স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি। (পর্ব- ১৯)

#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি। (পর্ব- ১৯)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

ঘড়ির কাটায় সকাল আটটা। ব্যস্ত হাতে রুটি বেলছে মুশরাফা । দু’মুখো চুলোর একটায় ভাজি বসিয়েছে, আরেকটায় প্রেশার কুকারে চিকেন কারি বসিয়েছে। রুটি বেলার পাশাপাশি চুলোতেও উঁকি দিচ্ছে। জাওয়াদের টিফিন, সবার নাস্তা একসাথে সামলাতে গিয়ে হিমসিম খেতে হচ্ছে তাকে। আজ বুয়া আসেনি। সে আসলেও কিছুটা সাহায্য পেত। ওকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে শ্বাশুড়ি, জা এ মুখো হয়নি। সব একা হাতে করতে হচ্ছে ওকে। প্রেশার কুকারে বসানোয় মুরগীটা আগে হয়ে গেল। কুকার নামিয়ে তাওয়া বসিয়ে দিল। রুটি বেলার ফাঁকে চেকতে ও লাগল। এর মাঝে ভাজি হলে চা বসাল। রুটি চেকা শেষ হওয়ার পর ওই চুলোয় ভাত বসাল। রান্নার চাপে পড়লে গৃহিনীরা রোবট হয়ে যান। দু’হাতে রোবটের মতো কাজ করেন। মুশরাফার হাত জোড়া এই মুহুর্তে রোবটের মতো চলছে। চায় বানিয়ে নাস্তা সমেত টেবিলে রেখে আসল। মায়মুনা আর কাকন টেবিলে ছিল। মুশরাফা বলল,
‘মা, নাস্তা রেখে যাচ্ছি।’

কাকন বলল,
‘ এ বাসায় সবাই একসাথে খাবার খায়। তুমি ও বসে যাও। বাকিরা এসে যাবে।’

মুশরাফা ধীর স্বরে বলল,
‘ আমি পরে খাব।’

মায়মুনা কারণ ধরতে পারলেন। তীক্ষ্ম গলায় বললেন,
‘ তুই আবার নাটক শুরু করেছিস? সকাল সকাল অশান্তি না করলে হচ্ছে না তোর? নিজের নাই ঠিক, আবার আসে মানুষকে খারাপ বলতে..

মায়মুনা গতকালের মতো আবার শুরু করলেন। মুশরাফা বিভ্রান্ত চোখে তাকাল এক পলক। তারপর রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। ভাত কতদূর হলো দেখা দরকার। মায়মুনা মনে করলেন, মুশরাফা উনাকে এড়িয়ে গেছে। তার রাগের মাত্রা বাড়ল। টেবিলে বসেই বকাঝকা শুরু করলেন। সবাই খেতে আসতেই থেমে গেলেন। এমন ভান করলেন, যেন কিছুই হয়নি। সবাই এসে খেয়ে গেল। মুশরাফার রান্না ও শেষ। হট টিফিন বক্সে খাবার রেখে রুমের দিকে পা বাড়াল। ডাইনিং টেবিলে তখনো বউ শ্বাশুড়ি বসা। জাহিন খেতে চাচ্ছেনা, কাকন জাহিনকে খাওয়াচ্ছে। মায়মুনা ওষুধের বক্স নিয়ে বসেছেন। মুশরাফা পাশ কাটিয়ে যাবার সময় ওর হাতে থাকা বক্স দেখলেন। মায়মুনা ধারণা করলেন, মুশরাফা নিজের খাবার নিয়ে রুমে চলে যাচ্ছে। দমে যাওয়া রাগটা আবার উঠল। সবার সাথে খেতে এত সমস্যা কেন? সবার সাথে খেলে গায়ে ফোস্কা পড়ে যাবে?
রাগী স্বরে বললেন,

‘ সবার সাথে না খেয়ে একা রুমে নিয়ে খাওয়া যে অভদ্রতা এটা তোর বাবা মা তোকে শেখায় নি? কী শিখিয়েছে তোকে? শুধু বেয়াদবি? টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে, খেলে এখান থেকে খাবি সবার সাথে। নয়তো খাবি না। রুমে নিয়ে খাওয়ার রীতি নেই এ বাসায়। ‘

