স্বর্নাভ_সুখানুভূতি,পর্ব-১১,১২

#স্বর্নাভ_সুখানুভূতি,পর্ব-১১,১২
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
১১

রূপের মোহে, আবেগের বশবর্তী হয়ে মানুষ হুট করেই কাউকে মন দিয়ে বসে। তার সবটা জুটেই সেই মানুষটার বাস থাকে। কল্পনায় তাকে নিয়ে হাজার স্বপ্ন বুনে। মন মাঝে ভাবনা আসে, এই মানুষটাকে ছাড়া তার চলবে না। সব সুখ বুঝি এর মাঝেই নিহিত। কল্পনায় বোনা স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে হাজার চেষ্টার পর তাকে জীবনে নিয়ে আসে। সেইক্ষণে নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়। সময় গড়ার সাথে সাথে যখন সে দেখে সঙ্গীর সাথে তার মনের অমিল, তখন সুখভাবটা ফিকে হয়ে যায়। প্রথমে মনের দূরত্ব এসে যায়, অনুভূতি কাজ করা বন্ধ করে দেয়, বিরক্তি লাগতে শুরু করে। মনে হয় রূপে মত্ত হওয়া উচিত হয়নি। মতের মিল, চলনের মিল আছে কি-না যাচাই করা উচিত ছিল। বড্ড ভুল হয়ে গেছে। মানুষটা তার জন্য ঠিক নয়, সে এমন কাউকে চায়নি। অথচ একটা সময় মনে হয়েছে এই সেই মানুষ, যাকে সে হন্য হয়ে খুঁজেছে।

মুশরাফার পোশাক দেখে ঠিক এই অনুভূতিগুলো হচ্ছে জাওয়াদের। যাবারকালে যখন পাশাপাশি হাঁটছিল, তখন নিজের পাশে মুশরাফাকে বড্ডো বেমানান লাগছিল। মানাচ্ছে না তাদের, একটু ও না।
কপালে বিরক্তির ভাজ জাওয়াদের। সেই বিরক্তির মাত্রা গাঢ় হলো রেস্টুরেন্টে গিয়ে। টেবিলে টেবিলে মানুষ বসা, জাওয়াদ একটা টেবিল বুক করল। বার্গার অর্ডার করল। বড়ো সাইজের বার্গার। খেতে গিয়ে জাওয়াদের ও কিছুটা ধাক্কা লাগল, এক কামড় দুইটা বান অবধি পৌঁছাচ্ছে না।
মুশরাফা নিকাব করা। নোজ নিকাবটা ঘোমটা থেকে আলাদা। নাকের উপর ঘোমটার ভেতর পেছনে বাধা। নাক থেকে বুকে ঝুলে পড়েছে। মুশরাফা এর আগেও রেস্টুরেন্টে এসে খেয়েছে। কায়দা তার জানা। সেই কায়দা মাফিক মুখ খুলল না সে। একহাতে বার্গার নিল, অন্যহাতে নিকাবটা একটু বাকিয়ে ফাঁক করে বার্গারে কামড় দিল। বার্গার দু’হাতে নিয়ে খেলে বিপত্তি হয়না, এক হাতে বড়ো সাইজের বার্গার খেতে গিয়ে নিকাবে লেগে গেল। একটু সস বোরকায় ও পড়ল। মুশরাফা ভড়কাল না। বার্গারে কামড় দিয়ে বার্গার রেখে দিল প্লেটে। তারপর স্বাভাবিকভাবে টিস্যু নিয়ে সস মুখে ফেলল। তাকে একটু ও বিচলিত দেখাল না।

কিন্তু জাওয়াদকে বিচলিত দেখাল। সে খাওয়া থামিয়ে তীক্ষ্ম চোখে পরখ করল ব্যাপারটা। চোখ মুখ কুঁচকে এলো। ওর খাওয়ার ধরণ একবারেই পছন্দ হলো না জাওয়াদের। নিকাবের ভেতর বার্গার নিয়ে কিভাবে খাচ্ছে! আবার ফেলে টেলে একাকার। পাশের টেবিলের একটা মহিলা এদিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে হাসছে। লজ্জায় মাথা কা/টা যাচ্ছিল জাওয়াদের। তখনই শপথ নিয়েছে দ্বিতীয়বার মুশরাফাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে আসবে না। তার বন্ধুরা দেখলে হাসবে, টিপটপ চলা ছেলেটা শেষে কিংবা এমন গেঁয়ো মেয়েকে বিয়ে করেছে! টিটকারি দিবে।

বিয়ের আগে ওর পর্দার কথা শুনে মনে হয়েছিল, পছন্দের মানুষটা যেমনই হোক, মানিয়ে নিতে পারবে। তার কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে পারবে না মানিয়ে নিতে । এই চালচুলোহীন মেয়েটার সাথে সারাজীবনে কাটানো সম্ভব নয় তার পক্ষে। মেয়েটা তার মতো নয়, তার স্ট্যাটাসের সাথে যাচ্ছে না। শার্টের সাথে বোরকার মিশ্রণ হচ্ছে না।
একদিনেই মন বেঁকে গেছে। সকাল অবধি মনের ভেতর যে ভালোবাসা, সুখের উপস্থিতি ছিল তা যেন এক নিমিষেই উবে গেল। বাস্তবতার ধাক্কা বোধহয় একেই বলে। কল্পনার জীবন সুন্দর, বাস্তবতার নয়। বিরক্তিতে জাওয়াদের মুখ কালো হয়ে গেল। মুশরাফা তখনো আগের ভঙ্গিমায় খাচ্ছে। জাওয়াদের দেখতে ভালো লাগছিল না দৃশ্যটা। সে উঠে দাঁড়াল। অনেক কষ্টে নিজের স্বর স্বাভাবিক করে বলল,
‘তুমি খাও, আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি।’

মুশরাফাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল। মুশরাফা ওর এহেন আচরণের অবাক হলো না, কারণটা রুমেই আন্দাজ করেছে সে। ব্যাপারটাকে সে স্বাভাবিকভাবেই নিল। খাওয়া থামিয়ে মনে মনে বলল,
‘আল্লাহ, তুমি মানুষটাকে সঠিক বুঝ দাও।’

