সম্মোহনী_সেই_মেয়েটি #পর্বঃ৫,৬

#সম্মোহনী_সেই_মেয়েটি
#পর্বঃ৫,৬
#লেখিকাঃ রাদিয়াহ রাফা রুহি
পর্বঃ৫

তখন দ্বিপ্রহর।রোদের উত্তাপ মোলায়েম। সোনালী,কমলাটে রোদ্দুরের ছটা গড়িয়ে পড়েছে ছোট রাস্তার উপর।সায়াহ্নের শেষপ্রান্তে এক চড়ুই পাখির দল কিচিরমিচির করে উড়ে চলে গেলো নিজের গন্তব্যের দিকে।অনিলা বাজারে গিয়েছিল স্ট্রুয়ার্ট এর জন্য কিছু ফলমুল কিনতে।কোনো অটো বা রিকশা না পাওয়াই তাকে হেটে হেটেই বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।বেশ ক্লান্ত সে আজ।ভার্সিটিতে ক্লাস শেষ করেই বাজারে গিয়েছিল সে।আর ঘরেও কিচ্ছু নেই।চাল নেই ডাল নেই।আসলে সে তেমন রান্না ও জানে না।আলুভাজি,ডিম,ম্যাগি আর ভাত ফুটাতে পারে।এই টুকুই।আর মাঝে মাঝে মালাই চা বানিয়ে ফেলে শুধু চা টাকে একটু স্পেশাল করার জন্য। চা,কফি এসব ই করতে পারে আপাতত।তাই তেমন বাজার করার প্রয়োজন পরে না।কিন্তু আজকে মাংস কিনেছে।রোজ রোজ এক খাবার খেতে খেতে পিত্তি পরেছে মুখে।ইউটিউব ঘেটে নিজের হাতে বিরিয়ানি রান্না করবে সে।অনলাইন ফুড এর প্রতিও অনীহা সৃষ্টি হয়েছে আজকাল।

ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে এদিক সেদিক তাকালো অনিলা।আজকে যেনো রিকশা আর অটোরিকশা অন্যেষন নিয়েছে আসবে না বলে।ক্লান্তিতে কপালে আর ঠোঁটের উপর নিচে ঘামের বিন্দু জ্বলজ্বল করছে ওর।
বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়েই পরলো এবার।শরীর টাও কেমন যেনো ম্যাজ ম্যাজ করছে।এদিকে সন্ধ্যা নেমে আসছে প্রায়।

হঠাৎ করেই একটা বাইক দমকা হাওয়ার সাথে অনেকটা গতিতে এসে থামলো অনিলার সামনে।কিছুটা ভড়কে গিয়ে দূরে ছিটকে গেলো সে।হাত থেকে বাজারের ব্যাগটাও পরে যায়।আকষ্মিক কান্ডে হকচকিয়ে যায় অনিলা।ক্ষোভে কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই আবার সেই বাইক ওয়ালা সামনে এসে হ্যালমেট খুলতেই অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে গেলো অনিলা।এই ব্যাক্তিটি বিগত কয়েকদিনে তাকে আসতে যেতে বেফাঁস বিরক্ত করেছে সমানে।একাধারে, নানা রকম ভাবে বিভ্রান্তিকর অবস্থায় ফেলেছে।সেদিন ভার্সিটিতে ঘটে যাওয়া ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জুনইদ ইচ্ছে করেই ওঁর মুখে কাদা মাখিয়ে দিয়েছিলো।অপমানে লজ্জায় সে দুদিন ভার্সিটিতে যায় নি।সব মেনে নিয়েছিলো সে।এরপর আর জুনইদ ওর সামনে আসেনি।এসবের জন্য নিশা অবশ্য অনেক বার ওর ভাইয়ের হয়ে ক্ষমা চেয়েছে বার বার।সে ভুলেও গেছিলো ব্যাপার টা।কিন্তু আজ যেনো এই ব্যাপার টা অতিরিক্ত মাত্রায় সহ্যসীমা অতিক্রম করে ফেলেছে এই লোকটা।তাই সে ফুসে উঠলো,

মিস্টার ল্যাম্পপোস্ট আপনি?কোনো আক্কেল নাই আপনার তাই না।এভাবে কেউ বাইক চালাই নাকি।অসভ্য মাতালের মতো বাইক চালাচ্ছেন।লজ্জা করে না হ্যাঁহ।

