#সুপ্ত_অনুরাগে,সূচনা পর্ব
#প্রভা_আফরিন
সাঁই করে একটি বাইক এসে থামল ফরিদ মিয়ার খুপরি দোকানের সামনে। বাইকের শব্দ পাওয়া মাত্রই ফরিদ তার গুল মাখানো কালচে ছোপ পড়া দাঁতের পাটি বের করে বিস্তর এক হাসি দিলো। বাধা খদ্দের এসেছে। সে উৎফুল্ল দৃষ্টিতে একবার সম্মুখের চারতলা বাড়ির দিকে তাকিয়ে এঁটো কাপ গরম পানি দিয়ে ধোয়ায় মন দিলো। সুপ্ত ইঞ্জিন বন্ধ করে আঙুলের ডগায় চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে বাইক থেকে নামল। নির্লিপ্ত চক্ষুদ্বয় থেকে ধুসর সানগ্লাসটি খুলে বুকের কাছটায় ঝুলিয়ে দিলো। ভাজ পড়া শার্টের কলার ঝাঁকিয়ে দু-হাত দুদিকে প্রসারিত করে শেষ বিকেলের ম রা রোদের পরশ বুলিয়ে নিল গায়ে। ধপ করে কাঠের লম্বা বেঞ্চিতে বসে চনমনে গলায় বলল,
“ফরিদ মিয়া, সূর্যমামা কি আজ জলদি বিদায় নিচ্ছে নাকি আমিই দেরি করে ফেললাম?”
ফরিদ তার লিকলিকে দেহটি ঝাকিয়ে উত্তর দিলো,
“না ভাইজান, সূর্য সময় মতোনই যাইতাছে। আপনেরও দেরি হয় নাই।”
সুপ্ত কপট কৌতুহলী দৃষ্টি মেলে জানতে চাইলো,
“কি করে বুঝলে?”
“ভাবী এহনো বাইর হয় নাই।”
কথাটা বলেই ফরিদ ইঙ্গিতপূর্ণ একটা হাসি ঠোঁটে আঁটতে গিয়ে সুপ্তের দৃষ্টির রো ষানলে পড়ে থেমে গেল।
“তোমাকে না নি’ষেধ করেছি ওদিকে নজর দেবে না? চায়ের কেটলিতে মনোযোগ না দিয়ে আশেপাশে তাকাও বলেই আজকাল চায়ের স্বাদ বদলে যাচ্ছে।”
ফরিদ জিভে কা মড় দিয়ে বলল,
“আমার ইস্পেশাল গুড়ের চায়ের কসম ভাইজান, কোনোদিকে দেহি না।”
“তাহলে বুঝলে কি করে বের হয়নি?”
“অ…অনুমান করলাম। রা’গ হইয়েন না ভাইজান। আপনে আমার ভাই। আপনের বউ আমার ভাবী। আমার মনে কোনো পা’প নাই।”
সুপ্ত নিভে গেল। ‘আপনের বউ’ শব্দটা তার কানে যেন মধু ঢালল। চোখ ঘুরিয়ে দোকানের উল্টোপাশে তাকালো। মুখ না ফিরিয়েই আদেশের স্বরে বলল,
“তোমার স্পেশাল গুড়ের চা বানাও ফরিদ মিয়া। তারআগে একটা সি-গারেট দাও।”
ফরিদ তার গুল মাখানো কালচে দাঁতগুলো আরেকবার প্রদর্শন করল। সিগারেট ও লাইটার এগিয়ে দিয়ে মন দিলো চায়ের কাপে। সুপ্ত এখন ঘন্টাখানেক এই স্যাতস্যাতে, চা পাতার কড়া গন্ধযুক্ত, পলিথিনের জোড়াতালি দেওয়া দোকানে বসে থাকবে, যতক্ষণ না দিনের আলো নিংড়ে আঁধার নেমে আসে। এ সম্পূর্ণ সময়টায় সে একে একে পাঁচ কাপ চা খাবে। সাথে দুটি সি-গারেট। দ্বিতীয় ও শেষ সি-গারেটটি ধরাবে যখন যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হবে। এবং পুরোটা সময় আনমোনা, উদাসী দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকবে সম্মুখের সবুজ টাইলসে মোড়ানো চারতলা বাড়ির দিকে। এটি তার নিত্যদিনের অভ্যাস। ফিরে যাওয়ার পথে কোনোদিন ঠোঁটে মৃদু হাসি লেপ্টে থাকে আবার কোনোদিন রাজ্যের বিষন্নতা। বিষন্নতাই বেশি দেখা যায়। আর যেদিন হাসি ফোটে ফরিদ বখশিশ লাভ করে। সেই বখশিশের লোভেই কিনা, ফরিদ চায় সুপ্ত খুশি থাকুক।
