্যার পরে ঠিকই আসে। আজ আসছে না বলেই এত শূন্যতা।

নিরুর মনে ফারহানের জন্য অনুভূতিগুলো ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় নিরুর কাছে। ভেবেছে আজই বলে দেবে ফারহানকে তবে তার তো আসার নাম-গন্ধই নেই।

মন খারাপ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে নিরু। তার দৃষ্টি গেটের দিকে। ফারহান আসছে না-কি দেখার জন্যই মূলত সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা।

রাত দশটায় ফারহান আসলো। নিরুর মা, বাবা, নাহিদের সাথে কথা বলে নিরুর রুমে এল। নিরু এখনো বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।

ফারহান ফ্রেশ হয়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

নিরু ওকে দেখে বললো, “এত লেট করলেন কেন?”

ফারহান নিরুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো, “এতটাই মিস করছিলে আমাকে?”

“হুম প্রচুর। আপনি আমাকে মিস করেননি বুঝি?”

“অনেক মিস করেছি। তাই তো দেরি করে হলেও চলে এলাম।”

“আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।”

“হুম বলো।”

“আসলে…”

“কী?”

নিরু চোখ বন্ধ করে একদমে বলে ফেললো, “আমি আপনাকে ভালোবাসি।”

ফারহানের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। নিরুকে আরেকটু গভীরভাবে স্পর্শ করে বললো, “আমিও অনেক ভালোবাসি নিরুপাখি।”

নিরু এখনো লজ্জায় চোখ বন্ধ করে আছে।

ফারহান আর কিছু না বলে চুপ করে রইল। মনের ভেতরে শান্তি লাগছে তার। ভালো লাগছে। ভীষণ ভালো লাগছে। এই প্রথম তার নিরু তাকে ভালোবাসার কথা বললো। ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে।

বেশ কিছুক্ষণ পর নিরু নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, “খিদে পায়নি আপনার? খাবেন চলুন। রাত তো অনেক হলো।”

“তুমি খেয়েছো?”

“না, আমি জানতাম আপনি আসবেন। তাই ওয়েট করছিলাম।”

“আচ্ছা, চলো। বাকি সবাই খেয়েছে?”

“হুম।”

নিরু আর ফারহান ড্রয়িংরুমের দিকে যেতেই দেখলো কেউ নেই সেখানে। পুরো ড্রয়িংরুম ফাঁকা। তারমানে সবাই যার যার রুমে চলে গেছে।
ওরা দুজনে ডিনার করে রুমে চলে এল। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। আপাতত কারোর চোখেই ঘুম নেই তাই বারান্দায় বসে এত সুন্দর আবহাওয়াটা উপভোগ করাই শ্রেয়। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে দুজন।

নীরবতা ভেঙে ফারহান বিমোহিত স্বরে বললো,
“গুমোট পরিবেশে হঠাৎ হাওয়া এলে যেমন মনের মাঝে মুগ্ধতা ছেয়ে যায়, তেমনি তোমার সাথে প্রথম দেখায় আমার মনের মাঝেও মুগ্ধতা ছেয়ে গিয়েছিল।”

নিরুও একমনে ফারহানের কথা শুনছিল। এবার কৌতুহল নিয়ে বললো, “আপনি আমাকে প্রথম কোথায় দেখেছিলেন?”

ফারহান এবার কোনো হেয়ালি না করেই বললো, “প্রায় মাস চারেক আগে এই বাড়ির কাছের পার্কের সামনে।”

নিরু প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “আমার সম্পর্কে এতকিছু কীভাবে জানলেন? ওই লোকটাকে ওইদিন বলেছিলেন যে আমি কাউকে ভালোবাসি না-কি কারো সাথে কখনো ঘুরতে গিয়েছি না-কি এসবও জানেন।”

“নিধির কাছ থেকে জেনেছি।”

নিধির নামনটা শুনেই মুখটা কালো হয়ে গেল নিরুর। একটু অবাক হয়েই বললো, “নিধির থেকে!”

