#সুখের_অ-সুখ-১২,১৩
#মম_সাহা
পর্বঃ বারো
দীর্ঘ ছয়ঘন্টা যাবত সুখকে পাগলের মতন খুঁজছে মেঘ। সকাল হতেই সে চলে এসেছিলো সুখের বাড়ি কিন্তু সেখানে এসেই শুনতে পায় চাঞ্চল্যকর খবর। সুখ গতরাতেই বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে গেছে। বের হয়ে গেছে বললে ভুল হবে বের করা হয়েছে। মেঘের রাগ জেনো আকাশ ছুঁয়েছিলো, ইচ্ছে করছিলো সবাইকে গলা টিপে মেরে ফেলতে। তারপর সেখান থেকে বের হয়ে অনুর বাড়ি আর হিমার বাড়িও খোঁজ করেছে।
এত বড় শহরে কোথায় খুঁজবে অপরিচিতাকে? তবে কী অপরিচিতা, অপরিচিতা হয়েই থেকে যাবে? উপায়ন্তর না পেয়ে মেঘ কল লাগায় ইউসুফকে। অপর পাশ থেকে ফোন রিসিভ হতেই মেঘ ব্যতিব্যস্ত স্বরে বলল,
-‘ইউসুফ তোমার মেমকে খুঁজে পাচ্ছি না। তাকে কাল রাতে ঘর থেকে বের করা হয়েছে। কী করবো ইউসুফ? আমার মাথা যে কাজ করছে না।’
-‘স্যার, এখন আপনি কোথায় আছেন?’
-‘এইতো ইউসুফ বাস স্ট্যান্ড এর কাছে। খোঁজ করে দেখতে হবে কেউ কিছু বলতে পারে কি না।’
ইউসুফ ছোট্ট শ্বাস ফেলল। প্রণয় বুঝি এমন হয়? একজন গম্ভীর মানুষকে কেমন মাতোয়ারা করে দিয়েছে। প্রেম নামক বস্তুটা মরুভূমিতেও জল বের করতে পারবে বোধহয়। ইশ্ মাঝে মাঝে মনে হয় “যে মানুষ একবার জীবনে প্রণয়ে জড়ায় নি, সে সমস্ত জীবনটাই মধু বিহীন কাটিয়েছে। প্রেম এমন একটা জিনিস যার প্রাপ্তিতে মিলবে অমৃত আর বিচ্ছেদে মিলবে গরল। তবুও একবার স্বাদ গ্রহন করা উচিত। হয় অমৃত নাহয় গরল কিছু তো মিলবে।”
ইউসুফকে চুপ থাকতে দেখে মেঘ অধৈর্য হয়ে বলল,
-‘ইউসুফ কিছু বলবে না আমি ফোনটা রাখবো?’
ইউসুফ থতমত খেয়ে বলল,
-‘না স্যার কাটবেন না। আপনি তো বাস স্ট্যান্ডে আছেন,গাড়িটা ঘুরিয়ে আরেকটু এগিয়ে আমার বাড়ির সামনে চলে আসুন আমিসহ মেমকে খুঁজবো। আর এ সময় আপনার ড্রাইভিং করাও ঠিক না।’
ইউসুফের যুক্তিটা অর্থবহ মনে হলো মেঘের। সে “আচ্ছা” বলেই ফোনটা কেটে গাড়িটা আরেকটু সামনে নিয়ে ইউসুফদের বাড়ির সামনে দাঁড়ালো।
মেঘ গাড়ি থামাতেই দেখে ইউসুফ বেশ সুন্দর ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ ভ্রু কুঁচকে বলল,
-‘উঠো গাড়িতে।’
ইউসুফ এগিয়ে আসলো, মেঘের পাশের দরজাটা খুলে দিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
-‘আমরা মেমকে খুঁজতে ঠিকই যাবো স্যার তবে, তার আগে আম্মু আপনাকে দেখা করতে বলেছে। চলুন।’
মেঘ বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে বলল,
-‘তুমি আন্টিকে কোনো বললে আমার আসার কথাটা? জানোই তো এখন আমার স্বস্তি মিলবে না যতক্ষণ অব্দি অপরিচিতার দেখা না পাই।’
-‘জ্বি স্যার জানি। তবুও আম্মু বলেছে একটু রাখুন।’
মেঘ আর কথা বললো না। গাড়ি থেকে নেমেই গটগট পায়ে হাঁটা ধরলো। তার পিছু পিছু ভিতরে গেলো ইউসুফও।
ফ্লাটের দরজাটায় কলিং বেল বাজাতেই ইউসুফের বোন দরজাটা দ্রুত খুলে দেয়। মেঘ ভিতরে ঢুকে আন্তরিকতার সাথে ইউসুফের আম্মু আমেনা রহমানের পানে তাকিয়ে মিষ্টি কন্ঠে বলল,
-‘আন্টি কেমন আছেন?’
