স্বপ্নচারিণী,পর্ব_১৬

স্বপ্নচারিণী,পর্ব_১৬
সামান্তা সিমি

নিশানকে নিজের কেবিনে দেখে মুশতাক রহমানের ভ্রু কিছুটা কুঞ্চিত হলো।এই লোক হঠাৎ এখানে কেনো।শহরে নিশানের নাম ডাক তিনি অনেক শুনেছেন।ক্রিমিনালরা যার নাম শুনলেই ভয়ে কেঁপে উঠে সে হলো নিশান।সেই লোক যখন এখানে পা রেখেছে নিশ্চয়ই কোনো ঘাপলা আছে।
চেহারায় যথাসম্ভব জবুথবু ভাব এনে মুশতাক রহমান বললেন,

“—আরে স্যার আপনি! অনেক সৌভাগ্য আমার।কোনোদিনও সরাসরি আপনার দেখা পাব ভাবতেই পারিনি।প্লিজ বসুন।”

নিশান তীব্র চোখে তাকিয়ে আছে মুশতাক রহমানের দিকে।নিশানের ভাবভঙ্গি বুঝে উঠতে পারছেন না মুশতাক রহমান। ছেলেটার চাহনি দিয়ে যেন আগুনের হল্কা বের হচ্ছে। কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলেন।
হঠাৎই দরজার কোনায় যূথীর আগমনে কাঠের পুতুলের মত দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি।এই মেয়ে এসময় এখানে কি করছে?
সমস্ত ঘটনাটাকে একসাথে মিলানোর চেষ্টা করলেন।তাঁর ভাবনা যদি সত্যি হয় তাহলে তো সর্বনাশ!গলা শুকিয়ে আসছে তাঁর।জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বিনয়ী গলায় বললেন,

“—যূথীকা তুমি এখানে? কোনো প্রয়োজন থাকলে কাল এসো।আজ আমি একটু…….

বাকি কথা সম্পূর্ণ করার আগেই নিশানের তান্ডব শুরু হয়ে গেল।টেবিলের কোনায় পরে থাকা মোবাইলটা পকেটে নিয়ে মুশতাক রহমানের কলার চেপে ধরল নিশান।হতভম্ব হয়ে গেলেন মুশতাক রহমান।টাল সামলাতে না পেরে দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেলেন। যূথী ভয়ে কাঠ হয়ে এক কোনায় জড়োসড়ো হয়ে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে।নিশানের এমন ভয়াবহ রূপ আবার দর্শন করতে হবে সেটা ভাবেনি।
মুশতাক রহমানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই টেনে হিঁচড়ে মাঠে নিয়ে এল নিশান।

সকলের পরীক্ষা কিছুক্ষণ আগেই শেষ হয়ে গেছে।মাঠের আনাচে-কানাচে, ক্লাসের বারান্দার সামনে অল্প সংখ্যক ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে।হঠাৎ করে এমন এক দৃশ্য দেখতে পেয়ে সবার আকর্ষণ সেখানে চলে গেল।কেউ কেউ গেইট দিয়ে বাইরে যাচ্ছিল কিন্তু মাঠের কাহিনী দেখে ওখানেই থেমে গেল।সবার চোখে একরাশ বিস্ময় এবং কৌতুহল।এরকম ঘটনা তাঁরা কস্মিনকালেও দেখেনি।
মুশতাক রহমানকে এক ধাক্কায় মাটিতে ফেলে দিল নিশান।

“—নর্দমার কীট! তুই কলেজের শিক্ষক? তোর ক্যারিয়ার আমি শেষ করে দিব।তোর মত লোকদের এই সমাজে জায়গা নেই।তোদের স্থান আস্তাকুঁড়ে। ”

নিশানের বলা কথাটা চারদিকে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।ততক্ষণে ছেলেমেয়েরা জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে গেছে।ভীরের এক কোনায় মনীষা এবং নীলিমাও আছে।অবাক চোখে তাঁরা তাঁদের ভাইকে দেখছে।ঘটনার বিষয়বস্তু কিছুই মাথায় ঢুকছে না।অনেকদিন পর নিশানের এমন ভয়ঙ্কর চেহারা দেখল ওঁরা। নিশানের পেছনেই কাঁদো কাঁদো চেহারায় যূথীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দুইজন আরো বেশি ধাঁধায় পরে গেল।পরীক্ষা শেষে ওরা তো যূথীকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। আর এই মেয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছে।
অবস্থা বেগতিক দেখে মুশতাক রহমান গলায় কাঠিন্যত্ব এনে বললেন,

“—এটা কেমন ব্যবহার মিস্টার নিশান?আপনি আমার সাথে এমন মিসবিহেভ করার মানে কি?”

ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল নিশান।তাঁর মন চাইছে এই মানুষরূপী জানোয়ারটাকে মারতে মারতে রক্তাক্ত করে দেয়।ফের মুশতাক রহমানের কলার ধরে দাঁড় করিয়ে নিশান গর্জে উঠে বলল,

“—একদম চুপ। তোর গলা টেনে ছিড়ে ফেলব আমি।কবে থেকে এভাবে নিরীহ মেয়েদের ফাঁসিয়ে নিজের লালসা পূরণ করছিস বল!”

এমন একটা কথা শুনে ভীড়ের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল।কেউ কেউ মূল ঘটনার সুত্রপাত কোথায় সেটা আন্দাজ করে ফেলেছে।ঘৃণ্য দৃষ্টিতে ওঁরা মুশতাক রহমানের দিকে তাকাচ্ছে। ভীড়ের মধ্য থেকে একজন মেয়ে গলা উঁচিয়ে বলল,

“—উনি শিক্ষক নামে কলংক নিশান স্যার।অনেক মেয়েদের সাথে অশালীন কাজ করেছেন।কিন্তু ভয়ে কেউ তাঁকে কিছু বলতে পারে না। আজ আপনাকে দেখে সব বলতে ইচ্ছা হলো।গতবছর শিউলি নামে আমাদের একটা ক্লাসমেট উনার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সুইসাইড করেছে।শিউলির বাবা মা গরিব তাই তাঁরা টু শব্দও করেনি।চুপচাপ মেনে নিয়েছে।না জানি আজ আবার কে উনার কুৎসিত জালে আটকা পরেছে।”

তখনই ভীড় ঢেলে কলেজের প্রিন্সিপাল হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলেন।তাঁকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে বেশ ঘাবড়ে গেছে।রুমাল দিয়ে একটু পর পর কপালের ঘাম মুছে নিচ্ছেন।নিশানের আসার খবর শোনা মাত্রই তিনি কোনোরকমে দৌড়ে এসেছেন।কৌতুহলী চোখে নিশানের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“—কোনো সমস্যা হয়েছে স্যার? মুশতাক রহমান কিছু করেছে?”

নিশান সকলের সামনে স্পষ্ট ভাষায় মুশতাক রহমানের কুকীর্তি শুনিয়ে দিল।কিন্তু সেখানে যূথীর কথা উল্লেখ করে নি।
মুশতাক রহমানের চেহারা রক্তশূণ্য। তিনি এমন বাজেভাবে ফেঁসে যাবেন তা স্বপ্নেও ভাবেন নি।এতগুলো মানুষের ক্ষুব্ধ দৃষ্টির সামনে তাঁর কেমন হাঁসফাঁস লাগছে।আঁটসাঁট করে লাগিয়ে রাখা গলার কাছের বোতাম কয়েকটা খুলে দিলেন।

“—কলেজের প্রিন্সিপাল আপনি।আপনার কলেজে কি করে এমন একজন নিকৃষ্ট মনের মানুষ শিক্ষকতা করতে পারে? কোনো খবর রাখেন না আপনি? ”

নিশানের ধমকে কলেজ ক্যাম্পাস আবার কেঁপে উঠল।প্রিন্সিপাল চারদিকে অন্ধকার দেখছেন।এ কেমন সমস্যায় পরলেন উনি।তাঁর অগোচরে এতসব ঘটে চলেছে এতদিন।এখন তো কলেজের বদনাম শহরে বিদুৎ গতিতে রটে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা নিশান যেহেতু এই ঘটনায় হাত দিয়েছে তাহলে এত সহজে ছাড় পাওয়া যাবে না।
প্রিন্সিপাল কঠোর গলায় মুশতাক রহমানকে বললেন,

“—আপনাকে একজন সৎ এবং ভালো মনের মানুষ হিসেবে জানতাম।আর আপনি একটা সম্মানিত ব্যক্তির আসনে বসে এমন কুকর্ম করলেন কিভাবে?”

লজ্জায় অপমানে মুশতাক রহমানের মুখ লাল হয়ে উঠেছে।দরদর করে ঘামছেন।কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন কিন্তু গলা দিয়ে টু শব্দও বের হচ্ছে না।ঘটনা দেখে বুঝেছেন যূথীকা নামের মেয়েটা কোনোভাবে নিশানের পরিচিত। মারাত্মক ভুল করে ফেলেছেন আজ।কে জানে এখন তাঁর কি দশা হয়।

জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেমেয়ে গুলোর মুখ রাগে থমথম করছে।এতক্ষণ সবাই নিচুস্বরে আলোচনা করলেও এবার বেশ হৈচৈ শুরু হয়ে গেল।
কয়েকজন চিৎকার করে প্রিন্সিপালকে বলতে লাগল,

