#শেষ_বিকালের_আলো(শেষ পর্ব)
অবনী ব্যাগ গুছিয়ে ফেলেছিলো এখান থেকে অন্যত্র চলে যাবে বলে…সকালে চলে যাওয়ার আগে কাকিমার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো তার বাসায়…
কাকিমাকে মনে হলো এই কয়দিনে অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। অবনী বিষয়টা প্রকাশ না করলেও বুঝতে পেরেছে যে কাকিমা হয়তো আগের ঘটনা জেনে গিয়েছে তাই নিজে থেকে অবনীর সামনে একবারও আসেনি।
আগের যত যত্ন আর ভালোবাসা এক নিমিষেই চলে গেলো। অবনীর মনে মনে কষ্ট পেলেও তার অন্য কষ্টের ভার যে এত বেশি যে এটার জন্য আলাদা করে আর ভাবতে পারছেনা।
কাকিমার এই রাগের পিছনে সবচেয়ে বড় একটা কারণ আছে।
অবনী যখন সকালে কাকিমার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো তখন আকাশ বলেছে এই বাড়ি থেকে তোর যাওয়ার কোন দরকার নেই অবনী।তুই এই বাড়িতেই থাকবি অবনী, আমিই চলে যাচ্ছি। তুই থাকা অবস্থায় আর কখনো এই বাড়িতে আমি আসবোনা কথা দিচ্ছি। আমি জানি তুই আমার জন্যই এই বাড়ি থেকে চলে যেতে চাস।
কাকিমা কোনভাবেই এটা মেনে নিতে পারেনি। মেনে না নেয়াটাই আসলে স্বাভাবিক। অবনী জানে আকাশ কাকিমার কতখানি জুড়ে আছে।
অবনী তারপরও বলে এসেছিলো এখানে থাকা সম্ভব নয়,আর থাকলেও কাকিমার হয়তো আর ভালো লাগবেনা। আকাশ কিছুক্ষণ পরেই চলে গিয়েছিলো বাড়ি থেকে। যাওয়ার সময় অবনীকে বলে গিয়েছিলো…”অবনী আমার তো আর কখনো হলি না কিন্তু এই বাড়িটায় তুই থাকলে আমার খুব ভালো লাগবে। সবসময় না থাকলেও অন্তত মাঝে মাঝে আসিস।তোর জন্যই তো এতকিছু করা আমার”
অরণ্য ভাই যে তোকে ভুল বুঝেছে তুই বললে আমি তাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে পারি। অবনী আকাশকে বারণ করেছিলো। আর কোন কথাই সে আকাশের সাথে বলেনি।
আকাশ চলে যাওয়ার পরপরই যখন ভাবছে এখন সে কি করবে তখনই রাহেলা খালার ফোন…
রাহেলা খালার কথাগুলো অবনীর মাথার মধ্যে ভন ভন করে ঘুরছে…অরণ্য তার সাথে এত বড় প্রতারণা করতে পারলো! কিভাবে সম্ভব! এমনকি লিনসাও এই একদিনে যেন অপরিচিত হয়ে গিয়েছে বাবার কাছে গিয়ে!
কিন্তু লিনসা তো বুঝতে পারছেনা…আসলে কি ঘটতে যাচ্ছে তার প্রিয় বাবার জীবনে।
অবনীর কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে লিনসার সাথে কথা বলে…শেষ পর্যন্ত যে মেয়েকে নিয়ে সে সন্দেহ করে বাসা থেকে চলে এসেছে সেই মেয়েকে নিয়েই ঘটনা আর এজন্যই অরণ্য আকাশকে নিয়ে যাচ্ছেতাই বলে গিয়েছে কোন কথা না শুনেই। যাতে সে তার উদ্দেশ্য সফল করতে পারে।
অবনী ভাবছে, মা,বাবাকে কি একটা ফোন দেবে! তারা কি জানে তাদের আদরের জামাই কি করছে!
পরক্ষণেই ভাবলো নাহ্ সে নিজেই যাবে! অরণ্যকে এভাবে ছেড়ে দেয়া যায়না। অরণ্য কি সব আইনের উর্ধ্বে চলে গেলো। কোন কিছু না বলে কয়ে হঠাৎ করেই একটা বিয়ে করে ফেলবে!
