প্রেমাস্নাত সন্ধ্যায়,পর্ব_০২ (শেষ)

প্রেমাস্নাত সন্ধ্যায়,পর্ব_০২ (শেষ)
অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)

আমার অভিমানী মন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো,

‘এতক্ষণে আমার কথা মনে পড়লো? আমার কাছে আসার সময় হলো?’

মুখ দিয়ে কিছুই বললাম না। দম বন্ধ করে পড়ে রইলাম। ধীরে ধীরে হিমায়নের অস্তিত্ব আরো নিকটে অনুভব করতে লাগলাম। পরিচিত পারফিউমের গন্ধটা কড়া ভাবে নাকে প্রবেশ করলো। সে আবারো নিস্তব্ধতার পর্দা চিঁড়ে গভীর স্বরে বলে উঠলো,

‘নিশি? আপনি কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?’

আমি উত্তর দিলাম না। ঠোঁট চেপে ঘুমানোর ভান ধরে পড়ে রইলাম। ঠিক তখনি কেউ আঙুলের ডগা দিয়ে হালকা করে ছুঁয়ে দিল। মুখের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিল। ধপ করে চোখ খুললাম আমি। চতুর্থ বারের মতো আমাদের দুজনের দৃষ্টি এক হলো। এবারে পূর্বের মতো ঝটপট চোখ সরিয়ে নিলাম না। আমার ঘোর লাগা ঝাপসা দৃষ্টি হারিয়ে গেল তার দৃষ্টির অতলে। কয়েক সেকেন্ড পর হিমায়ন চিন্তিত কন্ঠে বলল,

‘আপনি কাঁদছেন কেন নিশি? কি হয়েছে? কোথাও কষ্ট হয়? আমায় বলুন প্লিজ।’

চোখ বন্ধ করে ফেললাম আমি। সঙ্গে সঙ্গে চোখের কার্নিশ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। হিমায়ন তার দক্ষ হাত দিয়ে পরম মমতায় আমার চোখের জল মুছে দিল। মাথায় হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করলো,

‘কি হয়েছে? মন খারাপ?’

‘আপনি একটা বজ্জাত। ১১ ঘন্টা হলো বাড়ি এসেছেন। কিন্তু একটিবার আমার কথা মনে পড়েছে? আমার সাথে দেখা করেছেন? দুটো ভালো মন্দ কথা বলেছেন? একটু সুন্দর মতো তাকিয়েছেন? শীতের শেষে যে একটা অসহায় মেয়েকে তিন কবুল বলে নিজের স্ত্রীর স্বীকৃতি দিয়েছিলেন সেটা ভুলে গেছেন?এতক্ষণে আমার কথা মনে পড়লো? কে নিশি?’

ঝাঁঝালো স্বরে বলে উঠলাম আমি। নিজের অজান্তে হাতটা কখন হিমায়নের কলার চেপে ধরেছে খেয়ালে নেই। তার বিস্ময় ভরা দৃষ্টি আমার উপর ন্যস্ত। বিস্মিত হবারই কথা। তার সাথে মিনমিন করে কথা বলা সেই আমি আমার গলার স্বর হিমালয় ছুঁয়েছে। আমি রাগান্বিত চোখে চেয়ে রইলাম তার দিকে। একটা হাত শার্টের কলার চেপে ধরা আমার হাতটা স্পর্শ করতে চমকে উঠলাম। হুশ ফিরলো আমার। হিমায়নের কলার ছেড়ে দ্রুত সরে গেলাম। বিছানার দেয়াল ঘেঁষে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। কাঁথা দিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে ঢেকে ফেললাম লজ্জায়। কিছু সময় নিশ্চুপে অতিক্রান্ত হলো। আচমকা হিমায়ন শব্দ করে হেসে উঠলো। তার সেই ঝর্ণার উত্তাল ঢেউয়ের মতো হাসি শুনে চমকে উঠলাম। কয়েক সেকেন্ড পর হিমায়ন জোরপূর্বক আমার মুখ থেকে কাঁথা সরিয়ে ফেলল। আমি তবুও দেয়ালের দিকে মুখ করে চেয়ে রইলাম। সে হাসতে হাসতে বলল,

‘তুমি বড্ড বোকা নিশি।’

কপাল কুঁচকে গেল আমার। হিমায়ন যে হুট করে তুমিতে নেমে এসেছে সেটা বোধগম্য হলো না। মুখ ঘুরিয়ে তার দিকে তাকালাম। চোখ পাকিয়ে বললাম,

‘কে বোকা? আপনি বোকা। শুধু বোকা নয়, বোকা স্কয়ার, বোকা কিউব! বোকা টু দ্যা পাওয়ার ইনফিনিটি! শুনতে পেয়েছেন?’

