হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া,১ম পর্ব
হেমন্ত হাসান
মেসেজের টুং শব্দে ঘুম ভাঙলো।একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে।
কেউ একজন লিখেছে,
“আজকে সন্ধ্যায় বৃষ্টি হবে সাথে ঝড়ো হাওয়া।সাবধানে থাকবেন।”
আজব! কে দিবে এমন মেসেজ।পরিচিত হয়তো কেউ মজা করছে।কল দিলাম সেই নাম্বারে।ফোন বন্ধ। অবাক হলাম ।মেসেজ দিয়ে আবার ফোন বন্ধ করে রেখেছে।
.
সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ দমকা হাওয়া বওয়া শুরু করলো।আমি মাত্র বাহিরে বের হয়েছি তখন তখনই এই ঝড়।
বাতাসের ঝাপটা একটু কমতেই বৃষ্টি শুরু হলো।সে কি তেজ!
বৃষ্টির ভাব দেখে মনে হচ্ছে আজকে ঢাকা শহরকে ভাসিয়ে ফেলবে।
.
হালকা ভিজে, হালকা নিজেকে বৃষ্টির পানি থেকে বাচিয়ে বাসায় আসলাম।মা কফি দিয়ে গেল।গরম কফি নিয়ে অন্ধকার বারান্দায় বসে আছি।বৃষ্টির তেজ এতোক্ষণে একটু কমেছে। ঠান্ডা বাতাস আসছে হু হু করে বাহির থেকে। ভালই লাগছে ।মনের ভেতরটা প্রশান্তিতে ভরে যাচ্ছে।রাত আটটার মত বাজে।আগামীকাল ভারসিটিটে পরিক্ষা আছে একটা।পড়তে বসতে হবে।
মোবাইলটা হাতে নিলাম।সাথে সাথেই মনে পরলো ওই মেসেজের কথা।আজব! এরপর আর কিছুই বললো না।
বৃষ্টি হবে, ঝড় বইবে এ কথা আমাকে কেন জানালো?
.
টুং করে মোবাইলে মেসেজ আসলো।সেই নাম্বার থেকে আবার এসেছে। লিখেছে,
“ঝড়ো বাতাসে আমাকে অনুভব করেছিলেন?আমি কিন্তু আপনাকে ঠিকই স্পর্শ করে গেছি।”
মেসেজটা দেখে কিছুই বুঝলাম না।কিছু বোঝা বা না বোঝার আগে ফোন দেয়া উচিৎ। কিন্তু অবাক করার মত ব্যাপার এবারও ওই পাশ থেকে শব্দ আসলো,”আপনি যেই নাম্বারে কল দিয়েছেন তা এই মুহুর্তে বন্ধ আছে। অনুগ্রহ করে…….”
.
কে দিবে এমন মেসেজ। কোন বন্ধু হয়তো মজা করছে।থাক এই বিষয় নিয়ে চিন্তা করার কোন কারন দেখছি না। আপাতত পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়া উচিৎ।
.
রাতের দিকে আরেকবার বৃষ্টি হয়ে গেল।ঠান্ডা ঠান্ডা একটা ভাব চারদিকে।অন্ধকার ঘড়ে শুয়ে আছি।ঘুম আসছে না।সকালে উঠতে হবে, পরিক্ষা।
হঠাৎ ওই নাম্বার থেকে আবার মেসেজ আসলো৷
“আপনি ইচ্ছা করলেই নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন।আপনাদের পরিক্ষা কাল হচ্ছে না।”
কি ব্যাপার?কে উনি?মনের ভেতরটা জানি কেমন করে উঠলো।একটু পর আমি নিজের অজান্তেই আবিষ্কার করলাম এই উড়ো মেসেজের প্রতি আমার হালকা ভরসা জন্মে গেছে।কারন আমি বিশ্বাস করে ফেলেছি আসলে কাল পরিক্ষা হবে না।
.
