সূর্যোদয় #পর্ব_২০ #কারিমা_দিলশাদ

#সূর্যোদয়
#পর্ব_২০
#কারিমা_দিলশাদ

ছাদে মাদুর পেতে বসে আছে সিয়াম আর ফয়সাল। বসে বসে এদিক ওদিকের কথা বলছে আর সিগারেট ফুঁকছে। দূরে দাঁড়িয়ে জয়ও সিগারেট ফুঁকছে।

সিয়াম আর ফয়সাল কলেজে থাকতেই মাঝেমধ্যে সিগারেট খেলেও। জয় কখনো এসবের ধারেকাছ দিয়ে যেত না। তবে পুতুলের রিজেকশনের পর এসব শুরু করে। মায়ের মুখের দিকে চেয়ে কমিয়ে আনলেও গত দুবছরে মাঝেমধ্যে খেত। কিন্তু এই একবছরে জয় এসব ছুঁয়েও দেখেনি। তার পিছনেও ঐশীর হাত। আর আজ ঐশীর জন্যই সে আবার এটা ঠোঁটে নিয়েছে।

সিয়াম আর ফয়সাল এদিক ওদিকের কথা বললেও তাদের সবটা মনোযোগ জয়ের উপর। এতদিন পর আবার কি হয়েছে তা জানাটা জরুরি। তবে তারা জানে জয় নিজে না বললে তারা কখনো জয়ের পেট থেকে কথা বের করতে পারবে না।

কি হয়েছে কিংবা কোন বিষয় নিয়ে জয় আপসেট সেই বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা নেই। যদিও মনে মনে পুতুলকে নিয়েই কিছু একটা আন্দাজ করছে। তবে তা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় আছে তাদের। তারা তো একরকম বিশ্বাসই করে যে জয় ঐশীকে ভালোবাসে। কিন্তু জয় তা কখনো স্বীকার করে নি। আর আজ আবার এমন ব্যবহারে কিছু বুঝতে পারছে না। কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলে সেটা নিয়ে রাগিয়ে দিলে হয়তো জয় রাগটা প্রকাশ করতো। কিন্তু এখন একেবারে কোনো কিছু না জেনে কোনো কথা তুলতেও পারছে না। হীতে বিপরীত না হয়ে যায় আবার।

একপর্যায়ে ফয়সাল অতিষ্ঠ হয়ে বলে,

“ ভাই কি হইছে বল না। না বললে কিভাবে বুঝমু বলতো? সিয়াম ব্যাটা ঘরে বউ রাইখা আইছে। আমার গার্লফ্রেন্ড ওইদিক দিয়া সমানে ফোন দিতাছে। তোর লাইগা যদি খালি আমার ব্রে’কআপ হয় তাইলে খবর আছে কইয়া দিলাম।”

“ আহ ফয়সাল চুপ করতো। জয় দোস্ত বল না কি হইছে?”

এরপর সিয়াম উঠে জয়ের কাছে গিয়ে ইতস্তত এবং আমতাআমতা করতে মিনমিনিয়ে বললো,

“ পুতুলকে নিয়ে কি তুই আবার আপসেট?”

জয় চুপ। এরমানে পুতুলকে নিয়ে না। হলে বলতো। আসলে জয়ের স্বভাবটাই এমন। ভীষণ মুখচোরা স্বভাবের। কষ্ট পেলে বলবে না। কোনো বিষয় নিয়ে রেগে থাকলেও বলবে না। তবে যদি কাউকে নিয়ে রেগে থাকে তাহলে তার নাম নিলেই বো’মার মতো ফেটে পড়ে। এরপর একটু ভেবে বললো,

“ তাহলে কি ঐশীকে নিয়ে কিছু? ”

“ ওর নাম একদম নিবি না। জানিস কি করেছে বে’য়াদপ মেয়ে?
নায়িকা সেজে ঘুরে বেড়াতে হবে তার৷ এক টাকওয়ালা বেটার সাথে হাতে হাত মিলিয়ে দাঁত বের করে হেসে হেসে কথা বলছিল। কেন তার এতো হেসে হেসে কথা বলতে হবে বলতো? সবার সাথে হেসে কথা বলতে হবে কোন কারণে? ও কি জানে না ওর হাসি ঠিক কতটা মোহনীয়? এই যে এতগুলো দিন ধরে আমি ওকে চিনি, কই একবারো তো আমার সাথে হাত মিলালো না? আর ওই টাকলার সাথে গিয়ে হাত মিলাচ্ছে।

এই এই বল, বল আমি কোনদিক দিয়ে খারাপ। দেখতে ভালো আছি। ওই টাকলার থেকে আমি কমপক্ষে এক হাত লম্বা। বডি ফিট আছে। দেখ ভুঁড়ি বের হয় নাই আমার। দেখ দেখ।”

গেঞ্জি তুলে দেখাতে দেখাতে না থেমে আবার বলা শুরু করে,

“ আমার পিছে মেয়েদের লাইন লেগে থাকে। কত জুনিয়র, ক্লাসমেট, কলিগ আমার জন্য পাগল তোদের জানা নেই? ভালো ইনকাম করি, সেভিংস আছে, বাড়ি আছে। তারপরও কেন আমার দিকে তার নজর নেই? আমার সাথে এক দুইটা কথা বলে শেষ। ওই হ্যালো, হাই পর্যন্তই। মেসেজ দিলেও আমি ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন এতটুকু বলেই শেষ। ইনবক্স চেক করে দেখ এগুলো ছাড়া অন্য কোনো কথা নেই। যাও আছে সব স্মৃতিকে নিয়ে। কেন! কেন রে ভাই আমি কি এতোই ফেলনা নাকি?
ছেলেরা ওর সঙ্গে কথা বলতে চাইলেই ওর কথা বলতে হবে? আরে ওর সাথে তো ছেলেরা কথা বলতে চাইবেই। জানিস আরও কি হয়েছে?

যখন ও স্টেজে নাচছিল পিছনের ছেলেগুলো তো ক্রাশ ক্রাশ ভাবি ভাবি করে চিল্লাচ্ছিল। ও কি জানে না ও কতোটা সুন্দর? সি ইজ সো প্রিটি ইয়ার। সি ইজ সো সুইট। ও কি জানে ও ঠিক কতটা অসাধারণ? সি ইজ সো ইউনিক। ওকে যার তার সাথে মানায় না ইয়ার। সি ডিজার্ভ সামওয়ান বেস্ট। যার তার সাথে কেন কথা বলতে হবে ওই অ’সভ্য মেয়েটাকে…….”

একদমে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে কথা গুলো বলে ছাদের মেঝেতে চার হাত পা চারদিকে মেলে শুয়ে পড়ে জয়। আর জোরে জোরে শ্বাস নিতে শুরু করে।

আর বেচারা সিয়াম আর ফয়সাল। তারা তো এতোক্ষণ হা করে সব শুনছিল। আর এক নতুন জয়কে অবলোকন করছিল। সিয়াম আর ফয়সাল একজন আরেকজনের দিকে একবার তাকিয়ে আবার অবাক দৃষ্টিতে মেঝেতে থাকা জয়ের দিকে তাকায়। ওদের দেখলে যে কেউ বলবে ওরা ভূত দেখেছে। অবশ্যই এটা তাদের কাছে ভূত দেখার থেকে কম কিছু না।

জয় হচ্ছে মুখচোরা, শান্ত, নম্র, ভদ্র, সভ্য একজন মানুষ। ভীষণ লাজুক এক পুরুষ। একদমই এক্সপ্রেসিভ না। সিয়াম জয়ের স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড। আর ফয়সালের সাথে পরিচয় মেডিকেল কলেজের হোস্টেল থেকে। একই রুমে থাকতো তারা। অথচ সিয়াম জয়ের স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড হওয়া সত্যেও পুতুলকে নিয়ে জয়ের অনুভূতি সে হোস্টেলে গিয়ে জানতে পারে।

পুতুলকে নিয়ে তার যেই অনুভূতি তা জয় মাঝে মাঝে খুবই শান্তভাবে বলতো। ডাক্তারি পড়াশেষ হলে পুতুলের মা বাবাকে সে বিয়ের প্রস্তাব দিবে, তার পরিকল্পনা সবকিছু। যখন পুতুলের কাছ থেকে রিজেক্ট হয় তখন জয়কে খুব ভেঙে পড়তে দেখে তারা। অসহায় হতে দেখে। সারাদিন চুপচাপ থাকতো, কান্না করতো। কিন্তু পুতুলকে নিয়ে কখনো ডেস্পারেট হতে দেখে নি। কক্ষনো না। আর আজ এ কোন জয়কে তারা দেখছে। এতো রীতিমতো সা’ইকোর মতো বিহেভ করছে!