আবার খাওয়ায় মন দিল। জাওয়াদ তৎক্ষনাৎ ফিরল না। মিনিট দশেক বাদে ফিরল। মুখে মাস্ক। ততক্ষণে মুশরাফার খাওয়া শেষ। এসে চেয়ারে বসল। বার্গারের দিকে চেয়ে ও দেখল না। মুশরাফার উদ্দেশ্যে বলল,
‘তোমার খাওয়া শেষ?’
‘হ্যাঁ।’ ছোটো করে উত্তর দিল মুশরাফা। জাওয়াদ উঠে দাঁড়াল। মানিব্যাগ বের করে বলল,
‘তুমি হাঁটো, আমি বিল দিয়ে আসছি।’

মুশরাফা জাওয়াদের আধখাওয়া বার্গারের দিকে চাইল এক পলক। কিছুই বলল না। জাওয়াদ যে আর খাবে না সে জানে। উঠে দাঁড়াল। ব্যাগ হাতে দিয়ে বলল,
‘আমি বিল দিয়ে দিয়েছি।’

মুশরাফা হাঁটা ধরল। জাওয়াদ বিল কার্ড চেক করল। সত্যি বিল দেয়া। সে ভ্রু কুঁচকাল। মুশরাফার কাছে এসে বলল,
‘তুমি বিল দিলে কেন? আমি বিল দিতাম।’

মুশরাফা হাসল। নিকাবের ফাঁকে ওর চোখকে ও হাসতে দেখা গেল। হেসেই বলল,
‘ আমি আপনি একইতো। একজন দিলেই হলো।

জাওয়াদ বলল,
‘ কিন্তু মুশরাফা, ট্রিটটা তো আমার পক্ষ থেকে দেয়ার কথা ছিল।’

লোকটা সকাল অবধি ‘রাফা’ ডেকেছে। এখন ‘মুশরাফা’ ডাকছে। সম্পর্কের অবনতি টের পেল মুশরাফা। আলতো স্বরে বলল,
‘একদিন মন থেকে ট্রিট দিয়েন। ‘

‘আজ মন থেকে দিই নি?’
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল জাওয়াদ। রেস্টুরেন্টে থেকে বেরিয়ে এসেছে ওরা। রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। মুশরাফা গাড়ির খোঁজে এদিক ওদিক তাকাল। সুকৌশলে উত্তর এড়িয়ে বলল,
‘ এবার বাসায় ফিরি? ‘

থাকার ইচ্ছে জাওয়াদের নেই। তবুও সৌজন্যবোধে জিজ্ঞেস করল, ‘আর কোথাও যাবে না? চলো পার্ক টার্ক থেকে ঘুরে আসি?’

মুশরাফা কিছুটা দূরে ছিল। কদম বাড়িয়ে কাছে এলো। হাতের মুঠোয় হাত রেখে আলতো স্বরে বলল,
‘ আমি আপনার জীবনে বিরক্তি হতে আসিনি। বিরক্তির ভাজে আমায় আটকাবেন না। বাসায় চলুন।’

বলে হাত ছেড়ে দিল। সরে গেল দূরে। জাওয়াদ স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল। মেয়েটা তার বিরক্তিভাব টের পেয়ে গেছে! কিভাবে? সে তো তেমন আচরণ করেনি। তবে? এই মেয়ে তো দেখি বেজায় চালাক। জাওয়াদ বিব্রতবোধ করল, অস্বস্তি হলো তার। হতভম্ব চোখে এক পলক চাইল মুশরাফার পানে। পরপরই দৃষ্টি ঘুরাল। গাড়ি ঠিক করে উঠে বসল। মুশরাফাকে বলা লাগল না, নিজেই উঠে বসল। গাড়ি চলতে শুরু করেছে।

মাঝপথে মুশরাফা শান্ত স্বরে বলল,
‘ আমার জানামতে, মামা আপনাকে আমার জীবনধরণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন। আপনি সবটা জেনে, সায় জানিয়েই বিয়ের ব্যাপারে এগিয়েছেন। তবে এখন আপনার কপালে বিরক্তির ভাজ কেন?’

জাওয়াদ ভাবেনি, মুশরাফা ওকে সরাসরি প্রশ্নবাণে ফেলবে। মেয়েটার বোল্ড পার্সোনালিটি যেন পদে পদে প্রকাশ পায়। জাওয়াদ তৎক্ষনাৎ উত্তর দিতে পারল না। খানিক বাদে ধীর স্বরে বলল,
‘আমি পর্দার মানে জানতাম না।’

মুশরাফা অবাক হলেও প্রকাশ করল না। কোমল স্বরে বলল,
“বিয়ের আগে অন্তত একবার হলে গুগলে গিয়ে ‘পরিপূর্ণ পর্দার ধরণ’ লিখে সার্চ দেয়া উচিত ছিল আপনার। তাহলে বোধহয় মিসম্যাচ হতো না। ”

কথাটা যুক্তিযুক্ত। আসোলেই উচিত ছিল, পর্দা সম্পর্কে জানা। ভুল হয়ে গেছে। এখন প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। জাওয়াদ পাশ ফিরে চাইল এক পলক। তড়িৎ চোখ সরাল। এই পোশাক ওর মোটেই পছন্দ নয়। তাকাতে ইচ্ছে করছে না।

বাকি পথ আর কথা হলো না। চারতলায় উঠে মুশরাফা বাসায় গেলেও জাওয়াদ গেল না। ছাদে উঠে গেল। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। এখন একটা সিগারেট না গেলেই নয়।

বন্ধুর বিয়ে উপলক্ষে দু’দিন ছুটি নিয়ে অনিক। আজ সে বাসাতেই আছে। অনিক ল্যাপটপে খেলা দেখছিল। জাওয়াদকে দেখে প্রফুল্ল মনে বলল,
‘কিরে নববর, কী অবস্থা? জীবনের প্রথম বিয়ের অনুভূতি কেমন?’