ঘুম থেকে উঠলাম ছ’টায়।সকাল আটটার দিকে পরিক্ষা আরেকটু আগে পৌছে যেতে হবে।
সকালে উঠে নোটিফিকেশন চেক করা আমার একটি অভ্যাসে দাড়িয়েছে । নোটিফিকেশন চেক করতেই দেখলাম আজকের পরিক্ষা ক্যান্সেল করা হয়েছে।আনন্দে লাফাতে মন চাচ্ছে।একে তো ভাল করে পড়া হয় নি তাছাড়া এতো সকালে উঠতে কারই বা মন চায়?
.
মেসেজের কথাটা মনে পরলো।কিভাবে জানলো আজকে পরিক্ষা হবে না?যাইহোক আগে ঘুম পরে কথা।
.
পরিক্ষা ক্যান্সেল হলেও ক্লাস আছে।দশটার দিকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ভারসিটির জন্য রউনা দিলাম।
ভারসিটির বাস এখন আর পাবো না।যেতে হবে লোকালে।
অনেক মানুষ দাড়িয়ে আছে বাসের জন্য।বাস আজকে কম মনে হচ্ছে।
এই সময় সামনে একটা প্রিমিও কার থামলো।গাড়ির কাচটা নেমে যেতেই দেখলাম একটি খুবই অপরুপ মেয়ে।
মেয়েটা এদিক তাকিয়ে এক্সকিউজ মি বলল।
মনে হয় আমাকেই বলেছে।আশাপাশে অনেক মানুষ থাকলেও কেউ নেই মনে হচ্ছে।
আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম,
“জ্বি, আমাকে বলছেন?”
“আসলে একটা বিপদে পরেছি যদি একটু হেল্প করতেন খুব ভালো লাগত।”
এতো সুন্দর একটা গাড়ি থাকলে মানুষ আবার বিপদেও পরে।
“কি বিপদ?”
মেয়েটা একটু গলায় ঠেকে একটু দ্রুততার সাথে বলল,
“আসলে আমি একটা ঠিকানা খুজে পাচ্ছি না।যদি একটু হেল্প করতেন।”
মনে মনে বললাম, ওহ এই ব্যাপার।
মেয়েটার হাতে একটা কাগজ ছিল। আমার কাছে বাড়িয়ে দিল।ঠিকানাটা দেখলাম আমাদের পাশের বাড়ি আমি খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলাম।
মেয়েটা আমাকে অনেকবার ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেল।তাকে বলি নাই এই ঠিকানায় যেই বাড়ি তার পাশেই আমাদের বাসা।
.
আকাশের অবস্থা ভালো ঠেকছে না।কালো হয়ে যাচ্ছে।রাস্তার বালুগুলো বাতাসের উষ্কানিতে আন্দোলন শুরু করে দিয়েছে।যে যেভাবে পারছে মুখচোখ ঢাকছে।
এমন সময় কাঙ্ক্ষিত বাস পেলাম আর উঠে বসলাম।বাসে উঠার কিছুসময়ের মাঝেই বৃষ্টি নেমে গেল।
.
বাসের জানালা সব বন্ধ। নাহলে পানি ঢুকে পরবে ভেতরে।
আমি বসতে পারলেও অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।এইটুকু বাসে কত মানুষ।বাসের জানালা সব বন্ধ, তাতে এতো মানুষ
আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
হঠাৎ মেসেজের শব্দ।কেন জানি মনে হচ্ছে সে মেসেজ দিয়েছে।
আমার ধারনাই ঠিক। সেই অপরিচিত নাম্বার৷ লিখেছে,
“একটু বাসের জানালাটা খুলে দিন। দম বন্ধ হয়ে যাবে তো বৃষ্টির ফোটা গায়ে পরলে তেমন তো কোন সমস্যা নেই।”
.
