শূন্যতায় অস্তিত্ব (৮ম পর্ব)

শূন্যতায় অস্তিত্ব (৮ম পর্ব)
লেখাঃ তাজরীন খন্দকার

তখন বাবা প্রথম দেখেছিলো তিয়াসকে। আর আমি চেয়েছিলাম শেষবার দেখতে! কিন্তু হয়ে উঠেনি।

ছয়-সাত মাসে অতিরিক্ত টেনশন, অযত্ন, নির্ঘুমের জন্য প্রচুর চুল ঝড়তো। এরপর রাগ করে চুল ছোট করে ফেলেছিলাম। সেটা তিয়াস আজ লক্ষ্য করেছিলো হয়তো।

সেদিনের পর আমার জীবনের পুরো মোড়টাই ঘুরে গিয়েছিল। ইউভার্সিটিতে পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ততা, তার ফাঁকে বাবার বোজা হালকা করার জন্য দুই-একটা টিউশনিও করাতাম। অবশ্য টিউশনিতে আমার আলাদা একটা সম্মান ছিল সবসময়। এমনো হয়েছে গার্ডিয়ানরা অনেকমাস ঘুরার পরে আমি তাদেরকে সময় দিতে পেরেছি। কেননা আমি আমার পড়ালেখার প্রতিই মনোযোগী ছিলাম বেশি।
সেটাই প্রথমবার ছিল, তিয়াসদের বাসায় ফোন নিয়ে লজ্জাজনক কথা শুনেছি ৷ সত্যি বলতে যেই মানুষটাই লজ্জাহীন, বেহায়া! তার দ্বারা ভালো ব্যবহার কীভাবে সম্ভব?
তবে সেটা যেমন পরিবারই হতো আমি সেদিনের পর ভুলেও ওখানে পা রাখতাম না। কারণ আর যাই হোক আত্মসম্মানবোধ আমার মধ্যে জাগ্রত হয়েছে বহু আগেই।



চার বছরেরও বেশি সময় পর আবার তিয়াসের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তারপরও তো আমি চেয়েছিলাম আবার হারিয়ে যেতে কিন্তু সে আমার বাড়ি পর্যন্ত কেন পৌঁছালো?
সে এখন কেন আমাকে বিয়ে করতে চায়? নাকি ভাবছে আমি পড়ালেখায় ভালো, অল্প বছরের মধ্যে ভালো একটা অবস্থান পাবো তখন আর ওর মতো ছেলেকে পাত্তা নাও দিতে পারি। তাই আগেভাগে পরিবারের হাত ধরে বিয়ে করতে চাইছে? নাকি অন্য কারণ? আমার মাথায় বারবার প্রশ্ন ঘুরছে দীপ্তি এরপর আমেরিকা গিয়েছিল কিনা? আর তিয়াস কেন আমেরিকা যাওয়ার কথা বলে চট্টগ্রামেই পড়ে আছে?
ওর বাবা-মা ঢাকাতে অথচ সে একা চট্টগ্রামে।
সেখানে ওর সাথে আমি থাকতে চেয়েছিলাম কিন্তু সে আমার সাথে প্রতারণা করার পরে আমি ওই জায়গার নামটাও মুখে নেইনি। কিন্তু সে কেন এখনো ওখানে?
সে কি কিছু আমাকে বলতে চাইছে যা আমি জানিনা? আমার কি ওর সব কথা শোনা উচিত?
পরক্ষণেই স্থির হয়ে নিজেকে বললাম, না না প্রতারকরা আবারও প্রতারণার সুযোগ খুঁজবে। তাকে কোনোভাবে কিছু বলার সুযোগই দিবো না।


বিকেলের দিকে মা এসে দরজায় ঠকঠক করতে লাগলো। এতক্ষণে অবশ্য অসংখ্যবার দরজা খুলতে বলেছে কিন্তু বাবা বারবার মা’কে বাধা দিচ্ছিলো।
আমি চোখমুখ মুছে উঠে দাঁড়ালাম। তবে উঠে দাঁড়াতে শিখেছিলাম সেই দিনই, যেদিন আমার বাবা আমার বুকে এক পৃথিবী স্বপ্ন উদিত করেছিলো।
আমি গতকালের জন্যও বাবাকে দোষ দিতে পারবোনা। কারণ শত হোক তিনি আমার বাবা, যিনি নিজ চোখে আমাকে একদিন তিয়াসের জন্য মৃত্যুপথে দেখেছিলেন। বাবা ভেবেছে তিয়াসকে আজও ভালোবাসি তাই হয়তো মেনে নিতেও পারি! বাবা তো আর আমার ভেতরটা জানেননা, সেখানে ওর জন্য কতটা ঘৃণা পুষিয়ে রেখেছি জানলে হয়তো এমনটা করতেন না।

মায়ের ডাকাডাকিতে পরিশেষে আমি দরজা খোলে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলাম,
___ মা তুমি কি বুঝে ওদেরকে সাপোর্ট করে নিজের মেয়েকে বকতেছো? জীবনের এতটা বছর আমি কষ্ট করে এতদূর এসেছি অথচ তোমরা কিনা শেষ বেলায় সব ধ্বংস করে দিতে চাইছো?