মহিলাও মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বলল,
-‘ভালো,বাবা। তুমি কেমন আছো?’
মেঘ “ভালো আছি” উচ্চারণ করার আগেই সোফায় বসে থাকা ব্যাক্তিটাকে দেখে চক্ষু চড়কগাছ। মুখের কথা মুখের ভিতরই রয়ে গেলো। বরং সে কথার বদলে বিষ্ময়কর কন্ঠে বলল,
-‘অপরিচিতা আপনি?’
মেঘ দ্রত এগিয়ে গেলো সুখের কাছে। সুখ সোফাতেই তখনও ঠাঁই বসে রইলো। মেঘ এগিয়ে গিয়ে আবারও একই প্রশ্ন ছুঁড়ে মারলো। এবার পিছন থেকে ইউসুফ জবাব দিলো,
-‘আমিই মেমকে কাল রাতে এখানে এনেছিলাম। আপনাকে তো আর শ্বাসকষ্ট নামক রোগে ডুবাতে পারি না।’
ইউসুফের কথা থামতেই ড্রয়িং রুমে হাসির জোয়ার বসে গেলো।মেঘও হেসে দিলো। মেঘের নিজেকে অতি সুখে পাগল মনে হলো। কি জেনো হারিয়ে গেছে অনুভূতিটা হঠাৎ করেই চলে গেলো। সে অপরিচিতার পাশে গিয়ে বসলো।
ইউসুফ মেঘের সামনে এসে দাঁড়ালো। সুখ এবার মুখ খুললো,ধীর কন্ঠে বলল,
-‘ভাইয়া বসুন।’
ইউসুফ হাসি দিয়ে মাথা নেড়ে “না” ইশারা করলো। মেঘ গলা পরিষ্কার করে ইউসুফকে চোখের ইশারায় বসতে বলল। সেকেন্ড দুইও ইউসুফ অপেক্ষা করেনা বোধহয় বসতে। সুখ অবাক হয় তবে এই ইউসুফ নামক মানুষটার প্রতি তার সম্মান আরেকটু বেড়ে যায়।
মেঘ এবার অধৈর্য কন্ঠে বলল,
-‘এবার বলো তো ইউসুফ,তুমি তোমার মেমকে কোথায় পেলে?’