————————

সিয়াম আর ফয়সাল থম মে’রে বসে আছে। পুরো ছাদ জুড়ে ভয়ানক নিরাবতা বিরাজ করছে। কিছুক্ষণ পর সিয়াম এবং ফয়সাল নড়েচড়ে উঠে। তারাও মেঝেতে বসে পরে। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে কিছু বলে নেয়। এরপর ফয়সাল গলা খাঁকারি দিয়ে জয়কে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ দোস্ত তুই ঠিকই বলছস সি ডিজার্ভ সামওয়ান বেস্ট।”

সিয়াম বলে,

“ ইয়েস। কত্ত সুন্দর ঔ বলতো! কত্তো অসাধারণ একটা মেয়ে। ওরজন্যে এমন কাউকে দরকার যে ওকে সবটা দিয়ে ভালোবাসবে।

কিন্তু তুই এতো হাইপার হচ্ছিস কেন বলতো? তুই তো ওকে ভালোবাসিস না। ও যার সাথে মন চায় কথা বলুক, হাসুক, হাত মেলা’ক তাতে তোর কি বলতো?”

সিয়ামের কথা শুনে জয় চোখ খুলে থম মে’রে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর চট করে উঠে বসে মাথা নিচু করে বসে থাকে। সিয়াম আবার জিজ্ঞেস করে,

“ কি হলো কথা বলছিস না কেন? ঐশী যার সাথে ইচ্ছা কথা বলুক তাতে তোর কি? তাতে তুই কেন এতো আপসেট? আর এতো ডেস্পারেট হওয়ারই বা কি মানে?”

জয় এখনো চুপ। ওদের করা প্রশ্নে হাসফাস বোধ হচ্ছে তার। জয় উঠে এগিয়ে গিয়ে সামনের রেলিং ধরে দাঁড়ায়। এসব প্রশ্নের যে কোনো জবাব তার কাছে নেই। এই প্রশ্নগুলো তো তারও। তবুও সে বিষয়টা কোনোভাবে কন্ট্রোল করতে পারছে না।

সিয়াম বলে,

“ জয়… এখনো কি বলবি তুই ঐশীকে ভালোবাসিস না?”

“ বলেই দেখুক দাবাং মার্কা চ*ড় খাবে এবার।” — ফয়সাল কিছুটা রাগত্ব স্বরে বলে। আরও বলে,

“ স্পিক জয়। এবারও কি বলবি তুই ঐশীকে ভালোবাসিস না? ”

জয় নিশ্চুপ। ফয়সাল জয়ের কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ায় আর বলে,

“ বন্ধু তুমি যতো যাই বলো না কেন। তুমি প্রেমে সেইভাবে ডুবছো। তুমি চরমভাবে জেলাস। জেলাসে জেলাসে তুমি ছারখার হয়ে গেছ। আর ভালোবাসার একটা অংশ হচ্ছে জেলাসি। যাকে তুমি ভালবাসো তাকে অন্যকারো সাথে দেখলে বুকে খুব লাগে। আর তুমি তো পুরা লাস্ট জোনে আছো ভাই। তুমি শেষ।

এখন যতই বাহানা দেখাস তুই, সত্যি তো এটাই যে তুই ঐশীকে ভালোবাসিস। এটাকে এক্সেপ্ট করে নে দোস্ত।”

সিয়ামও জয়ের অপর পাশে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলে,

“ দোস্ত…. মানুষের জীবনে ভালো লাগা আসে, প্রেম আসেই। এটা পাপ না। তবে একটা সম্পর্কে থেকে কিংবা কমিটেড থেকে আরেকটা প্রেম ভালো লাগার ডাকে সাড়া দেওয়া অন্যায়, পাপ। চিন্তা করাটাও অন্যায়, পাপ। তবে তুই তো কারো কাছে কমিটেড না, কোনো সম্পর্কে জড়িতও না। তবে এতো দ্বিধা কেন তোর?

তুই এটাই তো ভাবছিস তুই অন্য কাউকে ভালোবাসলে তোর ভালোবাসার মান কমে যাবে। অপমান হবে তোর ভালবাসার। দাম থাকবে না তোর ভালোবাসার। তাই না?”

জয় এবার সিয়ামের দিকে তাকায়। তবে কিছু বলে না। সিয়াম হালকা হেসে বলে,

“ তুই এমন বোকার মতো ভাবনা কেন ভাবছিস বলতো? কার জন্য তুই নিজের মনের দরজা বন্ধ করে রাখছিস বলতো। যে তোর কখনো ছিলই না তার জন্য! তোর ভালোবাসার কোনো দামই যার কাছে নেই তারজন্য? যদিও এতে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। তবুও এমন একজনের মানুষের জন্য নিজেকে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে নেই।”

ফয়সাল জয়ের কাঁধে চা’পড় দিয়ে বলে,

“ লোকে বলে না মানুষ প্রেমে পড়লে হিতাহিত জ্ঞান হারায় ফেলে, বোকা হয়ে যায় আমাদের জয়েরও সেই হাল হইছে বুঝলি।
এসব কথা আমাদের তোকে বুঝাতে হচ্ছে জয়? যেই তুই কিনা কত মানুষকে মোটিভেট করতি। ইভেন এখনও তোর কথা শুনেই রোগীরা অর্ধেক সুস্থবোধ করে। সেই তোকে এসব কথা আমাদের বারবার বুঝাতে হচ্ছে? ”

সিয়াম এবার জয়কে দু’হাতে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,

“ জয় লুক এট মি। মেডিকেলের সেকেন্ড ইয়ারের কথা মনে আছে তোর? ওই যে শাকিলের কথা। যে কিনা একটা মেয়ের চক্করে পড়ে অলমোস্ট নিজের ক্যারিয়ার নিজের জীবন সব নষ্ট করতে বসেছিল। তখন তুইই তো ওকে মোটিভেট করেছিলি। আজ ওকে দেখ ব্যাটা এখন বিদেশে চলে গেছে আরও ডিগ্রি নিতে। আর এখন তুই নিজের জীবন নিয়ে এমন দ্বিধায় দিন কাটাচ্ছিস, এটা কি চলে বলতো? হ্যা?”

“ গ্রো আপ ম্যান। আমরা আমাদের আগের সেই জয়কে দেখতে চাই। যে যেকোনো পরিস্থিতিতে অটল, অবিচল, শান্ত থাকতো। যে সব সমস্যার সমাধান কনফিডেন্সের সাথে করতো, সমস্যার সাথে লড়তো।কোনো পরিস্থিতিতে যে ঘাবড়ে যেত না। বি এ ম্যান ইয়ার।” — ফয়সালের কথায় জয় তার দিকে তাকায়।

এরপর সিয়ামের দিকে তাকায়। এরপর আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখবুঁজে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আর ভাবে সত্যিই তো কোথায় সে? সে তো নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছে। অথচ সেই কিনা একসময় লোকেদের বলতো যা কিছুই হয়ে যাক নিজের মাঝে নিজেকে যেন ধরে রাখে।

কার জন্য এতো দ্বিধায় সে। তিনবছর পার হয়ে গেছে। এবার তো নিজের লাইফটাকে গোছানো উচিত। এভাবে তো আর সারাজীবন চলতে পারে না। আর যেখানে এক তীব্র আলোক রশ্মি তার সামনে আছে। যার নামটাও তাকে শান্তি দেয়। তাকেই তো তার আঁকড়ে ধরা উচিত।

জয় পিছন ফিরে তাকায়। তার দুই সত্যিকারের বন্ধু। তার জানের জিগার। মানুষ দুটা তার সব পরিস্থিতিতে ছায়ার মতো পাশে ছিল এবং আছে। আর কি চাই! জয় হেসে সিয়াম আর জয়কে জড়িয়ে ধরে। হাসিমুখে জড়িয়ে ধরে ওরাও।

