শেষ_শ্রাবণ পর্বঃ ৩

#শেষ_শ্রাবণ
পর্বঃ ৩
পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছি আমরা তিনজন, বাবা আমি আর সোহেলী। ছোট্ট শ্রাবণ এখনো আম্মার কোলের মধ্যে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে পরম স্বস্তিতে। দুনিয়ায় তার সবচেয়ে শান্তির স্থান যে দুনিয়া থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছে তা তার ছোট্ট মস্তিষ্ক এখনো ধরতে পারেনি। আমার যেনো সব কিছু কল্পনা মনে হচ্ছে। এমন মনে হচ্ছে যে একটু পরেই ঘোর ভেঙ্গে যাবে আর দেখতে পাবো আম্মা খুশিতে ঝলমলিয়ে হাসছে তার ছোট্ট শ্রাবণকে কোলে নিয়ে। সোহেলী আমাকে জড়িয়ে ধরে থরথর করে কাঁপছে। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না সে আর কোনোদিন মা বলে কাউকে ডাকতে পারবে না, কাঁদতেই যেনো ভুলে গেছে সে। এক জোড়া লাল বিস্ফারিত চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে কলিজাটা মোচড় দিয়ে উঠলো আমার। এখনো যেনো এক চিলতে মিষ্টি হাসি ছুঁয়ে আছে তার সারা মুখ জুড়ে। কি সুন্দর লাগছে সে মুখটা। বাবার দিকে তাকানোর সাহস হলো না আমার। বাবার ওই চোখজোড়ার দিকে আমি এখন তাকাতে পারবো না, সে সাহস আমার নেই। শুধু দেখলাম কাঁপতে কাঁপতে ধপ করে আম্মার পাশে যেয়ে বসে পড়লেন। আমি শ্রাবণকে কোলে তুলে নিলাম। সোহেলীকে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে কেবিন রুমের বাইরে চলে আসলাম। মায়ের কোল থেকেই সরাতেই একটু নড়েচড়ে কেঁদে উঠলো বাচ্চাটা। পিছন ঘুরে একবার তাকালাম। বাবা আম্মার হাতটা ধরে চুপচাপ বসে আছে। হাতটা মনে হয় এখনও মমতার উষ্ণতায় তপ্ত।
বাইরে এসে দেখি মাত্রই সাজ্জাদ এসে পৌঁছেছে। আমাদের দেখে ছুটে আসলো সে। সোহেলী তখনও ধাতস্থ হতে পারেনি। এক নাগাড়ে থরথর করে কেঁপে যাচ্ছে সে। সাজ্জাদ আমার কোলে থাকা শ্রাবণকে একটা নজর দেখলো। কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়েই বললো,”রুমকি মা কোথায়? কেমন আছে এখন?”
আমি চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকি। কিছুতেই চোখের পানি সংবরণ করতে পারছি না আমি। ঠোঁট কামড়ে নিচের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলি আমি। সাজ্জাদ আমার কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে সোহেলীর দিকে তাকায় সে। তার রক্তিম চেহারা দেখে ভয় পেয়ে যায় সাজ্জাদ। হালকা চিৎকার করে বলে,” কেউ কি দয়া করে বলবি মা কেমন আছে এখন? কি হয়েছে মায়ের?” সোহেলী কাঁপা কাঁপা দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকায়। কয়েক সেকেন্ড কেউ কোনো কথা বলে না। সাজ্জাদ অসহিষ্ণু হয়ে সোহেলীর দুই বাহু চেপে ঝাঁকি দেয়। “চুপ করে আছিস কেনো? বল না কিছু।” তার গলায় কান্নার স্বর। সোহেলী আর থাকতে পারে না। ভাইয়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে থাকে। কান্নার দমকে কথা বলতে পারে না। সাজ্জাদ মনে হয় কিছু বুঝতে পারে। অসহিষ্ণু সাজ্জাদ হঠাৎ শান্ত হয়ে যায়। কাঁপা কাঁপা হাত দিতে বোনকে জড়িয়ে ধরে। সোহেলী সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে। “ভাইয়া রে আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে রে। আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। মা আর নেই রে ভাইয়া, আমাদের মা আমাদের উপর অভিমান করে অনেক দূরে চলে গেছে।” সোহেলীর কণ্ঠে কি ছিলো আমি জানিনা। নয়টা মাসের পরিচিত সাজ্জাদকে আমার অপরিচিত লাগে। যাকে কখনো কাঁদতে দেখিনি আমি এই কয় মাসে, সে ছোট বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। ছুটে কেবিন রুমের দিকে যায় সে। আমিও যাই পিছু পিছু। যেয়ে