যেহেতু একবারে শেষে জানালার কাছে বসেছি, তাই বাসের জানালা খুললে শুধু আমিই ভিজবো।
অল্প করে জানালাটা খুললাম।জানালাটা খোলার সাথে সাথেই বৃষ্টির পানি,ঠান্ডা বাতাস আর অসম্ভব সুন্দর এক সুগন্ধ আমার নাক-চোখ-মুখ স্পর্শ করে গেল।এইরকম সুন্দর গন্ধ আমি কোথাও পাই নাই।
মনটা ভরে গেল। পুরো রাস্তায় একটু একটু বৃষ্টির পানিতে ভিজতে লাগলাম।
.
ভারসিটি পৌছাতেই একটি বাজে সংবাদ শুনতে হলো।আমাদের আগের সেমিস্টারের শিক্ষক, হামিদ খান, আজকে সকালে ইন্তেকাল করেছে।
এখন সব ক্লাস বন্ধ। বন্ধু রাফি এসে বললো,”স্যারের সাথে যাবি?”
“হুম.. যাওয়া যায়।তুই?”
“যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, মামা।কিন্তু এখন আর যাবো না।”
“কেনো?ফখরুলরা তো যাচ্ছে।”
“এই জন্যই যাবো না।”
রাফি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু।ও না গেলে আমারও যাবার প্রশ্ন ওঠে না।
“আমিও যাবো না তাইলে। চল চা খাই। ”
.
টিএসসিতে এসে দুইজন দু কাপ চা নিলাম। রাফি স্যারের জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে একটা লেকচার মারছে।কিন্তু আমার মনোযোগ সেদিকে নেই।আমি ভাবছি সেই মেসেজের কথা।রাফিকে কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা?যদি কেউ মজা করে তাহলে আমি লজ্জিত হবো।
কিন্তু এইভাবে মজা নেয়া সম্ভব?
রাফির লেকচার থামিয়ে দিলাম।
“রাফি, তুই কি আমার সাথে মজা করতেসিস কোন?”
“কি মজা?”
রাফিকে অবাক লাগলো।নাহ,ও এ কাজ করবে না।
.
রাফিকে সব খুলে বললাম। মেসেজগুলো দেখালাম।ওই নাম্বারে ফোন দিলাম ফোন বন্ধ।
রাফি আমার কথাগুলো শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো।
এরপর বললো,
“আমার মনে হয় কেউ মজা নিচ্ছে ।”
“আমারও তাই মনে হলো।কিন্তু কিছু জিনিস তো আসলে বিভ্রান্তিতে ফেলিয়ে দেয়ার মত।”
রাফি চুপ।তারপর ওর মাথার লম্বা চুলে একটা নাড়া দিয়ে একটা ভয়ানক কথা বললো,”দেখ হেমন্ত, কেউ যদি মজাও করে, তার মানে এই দাড়াচ্ছে সেই লোক বা নারী তোকে ফলো করছে।সে হয়তো আশেপাশেই আছে অথবা নাই।”
রাফির কথা শুনে কেমন জানি ভয় ভয় লাগলো।চারপাশে একটু তাকালাম।এতোক্ষণ চারপাশ যেমন স্বাভাবিক লাগছিল এখন আর লাগছে না।মনে হচ্ছে প্রত্যেকটা মানুষ রহস্যে ঘেড়া।
ঠিক এই সময়ে একটা মেসেজ এলো।রাফির দিকে ভয় ভয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, “ওই নাম্বার থেকে।”
রাফি আগ্রহ নিয়ে বললো, “কি লিখেছে দেখ।”
আমরা দুইজন একই সাথে দেখলাম। লিখেছে,
“কারো সম্পর্কে বলার জন্য আমার তাকে ফলো করতে হয় না।আমি আপনার আশাপাশে কি দুরেও নেই।আমাকে নাগালের মাঝে পাওয়া যায় না।”
আমি রাফির দিকে তাকালাম।ওকে একটু কেমন জানি দেখাচ্ছে।ভয় পেয়েছে নাকি?
আমরা এতো আস্তে কথা বলছিলাম যে দুইজন বাদে অন্যকারো শোনা অসম্ভব। আর রাফিও একটা বারের জন্য ফোন হাতে নেয় নি।মানে কি দাড়াচ্ছে?