সুপ্ত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিন তলার বারান্দায় দোলায়মান গোলাপি পর্দার দিকে। গোধূলির ম্লান আভায় সেই গোলাপি রঙ ধীরে ধীরে ওর চোখ ভেদ করে মনেও লেপ্টে যাচ্ছে।
অনেকদিন পর বড়ো বোনের বাড়িতে এসেছে কাজু। বসার ঘরে বসে পা দোলাচ্ছে আয়েশে। ঠোঁটে ফুরফুরে এক হাসি। হাতে একটি রেজাল্ট কার্ড ধরে রাখা। কার্ডের বাংলার ঘরটায় মোটা লাল কালি দিয়ে ইংরেজি ‘এফ’ অক্ষরটি লেখা। পাশেই মুখ কাচুমাচু করে বসে আছে শিমুল। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে একবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। পর মুহূর্তে চোখ ফিরিয়ে তাকাচ্ছে লাল কালিতে রাঙানো তার পরিশ্রমের ফলের দিকে। ফাঁকা ঢোক গিলছে অনবরত। ভাগ্নের অবস্থা দেখে কাজু বলল,
“কি হলো? ভয় পাচ্ছিস?”
শিমুল কোনো উত্তর দিলো না। কাজু ওর কাধে থাবা বসিয়ে বলল,
“আরে ব্যাটা! বিশ্বের সব সফল ও ধনী ব্যক্তিদের সফলতার মূল মন্ত্র কি জানিস?”
শিমুল পুতুলের মতো ডানে-বামে মাথা নাড়ল। অর্থাৎ সে জানে না। কাজু যেন তার অজ্ঞতায় আরেকটু ফুরফুরে অনুভব করল। বিজ্ঞের মতো হাত নেড়ে, মুখে বক্তৃতা দেওয়ার ভঙ্গি এঁটে বলতে লাগল,
“সফল হওয়ার মূলমন্ত্র হচ্ছে পেছনের বেঞ্চে বসে ক্লাস করা। আর বছরে দুয়েকটা ডাব্বা মা’রা। ভালো ছাত্ররা গতানুগতিক জীবনের বাইরে গিয়ে ক্রিয়েটিভ হতে পারে না। মুখস্ত বিদ্যাই তাদের সম্বল। তারা ততটুকুই জানে যতটুকু দেখে এবং শোনে। অন্যদিকে ফেইল মা’রা ছাত্ররা মুখস্ত বিদ্যার ধার ধারে না। তারা যা দেখে না তা থেকেও শিক্ষা নেয়। ক্রিয়েটিভ চিন্তাভাবনায় তাদের ব্রেইন এতটাই ব্যস্ত থাকে যে পড়াশোনার বাড়তি লোড নিতে পারে না। আমাকে দেখেই শেখ। জীবনে উন্নতি করতে হলে দুয়েকটা হো’চ’ট খেতে হয়। এগুলো উন্নতির লক্ষণ। তোর মাঝে বিকশিত হতে শুরু করেছে।”
এগারো বছর বয়সী শিমুল তর্জনী দ্বারা নাকের ওপর থেকে চশমা ঠেলে ফট করে বলে বসল,
“কিন্তু মামা, মা যে তোমায় খালি অকর্মার ঢেকি বলে ডাকে।”
কাজু থতমত খেয়ে ভাগ্নেকে ধ’মকে উঠল,
“চুপ… চুপ গা ধা! গুরুরা নিজের জন্য নয়, নিজের শিষ্যদের ভবিষ্যৎ আটশো আশি ভোল্টের বাত্তির মতো উজ্জ্বল করে গড়তে নিজেদের জীবন ফিউজ করে দেয়। পরার্থে নিজের ভবিষ্যৎ নিবেদন করে। এটাই গুরুদের জীবনের সার্থকতা। আমিও তোদের গুরু। নিজের ভবিষ্যৎ বানের জলে ভাসিয়ে তোদের জীবনকে গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত হয়েছি।”
শিমুল মামার কথার আগামাথা কিছুই বুঝল মা। প্রকাশ না করে বলল,
“আমি বুঝলে কিচ্ছু হবে না। তুমি বাবাকে বোঝাও, প্লিজ মামা! এ যাত্রায় বাঁচিয়ে দাও। পরের বার পাশ করব, প্রমিস।”
এমন সময় শব্দহীন একজোড়া পায়ের আগমন ঘটল বসার ঘরে। সঙ্গে সঙ্গে শিমুল মাথা নত করল। শব্দ উবে গেল কণ্ঠ হতে। অপরাজিতা ভ্রু কুচকে মামা ও ছোটো ভাইকে পরখ করে নেয়। কাজু বলল,
“এভাবে দেখছিস কেন?”
