সখি,পর্ব:১
নাসরিন সুলতানা
নেলির বিয়ে হয়েছে মাত্র ঊনিশ দিন।
এই ক’দিনেই নেলি বুঝে গেছে ওর বর সাবের বেশ বদমেজাজী টাইপের।
নেলির শ্বশুর বাড়িটার বেশ একটা বাহারি নাম আছে। বউ হয়ে আসার ক’দিন পর নেলি বেশ কৌতুহল নিয়ে সাবেরকে জিজ্ঞেস করেছিল – আচ্ছা, বাড়ির নাম প্রিয়ংবদা কে রেখেছে?
সাবের বিছানায় শুয়ে বই পড়ছিল, বেশ খটমটে টাইপের জটিল বই।
সে বই থেকে মুখ তুলে ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলল – এতো বাজে প্রশ্ন করো কেন ? বাড়ির নাম কে রেখেছে সেটা জেনে তুমি কি করবে?
নেলির বড্ড লজ্জা লাগল।
এটা যে বাজে প্রশ্ন সে বুঝতে পারেনি।
নেলি আরও অনেক কিছু বুঝেনা।
এই যেমন তার বরের মেজাজের উঠানামা।
এতো মেজাজি! নেলির কথা বলতেই ভয় লাগে।
অথচ বিয়ে ঠিক হবার পর ওর বড় মামী খুশিতে গদগদ হয়ে নেলির মাকে বললেন – তোমার মেয়ের রাজকপাল বুবু। হীরের টুকরো ছেলে পাইসো নেলির জন্য। কি বড় খান্দান! শ্বশুর ডাক্তার ভাবা যায়!
নেলির মা রাহেলা আমতা আমতা করে
বললেন – রওশন আমার বড় ভয় করছে। আমার খান্দানের দরকার নাই ওরা আমার নেলিকে ভালোবাসবে তো?
বড় মামী রওশন বিয়ের ঘটকালি করেছেন।
তিনি হাত ঝাড়া দিয়ে বললেন – রাখো তোমার ভালোবাসা, বিয়েই তো হচ্ছিলোনা। বাবা নেই, পরের বাড়িতে আশ্রিত এমন মেয়েকে বিয়ে দেয়া কি কঠিন!
রাহেলা আর কথা বাড়ালেন না।
আসলেই নেলির বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি নিজেদের বাড়িটা ভাড়া দিয়েছেন।
দুই মেয়ে নেলি আর বেলিকে নিয়ে ভাইয়ের বাড়িতে উঠেছেন শুধুমাত্র মেয়েদের নিরাপত্তার কথা ভেবে।
ভাইয়ের বউ কথায় কথায় সেই খোঁটা দিতে ছাড়েনা।
অথচ তাদের তিনজনের খরচের টাকা মাসের প্রথমেই তিনি রওশনের হাতে তুলে দেন।
আল্লাহর উপর ভরসা করে রাহেলা ভয়ে ভয়েই বিয়েতে রাজী হয়েছিলেন।
বিয়ের আগের রাতে নেলিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন -একটু মানিয়ে চলিস মা।
নেলি অবশ্য এমনিতেই মানিয়েই চলতো।
মানিয়ে চলার ভালো একটা গুন নেলির আছে।
********
প্রিয়ংবদা নামের বাড়িটিতে প্রচুর জায়গা।
বাড়িটা তেমন আহামরি না যদিও, তবুও
প্রথম দিনই নেলির বাড়িটার প্রতি মায়া পড়ে গেলো। কেমন যেন শান্তি শান্তি ভাব আছে।
বড় মামী খান্দান আর হীরের টুকরো ছেলে বলে যে বয়ান দিচ্ছিলেন দেখা গেলো সেটাও অনেকটা বাড়িয়ে বলা।
নেলির শ্বশুর কামালউদ্দিন ডাক্তার, কিন্তু রিটায়ার্ড করেছেন।
এখন আর তিনি প্র্যাকটিস করেন না।