মেঘের কথায় ইউসুফ বলা শুরু করলো। সুখও হারিয়ে গেলো কালকের বিভীষিকাময় রাতে,
রাত বারোটার কাছাকাছি। যশোরের মতন শহরেও একদম জনমানবশূণ্য মনে হচ্ছে এই সময়টা। সুখ ফুটপাতের উপর বসে আছে। দিনের বেলাতে অনেক রৌদ থাকলেও রাতের বেলাতে বেশ ঠান্ডা। শরীরে বিয়ের বেনারসী টা এখনো জড়িয়ে আছে সে। মাঝে মাঝে হিম শীতল বাতাস আচমকা হাড় কাঁপানো অনুভূতি দিয়ে চলে যাচ্ছে।
সুখ নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে পথের মলিন ধূলার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। রাস্তাটা একবারে শুনশান হওয়াতে ভালো হয়েছে, না আছে ভালো মানুষ আর না আছে খারাপ মানুষ। রীতিমতো গলার স্বর বসে গেছে। নিজের বাড়ি থেকে বের হয়ে প্রথমে অনুদের বাড়িতে গিয়েছিল,কিন্তু গিয়ে শুনে অনুর মায়ের শরীর ভীষণ অসুস্থ হওয়ায় তারা তাকে হসপিটালে নিয়ে গেছে। আর, হিমার বাসায় যাওয়ার ইচ্ছে সত্যি বলতে সুখের হয় নি। হিমার পরিবারে একমাত্র হিমা’ই সুখের ভরসা কিন্তু বাকি সদস্য গুলো সুখকে পছন্দ করেনা তৎকালীন ঘটনার জন্য। শুধু শুধু সেখানে গেলে ভীষণ ঝামেলা ছাড়া কিছুই হবে না তাই সুখ সেখানে যাওয়ার চেয়ে রাস্তাকেই উত্তম বলে ভেবে নিয়েছে।
এই বিপদের দিনে না চাইতেও সুখের আরেকজনের কথা মনে পড়েছে,সে হলো মেঘ সাহেব। কিন্তু এমন উদ্ভট ভাবনার জন্য সুখ নিজেই নিজেকে ভর্ৎসনা করেছে। এই পৃথিবীতে নিজের বাড়িটা ছাড়া আর কোনো জায়গা যে তার নেই।
সুখ যে ফুটপাতে বসে আছে তার ঠিক বিপরীত দিক থেকে কেউ একজন দ্রুত গতিতে সুখের দিকে ছুটে আসলো। কারো হিম শীতল হাত সুখের বাহুতে ঠেকল। সুখ ভয় পেলো, আৎকে উঠলো মনের কু ডাকে। দ্রুত গতিতে উঠে পিছে তাকাতেই চমকে উঠলো ভীষণ বিষ্ময়ে, অবাক কন্ঠে বলল,
-‘আপনি এখানে?’
সুখের চেয়েও দ্বিগুণ অবাক হয়ে ইউসুফ বলল,
-‘মেম,আপনি এখানে কেনো? এই এত রাতে একা এ রাস্তায় কী করছেন?’
সুখের উত্তর দিতে হয় না। ততক্ষণে ইউসুফ সুখের পাশে থাকা ট্রলি ব্যাগটা দেখে যা বুঝার বুঝে যায়। করুণ স্বরে বলল,
-‘অবশেষে বাড়ি ছাড়া হলেন? ঠাঁই দিলো না আপনার পাষাণ পরিবার?’
ইউসুফের করুন স্বরে বলা কথাটা সুখের হৃদয়ের গহীনে আন্তঃ ক্ষরণ করলো। ভীষণ রক্ত ঝড়ে পরলো হয়তো হৃদয় নিংড়ে। চোখ টলমল করে উঠল,কথা বললেই হয়তো কেঁদে দিবো তাই মুখ বন্ধ করে কেবল ডানে বামে মাথা নাড়ালো,যার অর্থ “নাহ্, এ বার আর ঠাঁই মেলে নি বাড়িতে।”
ইউসুফ কতক্ষণ চুপ রয়। নিরব রয় কিছুকাল। তারপর ধীর গতিতে কাপড়ের ব্যাগ টা হাতে নিয়ে নমনীয় স্বরে বলে,
-‘আমার সাথে চলুন মেম। আপনার এ ভাই আছে তো। আপনার চিন্তা কিসের?’
সুখ অবাক হয়। তার কানে “আপনার এ ভাই আছে তো” কথাটি পৌঁছাতে মস্তিষ্কের সব গুলো নিউরন সচল হয়ে উঠলো। কী পরম ভরসার কথা খানা তার কান শ্রবণ করলো বোধহয়। তবুও নিজেকে আরেকটু সংযত করে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-‘কোথাও যাবো ইউসুফ ভাই?’
-‘এই যে মেম,এই ভাইটার বাসায়। ভাই ডাকছেন অথচ কোথায় যাবেন তা নিয়ে চিন্তা করছেন? আপনার এ পৃথিবীতে আপনার ভাই তো বেঁচে আছে। এত চিন্তা কিসের?’