বার কয়েক পলক ফেললো জুনইদ।সম্পূর্ণ কথার অর্থ বুঝতে পেরে অভিব্যক্তি মলিন হয়।নিষ্প্রভ চাহনিতে তাকায় সে অনিলার দিকে।ভাব এমন যেনো কিছুই জানে না।সে কিছু বলবে তার আগেই অনিলা আবার ফুসে উঠলো,

এই কদিন এতো জ্বালিয়েও শান্তি হয়নি আপনার।আজকে একেবারেই বাইক চাপা দিয়ে মেরেই ফেলতে চাইছিলেন।একটা থাপ্পড় এর জন্য খুন করাটাই ঠিক মনে হলো আপনার তাই না।কি চান টা কি হ্যাঁ।

জুনইদ যেনো বিস্মিত হতবাক হয়ে গেলো। এসব কি বলছে অনিলা।সে তো কেবল অনিলাকে হেল্প কর‍তে চাইছিলো।হঠাৎ করেই বাইকের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গেছিলো তাই এভাবে ব্রেক কষতে হলো।দূর থেকে দেখেই সে বুঝতে পেরেছিলো এটা অনিলা।সন্ধ্যা হয়ে গেছে ভেবেই সাহায্য করতেই আসছিলো হঠাৎ করেই কি যে হলো বাইক টার।জুনইদ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,

আমি কোনো মার্ডারার নয় যে তোমাকে খুন করবো।না জেনে কাউকে একিউজ করা টা ঠিক নয়।আমি তো তোমাকে,,,

অনিলা জুনইদ কে থামিয়ে দিলো হাত উচিয়ে।তারপর ক্রধান্বিত কন্ঠে বললো,

আপনাকে আমার খুব ভালো করেই চেনা হয়ে গেছে।সেদিন কিভাবে আমার মুখে সবার সামনে কাদা মাখিয়ে দিয়েছিলেন সেটা আমি ভুলে যায় নি।ভার্সিটির সবাই হেসেছিলো আমাকে নিয়ে কত্তো।ঠিক কত্তো টা কষ্ট হয়েছিল জানেন আপনি।আমার মানসিক অবস্থা কেমন হয়েছিল জানা আছে আপনার। তাছাড়া এরপর তো সব কিছু মিটেই গেছিলো নাকি।সোধ বোধ হয়েই গেছিলো সব।আর তো কোনো ক্রোধ থাকার কথা না আপনার আমার উপর।

হ্যাঁ এতদিন পারিপার্শ্বিক ভাবে এটা সেটা করে জুনইদ অনিলাকে অতিরিক্ত মাত্রায় জ্বালিয়েছে।কিন্তু তারপর কাদা মাখিয়ে দেওয়ার পর সেই বিষয় টাই অনেক অনুতপ্ত হয়েছিল সে।অনেক বার অনিলার সামনে যেতে চেয়েছিলো ক্ষমা চাইতে।কিন্তু কোথাও গিয়ে সে আটকে যেতো।সামনেও যায় নি অনিলার।মেয়েটার তার প্রতি এমন নৃশংসতা সহ্য করতে না পেরে অবশেষে বলে,

আমি তোমাকেই হেল্প করতে আসছিলাম।এই রাস্তাটা আপাতত একদম ফাঁকা।কোনো রিকশা বা অটোরিকশা নেই। তুমি একা একটা মেয়ে এভাবে হেঁটে আসছিলে তাই ভাবলাম তোমাকে সাহায্য করি।কিন্তু তুমি তো,

অনেক সাহায্য করেছেন আপনি আমার।আপনি আমার সম্মুখে না এলে খুশি হতাম।এরপর আমি আর আপনার এই মুখ টা দেখতেও চাই না।

জুনইদ মলিন মুখ তাকালো অনিলার দিকে।দুজনের চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিলো জুনইদ।

মিস সুনামি আমার কথাটা শুনো একবার।তুমি ভুল বুঝছো আমাকে।আমি ইচ্ছে করে–

জুনইদের কথায় পাত্তা না দিয়ে অনিলা রাস্তায় পরে থাকা বাজারের ব্যাগ টা হাতে তুলে নিলো।নিচু হতেই ভ্রু কুঞ্চিত হলো আপনা আপনি।কিছু একটা বিদঘুটে গন্ধ এলো।পেট্রোলের গন্ধ মনে হচ্ছে এটা।এদিক সেদিক তাকালো অনিলা।দেখলো জুনইদের বাইক থেকে পেট্রোল গড়িয়ে পরছে।আর নিচেই দগদগ করে জ্বলছে কিছু একটা।আবার শব্দ ও আসছে টিকটিক টাইপের।সেটা তে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করলো না সে।একবার বাইক আরেকবার জুনইদের দিকে তাকিয়ে গটগট করে হাঁটা ধরলো।