জাওয়াদ হতাশ চোখে তাকাল এক পলক। তারপর চেয়ারে বসে সিগারেট ধরাল। উদ্ভান্তের মতো কয়েক টান দিল। উদাস গলায় বলল,
‘হুটহাট বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত হয়নি।’

অনিককে চিন্তিত দেখাল। ল্যাপটপ রেখে নড়েচড়ে বসল। বলল,
‘কাহিনি কী?’
‘কাহিনি হইতাছে, সি ইজ নট মাই টাইপ। কী সব আলখাল্লা পরে থাকে। বাইরে গিয়ে লজ্জায় পড়েছি। আমার সাথে যাচ্ছে না ওকে। বন্ধুবান্ধব কেউ দেখলে মান ইজ্জত থাকবে না। ‘ বিরস মুখে বলল জাওয়াদ।

অনিক কটু চোখে তাকাল। এমন মহীয়সী নারী কজনার ভাগ্যে থাকে? জাওয়াদ ভাগ্যজোরে পেয়েছে, তাও মূল্য দিচ্ছে না। অনায়েসে পেয়ে গেছে তো তাই, মূল্য বুঝে সাধনা করে পেলে মাথায় তুলে নাচতো। বন্ধুটি হীরে চিনছে না, আফসোস হলো অনিকের। প্রার্থনা করল, বন্ধুটি যাতে শীঘ্রই বুঝে, কত মূল্যবান রত্ন পেয়েছে জীবনে। চাপা শ্বাস ফেলল অনিক। তারপর কৌতুকের সুরে বলল,
‘ শালা তুই হলি লোকাল মানুষ, তাই রিজার্ভ ভালো লাগে না। সারাজীবন তো লোকাল ছিলি, এবার একটু রিজার্ভ হ। ‘

রাত ন’টা নাগাদ জাওয়াদ বাসায় ফিরল। মেহমানরা সবাই বিকেলে চলে গিয়েছে। শুধু লায়লা আর জায়ফা আছে। তারা কাল মুশরাফাকে বিদায় দিয়ে যাবে। বসার ঘরে সবাই মিলে কথা বলছে। জাওয়াদ সবার সাথে কুশল বিনিময় করে রুমে এলো। মুশরাফার উপর ক্ষীণ বিরক্তভাব তখনো অবিচল। মেয়েটাকে যথাসাধ্য এড়িয়ে যাওয়ার প্রয়াস তার মনের। অনিকের জোরাজোরিতে এসেছে, নয়তো আসার ইচ্ছে ছিল না তার। গম্ভীর মুখভঙ্গিমায় রুমের দিকে এগুলো। দরজা ভেজানো। ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল।
মুশরাফা কাপড় গুছাচ্ছিল। ওকে দেখে কাপড় রেখে কাছে এলো। প্রসন্ন হেসে কোমল স্বরে বলল,
‘আসসালামু আলাইকুম। ‘

জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। মুশরাফার মুখভঙ্গি স্বাভাবিক যেন কিছুই হয়নি। অথচ বিকেলে তাদের নিরব বোঝাপড়া হয়ে গেছে এক চোট। জাওয়াদ সালামের উত্তর নিল না। পাশ কাটিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসল। ফোন হাতে নিয়ে ফোনে চোখ ডুবাল। বাইরে থেকে এসেছে বোধহয়। ঘেমে-নেয়ে একাকার। মুশরাফা বরফ কিউব দিয়ে লেবুর শরবত করে আনল। জাওয়াদের সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ এটা নিন। ফ্রেশ লাগবে।’

জাওয়াদ মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে তাকাল এক পলক। আবার নিবদ্ধ করল ফোনে। বলল,
‘আমি এমনিই ফ্রেশ আছি।’

‘কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আপনার চেহারায় ফরমালিন আছে।’ মুখ টিপে হাসল মুশরাফা।

জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল,
‘ কীসব বলছো? মুখে কীসের ফরমালিন?’

খাটের পাশে সাইট টেবিল, তাতে গ্লাসটা রাখল মুশরাফা। তারপর জাওয়াদের কাছে বসল। মুখের কিছুটা উপর আঙুল ঘুরিয়ে বলল,
‘রাগ আর গম্ভীরতা নামক ফরমালিন দেখা যাচ্ছে আপনার মুখে। চোখে রাগ রাগ ভাব, নাকের ডগা ফুলে আছে। লক্ষণ ভালো নয়। আয়নায় দেখুন, নিজেই টের পাবেন। ‘

জাওয়াদ চোখ রাঙালো, ‘মজা করছো আমার সাথে?’

মুশরাফা উত্তর দিল না। চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে রইল। কেমন গোয়েন্দা গোয়েন্দা ভাব ওর দৃষ্টিতে । চোখের পলক পড়ছে না, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল,
‘এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’

মুশরাফা উত্তর দিল না। তাকিয়ে রইল অনিমেষ। জাওয়াদ কপাল কুঁচকে ফোনের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ পর যখন চোখ তুলল তখনও মুশরাফাকে একইভাবে তাকানো দেখল। জাওয়াদ আবার বলল,
‘ কী দেখছো এভাবে? চোখ নামাও, আমার অস্বস্তি হচ্ছে।’

মুশরাফা ঠোঁট চেপে হাসল। লোকটাকে বিরক্ত করতে ভালো লাগছে ওর। পলক ফেলল না। জাওয়াদ আবার কপাল কুঁচকাল। মেয়েটার হলো কী হঠাৎ? বুঝতে পারল না ও। দুজনার দৃষ্টিমিলনের মাঝে একবার পলক সরাল মুশরাফা। শরবতের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার দৃষ্টি ফেলল জাওয়াদের পানে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে গ্লাসে তাকাল জাওয়াদ। শরবত খায়নি বলে এমন করছে? জাওয়াদ গ্লাস হাতে নিয়ে চুমুক দিল। এক টানে অর্ধেকটা করল। শরবতটা ভালো হয়েছে। আসোলেই ফ্রেশ লাগছে। মেয়েটাকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করল। কিন্তু ধন্যবাদ দিলে আবার পেয়ে বসবে, এই ভেবে চেপে গেল। আবার চুমুক দেয়ার পরপরই মুশরাফা বলল,
“আপনি নাকি আমাকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলেন? মাকে না কি বলেছিলেন, বিয়ে করলে ‘রাফা ‘কেউ করব। অন্যকাউকে না।”