‘হু। শুনতে পেয়েছি। এবার তোমার গলা চেক করো তো। দেখো তো, আমি তোমার কাছে মাত্র এসেছি নাকি অনেক আগেই?’

সন্দেহ নিয়ে গলায় হাত রাখলাম আমি। সঙ্গে সঙ্গে এক লাফে বিছানায় উঠে বসলাম। গলার কাছের হাতটা সামনে এনে দেখি ধবধবে শুভ্র রঙের একটা লকেট সহ চেইন। লকেটের ভেতর যে ‘এইচ’ অক্ষর লেখা সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। চমকে বললাম,

‘এটা কখন পড়িয়ে দিয়েছেন?’

‘বিকেল বেলা তুমি যখন দিন-দুনিয়া ভুলে ভুসভুস করে ঘুমাচ্ছিলে ঠিক তখন।’

আমার মনের আকাশে অভিমানে সৃষ্ট পেজা তুলোর মতো মেঘ সরে ঝলমলে রোদে ছেয়ে গেল। অস্পর্শনীয় আনন্দে ভরে গেল ভেতরটা। দৃষ্টি লকেটের উপর রেখে লাজুক স্বরে বললাম,

‘এটা ভীষণ সুন্দর। আমার খুবই পছন্দ হয়েছে।’

‘শুধু এটা পড়িয়ে দেইনি। আরো অনেক কিছু করেছি। কিন্তু তোমার যা ঘুম! কিচ্ছু টের পাওনি।’

গলার চেইনে হাত থেমে গেল আমার। লজ্জার রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো মুখজুড়ে। কম্পিত ঠোঁট জোড়া নেড়ে কিছু বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ব্যর্থ হলাম। আমাকে এই ভালো লাগার অস্বস্তি থেকে রক্ষা করলো হিমায়ন। ঘাড়ের কাছে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিল। বলল,

‘চুল খোলা রেখেছ কেন? অগোছালো হয়ে গেছে। জট পাকিয়ে যাবে তো এখন।’

‘চুল আঁচড়ানো আমার অপছন্দের কাজের মধ্যে একটি।’

‘তোমার আর কোন কোন কাজ অপছন্দের?’

আমি বেশ সহজ হয়ে এলাম। খুব কাছে বসে থাকা ছেলেটার সাথে যে আমার খুবই অল্প সময়ের পরিচয় সেটা মাথায় রইলো না। তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে কাছের মনে হলো। মনে হলো আমাদের আত্মিক সম্পর্কটা বহুদিনের। আমি সহজ গলায় বললাম,

‘বেশকিছু কাজ আমার ভীষণ অপছন্দের। এই ধরুন মাথার চুল নিয়মিত আঁচরানো, গোসল শেষে কাপড় ধোয়া, রাতের বেলা ঘুমানোর আগে দাঁত ব্রাশ করা, মাথায় তেল দেওয়া, হাত-পায়ের নখ কাটা ইত্যাদি। আরো কিছু আছে যেটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।’

‘আজ থেকে তোমার সব অপছন্দের কাজগুলো করে দেওয়ার অধিকার আমায় দিবে?’

হিমায়নের কন্ঠস্বর শুনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেলাম। পরক্ষণে মনে পড়লো সে আমার অপছন্দের কাজগুলো কি করে করবে? দুদিন পর তো আমাকে ছেড়ে সেই শহরে চলে যাবে আবার। হিমায়ন হয়তো আমার মনের কথা বুঝতে পারলো। আমার ডান হাতটা নিজের দু হাতের মুঠোয় পুড়ে নিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘চিরদিন তো দুজন আলাদা থাকবো না নিশি। যখন একসাথে থাকবো, অথবা যতটুকু সময় একসাথে থাকবো তোমার অপছন্দের সব কিছু আমি করে দিবো। তোমার অপছন্দ, আমার ভালোবাসা। বুঝতে পেরেছ?’