অবনী আর ভাবতে পারছেনা! অরণ্যকে ছাড়া সে কিভাবে বাঁচবে! এত সহজেই অরণ্য অন্য কারও হয়ে যাবে এটা সে কিভাবে মেনে নেবে! অরণ্য যা ভেবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতো সঠিক নয় কিন্তু সে যা ভেবেছে অরণ্যের বেলায় তা সত্য তার প্রমাণ তো অরণ্য নিজেই দিচ্ছে এখন।
অবনী এর শেষ দেখতে চায়! তিলতিল করে গড়ে তোলা তার বাড়ি, সংসার, বাগান তা কিনা এক নিমিষেই অন্য কারও হয়ে যাবে এটা তো কোনভাবেই সম্ভব না।
অবনী আবার রাহেলা খালাকে ফোন দিলো… রাহেলা খালা ফোন ধরতেই অবনী জিজ্ঞেস করলো,খালা বিয়ে কখন হবে নাকি হয়ে গিয়েছে!
রাহেলা খালা বলল, আফা বাদ আসর কলমা পড়াইবো বিয়ার। আপনে কি আইবেন? অবনী কথার উত্তর না দিয়েই লাইন কেটে দিলো।
হাতে বেশি সময় নেই, এখনি বের হতে হবে বিয়ে আটকাতে হলে!অবনী ঝটপট রেডি হয়ে লিনিয়াকে নিয়ে বাগান বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো।শুধু
মোবাইল আর টাকা নিয়ে।
অবনী এই বাড়িতে ঢোকার পর থেকে একবারও বের হয়নি।এই প্রথম বের হলো এতদিনের মধ্যে। রাস্তাঘাট একটু অপরিচিতও লাগছে কেমন!
অবনী যাচ্ছে তো যাচ্ছেই কিন্তু পথ মনে হয় আর ফুরাচ্ছে না…এই বাড়িতে আসার সময়টাতেও অবনীর এমন লেগেছিলো!লিনিয়া জিজ্ঞেস করলো আম্মু আমরা কি লিন আপুর কাছে যাচ্ছি? আরও অনেক প্রশ্ন করতে লাগলো!
অবনী কোন কথাই বলতে পারছেনা…শুধু বলল হুম…অবনীর মনে হচ্ছে সে পাথর হয়ে গিয়েছে,তার কোন কান্না পাচ্ছেনা,চোখের পানি মনে হয় শুকিয়ে গিয়েছে।
কথায় আছেনা”অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর ”
রুদ্র সাদিয়ার পারলারের সামনে অপেক্ষা করছে…একটু পরেই সাদিয়া বের হলো।রুদ্র অপলক দৃষ্টিতে সাদিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।পরীও মনে হয় সাদিয়ার কাছে হার মানবে আজ!
সাদিয়া এসে রুদ্রর চোখের সামনে তুড়ি বাজাতে রুদ্র হেসে ফেলল। সাদিয়াকে বলল,তোমাকে পরীর মত সুন্দর লাগছে সাদিয়া।
সাদিয়া একটু লজ্জা পেয়ে বলল…তাই বুঝি! রুদ্র আর সাদিয়া বাসায় এসে ঢুকলো। বাসায় এসে দেখে সবাই তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
সাদিয়া তার রুমে চলে গেলো। রুমে ঢুকতেই দেখলো…পুরো রুম ফুল দিয়ে সাজানো।তার এত ভালো লাগলো।মনে মনে বলল, উপরওয়ালা যেন তার ভাইয়ের সব ইচ্ছে পূরণ করে দেয়।
অরণ্য ভাইকে প্রথম কতই না জটিল আর মুডি মনে হয়েছে কিন্তু ভাবী এভাবে চলে যাওয়াতে মানুষটা একদম নরম হয়ে গিয়েছে।
অরণ্য বলল,সবাই হালকা কিছু খেয়ে রেস্ট নিলে ভালো হয়। শুভকাজ হয়ে যাওয়ার পরে আমরা একসাথে সবাই খেতে চাই।আসলে অরণ্য মনে মনে চাইছে অবনীও যাতে তাদের সাথে খেতে পারে।
অরণ্যের মন বলছে অবনী আসবে!!!…তাকে আসতেই হবে যে! অবনী ছাড়া প্রতিটা দিন তার কাছে অসহ্য লাগছে।কতদিন অবনীর হাতে খায়না।কতদিন অবনী রাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়না।আরও কত কি!!!