তার কাজ বাজার করা, আর পাড়ার মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে মসজিদেই অনেকটা সময় কাটানো। বেশ সরল মানুষ, কিন্তু চট করে রেগে যান। শুধু একটাই সমস্যা করেন প্রতি বেলায় টাটকা এবং গরম খাবার ছাড়া খেতে পারেন না।
সেই রান্নাটা আবার নেলির শাশুড়ি সেলিনাকেই করতে হয়। অন্য কারোর হাতের রান্না তিনি খেতে চাননা।
সেলিনার বেশিরভাগ সময় রান্না ঘরেই কাটে।
অবসর পেলে ঘুমিয়ে না হয় বই পড়েন তিনি।
এ বাড়িতে সাবেরের বড় ভাই আবেদ বউ বাচ্চা নিয়ে থাকে।
আবেদ একটা কলেজের প্রভাষক ।
আবেদের বউ মিথিও একটা স্কুলে আছে।
দুইটা বাচ্চা তাদের, বড়টা ছেলে মিঠু।
ছোটটা দেড় বছরের মেয়ে নাম আনা ।
সাবেরের বড় বোন মেহেরজানও থাকে বাড়িটায়। মেহেরজানের এই বাড়িতে থাকার কথা নয়, এই বয়সে সাধারণত মেয়েদের বিয়ে হয়ে স্বামী সংসার হয় কিন্তু মেহেরজান জটিল মানসিক রোগ সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। তাই আর বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়নি ওকে। বত্রিশ বছর বয়সী মেহেরজানকে দেখে নেলি অবাক! মানুষ এতো সুন্দর হয়!
নেলির বর সাবেরকে হীরের টুকরো ছেলে বলা যেতে পারে কারণ সাবের খুব ভালো ছাত্র ছিল।
হীরের দ্যুতির মতই উজ্জ্বল রেজাল্ট করার পর বুয়েটের আর্কিটেক্ট এ ভর্তি হয় সে। কিন্তু দু’বছর পড়ার পর সে পড়াশোনা ছেড়ে দিল। ছ’মাস ঘরে বসে থাকার পর হিস্ট্রিতে অনার্স ভর্তি হয়ে এক বছর পর সেটাও বন্ধ করে দিল। এরপর বাবার পিড়াপীড়িতে বিএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফার্স্ট ক্লাস থার্ড হয়ে আবার তার হীরক দ্যুতির পরিচয় দেয়। মাস্টার্স শেষ করে একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি নেয়। কিন্তু তার বিখ্যাত মেজাজের জন্য বেশিদিন চাকরি করতে পারেনি।
এখন চেষ্টা করছে গ্রামের বাড়িতে একটা ফার্ম দিতে, এই ফার্ম নিয়েই সে ইদানীং খুব ব্যস্ত।
হীরে খুব কঠিন রত্ন। এর ব্যবহারও বিচিত্র ধরনের।
কখনো অলংকার হিসাবে আবার কখনো কাঁচ কাটার জন্য হীরে ব্যবহার করা হয়। হীরা কাটতে হলেও হীরা লাগে।
নেলি অসহায় হয়ে ভাবে হীরে বাইরে থেকে দেখতেই দ্যুতিময়, কিন্তু ভেতরটা শক্ত পাষাণ।
নেলির জীবন কাটতে লাগলো পাষাণ হীরের সাথে!
********
দিনে দিনে নেলি এই বাড়ির সাথে তার জীবনকে জড়িয়ে ফেলল।
এ বাড়ির শ্যাওলা জড়ানো উঠান, ঝাঁকড়া আম গাছ আর অযত্নে বেড়ে উঠা মাধবীলতার ঝাঁড় যেন নেলির কতো চেনা!
