#সম্মোহনী_সেই_মেয়েটি
#পর্বঃ১৭,১৮
#লেখিকাঃরাদিয়াহ_রাফা_রুহি
পর্বঃ১৭
মায়াবীর বিয়ে হয়ে গেছে কালকে।বেশ ধুমধামে মেয়ের বিয়েটা সেরেছেন আলিফ হোসেন।বড় মেয়ের বিয়ে নিয়ে তিনি খুব চিন্তিত ছিলেন।তার কারণ বাবা মা ছাড়া একটা ছেলে মানুষ হয়েছে না জানি কেমন হবে সেসব নিয়ে চিন্তায় পরে গেছিলেন প্রথম দিকে।পরে অবশ্য দেখেছেন খোঁজ নিয়ে যে ফাহাদ ছেলেটা আসলেই অনেক ভালো।মামা মামির কাছে মানুষ হলেও সুশিক্ষা লাভে কোনো ত্রুটি ছিলো না।
আর অনিলা আজ ফিরবে ফ্ল্যাট এ।আলিফ হোসেন মেয়েকে রেখে আসতে চাইলেন।কিন্তু অনিলা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে সে একাই যেতে পারবে।সে তার বাবা কে হয়রানি করাতে চাই না।এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল পাঁচ টা।ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে অনিলা।
“অনি মা আমি তোমার সঙ্গে যায় না।আজ কাল সব জায়গায় ভয় হয়।দিন দুনিয়া তো এখন আর ঠিক নেই।যা হচ্ছে চারপাশে।বিপদ যেনো আমাদের পিছনে পিছনে যায়।আলিফ হোসেন চিন্তিত হয়ে বললেন।”
অনিলা ব্যাগ গোছাতে গোছাতে উত্তর দিলো,
“না বাবা আমি একা যেতে পারবো।তোমার এই শরীর নিয়ে আর তোমাকে যেতে হবে না।তুমি তো গিয়ে থাকতেও পারবে না।আমাকে রেখে আসবা আবার ফিরবে এখানে।টানা ড্রাইভ করা তোমার শরীরের জন্য ভালো না।এতো ধকল সইতে পারবে না তুমি।তার চেয়ে ভালো তুমি মাকে সামলাও।আর আমি তো এর আগেও একা একা চলাচল করেছি বাবা।কিছু হয় নি তো তাই না।আমি যেতে পারবো চিন্তা করো না!”
পাশ থেকে মনিরা বেগম বললেন,”তোর বাবা তো ঠিকই বলেছে।একা একা এভাবে যাস না।আমার মন টা কেমন কু ডাকছে।কাল গেলে হয় না।দেখলি তো তোর বাবার সঙ্গে কত কিছু হয়ে গেলো।এরপর ভয় হয় সব কিছু তেই!যদি তোর ও কোনো বিপদ হয় রাস্তা ঘাটে!”
অনিলা নিদারুণ কন্ঠে বললো,অফফহো মা কিছুই হবে না।আমি কি এর আগে কখনো একা একা যায় নি ফ্ল্যাটে?এই তো তিন ঘন্টার মধ্যেই চলে যাবো।বেশি রাত হবে না।রাত আট টার মতো বাজবে।ঢাকায় এটা কোনো রাত ই না মা!”
আলিফ হোসেন কিছু টা ক্ষোভের সহিত বলে উঠলেন,”তুই কথা কেন শুনিস না।আমাদের যে চিন্তা হচ্ছে বুঝতে পারছিস না!”
“তুমি বোঝাও না তোমার মেয়েকে।কাল যদি যায় তাহলে তো আর ক্ষতি নেই তাই না।কি এমন হবে ভোর বেলায় গেলে।”
অনিলা মনিরা বেগম কে জড়িয়ে ধরে কপলে একটা চুমু দিয়ে বলে, “তোমাদের দোয়া যতদিন আমার সঙ্গে আছে ততদিন কিছুই হবে না আমার।শুধু দোয়া করো বুঝলে।চিন্তা করো না আমি গিয়েই ফোন করে জানাবো।
মনিরা বেগম নিজের মেয়েকে স্বযত্নে আগলে নিলেন নিজের বাহু বন্ধনে,”তুমি কি ভাবে বুঝবে গো মা।আমরা তোমার বাবা মা।সন্তানের জন্য আমাদের সব সময় চিন্তা হয়।আগে তুমি মা হও বুঝবে কেন এতো চিন্তা করি!”