মুশরাফা থামল। মায়মুনার স্বভাব সে আন্দাজ করে ফেলেছে। এখন প্রতিনিয়ত তার ভুল ধরে তাকে কথা শুনাবেন তা বেশ বুঝতে পেরেছে। নিজেকে প্রস্তুত ও করে নিয়েছে। সে হিসেবে খুব একটা অবাক কিংবা ব্যথিত হলো না। ধীর স্বরে বলল,
‘ এই বক্সে উনার টিফিন। ‘

মায়মুনা বিশ্বাস করলেন না। এই বাসায় কেউ টিফিন নেয় না। বাবা ভাই সবাই বাইরে খায়। এত বলে কয়ে ও কাউকে দিয়ে টিফিন নেয়ানো যায় না। কত চেষ্টা করলেন তিনি! পারলেন কোথায়! বাসা থেকে টিফিন নেয়া সবচেয়ে অপছন্দ হলো জাওয়াদের। সে তো স্কুল লাইফে ও টিফিন নিতো না। এটা না কি ওর কাছে মেয়ালি ব্যাপার মনে হয়। সেখানে সে নিবে টিফিন! অসম্ভব। মেয়েটা নিশ্চিত বানিয়ে বলছে। মায়মুনা নিজের ধারণা মতেই বললেন,
‘ জাওয়াদ নিবে টিফিন! আর আজাইরা কথা বলার জায়গা পাস না! শেষ অবধি নিজের কাজে আমার ছেলেকে ও ব্যবহার করা শুরু করেছিস? তোর মা বাপ এসব শিখাইছে তোরে?’

শ্বাশুড়ি সমাজের পছন্দের টপিক হলো পুত্রবধুর বাবা মায়ের শিক্ষা নিয়ে কথা বলা। কিছু হলেই বাবা মায়ের শিক্ষা নিয়ে কথা উঠাবে। ওটা ভিন্ন ব্যাপার যে, তারা নিজেদের মেয়েকে ও সেভাবে শিক্ষা দেন নি। কিন্তু সেসব মনে করার সময় কই?
বাবা মা নিয়ে কথা উঠলে খারাপ লাগে মুশরাফার। ওর কথা হলো, দোষ যদি করে থাকে ও করেছে। ওর বাবা মা তো করেনি। তবে ওদের টানা হবে কেন? সেই খারাপ লাগা প্রকাশ করল না। ও বেশ বুঝতে পেরেছে ওকে বিশ্বাস করবেন না মায়মুনা। যাই বলুক ভুলই বুঝে যাবেন। তাই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর রুমে চলে গেল।

জাওয়ার তখন অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছিল। মুশরাফা সালাম দিল রুমে ঢুকে। জাওয়াদ তাকাল এক পলক। আবার চোখ ফেরাল। মুশরাফা টিফিন বক্স ব্যাগে ঢুকিয়ে বলল,
‘ কাল তো টিফিন খেলেন না। আজ অন্তত খাবেন। বাইরের খাবার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না। শরীরে রোগ বাসা বাধবে। ‘

বলে ব্যাগ রেখে ফ্যানের নিচে এসে দাঁড়াল। পুরো শরীর ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে আছে। জাওয়াদ তৈরি হয়ে ব্যাগ নেয়ার সময় টিফিন বক্স রেখে যেতে উদ্যত হলো। মুশরাফার দিকে তাকাল এক পলক। ওর ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত চেহারা যেন বলে উঠল, আমি এই সাতসকালে অনেক কষ্ট করে আপনার জন্য টিফিন তৈরি করেছি। প্লিজ নিয়ে যান! অথচ মুশরাফার চোখ, মুখ বন্ধ। শুধুমাত্র ওর জন্য একটা মানুষের এই পরিশ্রমকে বৃথা যেতে দিতে বাধা দিল জাওয়াদের বিবেকবোধ। রাখতে গিয়ে ও রাখল না।

ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল। বসার ঘরে মাকে বসা দেখে বলল,
‘মা যাচ্ছি।’

মায়মুনার চোখ পড়ল জাওয়াদের ব্যাগে। জাওয়াদ সত্যি টিফিন নেয়! মেয়েটা তবে সত্য বলছিল! মায়মুনা বলেই ফেললেন,
‘তুই টিফিন নিচ্ছিস?’