কেউ একজন আমার সব কাজ দূর থেকে দেখতে পারছে।
.
বাসায় আসলাম সন্ধ্যার দিকে।মাথাটা কেমন জানি ব্যাথা করছে।সব কিছু অসহ্য লাগছে।কি একটা কথা!আমি যা করছি কেউ একজন তা প্রত্যক্ষ করছে।
মানে আমি বাথরুমে গেলেও সে দেখছে।
এমন সময় মেসেজ আসলো।এখন মেসেজ আসলেই ভয় লাগে।
“আসলে উপরওয়ালা বাদে কেউই পারে না আরেকজনের সব কাজে, মনে দৃষ্টি দিতে।মানুষ যেটা পারে অনুমান করতে পারে।অনুমান শক্তি মাঝে মাঝে কারো খুবই শক্তিশালী হয়। বন্ধুর সাথে একটা মানুষ কি কথা বলবে, এরপর বন্ধু কি উত্তর দিতে পারে সবই অনুমানে বলা যায়।”
এবার কিছুক্ষণ অবাক হয়ে রইলাম।অনুমান শক্তি কারো এতো ভাল হয়? মনের কথাও বলে দেয়া যায়?
.
আসলেই যেই মেসেজগুলো আমাকে এই পর্যন্ত দিয়েছে সবই অনুমান করে বলা যায়।পরিক্ষা ক্যান্সেল হতে পারে, বৃষ্টিতে বাসের সব জানালা বন্ধ থাকে এগুলো অনুমান করে আসলেই বলা যায়।তবুও মনে একটা খটকা তো লেগেই আছে।
মেসেজ দিয়েই ফোন কেন অফ করে দেয়?কে এই অপরিচিত নাম্বারের মালিক।পুলিশ ফাইল করবো নাকি আরেকটু দেখবো?
.
হঠাৎ মা রুমে দেখলো।আমাকে দেখে বলল,”কি ব্যাপার?তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
কথাটা বলেই মাথায় হাত দিতে দেখলো জ্বর আসছে কি না?
আমি যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত রেখে বললাম,”কিছু হয় নি।এমনেই জার্নি করে এসেছি তাই একটু টায়ার্ড লাগছে।”
মাথার ভেতর যে এতোবড় একটা চিন্তা বুঝতে দেয়া যাবে না।
“আচ্ছা,দেখিস অসুখ বাধাইস না।এমনেই কি করোনা নাকি ফরোনা দিয়ে ভয়ে একবারে শেষ সবাই।”
আমি একটু হাসলাম। বললাম, “আচ্ছা এখন যাও।একটু রেস্ট নেই।”
মা যাওয়ার পর দরজাটা একটু চাপিয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পরলাম।
কেমন জানি লাগছে। ঘুম আসছে কিন্তু ঘুমাতে পারছি না।একে তো একটা উটকো ঝামেলায় ব্যাপক চিন্তা হচ্ছে তার মধ্যে আবার পাশের বাড়ির ছাদে জোরে গান বাজাচ্ছে।খুব সম্ভবত বিয়ে বা গায়ে হলুদ।ঘুম যেহেতু আসছে না একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসি।
.
পাশের বাড়ির ছাদে ব্যাপক গান-বাজনা হচ্ছে।গায়ে হলুদ।আকাশে মেঘ মেঘ, যেকোন সময় বৃষ্টিতে গায়ে হলুদ পন্ডু হয়ে যেতে পারে।
এমন সময় একটা ডাক এলো,”এই যে এক্সকিউজ মি।”
গায়ে হলুদ যেই ছাদে সেই ছাদ থেকে ডাকছে।তাকাতেই দেখলাম সেই মেয়ে।যে সকালে আমার কাছে ঠিকানা জিজ্ঞেস করেছিল।অনুষ্ঠানের জন্য হলুদ শাড়ি পরেছে মেয়েটা।
এতো অপরুপ সুন্দর মেয়ে আমি আগে কখনও দেখে নি।আমাকে ডেকেই চলছে।
[চলবে……]