অনিলা আদুরে কন্ঠে বললো, ” মা আমি যাওয়ার আগে যদি এমন মুখ ভার করে রাখো তোমরা আমার কি ভালো লাগে বলো তো?কাল ভার্সিটি যেতেই হবে মা।সামনে পরীক্ষা। এমনিতেই অনেক টা পিছিয়ে গেছি আল্লাহ জানে কি হবে আমার!আরও যদি পিছিয়ে যায় তাহলে নির্ঘাত তোমার মেয়ে ইয়া বড় বড় লাড্ডু পাবে পরীক্ষায়!”
আলিফ হোসেন আর মনিরা বেগম এতো চিন্তার মাঝেও হেসে দিলেন মেয়ের কথায়।আলিফ হোসেন মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,”ঠিক আছে সাবধানে যাবি।পড়াশোনার ব্যাপারে আমার কোনো কথা নেই।তবে সাবধানে যাবি ঠিক আছে!গিয়ে ফোন করতে ভুলিস না কিন্তু।”
ঠিক আছে বাবা।”অনিলা মা বাবাকে বিদায় জানিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এলো।বেরিয়ে টেক্সি নিলো।রেইল স্টেশনে পৌঁছে টিকিট বুক করে নিলো।ট্রেইন আসলেই ট্রেইনে উঠে পরলো।এরপর নিজের সীটে বসে পরলো। স্ট্রুয়ার্ট মৃদুস্বরে চেচামেচি করছে।টুকুর টুকুর করে বাইরের মনোরম দৃশ্য দেখছে।সে হইতো মনে মনে মুক্তি পেতে চাই এই বন্দি জীবন থেকে।অনিলার মন টা হুহু করে উঠলো কেমন যেনো।স্ট্রুয়ার্ট কে যখন তার বাবা বার্থডে গিফট করেছিলো তখন স্ট্রুয়ার্ট অনেক ছোট্ট। এতো বছর থেকে স্ট্রুয়ার্ট কে সে এতো যত্নের সঙ্গে বড় করেছে।প্রথম কয়েকদিন ভেবেও ওর কোনো নাম ই মাথায় আসছিলো না সে সময়।একদিন সে স্টুয়ার্ট লিটিল মুভি টা দেখছিলো সেদিনের পর থেকে ওর নাম টা স্টুয়ার্ট থেকে স্ট্রুয়ার্ট রাখা হয়।একটু ভিন্নতা আছে নাম টাই।নাম করণের সঙ্গে সঙ্গে ওকে কথা বলাও শিখিয়েছে আস্তে আস্তে।ওর চোখ ভিজে এলো।সে কি ছেড়ে দেবে স্ট্রুয়ার্ট কে।একবার এটাও ভাবলো সে তো আর স্ট্রুয়ার্ট কে কষ্ট দেইনা বরং স্ট্রুয়ার্ট ও তার কাছে খুব ভালো থাকে।তাও স্ট্রুয়ার্ট যদি চাই তাহলে অনিলা তাকে মুক্ত করে দেবে।
হঠাৎ একটা অদ্ভুত আওয়াজে তার সম্বিত ফিরে এলো।সে তাকিয়েই কিছু টা শিউরে উঠে।একটা পাগল হাত নেড়ে কি যেনো চাইছে।অনিলা বুঝলো লোকটা টাকা চাইছে। সে ভয়ে ভয়ে ব্যাগ থেকে একশো টাকার একটা নোট হাতে ধরিয়ে দিলো লোকটার।সে সময় পাগল টা কেমন যেনো লালসা পুর্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো।আর অচাঞ্চল্য স্পর্শ করতে লাগলো।সে পাগল টার এরকম অদ্ভুত চাহনি তে ভয়ে শিটিয়ে গেলো।পাগল টা একটা আধো ছেড়া আলখাল্লা পড়া আছে।পরনে লুঙ্গি।হাতে একটা থালা। চোখ গুলো কেমন ভয়ংকর ভাবে লাল।মুখে কাল চিটে পরেছে।হাতে পায়ে ময়লা পরে কালো হয়ে গেছে।
ট্রেইন চলছে আপন গতিতে তখনই একটা মহিলা আসলেন আর সামনে তাকিয়ে অনিলা কে ভয় পেতে দেখে মোলায়েম গলায় বললো,
“মা তুমি ভয় পাচ্ছো নাকি এই পাগল টাকে।ভয় পেও না আমি আছি তো।ওইটা একটা ভিখারি ভয়ংকর হলেও ক্ষতি করবে না।”
মহিলা টি তাড়িয়ে দিলেন লোকটা কে।পাগল টা সামনে এগিয়ে গেলো ভিক্ষা করতে।অনিলা মেকি হাসার চেষ্টা করলো মহিলার দিকে তাকিয়ে।একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে লোকটা যেতেই।হয়তো ট্রেনে উঠতে একটু লেট হয়েছে।মহিলাটার সাথে একটা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েও আছে।তার সামনের সীট টাই বসলেন মহিলা টি।মহিলা টা আবার মিহি কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি বোধহয় এখনো ভয় পেয়ে আছো তাই না?”