জুনইদ ওর যাওয়ার পানে অপলক নয়নে তাকিয়ে রইলো।বেশকিছু দূর যেতেই জোরে ব্রাস্ট হওয়ার একটা শব্দ কানে এলো।আকষ্মিক এমন শব্দে পিছনে ফিরলো অনিলা।দেখলো পিছনের দিকে জুনইদের বাইকে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে।

জুনইদ ও বাইক রেখে অনিলার পিছনে পিছনে আসছিলো।যাতে ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওঁকে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারে।আর এরকম শব্দ পেয়ে সেও তাকালো পেছনে।এমন ঘটনাই সেও কেঁপে উঠলো।এক ঝটকায় ছিটকে দূরে চলে এলো সে।ভাগ্যিস দূরে ছিলো না হলে আজ কি হতো।এই আগুনেই শেষ হয়ে যেতো সে।কি ভয়াবহ অবস্থা এই মুহুর্তে হতো তার।হইতো লাশ টাও খুজে পেতো না তার পরিবার।

এদিকে অনিলা আগুন জ্বলছে দেখে ভয়ংকর ভাবে কাঁপতে শুরু করলো।ঠোঁট, হাত পা কাঁপছে তার তিকতিক করে।শরীর অসাড়তায় মুড়িয়ে যাচ্ছে।ভয়াবহ ধোয়া উঠা আগুন দেখেই কাঁপতে কাঁপতে লুটিয়ে পরলো সেখানেই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ কিছু লোক জড়ো হলো সেখানে।পরিবেশ থমথমে কোলাহলযুক্ত সৃষ্টি হলো।কিছু লোকজন এগিয়ে এলো জুনইদের দিকে।এই সময় এই রাস্তায় লোকজন কম ই থাকে।কিন্তু শব্দ পেয়ে বেশ কয়েকজন দাঁড়িয়ে পরেছে সেখানে।

জুনইদ বেশ কিছুক্ষন পর নিজেকে ধাতস্থ হলো লোকজনেদ সরগোল পেয়ে।হঠাৎ বাইক ব্রাস্ট হওয়ার কারণ কিছুতেই বুঝতে পারছে না।তার ও শরীর কাঁপছে।বক্ষস্পন্দন দ্রুত গতিতে উঠানামা করছে।এরকম কিছু হবে আন্দাজের ও বাইরে ছিলো সে।

আরে আরে কি হলো হঠাৎ।এই বাইক টাই আগুন লাগলো কিভাবে।তুমি ঠিক আছো তো বাবা।

একজন মাঝ বয়সি লোক জিজ্ঞেস করলো। জুনইদের দিকে তাকিয়ে।

জুনইদ উপর দিকে তাকিয়ে দেখলো মানুষ জন দেরকে।তারপর শরীর ঝাড়তে ঝাড়তে বলে,

হ্যাঁ আংকেল ঠিক আছি।আপনারা যান আমি সামলে নিচ্ছি বাকিটা।কারোর কোনো ক্ষতি হয়নি দেখেই চলে গেলো তারাও।

হঠাৎ অনিলার কথা মাথায় আসতেই হড়বড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো জুনইদ।একটু দুরেই অনিলা জ্ঞানহীন অবস্থায় দুর্বল চিত্তে পরে আছে।জুনইদ দৌড়ে এলো অনিলার কাছে।এসেই হাটু মুড়ে কাঁপা কাঁপা হাতে ওর গালে থাবড় দিলে।অশান্ত,অস্থির হয়ে উঠলো তার মন।অনিলার হাতে ব্যাগের ভেতর দেখতে পেলো একটা ওয়াটার বোটল।জুনইদ তারাতাড়ি করে সেটা নিয়ে অনিলার মুখ পানে পানি ছিটিয়ে দিলো।জ্ঞান ফিরছে না দেখে অস্থির হয়ে হাত ঘষতে লাগলো অনিলার।পায়ের কাছে গিয়ে পা ঘষতে লাগলো।আবার হাত ঘষতে ঘষতে সে আড়ষ্টভাবে মোলায়েম গলায় বলে,

ওয়্যাক-আপ ইয়্যার।উঠো মিস সুনামি।মুখে আলতো করে আবারও থাবড় দিলো সে।

জুনইদ আবার অনিলার মুখে পানি ছেটালো।কিছুক্ষণ পর অনিলা চোখ মেললো।অনিলাকে চোখ খুলতে দেখে জুনইদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।অস্থির চিত্তে জিজ্ঞেস করলো,