“হুম, সেদিন আমি যখন এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন তুমি আর নিধি রাস্তার পাশ দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিলে৷ তোমাকে দেখার সাথেসাথেই মুহূর্তের মাঝেই দৃষ্টি আটকে গেছিলো আমার। তোমরা কথা বলতে বলতে যাচ্ছিলে। নিধির মামাবাড়ি আমাদের বাড়ির কাছেই। সে সূত্রে ওকে আগে থেকেই চিনতাম। পরেরদিন আবার একই সময়ে আসি তোমাকে একটি বার দেখার আশায়। কিন্তু তুমি সেদিন ছিলে না। নিধি একাই যাচ্ছিলো। ওকে তোমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি৷ ও প্রথমে বলতে চাচ্ছিলো না। পরে অনেক রিকুয়েস্ট করায় বলেছিল। সবই জেনেছিলাম ওর থেকে, তোমার পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারেও। সবকিছু জানার একটাই কারণ, তোমার জীবনে কেউ থাকলে আমি সরে যেতাম৷ কিন্তু কেউ ছিল না জেনে কী পরিমাণ খুশি হয়েছিলাম সেটা তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। তখনই বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে চেয়েছিলাম কিন্তু সামনে তোমার এইচএসসি পরীক্ষা ছিল তাই দূরে থেকেই খোঁজ নিতাম তোমার। আর পরীক্ষার পরেই ডিরেক্ট বিয়ে।”

নিরু একটু মন খারাপ করে বললো, “ওহ।”

ফারহান মন খারাপের কারণটা আন্দাজ করতে পেরে বললো, “নিধির জন্য মন খারাপ করছে?”

চলবে__??

হঠাৎ হাওয়া
সুমনা ইসলাম
পর্বঃ১০

ফারহানের কথায় নিরু মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। নিধির জন্যই মন খারাপ হচ্ছে তার। কতটা দিন হয়ে গেল মেয়েটার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। কোথায় আছে, কেমন আছে কিচ্ছু জানা নেই।

ফারহান আর কিছু না বলে নিরুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

নিধি নিরুর ছোট বেলার বান্ধবী। স্কুলে ভর্তি হয়েছে থেকে নিধির সাথে তার বন্ধুত্ব। স্কুল, কলেজ, কোচিং সব জায়গায়ই দুইজন একসাথে পড়ালেখা করেছে। বাড়িও পাশাপাশি। একজনের এমন কোনো কথা নেই যা অন্যজন জানতো না। বোনের মতো ছিল একদম। দুজনে সবসময় একসাথেই থাকতো। অন্যরকম একটা টান ছিল দুজনের মাঝে। কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হতেই নিধি পালিয়ে গেল তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে। ছেলেটা মোটেও ভালো নয়। নিরু বাঁধা দিয়েছিল ওকে কিন্তু শোনেনি। পালিয়ে যাওয়ার সময় ফোনটাও বাড়িতে রেখে গিয়েছিল। তারপর থেকে আর কোনো যোগাযোগই হয়নি। নিরুর তো মাঝেমধ্যে সন্দেহ হয় যে ছেলেটা ওর কোনো ক্ষতি করে দেয় নি তো?

ফারহান নিরুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে স্বান্তনার স্বরে বললো, “মন খারাপ করো না প্লিজ। দেখো একদিন নিধি ঠিকই ফিরে আসবে।”

নিরু ভেজা স্বরে বললো, “কবে আসবে ও? ওই লোকটা ওর কোনো ক্ষতি করেনি তো? ও ঠিক আছে তো?” বলতে বলতেই নিরুর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।

“নিধির ক্ষতি করবে কেন?”

“ওই লোকটা একটা গুন্ডা। একদম ভালো ছেলে নয়।”

“যদি সে নিধিকে ভালোবেসে থাকে তাহলে কখনো কোনো ক্ষতি করবে না আর যদি ভালোই না বাসে তাহলে ক্ষতি করতে দু’বার ভাববে না।”

“ওর মামারা শুনেছি অনেক ক্ষমতাবান তারা কী ওকে খুঁজতে চেষ্টা করেনি? আপনাদের বাড়ির কাছেই না-কি বাসা। আপনি কিছু জানেন না?”

