স্বপ্নচারিণী,পর্ব_৯

স্বপ্নচারিণী,পর্ব_৯
সামান্তা সিমি

বাড়ির মেয়েদের গ্রুপটা একসাথে জড়োসড়ো হয়ে নিশানের রুমের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।ওরা ভেতরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না।
তাঁদের নিশান ভাইয়া আজ এখনো অফিসে যায় নি।ঘুম থেকে উঠেই ওদের সবাইকে রুমে ডেকে পাঠিয়েছে।
যূথীর মেজাজ বিগড়ে আছে।সে কোনোভাবেই নিশানের সামনে যেতে চায় না।এ কয়েকদিন নিজেকে আড়ালে রেখেছিল।কিন্তু আজ তো একদম ঘরে ডেকে পাঠিয়েছে।
যূথী বলল,

“—এই তোমরা ভেতরে যাও।আমি না গেলে এমন কিছুই হবে না।কি জন্য ডেকেছে সেটা শুনে চলে আসো।”

“—নেভার! ভাইয়া আমাদের সবাইকে ডেকেছে।আমরা সবাই একসাথে ভেতরে যাব।বকা খেতে হলে একসাথে খাব।” (মনীষা)

“—এত কথা বলার দরকার কি! এখানে বকবক না করে চল দেখে আসি কি জন্য ডেকেছে।” (নীলিমা)

মনীষা আস্তে আস্তে দরজায় নক করল,

“—ভাইয়া আসবো?”

ভেতর থেকে আওয়াজ আসলো,

“—আয়!”

চারজন রেলগাড়ীর মত সিরিয়াল ধরে রুমে ঢুকল।সবার পেছনে যূথী।সে ইচ্ছে করেই নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে।
নিশান সোফায় বসে কফি খাচ্ছিল।ওদের আসতে দেখে কাবার্ড খুলে একটা বড় প্যাকেট সামনে রাখল।

নীলিমা স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করল,

“—কেন ডেকেছো ভাইয়া?”

“—প্যাকেটটা খুলে দেখ।”

মনীষা হাত বাড়িয়ে প্যাকেট নিয়ে খুলে ফেলল।যূথী বাদে বাকি দুইজন হামলে পরল প্যাকেটটার উপর। ভেতর থেকে লেটেস্ট মডেলের চারটা নিউ ফোনের বক্স বেরিয়ে আসলো।ওদের চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে নিশান ভাইয়া ওদের ফোন গিফট করেছে।
বিদীষা চিৎকার করে বলে উঠল,

“—ওওও ভাইয়া!!! নিউ ফোন!! আমাদের জন্য???”

নিশান কোনো জবাব দিল না।সে স্ট্রেইট তাকিয়ে আছে পেছনে বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকা যূথীর দিকে।এতদিন ইচ্ছে করে তাঁর থেকে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল মেয়েটা।নিশানের মন চাইছে ঠাস ঠাস করে যূথীর গালে দুইটা চড় বসিয়ে দেয়।যূথী এখনো জানে না তাঁর রাগ সম্পর্কে।
নীলিমার ডাকে যূথীর থেকে চোখ ফেরাল নিশান।

“—ভাইয়া! আমাদের তো ফোন আছে।যূথীর অবশ্য নেই।আমাদের জন্য শুধু শুধু কেনো আনতে গেলে!”

“—ভাল না লাগলে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আয়।”

নিশানের এমন কথায় নীলিমা থতমত খেয়ে গেল।সে একটু ভাব নিয়ে কথাটা বলতে গেছিল উল্টে নিশান ভাইয়া তাঁর গালে একটা অদৃশ্য চড় বসিয়ে দিল।

ফোন হাতে নিয়ে চারজন বেরিয়ে যেতে নিলে নিশান বলে উঠল,

“—মনীষা তোরা যা।যূথীর সাথে আমার কথা আছে।”

একটা ঢোক গিলল যূথী।এখন কি করবে সে? “যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়”- এই প্রবাদ বাক্যটা আজ তাঁর কাছে সত্য মনে হচ্ছে। যতই সে নিশান নামক রাক্ষস লোকটা থেকে দূরে যাওয়ার প্ল্যান করছে ততই যেন তাঁকে কাছে যেতে হচ্ছে।
যূথীকে ঘরে রেখে বাকি তিনজন দরজা লাগিয়ে বেরিয়ে গেল।
যূথী আড়চোখে দেখছে আর বুঝার চেষ্টা করছে আসলে নিশানের উদ্দেশ্যটা কি!
নিশান সোফা থেকে উঠে এসে ডিরেক্ট যূথীর গলা চেপে ধরল।যদিও হালকাভাবে ধরেছে কিন্তু যূথী ভাবতেও পারেনি নিশান এমন একটা কাজ করে বসবে।অটোমেটিক তাঁর চোখ বড় বড় হয়ে গেল।লোকটা কি তাঁকে মেরে ফেলতে চাইছে নাকি।