আর ইউ ওকে মিস সুনামি।

অনিলা মাথায় হাত দিয়ে উঠে বসলো।ঝিম ঝিম করছে মাথা টা।এরকম অগ্নুৎপাতের কথা মনে পরতেই ভয়ে অকপটে ঝাপটে ধরলো জুনইদ কে।বিড়াল ছানার মতো গুটিয়ে ফেললো নিজেকে জুনইদের বুকে।

জুনইদ কিছু টা বিব্রতবোধ করলো অনিলা এভাবে জড়িয়ে ধরায়।কিন্তু ওঁকে জড়িয়ে ধরেই অনিলা থরথর করে কাঁপছে দেখে কিছু বললো না।যাকে বলে ব্যাপকভাবে কাঁপছে মেয়েটা।জুনইদ বুঝতে পারছে অনিলা ভয় পেয়ে গেছে অনেক।এতোটাই ভয় পেয়েছে যে হিতাহিতজ্ঞান শুন্য হয়ে তাকে এভাবে জাপটে ধরেছে।কিছুক্ষন আগে যাকে নিজের খুনি ভাবছিলো তাকেই কিনা আঁকড়ে ধরেছে ভয় থেকে বাঁচতে।এভাবেই নিভৃতে কেটে গেলো কয়েক মুহুর্ত।কিছুক্ষণ পর একটু কাঁপুনি থামলো অনিলার।জুনইদ অনিলাকে শান্ত করার জন্য বলে,

অলরাইট।কিচ্ছু হয়নি মিস সুনামি।সব ঠিক আছে।এতো ভয় পাচ্ছো কেন।মিস সুনামির তো ভয় পাওয়ার কথা নয়।ভয়ে একেবারে নিজের শত্রুকেই জড়িয়ে ধরলে।

নিজের অবস্থান বুঝতেই অনিলা কিছু টা হন্তদন্ত হয়ে সরে এলো।মাথা নত করে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

আ-আমার আ-আগুনে ফো-ফোবিয়া আছে।অতিরিক্ত আগুন দেখলেই আমি এভাবে অজ্ঞান হয়ে যায়।আমি আগুন দেখে সহ্য করতে পারি না বুঝতেই পারছেন।আ’ম স্যরি।

জুনইদ অনুদ্ধত কন্ঠে বললো, হুম বুঝলাম।এবার চলো তোমাকে তোমার শত্রু বাড়ি পৌঁছে দেবে।

অনিলা নত মুখেই বলে,লাগবে না আমি একাই যেতে পারবো।বলেই উঠে দাঁড়িয়ে পরলো অনিলা।বাজারের ব্যাগ টা নিয়ে হাটা ধরলো ক্লান্ত পায়ে।শরীরের শক্তি নেই কিন্তু জোর করেই হেটে যাচ্ছিলো সে।

জুনইদ ভাবছে এটা কেমন মেয়ে হ্যাঁহ।এরকম দুর্বল শরীরেও নিজের শরীরকে যেনো ঝড়ের বেগে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।এই জন্যই তো সে অনিলার নাম মিস সুনামি দিয়েছে।দেখো কিভাবে হেটে হেটে এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা।জুনইদ কিছুক্ষণ পরেই একটা রিকশা পেলো।রিকশা নিয়ে অনিলার সামনে দাঁড়িয়ে পরলো।

অনিলা উঠতে না চাইলেও ওঁকে জোর করে উঠালো রিকশায়।অনিলা না পেরে বাধ্য হয়ে উঠে পরলো রিকশায়।প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে পৌঁছে গেলো ওরা।অনিলা দুর্বল শরীরেই নামলো রিকশা থেকে।ওর শরীর চলছে না আর।কিন্তু তাও হাঁটা লাগালো ফ্ল্যাট এ ঢুকার জন্য।

জুনইদ ভাড়া মিটিয়ে অনিলার দিকে তাকালো।এই মেয়েটা বড্ড জেদি আর এক গুয়ে।এরকম নচ্ছাড় মেয়ে সে জীবনে এক পিস ও দেখে নি।উপায়ন্তর না পেয়ে আচমকাই সে চট করে কোলে তুলে নিলো অনিলাকে।কোলে নিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো আস্তে আস্তে।অনিলা নির্বাক নিরর্থক ভাবে বোকা বোকা চাহনিতে চেয়ে রইলো শ্যাম পুরুষটির মুখ পানে।