দেখি বাবা এখনো আম্মার হাত ধরে বসে আছেন তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। তার চোখে পানি নেই, তবে মুখে এমন কিছু ছিলো যা দেখলে যে কোনো পাষাণের চোখেও পানি চলে আসবে। সাজ্জাদ আম্মার কাছে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে পড়ে। পা দুটো দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে অজস্র চুমু দিতে থাকে। চিৎকার করে কেঁদে উঠে বলে,” মা গো, ও মা। আমারে তুমি ক্ষমা করে দাও না মা। আমি তোমার পাপী ছেলে গো মা। আমি আর কোনোদিন তোমারে কষ্ট দিবো না। তুমি আমারে ছেড়ে এইভাবে চলে যেয়ো না মা। আমারে তুমি ক্ষমা করে দাও।” হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে সে। আমি সেদিকে তাকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে দিই। বাবা সাজ্জাদের দিকে তাকান না। তিনি কোনোদিকেই তাকান না। একদৃষ্টিতে তিনি তার প্রিয়তমাকে শেষ দেখা দেখে নিচ্ছেন। তার স্ত্রীর মুখের এক চিলতে হাসির দিক থেকে চোখ সরাতে পারছেন না তিনি। ততক্ষণে সোহেলী এসে ভাইকে জড়িয়ে ধরেছে পিছন থেকে। ছোট্ট শ্রাবণের হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে হয়তো বুঝতে পারে, মায়ের গন্ধটা আর পায়না।তার ঘুমের মধ্যে কি ঘটে গেলো? সেও তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে। তিন ভাইবোনের আর্তচিৎকারে হাসপাতালের বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। শুধু বাবা এক ফোঁটাও চোখের পানি ফেলতে পারেন না। পাথরের মতো বসে থাকেন চুপ করে।সোহেলী দৌড়ে যেয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। বাবা কিছু বলেন না তাকে।

দেখতে দেখতে তিনটা দিন কেটে গেলো, আম্মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এই তিনদিন বাবা আমাদের কারো সাথে কথা বলেননি। বেশির ভাগ সময় জায়নামাজে বসেই কাটিয়ে দেন। আবার কখনো বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন, পার্থক্য শুধু একটাই কিছুদিন আগে এখানে তিনি বসে থাকতেন তার প্রিয়তমার হাত ধরে, এখন একা। মাঝে মাঝে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি বাবার ঘরে লাইট জ্বলছে।জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি উনি হয় জায়নামাজে বসে কাঁদছেন নাহয় কুরআন শরীফ পড়ছেন।এই বাড়িটায় আগের মতো প্রাণ নেই। আম্মার সেই বালিশ,জায়নামাজ,তসবিহ,পানের বাটা সব আছে, শুধু নেই মানুষটা। এই তিনদিন শ্রাবণ আমার কাছেই থাকে সবসময়। সোহেলী মাঝে মাঝে কোলে নেয়, আমি তখন রান্না করে নিই। রাতেও আমার কাছেই থাকে শ্রাবণ। সাজ্জাদ মায়ের মৃত্যুতে অনেক কাতর এটা বোঝা যায়,কিন্তু এই কয়দিনে শ্রাবণকে একবারও ভালো করে দেখেনি পর্যন্ত সে। রাতে শ্রাবণ আমার কাছে থাকে আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করি আমি শ্রাবণকে ঘুম পাড়াতে আমাদের ঘরে আসলেই সাজ্জাদ বালিশ নিয়ে গেস্টরুমে চলে যায়। আমি খুব অবাক হই ব্যাপারটায়। এমন না যে শ্রাবণ রাতে অনেক বিরক্ত করে। চুপচাপ ঘুমিয়ে থাকে। তারপরও সাজ্জাদ এমন করছে কেনো? আমি ঠিক করেছি আম্মার তিন দিনের মিলাদ হয়ে গেলে ওর সাথে খোলাখুলি এই বিষয়ে কথা বলবো আমি।
মিলাদে আমার পরিবারের সবাই এসেছে। আমি খেয়াল করলাম আমার মা বেশ চুপচাপ তেমন কোনো কথা বলছেন না। আমি শ্রাবণকে দেখালাম তাকে। সে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। মিলাদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমি শ্রাবণকে কোলে নিয়ে ওকে ঘুম পাড়াচ্ছিলাম। এর মধ্যে আমার মা আমাকে আলাদা করে ডাকলেন। আমি বললাম,” কি ব্যাপার মা? কি বলতে আলাদা ডাকলে?”