এই সুন্দর বন্ধুত্বের সাক্ষী হয়ে রইল আকাশের চাঁদ-তারা এবং হয়তো আরও কেউ।

#চলবে

( কপি করবেন না। আর কেমন লাগলো তা জানাবেন।)#সূর্যোদয়
#পর্ব_২০
#কারিমা_দিলশাদ

ছাদে মাদুর পেতে বসে আছে সিয়াম আর ফয়সাল। বসে বসে এদিক ওদিকের কথা বলছে আর সিগারেট ফুঁকছে। দূরে দাঁড়িয়ে জয়ও সিগারেট ফুঁকছে।

সিয়াম আর ফয়সাল কলেজে থাকতেই মাঝেমধ্যে সিগারেট খেলেও। জয় কখনো এসবের ধারেকাছ দিয়ে যেত না। তবে পুতুলের রিজেকশনের পর এসব শুরু করে। মায়ের মুখের দিকে চেয়ে কমিয়ে আনলেও গত দুবছরে মাঝেমধ্যে খেত। কিন্তু এই একবছরে জয় এসব ছুঁয়েও দেখেনি। তার পিছনেও ঐশীর হাত। আর আজ ঐশীর জন্যই সে আবার এটা ঠোঁটে নিয়েছে।

সিয়াম আর ফয়সাল এদিক ওদিকের কথা বললেও তাদের সবটা মনোযোগ জয়ের উপর। এতদিন পর আবার কি হয়েছে তা জানাটা জরুরি। তবে তারা জানে জয় নিজে না বললে তারা কখনো জয়ের পেট থেকে কথা বের করতে পারবে না।

কি হয়েছে কিংবা কোন বিষয় নিয়ে জয় আপসেট সেই বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা নেই। যদিও মনে মনে পুতুলকে নিয়েই কিছু একটা আন্দাজ করছে। তবে তা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় আছে তাদের। তারা তো একরকম বিশ্বাসই করে যে জয় ঐশীকে ভালোবাসে। কিন্তু জয় তা কখনো স্বীকার করে নি। আর আজ আবার এমন ব্যবহারে কিছু বুঝতে পারছে না। কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলে সেটা নিয়ে রাগিয়ে দিলে হয়তো জয় রাগটা প্রকাশ করতো। কিন্তু এখন একেবারে কোনো কিছু না জেনে কোনো কথা তুলতেও পারছে না। হীতে বিপরীত না হয়ে যায় আবার।

একপর্যায়ে ফয়সাল অতিষ্ঠ হয়ে বলে,

“ ভাই কি হইছে বল না। না বললে কিভাবে বুঝমু বলতো? সিয়াম ব্যাটা ঘরে বউ রাইখা আইছে। আমার গার্লফ্রেন্ড ওইদিক দিয়া সমানে ফোন দিতাছে। তোর লাইগা যদি খালি আমার ব্রে’কআপ হয় তাইলে খবর আছে কইয়া দিলাম।”

“ আহ ফয়সাল চুপ করতো। জয় দোস্ত বল না কি হইছে?”

এরপর সিয়াম উঠে জয়ের কাছে গিয়ে ইতস্তত এবং আমতাআমতা করতে মিনমিনিয়ে বললো,

“ পুতুলকে নিয়ে কি তুই আবার আপসেট?”

জয় চুপ। এরমানে পুতুলকে নিয়ে না। হলে বলতো। আসলে জয়ের স্বভাবটাই এমন। ভীষণ মুখচোরা স্বভাবের। কষ্ট পেলে বলবে না। কোনো বিষয় নিয়ে রেগে থাকলেও বলবে না। তবে যদি কাউকে নিয়ে রেগে থাকে তাহলে তার নাম নিলেই বো’মার মতো ফেটে পড়ে। এরপর একটু ভেবে বললো,

“ তাহলে কি ঐশীকে নিয়ে কিছু? ”

“ ওর নাম একদম নিবি না। জানিস কি করেছে বে’য়াদপ মেয়ে?
নায়িকা সেজে ঘুরে বেড়াতে হবে তার৷ এক টাকওয়ালা বেটার সাথে হাতে হাত মিলিয়ে দাঁত বের করে হেসে হেসে কথা বলছিল। কেন তার এতো হেসে হেসে কথা বলতে হবে বলতো? সবার সাথে হেসে কথা বলতে হবে কোন কারণে? ও কি জানে না ওর হাসি ঠিক কতটা মোহনীয়? এই যে এতগুলো দিন ধরে আমি ওকে চিনি, কই একবারো তো আমার সাথে হাত মিলালো না? আর ওই টাকলার সাথে গিয়ে হাত মিলাচ্ছে।

এই এই বল, বল আমি কোনদিক দিয়ে খারাপ। দেখতে ভালো আছি। ওই টাকলার থেকে আমি কমপক্ষে এক হাত লম্বা। বডি ফিট আছে। দেখ ভুঁড়ি বের হয় নাই আমার। দেখ দেখ।”

গেঞ্জি তুলে দেখাতে দেখাতে না থেমে আবার বলা শুরু করে,

“ আমার পিছে মেয়েদের লাইন লেগে থাকে। কত জুনিয়র, ক্লাসমেট, কলিগ আমার জন্য পাগল তোদের জানা নেই? ভালো ইনকাম করি, সেভিংস আছে, বাড়ি আছে। তারপরও কেন আমার দিকে তার নজর নেই? আমার সাথে এক দুইটা কথা বলে শেষ। ওই হ্যালো, হাই পর্যন্তই। মেসেজ দিলেও আমি ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন এতটুকু বলেই শেষ। ইনবক্স চেক করে দেখ এগুলো ছাড়া অন্য কোনো কথা নেই। যাও আছে সব স্মৃতিকে নিয়ে। কেন! কেন রে ভাই আমি কি এতোই ফেলনা নাকি?
ছেলেরা ওর সঙ্গে কথা বলতে চাইলেই ওর কথা বলতে হবে? আরে ওর সাথে তো ছেলেরা কথা বলতে চাইবেই। জানিস আরও কি হয়েছে?

যখন ও স্টেজে নাচছিল পিছনের ছেলেগুলো তো ক্রাশ ক্রাশ ভাবি ভাবি করে চিল্লাচ্ছিল। ও কি জানে না ও কতোটা সুন্দর? সি ইজ সো প্রিটি ইয়ার। সি ইজ সো সুইট। ও কি জানে ও ঠিক কতটা অসাধারণ? সি ইজ সো ইউনিক। ওকে যার তার সাথে মানায় না ইয়ার। সি ডিজার্ভ সামওয়ান বেস্ট। যার তার সাথে কেন কথা বলতে হবে ওই অ’সভ্য মেয়েটাকে…….”

একদমে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে কথা গুলো বলে ছাদের মেঝেতে চার হাত পা চারদিকে মেলে শুয়ে পড়ে জয়। আর জোরে জোরে শ্বাস নিতে শুরু করে।

আর বেচারা সিয়াম আর ফয়সাল। তারা তো এতোক্ষণ হা করে সব শুনছিল। আর এক নতুন জয়কে অবলোকন করছিল। সিয়াম আর ফয়সাল একজন আরেকজনের দিকে একবার তাকিয়ে আবার অবাক দৃষ্টিতে মেঝেতে থাকা জয়ের দিকে তাকায়। ওদের দেখলে যে কেউ বলবে ওরা ভূত দেখেছে। অবশ্যই এটা তাদের কাছে ভূত দেখার থেকে কম কিছু না।

জয় হচ্ছে মুখচোরা, শান্ত, নম্র, ভদ্র, সভ্য একজন মানুষ। ভীষণ লাজুক এক পুরুষ। একদমই এক্সপ্রেসিভ না। সিয়াম জয়ের স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড। আর ফয়সালের সাথে পরিচয় মেডিকেল কলেজের হোস্টেল থেকে। একই রুমে থাকতো তারা। অথচ সিয়াম জয়ের স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড হওয়া সত্যেও পুতুলকে নিয়ে জয়ের অনুভূতি সে হোস্টেলে গিয়ে জানতে পারে।

পুতুলকে নিয়ে তার যেই অনুভূতি তা জয় মাঝে মাঝে খুবই শান্তভাবে বলতো। ডাক্তারি পড়াশেষ হলে পুতুলের মা বাবাকে সে বিয়ের প্রস্তাব দিবে, তার পরিকল্পনা সবকিছু। যখন পুতুলের কাছ থেকে রিজেক্ট হয় তখন জয়কে খুব ভেঙে পড়তে দেখে তারা। অসহায় হতে দেখে। সারাদিন চুপচাপ থাকতো, কান্না করতো। কিন্তু পুতুলকে নিয়ে কখনো ডেস্পারেট হতে দেখে নি। কক্ষনো না। আর আজ এ কোন জয়কে তারা দেখছে। এতো রীতিমতো সা’ইকোর মতো বিহেভ করছে!