জাওয়াদ ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘ হ্যাঁ। আসি মা।’ জাওয়াদ এত কিছু খেয়াল করল না, চলে গেল। মায়মুনা অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইলেন কেবল। তার ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণ হলো। তবু ও তিনি দমলেন না। মুশরাফাকে বাঁকা চোখেই দেখলেন। সুযোগ ফেলেই বকাঝকা করলেন। বুয়া না আসায় মুশরাফা ঘর ঝাড়ু দিল। জিশান রুমে থাকায় জিশানের রুমে যায়নি। বাকি রুমে ঝাড়ু দিয়ে এসেছে।
মুশরাফা ঝাড়ু দেয়ার খানিক বাদে জিশান এসে বলল,
‘মা বুয়া এলে বলো, আমার রুম ঝাড়ু দিতে। অনেক ময়লা জমে গেছে।’

মায়মুনা সুযোগ ফেলেন। মুশরাফা কেন ওর রুম ঝাড়ু দিল না এই নিয়ে কথা শুনালেন। দুপুরে একসাথে খেতে না বসায় ও বকলেন। দিনটা বকা খেয়েই কাটল মুশরাফার। সন্ধ্যায় ছেলে ফিরতেই মায়মুনা ইনিয়ে বিনিয়ে ছেলের কান ভারি করলেন। জাওয়াদ রুমে গেল। জাহিন থেকে শুনেছে, আজ সকালে মা মুশরাফে বেশ বকাঝকা করেছে। ওর ভাবনা আজ অন্তত মুশরাফা ওর কাছে মায়ের নামে অভিযোগ দিবে। কিন্তু দিল না। পূর্বাকার নিয়মে হেসে সালাম দিল। বলল,
‘কিছুক্ষণ ফ্যানের নিচে বসুন। ঘাম শুকিয়ে যাক। এখন শাওয়ার নিলে ঠান্ডা লেগে যাবে। ‘ বলে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি এনে দিল।

জাওয়াদই বলল,
‘ কী হয়েছে আজ বাসায়?’

মুশরাফা তেমন কিছুই বলল না । না কোন অভিযোগ দিল। শুধু বলল,
‘ ইসলামে দেবরের সাথে সখ্যতা গড়া হারাম। আমি কী করব? বলুন!’

মুশরাফার চাপা স্বভাবের ধাতটা ধরতে পারল এই ক্ষণে। এই কথার বিপরীতে কী বলবে ভেবে পেল না সে। নিরবতায় গা মাড়াল। মুশরাফা টিফিন বক্স বের করে ওর সামনেই খুলে দেখল খেয়েছে কি-না। টিফিন বক্স খালিই পেল। প্রসন্ন হেসে বলল,
‘জাযাক-আল্লাহু খায়রান। (আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুক)’

চোখে মুখে খুশির ঝিলিক দিচ্ছে। এত ছোট্টো ব্যাপারে যে কেউ এত খুশি হতে পারে, জানা ছিল না জাওয়াদের। সে নিশ্চুপ মুশরাফার খুশিমাখা মুখ পরখ করল। মুশরাফা টিফিন বক্স নিয়ে রুম থেকে বেরুনোর জন্য উদ্যত হলো। জাওয়াদ বলল,
‘টেবিলে আইসক্রিম রেখে এসেছি। সবাইকে সার্ভ কোরো। আমার জন্য ও নিয়ে এসো।’

মুশরাফা চলে গেল। সবাইকে দিয়ে যখন ফিরল তখন জাওয়াদ ওয়াশরুমে। জাওয়াদ বের হয়ে খেতে বসে বলল,
‘সবাই খেয়েছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘মা খেয়েছে?’
‘হ্যাঁ।’