“—এই জঘন্য মানুষটাকে বের করে দিন কলেজ থেকে নাহলে আমরা তান্ডব বাঁধিয়ে দেব।আর কোনো মেয়ের ক্ষতি হতে দিব না আমরা।”

নিশান সকলের দিকে একবার চোখে বুলিয়ে নিতেই ওঁরা চুপ মেরে গেল।সবাইকে আশ্বাস দিয়ে বলল,

“—উনি যা করেছেন তাঁর শাস্তি তো অবশ্যই পাবেন।আজকের পর থেকে কোনো মেয়েকে যদি কখনো কেউ অসম্মান করে তাহলে সাথে সাথে তোমরা আমাকে জানাবে।যা-ই ঘটুক আমাকে ইনর্ফম করবে।আমিও দেখতে চাই কার বুকে কতখানি দম আছে যে মেয়েদের ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে।”

মুশতাক রহমানের দিকে আরো একবার কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিশান প্রিন্সিপালকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“—উনাকে আপনাদের কাছে কিছুক্ষণের জন্য রেখে যাচ্ছি। আধাঘন্টার ভেতর আমি লোক পাঠাবো।ওঁরা এসে নিয়ে যাবে এই বদমাশকে।ওর দফারফা করে ছাড়ব আমি।কার দিকে হাত বাড়িয়েছে এই কু**বা** নিজেও জানে না।”

নিশান যূথীর হাত ধরে গেইটের বাইরে নিয়ে গেল।কিছুই বলছে না যূথী।মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে আছে নিশানের দিকে।তাঁর ভালো লাগছে এভাবে তাকিয়ে থাকতে।আজ কি নিশান ভাইয়ার সৌন্দর্য দ্বিগুন বেড়ে গেছে?কই অন্যদিন তো এমন হয় না?
ঘামের কারণে নিশানের চুলগুলো কপালের ছোট চুলগুলো একসাইডে লেপ্টে আছে। এটাই যেন লোকটার সৌন্দর্য একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে।লোকটা সত্যিই অপরূপ। আনমনেই যূথীর ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠল।

________________

রাতে ডিনার করার পর রুম অন্ধকার করে বারান্দায় বসে আছে যূথী।আকাশে তারার ছিটেফোঁটাও নেই।পরিবেশটা কেমন থম মেরে আছে।জোরে বর্ষণ হওয়ার পূর্ব লক্ষণ।এরকম আবহাওয়া যূথীর খুব পছন্দের। গ্রামে যখন ছিল তখন বৃষ্টির দিনে তাঁর খুশির সীমা থাকত না।টিনের চালে টুপটাপ বৃষ্টির ঝংকার শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিত।সেই সুখময় দিনগুলো খুব মিস করে যূথী।আজ সে বারান্দায় বসে বৃষ্টিবিলাস করবে।কেনো জানি মেঘলা আকাশটার দিকে তাকিয়ে থাকতেও ভালো লাগছে।
পেছনে কারোর উপস্থিতি টের পেতেই চমকে উঠল যূথী।দূরের বিল্ডিং থেকে আসা হালকা আলোয় মানুষটাকে চিনতে কষ্ট হলো না।নিশান ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে।যূথী দেখেও না দেখার ভান করলো।নিশান সেটা ঠিকই লক্ষ্য করেছে।

“—অন্ধকারে বসে আছো কেন?”

যূথী এখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে। খেয়াল করলো এই মুহূর্তে নিশান ভাইয়ার এখানে আসাতে সে একটুও বিরক্ত হয় নি।উল্টে তাঁর অবচেতন মন যেন এতক্ষণ এটাই চাইছিল।
নিশান আবার বলল,

“—চুপ কেনো?ঝড় আসতে পারে।রুমে চলে আসো।”

যূথী এখনো কোনো জবাব দিচ্ছে না।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিশান যূথীর পাশের চেয়ারটায় গিয়ে বসল।যূথীর হাতটা নিজের হাতের ভাঁজে ঢুকিয়ে বলল,

“—মন খারাপ? আমি থাকতে কোনো ভয় নেই তোমার।কেউ চোখ তুলে দেখার সাহসও করবে না তোমায়।”

যূথী ঘাড় ঘুরিয়ে নিশানের দিকে তাকাল।কেনো এত কেয়ার করে নিশান ভাইয়া?সত্যিই কি সে এত কিছুর যোগ্য ছিল।তাঁর মন চাইছে পাশে বসা লোকটাকে দুইহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।কিন্তু পারছে না।এটা হয় না।সে কি দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে? সে যদি নিজেকে শক্ত করতে না পারে তাহলে চরম ভয়াবহ অবস্থা নেমে আসবে এই পরিবারের উপর যা সে কখনোই হতে দিবে না।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here