অথচ নেলি এই বাড়িতে এসেছে মাত্র নয় মাস সতেরো দিন। একদম নির্ভুল হিসাব। নেলি প্রতি রাতে শুয়ে শুয়ে হিসাব করে।
মাঝে মাঝে নেলির মনটা বড্ড উচাটন হয়ে উঠে।
তখন মন চায় বাসা থেকে বেড়িয়ে কোন অজানায় চলে যেতে। সেটা সম্ভব নয় বলে সে নানান কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে।
আজ নেলির দিনটাই শুরু হলো উলট পালট কষ্টের ভেতর দিয়ে। সাবের ভোর বেলা বের হয়ে যাওয়ার সময় কিছু খায়না। সাধলেও লাভ নেই তাই নেলি সাধেওনা।
আজ বের হবার সময় সাবের খুব স্বাভাবিক গলায় বললো- নেলি, ঝটপট কিছু খেতে দাও।
নেলি ফ্রিজ খুলে খাওয়ার মতো কিছু পেলোনা।
তাড়াতাড়ি আটা গুলে রুটি বানাতে গেলো।
সাবের সেটা দেখে বলল – থাক কিছু লাগবেনা, আমি বাইরে খেয়ে নেব।
নেলি বললো – একটু বস আমার দু’মিনিট লাগবে।
সাবের হেসে বললো- দু’মিনিটে তো হবেনা, তাও শুধু শুধু সময় বেঁধে দিলে! মানুষ কেন যে অকারণে সময় বেঁধে দেয়।
পাষাণ লোকটা নেলির মন খারাপ করিয়ে দিয়ে আনমনে বের হয়ে গেল।
নেলি নিজেকে ব্যস্ত রাখতে শাশুড়ীর সুতির শাড়িগুলো বের করে হালকা মাড় দিয়ে দিলো। কেমন ম্যাড়মেড়ে শাড়ি পরেন মা!
উঠানের তারে কাপড় মেলতে মেলতে দেখে মিঠু ফিচফিচ করে কাঁদছে।
এই ছেলেটা এতো ছিঁচকাঁদুনে যে আর বলার না!
একবার তাকিয়ে আবার শাড়ি মেলায় মন দিলো নেলি। মাড় দেয়া শাড়ি টান টান করে মেলে শুকাতে না দিলে পরে ভাঁজ করার সময় ভারি মুশকিল হয়ে যায়।
বেশ তাঁতানো রোদ উঠেছে।
নেলি অকারণেই সূর্যের দিকে তাকালো।
ইশ কি রোদ রে বাবা!
সূর্য থেকে চোখ সরানোর পর চোখে লাল, কমলা আলোর ঝিকমিক খেলে গেলো।
নেলি কাপড়ের বালতিটা বারান্দার এককোনায় রেখে মিঠুর কাছে গেলো।
– কি রে মিঠু, কাঁদছিস কেন?
– কাঁদছি কই?
– আমি যে কান্নার শব্দ পেলাম, তোর হাতে কি রে বেলের শরবত নাকি?
– হুম।
– খাচ্ছিস না কেন হাতে নিয়ে বসে আছিস সেই তখন থেকে দেখছি।
– খেতে ভীষণ পঁচা, মুখ কেমন শিরশির করছে।
– দে তো চেখে দেখি।
এ বাড়িতে চৈত্র মাসের গরমে প্রতিদিন বেলের শরবত বানায় নেলির শ্বশুর ।
উঠানের একপাশে মস্ত বেল গাছ।
প্রতি বছর নাকি ঝেঁকে বেল আসে। এবারও গাছ ভরা বেল। দুপুরের আগ দিয়ে কামাল উদ্দিন বড় ঘরের খাটে বসে বেলের শরবত বানান, সেই শরবত এক গ্লাস করে বাড়ির সবাইকে খেতে হয়।
তা শরবত খেতে হোক এ নিয়ে নেলির কোন মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু এই শরবত এতো অখাদ্য করে বানান যা আর বলার না।
ভালো করে ছাঁকেন না। আঁশ, একটা, দুটো বিঁচি থেকেই যায় গ্লাসের তলানিতে।
কেউ কিছু না বলে খেয়ে নেয়।
শুধু মিঠুই কাঁদে।
সাবেরকে দিলে বেসিনে ঢেলে দিয়ে বলে- এসব ফালতু খাবার আমাকে দিবেনা।
– বাবা মন খারাপ করবেন, না খেলে। নেলি মৃদু কন্ঠে বলে।
– আশ্চর্য! মানুষের মন ভালো করার দায়িত্ব তোমাকে কে দিল? সাবের বিরক্ত হয়ে বলে।
নেলি এখন আর সাবেরের কথায় রাগ করেনা, ভয়ও পায়না।
শুধু মাঝে মাঝে উদাস হয়ে যায়।
মনে মনে বলে- এই হীরাকে একদিন আমি ভেঙে ফেলব।
*************
মিঠুর হাত থেকে গ্লাসটা নিল নেলি।
– এতো সামান্য বিষয় নিয়ে কাঁদতে হয় না বাবা।
কান্নার জন্য অনেক বড় বড় বিষয় আছে।
– কি বিষয় আছে চাচী?