জাওয়াদ ইতস্ততবোধ করল। কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছে, জড়তার জন্য পারছে না। মুশরাফা ধরে ফেলল। হেসে বলল,
‘আমি খাইনি। ‘

জাওয়াদ চোরা চোখে তাকাল। মেয়েটা দুরদর্শী। সব কিভাবে বুঝে যায়! আইসক্রিম মুখে তুলে বলল,
‘আইসক্রিম শেষ? ‘

মুশরাফা হেসে বলল,
‘ না। আপনি তো আমাকে খেতে বলেন নি। তাই খাইনি।’

জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। মুশরাফা হেসে বলল,
‘ স্বামী স্ত্রী এক পাত্রে খাওয়া সুন্নত। আপনি যদি আপনার বাটি থেকে আমাকে খাওয়ার সুযোগ দেন তবে খেতে পারি। ‘

জাওয়াদ তৎক্ষনাৎ উত্তর দিল না। মুখ কুঁচকে বলল,
‘ কারো এঁটো খাওয়া বা কাউকে এঁটো খেতে দেয়া আমার পছন্দ নয়। বক্স থেকে নিয়ে খাও।’

মুশরাফা মুখ টিপে হেসে বলল, ‘ আমার পছন্দ বলে আইসক্রিম আনতে সমস্যা নেই,কিন্তু এক বাটিতে খেতে সমস্যা! খেলে আপনার বাটি থেকে খাব, নইলে খাবোই না।’

জাওয়াদ প্রতিবাদ করল, ‘ আমি জাহিনের কথা ভেবে এনেছি।’

মুশরাফা হেসেই বলল, ‘ আমি বুঝতে পেরেছি। ঠিক বিয়ের দু’দিন পরের মতো।’

সেদিন সন্ধ্যায় জাহিনকে নিয়ে আইসক্রিম খেতে যাবার সময় জেরিন মুশরাফাকে সাথে নিতে বললে জাওয়াদ নেয় নি। কিন্তু ফিরতি পথে আইসক্রিম নিয়ে ফিরেছে ঠিকই। ওকে না নেয়ায় মুশরাফার মন খারাপ হয়েছিল, আইসক্রিম দেখেই মন খারাপটা বিলীন হয়েছে। সত্যটা সেই ক্ষণেই টের পেয়েছে মুশরাফা। জাওয়াদ আবার চমকাল। মানুষকে এত চালাক হওয়া ও উচিত না। পাজি মেয়ে!

জাওয়াদ মনে মনে ক্ষেপে গেল। মুশরাফাকে দিল না, একাই খেল। খেয়ে বাটিটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ এঁটো খেতে চাইলে না তুমি? এবার এঁটো বাটি কামড়ে খাও।’

‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার। আশহাদু-আল লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ। ‘

মাইলখানিক দূরে অবস্থিত মসজিদ থেকে আজান ভেসে আসছে। নিস্তব্ধ পরিবেশ মুখরিত হচ্ছে রবের প্রার্থনার আহ্বানে। এই মধুর আহ্বান কানের পর্দায় করাঘাত করতেই চোখ থেকে ঘুম ছুটে গেল মুশরাফার। আরও মিনিট দশেক বাদে এলার্ম বাজবে।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজানের মাঝে সবচেয়ে সুন্দর এবং হৃদয়গ্রাহী হলো ফজরের আজান। এর বিশেষত্ব হলো, নিস্তব্ধতা। বাকি সব আজানের সময় পৃথিবী কোলাহলে পরিপূর্ণ থাকে। মানুষের হৈচৈ, শোরগোল, কলকারখানার শব্দ, গাড়ির শব্দ, ট্রাফিক পুলিশের বাঁশির শব্দ, নানা শব্দে ভারি থাকে পরিবেশ। এত শব্দের মাঝে আজান ভালোভাবে শোনা যায় না, বা হয়না।