#চলবে

#সম্মোহনী_সেই_মেয়েটি
#পর্বঃ৬
#লেখিকাঃ রাদিয়াহ রাফা রুহি

জুনইদ রুমের সামনে এসেই অনিলা কে নামিয়ে দিলো।অনিলা কে নামিয়ে দিতেই চোখাচোখি হলো জুনইদের সঙ্গে।সাথে সাথেই অত্যন্ত অপ্রতিভ হয়ে চোখদুটো সরিয়ে নিলো ও।কিছু সময়ের জন্য স্বস্থানে থমকে দাঁড়িয়ে থেকে গটগট করে ভেতরে ঢুকলো।কোনো দিকে তাকালো না কিচেনে গিয়ে বাজারের ব্যাগ টা রাখলো।এরপর নিজের রুমে ঢুকে সোজা বিছানার কাছে গেল।

এসব কিছু লক্ষ্য করলো জুনইদ।না চাইতেও হেসে ফেললো সে।অনিলা ভেতরে আসতে না বললেও সে নিজে থেকেই ভেতরে ঢুকলো।চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো আশপাশ টা।তারপর একটা সোফায় বসলো।

অনিলা এক মনে ভেতর থেকে এসে পেয়ারা আর আঙ্গুর বের করে হাতে নিয়ে বারান্দায় গেলো।

এসব কিছু দেখে জুনইদ ভ্র-কুটি সংকুচিত হয়ে গেলো।স্ট্রেঞ্জ গার্ল।বাড়িতে কোনো মেহমান আসলে কি মিস সুনামি তাদেরকে এইভাবেই ট্রিট করে নাকি।একবার ভেতরে তো আসতে বললোই না।ইভেন সে যে ভেতরে এসে বসেছে তার দিকে একবার তাকালো না পর্যন্ত।কি অদ্ভুত।তারপর ফল ও বের করে নিয়ে বারান্দায় গেলো।এতে অবশ্য কিছু মনে করলো না জুনইদ।ভাবলো হইতো খাবে নিযে।

এর মধ্যেই জুনইদের কানে এলো অনিলা কারোর সাথে কথা বলছে।কিন্তু কার সাথে।সে উঠে দাঁড়ালো।বারান্দায় গিয়ে কারোর সাথে ফোনে কথা বলছে নাকি এই মেয়েটা।সে কি যাবে একবার, দেখবে উঁকি দিয়ে।নাহ আবার যদি ডিস্টার্বড ফীল করে।সে উঁকি দিতে চেয়েও দিলো না।সে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই একটা মিষ্টি মিহি কন্ঠ তার কানে প্রতিধ্বনিত হলো।সে ফিরে গেলো, বারান্দায় উঁকি দিলো সে,

ও মাই গড এই মেয়েটা এতক্ষণ একটা টিয়া পাখির সাথে কথা বলছিলো।সে বাকা হেসে বললো,

তোমার বাড়িতে কেউ আসলে বুঝি এভাবেই ট্রিট করো তাকে।

আকম্মাৎ কন্ঠে অনিলা চট করে তাকালো, এবাবা সে তো ভুলেই গেছিলো তার সাথে জুনইদ এসেছে।একটু লজ্জায় পরে গেলো সে।আমতা আমতা করে বলে উঠে,

নাহ আসলে ওঁকে খাওয়াতে খাওয়াতে ভুলে গেছিলাম আপনি ভেতরে,আব,আপনি বসুন না।

জুনইদ ফিচেল হেসে বলে, নাহ বসবো না।আফসোস হচ্ছে খুব।আমি যদি পাখি হতাম তাইলে কতই না ভালো হতো।

হঠাৎ এমন কথার মানে ধরতে পারলো না অনিলা।

মানেহ।

মানেহ হলো আমি এসে বসলাম আর তুমি দেখলে না অব্দি।এসেই এই সামান্য পাখিটাকে নিয়ে খাওয়াচ্ছো।

ওঁকে পাখি বলবেন না।ওর নাম স্ট্রুয়ার্ট।স্ট্রুয়ার্ট আপনার কাছে সামান্য কিন্তু আমার কাছে অনেক কিছু।

স্ট্রুয়ার্ট নিজের নাম নিতে দেখে তাকালো জুনইদের দিকে।ডানা ঝাপটিয়ে সেও বলে উঠলো, “স্ট্রুয়ার্ট, স্ট্রুয়ার্ট।নাম স্ট্রুয়ার্ট”