“—আমার সাথে চালাকি করবে না।একদম জানে মেরে ফেলব।”

নিশানের এমন ভয়াবহ হুমকি শুনে যূথীর কলিজা কেঁপে উঠল।দিনদিন যেন নিশান তাঁর আসল রূপ যূথীর সামনে তুলে ধরছে।শুধুমাত্র দূরে ছিল বলে মেরে ফেলার থ্রেট দিচ্ছে তাঁকে। কেমন লোকের পাল্লায় পরলো সে?
যূথী করুণ মুখে বলল,

“—এমন করছেন কেনো আপনি? প্লিজ ছাড়ুন।”

“—পালিয়ে বেড়াচ্ছিলে আমার থেকে?এটাই লাস্ট কিন্তু। আর যদি এরকম দেখি তাহলে সেদিন খুব খারাপ হয়ে যাবে।”

নিশানের কথার উত্তরে যূথী কিছুই বলছে না।এখন কিছু বলা মানে ঘুমন্ত বাঘকে জাগিয়ে তুলা।এরচেয়ে চুপ করে থাকা ভালো।
হঠাৎ নিশান একহাতে যূথীর কোমড় চেপে ধরে একটানে কাছে নিয়ে আসলো।যূথীর গলায় নিজের ঠোঁট ছুইয়ে বলতে লাগল,

“—ড্যু ইউ নো দ্যাট ইউ আর আ ক্রিমিনাল? ইচ্ছে করে একদম জেলে ঢুকিয়ে দেই যাতে আর পালিয়ে বেড়াতে না পারো।আজ হোক কাল হোক তোমাকে ঠিক অ্যারেস্ট করে নিব।”

নিজের মনেই নিশান কথাগুলো বলে যাচ্ছে। এদিকে যূথীর অবস্থা খুব শোচনীয়।তাঁর শিরা-উপশিরা গুলো যেন রক্ত চলাচলে সক্ষম হচ্ছে না।বারবার দম আটকে আসছে।নিশানের দাড়ি গুলো তাঁর গলায় ফুটছে।
যূথী চোখ খিঁচে বারবার নিশানের টি-শার্ট খামচে ধরছে।
যূথীর এমন কাঁপা-কাঁপি অবস্থা টের পেয়ে নিশান যূথীকে ছেড়ে দিল।একদিনে এত ডোজ সহ্য হবে না।আজ এতটুকুই যথেষ্ট। নিজের মনে কিছুক্ষণ হাসলো নিশান।
ছাড়া পেতেই যূথী চোখ মেলে তাকাল।তবে নিশানের দিকে নয়।ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে।তাঁর তো উচিত এখন এ রুম থেকে অতিসত্বর বেরিয়ে যাওয়া।কিন্তু পা দুটো যেন মাটিতে আটকে গেছে।এক কদম চলারও শক্তি পাচ্ছে না।দুইহাতে পরনের স্কার্টটাকে চেপে ধরল সে।
দুষ্টু চোখে নিশান বলে উঠল,

“—যূথী….”

বাক্যটা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই যূথী একদৌড়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।
অনেকদিন পর নিশান প্রাণখোলা হাসি হাসলো।কি আছে এই মেয়েটার মাঝে যে মাত্র এ কয়েকদিনেই তাঁকে এতটা বদলে দিল!