রাহেলা খালা সবাইকে চা নাস্তা দিলো…অরণ্য ঝটপট খেয়ে বাইরে বের হলো।একটু শপিংয়ে যেতে হবে।তাড়াহুড়ায় আর টেনশনে একদম খেয়াল ছিলোনা যে অন্য সবার জন্যও কেনাকাটা করতে হবে।
অরণ্য প্রথমেই মার্কেটের কিডস জোনে ঢুকে লিনসা আর লিনিয়ার জন্য সাইজ অনুযায়ী ২ টা সাদা ফ্রক কিনে অন্য সাইডে গেলো।এরপর ২ বাবার জন্য পায়জামা,পাঞ্জাবী, নিজের জন্য ধবধবে সাদা পায়জামা,শেরোয়ানি স্টাইলের পাঞ্জাবী সাথে পাগড়ী নিলো।
এরপর আম্মার জন্য আর রাহেলা খালার জন্য শাড়ি নিলো। এবার অবনীর পালা…এটা কিনতে গিয়ে একটু চিন্তায় পড়ে গেলো। কারণ অবনী খুবই চুজি। শপিংয়ের ব্যাপারটা অবনী একাই সামলাতো মোটামুটি। অরণ্য অকেশনালি যেত অবনীর সাথে।
হঠাৎ করেই মনে হলো…অবনী জামদানি শাড়ি খুব পছন্দ করে। অরণ্য অনেক জামদানির মধ্য থেকে সোনালি কাজ করা একটা সাদা জামদানি অবনীর জন্য পছন্দ করলো।
অরণ্যের শপিং প্রায় শেষের দিকে।যদিও কেনাকাটায় আনাড়ি দেখে একটু দেরি হয়ে গিয়েছে। বাবা ফোন দিয়েছে,কাজি সাহেব চলে এসেছেন। অরণ্য জিজ্ঞেস করলো আর কেউ আসেনি বাবা? বাবা বলল,কার কথা বলছো অরণ্য! অরণ্য আর কিছু না বলে ফোন রেখে দিলো।
অরণ্য বাসার কাছাকাছিই শপিং এ গিয়েছিলো তাই বাসায় ফিরতে ১০ মিনিটের মত লাগলো। আসার পথে ফুলের দোকান থেকে অবনীর প্রিয় বেলী ফুলের মালা নিলো অনেকগুলো।খোঁপায় পরার জন্য।
বাসায় এসে সবাইকে সবার শাড়ি,পাঞ্জাবী বুঝিয়ে দিলো।আসরের আযান হতে আর আধা ঘন্টার মত বাকি আছে।
সবাইকে রেডি হতে বলল অরণ্য। রাহেলা খালা খুব খুশি নতুন শাড়ি পেয়ে। লিনসাকে ড্রেস দিতেই বলল…বাবা আম্মু তো এখনো আসছেনা!
অরণ্য খুব আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল,আসবে মা আসবে…তুমি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। অরণ্য নিজেও রেডি হয়ে নিলো।
রেডি হয়ে অরণ্য আয়নার সামনে দাঁড়ালো। পাগড়ি পরার কারণে তাকে একদম নতুন জামাইয়ের মত লাগছে।অরণ্য মনে মনে বলল,শালার বিয়েতে তো একটু পাগড়ি পরা যেতেই পারে!!!
এরমধ্যে লিনসাও তার ড্রেস পরে হাজির।লিনসাকে একদম ছোট্ট পরীর মত লাগছে দেখতে।অরণ্য লিনিয়ার ড্রেসটা লিনসার হাতে দিয়ে বলল,এটা লিনিয়া আসলে ওকে পরিয়ে দিও মামনী।
লিনসা জিজ্ঞেস করলো,আম্মুর জন্য আনোনি বাবা! তোমার আম্মুর জন্য আনবোনা তাই কি হয় বাবা!