সুখের জেনো মনে হলো কূল কিনারা বিহীন সমুদ্র আশার প্রদীপ পেলো। কৌতূহল দমাতে না পেরে সে জিজ্ঞেস করল,
-‘আপনি এত রাতে এখানে কেন ভাইয়া?’
-‘আগে বাসায় আসুন তারপর সব কথা। আমার বোন আছেন বাসায় সাথে মা-ও। নির্দ্বিধায় চলুন।’
ইউসুফের গভীর সর্তকতার সাথে সুখের মনের দ্বিধা দূর করার প্রক্রিয়াটা অসাধারণ লাগলো সুখের। যতই ইউসুফ ভরসা যোগ্য হোক কিন্তু এত রাতে তার সাথে একটা বাড়িতে যাওয়া টা নিত্যান্তই দৃষ্টিকটু মনে হচ্ছিলো সুখের। সুখের এ ভাবনা ইউসুফ হয়তো আঁচ করতে পেরেছে তাই তো কৌশলে মা আর বোনের কথাটা বলেছে।
সুখ ইউসুফে কথায় মাথা নাড়াতে ইউসুফ ধীর গতিতে পা ফেলল পথে। রাস্তাটা পাড় হতেই একটা বাড়িতে ঢুকে পড়লো ইউসুফ, তার সাথে সাথে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো সুখও।আট তলা বিল্ডিং। তত আলিশান না হলোও বেশ স্বচ্ছল ভাবে থাকার মতন।
ইউসুফ সিঁড়ি ভেঙে তিন তলা উঠে বা’পাশের ফ্লাট টাই চলে গেলো। দরজা খোলাই ছিলো। রুমে প্রবেশ করতেই পুরো ড্রয়িং রুম জুড়ে অন্ধকার। ইউসুফ দ্রুত গতিতে হাতের ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে ড্রয়িং রুমের লাইট জ্বালায়। ফিল্টার থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে সুখের দিকে এগিয়ে দেয় এবং আশ্বস্ত কন্ঠে বলে,
-‘মেম আপনি পানিটুকু সোফায় বসে খান আমি আম্মুকে ডাক দিচ্ছি।’
অতঃপর ইউসুফ তার মা, বোনকে ডেকে আনলো। বেশ আদর যত্ন করে রাতটা অতিবাহিত করলো।
সমস্ত কথা শোনার পর মেঘ কতক্ষণ চুপ করে রয়। তারপর ধীর কন্ঠে সুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘অপরিচিতা আপনি আমার সাথে আমার বাসায় চলুন। আপনার থাকার জায়গার অভাব পরবে না।’
সুখ তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,
-‘শেষমেশ লোকে আশ্রিতা বলুক সেটাই চাচ্ছেন? এই কলঙ্কও যেনো লেপিত হয়!’
সুখের এহেন প্রশ্নে ভড়কে যায় মেঘ। তারপর মনের গহীন কোণে খারাপ লাগাটা তড়তড় করে বেড়ে যায়। এই মেয়ে ভালো কথার মানুষ না। হঠাৎই শান্ত মেঘ অশান্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। রাগী কন্ঠে ইউসুফকে বলে,
-‘ইউসুফ, তোমার মেমদের বাড়ি যাবে এখন আর উনার দাদীকে নিয়ে আসবে। গো,ফাস্ট।’
স্যারের হঠাৎ বদলে থতমত খায় ইউসুফ। সেও দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। সুখ মেঘের আচরণ বুঝতে না পেরে অবাক কন্ঠে বলল,
-‘দাদীকে দিয়ে কী হবে? আগে আমার থাকার জায়গা ঠিক করি।’
মেঘ সুখের দিকে তাকায়। ইউসুফকে শক্ত কন্ঠে বলল,
-‘এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আচো কেন ইউসুফ? যা বলেছি তা ফাস্ট ফাস্ট করো। আর শুনো সাথে কাজি নিয়ে আসবে।’
ইউসুফ আর সুখ উভয়ে বিষ্ময় কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
-‘কাজি?’
মেঘ দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
-‘হ্যাঁ কাজি। আশ্রিতা না বউয়ের পরিচয়ে অপরিচিতা আমার বাড়িতে উঠবে। এটাই লাস্ট কথা।’
#চলবে
[কি মনে হয়? বিয়েটা হবে?]