মা বেশ বিরক্ত হয়ে বললেন,” হ্যা রে রুমকি তোর কি কোনোদিন আক্কেলজ্ঞান হবে না রে?”
আমি বেশ অবাক হলাম,” কেনো মা? কি হয়েছে?”
মায়ের রাগ যেনো আরো বেড়ে গেলো। বেশ ঝাঁঝের সাথে বললেন,” বুঝতে পারছিস না কি হয়েছে? তোর নিজের সংসার নেই?”
“কেনো থাকবে না? অবশ্যই আছে।”
“তাহলে তুই কতোদিন এই পরের বাচ্চা মানুষ করবি?”
আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারিনা। মা এসব কি বলছে? কোনো কথা মুখ দিয়ে বের হয়না আমার।
মা বলে চলে,”নিজের একটা ভবিষ্যৎ তো তোর আছে। কয়দিন পর নিজের বাচ্চাকাচ্চা হবে। এখন তুই শ্বাশুড়ির বাচ্চা মানুষ করবি?”
আমি শক্ত গলায় বলি,” মা, সবাইকে নিয়েই আমার সংসার। শ্রাবণ ও আমার সংসারেরই অংশ।”
“তাই যদি হয় সাজ্জাদ আলাদা ঘুমায় কেনো?”
আমি অবাক হয়ে যাই,সাজ্জাদ যে আলাদা ঘুমায় তা মা কিভাবে জানলো?
“দ্যাখ রুমকি। সাজ্জাদের সাথে আমার কথা হয়েছে। ও নিজেই চায়না তুই এই বাচ্চা মানুষ করিস।”
আশ্চর্যের চরম সীমায় পৌঁছে যাই আমি। আমি ভেবেছিলাম নিজের মায়ের মৃত্যুতে হয়তো সাজ্জাদ একটু শোধরাতে পেরেছে। কিন্তু না ও শোধরানোর মানুষ নয়। মা কে পর্যন্ত সব নালিশ করেছে।
“তবে আমি ওকে কার কাছে রাখবো মা?”
“কেনো? তোর শ্বশুর আছে, ননদ আছে। ওরা রাখবে। তোর কি দায় পড়েছে?”
“বাবার বয়স হয়েছে মা,তাছাড়া সে পুরুষ মানুষ। এতো ছোট বাচ্চা তিনি কিভাবে রাখবেন? আর সোহেলী? ও তো শ্রাবণকে এখনো সেভাবে মেনেই নিতে পারেনি। মাঝে মাঝে যে কোলে নেয় না তা নয়। তবে এতোটাও নয় যে তাকে সবসময় রাখতে পারবে।”
“তাই সব দায় বুঝি তোর? আমি বুঝিনা কিছু? সব তোর শ্বশুর আর ননদের চালাকি। আমার ভালোমানুষ মেয়েটাকে পেয়ে সব ওর ঘাড়ে চাপিয়ে নিশ্চিন্তে আছে। ভাগ্যিস সাজ্জাদ আমাকে আজ সব কিছু বললো। নাহয় আমি তো জানতেই পারতাম না।”
মায়ের কথা শুনে আমি এতোটা অবাক হই যে বলার মতো না। শক্ত গলায় আমি বলি,”মা তুমি হয়তো জানো না, আম্মা মৃত্যুর আগে আমার হাত ধরে আমাকে অনুরোধ করেছেন শ্রাবণকে যেনো আমি লালনপালন করি, তার যেনো কোনো অবহেলা না হয়। আমি একজন মৃত্যু পথযাত্রীকে কথা দিয়েছি। আমি সেই কথা রাখবো। তবে আগামী দুই/চার বছর পর্যন্ত আমার কাছে থাক, ও একটু বড় হোক এরপর বাবার কাছে থাকবে। তবে এতো ছোট বাচ্চাকে আমি আর কারো কাছে রাখবো না।”
“ততদিন সাজ্জাদ তাহলে আলাদা থাকবে?”