-সেটা বড় হলে নিজেই বুঝতে পারবি রে। বলে গ্লাসটা মিঠুর হাতে ফিরিয়ে দিল।
মিঠু দু’হাতে গ্লাস ধরে চুমুক দিয়ে বললো – মেহের ফুপু কি জন্য কাঁদে?
নেলি এই প্রশ্নের উত্তর জানেনা।
তাই প্রসংগ পাল্টে বলল -আজ স্কুল নেই?
– না।
– একটু জিরিয়ে গোসল করতে যা।
নেলির হাতে আপাতত কোন কাজ নেই।
রান্নার দায়িত্ব পুরোটাই শাশুড়ির।
সাহায্যকারী আছে আনুর মা।
শ্বশুর সাহেব খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে এতো খুঁতখুঁতে! কারো হাতের রান্নাই তার মুখে লাগেনা।
কতো রকমের যে বাতিক মানুষের!
শুধু শুধুই বুড়ো মানুষটাকে রান্না ঘরের আগুনে আটকে রাখা।
***********
মেহেরজান ঘুম থেকে উঠে বারোটার পর। সারারাত কখনো পায়চারী করে, কখনো গান গায় আবার কখনো কাঁদে। ভোরের দিকে ঘুমাতে যায়। অষুধের প্রভাবে গভীর ঘুম হয়।
তার নাস্তা খাওয়ার সময় সাথে থাকে নেলি।
ভীষণ আশ্চর্য লাগে মেহেরজানকে তার।
দিব্যি সুস্থ মানুষ, কিন্তু আবার সুস্থ না! কি অদ্ভুত রোগ! স্বাভাবিক কথা বলছে, আবার সেই সাথে অস্বাভাবিক কথা বলছে।
মেহেরজানের নাস্তা হলো পাতলা রুটি, পেঁপে ভাজি, সাথে কুসুম ছাড়া ডিম সিদ্ধ ।
শেষে মগ ভর্তি লাল চা, তাও চিনি ছাড়া।
মেহেরজানের ডায়বেটিস, হাইপ্রেশার, হাই কলেস্টেরল কি নেই!
নেলি খুব চেষ্টা করে মেহেরজানের জন্য মুখরোচক কিছু বানাতে।
রোজ দিন পারেনা অবশ্য।
মেহেরজান অনেক কিছু হজম করতে পারেনা।
এদিক সেদিক কিছু হলে শ্বশুর সাহেব আস্ত রাখবেন না। মেয়ের ব্যাপারে খুব কড়া নিয়ম তাঁর।
সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় মেহেরজান আর নেলি টুকটাক গল্প করে। তাদের বেশির ভাগ গল্পই খাওয়া দাওয়া নিয়ে।
– বুবু ডিমটা পেঁপে ভাজির সাথে মিশিয়ে নাও তাহলে মজা লাগবে।
– দেখি, রুটিটা রোল করতো, আচ্ছা দাও আমি করে দিচ্ছি।
নেলি ডিমটা চটকিয়ে পেঁপে ভাজির সাথে মিশিয়ে পুর বানিয়ে রুটির ভেতর রেখে রোল বানিয়ে দিলো।
– নাও এখন খাও মজা লাগবে।
মেহেরজান কোন মজা পায়না। বিরস মুখে একটু একটু করে খায়।
-কোন মজা নাই রে সখি।
মেহেরজান নেলিকে সখি ডাকে।
নেলির বড় ভালো লাগে এই ডাকটা।
আরও ভালো লাগবে সাবের যদি কখনো ডাকে এ নামে। কি অদ্ভুত ভাবনা, নেলির কেমন লজ্জা লাগল!