জুনইদ অবাক হলো, বাব্বাহ কথাও বলা শিখিয়েছো ওঁকে।

অনিলার মুখে হাসি ফুটলো।জুনইদ সেটা খেয়াল করলো।পাখিটির কথা বলতেই অনিলার মুখ টা কেমন খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠলো।অনিলা মুখে হাসি সমেত উত্তর দিলো,

হুম দের’বছর থেকে কথা বলা শিখাচ্ছিলাম।এখন বেশ অনেক কথায় বলতে পারে।

বাহ ভালো তো।তা আর কি কি জানে ও।

হ্যাঁ গান গাইতে পারে ও। আমি শিখিয়ে দিয়েছিলাম।কিন্তু যাকে তাকে শুনাই না ও।

জুনইদ স্ট্রুয়ার্ট কে বলে, হাই স্ট্রুয়ার্ট।আমাকে একটা গান শুনাও তো দেখি তুমি কি গান পারো।

স্ট্রুয়ার্ট জুনইদকে পাত্তাও দিলো।অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে আঙ্গুর খাওয়াই মনোযোগ দিলো।ভাব এমন যে সে যে কিছু বলছে তা যেনো শুনতেই পাইনি।

স্ট্রুয়ার্ট এর কান্ড দেখে অনিলা ফিক করে হেসে দিলো।স্ট্রুয়ার্ট এর পাত্তা না পাওয়াই এতে জুনইদের মন ক্ষুন্ন হলো।এই মিস সুনামি নিজের পাখিকে একদম নিজের মতোই বানিয়েছে।ইগোস্টিক।তাকে পাত্তাও দিলো না।তাই সে মুখ বাকিয়ে বলে,

একদিন আমাকেও গান শুনাবে দেখে নিও তোমার এই স্ট্রুয়ার্ট।

অনিলা হাসি থামিয়ে বলে,ওকে দেখা যাবে।

জুনইদ মাথা নিচু করে বললো, ওকে মিস সুনামি আমি আসছি তাহলে।

অনিলা জুনইদের দিকে তাকালো।মুখের হাসি মিলিয়ে মলিন হলো মুখ।কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই তার।আজকে জুনইদ তাকে অনেক সাহায্য করেছে।আস্তে করে মোলায়েম গলায় বলে,

ওকে সাবধানে যাবেন।

জুনইদ ভাবলো অনিলা অন্তত তাকে এক কাপ কফি নিশ্চয়ই অফার করবে সে যাওয়ার কথা শুনলে।কিন্তু নাহ এই মেয়ে তো কিছুই বললো না।কৃতজ্ঞতা থেকেও কিছু বললো না মেয়েটা।সে মুচকি হেসে পিছনে ফিরে চলে আসছে।দরজার কাছে যেতেই স্ট্রুয়ার্ট এর এমন বিভৎস চেচামেচি আর ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ কানে এলো।হঠাৎ এতো চেচানো শুনে জুনইদের বুক টা ধক করে উঠলো।অনিলার কিছু হলো না তো।

সে প্রায় হন্তদন্ত করে আবার ঘরে ঢুকলো।বারান্দায় গিয়ে অনিলাকে অজ্ঞান অবস্থায় পরে থাকতে দেখে মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে এলো যেনো।বক্ষস্থলের কাছে ভারী ভারী মনে হলো। সে তারাতারি করে অনিলাকে কোলে নিতেই বুঝলো অনিলার শরীরে হাই টেম্পারেচার।কপালে হাত দিয়ে দেখলো হাই ফিভার।সে বেশ চিন্তিত হয়ে পরলো।এই অবস্থায় সে অনিলাকে ছেড়ে যাবে কি করে।কিন্তু সে তো থাকতেও পারবে না।একা একটা মেয়ের সঙ্গে একটা ছেলেকে দেখলে মানুষ খারাপ চোখে দেখবে সেটা।স্ট্রুয়ার্ট এর চেচামেচির কারণ তার মানে এটাই ছিলো।জুনইদ কে দেখে স্ট্রুয়ার্ট চেচানো বাদ দিয়েছে ঠিকই কিন্তু খাচার মধ্যে দাপাদাপি করছে সে।

জুনইদ ওঁকে বিছানায় শুইয়ে দিলো।নিজের মাথার চুল গুলো হাত দিয়ে পিছনে ঠেলে দিলো।উম্মাদের মতো লাগছে তার নিজেকে।জুনইদ বিরবির করে বলে,