আমি আস্তে করে বলি,”আমি তো ওকে আলাদা থাকতে বলিনি।”
মা কোনো কথা না বলে রাগে গজগজ করতে করতে উঠে চলে যান।

সে রাতে সাজ্জাদের সাথে আমার বেশ কথা কাটাকাটি হয়। আমি শ্রাবণকে নিয়ে আমাদের ঘরে আসার সাথে সাথে সাজ্জাদ বলে,”আমার ঘরে ওকে আমি রাখবো না।”
“বেশ তবে আমি অন্য ঘরে যাচ্ছি ওকে নিয়ে।” সাজ্জাদ পিছন থেকে এসে আমার হাত মুচড়ে ধরে,”খুব বেড়েছো কিন্তু তুমি রুমকি।”
ব্যথায় হাতটা অবশ হয়ে আসে আমার। হাত ছাড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলি,”লজ্জা করে না তোমার? তোমার মা মারা গেছে মাত্র তিনদিন হলো। এর মধ্যে এসব বলা শুরু করেছো।খুব তো মায়ের জন্য কান্নাকাটি করলে। সব কি নাটক ছিলো?
সাজ্জাদ রাগে কাঁপতে থাকে,রোষের সাথে বলে,”লজ্জা তোমার করে না? স্বামীকে অন্যঘরে রেখে পরের বাচ্চা মানুষ করছো।” অবাক হয়ে তাকাই আমি।
“পরের বাচ্চা? কাকে তুমি পরের বাচ্চা বলছো? ও তোমার ভাই, তোমার রক্ত, এটা কি ভুলে গেছো তুমি?”
“ভাই? আমার কোনো ভাইয়ের দরকার নেই। যে ভাই আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী, সে ভাই এর কোনো প্রয়োজন নেই আমার।”
“মুখ সামলে কথা বলো। কি ভাষা এগুলো তোমার ছোটলোকের মতো? একটা ছোট বাচ্চা, তাকে নিয়ে এতো বাজে কথা তুমি বলতে পারো?”
“হ্যা আমি তো ছোটলোক। আর তুমি তো মাদার তেরেসা হয়েছো। একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো। ও আমার কিছু হয়না। আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য ও দায়ী।”
আমি টিটকারি সূচক একটা হাসি দিয়ে বলি,” ওহ তাইনা? আর দিনের পর দিন যে নিজের মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করে এসেছো। তার খোঁজ নাও নি। তাকে প্রতিনিয়ত মানসিক কষ্ট দিয়েছো। এসব ব্যবহার তোমার মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়?”
