স্বপ্নচারিণী,পর্ব_৮

স্বপ্নচারিণী,পর্ব_৮
সামান্তা সিমি

সিআইডি অফিসের সামনে সাংবাদিকদের ভিড়।আজ মতিন ভূঁইয়া নামক নামকরা অপরাধীর ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা হয়েছে।মতিন তাঁর সকল অপরাধ স্বীকার করেছে।মতিনের সকল অবৈধ ব্যবসা এবং কালো টাকার খবর সিআইডিদের হাতে চলে এসেছে।
নিশান ভেতর থেকে বের হতেই সকল সাংবাদিক তাঁকে ঘিরে ধরল।নিশানও খুব সুন্দরভাবে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল।আজও তাঁর মা ডাইনিং টেবিলে বসে অপেক্ষা করছে।
খাবার রুমে পাঠিয়ে দিতে বলে নিশান উপরে চলে গেল।

* ডিনার শেষে বারান্দায় বসে আছে নিশান।আজ দুইদিন হয়ে গেল সে যূথীকে দেখতে পাচ্ছে না।নিজে এত রাত করে বাড়ি ফেরে যে মেয়েটার আর দেখাই পাওয়া যায় না।প্রত্যেকদিন সকালে একবার করে বাগানে চেক করে।কিন্তু যূথীকে সেখানেও দেখা যায় না।
শত ব্যস্ততার মাঝেও মেয়েটার হাসোজ্জ্বল মুখটা নিশানের চোখে ভেসে উঠে।তাঁর মন চাইছে এখনই ছুটে গিয়ে দেখে আসে যূথীকে।
নিশান বারান্দায় প্রায় দশ মিনিটের মত পায়চারি করল।যূথীকে না দেখলে আজ রাতে তাঁর চোখে ঘুম আসবে না।
কোনোকিছু না ভেবেই সে রওনা দিল যূথীর রুমের দিকে।
দরজা পুশ করে বুঝল ভেতর থেকে বন্ধ। মুহূর্তেই তাঁর মেজাজ চড়ে গেল।তাঁকে পাগল বানিয়ে মেয়েটা শান্তিতে ঘুমাচ্ছে!
দরজায় হালকা নক করে অপেক্ষা করতে লাগল।নিশান ভাবতেও পারেনি তাঁকে কোনোদিন এভাবে চোরের মত একটা মেয়ের রুমের বাইরে দাড়িয়ে থাকতে হবে।এখন যদি বাড়ির কেউ এই দৃশ্য দেখে তাহলে তাঁর সামনে তো কিছু বলার সাহস পাবে না তবে আড়ালে ছোটখাটো একটা ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাবে।
দুই-তিন বার নক করার পরও যূথী দরজা খুলছে না।নিশানের মন চাইছে এক লাথি দিয়ে দরজা ভেঙে দেয়।কিন্তু এত রাতে এটা করতে গেলে বাড়ির লোকজন ভূমিকম্প ভেবে হৈচৈ শুরু করবে।

বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমে কাদা হয়ে আছে যূথী।দরজার খটখট শব্দটা হালকাভাবে কানে যেতেই চোখ মেলল।বিছানার পাশে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দেখল ঘড়িতে প্রায় একটা বাজে।এত রাতে তাঁকে কি দরকারে ডাকা হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না।
গলায় উড়না জড়িয়ে যূথী দরজার দিকে এগুলো।দরজা একটু ফাঁকা করে মাথা বের করতেই সামনের মানুষটাকে দেখে তাঁর চোখ থেকে ঘুম উধাও। নিশান ভাইয়া এত রাতে তাঁর রুমের দরজার সামনে ব্যপারটা তাঁর হজম হচ্ছে না।
যূথীকে দেখামাত্র নিশান আদেশের সুরে বলল,

—ছাদে আসো।

যূথী কোনো উত্তর না দিয়ে নিশানের দিকে তাকিয়ে আছে।তাঁর মনে হচ্ছে নিশান বোধ হয় পাগল টাগল হয়ে গেছে।নয়তো ঘুমের ঘোরে হাঁটতে হাঁটতে এখানে এসে উল্টাপাল্টা কথা বলা শুরু করেছে।
যূথী মিনমিনে গলায় বলল,

—এখন ছাদে যাব কেন নিশান ভাইয়া?