————————

সিয়াম আর ফয়সাল থম মে’রে বসে আছে। পুরো ছাদ জুড়ে ভয়ানক নিরাবতা বিরাজ করছে। কিছুক্ষণ পর সিয়াম এবং ফয়সাল নড়েচড়ে উঠে। তারাও মেঝেতে বসে পরে। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে কিছু বলে নেয়। এরপর ফয়সাল গলা খাঁকারি দিয়ে জয়কে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ দোস্ত তুই ঠিকই বলছস সি ডিজার্ভ সামওয়ান বেস্ট।”

সিয়াম বলে,

“ ইয়েস। কত্ত সুন্দর ঔ বলতো! কত্তো অসাধারণ একটা মেয়ে। ওরজন্যে এমন কাউকে দরকার যে ওকে সবটা দিয়ে ভালোবাসবে।

কিন্তু তুই এতো হাইপার হচ্ছিস কেন বলতো? তুই তো ওকে ভালোবাসিস না। ও যার সাথে মন চায় কথা বলুক, হাসুক, হাত মেলা’ক তাতে তোর কি বলতো?”

সিয়ামের কথা শুনে জয় চোখ খুলে থম মে’রে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর চট করে উঠে বসে মাথা নিচু করে বসে থাকে। সিয়াম আবার জিজ্ঞেস করে,

“ কি হলো কথা বলছিস না কেন? ঐশী যার সাথে ইচ্ছা কথা বলুক তাতে তোর কি? তাতে তুই কেন এতো আপসেট? আর এতো ডেস্পারেট হওয়ারই বা কি মানে?”

জয় এখনো চুপ। ওদের করা প্রশ্নে হাসফাস বোধ হচ্ছে তার। জয় উঠে এগিয়ে গিয়ে সামনের রেলিং ধরে দাঁড়ায়। এসব প্রশ্নের যে কোনো জবাব তার কাছে নেই। এই প্রশ্নগুলো তো তারও। তবুও সে বিষয়টা কোনোভাবে কন্ট্রোল করতে পারছে না।

সিয়াম বলে,

“ জয়… এখনো কি বলবি তুই ঐশীকে ভালোবাসিস না?”

“ বলেই দেখুক দাবাং মার্কা চ*ড় খাবে এবার।” — ফয়সাল কিছুটা রাগত্ব স্বরে বলে। আরও বলে,

“ স্পিক জয়। এবারও কি বলবি তুই ঐশীকে ভালোবাসিস না? ”

জয় নিশ্চুপ। ফয়সাল জয়ের কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ায় আর বলে,

“ বন্ধু তুমি যতো যাই বলো না কেন। তুমি প্রেমে সেইভাবে ডুবছো। তুমি চরমভাবে জেলাস। জেলাসে জেলাসে তুমি ছারখার হয়ে গেছ। আর ভালোবাসার একটা অংশ হচ্ছে জেলাসি। যাকে তুমি ভালবাসো তাকে অন্যকারো সাথে দেখলে বুকে খুব লাগে। আর তুমি তো পুরা লাস্ট জোনে আছো ভাই। তুমি শেষ।

এখন যতই বাহানা দেখাস তুই, সত্যি তো এটাই যে তুই ঐশীকে ভালোবাসিস। এটাকে এক্সেপ্ট করে নে দোস্ত।”

সিয়ামও জয়ের অপর পাশে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলে,

“ দোস্ত…. মানুষের জীবনে ভালো লাগা আসে, প্রেম আসেই। এটা পাপ না। তবে একটা সম্পর্কে থেকে কিংবা কমিটেড থেকে আরেকটা প্রেম ভালো লাগার ডাকে সাড়া দেওয়া অন্যায়, পাপ। চিন্তা করাটাও অন্যায়, পাপ। তবে তুই তো কারো কাছে কমিটেড না, কোনো সম্পর্কে জড়িতও না। তবে এতো দ্বিধা কেন তোর?

তুই এটাই তো ভাবছিস তুই অন্য কাউকে ভালোবাসলে তোর ভালোবাসার মান কমে যাবে। অপমান হবে তোর ভালবাসার। দাম থাকবে না তোর ভালোবাসার। তাই না?”

জয় এবার সিয়ামের দিকে তাকায়। তবে কিছু বলে না। সিয়াম হালকা হেসে বলে,

“ তুই এমন বোকার মতো ভাবনা কেন ভাবছিস বলতো? কার জন্য তুই নিজের মনের দরজা বন্ধ করে রাখছিস বলতো। যে তোর কখনো ছিলই না তার জন্য! তোর ভালোবাসার কোনো দামই যার কাছে নেই তারজন্য? যদিও এতে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। তবুও এমন একজনের মানুষের জন্য নিজেকে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে নেই।”

ফয়সাল জয়ের কাঁধে চা’পড় দিয়ে বলে,

“ লোকে বলে না মানুষ প্রেমে পড়লে হিতাহিত জ্ঞান হারায় ফেলে, বোকা হয়ে যায় আমাদের জয়েরও সেই হাল হইছে বুঝলি।
এসব কথা আমাদের তোকে বুঝাতে হচ্ছে জয়? যেই তুই কিনা কত মানুষকে মোটিভেট করতি। ইভেন এখনও তোর কথা শুনেই রোগীরা অর্ধেক সুস্থবোধ করে। সেই তোকে এসব কথা আমাদের বারবার বুঝাতে হচ্ছে? ”

সিয়াম এবার জয়কে দু’হাতে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,

“ জয় লুক এট মি। মেডিকেলের সেকেন্ড ইয়ারের কথা মনে আছে তোর? ওই যে শাকিলের কথা। যে কিনা একটা মেয়ের চক্করে পড়ে অলমোস্ট নিজের ক্যারিয়ার নিজের জীবন সব নষ্ট করতে বসেছিল। তখন তুইই তো ওকে মোটিভেট করেছিলি। আজ ওকে দেখ ব্যাটা এখন বিদেশে চলে গেছে আরও ডিগ্রি নিতে। আর এখন তুই নিজের জীবন নিয়ে এমন দ্বিধায় দিন কাটাচ্ছিস, এটা কি চলে বলতো? হ্যা?”

“ গ্রো আপ ম্যান। আমরা আমাদের আগের সেই জয়কে দেখতে চাই। যে যেকোনো পরিস্থিতিতে অটল, অবিচল, শান্ত থাকতো। যে সব সমস্যার সমাধান কনফিডেন্সের সাথে করতো, সমস্যার সাথে লড়তো।কোনো পরিস্থিতিতে যে ঘাবড়ে যেত না। বি এ ম্যান ইয়ার।” — ফয়সালের কথায় জয় তার দিকে তাকায়।

এরপর সিয়ামের দিকে তাকায়। এরপর আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখবুঁজে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আর ভাবে সত্যিই তো কোথায় সে? সে তো নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছে। অথচ সেই কিনা একসময় লোকেদের বলতো যা কিছুই হয়ে যাক নিজের মাঝে নিজেকে যেন ধরে রাখে।

কার জন্য এতো দ্বিধায় সে। তিনবছর পার হয়ে গেছে। এবার তো নিজের লাইফটাকে গোছানো উচিত। এভাবে তো আর সারাজীবন চলতে পারে না। আর যেখানে এক তীব্র আলোক রশ্মি তার সামনে আছে। যার নামটাও তাকে শান্তি দেয়। তাকেই তো তার আঁকড়ে ধরা উচিত।

জয় পিছন ফিরে তাকায়। তার দুই সত্যিকারের বন্ধু। তার জানের জিগার। মানুষ দুটা তার সব পরিস্থিতিতে ছায়ার মতো পাশে ছিল এবং আছে। আর কি চাই! জয় হেসে সিয়াম আর জয়কে জড়িয়ে ধরে। হাসিমুখে জড়িয়ে ধরে ওরাও।