* নিশানের রুম থেকে বেরিয়ে যূথী আস্তে আস্তে পা ফেলে সামনে এগুচ্ছে। তাঁর চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠছে যেন এখনই গড়িয়ে পরবে।
নিশানের এমন ব্যবহারগুলো সে মেনে নিতে পারছে না।কেনো লোকটা তাঁকে মায়ায় জড়াতে চাইছে? সে তো এই বাড়িতে অনেকটা আশ্রিতার মতো।এটা জানার পরেও নিশান ভাইয়া কেনো তাঁকে কাছে টানছে।
দিনদিন নিশান ভাইয়ার পাগলামি বেড়েই যাচ্ছে।বাড়ির লোক যদি ঘূর্ণাক্ষরেও কিছু টের পেয়ে যায় তাহলে ওইদিনই হয়তোবা এ বাড়িতে যূথীর শেষদিন হবে।এই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলে সে যাবে কোথায়?
গ্রামে তো নিজের কোনো নিরাপত্তা খুঁজে পায় না সে।
যূথী সিদ্ধান্ত নিল এভাবে ভয় পেয়ে আর চুপ করে থাকবে না।নিশান ভাইয়া যদি আবার তাঁর সাথে এরকম কিছু করে তাহলে সে অনেকগুলো শক্ত কথা শুনিয়ে দিবে।এরপর যা হয় হোক!

_______________

অস্পষ্ট কিছু চেচাঁমেচির শব্দ কানে যেতেই যূথীর ঘুম ভেঙে গেল।ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে পাঁচটা বেজে গেছে।দুপুরবেলা লাঞ্চ করে একটু শুয়েছিল।কখন যে চোখ লেগে গেছে বুঝতেই পারে নি।
চেঁচামেচির উৎস খুঁজতে যূথী দরজা খুলে বাইরে এল।করিডোরের একপাশে মনীষা, বিদীষা আর নীলিমা কি বিষয়ে যেন কথা বলছে আর হাসতে হাসতে লুটিয়ে পরছে।
যূথীকে দেখতে পেয়ে ওরা দৌড়ে আসল।সবার মুখে আনন্দের হাসি।
মনীষা বলল,

“—গন্ধ পাচ্ছো যূথী?”

যূথী চোখ সরু করে মেয়েগুলোর দিকে তাকাচ্ছে। ভাবছে ওরা কি পাগল টাগল হয়ে গেল নাকি!এখনো উন্মাদের মত হেসেই যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন যূথীকে খুব একটা মজার প্রশ্ন করেছে।
যূথী গলা পরিষ্কার করে জিজ্ঞেস করল,

“—আমি কোনো গন্ধ পাচ্ছি না।অনুগ্রহ করে আপনারা বলবেন কি কারণে এরকম হিহি করে হেসে যাচ্ছেন?”

“—বাড়িতে বিয়ে লাগবে!চারদিকে বিয়ে বিয়ে গন্ধ।” (মনীষা)

“—কার বিয়ে?” (যূথী)

“—মাহির ভাইয়ার।আমার তো খুশির চোটে লাফাতে ইচ্ছা করছে। এই বাড়ির প্রথম বিয়ে এটা।ভাবতে পারছো!” (বিদীষা)

“—একি! বড় ভাইয়ের এখনো বিয়ে হলো না তার আগেই ছোট ভাই বিয়ে করে ফেলছে?” (যূথী)

তখনই কোথা থেকে মাহির চলে আসলো।যূথীর কথা শুনতে পেয়ে মুখ কালো করে বলল,

“—বিগ ব্রো’য়ের উপর আমি খুব রেগে আছি যূথী।আজ আমার বিয়ের ডেট ফিক্সড হবে আর সে অফিসে গিয়ে বসে আছে।আর বিগ ব্রো তো নিজে বিয়ে করবে বলে মনে হয় না।এই কারণে আমার বিয়ে আটকে থাকবে কেনো? আমি তো এই মাসেই বিয়ের কাজ কমপ্লিট করব।তারপর হানিমুন তারপর একটা ক্রিকেট টিম বানাবো। ভালো হবে না?”

মাহিরের এমন বেকুবমার্কা কথা শুনে চারজন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।এই ছেলের এখনো বিয়েই হয় নি আর ক্রিকেট টিম বানানোর চিন্তায় পরে আছে।

“—উফ্ থামো ভাইয়া।তোমার মত এমন একটা নবজাতক’কে বিয়ে করে কারিমা আপুর তো একদম নাজেহাল অবস্থা হয়ে যাবে সেটা কি জানো?” (বিদীষা)

“—জিহ্বা টেনে ছিড়ে ফেলব তোর।আমাকে তোর কোন এঙ্গেল থেকে নবজাতক লাগে!” (মাহির)

“—এক সেকেন্ড! কেউ আমাকে বলো এই কারিমা আপুটা কে?” (যূথী)