অনিলা মুখে হালকা ভদ্রতাসূচক হাসি এটে বলে, “জ্বী আন্টি।আসলে কেমন ভয়ংকর চেহেরাটা।আমি জানি কাউকেই অবহেলা করা উচিত না তাও কেমন একটা ভয় ভয় করছিলো!আপনি আসায় স্বস্তি পেলাম।”
“আচ্ছা এসব ছাড়ো।ভয় নেই।আরও অনেকে তো আছেই ট্রেনে।”
“হুম আন্টি।”
অনিলা দেখলো মহিলাটির বাচ্চা মেয়েটি স্ট্রুয়ার্ট এর দিকে তাকিয়ে আছে।অনিলা বুঝতে পারলো যে পুচকি টা তার স্ট্রুয়ার্ট কে ধরতে চাইছে।অনিলা কোনো কথা না বলে এগিয়ে দিলো খাচাটি।
বাচ্চাটার সেকি ভুবন ভুলানো হাসি স্ট্রুয়ার্ট কে পেয়ে।সাথে সাথে মহিলা টিও এক গাল হেসে দিলো।সব মায়েরাই এমন,সন্তানদের খুশিতে তাদের খুশি।পুরো টা সময় স্ট্রুয়ার্ট বাচ্চাটির কাছেই ছিলো।স্ট্রুয়ার্ট বরাবরই মানুষ জনদের মাঝে কথা বলে না।সে চুপচাপ ফল খাচ্ছে।
আর কথা হয়নি মহিলাটির সঙ্গে।সামনে স্ট্যান্ড এ মহিলা টি নেমে গেছে।বাচ্চাটি নামার সময় কাদো কাদো চোখে তাকিয়ে ছিলো স্ট্রুয়ার্ট এর দিকে।এটা দেখে অনিলার বেশ দুঃখ হলো।অনিলা আর এক স্ট্যান্ড পরেই নেমে যাবে।আপাতত কোনো পুরুষ মানুষ নেই ক্যাবিন টা তে।সামনের একটা সীট মাঝ বয়সি টাকলা লোক আছে।আর গুটিকয়েক মহিলারা বেশিরভাগ ভাগ গল্পে মেতে আছে।আর প্রায় খালিই কেবিন টা।অর্ধেকের বেশি মানুষ নেমেই গেছে।
ট্রেইন থামলো পরের স্টেশনে। অনিলা নেমে পরলো ট্রেইন থেকে।নেমেই এদিক ওদিক তাকাতেই চমকে উঠে সে। দু কদম পিছিয়ে যায় সে।ট্রেনের সেই পাগল টা।মুহুর্তের মধ্যেই অনিলার রুহ কেপে উঠলো।পাগল টা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।অদ্ভুত লাগলো লোকটার দৃষ্টি।পাগল টা অস্ফুটে বলে উঠলো,
আসো,আসো না, আসো।আমার সাথে আসো।
অনিলা শুকনো ঢুক গিলে নিলো।কি জানি কি বলছে পাগল টা।
তারাতাড়ি আসো না, আসো না,খিদে, খিদে পেয়েছে।পাগল টা হাতে ইশারা করে সামনে ডাকলো।লোকটার কন্ঠ টা কেমন যেনো রুক্ষভাষী ছিলো।
অনিলা লোকটার খিদে পেয়েছে জেনে ভেতর থেকে একটু মায়া লাগলো।তাই সে দোকানের দিকে গেলো।যদিও হাত পা কাপছে তার ভয়ে।তাও সে তো ওতো টা অমানবিক না।একজন ক্ষুদার্থ ব্যাক্তিকে খাবার কিনে দেবে না।তাই সে একটা দোকান থেকে খাবার কিনে লোকটার দিকে বারিয়ে দিলো।তখনকার মতোই লোকটা বাজে ভাবে স্পর্শ করে অনিলার হাত।অনিলা ছাড়িয়ে নিলো হাতটা চট করে।
জলদি করে সিএনজি স্ট্যান্ডের দিকে হাটা ধরলো সে।এর আগে সে যত বার বাড়ি থেকে এসেছে ততবারই ট্রেইনেই এসেছে।তার তো তখন ভয় করেনি।কিন্তু আজ কেমন যেনো গা ছমছম করছে।কিছুটা এগোতেই তার মনে হলো কেউ তার পিছু পিছু আসছে।এখন এদিক টাই অন্ধকার ও হয়ে এসেছে।সারে সাত টা বাজে ঘড়িতে।সে পা চালিয়ে এগোতে লাগলো।সামনেই সিএনজি স্ট্যান্ড।গিয়ে দেখলো সিএনজি স্ট্যান্ডে বেশি সিএনজি নেই।ইশ তার আসতেই লেট হয়ে গেছে।কয়েক জন কে বললো যাবে কি না কিন্তু কেউ যেতে চাইলো না।তাই ক্যাব বুক করলো।একটু সময় লাগবে আসতে।সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।
ওর মনে হলো ওর পেছনে কেউ আছে।সে চট করে তাকিয়েই ভীষণ ভাবে আঁতকে উঠে।কম্পিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি আবার এখানে কি চাই?”