সে তো সাবেরের সখি হতেই চায়, কিন্তু সেটা পাষাণ হীরে বুঝলে তো হতোই!
মেহেরজান খেতে খেতে বলে – জানিস সখি অর্ণব আমার মেহেরজান নামটা একটুও পছন্দ করেনা।
নেলি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে – অর্ণব কে বুবু?
মেহেরজান লাজুক গলায় বলে – আমার বর অর্ণবকে চিনিস না? বাবা কেন যে আমার নাম রেখেছেন মেহেরজান!
– সুন্দর নাম বুবু।
– আমার দাদীর নাম ছিলো মেহেরজান ।
– তোমাকে বাবা অনেক ভালোবাসেন।
– তা বাসে। কিন্তু অর্ণব বলে এটা নাকি পঁচা নাম।
সে আমাকে শুধু জান ডাকে।
বলেই হাসিতে ভেঙে পড়লো মেহেরজান। সে হাসি আর থামেইনা। কি অস্বাভাবিক লাগছে বুবুকে!
নেলি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
বহু কষ্টে হাসি থামালো মেহেরজান।
হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল – সখি দুটো শুকনো মরিচ পুড়িয়ে পেঁয়াজ, সরষের তেল দিয়ে মেখে দিবি? রুটি দিয়ে খাবো।
– মরিচ ভর্তা খেলে তোমার পেট জ্বলবে বুবু।
দুপুরে তোমার জন্য মাখা মাখা ঝোলের পাবদা মাছ রেঁধে দিব।
মেহেরজান খুশি হয় শুনে, একটু একটু করে খায়।
নেলির বড় কষ্ট হয় মেহেরজানের জন্য। আহা! কি কষ্টের জীবন!
কি মায়া লাগে!
***********
নেলি রান্নাঘরে ঢুকল।
গরমে তেঁতে পুড়ে ওর শাশুড়ি সেলিনা রান্না করছেন।
কড়াইয়ে বড় বড় রুই মাছের পেটি ভাজা হচ্ছে। সেলিনা সাবধানে মাছ উল্টে দিলেন। ।
শাশুড়ির সারা মুখে ঘাম লেগে আছে।
– মা, আপনি তো ঘেমে একেবারে শেষ, দেন আমি মাছগুলো ভাজি।
সেলিনা ক্লান্ত গলায় বললেন – পারবে তুমি, দেখ সাবধানে ভাজ। মাছ বেশি কড়কড়ে হয়ে গেলে তোমার শ্বশুর খাবেনা। চুলার আঁচ কমিয়ে দাও।
– আমি আঁচ কমিয়ে দিচ্ছি, আপনি ফ্যানের নীচে বসেন।
নেলি শাশুড়ির হাতে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিয়ে চুলার পাশে দাঁড়ালো।
সেলিনা পানি হাতে নিয়ে গ্লাসের দিকে তাকালেন।
গ্লাসে একটুকরো বরফ ভাসছে।
নেলি জানে তিনি ঠান্ডা পানি ছাড়া খেতে পারেন না।
রান্না ঘরে আসার আগে পানি নিয়েই এসেছে সে। অল্প ক’দিনেই সবাইকে কি আপন করে নিয়েছে মেয়েটা।
আল্লাহপাক কিছু কিছু মানুষকে এতো ভালো মানুষ করে দুনিয়ায় পাঠান!
এরা যেন শুধু দিতেই আসে। অথচ তার ছেলে এমন ভালো মেয়েটার কোন মুল্যেই বুঝলনা!