—নো আর্গুমেন্ট।ছাদে আসো ইন ওয়ান মিনিট।

কথাটা বলেই নিশান হনহন করে চলে গেল।

* যূথী ধীর পায়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছে কিন্তু একটু পর পর আবার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে। বাড়ির কেউ যদি এই মুহূর্তে তাঁকে ছাদে দেখে তাও নিশান ভাইয়ার সাথে তাহলে কেলেংকারী হয়ে যাবে।আর এটাই তো স্বাভাবিক। এমন গভীর রাতে একটা মেয়ে বাড়ির ছেলের সাথে ছাদে ব্যপারটা সত্যি দৃষ্টিকটু।
যূথী একবার ভেবেছিল আসবে না।পরক্ষণেই নিশানের রাগের কথা মনে পরতেই সিদ্ধান্ত বদলে ফেলল।নিশান ভাইয়া নিশ্চয়ই জরুরি কিছু বলার জন্য ডেকেছে।

ছাদে পা রেখে যূথী আশেপাশে তাকাতে লাগল।কই কাউকেই তো দেখছে না।আশপাশটা কেমন নিস্তব্ধতায় ঘিরে আছে।নিশান ভাইয়া কোথায়?
হঠাৎই তাঁর মনে একটা অজানা ভয় এসে জমল।তখন কি ওটা সত্যিই নিশান ভাই ছিল নাকি কোনো অশরীরী নিশানের রূপ নিয়ে এসেছিল!
রাত একটা বাজে নিশান ভাইয়া কেনো তাঁকে ডাকতে যাবে এটাতো মাথায়ই আসেনি। যূথীর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।সে কি শেষমেষ ভুতের খপ্পরে পরল।গ্রামে এমন অনেক কাহিনী শুনেছে ভুতেরা নাকি মানুষের রূপ ধরে গভীর রাতে ডেকে নিয়ে যায়।
যূথী ফিরে যাওয়ার জন্য পেছনে মোড় নিতেই কেউ তাঁর হাত টেনে ধরল।আচমকা এমন হওয়ায় যূথীর আত্মারাম খাঁচা ছাড়ার উপায়।
সে বিকট এক চিৎকার দিতেই হাত চেপে ধরা লোকটা এবার তাঁর মুখ চেপে ধরল।
যূথী ভয়ের চোটে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।তাঁর কাছে মনে হচ্ছে চোখ খোলা মাত্রই ভয়ানক কিছু দেখবে।

—চোখ খুলো।

পরিচিত কন্ঠস্বর কানে যেতেই ঝট করে চোখ খুলল যূথী।এইতো নিশান ভাইয়া সামনে দাঁড়িয়ে।
নিশান আরেকটু ঝুঁকে এসে বলল,

—ভয় পেয়েছিলে? আমি ভুত নই।

যূথী সাথে সাথে চোখ মুখ কুচকে ফেলল।নিশানের মুখ থেকে সিগারেটের সেই পঁচা গন্ধটা পাওয়া যাচ্ছে।
দূরে যাওয়া চেষ্টা করতেই যূথীর খেয়াল হলো তাঁর একহাত এখনো নিশানের শক্ত মুঠোয় বন্দী।
সে নিশানের ভাব-গতিক কিছু বুঝতে পারছে না।হঠাৎ নিশান ভাইয়া এমন আচরণ করছে কেনো?একে তো সিগারেটের গন্ধ তার উপর নিশানের এভাবে কাছে আসাটা তাঁকে ঠিক থাকতে দিচ্ছে না।
হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা দূরে ফেলে নিশান বলে উঠল,

—সিগারেটের গন্ধ ভালো লাগে না? অভ্যাস করে নাও।ফিউচারে দিনরাত এই গন্ধটার মাঝেই থাকতে হবে।

নিশানের কথার কোনো আগামাথা খুঁজে পাচ্ছে না যূথী।এই কথাগুলো বলার মানে কি!
নিশানের ক্যারেক্টারের যেমন বর্ণনা শুনেছিল তাঁর সাথে এই রূপটা ঠিক মানাচ্ছে না।
হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে যূথী বলল,

—আমায় যেতে দিন নিশান ভাইয়া।আপনি এসব কি কথা বলছেন? কেউ এসে এভাবে দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

নিশান যেন যূথীর কথা শুনতেই পায় নি।যূথীর কোমড়টা আরো একটু চেপে কাছে টেনে নিল।তৎক্ষনাৎ যূথীর সমস্ত শরীরে যেন কারেন্টর শক লাগল।জীবনে এই প্রথম কোনো ছেলের স্পর্শ!তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যাচ্ছে। এক্ষুনি মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পরবে।
দুইহাতে নিশানকে ধাক্কা দিয়েও লাভ হচ্ছে না।
যূথীর এমন অবস্থা দেখে নিশান ফিসফিস করে বলল,

—এটুকুতেই এই অবস্থা? তোমার করা ভুলের শাস্তি তো এখনো বাকি।

যূথী কিছু না বুঝেই মোহাচ্ছন্নের মত জবাব দিল,

—আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি তাঁর জন্য ক্ষমা চাইছি ভাইয়া।কিন্তু এখন আমাকে যেতে দিন প্লিজ!