নাহ এখন যা করার আমাকেই করতে হবে।আমি না থাকলে তো জ্বর টার ও কোনো সুরাহা হবে না।কি করা যায় এখন।এখন তো বাইরে গিয়ে মেডিসিন আনাও সম্ভব নয়।রাত বেরেছে।যদি কেউ তাকে ফ্ল্যাট থেকে এইভাবে বেরিয়ে যেতে দেখে ব্যাপার টা খুব বাজে হবে।আর অনিলার ঘরে কোনো মেডিসিন থাকলেও তা খুজে পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।এদিকে অনিলা জ্বরে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে।আর জ্বরের ঘোরে গোঙ্গাচ্ছে।

জুনইদ আর বেশি কিছু না ভেবে রুমাল বের করলো।কিচেন রুম খুজে নিয়ে একটা বাটিতে পানি নিয়ে এলো।অনিলার মাথার পাশে খাটের এক কোণায় বসে অনিলার মাথায় জলপট্টি দিতে গিয়ে দেখলো অনিলার এক গাছি চুল এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরো মুখশ্রী জুড়ে।বাচ্চা বাচ্চা লাগছে পুরো।ওর মুখে চুল পড়াই ওঁকে আরও স্নিগ্ধ আরও মায়াময়ী লাগছিলো।সে তার স্মিত হেসে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।আকস্মিক হাত দিয়ে চুল সরিয়ে দিতে চেয়েও হাত সরিয়ে নিলো।এর নিজের মুখ টা অনিলার কপালের কাছে নিয়ে গিয়ে ফু দিয়ে সরিয়ে দিলো।তারপর মাথায় জলপট্টি দিতে লাগলো।অনিলা বার বার কেঁপে কেঁপে উঠছে।কিন্তু এখন জুনইদ এখন কি করবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না।বিছানায় শুধু একটা পাতলা চাদর পরে আছে।কিন্তু এই চাদরে তো আর কাঁপুনি কমবে না।যায় হোক চাদর টা টেনে নিয়ে অনিলার গায়ে ভালো করে জড়িয়ে দিলো।তাতে যদি একটু কাঁপুনি কমে।কিন্তু এতেও ওর কাঁপুনি বন্ধ হচ্ছে না।

এদিকে জুনইদ ওর মাথার কাছে বসে সমানে জলপট্টি দিয়ে যাচ্ছে।এরকম চঞ্চল মেয়েকে এইভাবে দেখে তার কষ্ট হচ্ছে।কিন্তু তার এতো কষ্ট কেন হচ্ছে সেটা নিজেই বুঝতে পারছে না।কিন্তু কষ্ট হচ্ছে।সেই বা কি করবে।নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে।আবার এটাও ভাবছে সে এটা ঠিক করছে তো।এইভাবে একা একটা মেয়ের বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে কিছু ভুল করে বসছে না তো।কিন্তু অনিলাকে তো একা ফেলেও যেতে পারবে না।

ওষুধ না দেওয়াই শুধু জলপট্টি তে জ্বর কমছে না।অনিলাকে যে জিজ্ঞেস করবে ব্ল্যাংকেট কোথায় আছে সেটাও জিজ্ঞেস করতে পারছে না।তাও অনিলার এভাবে কাঁপতে দেখে ওঁকে ঝাকিয়ে জিজ্ঞেস করবে বলে ঠিক করলো।তাছাড়া মিস সুনামির তো কিছু খাওয়াও হয়নি।

মিস সুনামি,এই যে মিস চোখ খুলো।একটু আমার দিকে তাকাও প্লিজ।ব্ল্যাংকেট কোথায় আছে বলো তো।এই যে মিস সুনামি।

নাহ এইভাবে হবে না।অনিলার কোনো সারা না পেয়ে জুনইদ আরও হতভম্ব হয়ে পরলো। এবার যা করার তাকেই করতে হবে।এই ভেবেই জুনইদ কিছু টা দুটোনা নিয়েই অনিলার ওয়ারড্রব টা খুলে ফেললো।খুলে নিচের সেলফে একটা ব্ল্যাংকেট পেয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।অনিলার গায়ে ব্ল্যাংকেট টা ভালো ভাবে চাপিয়ে দিলো।কিন্তু অনিলা এখনো কাঁপছে।জুনইদ বার বার জল টা পালটে ঠান্ডা জল দিয়ে জলপট্টি দিচ্ছে।