বিষম খেল জাওয়াদ। মেয়েটা তার ভাণ্ডারের সব কথা কিভাবে জেনে যায়? কে বলে? মা বলেছে নিশ্চয়ই! কাশতে কাশতে কেমন চোরা চোখে তাকাল মুশরাফার দিকে। মুশরাফা ওর পিঠ ঢলতে ঢলতে মুখ চেপে হাসল। পানি দিল। পানি খেয়ে স্বাভাবিক হলো জাওয়াদ। আত্মপক্ষ সমর্থনে বলল,
‘মোটেও না। মা তোমাকে বাড়িয়ে বলেছে।’

মুশরাফা আগের জায়গায় গিয়ে বসল, ‘আমি কিন্তু একবারও বলিনি মা বলেছে।’

‘মা বলেনি! তবে কে বলেছে? মাকে বলা কথাটা মা ছাড়া তো কেউ জানে না।’ অবিশ্বাস্য সুরে সত্য ফাঁস করে দিল জাওয়াদ।
মুশরাফা চওড়া হাসল,
‘তার মানে ঘটনা সত্যি! ‘ আবার স্থির দৃষ্টি ফেলল মুশরাফা।

জাওয়াদ প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল,
‘দেখো, শরবত শেষ করেছি। এবার অন্তত চোখ সরাও মুশরাফা। ‘

মুশরাফা ঠোঁট উল্টালো,
”সকালে ও ‘রাফা’ ডাকছিলেন। এখন ‘মুশরাফা?’ কয়েক ঘন্টায় ভালোবাসা শেষ? এটা ভালোবাসা না হাওয়াই মিঠাই? ছুঁয়ে দিলেই গায়েব।’

মুশরাফাকে ভীষণ চঞ্চল দেখাচ্ছে। শান্ত, কোমল কিংবা কঠোর সেই মেয়েটি এখন আর নেই। এখনকার মেয়েটা চঞ্চল, চতুর। যে মেপে মেপে কাট কাট কথা বলে না, গম্ভীর চোখে তাকায় না। এ যেন অন্য রূপ। এই মেয়ের কত রূপ? খনিকেই রঙ বদলায়। জাওয়াদ আড়চোখে ওর বদলে যাওয়া রূপটা পরখ করল। এখন বিরক্তি আসছে না। বিরক্তিটা কি শরবতের সাথে গিলে ফেলেছে? না কি চঞ্চলতার চাঞ্চল্যে উড়ে গেছে কে জানে?

চারদিক আঁধার মাড়িয়ে আছে। নিস্তব্ধতা গ্রাস করেছে প্রকৃতিকে। নিস্তব্ধতা কাটাতে মুয়াজ্জিনের মধুর সুরে রবের বাণী গেয়ে উঠলেন। আযান কানে যেতেই ঘুম ভেঙে গেল মুশরাফার। আযান শেষ হওয়া অবধি শুয়ে রইল। তারপর উঠে ওয়াশরুমে গেল। বেরিয়ে জায়নামাজটা বিছালো খাটের পাশ ঘেঁষে। জায়নামাজে দাঁড়িয়ে ঘুমন্ত জাওয়াদকে ডাকতে লাগল,
‘এ্যাই, উঠুন নামাজের সময় হয়ে গেছে।’

জাওয়াদের সাড়াশব্দ নেই। গভীর ঘুমে আছন্ন সে। মুশরাফা ওর কানে ফুঁ দিল। শিউরে উঠল জাওয়াদ। ঘুম ছুটে গেল। ঘুমঘুম স্বরে বলল,
‘কী হয়েছে?’
‘উঠুন।’
‘কেন?’
‘নামাজের সময় হয়েছে।’
‘আমি নামাজ পড়িনা। বিরক্ত করো না। ঘুমাতে দাও।’ বলে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল জাওয়াদ। মুশরাফা ঝাকি দিল। ঘুম ছাটালো চোখ থেকে। জাওয়াদ রেগে বলল,
‘সমস্যাটা কী তোমার? বললাম তো নামাজ পড়ব না।’
‘আমি নামাজ পড়তে বলছি না। জাস্ট অযু করে আসুন। ‘

জাওয়াদ যেতে চাইল না। মুশরাফা নাছোড়বান্দা, ঠেলে পাঠালো ওয়াশরুমে। ফ্রেশ হয়ে অযু করে বের হলো জাওয়াদ। মুখে তীব্র বিরক্তি, চোখে রাগ। বের হয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাল মুশরাফার দিকে। জায়নামাজের পাশ কাটিয়ে খাটে উঠতে গিয়ে থেমে গেল। চোখ থেকে ঘুম চলে গেছে। অযু করে এসেছে। একজন মুসলিম অযু করলে নামাজ না পড়ে থাকতে পারে না। চতুর মেয়েটা এটা জেনেই শুধু অযু করতে বলেছে। সে জানে অযু করলে নামাজ না পড়ে থাকতে পারবে না জাওয়াদ। হলো ও তাই। পা থামিয়ে নিল জায়নামাজের গোড়ায়। রাগত চোখে তাকাল মুশরাফার পানে।

মুশরাফার নামাজ শেষ। সে উঠে দাঁড়াল। চেয়ার থেকে টাওয়াল তুলে নিয়ে জাওয়াদের মুখ মুছে দিল। তারপর বলল,
‘এখন আপনাকে স্বামী স্বামী ধরনের সুন্দর লাগছে। ‘

জাওয়াদ তীক্ষ্ম চোখে ওর কাজ পরখ করছিল। কপালে ছিল বিরক্তির ভাজ। মুশরাফার কথায় আকস্মিক সব বিরক্তি উবে গেল। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল। হেসে ফেলল সে। মুশরাফা ও হাসল, সার্থকতার হাসি।

সকালে শ্বশুরবাড়িতে পা রাখল মুশরাফা। হলো আরেক বিপত্তি।

চলবে..