এই সুন্দর বন্ধুত্বের সাক্ষী হয়ে রইল আকাশের চাঁদ-তারা এবং হয়তো আরও কেউ।

#চলবে

( কপি করবেন না। আর কেমন লাগলো তা জানাবেন।)#সূর্যোদয়
#পর্ব_২০
#কারিমা_দিলশাদ

ছাদে মাদুর পেতে বসে আছে সিয়াম আর ফয়সাল। বসে বসে এদিক ওদিকের কথা বলছে আর সিগারেট ফুঁকছে। দূরে দাঁড়িয়ে জয়ও সিগারেট ফুঁকছে।

সিয়াম আর ফয়সাল কলেজে থাকতেই মাঝেমধ্যে সিগারেট খেলেও। জয় কখনো এসবের ধারেকাছ দিয়ে যেত না। তবে পুতুলের রিজেকশনের পর এসব শুরু করে। মায়ের মুখের দিকে চেয়ে কমিয়ে আনলেও গত দুবছরে মাঝেমধ্যে খেত। কিন্তু এই একবছরে জয় এসব ছুঁয়েও দেখেনি। তার পিছনেও ঐশীর হাত। আর আজ ঐশীর জন্যই সে আবার এটা ঠোঁটে নিয়েছে।

সিয়াম আর ফয়সাল এদিক ওদিকের কথা বললেও তাদের সবটা মনোযোগ জয়ের উপর। এতদিন পর আবার কি হয়েছে তা জানাটা জরুরি। তবে তারা জানে জয় নিজে না বললে তারা কখনো জয়ের পেট থেকে কথা বের করতে পারবে না।

কি হয়েছে কিংবা কোন বিষয় নিয়ে জয় আপসেট সেই বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা নেই। যদিও মনে মনে পুতুলকে নিয়েই কিছু একটা আন্দাজ করছে। তবে তা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় আছে তাদের। তারা তো একরকম বিশ্বাসই করে যে জয় ঐশীকে ভালোবাসে। কিন্তু জয় তা কখনো স্বীকার করে নি। আর আজ আবার এমন ব্যবহারে কিছু বুঝতে পারছে না। কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলে সেটা নিয়ে রাগিয়ে দিলে হয়তো জয় রাগটা প্রকাশ করতো। কিন্তু এখন একেবারে কোনো কিছু না জেনে কোনো কথা তুলতেও পারছে না। হীতে বিপরীত না হয়ে যায় আবার।

একপর্যায়ে ফয়সাল অতিষ্ঠ হয়ে বলে,

“ ভাই কি হইছে বল না। না বললে কিভাবে বুঝমু বলতো? সিয়াম ব্যাটা ঘরে বউ রাইখা আইছে। আমার গার্লফ্রেন্ড ওইদিক দিয়া সমানে ফোন দিতাছে। তোর লাইগা যদি খালি আমার ব্রে’কআপ হয় তাইলে খবর আছে কইয়া দিলাম।”

“ আহ ফয়সাল চুপ করতো। জয় দোস্ত বল না কি হইছে?”

এরপর সিয়াম উঠে জয়ের কাছে গিয়ে ইতস্তত এবং আমতাআমতা করতে মিনমিনিয়ে বললো,

“ পুতুলকে নিয়ে কি তুই আবার আপসেট?”

জয় চুপ। এরমানে পুতুলকে নিয়ে না। হলে বলতো। আসলে জয়ের স্বভাবটাই এমন। ভীষণ মুখচোরা স্বভাবের। কষ্ট পেলে বলবে না। কোনো বিষয় নিয়ে রেগে থাকলেও বলবে না। তবে যদি কাউকে নিয়ে রেগে থাকে তাহলে তার নাম নিলেই বো’মার মতো ফেটে পড়ে। এরপর একটু ভেবে বললো,

“ তাহলে কি ঐশীকে নিয়ে কিছু? ”

“ ওর নাম একদম নিবি না। জানিস কি করেছে বে’য়াদপ মেয়ে?
নায়িকা সেজে ঘুরে বেড়াতে হবে তার৷ এক টাকওয়ালা বেটার সাথে হাতে হাত মিলিয়ে দাঁত বের করে হেসে হেসে কথা বলছিল। কেন তার এতো হেসে হেসে কথা বলতে হবে বলতো? সবার সাথে হেসে কথা বলতে হবে কোন কারণে? ও কি জানে না ওর হাসি ঠিক কতটা মোহনীয়? এই যে এতগুলো দিন ধরে আমি ওকে চিনি, কই একবারো তো আমার সাথে হাত মিলালো না? আর ওই টাকলার সাথে গিয়ে হাত মিলাচ্ছে।

এই এই বল, বল আমি কোনদিক দিয়ে খারাপ। দেখতে ভালো আছি। ওই টাকলার থেকে আমি কমপক্ষে এক হাত লম্বা। বডি ফিট আছে। দেখ ভুঁড়ি বের হয় নাই আমার। দেখ দেখ।”

গেঞ্জি তুলে দেখাতে দেখাতে না থেমে আবার বলা শুরু করে,

“ আমার পিছে মেয়েদের লাইন লেগে থাকে। কত জুনিয়র, ক্লাসমেট, কলিগ আমার জন্য পাগল তোদের জানা নেই? ভালো ইনকাম করি, সেভিংস আছে, বাড়ি আছে। তারপরও কেন আমার দিকে তার নজর নেই? আমার সাথে এক দুইটা কথা বলে শেষ। ওই হ্যালো, হাই পর্যন্তই। মেসেজ দিলেও আমি ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন এতটুকু বলেই শেষ। ইনবক্স চেক করে দেখ এগুলো ছাড়া অন্য কোনো কথা নেই। যাও আছে সব স্মৃতিকে নিয়ে। কেন! কেন রে ভাই আমি কি এতোই ফেলনা নাকি?
ছেলেরা ওর সঙ্গে কথা বলতে চাইলেই ওর কথা বলতে হবে? আরে ওর সাথে তো ছেলেরা কথা বলতে চাইবেই। জানিস আরও কি হয়েছে?

যখন ও স্টেজে নাচছিল পিছনের ছেলেগুলো তো ক্রাশ ক্রাশ ভাবি ভাবি করে চিল্লাচ্ছিল। ও কি জানে না ও কতোটা সুন্দর? সি ইজ সো প্রিটি ইয়ার। সি ইজ সো সুইট। ও কি জানে ও ঠিক কতটা অসাধারণ? সি ইজ সো ইউনিক। ওকে যার তার সাথে মানায় না ইয়ার। সি ডিজার্ভ সামওয়ান বেস্ট। যার তার সাথে কেন কথা বলতে হবে ওই অ’সভ্য মেয়েটাকে…….”

একদমে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে কথা গুলো বলে ছাদের মেঝেতে চার হাত পা চারদিকে মেলে শুয়ে পড়ে জয়। আর জোরে জোরে শ্বাস নিতে শুরু করে।

আর বেচারা সিয়াম আর ফয়সাল। তারা তো এতোক্ষণ হা করে সব শুনছিল। আর এক নতুন জয়কে অবলোকন করছিল। সিয়াম আর ফয়সাল একজন আরেকজনের দিকে একবার তাকিয়ে আবার অবাক দৃষ্টিতে মেঝেতে থাকা জয়ের দিকে তাকায়। ওদের দেখলে যে কেউ বলবে ওরা ভূত দেখেছে। অবশ্যই এটা তাদের কাছে ভূত দেখার থেকে কম কিছু না।

জয় হচ্ছে মুখচোরা, শান্ত, নম্র, ভদ্র, সভ্য একজন মানুষ। ভীষণ লাজুক এক পুরুষ। একদমই এক্সপ্রেসিভ না। সিয়াম জয়ের স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড। আর ফয়সালের সাথে পরিচয় মেডিকেল কলেজের হোস্টেল থেকে। একই রুমে থাকতো তারা। অথচ সিয়াম জয়ের স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড হওয়া সত্যেও পুতুলকে নিয়ে জয়ের অনুভূতি সে হোস্টেলে গিয়ে জানতে পারে।

পুতুলকে নিয়ে তার যেই অনুভূতি তা জয় মাঝে মাঝে খুবই শান্তভাবে বলতো। ডাক্তারি পড়াশেষ হলে পুতুলের মা বাবাকে সে বিয়ের প্রস্তাব দিবে, তার পরিকল্পনা সবকিছু। যখন পুতুলের কাছ থেকে রিজেক্ট হয় তখন জয়কে খুব ভেঙে পড়তে দেখে তারা। অসহায় হতে দেখে। সারাদিন চুপচাপ থাকতো, কান্না করতো। কিন্তু পুতুলকে নিয়ে কখনো ডেস্পারেট হতে দেখে নি। কক্ষনো না। আর আজ এ কোন জয়কে তারা দেখছে। এতো রীতিমতো সা’ইকোর মতো বিহেভ করছে!