ফজরের সময়টায় পৃথিবী ঘুমিয়ে থাকে। নিরব নিস্তব্ধতা মাড়ানো থাকে চারপাশ। কোন কোলাহল নেই, কোন শব্দ নেই, কোন ব্যস্ততা নেই। মৃদু বাতাস বয়ে চলে। শীতল থাকে আবহাওয়া। সেই শীতল আবহাওয়া নিরবতার চাদর ঠেলে মুয়াজ্জিন গেয়ে উঠেন রবের গুনগান। ঘুমন্ত পৃথিবীকে জাগাতে বলে উঠেন, ‘ঘুম থেকে নামাজ উত্তম।’
খোলা পরিবেশে মৃদু বাতাস গায়ে মাখিয়ে সেই আজান শুনার মতো চমৎকার অনুভূতি দুটো নেই। ঘুমের জন্য অধিকাংশ মানুষ এই অনুভূতি থেকে বঞ্চিত হয়। মুশরাফার আজ সুযোগ হলো। সুযোগটা হাতছাড়া করল না সে। বারান্দায় চলে গেল। চোখ বন্ধ করে শুনল আজান।

মুয়াজ্জিন তখন সুমিষ্ট সুরে বলছে,

‘হাইয়্যা আলাস সালাহ্ (নামাজের জন্য এসো।) হাইয়্যা আলাল ফালাহ্ (কল্যাণের জন্য এসো) আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম। (ঘুম থেকে নামাজ উত্তম)…. আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার। লা ইলাহা ইল্লাহ।

মুয়াজ্জিন একবার দুবার করে বললেন কথা গুলো। মুশরাফা মুয়াজ্জিনের সাথে সবটা রিপিট করল। শুধু মুয়াজ্জিন যখন বলল, ‘হাইয়্যা আলাস সালাহ্, হাইয়্যা আলাল ফালাহ্, তখন ‘ হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। (অর্থঃ আল্লাহ ব্যতীত অনিষ্ট দূর করার এবং কল্যাণ লাভের কোন শক্তি কারো নেই।)’ বলল।

আজান শেষ হতে হতেই মুশরাফা অনুধাবন করল, ওর মেজাজ ফুরফুরে হয়ে গেছে। মন প্রাণ শীতল হয়ে আসছে । পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তিময় বাণী বলা যায় আজানকে। । আজানের উত্তর দিল। চোখ বন্ধ করে দোয়া ও করে ফেলল। আযান এবং ইকামতের মাঝামাঝি সময়ে করা দোয়া কবুল হয়।

ফ্রেশ হয়ে অযু করে এলো। ততক্ষণে এলার্ম ও বেজে উঠল। এলার্মের শব্দে ঘুম ভেঙেছে জাওয়াদের। নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে গেল। মুশরাফা ডাকল দু’বার,
‘এই যে উঠুন।’

জাওয়াদ উঠল না। মুশরাফা ওর কানে ফুঁ দিল, গাল টেনে দিল। জাওয়াদ বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকাল, ‘এত বিরক্ত করো কেন? ঘুমোতে দাও।’

‘ ঘুম থেকে নামাজ উত্তম। উঠুন। ‘ মুশরাফা বলল। জাওয়াদ উঠল না। মুশরাফা উঠে দাঁড়াল। তবে উঠার আগে ফোনে দুই মিনিট পরপর এলার্ম সেট করে দিল। খানিক পরেই বেজে উঠল। ভাইব্রেশনে পুরো খাট কেঁপে উঠল। সাথে কানফাটা রিংটোন তো আছেই। মুশরাফা মুখটিপে হেসে নামাজে দাঁড়াল। এত শব্দের মাঝে ঘুমানো যায় না। জাওয়াদ একরাশ বিরক্তি নিয়ে উঠে বসল। বিড়বিড় করে বলল,
‘এই মেয়ে আমাকে শান্তি দিল না।’

নামাজে দাঁড়িয়ে গেছে দেখে কিছু বলতে ও পারল না। অগত্যা উঠে পড়ল। ফ্রেশ হয়ে অযু করে আসতেই ফোনের রিংটোন কানে এলো। কাছে গিয়ে দেখল, বাবা নামটা ভাসছে পর্দায়। জাওয়াদ অবাক হলো। এই মুহুর্তে বাবা ফোন দিচ্ছেন!