লোকটা এগিয়ে আসতে লাগলো কিছুই না বলে।সেই পাগল লোকটা কেন তার পিছনে পিছনে আসছে বার বার।কি চাই লোকটা।সে ভীত স্বরে বলে,
“আপনি আমার পিছনে পিছনে আসছেন কেন?সমস্যা কি আপনার, তখন তো খাবার কিনে দিলাম আবার কেন এসেছেন? ”
অন্ধকারে লোকটার চোখ কেমন আরও ভয়ংকর লাগছিলো। অনিলা ভয়ে এবার কেদেই দিলো।ভয়ে তার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না।শুকনো ঢোক গিলে নিলো সে।
লোকটা এগিয়ে আসতে আসতে লমুলুব্ধ
গলায় বললো,
আসো না একটু আমার কাছে আসো।এই এই আসো।এই অনেক খিদে অনেক!”
অনিলা পিছন দিকে পিছিয়ে যায়।ভয় পেয়ে সে দৌড় দিলো।পাগল লোকটাও খুড়িয়ে খুড়িয়ে ওর পিছনে পিছনে আসতে লাগলো। সরু রাস্তা টা যেনো জনমানবহীন।অনিলাকে যেনো এতো নিস্তব্ধতা আরও বিদীর্ণ করে দিলো।হঠাৎ কিছু একটার সাথে পা বেজে হোচট খেয়ে পরে গেলো মুখ থুবড়ে।হাত থেকে ব্যাগ,স্ট্রুয়ার্ট খাচা টা ছিটকে দূরে পরে গেলো।
পায়ে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলো সে।অনর্গল রক্ত পরতে লাগলো।কোনো রকমে চেচালো সে কিন্তু তার মনে হলো না কেউ আছে এই রেইল স্টেশন এর পাশের সরু রাস্তায়।অনিলা নিজের ব্যাগ টা হাতড়ে ফোন টা বের করে ফার্স্ট ডায়াল কৃত নাম্বারে ফোন করলো।এদিকে সেই বাজে পাগল লোকটা এগিয়ে আসতে লাগলো অনিলার দিকে।কেমন যেনো সেই দৃষ্টিকে ভয়ংকর লাগলো।হিংস্র বাঘের ন্যায় লোকটা অনিলার দিকে তাকিয়ে রইলো।অনিলা পিছিয়ে যেতে যেতেই পরে গেলো একটা ক্ষাদে।ভয়ে হাত থেকে ফোন টা পরে গেলো।লোকটা অনিলার পা ধরে টেনে তুললো।ভয়ংকর ভাবে ঝাপিয়ে পরলো।স্পর্শ করতে লাগলো স্পর্শ কাতর স্থানে। অনিলা প্রান পনে চেষ্টা করছে নিজের সম্মান বাচানোর।কিন্তু সে আহত এই হিংস্র পাগলের সঙ্গে পেরে উঠলো না।মনে হচ্ছে কতদিনের অভুক্ত থাকার পর ভয়ংকর হয়ে উঠেছে লোকটা।
স্ট্রুয়ার্ট বিভৎস ভাবে চেচাতে লাগলো।ডানা ঝাপটা দিতে লাগলো সমানে।খাচার মুখ টা খুলে গেছে তখন ওতো জোরে ছিটকে পরায়।স্ট্রুয়ার্ট খাচা থেকে বেরিয়ে এলো ছুটলো তার মনিবের প্রান রক্ষার চেষ্টায়।সেও যেনো বুঝতে পারলো তার মনিবের ভয়নাশক বিপদ হতে যাচ্ছে।কিন্তু সে কি আদোও পারবে কিছু করতে।পরক্ষনেই ভেসে এলো এক তরুনীর আর্তচিৎকার।
#চলবে
আসসালামু আলাইকুম। নামাজ কায়েম করুন।
#সম্মোহনী_সেই_মেয়েটি
#পর্বঃ১৮
#লেখিকাঃরাদিয়াহ_রাফা_রুহি
“আমি অনিলাকে বিয়ে করতে চাই আংকেল!”