অপরাজিতা পাশের সিঙ্গেল সোফায় বসে থমথমে গলায় বলল,
“ফেলুর মাথায় গোবর ঠাসছো কেন?”
“কারণ গোবরে একদিন পদ্মফুল ফুটবে।”
“পদ্ম না আমি শিমুল।”
শিমুল মামার বাক্য সংশোধন করে বোনের কড়া চাহনি থেকে আবার চোখ লুকালো। কাজু চুটকি বাজিয়ে বলল,
“রাইট, শিমুল ফুল ফুটবে। রেজাল্ট কার্ডের লাল কালির চেয়েও টকটকে লাল ফুল। তোদের বাপ তো এমনিতেও ফুলের বাগান বানিয়েছে। একজন বেলী, একজন অপরাজিতা, আরেকজন শিমুল।”
মামার কথা শুনে অপরাজিতা তথা অপুর নাসিকা পিছলে একটি লম্বা হতাশ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। তার পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া আদরের ছোটো ভাই দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় এক বিষয়ে ফেইল করেছে। গণিত কিংবা ইংরেজিতে হলেও মনকে বোঝানো যেত। কিন্তু শিমুল ফেইল করেছে বাংলায়! এরপরেও কঠিন সাবজেক্টকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে সহজ সাবজেক্ট এ গাফিলতি হয়েছে হিসেবে ধরে নিতে পারত। কিন্তু শিমুল রেজাল্ট কার্ডটাই লুকিয়ে গিয়েছে। অপুর হাতে সেটা পড়েছে চারদিন পর। ভাইয়ের এহেন অধঃপতনে অপু তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করেছে। একান্তই বলতে হলে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বলে। শিমুল বলে না ডেকে ফেলু বলে ডাকছে। শিমুলের সে নাম শুনলে কি যে কান্না পায়! কিন্তু নামের পরিবর্তনের চেয়েও এখন তার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু বাবা। অফিস থেকে ফিরলেই জেনে যাবে তার কীর্তিকলাপ। এরপর কী হবে? ভাবার আগেই শিমুলের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। এদিকে মামাকে পেয়ে সে খানিক আশার আলো দেখতে পাচ্ছে। যদি তাকে বাঁচিয়ে নিতে পারে সে সারাজীবন মামার চাকর হয়ে থাকবে, মসজিদে টাকা দেবে, নিজে না খেয়ে একটি ভি ক্ষুককে একবেলা খাওয়াবেসহ নানান প্রতিজ্ঞা করছে।
অপু পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে তার বোহেমিয়ান মামার মনে চলছেটা কী? তারচেয়েও বেশি ভাবাচ্ছে মামার ছাড়া ছাড়া হাসিটা। অপু ঠান্ডা স্বরে বলল,
“ফেলু, রুমে যা।”
শিমুল নামের অ ত্যা চার থেকে বাঁচতে প্রায় ছুটে চলে গেল যেন। অপু মামার দিকে মনোযোগ দিয়ে বলল,
“তোমার মতলবটা কী বলোতো মামা। হঠাৎ না বলে চলে গেলে, আবার না বলেই ফিরে এলে? এই হাসিটার অর্থ কী?”