আমি মাথা নিচু করে শুধু সম্মতি দিলাম। হিমায়ন গম্ভীর স্বরে বলল,

‘বুঝলে নিশি! ছেলেদের অনেক কিছু ট্যাকল করে চলতে হয়। বিশেষ করে আমার মতো নিম্ন মধ্যবিত্ত ছেলেদের। আমাদের বাবা-মায়ের আনন্দের কথা ভাবতে হয়, ভাই-বোনের খুশির কথা ভাবতে হয়, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশি, উর্ধ্বতন কর্মকতা সবার মন যুগিয়ে চলতে হয়। আবার এরই মাঝে সহধর্মিণীর কথা ভাবতে হয়। তার ছোট ছোট আবদার, তার খুশির কথা ভাবতে হয়। দিনশেষে সব ঝড় মাড়িয়ে, সব ক্লান্তি দূর করতে তার বুকে মাথা রেখেই প্রশান্তির ঘুম দিতে হয় যে! আমাদের মতো ছেলেদের অদৃশ্য অনেক শক্তি থাকে। আমরা একই সাথে অনেকগুলো নৌকার হাল ধরি। তবুও মাঝে মধ্যে হিমশিম খেতে হয়।’

হিমায়ন থামলো। আমি গভীর দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকালাম। কিছুক্ষণ পর হাত বাড়িয়ে তার মুখ স্পর্শ করলাম। ত্বকের আড়ালে লুকিয়ে রাখা দুঃখ গুলো মুছে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। নিজে থেকে তার বুকে মাথা রেখে বললাম,

‘আমি আছি তো! ঠিক এখানে। আপনার অদৃশ্য শক্তি আরো মজবুত করতে। আপনার জীবন যুদ্ধের সহযাত্রী হিসেবে।’

৩.

ভোর রাত থেকে বৃষ্টি। একটানা ঝড়ছে তো ঝড়ছেই! কোনো থামাথামি নেই। এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সিএনজি করে হিমায়ন আটটার দিকে তার আস্তানায় রওনা দিয়েছে। যাওয়ার সময় তার চোখের দিকে তাকাতে পারিনি আমি। মনে হচ্ছিল একবার ও চোখে চোখ রাখলে আর নিজেকে সামলাতে পারব না। হিমায়নের মন তো দূর্বল করে দিতে পারি না আমি। আমি তার জন্য এক টুকরো বরফ শীতল নদী হতে চাই।ব্যক্তিগত নদী। যে নদীতে সে এসে সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি, না পাওয়ার কষ্ট, দুঃখ গুলো ধুয়ে মুছে দিবে। নিজেকে পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, ঝলমলে আর সতেজ করে পরবর্তী দিনের জীবনযুদ্ধে নামবে। আমি তার জন্য এক টুকরো প্রশান্তি হতে চাই। তার একমাত্র কমফোর্ট জোন হতে চাই।

ইটের দেয়াল বিশিষ্ট টিনের চালে বিরতিহীন বৃষ্টির ফোঁটা ঝরছে। ঝাপসা চোখে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বারান্দার অনেকখানি মেঝেতে বৃষ্টির ছাঁট! সাবধানে পা রেখে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। শীতল এক স্পর্শে লোমকূপ কেঁপে উঠলো। ঠিক সঙ্গে সঙ্গে ফোনের মেসেজ টিউন বাজলো। ভেজা হাতে কোমড় থেকে বাটন ফোনটা বের করলাম। বাটনে চাপ দিয়ে দেখি হিমায়ন মেসেজ পাঠিয়েছে। বেশি কিছু লেখা নেই। গুটি গুটি বাংলা অক্ষরে লেখা অত্যন্ত ভারী একটা শব্দ,

‘ভালোবাসি!’

ক্রমেই বৃষ্টির বেগ বেড়ে চলেছে। টিনের চালে পড়া বর্ষণ বিশেষ এক ছন্দময় সুর সৃষ্টি করেছে। হাওয়ার তালে তালে ছিঁটেফোঁটা বৃষ্টি এসে পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে দেহে। প্রকৃতিতে বেপরোয়া ভাব। এসবের মধ্যে আমার দৃষ্টি ফোনের স্ক্রিণের উপর নিবদ্ধ হয়ে আছে। বিড়বিড় করে লেখাটি উচ্চারণ করতে ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠলো। বেপরোয়া প্রকৃতির তৃষ্ণা নিবারণের জন্য হাটুঁসম বারিধারায় কয়েক ফোঁটা নির্জল আনন্দাশ্রু উপহার দিলাম। প্রকৃতি মনে রাখবে তো?

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here