#সুখের_অ-সুখ
#মম_সাহা
পর্বঃ তেরো
সময়টা ঠিক গ্রীষ্মের ক্লান্ত বিকেল। চারদিকে আধাঁর করে ঝড় উঠেছে। কৃষ্ণচূড়ার তৃষ্ণাতুর দেহ ভিজিয়ে দিচ্ছে বৃষ্টির কণা গুলো। ইউসুফদের পুরো ড্রয়িং রুম জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মানুষজন। ইউসুফ, তার মা, বোন, দাদীজান। সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে। এইতো ঘন্টাখানেক আগে সুখের দারুণ অনিচ্ছায় হয়ে গেলো তার বিয়েটা। সত্যিই কী দারুণ অনিচ্ছা ছিলো? মনের কোণে বুঝি একটুও ইচ্ছে ছিলো না? ছিলো বোধহয়, কিন্তু রমনী সেটা স্বীকার করবে না। বরাবরই বিয়ের লাল বেনারসী যখন সাদা কাপড়ে রূপান্তরিত হচ্ছিল তখন কোন রমনীরই বা বিয়ে করার ইচ্ছে জাগ্রত থাকে? তারও ছিলো না ইচ্ছে। আবার হয়তো জীবন সঙ্গী টা মেঘ সাহেব ছিলো বিধায় তমুল বাঁধাও প্রদান করে নি।
তখন যখন মেঘ রাগান্বিত স্বরে বলল কাজি আনার কথা তখন প্রতিবাদ করে উঠে সুখ। সুখের অমতেও ইউসুফ দাদীজানকে আনতে চলে যায়। দাদীজানও এক কাপড়ে চলে আসে সেখানে। একটু ভালো থাকার আশায় বৃদ্ধ মানুষটাও হয়তো ছটফট করছিলো। সানজিদা বেগম তখন বাড়ি ছিলো না, লীলাবতীও ছিলো নিদ্রায়। খালি বাড়িটা খুলে রেখে চলে এসেছে সে। পিছে ফিরে তাকায় নি। সে একটা অপরিচিত ছেলের আশ্রয়কে নিরাপদ মনে করেছে নিজের বাড়ি থেকেও।
সুখ দাঁড়িয়ে আছে নিজের জন্য বরাদ্দ করা রুমটায়। মেঘ বাহিরে গিয়ে ছিলো কোনো একটা কাজে। ড্রয়িং রুম থেকে কথার শব্দ আসছে। বেশ আলোচনা বলা চলে। দাদীজানের পরিষ্কার কন্ঠ ভেসে আসছে। সে ইউসুফকে জিজ্ঞেস করছে,
-‘তুমি আমাগো সুখোবতীরে কেমনে পাইলা?’
-‘আসলে দাদী আমার ঘুম আসছিলো না। পানি খাওয়ার জন রান্নাঘরে আসতেই জানালার দিকে চোখ যায়। বাহিরে রাস্তায় তাকিয়ে দেখি একটা লাল বেনারসী পড়া মেয়ে বসে আছে ফুটপাতে। জানালা দিয়ে কেবল পিছন টুকু দেখা যায়। এক মিনিট,দু মিনিট,তিন মিনিট এমন করে আমি ঠাঁই দশ মিনিট দাঁড়িয়ে রইলাম কোনো মেয়েটার কোনো নড়চড় দেখলাম না। অবশেষে খোঁজ নিতে নিচে গিয়ে দেখি আমাদের মেডাম।’
-‘জানো,মাইয়াডা যখন বাইর হইয়া গেলো তহন কলিজাডা আমার এট্টুক হইয়া গেছিলো। কাইল চাইলে আমি ঝগড়া ঝামেলা কইরা ওরে হেই বাড়িতে রাখতে পারতাম কিন্তু সত্যি কইতে আমার আর ইচ্ছা জাঁগে নাই ওরে হেই বাড়ি রাখতে। তাই নিজেরে কঠিন কইরা এত রাইতে বাড়ির বাইরে পাঠাইলাম। যদি বাইচ্চা থাহে তাইলা শক্ত হইবো আর নাইলে মরুক। পোঁড়া কপাল নিয়া বাইচ্চা থাকার চাইয়া মরা ভালো।’
তারপর ড্রয়িং রুমে আরও কথোপকথন চললে কিন্তু তা কর্ণগোচর হলো না সুখের। এমন করে বদলিয়ে যাবে তার জীবনটা সে ভাবে নি। জীবন যুদ্ধে এখন সে আর একা না। আরও একটা শক্ত হাত আছে তার হাতের মুঠোয়। আদৌ হাতটা শক্ত তো?