– মা দেখেন ভাজা মনে হয় হয়ে গেছে।
সেলিনার কেনো যেন আগ্রহ হলোনা দেখার।
-আরও কিছু রান্না করবেন মা?
– না রে মা, আর কিছু না।
রান্না শেষ শুধু মাছ ভাজাই বাকি ছিলো।
-একটা কথা বলি মা?
– কি কথা নেলি?
– ঘরে তো পাবদা মাছ আছে, বুবুর জন্য হালকা মসলা দিয়ে রেঁধে দেই?
– আজকে না, নেলি আর একদিন করো।
নেলির মনটা দমে গেলো।
আহারে, বুবু অপেক্ষায় থাকবেন।
সেলিনা সেটা বুঝতে পেরে আবার বললেন- তোমার বুবুকে আজ মাছ ভাজা দিও।
উচ্ছল মুখে নেলি বললো – আচ্ছা মা।
*********
মেহেরজান দুপুরের খাবার খায় বিকেলের আগে আগে। সেলিনা খাওয়ার সময় আজ পাশে বসে ছিলেন । মেহেরজান চুপচাপ খাচ্ছিল।
ওর চেহারায় আনমনা এক হাসির খেলা।
সেলিনা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
কি মিষ্টি একটা মায়াভরা মুখ। দেখে কে বলবে অসুস্থ! মনে হচ্ছে কোন ঘরের দুষ্টু একটা বউ।
যে সারাক্ষণ স্বামী, সন্তান নিয়ে খুঁনসুটিতে মেতে থাকে। আহ! কি অপূর্ণ একটা জীবন তার মেয়ের! তিনি মরে গেলে এই মেয়েকে কে দেখবে? হে মাবুদ
ওকে সুস্থ করে দাও তুমি!
– মা, আরেক পিস মাছ ভাজা দাওনা।
– মুরগীর ঝোলটা খাও মা, ভাজাভুজি খাওয়া ভালো না।
– সব সময় এতো না না করো কেনো তুমি? ভালো লাগেনা আমার।
– তোমার যে ভাজা খাবার সহ্য হয়না।
– আচ্ছা খাবোনা যাও।
মেহের প্লেট ভরে ভাত নিল। বাটি ভর্তি মুরগীর ঝোল সবটাই ঢেলে নিল।
সেলিনা তাঁকিয়ে রইলেন। খেতে পারুক আর নাই পারুক মেহের পাত ভরে খাবার নিবে। কিছু বলেও লাভ নাই।
– মা, ভাজা মাছ খুব মজা হয়েছে অর্ণবের জন্য দুই পিস রেখে দাও।
– অর্ণব কে মা?
মেহের ভাত খাওয়া থামিয়ে থমথমে গলায় বলল- অর্ণবকে চিননা ? কেন চিননা? নিজের মেয়ের বরকে এতো অবহেলা কেন তোমার? এই জন্যেই তো অর্ণব এখানে আসেনা।
মেহেরের এই এক সমস্যা। কাল্পনিক এক জগতে বাস করে।
– ঠিক আছে আমি অর্ণবের জন্য দু’পিস রেখে দিচ্ছি।
ঠিক এই সময় স্কুল থেকে মিথি এলো।
– মেহের, তুমি প্লেট ভরে খাবার নিয়ে নষ্ট করো খাবার…
সেলিনা চোখের ইশারায় মিথিকে বারণ করলেন কিছু না বলতে।
মিথি আরও রেগে গেল।
– আপনারাই ওকে অসুস্থ বানিয়ে রেখেছেন।
নিজের সবটাই বুঝে, তবুও পুতুপুতু করে অসুখ অসুখ করেন।
– মিথি তুমি চুপ করবে?
– এভাবে খেলে যে কেউ অসুস্থ হবে।
দু’দিন পর পর পেট নেমে যায় ছিঃ।
– চুপ করো মিথি, পায়ে পা বেঁধে ঝগড়া না করলে তোমার চলেনা?