স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি। (পর্ব-১২)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

‘ মাস্ক পরে নিন। তাহলে আপনাকে আমার স্বামী হিসেবে কেউ চিনবে না।’ হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ ঝুলানোর ফাঁকে জাওয়াদের দিকে মাস্ক বাড়িয়ে দিয়ে বলল মুশরাফা।

জাওয়াদ কপালের বিরক্তির ভাজ এঁটে শার্টের হাতা গুটাচ্ছিল। মেয়েটার গায়ে এই আলখাল্লা দেখলেই তার ঘা রি রি করে উঠে। সকাল অবধি মেজাজ ভালোই ছিল। বাবার বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হতে গিয়ে আবারও বিরক্তি মুখ, মন দুটোই তেতো হয়ে গেছে। বিয়ের পর প্রথম শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছে, শাড়ি গহনায় রানী সেজে যাবে। সবাই দেখেই বলবে, জাওয়াদ তোর পছন্দ আছে। খুশিতে আটখানা হবে জাওয়াদ। তা না, কীসব আলখাল্লা পরে জঙ্গলি সেজে যাচ্ছে তার সাথে। ওর বিরক্তিঘন মুহুর্তে মুশরাফা মাস্ক বাড়িয়ে দিল। সাথে বলা কথাটা শুনে জাওয়াদ থেমে গেল। বিস্ময় নিয়ে তাকাল স্ত্রীর পানে। মুশরাফার ধ্যান এদিকে নেই, সে এক হাতে মাস্ক বাড়িয়ে, অন্য হাতে নিকাব ঠিক করতে ব্যস্ত। চোখ জোড়া দেখা যাচ্ছে শুধু। জাওয়াদ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মুখভঙ্গি যাচাই করার চেষ্টা করল। ফলাফল এলো, স্বাভাবিক। অথচ মেয়েটার মুখ থমথমে থাকার কথা। তার স্বামী তাকে পরিচয় দিতে চাইছে না বলে মাস্ক পরে নিজেকে আড়াল করছে, এটা তার জন্য অপমান। অন্য মেয়ে হলে কেঁদে কেটে একাকার করতো, অথচ এই মেয়ে স্বাভাবিক। যেন এটা হওয়ারই ছিল। মেয়েটা এমন কেন?

মুশরাফা হঠাৎ জাওয়াদের পানে তাকাল। চোখ হাসল ওর। হাসি হাসি স্বরে বলল,
‘ নির্দ্বিধায় পরে নিন। আমি কিছু মনে করব না। ‘

কাঙ্খিত মুখভঙ্গি না পেয়ে জাওয়াদের বিরক্তির মাত্রা বাড়ল। মাস্ক নিল না সে। মুশরাফার হাসিটাতে যেন তিরস্কারের আভা পেল সে। গম্ভীরমুখে বলল,
‘ মাস্ক পরার কারণ জেনে ও হাসছো কিভাবে? ‘

মুশরাফা ঠান্ডা গলায় বলল,
‘ আমি কখনো ক্ষতির হিসেব কষি না, রাগের হিসেব ও কষি না। আমি কষি লাভের হিসেব। আপনার মাস্ক পরাটা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখলাম এখানে আমার লাভ আছে। সেই লাভটা আমাকে আনন্দ দিচ্ছে বলেই হাসছি।’

জাওয়াদ কিছুটা রেগে বলল,
‘মজা করছো আমার সাথে? এখানে লাভের কী আছে?’

দুজনার মাঝে এক হাতের দূরত্ব। মুশরাফা দূরত্ব গুজাল। নিজ হাতে জাওয়াদকে মাস্ক পরিয়ে দিল। তারপর চোখে চোখ রেখে বলল,
‘মাস্ক পরলে আপনার মুখ আবৃত থাকবে। সুন্দর মুখশ্রীটা কোন মেয়ের দেখার সুযোগ হবে না। কেউ আপনাকে চোখ দিয়ে গ্রাস করতে পারবে না। আমি সাথে থাকাকালীন সময়ে কেউ আপনার দিকে বাঁকা উদ্দেশ্যে তাকিয়ে থাকলে আমার সহ্য হবে না, হিংসে হবে। রাগ ও হবে হয়তো। রাগ, হিংসে শয়তানের পক্ষ থেকে আসে। আমি হয়তো শয়তানের কুমন্ত্রণায় পড়ে রাগ, কিংবা হিংসে বশত গুনাহের কাজে লিপ্ত হতে পারি। আপনি মাস্ক পরলে এই গুনাহ থেকে বাঁচতে পারব। লাভ না?’

জাওয়াদের চোখে আবার বিস্ময়ের রেখা। একটা মানুষ এত ইতিবাচক চিন্তা কিভাবে করতে পারে! আর তার এত অবহেলার পরও মনে প্রেম আসছে কিভাবে! সে আনমনে প্রশ্ন করলে,
‘আমার দিকে কেউ তাকালে তোমার সহ্য হবে না কেন?’

মুশরাফা হেসে বলল,
‘এই প্রশ্নের উত্তরটা না হয় আপনি খুঁজে বের করুন! যেদিন আপনি কারণটা বের করতে পারবেন, সেদিন আমার পোশাক দেখে আপনার কপালে বিরক্তির ভাজ আসবে না। সেদিন আপনি আপনার বিরক্তির উপর বিরক্তি হবেন। আমি সেইদিনের অপেক্ষায় রইলাম।’

কথাগুলোর ভাবার্থ গভীর। এত গভীরতায় পৌঁছাতে পারল না জাওয়াদ। ফলে কথার মানে বুঝতে পারল না সে। মুশরাফা থেকে সরে গিয়ে বলল,
‘ থাকো অপেক্ষায়। আমি চললাম। ‘

নিজের ট্রলি হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হলো জাওয়াদ। মুশরাফা ও নিজের ট্রলি তুলে নিয়ে অনুসরণ করল তাকে। বসার ঘরে সবাই তাদের অপেক্ষা করছেন। জাওয়াদ বসার ঘরের কাছে গিয়ে মাস্ক খুলে ফেলল। ঘরের ভেতরে মাস্ক পরে থাকা বেমানান। বাইরে গিয়ে আবার পরবে। তাদের দেখে সবাই উঠে দাঁড়াল। মুশরাফার বাবা আর মামা যাবে ওদের সাথে। বর কনেকে একা পাঠানো যায় না কি!