তমুল ঝড় হলে বিদ্যুৎ যাবেই প্রচলিত প্রথা। ইউসুফদের ঘরেও বিদ্যুৎ নেই। যেহেতু চারপাশ নিকোষ কালো আধাঁরে ছেয়ে গেছে তাই পুরো ফ্লাট টাও অন্ধকারে রূপান্তরিত হয়েছে। সেখানে ইউসুফের মা আমেনা রহমান মোমবাতি জ্বালিয়ে আধাঁর কিছুটা নিবারণের চেষ্টা করেছে।
সুখ বাহিরে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি তার উদাস। বিষন্নতার মায়াজালে ঘিরে আছে সে। হঠাৎ তার ঘরে হুড়মুড় করে প্রবেশ করলো কেউ,ধ্যানে বিঘ্ন ঘটলো রমনীর। বাহির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রুমের ভিতর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। থমকে গেলো চোখের পলক,মনের গহীন কোণে একটা ভালো লাগার স্রোত বয়ে গেলো বোধহয়, মনের মণিকোঠা থেকে আনমনেই কেউ বলে উঠলো-“সামনের সুপুরুষটি সুখের। কেবল মাত্র সুখের।”
ইশ্, মনটা কেমন নিলর্জ। এত জোড়ে বললে সামনের মানুষটি শুনে ফেলবে তো। মনকে ভীষণ রকমের সাবধান বাণী দিয়ে চোখ নামালো সুখ। এ পুরুষটির ভিতর কোনো মায়া আছে বোধহয়, নাহয় একমাস আগেও যে পুরুষটিকে ভালো লাগতো তাকে আজ মনে পড়ছে না কেনো? গতকালও যে পুরুষের জন্য বউ সেজেছিলো তাকে স্মৃতির কোণাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কেনো? সব গুলো মানবকে ছাপিয়ে কেবল একজন মানুষ সবটা জায়গা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে। আর সে হলো, “মেঘ সাহেব”।
সুখকে ভাবনায় ডুবতে দেখে মেঘ ভ্রু কুঁচকে তাকায়, গলা পরিষ্কার করে বলে,
-‘আধাঁর রুমে বসে আছেন যে? ড্রয়িং রুমে গেলেও তো পারতেন আর নাহয় রুমে মোম দিতে বলতেন।’
কথাটা বলেই নিজের হাতের মোমটা টেবিলের কোণায় রাখলো মেঘ। সুখ জবাব দেয় না, আজ চুপ থাকতেই ভীষণ ভালো লাগছে।
সুখের জবাব না পেয়ে হতাশার শ্বাস ফেলে মেঘ। অপরিচিতা যে তার প্রশ্নের উত্তর দিবে না সে ভালো করেই জানে। তবুও মেঘ উত্তরের আশা না করে আবার নিজে নিজেই বলা শুরু করলো,
-‘ আপনি তখন আশ্রিতার কথাটা বলে ভালোই করেছেন,নাহয় বিয়েটা এত দ্রুত হতো না।’
সুখ আর চুপ করে রইলো না। তীক্ষ্ণ কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
-‘দয়া করলেন?’