জুনইদের কথাটা যেনো বাজ পড়ে বিস্ফোরণ ঘটে যাওয়ার মতো লাগলো আলিফ হোসেনের কাছে।তিনি করুনঘন দৃষ্টিতে তাকালেন জুনইদের দিকে।তার মেয়ের সঙ্গে এতো কিছু হয়ে গিয়েছে সব টা জেনেও কেন বিয়ে করতে চাইছে এই ছেলেটা।তার মেয়েকে কি দয়া করতে চাইছে নাকি।যত যাই হোক সেদিন যেটা হয়েছে সেজন্য তো আর তার মেয়ে দায়ী নয়।তাই তিনি কিছুতেই কারোর কাছেই নিজের মেয়েকে দয়ার পাত্রী হিসেবে গন্য করবেন না।একজন যোগ্য মানুষের হাতেই তিনি তার মেয়েকে তুলে দিতে চান।যে তার মেয়েকে এভাবেই ভালোবাসবে।তিনি তার সামনে থাকা যুবকের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,
“তুমি আমার মেয়েকে কেন বিয়ে করতে চাইছো সব টা জেনেও?যেখানে অন্যান্য ছেলেরা আমার মেয়ের সাথে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার কথা শুনেই পিছু হটে যায়।তাছাড়া আমার মেয়েটা এখনো মানসিক ভাবে সুস্থ না।দয়া করতে চাইছো তুমি আমার মেয়েকে?”
জুনইদ মাথা নত করে অবসন্ন কন্ঠে বলে,”আংকেল আমি অনিলাকে ভালোবাসি।এটা বলতে আমার কোনো রকম দ্বিধা নেই।আর ওর অবস্থা যেমনই হোক না কেন আমার জন্য ও সব সময়ই একই থাকবে।আজকে ওর জায়গায় যদি আমার বোন থাকতো তাহলে?ওর সব রকম পরিস্থিতিতে আমি সব সময় পাশে থাকতে চাই আংকেল।এর থেকে আমাকে বঞ্চিত করবেন না প্লিজ!”
আলিফ হোসেন কিছুটা অবাক হলেন জুনইদের কথায়।ভেতরে ভেতরে অবসন্নও হলেন বটে।জুনইদ ছেলেটার চোখে মুখে কোনো রকম ছলনা নেই।যা আছে তা শুধুই মায়া তার মেয়ের জন্য ভালোবাসা।তিনি এরমম ই একজন কে নিজের মেয়ের জন্য খুজছিলেন।যে তার মেয়ের সত্যি টা জেনেও তার প্রতি অবহেলা করবে না।জুনইদ ছেলেটাকে তার কাছে ভীষণ বিচক্ষণ আর স্পষ্টভাষী মনে হলো।তাছাড়া এই ছেলেটা তার জীবনও বাচিয়েছে।সেই থেকে ছেলেটাকে ভালো লাগে তার কাছে।কিন্তু তাও সব টা ক্লিয়ার হয়ে যাওয়াই ভালো।তার মেয়ে যে বাড়িতে বউ হয়ে যাবে তাদেরও তো একটা মতামত এর ব্যপার আছে তাই না।
“তোমার বাবা মাকে ডেকে পাঠাও।উনারা যদি মেনে নেন তবে আমিও আপত্তি করবো না!”
জুনইদ দৃঢ়চিত্তে দৃষ্টি স্থীর করলো আলিফ হোসেনের মুখ পানে।পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন মনিরা বেগম।তিনি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জুনইদের দিকে।জুনইদ গলায় দৃঢ়তা টেনে বলে,
“আমার ফ্যামিলিকে আমি বুঝিয়ে বলবো।আমি জানি আমার এই সিদ্ধান্ত কে আমার ফ্যামিলির সবাই মেনে নেবে।আমি এই মুহুর্তে বাড়িতে কিছুই বলতে চাচ্ছি না কারণ আমি এখন কিছু বললে ওরা হিতে বিপরীত বুঝবে।আমি অনিলাকে নিয়ে গেলে তারা আর অস্বীকার করবে না এটা আমার বিশ্বাস।তাই আজই আমি অনিলা কে নিয়েই ফিরবো।অনিলাকে ছাড়া আমি এখান থেকে এক পা ও নড়বো না আংকেল।আমি আমার জীবনের সবচেয়ে অমুল্য জিনিস কে হারাতে পারবো না কোনো ভাবেই না!”