————————

সিয়াম আর ফয়সাল থম মে’রে বসে আছে। পুরো ছাদ জুড়ে ভয়ানক নিরাবতা বিরাজ করছে। কিছুক্ষণ পর সিয়াম এবং ফয়সাল নড়েচড়ে উঠে। তারাও মেঝেতে বসে পরে। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে কিছু বলে নেয়। এরপর ফয়সাল গলা খাঁকারি দিয়ে জয়কে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ দোস্ত তুই ঠিকই বলছস সি ডিজার্ভ সামওয়ান বেস্ট।”

সিয়াম বলে,

“ ইয়েস। কত্ত সুন্দর ঔ বলতো! কত্তো অসাধারণ একটা মেয়ে। ওরজন্যে এমন কাউকে দরকার যে ওকে সবটা দিয়ে ভালোবাসবে।

কিন্তু তুই এতো হাইপার হচ্ছিস কেন বলতো? তুই তো ওকে ভালোবাসিস না। ও যার সাথে মন চায় কথা বলুক, হাসুক, হাত মেলা’ক তাতে তোর কি বলতো?”

সিয়ামের কথা শুনে জয় চোখ খুলে থম মে’রে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর চট করে উঠে বসে মাথা নিচু করে বসে থাকে। সিয়াম আবার জিজ্ঞেস করে,

“ কি হলো কথা বলছিস না কেন? ঐশী যার সাথে ইচ্ছা কথা বলুক তাতে তোর কি? তাতে তুই কেন এতো আপসেট? আর এতো ডেস্পারেট হওয়ারই বা কি মানে?”

জয় এখনো চুপ। ওদের করা প্রশ্নে হাসফাস বোধ হচ্ছে তার। জয় উঠে এগিয়ে গিয়ে সামনের রেলিং ধরে দাঁড়ায়। এসব প্রশ্নের যে কোনো জবাব তার কাছে নেই। এই প্রশ্নগুলো তো তারও। তবুও সে বিষয়টা কোনোভাবে কন্ট্রোল করতে পারছে না।

সিয়াম বলে,

“ জয়… এখনো কি বলবি তুই ঐশীকে ভালোবাসিস না?”

“ বলেই দেখুক দাবাং মার্কা চ*ড় খাবে এবার।” — ফয়সাল কিছুটা রাগত্ব স্বরে বলে। আরও বলে,

“ স্পিক জয়। এবারও কি বলবি তুই ঐশীকে ভালোবাসিস না? ”

জয় নিশ্চুপ। ফয়সাল জয়ের কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ায় আর বলে,

“ বন্ধু তুমি যতো যাই বলো না কেন। তুমি প্রেমে সেইভাবে ডুবছো। তুমি চরমভাবে জেলাস। জেলাসে জেলাসে তুমি ছারখার হয়ে গেছ। আর ভালোবাসার একটা অংশ হচ্ছে জেলাসি। যাকে তুমি ভালবাসো তাকে অন্যকারো সাথে দেখলে বুকে খুব লাগে। আর তুমি তো পুরা লাস্ট জোনে আছো ভাই। তুমি শেষ।

এখন যতই বাহানা দেখাস তুই, সত্যি তো এটাই যে তুই ঐশীকে ভালোবাসিস। এটাকে এক্সেপ্ট করে নে দোস্ত।”

সিয়ামও জয়ের অপর পাশে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলে,

“ দোস্ত…. মানুষের জীবনে ভালো লাগা আসে, প্রেম আসেই। এটা পাপ না। তবে একটা সম্পর্কে থেকে কিংবা কমিটেড থেকে আরেকটা প্রেম ভালো লাগার ডাকে সাড়া দেওয়া অন্যায়, পাপ। চিন্তা করাটাও অন্যায়, পাপ। তবে তুই তো কারো কাছে কমিটেড না, কোনো সম্পর্কে জড়িতও না। তবে এতো দ্বিধা কেন তোর?

তুই এটাই তো ভাবছিস তুই অন্য কাউকে ভালোবাসলে তোর ভালোবাসার মান কমে যাবে। অপমান হবে তোর ভালবাসার। দাম থাকবে না তোর ভালোবাসার। তাই না?”

জয় এবার সিয়ামের দিকে তাকায়। তবে কিছু বলে না। সিয়াম হালকা হেসে বলে,

“ তুই এমন বোকার মতো ভাবনা কেন ভাবছিস বলতো? কার জন্য তুই নিজের মনের দরজা বন্ধ করে রাখছিস বলতো। যে তোর কখনো ছিলই না তার জন্য! তোর ভালোবাসার কোনো দামই যার কাছে নেই তারজন্য? যদিও এতে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। তবুও এমন একজনের মানুষের জন্য নিজেকে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে নেই।”

ফয়সাল জয়ের কাঁধে চা’পড় দিয়ে বলে,

“ লোকে বলে না মানুষ প্রেমে পড়লে হিতাহিত জ্ঞান হারায় ফেলে, বোকা হয়ে যায় আমাদের জয়েরও সেই হাল হইছে বুঝলি।
এসব কথা আমাদের তোকে বুঝাতে হচ্ছে জয়? যেই তুই কিনা কত মানুষকে মোটিভেট করতি। ইভেন এখনও তোর কথা শুনেই রোগীরা অর্ধেক সুস্থবোধ করে। সেই তোকে এসব কথা আমাদের বারবার বুঝাতে হচ্ছে? ”

সিয়াম এবার জয়কে দু’হাতে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,

“ জয় লুক এট মি। মেডিকেলের সেকেন্ড ইয়ারের কথা মনে আছে তোর? ওই যে শাকিলের কথা। যে কিনা একটা মেয়ের চক্করে পড়ে অলমোস্ট নিজের ক্যারিয়ার নিজের জীবন সব নষ্ট করতে বসেছিল। তখন তুইই তো ওকে মোটিভেট করেছিলি। আজ ওকে দেখ ব্যাটা এখন বিদেশে চলে গেছে আরও ডিগ্রি নিতে। আর এখন তুই নিজের জীবন নিয়ে এমন দ্বিধায় দিন কাটাচ্ছিস, এটা কি চলে বলতো? হ্যা?”

“ গ্রো আপ ম্যান। আমরা আমাদের আগের সেই জয়কে দেখতে চাই। যে যেকোনো পরিস্থিতিতে অটল, অবিচল, শান্ত থাকতো। যে সব সমস্যার সমাধান কনফিডেন্সের সাথে করতো, সমস্যার সাথে লড়তো।কোনো পরিস্থিতিতে যে ঘাবড়ে যেত না। বি এ ম্যান ইয়ার।” — ফয়সালের কথায় জয় তার দিকে তাকায়।

এরপর সিয়ামের দিকে তাকায়। এরপর আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখবুঁজে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আর ভাবে সত্যিই তো কোথায় সে? সে তো নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছে। অথচ সেই কিনা একসময় লোকেদের বলতো যা কিছুই হয়ে যাক নিজের মাঝে নিজেকে যেন ধরে রাখে।

কার জন্য এতো দ্বিধায় সে। তিনবছর পার হয়ে গেছে। এবার তো নিজের লাইফটাকে গোছানো উচিত। এভাবে তো আর সারাজীবন চলতে পারে না। আর যেখানে এক তীব্র আলোক রশ্মি তার সামনে আছে। যার নামটাও তাকে শান্তি দেয়। তাকেই তো তার আঁকড়ে ধরা উচিত।

জয় পিছন ফিরে তাকায়। তার দুই সত্যিকারের বন্ধু। তার জানের জিগার। মানুষ দুটা তার সব পরিস্থিতিতে ছায়ার মতো পাশে ছিল এবং আছে। আর কি চাই! জয় হেসে সিয়াম আর জয়কে জড়িয়ে ধরে। হাসিমুখে জড়িয়ে ধরে ওরাও।

এই #সূর্যোদয়
#পর্ব_২০
#কারিমা_দিলশাদ

ছাদে মাদুর পেতে বসে আছে সিয়াম আর ফয়সাল। বসে বসে এদিক ওদিকের কথা বলছে আর সিগারেট ফুঁকছে। দূরে দাঁড়িয়ে জয়ও সিগারেট ফুঁকছে।