মেহেরজান ভাত খাওয়া রেখে এঁটো হাতে মিথির চুলে ধরে টানতে টানতে বললো- এই, তুই আমার মায়ের সাথে ঝগড়া করিস কেন?
মিথি ভয়ে চিৎকার করতে লাগলো।
চিৎকার শুনে আবেদ ছুটে এলো, কামাল সাহেব এলেন।
আবেদ মিথিকে ছাড়িয়ে নিতে গেলো, সেলিনা এসে মেহেরজানকে ইচ্ছেমতো চড় দিলেন।
নেলি দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছিলো। ভয়ে তার কাঁপুনি এসে গেলো।
আনুর মা এসে মেহেরজানকে সরিয়ে নিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। মুহূর্তের মাঝে একটা বাজে পরিস্থিতি হয়ে গেলো।
সেলিনা এসে মেহেরজানের কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন – মরে যা তুই, মর তুই, এই যন্ত্রণা আর সহ্য হয়না ।
মিথির কিছু ছেড়া চুল মেহেরজানের হাতে।
মেহেরজান ফুঁপাতে ফুঁপাতে বললো – আমার মায়ের সাথে আবার ঝগড়া করলে আমি ওকে গলা টিপে মারব।
মেহেরজানের গালে চড়ের লাল দাগ।
সেলিনা ক্লান্ত গলায় স্বামীকে বললেন – আমি আর পারিনা, ওকে মেন্টাল ক্লিনিকে ভর্তি করে দাও।
কামাল সাহেব ভাঙা গলায় বললেন – আমার মেয়ের জন্য কারোর যদি এ বাড়িতে থাকতে অসুবিধা হয় সে স্বছন্দে চলে যেতে পারে। কিন্তু আমার মাকে আমি মেন্টাল হসপিটালে পাঠাবো না।
***************
অনেক দিন পর আজ সাবেরের মনটা বেশ ভালো।
এবার তার আমের বাগানে ভালো ফলন হয়েছে।
বাগানের মালি জসিম চাচা হাসতে হাসতে বললেন- তোমার বউয়ের ভাগ্যে এমন ফলন হইসে গো বাপ।
সাবের তার সব কর্মচারীদের সাথে খুব সহজ আচরণ করে।
কিন্তু জসিম চাচার কথায় তার বিরক্তি লাগলো।
– চাচা ফলন দেয়ার মালিক আল্লাহপাক, আমার বউয়ের এখানে কোন হাত নাই।
– তাও একটা কথা আছে বাপ, বউয়ের হাত দিয়া সৌভাগ্য আহে।
সাবের আর তর্কে গেলোনা।
তর্কে গেলে তার মুডটাই নষ্ট হবে।
যার হাত দিয়েই আসুক সৌভাগ্য এলেই হলো।
ইদানিং নেলির মুখটা বারবার উঁকি দিয়ে যায়।
সে কি আবার প্রেমে পড়লো!
স্ত্রীর প্রেমে পড়াটাই তো স্বাভাবিক, কিন্তু সাবের পণ করেছে জীবনে আর কাউকে ভালোবাসবে না। এতে অবশ্য মেয়েটার প্রতি চরম অবিচার করা হবে।
সাবের নিরূপায়, তার মনটা তো কবেই মরে গেছে!
সেই যে স্নিগ্ধা যখন ওকে প্রশ্ন করলো – তোমার বোন মেহের আপার কি সমস্যা সাবের?
– সমস্যা শুনে তুমি কি করবে? সাবের ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।
– শুনেছি মেহের আপা নাকি পাগল?