মুশরাফা ফরিদার কাছে যখন বিদায় নিতে গেল। তখন ফরিদা ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘আল্লাহ, তোকে দুঃখহীন সুখেভরা একটা জীবন দিক। প্রতিদিন ফোন দিবি, দু’দিন পরপর এসে হাজির হবি। ভাববি না, বিয়ে হয়ে গেছে বলে পর করে দিয়েছি।’

মুশরাফা কাঁদল না। সে সহজে কাঁদে না। তবে বুকের কাঁপুনি ঠিকই ধরতে পারল। স্মিত হেসে বলল,
‘ দোয়া করো। নিজের খেয়াল রেখো, নিয়মিত ওষুধ নিবে। ফাইজার সাথে অযথা রাগারাগি করো না, সুন্দর করে বুঝিয়ে বললে বুঝবে ও। ‘

ফরিদা হাসলেন। যাবার বেলায় ও অন্যের চিন্তায় মত্ত সে। জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ মেয়েটার জীবনে কষ্টের পাল্লা ভারি, তুমি একটু সুখ দিও। সবসময় ওর পাশে থেকো।’

ডাইনিং রুমে দাঁড়িয়ে এই কান্নার দৃশ্য দেখতে একবারেই ভালো লাগছিল না জাওয়াদের। বিরক্ত লাগছিল ওর। নাটক মনে হচ্ছিল। কবে রেহাই পাবে সে চিন্তায় অস্থির। মামী শ্বাশুড়ির কথার উত্তরে কৃত্রিম হেসে বলল,
‘আপনি চিন্তা করবেন না।’

মামীকে ছেড়ে মায়ের কাছে গেল মুশরাফা। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বলল,
‘নতুন জীবনে পা রাখছি। মাথায় হাত বুলিয়ে একটু দোয়া করে দিবে, মা?’

মুশরাফার স্বরটা কাতরতায় ভরা। এই একটা মানুষের ভালোবাসার জন্য সারাজীবন চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় ছিল সে। অথচ পায়নি। একটা বার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়নি।

লায়লার চোয়ালে নিত্যকার গম্ভীর্য ছিল। আকস্মিক মেয়ের কথায় মেয়ের দিকে তাকালেন। চোখে চোখ পড়তেই ভেতরটা কেঁপে উঠল উনার। দৃষ্টি নরম হলো। মনে পড়ল, এভাবে তাকানো হয়নি কতকাল!

মায়েরা যতই নিষ্ঠুর হোক, গর্ভে ধারণের সময় জন্ম নেয়া টানটা কখনো না কখনো বেরিয়েই আসে। সেই ক্ষণে তারা হাজার চেষ্টার পরও কঠোর হতে পারেন না। লায়লা আঞ্জুমান এই ক্ষণে এসে সেই টানটা অনুভব করলেন। মেয়ের প্রতি জন্মে থাকা রাগের পাহাড় মেয়েকে নিয়ে ভাবতে দেয়নি। মেয়ের বিয়ে কোথায় হচ্ছে, কার সাথে হচ্ছে সেটা যাচাই করার ও ইচ্ছে ছিল না। আসার ইচ্ছা ও ছিল না। লোকলজ্জার ভয়ে এসেছেন মাত্র। এসেই যেন আটকা পড়লেন। মেয়েটাকে বধূর সাজে দেখে তার চক্ষ যেন শীতল হয়ে এসেছিল। ইচ্ছে করেছিল মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে, কিন্তু এতকালের দূরত্বে তাদের মাঝে গড়ে উঠে দেয়ালের জন্য পারেন নি। দূর থেকেই তাকিয়ে দেখেছেন। বরকে দেখেও তার ভালো লেগেছে। ছেলেটা দেখতে শুনতে ভালোই। তার উৎফুল্লতা দেখে ভালো লেগেছিল। ছেলেটা বিয়েতে খুশি। যাক, মেয়েটা সুখী হবে। কিন্তু বিয়ের পরদিন যখন তারা একসাথে ঘুরতে বেরুচ্ছিল তখন মেয়ে জামাইয়ের চেহারার বদলটা কেন যেন তার চোখে লেগেছিল। এই দৃষ্টির সাথে নিজের দৃষ্টির সাদৃশ্য পেলেন। ছেলেটা মেয়েটাকে মেনে নিতে পারছে না! মনের ভাবনা মিথ্যা হওয়ার দোয়াও করেছিলেন মনে মনে।
খানিক আগে যখন জাওয়াদরা রুম থেকে বেরুচ্ছিল, তখন তার মাস্ক খুলা, মুশরাফার দিকে ছুঁড়ে দেয়া বিরক্তিমাখা দৃষ্টি যেন তার ভাবনাকে সত্য প্রমাণ করল। মেয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি। চিন্তার পসরা বসল মনে। মেয়েটার সব ঠিকঠাক, যত গন্ডগোল সব পোশাক আশাকে। পোশাক আশাকটা বদলালেই হয়। এটাই মেয়ের কাল হবে, মেয়েটা বুঝে না কেন?