ওই যে খাটের উপরে রেখে দিয়েছি তোমার আম্মুর শাড়ি।অরণ্যর মধ্যে ভয় কাজ করছে এখন।আসরের আযানের শব্দ শোনা যাচ্ছে অবনী কি তাহলে আসবেনা।এতটা ইগো অবনীর!!!
অরণ্য শুনতে পাচ্ছে তার বাবা তাকে ডাকছে।অরণ্য পাগড়ি হাতে নিয়ে লিনসাকে নিয়ে সামনে গেলো। সবাই অরণ্যের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
অরণ্য বুঝতে পারছে এই চাহনির মানে কি! অরণ্যের নিজেকে চোরের মত মনে হচ্ছে। সবাই এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন সে খুব বড় কিছু চুরি করে ফেলেছে!
বিশেষ করে অবনীর বাবা,মা খুবই অবিশ্বাসের চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে! আসলেই অরণ্য তাদের জীবন থেকে অনেক বিশেষ কিছু চুরি করে নিয়েছে!!! অরণ্য কথা দিয়েছিলো এই বিয়েতে অবনী থাকবে!কিন্তু….
অরণ্য আর নিতে পারছেনা…মনে মনে বলছে অবনী কই তুমি! আর কতদূর! আমাকে তুমি বাঁচাও!!!
সবার নিরবতা ভাঙলো কাজি সাহেব…আসরের আযান তো শেষ হয়ে গিয়েছে। বিয়ের কাজ কি শুরু করবো এখন?
অরণ্যর খুব কষ্ট হচ্ছিল কথা বলতে, তারপরও খুব দৃঢ়চিত্তে বলল…আর একটু অপেক্ষা করতে হবে কাজি সাহেব আমার ওয়াইফ এসে পৌঁছায়নি এখনও।
এটা বলেই অরণ্য সবার সামনে থেকে চলে গেলো! অরণ্য ছাদে গেলো…বাড়ির সামনের গেইটের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে গুনতে লাগলো…অবনী আমি আর ১০ গুনবো….অরণ্য গুনতে লাগলো…
১..২..৩..৪..৫..৬..৭..৮..৯.. দশ গোনার আগেই বাসার সামনে রিকশা থামার শব্দ পেলো। অরণ্য চোখ খুলে দেখতে পেলো…একটা রিকশা থেমেছে বাসার মেইন গেইটের সামনে…
হুম আমার মহারানী রিকশা থেকে রাজকন্যাকে নিয়ে হন্তদন্ত করে নামছে,চুল এলোমেলো। রিকশা ভাড়া দিচ্ছে….
অরণ্য এক দৌড়ে নিচে নেমে এলো…এসেই বাচ্চাদের মত আনন্দে গদগদ করতে করতে সবার উদ্দেশ্যে বলল,অবনী চলে এসেছে!!!
অবনীর মা বাবা আলহামদুলিল্লাহ বলে উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেলো।সবাই খুব খুশি।শুধু কাজি সাহেব মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলেন না।
তিনি হাঁ করে সবার মুখের দিকে চেয়ে বেড়াচ্ছে।অরণ্য দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে লুকিং গ্লাস দিয়ে তাকিয়ে আছে!
অবনী লিনিয়াকে কোলে নিয়ে মোটামুটি দৌড়ে দরজার কাছে আসলো।এসেই কলিং বেল বাজাতে লাগলো…ঘন ঘন কয়েকবার…অরণ্য দরজা খুলছেনা।অবনীর অরণ্যের জন্য এই অস্থির মুখখানা দেখতে কেমন যেন ভালো লাগছে!!!
এবার লিনিয়া ডাকতে লাগলো…বাবা…বাবা…নাহ্ এবার খুলতে হয়। মেয়ে ডাকছে…
অরণ্য পাগড়িটা ভালো করে পরে নিয়ে দরজাটা খুললো!