আলিফ হোসেন এবারে কিছুটা আক্ষেপের সহিত বলেন,”আমি নিশ্চিত না হয়ে তো আর তোমার হাতে আমার মেয়েকে তুলে দিতে পারি না বলো।বিয়ের পর যদি কোনো ভাবে তোমার পরিবারের কেউ মেনে না নেই তার দায় কে নেবে?অনেকেই বলবে আমরা আমাদের মেয়েকে তোমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছি।আমাদের মেয়েকে তো আর আমরা ফেলে দিই নি।ও যেমন আগে আমাদের কাছে ছিলো ঠিক তেমনই সারা জীবন আমাদের কাছেই রাখবো।তাও কারোর কাছে বোঝা হিসেবে থাকুক আমার মেয়ে সেটা আমি চাইবো না।”
জুনইদ এবার তেছড়া এক রোখা ভাবে বলে,
“আচ্ছা আংকেল আজ যদি আন্টির কিছু হয়ে যায় তাহলে কি আপনি আন্টিকে ছেড়ে দেবেন?”
এহেন প্রশ্নে আলিফ হোসেন বেশ বিচলিত হলেন।তিনি বুঝলেন সামনের যুবকটি কোনো ভাবেই তার সিদ্ধান্ত থেকে পিছপা হবে না।বড্ড এক গুয়ে আর জেদি ছেলেটা।ওর কথার ধাচ এমন যে ওর সঙ্গে কথায় পেরে উঠলেন না আলিফ হোসেন। তিনি অনুদ্ধত কন্ঠে বললেন,
“আমার মেয়ে যে মানসিক ভাবেও সুস্থ নয়।মেন্টালি,ফিজিক্যালি সিক,সব টা জেনেও তুমি বিয়েটা করবেই তাই তো।তাহলে আমার মেয়ের ভালো থকার নিশ্চয়তা দিতে পারবে তুমি?তাকে কখনোই কষ্ট পেতে হবে না তোমার কাছে এটার কি গ্যারান্টি আছে?এসব কথা তুমি আবেগের বসে বলছো পরে আবার আফসোস করবে না তো?”
জুনইদ এবার নৈশব্দে হাসলো।সে তো হাল ছাড়ার পাত্র নয়।ওঁকে যে আলিফ হোসেন নানান ভাবে প্রশ্ন করে পরীক্ষা করতে চাইছে সে ঠিকই বুঝতে পেরেছে।তাই এবারো সে খুবই বিচক্ষণতার সঙ্গে উত্তর দিলো,
“আপনার কথায় নেতিবাচক দিক আছে কারণ আপনি অনিলার বাবা আপনি আপনার মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভাববেন এটাই স্বাভাবিক।কিন্তু আমরা আমাদের আবেগ,অনুভূতি তথা আক্ষেপ,আফসোস,হতাশা,দুঃখ,বেদনা,আনন্দ,বিশেষ অনুভূতির গুলো প্রকাশ করতে প্রায়ই অক্ষম।তাই আমরা আমাদের এসব তিক্ত কিছু অনুভূতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারি না সহজেই।কিন্তু যারা প্রকাশ করতে পারে তারাই কিন্তু সবচেয়ে বেশি সুখী।আবেগ,অনুভূতি,আক্ষেপ,আফসোস,হতাশা,দুঃখ,বেদনা,আনন্দ,এসব কিছুকে নিয়েই কিন্তু আমাদের সকলের জীবন।আমি অনিলাকে এসব কিছু নিয়েই মেনে নিয়ে বেচে থাকবো সারাটা জীবন।আমি আপনার কাছে অনিলাকে ভিক্ষে চাইছি আংকেল ওঁকে ছাড়া আমার এক মুহুর্ত ও চলবে না প্লিজ আংকেল!”
মনিরা বেগম এতক্ষণ নিরব দর্শকের ন্যায় সব কথোপকথন শুনছিলেন।জুনইদ যে নাছোড়বান্দা তা তিনিও বুঝলেন।এরকম ছেলে তো কখনোই পাবেন না তার মেয়ের জন্য।তিনি বললেন,
“ছেলেটা যখন এতবার করে বলছে ওঁকে এভাবে ফিরিয়ে দেওয়া টা কি ঠিক হবে।আপনি বিয়ের ব্যবস্থা করুন!”