মেয়ের কথায় শিকলে বাধা মনটা আকস্মিক নড়ে উঠল। মাতৃত্বের মমতা উঁকি দিল মনে। তিনি মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে চাইলেন। অনেক গুলো বছরে তিলে তিলে গড়ে উঠা মনের দূরত্ব সেটা হতে দিল না। পারলেন না। তার ভেতরে বয়ে যাওয়া ঝড় কেউ টের পেল না। সবাই দোয়া করল, যাতে কোন বিশৃঙ্খলা না করে। ফরিদা পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,
‘জামাই আছে, মন থেকে না হোক, মুখ থেকে হলেও বিদায় দিন। একটু অভিনয় করুন, বিশৃঙ্খলা করবেন না আপা। আপনার কাছে হাতজোড় করছি।’

লায়লার ভেতরকার এক সত্তা তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। তিনি তড়িৎ চোখ মুখ থেকে কোমলতা সরালেন। গম্ভীর করলেন মুখ। ডান হাতটা মেয়ের মাথায় রাখলেন। তিনি স্পষ্ট টের পাচ্ছিলেন, তার হাত কাঁপছে। শুধু হাত নয়, হাতের সাথে কাঁপছে মন , কাঁপছে মাতৃত্ব। মনে মনে অনেক দোয়া করলেন। মুখে বললেন,
‘সুখী হ।’

মুশরাফা কী যে খুশি হলো! এই পর্যায়ে তার চোখে অশ্রু দেখা গেল। আবেগী হয়ে গেল সে। মাকে জড়িয়ে ধরল আকস্মিক। কান্না হাসিতে মেতে বলল,
‘আল্লাহ তোমাকে সবসময় সুখী রাখুক। আসি।’

মুশরাফা মাকে ছেড়ে সরে গেল। সবার থেকে বিদায় নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়াল। বাবা, মামা যাচ্ছে তার সাথে। ফরিদা, ফাইজা, ফাবিহা, জায়ফা দরজা অবধি এগিয়ে দিল মুশরাফাকে। লায়লা দিলেন না। শান বাধানো মনটায় ঝঙ্কার তুলছে তার। বাকি সবার মতো মেয়ে বিদায়ের কষ্ট ছুঁয়ে দিচ্ছে তাকে। সবার পিছনে দাঁড়িয়ে শূন্য দৃষ্টিতে মেয়ের যাওয়া দেখলেন। কেউ দেখল না, মাশকারার প্রলেপ লাগানো পাপড়ি জোড়া হঠাৎ ভিজে উঠার দৃশ্য। এই ঘরে থাকা যাবে আর এক মুহুর্ত। মনটা খা খা করছে। বসার ঘর ছাড়লেন তিনি। বাসায় যাওয়ার জন্য আগে থেকেই তৈরি হয়েছিলেন। রুমে গিয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে ফিরলেন। জায়ফার উদ্দেশ্যে বললেন,
‘চল, আমাদের দেরি হচ্ছে।’

ফরিদা অশ্রুভেজা চোখে তাকালেন। ক্ষিপ্ত হয়ে বলেই ফেললেন,
‘ আপনার মনে একটু ও মমতা নেই! আপনি সত্যি রাফাকে জন্ম দিয়েছেন? আমার সন্দেহ হয় আপা। মায়েরা এত নিষ্ঠুর হয়! আপনার মতো মা কোন শত্রুর ও না হোক আপা। আপনি রাফার মা হওয়ার যোগ্য না।’

লায়লা গম্ভীরমুখে কেমন করে হাসলেন। তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
‘আপনি তো যোগ্য, তবে আপনি রাখবেন ওর খেয়াল। ওর সুখ দুঃখের খবর রাখবেন। ছেলেটা তো ওর মতো জংলি না, মেনে টেনে নিয়েছে? হাবভাব তো সুবিধার না ছেলের। ওই জংলি পোশাকের জন্য জামাইর মার খাচ্ছে কি না খোঁজ নিয়েন। অসামাজিকের জন্য শ্বাশুড়ির নির্যাতনের শিকার হয় কিনা জেনে নিয়েন। যা স্বভাব ওর, হওয়াটাই স্বাভাবিক। ওই মেয়ের ব্যাপারে কোন কিছু শোনার ইচ্ছে আমার নেই। আপনি শুনেন। এই চল জায়ফা।’

মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন লায়লা। ফরিদা ক্ষিপ্ত হয়ে কত কী বলে গেলেন। অথচ তিনি টের পেলেন না, লায়লা তাচ্ছিল্যের আড়ালে তাকে সতর্ক করে গেছেন। তিনি যাবার আগে স্বরের সাথে যুদ্ধ করেছেন, বলতে যে, ভাবি আমার মেয়েটার খেয়াল রাখবেন। আমার মন বলছে, ও সুখে নেই। ওর সুখ যাচাই করবেন।
কিন্তু পারলেন কই? মনে জমানো রাগ, ক্ষোভ মানুষের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে। আর দূরত্ব গড়ে তুলে জড়তা। এই জড়তার জন্য চাইলেই অনেক বছর বাদে কাছে আসা যায় না, স্বাভাবিক হওয়া যায় না। মনের কথা বলা যায় না।

মায়মুনা ছেলে বউয়ের আগমন উপলক্ষ আত্মীয় স্বজন দাওয়াত করেছেন। বিয়েটা ঘরোয়াভাবে হয়েছে। সেভাবে কাউকে বলা হয়নি। সবার অভিযোগ, বউ না দেখার আক্ষেপ। ভাই বোনগুলো তো ক্ষেপে আছেন, মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোক ও বেজায় নারাজ। সবার দিকে চেয়ে ছোটো খাটো গেট টুগেদারের আয়োজন করলেন। বোন, জা নিয়ে বসার ঘরে বউ আসার অপেক্ষায় বসলেন তিনি। বউ আসল, বউয়ের পোশাক থেকে বিমূঢ় হয়ে গেলেন তিনি। এভাবে শ্বশুর বাড়ি আসে কেউ? একদিনের জন্য পর্দা না করলে কী হতো!
মানুষ কাজের আগে কত শর্তে সায় দেন, কিন্তু কাজের বেলায় সব ভুলে যান। মায়মুনা মুশরাফাকে পর্দার পরিবেশ গড়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিয়ের আগে। বিয়ে হতেই তিনি শক্ত মাটির নাগাল পেয়ে গেলেন। ওসব হেলাতেই ফেলে রেখেছেন তিনি। বিয়ে তে তো কত কথাই বলয়া হয়, বলতে হয় বলেই বলা। সব মানতে হবে না কি!