“ওইসব কথা কী আর কেউ জনসম্মুখে বলে বেড়ায়? খুঁজলেও হয়তো গোপনে খুঁজেছে। কাউকে জানায়নি। নিধির পালানোর কথাটাই শুধু শুনেছিলাম। এর বেশি কিছু না।”

“ওহ।”

ফারহান নিরুর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো, “হুম,এবার একটু শান্ত হও। চলো ঘুমাবে। অনেক রাত হয়েছে। একদম কাঁদবে না।”

ফারহান নিরুকে শান্ত করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

__________________

পরেরদিন সকালে ফারহান অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। আর নিরু বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে।

ফারহান টাই বাঁধতে বাঁধতে একটু রাগী স্বরে বললো, “তোমাকে বলেছি না দাঁত দিয়ে নখ কাটবে না। আবারো একই কাজ করছো।”

নিরু মুখ থেকে হাত সরিয়ে ভদ্র মেয়ের মতো বসে রইলো।

ফারহানের রেডি হওয়া শেষ হলে নিরু উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “আজকে আসবেন আপনি?”

“না আসার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা কালকে সকালে একটা মিটিং আছে। আর এখান থেকে গেলে মিটিংয়ে দেরি হয়ে যাবে।”

নিরু মন খারাপ করে বললো, “ওহ, আচ্ছা।”

ফারহান নিরুর কপালে একটু সময় নিয়ে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে বললো, “মন খারাপ করো না। কালকে আসবো।”

“আচ্ছা।”

ফারহান নিরুকে বিদায় জানিয়ে অফিসে চলে গেল আর নিরু তার মায়ের রুমে গেল। মায়ের সাথে বসে গল্প করবে এখন। দিন তো পেরিয়েই যাচ্ছে। ওবাড়ির কথাও মনে পড়ছে।

নিরুর মা ওকে সংসার সামলানোর বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনা দিচ্ছে। মাকে বারণ করা স্বত্তেও বলেই যাচ্ছেন তাই নিরু আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ সেগুলো শুনছে আর হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলাচ্ছে।

___________________

আজ ফারহান আসবে না তাই নিরু তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম পাচ্ছে তার। ফারহান আসলে তবুও জেগেই থাকতো।

রাত এগারোটায় ফোন করলো ফারহান। নিরু ঘুম থেকে জেগে রিসিভ করতে করতেই প্রথমবার কল কেটে গেল। পরেরবার কল আসতেই নিরু রিসিভ করে ঘুমঘুম কণ্ঠে বললো, “হ্যালো?”

ফারহান নিরুর ঘুমন্ত কণ্ঠস্বর শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। নিরুর ভারী শ্বাসগুলো অনুভব করছে।

নিরু আবারো বললো, “হ্যালো? শুনতে পাচ্ছেন?”

ফারহান এবার কোমলভাবে বললো, “ঘুমিয়ে ছিলে?”

নিরু একটা হাই তুলে বললো, “হুম। এতরাতে কল করলেন যে?”

“এতরাত কোথায়? সবেমাত্র এগারোটা বাজে। কালকের মিটিংয়ের জন্য সব কাজ শেষ করে একটু আগে ফ্রি হলাম। বউয়ের কথা মনে পড়ছিল তাই কল দিলাম কিন্তু বউ তো আমার ঘুমে ব্যস্ত।”

“আসলে প্রচুর ঘুম পেয়েছিল তাই তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷ খেয়েছেন আপনি?”

“না।”

“এখনো খান নি কেন?”