রাগে চোখমুখ লাল হয়ে আসে সাজ্জাদের, কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় বাবা ডাক দেন আমাকে।
“মামণি একটু বাইরে এসো তো শ্রাবণকে নিয়ে।”
আমি বেশ অবাক হই। এই তিনদিন বাবা কারো সাথে কথা বলেননি। আজ হঠাৎ এতো রাতে উনি এসেছেন। আমি চাপা গলায় সাজ্জাদকে বলি,”বাবার সামনে কোনো সিনক্রিয়েট করবে না তুমি।” এই বলে ঘর থেকে বের হয়ে আসি আমি, সাজ্জাদ রাগে ফুঁসতে থাকে।
“বাবা আপনি ঘুমাননি যে, এতো রাত হলো।”
বাবা আস্তে করে আমার কাছ থেকে শ্রাবণকে কোলে নেয়। ওর কপালে ছোট্ট করে একটা চুমু দেয়। এরপর আস্তে করে বলে,” ও আজকে থেকে আমার কাছে থাকবে মামণি, এই কয়দিন তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে। আমি নিজেকে একটু সামলে নিলাম এই কয়দিনে।এর জন্য ক্ষমা চাচ্ছি তোমার কাছে। তবে আজ থেকে ও আমার কাছেই থাকবে।” আমি চমকে উঠি বাবার কথা শুনে। তার মানে কি বাবা সব শুনতে পেরেছেন সাজ্জাদের কথা? আমি বাবাকে কিছু একটা বলে বাধা দিতে যাই। বাবা আমাকে কোনো কথা বলার সুযোগ দেন না। যেতে যেতে পিছন ঘুরে বলেন,”আমাদের জন্য তোমাদের নিজেদের মধ্যে কোনো অশান্তি করোনা মামণি। মা ছাড়াও শুধু বাবার কাছে সন্তান মানুষ হতে পারে,শ্রাবণও পারবে।”
আমি দরজায় হেলান দিয়ে ঠাঁয় দাঁড়ায় থাকি,চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে আমার।

আমি ঘরে ফিরে আসি। ঘৃণায় আমার ইচ্ছা হয়না এই ঘরে থাকতে। তবুও বাবার জন্য আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকলাম। শ্রাবণকে নিয়ে যাওয়াতে সাজ্জাদ মনে হয় বেশ খুশি হয়েছে। আমাকে বললো,”তোমাকে অনেক আগেই আমি বলেছিলাম, এ বাড়িতে আমার বউ হয়ে এসেছো, আমি যা বলবো যেভাবে বলবো সেভাবে চলবে। বাড়াবাড়ি করবে না। কিন্তু তুমি আমার কোনো কথা শুনতে চাও নি কখনো। সবসময় আগ বাড়িয়ে সব সিদ্ধান্ত একা নেওয়া তোমার একটা স্বভাব। এসব আমি অপছন্দ করি। এসব অভ্যাস বদলাও।”
রাগে কান গরম হয়ে আসে আমার। ওর দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় রোষের সাথে বলি,” আমার নিজের কোনো অভিমত নেই?তোমার জন্য আমার নিজেকে বদলাতে হবে? আজ তোমাদের জন্য, হ্যা আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি আজ তোমাদের দুই ভাইবোনের থেকে পাওয়া মানসিক কষ্টের জন্য মৃত্যুর আগের কয়টা দিন একটা মানুষ শান্তিতে থাকতে পারলেন না, যিনি বেঁচে আছেন তাকেও কম কষ্টের মধ্যে তোমরা রাখো নি। মানুষ দেখানো নাটক করলে মায়ের মৃত্যুতে। তুমি যদি সত্যি তোমার মায়ের জন্য শোক প্রকাশ করতে তবে তার কলিজার টুকরো ছেলেটা, যে কিনা একটা দুধের শিশু, একটা নিষ্পাপ বাচ্চা তার দিকে তাকিয়ে নিজের মায়ের মুখটা দেখতে পেতে। তোমাকে এতোদিন একটু কঠোর মনে হলেও তুমি যে এতো বড় অমানুষ আমি তা কখনো বুঝতে পারিনি।” সাজ্জাদ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় কখনো ধারণা করতে পারেনি যে রুমকি তার সব কথায় সম্মতি জানিয়ে এসেছে সবসময় সে তার মুখের উপর এতোগুলা কথা বলে দিবে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে সে।

আমার ঘুম আসে না। একা একা বারান্দায় যেয়ে দাঁড়াই মনে পড়ে যায় আম্মার কথাগুলো। “ওকে তুমি দেখো নাহলে যে আমি কোথাও যেয়ে শান্তি পাবো না।” আমি কি তবে আম্মাকে দেওয়া কথা রাখতে পারবো না? চোখটা বন্ধ করলেই আম্মার হাসি হাসি মুখটা ভেসে ওঠে, তিনি যেনো আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি, মনে মনে ভাবি আমি কি কোনোদিন পারবো এই সংসারটিকে আগলে রাখতে? সাজ্জাদ,সোহেলী আর শ্রাবণের মাঝে বন্ধন তৈরি করে দিতে? বাবার মুখে আবার হাসি ফোটাতে?
চলবে……

Methela Jaman Neva

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here