মুশরাফা চুপ রইল। শ্বশুর ফোন দিবেন, ওকে ডাকবেন এমন কিছুই বলল না। ও বললে হয়তো না ও যেতে পারে। কিন্তু এটা নিশ্চিত, বাবার কথা ফেলবে না জাওয়াদ।

অপরদিকে মসজিদের জন্য তৈরি হয়ে বসার ঘরে বসে আছেন জয়নাল আবেদীন। অবিবাহিত ছেলের রুমের দরজায় নক করা যায় নির্দ্বিধায়, কিন্তু বিবাহিত ছেলের দরজায় নক করা যায় না। তাও রাতের বেলায়। এটা অশোভন দেখায়। তাই তিনি নক করলেন না। ডাকলেন ও না। ভেবেচিন্তে কলই দিলেন। জাওয়াদ কল না ধরে বেরিয়ে এলো হন্তদন্ত হয়ে। বাবাকে বসার ঘরে দেখে বলল,
‘কী হয়েছে বাবা? কল দিলেন? সব ঠিকাছে? ‘ বিপদের আশঙ্কা ওর চোখে।

জয়নাল আবেদীন হেসে বলল,
‘ কিছু হয়নি। নামাজ পড়তে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম তোকে ও ডেকে নিই। বাপ ছেলে একসাথে নামাজ পড়ে আসব। রেড়ি হয়ে আয়, একসাথে মসজিদে যাব।’

জাওয়াদ হাফ ছাড়ল। অবাক ও হলো, বাবার প্রস্তাব শুনে। বাবার চোখে নিজের জন্য আগ্রহ দেখে ভালো ও লাগল। বাবার কথা ফেলতে পারল না। নামাজ তো পড়বেই ঘরে কিংবা বাইরে। এক জায়গায় হলেই হলো। ও ধীরে বলল,
‘আপনি দাঁড়ান, আমি পাঞ্জাবি পরে আসছি।’

রুমে চলে গেল জাওয়াদ। ঝটপট পাঞ্জাবি পরে নিল। মুশরাফা খুশিমাখা চোখে তাকিয়ে দেখল। দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
‘আমি বাবার সাথে মসজিদে যাচ্ছি । ‘

মুশরাফা জায়নামাজে বসে তাসবিহ পড়ছি। উঠে এলো। সামনে দাঁড়িয়ে চট করে অধর ছুঁলো ধৃষ্টতায়। আদুরে গলায় বলল,
‘আপনাকে এখন স্বামী স্বামী ধরণের সুন্দর লাগছে। ‘

জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। তারপর চলে গেল। বাবার সাথে গেল মসজিদে। নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করল দু’জন। সাথে গল্প সল্প ও করল। বাবা মনখুলে কতকথা বললেন ওর সাথে। বাবাকে ভীষণ খুশি দেখাচ্ছে। ফেরার পথে বললেন,
‘ আজ আমার মনে হচ্ছে, তুই সত্যি আমার ছেলে। আমি এমন একটা ছেলেই চাইছিলাম।’

জাওয়াদ হাসল। মৃদুস্বরে বলল, ‘কাল আমাকে ডেকে নিয়েন, বাবা।’
জয়নাল আবেদীন সাহেব শব্দ করেই হাসলেন। এত পরিমাণ খুশি লাগছে তার, প্রকাশ করতে পারছেন না। ছেলের কাধ চাপড়ালেন। বললেন,
‘এই না হলে, আমার ছেলে!’