সুখের বলা দুইটা শব্দ আগুন জ্বলালো মেঘের শরীরে। রাগ হলো চরম, মেয়েটা কী আবেগ অনুভূতি বুঝে না? পরক্ষণেই রাগটা নিজের মাঝে চেঁপে দিয়ে বলল,
-‘দয়া করার হলে বিয়ে করতাম না। বিয়ে করেছি জেনো দয়াটা না করা লাগে। নিজেকে এত ছোট কেনো ভাবেন আপনি? আপনি এমন ভাবেন বলেই মানুষ আপনাকে ছোট করে। আগে নিজের কাছে নিজে পরিষ্কার হোন।’
মেঘের কথায় বেশ রুক্ষতা ছিলো কিন্তু সাথে সত্যতাও ছিলো। সুখ মেঘের রাগী কন্ঠ শুনে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো মেঘের পানে। সে কী ভুল কিছু বলে ফেলে ছিলো?
মেঘের শরীর তখন ভিজে চুপসে আছে। মাথা থেকে টপটপ পানি পড়ছে। সুখ আর কিছু বলার আগে মেঘ ঘরের কোণা থেকে সুখের জামা কাপড়ের ব্যাগটা উঠিয়ে নিলো। সুখ অবাক হয়ে বলল,
-‘এমা,কী করছেন? ব্যাগ নিচ্ছেন কেনো? আর শরীরটা মুছেন আগে।’
মেঘ একঝলক সুখের দিকে তাকায় তারপর কন্ঠ একটু উঁচু করে বলে,
-‘আগে বাড়িতে চলুন তারপর সব হবে। এখানে আর থাকার প্রয়োজন নেই। পরে মনে হবে এখানেও আপনাকে দয়া করে রাখা হচ্ছে।’
সুখ অবাকে ‘হা’ হয়ে যায়। সামান্য কথাতে এত রিয়েক্ট করার কী হলো?
মেঘ ততক্ষণে ব্যাগ হাতে ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হলো। মেঘ ড্রয়িং রুমে আসতেই সবার কথাবার্তায় ভাঁটা পরলো। ইউসুফ তৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে গেলো। সবাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেঘ কন্ঠ কোমল করলো। শান্ত স্বরে বলল,
-‘ইউসুফ এখন আমাদের যেতে হবে। বিয়ের প্রথম রাত অপরিচিতা শ্বশুর বাড়ির বাহিরে থাকবে সেটা দেখতে ভালো লাগছে না। আদৌও শ্বশুর বাড়ি না স্বামীর বাড়ি বলা চলে। তাই চাচ্ছি আজ বাড়িতে চলে যেতে।’
ইউসুফ মেঘের দিকে ভালো করে তাকায়। দীর্ঘদিন একসাথে থাকার সুবাধে মেঘের অঙ্গভঙ্গি দেখে এতটুকু আঁচ করতে পারে যে কিছু একটা হয়েছে।
আমেনা রহমান ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলল,
-‘সে কী বাবা? কী বলছো? এই ঝড়বৃষ্টিতে কোথায় যাবে? এখানেই থাকবে। গরীবের ঘর বলে অসুবিধা হচ্ছে তাই না? একটু কষ্ট করে ম্যানেজ করে নেও বাবা।’
সুখ আমেনা রহমানের এমনে কথা দ্রুত মাথা নাড়িয়ে বলল,
-‘এসব কী বলছেন আন্টি? এমন বলবেন না। আপনারা কত ভালো।’
আমেনা রহমান সুখের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ইউসুফ নতজানু হয়ে বলল,
-‘মা স্যারকে আজ যেতে দেও, আরেকদিন মেম সহ এসে স্যার থাকবে নাহয়। বিয়ের প্রথম দিনই বাড়িছাড়া থাকবে কেমন জানি দেখাচ্ছে।’
আমেনা রহমান চোখ রাঙিয়ে বলল,
-‘ তোর লজ্জা করে না এসব বলতে? এই ঝড়বৃষ্টি তে বাড়ির মানুষ বাহিরে যায়?’