বিয়েতে আবার পর্দা কিসের? একদিনেরই তো ব্যাপার। কাল থেকে আবার পর্দা করবে। সমস্যা কী?
মুশরাফাকে বোরকায় দেখে তার মুখের রঙ বদলাল। ছেলের দিকে তাকালেন রাগি চোখে। যার অর্থ, এভাবে এনেছিস কেন? জাওয়াদ হতাশ চোখে তাকাল কেবল। তারপর পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

মায়মুনা মুশরাফাকে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। ভালো মন্দ জিজ্ঞেস না করে গমগমে গলায় বললেন,
‘একদিনের জন্য পর্দা না করলে কী এমন হতো? যাক গে, এসব আলখাল্লা ছেড়ে বসার ঘরে আসো। ‘

বসার ঘরে নারী পুরুষের অবাধ বিচরণ দেখে এসেছে মুশরাফা। যাদের কাউকেই চিনে না ও। ছেলে বয়সী, বয়স্ক অনেকজন আছে। এরা সবাই গায়রে মাহরম। কীভাবে যাবে ও?

স্তব্ধ চোখে তাকাল। স্বর অবরুদ্ধ হলো ওর, হতভম্ব হলো মুখ। মায়মুনার পরিবর্তিত মুখটা কিছুতেই হজম হচ্ছে না ওর। বিয়ের দিন অবধি উনার স্বরে কী কোমলতাই না ছিল! সবার সামনে বলছিলেন, তুমি একবারে চিন্তা করো না। আমার বাসায় যেভাবে ইচ্ছে থাকতে পারবে, তোমার পর্দার খেলাপ হবে না। অথচ নিজের বাসায় আসতেই সেই কোমলতা দূর হয়ে গেল! মুশরাফা কিছু বলতে চাইল, মায়মুনা সুযোগ না দিয়ে কাকনকে ডেকে ওকে তৈরি করিয়ে বসার ঘরে নেয়ার নির্দেশ দিলেন। তারপর চলে গেলেন।

মুশরাফা শ্বাশুড়ির মাঝে মায়ের রূপ দেখতে পেল। সব মেয়েরা শ্বাশুড়িতে মাকে চায়। সে পেল, অথচ খুশিতে হতে পারছে না। কী ভাগ্য ওর! মুশরাফা বুঝে গেল, স্বামীর কাতারে শ্বাশুড়ি ও পড়ে গেছে। সে বাবার বাড়ি থেকে বেঁচে আবার বাবার বাড়িতে এসে পৌঁছেছে। আবার শুরু হবে পর্দা রক্ষার সংগ্রাম। মামা তাকে এই সংগ্রামী জীবন থেকে বাঁচানোর জন্য বিয়ে দিলেন, সেই একই জাতে। ততক্ষণে কাকন চলে এসেছে। এ যেন কাকন নয় সাফা, সেই দিনের সাফা। জোরাজোরি করে বোরকা খুলে ফেলল ওর। এরপর বসার ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোরাজোরি শুরু করল। মুশরাফা ঠায় বসে রইল।

জাওয়াদের রুমটা মায়মুনার রুমের পাশে। মায়ের রুমের পাশ কাটিয়ে বসার ঘরে যেতে হয়। ফ্রেশ হয়ে জাওয়াদ বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রুম থেকে বের হলো। মায়ের রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কাকনের আওয়াজ পেল। মুশরাফার চাপা স্বর ও কান এড়াল না। কৌতুহলবশত দরজা গিয়ে দাঁড়াল। তাকে দেখেই কাকন অভিযোগের সুরে বলল,
‘দেখো, তোমার বউ বসার ঘরে যেতে চাচ্ছে না।’

জাওয়াদ তাকাল মুশরাফার পানে। গোলাপী কাতান শাড়িতে মেয়েটাকে অপূর্ব লাগছে। চোখ ধাঁধিয়ে আসছে তার সৌন্দর্যে। এই রূপেই একদিন আটকে গিয়েছিল জাওয়াদ। মোহে পড়ে জীবনে ও এনেছে, অথচ বাস্তবতার সম্মুখীন হতেই মোহ কেটে গেল। এত আকর্ষণীয় রূপ ও ওকে আকর্ষণ করতে পারছে না। আজ কোন ঘোর লাগছে না, মুগ্ধতা ভীড় জমাচ্ছে না চোখে।
সিনেমার মতো নায়িকার রূপে মজে নায়িকার সব দোষ ক্ষমা করা হয়না বাস্তবে। দোষের কাছে রূপকে হারতে দেখা যায়। এখনো দেখা গেল। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। যেন কিছু জানেই না এমন ভান করে বলল,
‘ এসব মেয়ালি প্রথায় আমি নেই। তোমরা জানো।’

জাওয়াদ চলে গেল। মানুষ কারো প্রতি বেশি আশা করলে, সে পূরণ না করলে হতাশ হয়। মুশরাফা জাওয়াদের প্রতি কোন আশা করেনি। যে তার পর্দার জন্য তাকে স্ত্রী পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করে, সে তার পর্দার ব্যাপারে সাপোর্ট করবে! স্বপ্ন বৈকি। আশা না করায় হতাশ হয়নি। তবুও কেন যেন এক পলক তাকিয়েছিল স্বামীর পানে। জাওয়াদ দৃষ্টির আড়াল হতেই মনে মনে বলল,
‘আল্লাহ, আমাকে ধৈর্যধারণ করার শক্তি দাও। আমি যেন ধৈয্যশীল হই, দুর্বল না হই।’

চাপা শ্বাস ফেলে কাকনের উদ্দেশ্যে বলল,
‘আমাকে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ার সুযোগ দিবেন, ভাবি?’
মুশরাফার দৃঢ় বিশ্বাস, সবাই নিরাশ করলেও আল্লাহ ওকে নিরাশ করবে না। আল্লাহর বিধান পালনের জন্যই তো এত সংগ্রাম তার। সফলতা আনার দায়ভার ও তার।

সময় বাড়ল, বাড়ল বিপদ। এ যেন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। শেষ অবধি কী হলো? এলো কোন প্রতিকার? না কি হার মানতে হলো?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here