“মতলব-ফতলব কিছু নেই। আমার মন আজ এমনিতেই ভালো।”
অপুর সে কথা বিশ্বাস হলো না। কাজু তা বুঝে আবার বলল,
“তুই এক্কেবারে বাপের মতো হয়েছিস। ঘোর স’ন্দেহবাতিক।”
“স’ন্দেহ করার কিছু নেই বলছো?”
কাজু সে কথার জবাব দিলো না। খানিকটা আগ্রহ জাগিয়ে রাখতে মন্দ লাগে না। যখন জানবে তখন আর তাকে পায় কে? প্রসঙ্গ বদলাতে বলল,
“খবরদারি রাখ তো। বুবু কোথায়?”
অপু বলল,
“মায়ের কিন্তু প্রেশার বেড়েছে মামা। উল্টোপাল্টা কিছু বলে অসুস্থ করে দিয়ো না যেন।”
কাজু চুকচুক শব্দ তুলে আফসোস করে বলল,
“অসুস্থ তোরা বানিয়েছিস। আমার ভোলাভালা বুবুটা তোর বাপের খ প্পরে পড়ে শেষ হয়ে গেল। ওদের বিয়ের সময় যদি গ্যাদা-বাচ্চা না থাকতাম নিশ্চয়ই বিয়েটা আটকে দিতাম। তা তোর বাপকে তো দেখছি না?”
“বাবা এই সময় বাড়িতে থাকে না, তুমি জানো সেটা।”
“ওহহ হ্যাঁ, মনে ছিল না। পেটে দানাপানি না থাকলে মাথা কাজ করে না।”
“দুপুরে খাওনি?”
“আমার তো তোদের মতো বাপের হোটেল নেই যে খাব।”
“নিজের হোটেল খুলে নাও। চুলে পাক ধরতে শুরু করেছে। এরপরে তো হোটেলের ম্যানেজারও কপালে জুটবে না।”
ভাগ্নির মশকরায় কাজু চোখ গরম করে তাকাল। অপু উঠতে উঠতে বলল,
“টেবিলে গিয়ে বসো, আমি খাবার বাড়ছি।”
টেবিলে খাবার সাজিয়ে অপরাজিতা দেয়াল ঘড়িতে তাকাল। ছয়টা বেজে গেছে। দিন কখন ফুরিয়ে গেল টেরই পায়নি। সে নিজের রুমে ঢুকতেই দেখল শিমুল জানালার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুকি দিচ্ছে। অপু কণ্ঠে আবারো গম্ভীরতা এঁটে জিজ্ঞেস করল,
“ওখানে কী?”
শিমুল তার রেজাল্টের কথা আপাতত ভুলে বসেছে। তার সব আগ্রহ ফরিদ মিয়ার চায়ের দোকানের কাছে। সে বলল,
“আপু, সেই বাইকটা দাঁড়িয়ে আছে। আর সেই লোকটা…”
“জানালা আটকে দে।”
শিমুল মুখ গোমড়া করল। অপু সঙ্গে যোগ করল,
“বাবার আসার সময় হয়েছে।”
কথাটা শোনা মাত্রই শিমুল তড়িঘড়ি করে জানালা বন্ধ করে ছুট দিলো। এখন তাকে মামার কাছে যেতে হবে। কারণ মামা-ভাগ্নে যেখানে আপদ নাই সেখানে।
সন্ধ্যা নামতেই ফরিদের দোকানের টিমটিমে হলুদ বাতিটা জ্ব-লে উঠেছে। সুপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে শেষ সি-গারেট টা ধরালো। ফরিদও অনুকরণ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বুঝে গেছে আজ আর বখশিশ পাওয়া হবে না। আদুরীকেও উপহার দেওয়া হবে না। নতুন নতুন প্রেমটা আবার ভেস্তে না যায়!
সুপ্ত উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে গেল ছায়াঘেরা, নির্জন পথের ধারে। তিনতলার জানালাটি ধীরে ধীরে আবছা হয়ে উঠছে। সুপ্ত সেই জানালার দিকে তাকিয়ে প্রায়ান্ধকারে বিড়বিড় করে বলল,
“আমি জ্যোৎস্নার নদীতে ভাসতে চাই আর সে ডোবায় অমাবস্যায়!”
চলবে…