এবার হঠাৎ করেই জ্বরের ঘোরে অনিলা জুনইদের হাত টেনে ধরে নিজের দু হাতের মাঝে নিয়ে জুনইদের হাতের উপর মাথা রেখে
শুয়ে পরলো।অনিলার এরকম কান্ড দেখে জুনইদের একটু হাসি পেলো।

মিস সুনামি এটা কি করছো।হাত টা ছাড়ো না হলে এক হাত দিয়ে তোমার মাথায় জলপট্টি দেবো কি করে।

কিন্তু অনিলা শুনলে তো ছাড়বে।এবার জুনইদ কোনো উপায় না দেখে এক প্রকার জোর করেই হাত টা ছাড়িয়ে নিলো।জুনইদ বিরবির করে বললো,

আমি জানি মিস সুনামি তুমি সেন্সে থাকলে কিছু তেই আমার হাত এভাবে জাপ্টে ধরতে না।স্যরি এর থেকে আর বেশি কিছু করতে পারছি না আমি তোমার জন্য।এবার জুনইদ কে আরও অবাক করে দিয়ে অনিলা জুনইদের কমোড় জড়িয়ে ধরে ওর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরলো।জুনইদ চেয়েও অনিলাকে সরাতে পারলো না।ওর কাঁপুনি টা একটু কমেছে।সঙ্গে জ্বর টাও।জুনইদ একবার কপালে হাত দিয়ে চেইক করলো।জ্বর কমেছে দেখে স্বস্তি পেলো সে।ওভাবেই অনিলার মাথায় থেকে থেকে জলপট্টি দিতে লাগলো। এরপর মোবাইলের দিকে চোখ যেতেই জুনইদ দেখলো পনেরো টা মিসড কল।

কয়েকটি কল তার কাকার আর আর কিছু নিশার।সে বলে উঠলো,

ওহ শিট।আমাকে ফোনে না পেয়ে বাড়িতে নিশ্চয়ই এতক্ষণে চিন্তা শুরু করে দিয়েছে।আসলে অনিলাকে এই অবস্থায় দেখে আমার মাথাতেই আসে নি বাড়ির কথা।অনিলাকে আস্তে করে নিজের কোল থেকে নামিয়ে দিতে চাইলো কিন্তু পারলো না।অনিলা শক্ত করে ধরে আছে তার কোমড়।সে ওভাবেই বসে বাড়িতে কল করলো।

হ্যালো।

এই হতচ্ছাড়া।কোথায় আছিস।তোর জন্য আমরা সবাই চিন্তায় পরে গেছি।সে খেয়াল কি আছে তোর।ফোনের অপাশ থেকে নিশা বলে উঠলো।

জুনইদের স্পষ্ট জবাব।

আচ্ছা মাকে ফোন টা দে।

শান্তা বেগম কে ফোন টা দিতেই জুনইদ বলে,

স্যরি মা ফোন টা সাইলেন্ট ছিলো।আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি।

শান্তা বেগম বলে উঠলো, তুই করছিস টা কি বল তো।এতো রাত হয়ে গেছে বাড়ি ফিরছিস না কেন।

আসলে মা আমি আমার একটা বন্ধুর বাসায় আছি।আজ ফিরবো না।বন্ধুর মা যেতে দিচ্ছে না।তোমরা চিন্তা করো না।আমি ঠিক আছি।

এরপর আরও কিছুক্ষন কথা বলে বোঝালো নিজের মাকে।ফোন টা রেখে দিলো সে।সত্যিটা সে বলতে পারলো না।অন্য কিছু ভাবতে পারে সবাই।স্ট্রুয়ার্ট এর কথা মনে পরতেই সে বারান্দায় গেলো।সেখান থেকে খাচা সহ স্ট্রুয়ার্ট কে ভেতরে এনে রাখলো।স্ট্রুয়ার্ট কেমন নির্জিব হয়ে গেছে।অনিলার দিকে ওর সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চোখে তাকিয়ে রইলো।একদম আওয়াজ করলো না সে।

জুনইদ স্ট্রুয়ার্ট কে দেখে বুঝতে পারলো স্ট্রুয়ার্ট চিন্তা করছে।তাই সে স্ট্রুয়ার্ট কে উদ্দেশ্য করে বলে,

চিন্তা করিস না।আমি আছি ওর কাছে।

স্ট্রুয়ার্ট ওর কথায় কি বুঝলো কে জানে।চুপচাপ নিজের ডানা ঝাপটা দিয়ে বসে রইলো।এটা বোঝালো সেও আছে।

#চলবে

আসসালামু আলাইকুম। নামাজ কায়েম করুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here