-‘আন্টি প্রমিস আমরা পরে এসে থাকবো কিন্তু আজ না।’
মেঘের কথায় সুখ নাক কুঁচকালো। এবার মানুষটা বেশি বেশি করছে। কোন কথার কী রিয়েক্ট করলো।
অতঃপর তুমুল কথাবার্তার পর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঝড় মাথায় বের হয়ে আসে মেঘেরা। দাদীর কাছে এর জন্য ক্ষমা চেয়ে নেয় মেঘ, মানুষটাকে বৃষ্টির মাঝে এভাবে টানা-হেঁচড়া করাটা অপরাধ হচ্ছে বলে। মেঘের এহেন আচরণে মুগ্ধ দাদী। তাদের সাথে সঙ্গী হয় ইউসুফও। সে তার স্যার মেমকে বৃষ্টিতে একা ছাড়বে না।
প্রচন্ড বৃষ্টি দেখে ধীর গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে ইউসুফ। সামনের সিটে বসে আছে মেঘ। পিছনের সিটে আছে দাদীজান আর সুখ। নতুন অধ্যায়ে পা রাখছে সুখ। অধ্যায়টা সুখকর হবে তো?
_________
দীর্ঘ দু’দিন পর ভার্সিটির গেইটে পা রাখলো সুখ। বাস দিয়েই এসেছে। মেঘদের বাড়ি থেকে ভার্সিটির দূরত্ব অনেক। কিন্তু মেঘের গাড়ি চড়ে বিলাসিতা করে সে আসে নি। যেহেতু মেঘের সাথে মানিয়ে নিতে তার সময় লাগবে তাই সে সময় দিচ্ছে নিজেকে। মেঘও সুখকে যথেষ্ট স্প্যাশ দিচ্ছে।
ভার্সিটিতে ঢুকতেই হিমা আর অণুর দেখা মিললো। সুখকে দেখেই অণু আর হিমা দ্রুত এগিয়ে আসলো। তাদের অবশ্য সুখ ফোনে সব বলেছে কিন্তু চেপে গেছে বিয়ের ব্যাপারটা। তারা দুজন তো মেঘ আর ইউসুফের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
অফিসের কেবিনে প্রবেশ করতেই মেঘের ফোনটা উচ্চশব্দে বেজে উঠলো। মেঘ ফোনটা বের করতেই ফোনের স্ক্রিনে বড় করে ভেসে উঠলো “মা” নামটা। মেঘ একটু ঢোক গিললো। দুই দিন যাবত মায়ের সাথে কোনোরূপ কথা হয় নি। বিয়ের কথা টা ঠিক কীভাবে বলবে বুঝে উঠতে পারে নি।
হাতের ফোনটা রিং হতে হতে কেটে গেলো। মিনিট এক এর মাঝে আবার ফোনটা তুমুল শব্দে বেজে উঠলো। ফোন রিসিভ হতেই অপরপাশ থেকে মহিলার তীব্র কন্ঠ ভেসে আসলো,
-‘বাবু,তুই মাকে ভুলে গেলি?’
মেঘ মুচকি হাসলো। আদুরে কন্ঠে বলল,
-‘না মা ভুলি নি,একটু ব্যস্ত ছিলাম।
অপরপাশের মহিলা শাসনের সুরে বলল,
-‘দেখবো তো মায়ের বেলা এত ব্যস্ততা বউ এলে কোথায় যায়। শোন বাবু, মোহিনীর বাবা তাড়া দিচ্ছেন। সেই সাত মাসে আগে এংগেইজমেন্ট করে রেখেছি তার মেয়েকে কবে ঘরে তুলবো। তুই একটু সময় করে তাড়াতাড়ি আয় বাবা। বিয়েটা সেড়ে ফেলতে হবে। মেয়েটাকে আর কত অপেক্ষা করাবো?’
মেঘ ভড়কে যায়। ভুলেই গেছিলো মোহিনী নামের মেয়েটার কথা। তবুও আমতা-আমতা কন্ঠে বলল,
-‘হ্যাঁ মা আসবো। ভুলি নি ওর কথা।’
_________
খাটের নিচ থেকে ধারালো রামদা টা বের করে রাতে আধাঁরে কেউ একজন ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। আধাঁরে এক জায়গায় মাটি খুড়ে ভীষণ গোপনে লুকিয়ে ফেলল অস্ত্রতা। চাঁদের আলোয় চকচক করে উঠলো পাঁচদিন পুরোনো রক্ততা। যা দেখে রহস্য হাসি হাসে গোপন মানুষ। আনমনেই বলল “অসৎ পুরুষের মৃত্যু শ্রেয়”।
#চলবে