“কাজ করছিলাম তো।”

“এখন গিয়ে তাড়াতাড়ি খেয়ে আসুন। রাখছি আমি।”

ফারহান অসহায় স্বরে বললো, “একটু কথা বলে যাই। আমি জানি এখন আমি খেতে গেলে তুমি আবার ঘুমিয়ে পড়বে।”

“ঘুমাবো না আমি। আপনি যান।”

“আমি জানি তুমি ঘুমিয়ে পড়বে। তোমার ঘুমের উপর একদম বিশ্বাস নেই আমার। একটু কথা বলে তারপরে খেতে যাবো।”

ফারহানের জেদের কাছে হার মেনে নিরু আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রাখলো।

_________________

নিরু আজ একটা হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি পড়েছে। ফারহান সেদিন বলেছিল ওকে না-কি হালকা গোলাপিতে বেশি মানায়। সাথে হালকা একটু সেজেছেও। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক আর চোখে কাজল। বাড়িতে কী আর এরচেয়ে বেশি সেজে থাকা যায় না-কি। রাত হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই হয়তো ফারহান আসবে।

নিরু শাড়ি পড়ে বিছানায় চুপচাপ বসে আসে। বাইরে বেরোচ্ছে না। অজানা কারণেই লজ্জা লাগছে তার। বিছানায় বসে বসে নখ কামরাচ্ছে। পরমুহূর্তেই ফারহানের কথা মনে পড়তে নখ নামিয়ে ফেললো। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। মানুষটার অনুপস্থিতিতেও তার ভালোবাসা, শাসন, বারণ গুলো খুব মনে পড়ে।

নিরু মনে মনে বলছে, “আমিও ভালোবাসি একজনকে। খুব ভালোবাসি। সে আর কেউ নয় আমার স্বামী। একান্তই আমার নিজের। তার উপর কোনো পরনারীর অধিকার নেই। সে শুধু আমার। আমার ভালোবাসা।”

ফারহান রুমে প্রবেশ করতে দরজা পর্যন্ত আসতেই দেখলো নিরু মনে মনে কী যেন ভাবছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। ফারহান ওকে শাড়িতে দেখায় কিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। পরমুহূর্তেই দুষ্টু হেসে রুমে ঢুকে বললো, “কী হলো একা একা হাসছো কেন?”

নিরু একটু থতমত খেয়ে গেল। মেকি হেসে বললো, “না, কিচ্ছু না। এমনি হাসছিলাম।”

ফারহান পূর্বের মতোই বললো, “হঠাৎ শাড়ি পড়েছো যে? আমাকে ইমপ্রেস করার জন্য বুঝি?”

নিরু আঁড়চোখে তাকিয়ে বললো, “আপনাকে ইমপ্রেস করার জন্য কেন পড়বো? আমার এমনি ইচ্ছা করছিলো তাই পড়েছি। আপনার জন্য শাড়ি পড়তে আমার বয়েই গেছে। হুহ।”

ফারহান মুখ চেপে হেসে বললো, “জানি আমি।”

“কচু জানেন আপনি। যান গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন।”

“উঁহু। আমি এখন আমার বউকে দেখবো। শাড়িতে কত্ত সুন্দর লাগছে আমার নিরুপাখিকে।”

নিরু লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো।

ফারহান ওর মাথা উপরে তুলে বললো, “এত লজ্জা পাও কেন বলোতো? লজ্জা পেলে তো তোমাকে একদম চেরি ফলের মতো লাগে।”

নিরু ভ্রু কুচকে বললো, “চেরি ফল!”

“হুম, লাল টুকটুকে চেরি ফল।”

নিরু কিছু না বলে লজ্জামিশ্রিত হাসলো।

ফারহান ওর একদম কাছে গিয়ে বসলো। নিরু একটু ইতস্তত করে বললো, “ফ্রেশ হবেন না আপনি?”

“উঁহু।”

“তাহলে?”

“তোমাকে দেখবো।”

নিরু আর কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইলো। ফারহান মোহাচ্ছন্ন কণ্ঠে বললো, “তোমাকে ভালোবাসার অনুমতি দেবে আমায়? একটু ভালোবাসবে৷ নিরুপাখি?”