সিয়াম আর ফয়সাল কলেজে থাকতেই মাঝেমধ্যে সিগারেট খেলেও। জয় কখনো এসবের ধারেকাছ দিয়ে যেত না। তবে পুতুলের রিজেকশনের পর এসব শুরু করে। মায়ের মুখের দিকে চেয়ে কমিয়ে আনলেও গত দুবছরে মাঝেমধ্যে খেত। কিন্তু এই একবছরে জয় এসব ছুঁয়েও দেখেনি। তার পিছনেও ঐশীর হাত। আর আজ ঐশীর জন্যই সে আবার এটা ঠোঁটে নিয়েছে।

সিয়াম আর ফয়সাল এদিক ওদিকের কথা বললেও তাদের সবটা মনোযোগ জয়ের উপর। এতদিন পর আবার কি হয়েছে তা জানাটা জরুরি। তবে তারা জানে জয় নিজে না বললে তারা কখনো জয়ের পেট থেকে কথা বের করতে পারবে না।

কি হয়েছে কিংবা কোন বিষয় নিয়ে জয় আপসেট সেই বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা নেই। যদিও মনে মনে পুতুলকে নিয়েই কিছু একটা আন্দাজ করছে। তবে তা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় আছে তাদের। তারা তো একরকম বিশ্বাসই করে যে জয় ঐশীকে ভালোবাসে। কিন্তু জয় তা কখনো স্বীকার করে নি। আর আজ আবার এমন ব্যবহারে কিছু বুঝতে পারছে না। কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলে সেটা নিয়ে রাগিয়ে দিলে হয়তো জয় রাগটা প্রকাশ করতো। কিন্তু এখন একেবারে কোনো কিছু না জেনে কোনো কথা তুলতেও পারছে না। হীতে বিপরীত না হয়ে যায় আবার।

একপর্যায়ে ফয়সাল অতিষ্ঠ হয়ে বলে,

“ ভাই কি হইছে বল না। না বললে কিভাবে বুঝমু বলতো? সিয়াম ব্যাটা ঘরে বউ রাইখা আইছে। আমার গার্লফ্রেন্ড ওইদিক দিয়া সমানে ফোন দিতাছে। তোর লাইগা যদি খালি আমার ব্রে’কআপ হয় তাইলে খবর আছে কইয়া দিলাম।”

“ আহ ফয়সাল চুপ করতো। জয় দোস্ত বল না কি হইছে?”

এরপর সিয়াম উঠে জয়ের কাছে গিয়ে ইতস্তত এবং আমতাআমতা করতে মিনমিনিয়ে বললো,

“ পুতুলকে নিয়ে কি তুই আবার আপসেট?”

জয় চুপ। এরমানে পুতুলকে নিয়ে না। হলে বলতো। আসলে জয়ের স্বভাবটাই এমন। ভীষণ মুখচোরা স্বভাবের। কষ্ট পেলে বলবে না। কোনো বিষয় নিয়ে রেগে থাকলেও বলবে না। তবে যদি কাউকে নিয়ে রেগে থাকে তাহলে তার নাম নিলেই বো’মার মতো ফেটে পড়ে। এরপর একটু ভেবে বললো,

“ তাহলে কি ঐশীকে নিয়ে কিছু? ”

“ ওর নাম একদম নিবি না। জানিস কি করেছে বে’য়াদপ মেয়ে?
নায়িকা সেজে ঘুরে বেড়াতে হবে তার৷ এক টাকওয়ালা বেটার সাথে হাতে হাত মিলিয়ে দাঁত বের করে হেসে হেসে কথা বলছিল। কেন তার এতো হেসে হেসে কথা বলতে হবে বলতো? সবার সাথে হেসে কথা বলতে হবে কোন কারণে? ও কি জানে না ওর হাসি ঠিক কতটা মোহনীয়? এই যে এতগুলো দিন ধরে আমি ওকে চিনি, কই একবারো তো আমার সাথে হাত মিলালো না? আর ওই টাকলার সাথে গিয়ে হাত মিলাচ্ছে।

এই এই বল, বল আমি কোনদিক দিয়ে খারাপ। দেখতে ভালো আছি। ওই টাকলার থেকে আমি কমপক্ষে এক হাত লম্বা। বডি ফিট আছে। দেখ ভুঁড়ি বের হয় নাই আমার। দেখ দেখ।”

গেঞ্জি তুলে দেখাতে দেখাতে না থেমে আবার বলা শুরু করে,

“ আমার পিছে মেয়েদের লাইন লেগে থাকে। কত জুনিয়র, ক্লাসমেট, কলিগ আমার জন্য পাগল তোদের জানা নেই? ভালো ইনকাম করি, সেভিংস আছে, বাড়ি আছে। তারপরও কেন আমার দিকে তার নজর নেই? আমার সাথে এক দুইটা কথা বলে শেষ। ওই হ্যালো, হাই পর্যন্তই। মেসেজ দিলেও আমি ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন এতটুকু বলেই শেষ। ইনবক্স চেক করে দেখ এগুলো ছাড়া অন্য কোনো কথা নেই। যাও আছে সব স্মৃতিকে নিয়ে। কেন! কেন রে ভাই আমি কি এতোই ফেলনা নাকি?
ছেলেরা ওর সঙ্গে কথা বলতে চাইলেই ওর কথা বলতে হবে? আরে ওর সাথে তো ছেলেরা কথা বলতে চাইবেই। জানিস আরও কি হয়েছে?

যখন ও স্টেজে নাচছিল পিছনের ছেলেগুলো তো ক্রাশ ক্রাশ ভাবি ভাবি করে চিল্লাচ্ছিল। ও কি জানে না ও কতোটা সুন্দর? সি ইজ সো প্রিটি ইয়ার। সি ইজ সো সুইট। ও কি জানে ও ঠিক কতটা অসাধারণ? সি ইজ সো ইউনিক। ওকে যার তার সাথে মানায় না ইয়ার। সি ডিজার্ভ সামওয়ান বেস্ট। যার তার সাথে কেন কথা বলতে হবে ওই অ’সভ্য মেয়েটাকে…….”

একদমে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে কথা গুলো বলে ছাদের মেঝেতে চার হাত পা চারদিকে মেলে শুয়ে পড়ে জয়। আর জোরে জোরে শ্বাস নিতে শুরু করে।

আর বেচারা সিয়াম আর ফয়সাল। তারা তো এতোক্ষণ হা করে সব শুনছিল। আর এক নতুন জয়কে অবলোকন করছিল। সিয়াম আর ফয়সাল একজন আরেকজনের দিকে একবার তাকিয়ে আবার অবাক দৃষ্টিতে মেঝেতে থাকা জয়ের দিকে তাকায়। ওদের দেখলে যে কেউ বলবে ওরা ভূত দেখেছে। অবশ্যই এটা তাদের কাছে ভূত দেখার থেকে কম কিছু না।

জয় হচ্ছে মুখচোরা, শান্ত, নম্র, ভদ্র, সভ্য একজন মানুষ। ভীষণ লাজুক এক পুরুষ। একদমই এক্সপ্রেসিভ না। সিয়াম জয়ের স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড। আর ফয়সালের সাথে পরিচয় মেডিকেল কলেজের হোস্টেল থেকে। একই রুমে থাকতো তারা। অথচ সিয়াম জয়ের স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড হওয়া সত্যেও পুতুলকে নিয়ে জয়ের অনুভূতি সে হোস্টেলে গিয়ে জানতে পারে।

পুতুলকে নিয়ে তার যেই অনুভূতি তা জয় মাঝে মাঝে খুবই শান্তভাবে বলতো। ডাক্তারি পড়াশেষ হলে পুতুলের মা বাবাকে সে বিয়ের প্রস্তাব দিবে, তার পরিকল্পনা সবকিছু। যখন পুতুলের কাছ থেকে রিজেক্ট হয় তখন জয়কে খুব ভেঙে পড়তে দেখে তারা। অসহায় হতে দেখে। সারাদিন চুপচাপ থাকতো, কান্না করতো। কিন্তু পুতুলকে নিয়ে কখনো ডেস্পারেট হতে দেখে নি। কক্ষনো না। আর আজ এ কোন জয়কে তারা দেখছে। এতো রীতিমতো সা’ইকোর মতো বিহেভ করছে!