অবনী অরণ্যের দিকে হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইলো। চোখে মুখে তার অবিশ্বাসের ছাপ! লিনিয়া কিছুই বুঝলোনা সে তার মায়ের কোল থেকে নেমে লিন আপু…লিন আপু ডাকতে ডাকতে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলো।
অবনী যত শক্ত হয়ে এসেছিলো যে অরণ্যকে অনেক কিছু বলবে…তাকে ছেড়ে দেবেনা এসব…কিন্তু অরণ্যের এই জামাই সেজে থাকা রুপ দেখে অবনীর সব গুলিয়ে গেলো যেন!
অবনী অরণ্যকে শুধু জিজ্ঞেস করলো”অরণ্য তুমি কি বিয়ে করে ফেলেছো!”অবনী এত করুণভাবে কথাটা জিজ্ঞেস করলো যে মেয়েটাকে আর কষ্ট দিতে মন চাইছেনা।এতদিনে অনেক ধকল গিয়েছে অবনীর উপরে।চেহারা দেখলেই বোঝা যাচ্ছে।
অরণ্য কোন কথা বলছেনা দেখে অবনী আবার প্রশ্ন করলো…অরণ্য কথা বলছো না কেন! যদি বিয়ে সম্পন্ন হয়ে থাকে তাহলে বলো এই ঘরে আর পা…. অরণ্য অবনীকে কথা শেষ করতে দিলোনা,অবনীর মুখ চেপে ধরে জড়িয়ে ধরলো।
অবনী এবার পাথর ভেঙে হুহু করে বাচ্চাদের মত কান্না জুড়ে দিলো। অরণ্য বুঝতে পারছে সবাই এই কান্না শুনছে কিন্তু তাও অরণ্য অবনীর কান্না থামালো না। অরণ্য নিজেও তার চোখকে সামাল দিতে পারেনি।এই চোখের পানিগুলো বড্ড বেহায়া।কোন নোটিশ ছাড়াই যখন তখন চলে আসে।
অরণ্য একটু পরে অবনীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,এবার একটু শান্ত হও অবনী।বাসায় অনেক গেস্ট আছে।এসো ভিতরে এসো।
অবনী ওড়না দিয়ে চোখের পানি মুছে অরণ্যের হাত ধরে ঘরের ভিতরে ঢুকলো। দেখলো ড্রয়িং রুমে সবাই বসে আছে। রুদ্রকে দেখলো জামাই সেজে আছে। পাশে খুব সুন্দর একটা বউ।এই মেয়েই কি সাদিয়া তাহলে!
আজ কি তাহলে সাদিয়ার সাথে রুদ্রর বিয়ে কিন্তু কিভাবে! সাদিয়াকে ওইদিন যে দেখেছে আজ বউ সাজার কারণে চেহারা ভালো করে মনে করতে পারছেনা।
ওইদিন তাহলে রুদ্রর সাথে সাদিয়া ছিলো! অবনীর সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে ।কি থেকে কি হচ্ছে এসব! তাহলে সেকি বুঝতে এত বড় ভুল করলো অরণ্যকে!
অরণ্য অবনীর অবস্থা বুঝতে পেরে পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক করার জন্য বলল,অবনী তুমি ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নাও।আমরা এতক্ষণ তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।রুদ্রর বিয়ের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
অবনী আর কিছু না বলে তার রুমে চলে গেলো! রুমে ঢুকেই দেখলো তার দুটো পরী নতুন সাদা ফ্রক পরে বসে আছে।অবনী রুমে ঢুকতেই লিনসা তাকে জড়িয়ে ধরলো।
আম্মু বাবা তোমার জন্য শাড়ি কিনে রেখেছে,তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। এটা বলেই লিনসা আর লিনিয়া রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
অবনী তাকিয়ে দেখলো বিছানার উপরে সাদা জামদানি শাড়ি আর বেলী ফুল রাখা।রুমটা একদম পরিপাটি করে গুছানো।
রজনীগন্ধা আর গোলাপের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে আছে ঘরময়। অবনীর সবকিছু স্বপ্নের মত লাগছে।অবনী নিজেকে চিমটি কেটে দেখলো যে সে স্বপ্ন দেখছে কিনা!নাহ্ স্বপ্ন দেখছেনা।
বাইরে থেকে অরণ্যের ডাক শুনতে পেলো…অবনী একটু তাড়াতাড়ি করো।
অবনী তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো, ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে শাড়ি পরলো,প্রায় শেষ এরমধ্যেই অরণ্য ঢুকলো রুমে।অরণ্য বলল,কোন হেল্প লাগবে অবনী?