গর্বিত স্বর তার। জাওয়াদের একটা ধারণা ছিল, বাবা তাকে শুধু শাসন করেন, ভালোবাসেন না। অবাধ্যতায় বাবা যখন ওকে ধমকাতেন তখন জাওয়াদের মনে হতো বাবা ওর সুখ সইতে পারেন না। ও তো সুখে আছে, তবে বাবার সহ্য হচ্ছে না কেন? কিন্তু এই মুহুর্তে এসে মনে হচ্ছে বাবা তাকে খুব ভালোবাসেন। বাবা তার সুখই চান। এভাবে বাবাকে পাওয়া হয়নি, বুঝে ওঠাও হয়নি।

বাপ ছেলে ঘুরে ফিরে বাড়ি ফিরল। জাওয়াদ রুমে গেল। ওকে ভীষণ খুশি দেখাল। মুশরাফা তখন বারান্দায় সূর্যোদয় দেখছে। জাওয়াদ বারান্দায় গেল। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে বলল,
‘ বসার ঘরে চা দাও। ‘

বলে চলে গেল বসার ঘরে। মায়মুনাকে ও দেখা গেল বসার ঘরে। জাওয়াদ যেতে যেতেই শুনল, বাবা উৎফুল্ল হয়ে মাকে বলছেন,
‘একজন বাবার কাছে নিজের ছেলেকে সুপথে ফিরতে দেখার চেয়ে সুন্দর দৃশ্য, সুন্দর অনুভূতি দুটো নেই। ‘

জাওয়াদ হাসল। বসার ঘরে যেতেই মায়ের বিস্ময় মাখা মুখ সামনে এলো।

দিনটা ছিল শুক্রবার। ছুটির দিন জাওয়াদ হয় ঘুমিয়ে কাটায়, নয়তো ঘুরে কাটায়। কাল রাতে ভেবে রেখেছিল, আজ সারাদিন ঘুমিয়ে কাটাবে। কিন্তু সকালে বাবার সাথে নামাজ পড়তে গিয়ে ফিরতে দেরি হয়ে গেলো, তারপর এসে মায়ের সাথে গল্পে বসল। নাস্তা সেরে আসতে আসতে ন’টা পার হলো। রুমে এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মাঝে ঘুমিয়ে ও পড়ল। ঘুম ভাঙল মুশরাফার ডাকে। জাওয়াদ চোখ না খুলে বিরক্ত হয়ে বলল,
‘আমার ঘুমের সাথে কী শত্রুতা তোমার? শান্তিমতো ঘুমোতে দাও।’

মুশরাফা অনুরোধের সুরে বলল,
‘ উঠুন না। কাপড় গুলো ছাদে মেলে দিয়ে আসুন।’

জাওয়াদ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বলল, ‘ বুয়াকে দিয়ে মেলে দিয়ে আসো।’

মুশরাফা অবাক স্বরে বলল, ‘ উনি বেগানা মহিলা। উনি কেন আপনার কাপড় ধরবে? আপনি উঠুন।’

কথাটা কানে গেল জাওয়াদের। সে বলল,
‘কিছু হবে না যাও।’
মুশরাফা স্পষ্ট বলল,
‘আমি আপনাকে বা আপনার জিনিসে কোন বেগানা মহিলার স্পর্শ সহ্য করতে পারব না।’

জাওয়াদ উঠল না। মুশরাফা হতাশ হয়ে বোরকা পরে নিজেই গেল বালতি হাতে। সবে দুটো শার্ট মেলেছে। তখন ফোনে কথা বলতে বলতে সিড়ির রুমে এসে দাঁড়াল জাওয়াদ। । মুশরাফাকে ডেকে বলল,
‘ এদিকে আসো, মামী কথা বলবে তোমার সাথে। ‘

মুশরাফা সিড়ির রুমের দিকে এগিয়ে এলো। হাত মুছে ফোন হাতে নিল। সিড়ির রুমে দাঁড়িয়ে কথা বলল। জাওয়াদ দরজা টেনে ছাদে গেল। অনেকক্ষণ পর ফিরে এলো। কিছু না বলে নিচে চলে গেল। মুশরাফা কথা শেষ করে যখন ছাদের গেল। তখন বিস্ময়ে হা। বিস্ময়ে কাটিয়ে উঠেই হেসে ফেলল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here