যূথীর গলায় কথা জড়িয়ে আসছে।শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি দ্বিগুণ বেড়ে গেছে।
নিশান তাকিয়ে আছে যূথীর ঠোঁটের দিকে।মেয়েটার ঠোঁট একটু পর পর কেঁপে উঠছে। ইচ্ছে করছে উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলতে।কিন্তু সেটা যূথীর জন্য একটুও ভালো হবে না।নিশানের সম্পর্কে তাঁর মনে নেগেটিভ ধারণা জন্মাবে।
নিশান যূথীকে ছেড়ে কিছুটা দূরে গিয়ে দাড়ালো।
যূথী যেই মুহূর্তে অনুভব করল নিশান তাঁকে মুক্ত করে দিয়েছে আর এক সেকেন্ড দেরি না করে সিড়ির দিকে দৌড়ে নেমে গেল।
পকেটে হাত দিয়ে নিশান যূথীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।ঠোঁটে ফুটে আছে মুচকি হাসি।যূথী কি কখনো তাঁর অনুভূতিগুলো বুঝতে পারবে? সে তো আর পাঁচজন প্রেমিকের মত ভালোবাসাকে সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপন করতে পারে না।এই মেয়েটাই তো তাঁর সাদা-কালো জীবনটাতে রঙিন প্রেমের জোয়ার নিয়ে এসেছে।সে নিজেও জানতো না তাঁর মনে যে এত প্রেম আছে।তাহলে নিশানের না বলা অনুভূতি গুলো বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব তো যূথীরই।

___________________

ভারী কাঁচের চশমা পরা মধ্যবয়স্ক একজন শিক্ষক ক্লাসে পড়া বুঝিয়ে চলেছে।ক্লাসের ছেলেমেয়েরা মনযোগ দিয়ে স্যারের কথা শুনে যাচ্ছে।
কিন্তু যূথীর সেদিকে মন নেই।স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকা সত্বেও তাঁর মনে চলছে অন্যকিছু।
সেদিন রাতে ছাদে নিশানের বলা কথাগুলো ভাবাচ্ছে তাকে।সে তো কোনো অবুঝ মেয়ে নয় যে ওই কথাগুলোর মানে বুঝবে না!
কিন্তু এটা হতে পারে না! নিশান ভাইয়া যদি এরকম কিছু ভেবে থাকে তাহলে কিছুদিন পরই তা ভয়াবহ রূপ নেবে।
নিশান ভাইয়ার মত একজন মানুষের সাথে যূথীকে মানায় না।এ বাড়ির মানুষ তাঁকে ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়েছে।পড়ালেখা করার সুযোগ পর্যন্ত দিয়েছে।সে কখনোই এ বাড়ির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবে না।তাঁর মত মেয়েদের জীবনে এসব প্রেম-ভালোবাসা নামক জিনিসগুলো মানায় না।
তাঁর মন বলছে হয়তোবা নিশান ভাইয়া তাঁর প্রতি শুধুমাত্র একটা আকর্ষণ অনুভব করে যার স্থায়িত্ব সাময়িক।এমন চাল-চুলোহীন মেয়েকে কেউ ভালোবাসতে পারে না।
এখন থেকে নিশান ভাইয়াকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলবে।বড় কিছু ঘটে যাওয়ার আগেই তাঁর সাবধান হয়ে যাওয়া দরকার।শত হোক সে একজন মেয়ে।পান থেকে চুন খসলেই সব দোষ তাঁর ঘাড়ে এসে পরবে।এমনটা কখনোই হতে দেবে না।সে তো কোনো বোকা মেয়ে নয়।

—এই যে যূথিকা।আমার মনে হচ্ছে কোনো কারণে তুমি ডিসটার্ব ফিল করছো।এম আই রাইট?

স্যারের ডাকে যূথী ভাবনার জগত থেকে বের হলো।এই স্যারটার নাম মুশতাক রহমান।ক্লাসের সবার সাথেই খুব মার্জিত আচরণ করে।কলেজে এই টিচারকেই যূথীর সবথেকে ভালো লাগে।এতবড় কলেজের শিক্ষক হওয়া সত্বেও কোনো অহংকার নেই।

—নো স্যার।আ’ম ফাইন।

মুশতাক রহমান সবার দৃষ্টি আকর্ষন করে বলতে লাগলেন,

—ইউ নো গার্লস এন্ড বয়েজ সি ইজ যূথিকা জাহান।গ্রাম থেকে এসে এখানে ভর্তি হয়েছে।এমন ভদ্র আর সুন্দর ব্যবহারের মেয়ে আমি খুব কম দেখেছি।

যূথী লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিল।কেউ সামনাসামনি তাঁর প্রশংসা করলে সে খুব বিব্রত বোধ করে।তখনই যূথীর পাশে বসা মেয়েটা ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

—একটা কথা বলি যূথীকা! কিছু মনে করো না।এই স্যারটা থেকে সবসময় দূরে থাকবে।নতুন এসেছো তাই কিছু জানো না।

মেয়েটার কথা শুনে যূথীর একটু রাগ হলো।তাঁর তো স্যারটাকে দেখে খারাপ মনে হয় না।শুধু শুধু স্যারদের নামে কুৎসা রটিয়ে মেয়েগুলো যে কি মজা পায়!
সব চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে যূথী পড়ায় মন দিল।

চলবে…………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here