স্ত্রীর কথা শুনে আলিফ হোসেন আর কিছু বললেন না।জুনইদকে তিনি এই এক মাসের মধ্যে খুব ভালো করেই বুঝেছেন।আর আজ এই ছেলেটা যখন বলেছে তখন অনিলাকে নিয়েই যাবে।তিনি এরকম ছেলে এর আগে কক্ষনো দেখেন নি।এরকম জেদি আর স্পষ্টভাষী ছেলে খুবই কম দেখেছেন তিনি।ওর কথায় যে কতটা জোর আছে তা তিনি টের পেয়েছেন।এরপর উনার আর অস্বীকার করার কোনো অর্থ নেই।তিনি নিরবে ড্রইংরুমে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পরলেন।ফোন করে কাজীকে ডাকলেন।
জুনইদের মুখে বিশ্বজয়ের হাসি।তৃপ্তিতে ওর চোখ বন্ধ হয়ে এলো।চোখের তৃষ্ণায় ধুঁকছে সে একটি বার প্রেয়সীকে চোখের দেখা দেখবে বলে।আর কিছুক্ষনের অপেক্ষা মাত্র।গত এক মাসে জুনইদ কম চেষ্টা করে নি একটি বার অনিলাকে দেখার জন্য। লাষ্ট হসপিটালের সাদা ধবধবে বিছানায় তার নিথর শরীর টা পরে থাকতে দেখেছিলো।মুখে অক্সিজেন মাস্ক থাকাই পুরো মুখ টাও স্পষ্ট ভাবে দেখতে পারেনি।রোজ এই বাড়ির সামনে এসে থেকেছে কিন্তু বাড়িতে ঢুকতে দেইনি কোনো ভাবেই।আজ এক প্রকার যুদ্ধ করেই বাড়িতে ঢুকেছে।এসেই মুখোমুখি হতে হয়েছে আলিফ হোসেনের।এতো দিনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়নি তার।তার মনের মধ্যে কি চলছে এক মাত্র সেই ই জানে।সম্মোহনী সেই মেয়েটিকে দেখার সাধ,তৃষ্ণা যে কোনো দিন ই যাবেনা।উম্মাদের মতো সারা বাড়িতে তার দৃষ্টি শুধু মাত্র একজনকেই খুজে যাচ্ছে।
•
প্রায় এক ঘন্টা অতিবাহিত হলে জুনইদ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অনিলাকে নিয়ে আসা হলো।এর মধ্যে কাজীও চলে এসেছে। আইন মোতাবেক ও বিয়ে টা সারা হবে।
অনিলা কে আনতেই জুনইদ তাকালো তার দিকে।অনিলাকে দেখতেই বুকের বা পাশ টা শুন্য হয়ে গেলো তার।সেই সম্মোহনী মেয়েটির একি অবস্থা হয়েছে আজ।লম্বা চুলের দুটি বিনুনি দুই পাশে ঝুলছে।পরনে টপস স্কার্ট।গলায় আটসাট করে একটা উড়না জড়ানো।ক্ষনে ক্ষনে হাতের নখ গুলো মুখে নিয়ে দাতে কাটছে।এই কি সেই অনিলা যাকে সে ফার্স্ট ডে দেখেছিলো।এরকম চঞ্চল মেয়েকে এরকম বিদ্ধস্ত অবস্থায় দেখবে সে তো কল্পনার বাইরে ছিলো।কি রকম বাচ্চাদের মতো করছে মেয়েটা। দেখেই মনে হচ্ছে ভয়াক্রান্ত মুখ।বহুক্ষণ শক্ত, কঠিন থাকার এক পর্যায়ে দেহের অন্তঃস্থল হতেই নরম হয়ে এসেছে বহির্ভাগ তার প্রেয়সীর মুখ দেখেই।সেই অশুভ দিনের সেই অসময়ের আগমনী তিক্তক কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে আজ এই হাল মেয়েটির।জুনইদ তার ভালোবাসার মানুষ টাকে এমন অবস্থায় দেখে চোখ দিয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরলো তার অজান্তেই।
মনিরা বেগম অনিলা দুই বাহু বন্ধনে সুন্দর করে ধরে এগিয়ে আনছেন।অনিলা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে এগিয়ে আসছে ছোট ছোট পা ফেলে।অনিলা কে এনে বসিয়ে দিলেন মনিরা বেগম।তিনিও পাশেই বসলেন।জুনইদ ধপ করে বসে পরলো সোফায়।অতঃপর বিয়ে পরানো শুরু করলেন।
জুনইদ কবুল বলে দেওয়ার পর অনিলার পালা।কিন্তু অনিলা তো তেমন কথাই বলে না।
কাজী সাহেব বার বার কবুল বলতে বললেন কিন্তু অনিলা নিজের মতো নখ কাটতে ব্যস্ত।তার তো কোনো দিকেই খেয়াল নেই।একমাত্র মায়ের কথা শুনে সে শুধু।মনিরা বেগম জুনইদ সহ বাকিদের কে আস্বস্ত করলেন চোখের ইশারায়।আর বললেন,
“মা অনি কবুল বলো মা! এই যে আংকেল দেখছো ইনি খুবই ভালো মানুষ।একদম তোমার বাবার মতো! আংকেল এর কথা শুনতে হয় তুমি তো আমার লক্ষী মেয়ে তাই না”
অনিলা মায়ের দিকে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকালো।তার মা কি বলছে!তারপর তার মায়ের কথার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে শুধালো,
“কবুল কি আম্মু?বললে কি হয়?”