“—ওহ্ সরি।তোমাকে আসল কথাই বলা হয়নি।কারিমা আপু আর মাহির ভাইয়ার প্রায় তিন বছরের রিলেশন।আজ সন্ধ্যায় আপুর বাবা-মা আসবে বিয়ের ব্যপারে কথা বলতে।শুনেছি যদি সব ঠিকঠাক থাকে তাহলে সামনের শুক্রবার এঙ্গেজমেন্ট আর পরের শুক্রবার বিয়ে।” (নীলিমা)

“—গাইজ! আমি একটা ডিসিশন নিয়েছি।বিয়েতে আমরা যা যা শপিং করব তার সবটা কিন্তু মাহির ভাইয়াকে বহন করতে হবে।” (মনীষা)

“—ইম্পসিবল! একটা কানাকড়িও পাবি না।তোদের আমি হাড়েহাড়ে চিনি।দেখা যাবে আমার একাউন্ট খালি করে আমাকে ফতুর বানিয়ে দিয়েছিস।” (মাহির)

“—তাই নাকি! আচ্ছা ভাইয়া তোমার মনে আছে মেডিকেলের ফার্স্ট ইয়ারে যখন পড়তে তখন ওই রাস্তার মোড়ের দুইতলা বিল্ডিংয়ে যে পরী নামের মেয়েটা থাকত তাঁকে যে ডিস্টার্ব করতে! আমরা এখনই গিয়ে আনন্দের সহিত এই খবরটা কারিমা আপুকে জানিয়ে আসছি।”

“—তোদের মত এমন কূটনী বোন থাকলে আমার মত এমন অসহায় ভাইদের মাথা ন্যাড়া করে কয়েকদিন পর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হবে।এত কূটনীতিবাজ তোরা! শুধু শুধু এ বাড়িতে পরে আছিস।পলিটিক্সে নেমে পর যা।” (মাহির)

এমন একটা অপমানজনক কথা তিনবোন হজম করতে পারল না।মনীষা ছুটে এসে মাহিরের চুল টেনে ধরল।আর বিদীষা মাহিরের পেটে একের পর এক ঘুষি মেরে চলেছে।
মারামারির এই দৃশ্য দেখে হাসতে হাসতে যূথীর পেটে খিল ধরে যাচ্ছে। ভাইবোনদের মধ্যে যে এত খুঁনসুটিময় ভালোবাসা থাকতে পারে ওদের না দেখলে সে জানতেই পারত না।

* সন্ধ্যার পর অতিথিরা বাড়িতে এসে গেছে।তাঁদের আপ্যায়নে সবাই ব্যতিব্যস্ত।মাহিরের হবু বউ কারিমাকে দেখে যূথীর চোখ ধাঁধিয়ে গেল।এত সুন্দরও কেউ হতে পারে! এই প্রথম নিজের গায়ের শ্যামলা রঙ নিয়ে যূথীর একটু আফসোস হলো।
রাত দশটার দিকে ডিনার শেষে অতিথিরা এঙ্গেজমেন্ট ও বিয়ের ডেট ফিক্সড করে বিদায় নিল।পরশুদিন এঙ্গেজমেন্ট।
বাড়ির সবাই বিয়ের আনন্দে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছে।
কিছুক্ষণ পর মেইন ডোর দিয়ে নিশানের আগমন ঘটল।ড্রয়িং রুমে সবার উপস্থিতি এবং কলরব এসব কিছুতেই তাঁর ভাবান্তর হলো না।
হাতের ব্লেজারটা কাঁধে ঝুলিয়ে সিড়িতে পা রাখল।
নীলুফা চৌধুরী জলদি সোফা থেকে উঠে গিয়ে নিশানকে ডাকলেন।

“—নিশান! আমরা তো মাহিরের বিয়ের ডেট ফাইনাল করে ফেলেছি।পরশুদিন এঙ্গেজমেন্ট।তোকে কিন্তু সেদিন বাড়িতে থাকতে হবে। কাজের বাহানা দিলে চলবে না।”

“—আই উইল ট্রাই।”

মাহির বলে উঠল,

“—বিগ ব্রো তুমি না থাকলে কিন্তু আমি এঙ্গেজমেন্ট ক্যান্সেল করে দিব।”

নিশান ভাবলেশহীন গলায় উত্তর দিল,

“—ভেরি গুড।”

নিশান আর দাঁড়িয়ে না থেকে রুমের দিকে রওনা দিল।বেচারা মাহিরের মুখটা অপমানে ছাইবর্ণ হয়ে গেছে।বাকিরা সবাই বাড়ি কাঁপিয়ে হাসতে লাগল।

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here