অরণ্য একদম স্বাভাবিক আচরণ করছে।অবনী বুঝতে পারছে অরণ্য কোন হেল্পের কথা জিজ্ঞেস করছে!অবনী শাড়ি পরলে অবনী সবসময় শাড়ির কুচি ঠিক করে দিতে বলতো।
অবনী কিছু বলছেনা দেখে অরণ্য নিজেই এসে শাড়ির কুচি ধরলো। তারপর অবনীর খোপায় বেলী ফুল লাগিয়ে দিলো। অবনী অরণ্যের এমন আচরণে একটু অবাক হলেও কিছু বলল না।
অবনী কিছু জিজ্ঞেস না করলেও অরণ্য সাদিয়ার কথা A to Z অবনীকে বলতে বলল।অবনী সব শুনে শুধু বলল,আমাকে এটা আগে বললেই তো পারতে অরণ্য।অরণ্য বলল, আমি এটা বলতেই তোমাকে পুলিশ ট্রাকিং করে খুঁজে বের করেছিলাম,তোমার ভুল ভাঙানোর জন্য।তারপর যা ঘটলো তাতো তুমি জানোই…
যাই হোক, আমার তো মনে হয়, না বলেই ভালো করেছিলাম।এই বলে হেসে দিয়েই চলে গেলো আর যেতে যেতে বলল,অবনী আর দেরি করোনা এসো এখন…বলে অরণ্য ড্রয়িং রুমে চলে গেলো। ড্রয়িং রুমে গিয়ে বলল,কাজি সাহেব আপনার কাজ শুরু করেন।
অবনী একটু হালকা সেজেই রুম থেকে বের হলো।রুম থেকে বের হতেই অরণ্য বলল,অবনী এখানে এসো,বসো।অবনী দেখলো অরণ্য তার পাশে অবনীকে বসতে বলছে।
অবনীর কেন যেন নিজেকে মেহমানের মত লাগছে বাসায় এসে।অরণ্যের খাতির যত্ন,এসেই বাসার মধ্যে বিয়ের আয়োজনে এটেন্ড করা।
বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলে সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া করে নিলো। অবনী তখন রাহেলা খালাকে বলল,খালা তোমার খবর আছে দেখো!
রাহেলা খালা দুই পাটি পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হেসে হেসে বলল… আফা আপনে আইছেন এহন যা খুশি কইরেন আমি সবতায় রাজি আছি…এটা বলতে বলতে কেঁদে ফেলল।
খাওয়া শেষ হয়ে কাজি সাহেব চলে যাওয়ার পরে অবনীর মা এসেও মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করলো…এভাবে কেন কষ্ট দিলো অবনী সবাইকে এই অভিযোগ করতে লাগলো!
অবনী তার মা বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলো। তার ভুল হয়েছে এমন করা সেটা স্বীকার করলো মায়ের কাছে।
পরিবেশ একটু শান্ত হলেই সাদিয়াকে আম্মা আর রাহেলা খালা তার রুমে নিয়ে গেলো।লিনসা আর লিনিয়াও অবনীকে টেনে নিয়ে বউ এর পিছু পিছু গেলো।
সবাই রুমে ঢুকতেই সাদিয়া অবনীর হাত ধরে বলল, ভাবী আমাকে মাফ করে দাও…আমার জন্যই আসলে এত ঘটনা ঘটেছে।তুমি খুব কষ্ট পেয়েছো,আসলে আমার কোন উপায় ছিলোনা!এক নি:শ্বাসে বলে যাচ্ছে সাদিয়া!