————————

সিয়াম আর ফয়সাল থম মে’রে বসে আছে। পুরো ছাদ জুড়ে ভয়ানক নিরাবতা বিরাজ করছে। কিছুক্ষণ পর সিয়াম এবং ফয়সাল নড়েচড়ে উঠে। তারাও মেঝেতে বসে পরে। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে কিছু বলে নেয়। এরপর ফয়সাল গলা খাঁকারি দিয়ে জয়কে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ দোস্ত তুই ঠিকই বলছস সি ডিজার্ভ সামওয়ান বেস্ট।”

সিয়াম বলে,

“ ইয়েস। কত্ত সুন্দর ঔ বলতো! কত্তো অসাধারণ একটা মেয়ে। ওরজন্যে এমন কাউকে দরকার যে ওকে সবটা দিয়ে ভালোবাসবে।

কিন্তু তুই এতো হাইপার হচ্ছিস কেন বলতো? তুই তো ওকে ভালোবাসিস না। ও যার সাথে মন চায় কথা বলুক, হাসুক, হাত মেলা’ক তাতে তোর কি বলতো?”

সিয়ামের কথা শুনে জয় চোখ খুলে থম মে’রে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর চট করে উঠে বসে মাথা নিচু করে বসে থাকে। সিয়াম আবার জিজ্ঞেস করে,

“ কি হলো কথা বলছিস না কেন? ঐশী যার সাথে ইচ্ছা কথা বলুক তাতে তোর কি? তাতে তুই কেন এতো আপসেট? আর এতো ডেস্পারেট হওয়ারই বা কি মানে?”

জয় এখনো চুপ। ওদের করা প্রশ্নে হাসফাস বোধ হচ্ছে তার। জয় উঠে এগিয়ে গিয়ে সামনের রেলিং ধরে দাঁড়ায়। এসব প্রশ্নের যে কোনো জবাব তার কাছে নেই। এই প্রশ্নগুলো তো তারও। তবুও সে বিষয়টা কোনোভাবে কন্ট্রোল করতে পারছে না।

সিয়াম বলে,

“ জয়… এখনো কি বলবি তুই ঐশীকে ভালোবাসিস না?”

“ বলেই দেখুক দাবাং মার্কা চ*ড় খাবে এবার।” — ফয়সাল কিছুটা রাগত্ব স্বরে বলে। আরও বলে,

“ স্পিক জয়। এবারও কি বলবি তুই ঐশীকে ভালোবাসিস না? ”

জয় নিশ্চুপ। ফয়সাল জয়ের কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ায় আর বলে,

“ বন্ধু তুমি যতো যাই বলো না কেন। তুমি প্রেমে সেইভাবে ডুবছো। তুমি চরমভাবে জেলাস। জেলাসে জেলাসে তুমি ছারখার হয়ে গেছ। আর ভালোবাসার একটা অংশ হচ্ছে জেলাসি। যাকে তুমি ভালবাসো তাকে অন্যকারো সাথে দেখলে বুকে খুব লাগে। আর তুমি তো পুরা লাস্ট জোনে আছো ভাই। তুমি শেষ।

এখন যতই বাহানা দেখাস তুই, সত্যি তো এটাই যে তুই ঐশীকে ভালোবাসিস। এটাকে এক্সেপ্ট করে নে দোস্ত।”

সিয়ামও জয়ের অপর পাশে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলে,

“ দোস্ত…. মানুষের জীবনে ভালো লাগা আসে, প্রেম আসেই। এটা পাপ না। তবে একটা সম্পর্কে থেকে কিংবা কমিটেড থেকে আরেকটা প্রেম ভালো লাগার ডাকে সাড়া দেওয়া অন্যায়, পাপ। চিন্তা করাটাও অন্যায়, পাপ। তবে তুই তো কারো কাছে কমিটেড না, কোনো সম্পর্কে জড়িতও না। তবে এতো দ্বিধা কেন তোর?

তুই এটাই তো ভাবছিস তুই অন্য কাউকে ভালোবাসলে তোর ভালোবাসার মান কমে যাবে। অপমান হবে তোর ভালবাসার। দাম থাকবে না তোর ভালোবাসার। তাই না?”

জয় এবার সিয়ামের দিকে তাকায়। তবে কিছু বলে না। সিয়াম হালকা হেসে বলে,

“ তুই এমন বোকার মতো ভাবনা কেন ভাবছিস বলতো? কার জন্য তুই নিজের মনের দরজা বন্ধ করে রাখছিস বলতো। যে তোর কখনো ছিলই না তার জন্য! তোর ভালোবাসার কোনো দামই যার কাছে নেই তারজন্য? যদিও এতে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। তবুও এমন একজনের মানুষের জন্য নিজেকে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে নেই।”

ফয়সাল জয়ের কাঁধে চা’পড় দিয়ে বলে,

“ লোকে বলে না মানুষ প্রেমে পড়লে হিতাহিত জ্ঞান হারায় ফেলে, বোকা হয়ে যায় আমাদের জয়েরও সেই হাল হইছে বুঝলি।
এসব কথা আমাদের তোকে বুঝাতে হচ্ছে জয়? যেই তুই কিনা কত মানুষকে মোটিভেট করতি। ইভেন এখনও তোর কথা শুনেই রোগীরা অর্ধেক সুস্থবোধ করে। সেই তোকে এসব কথা আমাদের বারবার বুঝাতে হচ্ছে? ”

সিয়াম এবার জয়কে দু’হাতে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,

“ জয় লুক এট মি। মেডিকেলের সেকেন্ড ইয়ারের কথা মনে আছে তোর? ওই যে শাকিলের কথা। যে কিনা একটা মেয়ের চক্করে পড়ে অলমোস্ট নিজের ক্যারিয়ার নিজের জীবন সব নষ্ট করতে বসেছিল। তখন তুইই তো ওকে মোটিভেট করেছিলি। আজ ওকে দেখ ব্যাটা এখন বিদেশে চলে গেছে আরও ডিগ্রি নিতে। আর এখন তুই নিজের জীবন নিয়ে এমন দ্বিধায় দিন কাটাচ্ছিস, এটা কি চলে বলতো? হ্যা?”

“ গ্রো আপ ম্যান। আমরা আমাদের আগের সেই জয়কে দেখতে চাই। যে যেকোনো পরিস্থিতিতে অটল, অবিচল, শান্ত থাকতো। যে সব সমস্যার সমাধান কনফিডেন্সের সাথে করতো, সমস্যার সাথে লড়তো।কোনো পরিস্থিতিতে যে ঘাবড়ে যেত না। বি এ ম্যান ইয়ার।” — ফয়সালের কথায় জয় তার দিকে তাকায়।

এরপর সিয়ামের দিকে তাকায়। এরপর আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখবুঁজে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আর ভাবে সত্যিই তো কোথায় সে? সে তো নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছে। অথচ সেই কিনা একসময় লোকেদের বলতো যা কিছুই হয়ে যাক নিজের মাঝে নিজেকে যেন ধরে রাখে।

কার জন্য এতো দ্বিধায় সে। তিনবছর পার হয়ে গেছে। এবার তো নিজের লাইফটাকে গোছানো উচিত। এভাবে তো আর সারাজীবন চলতে পারে না। আর যেখানে এক তীব্র আলোক রশ্মি তার সামনে আছে। যার নামটাও তাকে শান্তি দেয়। তাকেই তো তার আঁকড়ে ধরা উচিত।

জয় পিছন ফিরে তাকায়। তার দুই সত্যিকারের বন্ধু। তার জানের জিগার। মানুষ দুটা তার সব পরিস্থিতিতে ছায়ার মতো পাশে ছিল এবং আছে। আর কি চাই! জয় হেসে সিয়াম আর জয়কে জড়িয়ে ধরে। হাসিমুখে জড়িয়ে ধরে ওরাও।

এই সুন্দর বন্ধুত্বের সাক্ষী হয়ে রইল আকাশের চাঁদ-তারা এবং হয়তো আরও কেউ।

#চলবে

( কপি করবেন না। আর কেমন লাগলো তা জানাবেন।) বন্ধুত্বের সাক্ষী হয়ে রইল আকাশের চাঁদ-তারা এবং হয়তো আরও কেউ।

#চলবে

( কপি করবেন না। আর কেমন লাগলো তা জানাবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here