নিরুর শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত ওঠা-নামা করছে। কিছু বলতে পারছে না সে। ফারহানের বুকে মুখ গুঁজে রইলো সে। ফারহান মুচকি হেসে গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিল ওকে। ভালোবাসা পূর্ণতা পেল তাদের।

_________________

রাত বারোটা। ফারহানের বুকে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে নিরু। ফারহান তাকে আলতো স্বরে ডেকে বললো, “নিরু? উঠো। খাবে না? এই নিরু? উঠো। রাতে তো কিচ্ছু খাওনি মনে হয়।”

নিরু ঘুমের ঘোরে বললো, “একটু ঘুমাতে দিন প্লিজ।”

“তুমি তো এত ঘুমকাতুরে ছিলে না। এত ঘুমকাতুরে হলে কবে?”

“জানেন এখানটায় না অনেক শান্তি। ঘুম আপনা-আপনি এসে যায়। আপনি…।”

নিরু আর কিছু বলার আগেই আবারো ঘুমিয়ে পড়লো। ফারহান এবার বুঝতে পারলো যে নিরু এতক্ষণ ঘুমের ঘোরে কথা বলছিল। নাহলে কিছুতেই বলতে পারতো না। লজ্জায় মিইয়ে যেত।

ফারহান ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে নিরুকে আবারো জড়িয়ে ধরে নিজেও ঘুমিয়ে পড়লো।

______________________

পরেরদিন সকালে নিরু ঘুম থেকে দেরি করে উঠলো। বেশ বেলা হয়েছে। বিছানা হাতড়ে ফারহানকে কোথাও পেল না। দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকাতে আরো একটু চমকে গেল নিরু। নয়টার বেশি বাজে।

নিরু বিড়বিড় করে বললো, “উনি কী তাহলে অফিসে চলে গেছেন? এত বেলা করে কেন যে ঘুমালাম। উনি আমাকে না বলেই চলে গেলেন?”

নিরু মন খারাপ করে উঠে শাওয়ার নিতে চলে গেল।

শাওয়ার নেওয়া শেষে চুল মুছতে মুছতে বিছানার কাছে আসতেই দেখলো পাশের টেবিলে একটা চিরকুট রাখা। তখন বেখেয়ালিতে চোখে পড়ে নি।

নিরু চিরকুটটা হাতে তুলে নিল। তাতে লেখা-

“তোমার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হচ্ছিলো দেখে চিরকুটটা লিখে রেখে গেলাম। মন খারাপ করো না তোমাকে না বলে চলে এসেছি বলে। আসলে তুমি শান্তিতে ঘুমাচ্ছিলে দেখে আর জাগাই নি। রাতে আসতে পারলে ফোন করে জানিয়ে দেব। এখন খেয়ে নেবে। রাতে তো মনে হয় কিছুই খাও নি। ডাকলাম তাও উঠলে না।”
—-ফারহান

নিরু মুচকি হেসে চিরকুটটা ডায়েরির ভাজে রেখে খেতে চলে গেল।

পেরিয়ে গেছে আরো তিনটে দিন। ফারহানের উপস্থিতি কখনো অনুপস্থিতিতে দিন কেটেছে নিরুর। কাল ও শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যাবে। আরো দু’দিন থাকতে চেয়েছিল কিন্তু ফারহান রাজি-ই হলো না। অনেকদিন থাকা হয়েছে। আবার না-কি কয়েকদিন পর নিয়ে আসবে।

সকাল এগারোটা বাজে। নিরু অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিল আজ নিধিদের বাড়িতে যাবে। নিধি পালিয়ে যাওয়ার পর আর ওবাড়িতে যাওয়া হয়নি। ওর বাবা-মা মুখে কিছু না বললেও তারা নিরুর উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। তাই নিরুও যেতে ভয় পেত। কিন্তু আজ কেন যেন খুব যেতে ইচ্ছা করছে।

চলবে__??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here