অবনী তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,আমি কিছুটা শুনেছি তোমার ভাইয়ার কাছে তাতে তোমার কোন দোষ নেই।আসলে এমন ঘটার ছিলো তাই ঘটেছে।সবকিছুতো আর নিয়ম অনুযায়ী হবেনা। তবে কিছু ঘটনা ঘটলেই ভালো তাতে অনেক কিছু পরিস্কার হয়ে যায়।
একটু পরেই অবনী বের হয়ে রুদ্রকে কানে ধরে বললো,যা বউ এর কাছে যা! পরে তোর খবর আছে! সবাই আরও পরে বের হয়ে আসলে রুদ্র রুমে ঢুকলো।
অবনী কিছু না বলেই ছাদের দিকে চলে গেলো। অরণ্য তার জামাই পোশাক ছেড়ে অন্য পোশাক পরে নিলো।
তারপর ছাদের দিকে গেলো অবনীর কাছে… অরণ্য ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে অবনী এক দৃষ্টিতে লাল সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। কত যুগ পরে যেন সে অবনীকে এভাবে অপলক নয়নে দেখছে। #শেষ_বিকালের_আলো এসে পরেছে অবনীর মুখের উপরে। অবনীকে দেখতে একদম দেবীর মত লাগছে!
এই আলোটাকে কি বলে ঠিক মনে করতে পারছেনা অরণ্য… গোধূলি আলো নাকি কণে দেখা আলো!!!
সে যাই হোক যে আলোই হোক না কেন! এই মুহুর্তে অবনীকে তার আগের মত প্রপোজ করতে মন চাচ্ছে। বিয়ের আগে অবনীকে যখন ভালো লাগতো হঠাৎ করেই সিনেমার নায়কের মত একদিন হাটু গেড়ে দোলনচাঁপা ফুল দিয়ে প্রপোজ করেছিলো।
অরণ্য কখন এসেছে অবনী তাকে খেয়াল করেনি এখনও। অরণ্য অবনীর পেছন দিকটায় গিয়ে দোলনচাঁপার থোকা ছিঁড়লো কয়েকটা। তারপর হুট করে গিয়েই অবনীর সামনে হাটু গেড়ে বসে দোলনচাঁপা ফুল বাড়িয়ে দিয়ে সে আগের স্টাইলে চোখ বন্ধ করে বলল”আই লাভ ইউ অবনী”
অবনী অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো…অরণ্যের দিকে তাকিয়ে আছে অবনী কিছুই বলছে না…অবনীর কেন যেন এখনো ঘোর কাটেনি।
অরণ্য আবার বলল…অবনী আমি তোমাকে ভালোবাসি।অবনী এবার অরণ্যের হাত থেকে ফুলগুলো নিয়ে অরণ্যকে জড়িয়ে ধরে বলল,”আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি অরণ্য।”
অরণ্য বলতে লাগলো…আমাকে আর কখনো ছেড়ে যেওনা অবনী। তোমাকে ছাড়া আমার খুব অসহায় অসহায় লাগে!
আর যাবোনা….কিন্তু তুমি আমার সাথে এমন কঠিন খেলাটা না খেললেও পারতে অরণ্য। আমি সরি অবনী,আমার সব ভুলের জন্য আমি সরি…তুমি আমাকে মাফ করে দিও।অরণ্য….আমিও সরি আমার ভুলের জন্য।
এভাবে কতক্ষণ যে তারা জড়িয়ে ধরে কথা বলতে লাগলো অরণ্য আর অবনীর সে হিসেব নেই।
চারিদিকে এলোএলো সমীরণে ফুলের মোহময় সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে যেন!অরণ্য আর অবনীও মন্ত্রমুগ্ধের মত দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে আছে। বহুকাল পরে যেন এই প্রেম ধরা পরেছে তাদের জালে, যা শেষ হবার নয়♥️♥️
বি:দ্র: আরও কিছু পর্ব করতে পারতাম কিন্তু অনেক জায়গা থেকেই শর্ট করে দিয়েছি গল্প শেষ করার জন্য।আশাকরি ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
#লেখনীতে_নুসু