– বুবু পাগল না, তার জটিল মানসিক সমস্যা সিজোফ্রেনিয়া।
– ও, বুঝেছি। স্নিগ্ধা চুপ হয়ে গেলো।
ওর মিষ্টি চেহারায় কালো মেঘের ছায়া।
সাবের বললো – আমার বুবুর মতো ভালো মেয়ে পৃথিবীতে খুব কম আছে। বুবুর সমস্যা হলো সে নিজের একটা কাল্পনিক জগতে থাকে।
সেই প্রথম তারুণ্যে স্নিগ্ধা আর সাবেরের উথাল-পাথাল যে ভালোবাসাটা ছিলো সেই ভালোবাসার জাল কেটে সাবেরই দূরে সরে গেলো।
বুবুর মানসিক রোগটাকে স্নিগ্ধার বাবা জেনেটিক সমস্যা বলেছিলেন। বংশ পরম্পরায় এই রোগের বীজ নাকি সুপ্ত থাকে।
সাবের এতো ডিপ্রেশনে চলে গেলো তার আর বুয়েটেই পড়া হলোনা।
ইদানিং সে ভাবে তার আর স্নিগ্ধার ভালোবাসাটা একটা মোহ ছিলো।
সাবের ছিলো দুর্দান্ত ভালো ছাত্র, আরও অনেক প্রতিভা ছিলো তার। স্নিগ্ধা সেসব দেখেই সাবেরকে ভালোবেসে ছিলো। মোহ থেকে যে সম্পর্ক হয় সেখানে গভীরতা থাকেনা।
সাবের ভাবে আজকাল বেশিরভাগ মানুষই স্বার্থপর, অসুস্থ রুচির। সেই তুলনায় তার বুবু যেন মিষ্টি কোন ফুলের সুবাসের মতো। এমন বুবুকে নিয়ে যারা কথা তোলে তাদের সাথে সাবের কেন সম্পর্ক রাখবে! এই পৃথিবীতে আসলে কে যে সুস্থ এটা বুঝাই দায়। সাবের নিজেই কি সুস্থ!
সাবের শুনেছে স্নিগ্ধা বিয়ে করে এখন অস্ট্রেলিয়ায় সেটেল্ড। এই খবর শুনে সাবেরের কি বুকের মধ্যে চিনচিন করে ব্যাথা করেনি?
মাঝে মাঝে মনে হয় সে নিজেও মানসিক রোগী।
নাহলে নেলির মতো মিষ্টি স্বভাবের মেয়ের সাথে সে অযথাই রাগারাগি করে। শুধু নেলি কেন তার মেজাজ যাচ্ছেতাই রকমের খারাপ।
সাবের কি চেষ্টা করতে পারেনা আর একটু সহনীয় আচরণ করতে?
নেলি তো তার বন্ধুও হতে পারে, যাহ কি ভাবছে এসব! ওর মতো মানুষের আবার বন্ধু!
নেলিও নির্ঘাত বিপদে পরেই ওকে বিয়ে করেছে।
বাবা নেই, মামার বাড়ি আশ্রিত। না হলে সাবেরদের মতো পাগল পরিবারে কেউ মেয়ে বিয়ে দেয়।
মিথি ভাবিও বুবুকে পছন্দ করেনা।
মিঠুকে তো বুবুর ধার ঘেঁষতে দেয়না।
আর আনাকে ভাবী কোলেও নিতে দেয়না।
একদিন বলছিল সাবেরও নাকি আধা পাগল।
ভাইয়াকেও কথা শোনায় পাগল পরিবার বলে। শান্ত চুপচাপ ভাইয়া চুপ করে থাকে বলে রক্ষা।
সাবেরকে এমন কথা নেলি বললে তো উপায় ছিলোনা।
নেলিও যে ওদের পাগল ভাবেনা তা কে বলবে!
আচ্ছা, সেই কখন থেকে সাবের কি সব ভাবছে!
আজকে কি ওকে ভূতে পেলো নাকি?
তবে এটা ঠিক অনেক দিন পর মনের দরজা খুলে সে ভাবলো। মনের দরজায় আজকাল বারবার নেলির মুখটাই উঁকি দিচ্ছে।
সাবের অনেক দিন পর গুন-গুন করে ” যার চোখ তাকে আর মনে পড়েনা”।
ফিরে ফিরে শুধু নেলির মুখটাই চোখে ভাসছে।
ভালো মুসিবত হলো দেখছি!
চলবে