জুনইদ অবাক পানে তাকিয়ে রইলো অনিলার দিকে।যদি অনিলা কবুল না বলে তবে কি সে সারাজীবনের মতো হারিয়ে ফেলবে মেয়েটাকে।ভয় হচ্ছে তার খুব ভয় হচ্ছে,প্রানেশ্বরীকে হারানোর ভয়।বিয়ে ছাড়া যে তাকে সে রাখতে পারবে না নিজের কাছে।তাতে সমাজের চোখে অনিলার সম্মানহানী হবে।আলিফ হোসেন এক বার জুনইদ আর আরেকবার নিজের মেয়ের দিকে তাকালেন।কাজী সাহেব অধৈর্য্য হলেন।তিনি তাড়া দিলেন।
মনিরা বেগম অনিলার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
“কবুল হলো একটা পবিত্র শব্দ।এই একটি শব্দের মাধ্যমে সারাজীবনের মতো দুটো মানুষের মনের মিল হয়।একটা পবিত্র বন্ধন তৈরি হয় এই একটি শব্দের মাধ্যমে।এই যে ছেলেটাকে দেখছো ও হবে তোমার স্বামী।তুমি কবুল বললেই তোমাদের বিয়ে হবে বুঝেছো!তাই কবুল বলো মা!”
অনিলা মায়ের কথায় জুনইদের দিকে মায়া ভরা দৃষ্টি স্থাপন করে।নিজের কোমল নিষ্প্রাণ ঠোঁট গুলো উলটে কিছু ভেবে ভ্রু কুচকে বলে,
“ওঁকে,ওঁকে তো আমি চিনি!কিন্তু কোথায় দেখেছি মনে পরছে না জানো?কেন মনে পরছে না আম্মু।আম্মু ও কি ভালো লোক নাকি পঁচা লোক!”
মনিরা বেগম বললেন,”ও খুব ভালো লোক।এবার কবুল বলো মা।আংকেল টা চলে যাবেন তো!”
অনিলা মোলায়েম হেসে হাত তালি দিতে দিতে কবুল বললো।তারপর সাইন করলো জুনইদ আর অনিলাও সাইন করলো।সে তো সারাদিন ই খাতায় কি যেনো আঁকিবুকি করতেই থাকে।তার নাম লিখতে বললে সে এখানে কোনো বাধ সাধে নি।লিখতে তো তার ভালোই লাগে।
বিয়ে শেষ হতেই উপস্থিত সবাই আলহামদুলিল্লাহ বললেন।আলিফ হোসেন নিশ্চিন্ত হলেন মেয়েকে যোগ্য মানুষের হাতে তুলে দিতে পেরে।
জুনইদের মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটলো।এটা ভেবে যে অনিলার তাকে একটু হলেও মনে আছে।এবার আর কেউ তাদের কে আলাদা করতে পারবে না।যেভাবেই হোক সে তার অনিলাকে, না না তার মিসেস সুনামি কে আগের মতো সুস্থ করেই তুলবে।যেকোনো ভাবে সেই চাঞ্চল্যতাকে হারাতে দেবে না এভাবে।সেই আগের অনিলাকে এক অসহায় মা বাবাকে ফিরিয়ে দেবে।
অনিলাকে ওর ঘরে নিয়ে গেলে জুনইদ ও পিছু পিছু গেলো।সে শুধু ভালো করে তার পাগলি বউ টাকে দেখবে বলে।
#চলবে
আসসালামু আলাইকুম।নামাজ কায়েম করুন।