মা রাগী স্বরে বললো,
___কেন তোকে কি আমরা বিয়ে দিবোনা? তাছাড়া ওদের স্থানটা আমাদের বর্তমান অবস্থানের চেয়ে অনেক উচ্চমানের। তুই প্রতিষ্ঠিত হলেও এমন জায়গায়ই বিয়ে হবে। তারপর একটা কথা আছেনা যতো তারাতাড়ি বিয়ে হবে ততই ভালো। বয়স তো আর থেমে থাকেনা কারো জন্য। এরপর তুই আজকে যেই খারাপ ব্যবহারটা করেছিস সেটা একদম ভালো হয়নি।

আমি মা’য়ের উপর এই মূহুর্তে প্রচন্ড রেগে গেলাম। বাবার দিকে ইশারা করে বললাম,
___ বাবা তুমি মা’কে তিয়াসের ব্যপারে সব বলে দাও। আর দাদুকেও বলো। এরপর যদি ওদের বিবেক বলে আমি যা করেছি কিংবা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটা ভুল। তাহলে আজকের পরে আমি এই বাড়িতেই পা রাখবোনা। আর এমনিতেও আজকে আমাকে চলে যেতে হবে! এখন কোনো ট্রেন নেই,বাসে চলে যাবো। জানি সন্ধ্যা হয়ে যাবে তারপরও চলে যাবো। আমার সামনে পরিক্ষা বাবা। শুধুমাত্র দাদুর কথা শুনে আমি পাগলের মতো ছুটে এসেছিলাম।

বাবা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
___তোর মা সবকিছু শুনলে এই ছেলেকে বাড়িতে আসতে দিবে দূরে থাক, আশেপাশে দেখলেই ঝাড়ু নিয়ে দাঁড়াবে।

মা চোখ বড় করে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
___ কি গো! তিয়াস কি আমার মেয়ের সাথে খুব বড় অন্যায় করছে? ওদের আগে থেকেই পরিচয় ছিল এই নিয়ে ওখানে বসেও তিয়াসের মা কি যেন বলছিল। আবার লিয়া বলছিলো সে ততটা যোগ্য হবে যতটা হলে সে কোথাও রিজেক্ট হবে না। আমাকে বলো না সব প্লিজ। আসো আসো রুমে আসো এবং আমাকে সব খুলে বলো।

বাবা দাদুকেও আসতে বললো। যেতে যেতে মা কপাল, ভ্রু ভাঁজ করে দাদুকে বিরবির বলছে,
___ আম্মা জানেন ওরা বাপ বেটিই সব। আমি মাঝখানে পাশের বাসার আন্টি। যতো কুচুরমুচুর সব ওরা ওরাই করে। আমাকে কিচ্ছু জানায় না।

মা’র কথা শুনে বাবা হাসলো। আর আমি হাসতে হাসতে কাপড় নিয়ে গোসলে গেলাম।

বের হয়ে নিজে থেকেই খেয়েদেয়ে তৈরি হতে লাগলাম। ব্যাগ গুছানো শেষ এমন অবস্থায় দেখি মা আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। উনার চোখভর্তি পানি। এতো বছর পরেও মেয়ের সেসময়কার প্রতিকূলতা মানিয়ে আজকের অবস্থানটা দেখে হয়তো উনার আনন্দেই কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আমি ব্যাগ হাতে নিয়ে বললাম,
___, দাদু আর তোমার মত কি? এখনো ভালো মনে হচ্ছে ওই ছেলেকে?

মা আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। মায়ামাখা একটা স্বরে বললো,
___আমার লক্ষি লিয়া মা। তোকে না বুঝে বকা দিয়েছি, বোকা মায়ের উপর রাগ করিস না।

___আরে না মা কি বলছো? ঠিক আছে। জানো আমি কখনোই চাইনি তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়টা সম্পর্কে জানো। কিন্তু আজকে সময় পরিস্থিতি বলতে বাধ্য করলো। এটাই হওয়ার ছিল বোধহয়!

দাদুর মুখটাও শুকনো । তিনিও বুঝতে পারছেন একটা রং মাখানো মুখোশের ভেতর মানুষ চেনা কতো কঠিন। যেটা আমি দেড় বছরে বুঝতে পারিনি সেটা উনারা দুই-একদিনে কি করে বুঝবেন?

বাবা আমাকে এগিয়ে এনে একদম বাসে তুলে দিলো। বাসে বসে কিছুক্ষণ বই পড়ছিলাম। হঠাৎ করেই আমার নুজহাতের কথা মনে হলো। অনেকদিন ধরে ওর সাথে কথা হয়না৷ আমি বইটা বন্ধ করে ওর কাছে ফোন দিলাম। প্রথমবার রিসিভ হলোনা, পরেরবার রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে একটা বাচ্চা কণ্ঠে আওয়াজ আসলো,
___আম্মু তরকারি কাটতেছে। আমি দিচ্ছি।

এক মিনিট পর ওপাশ থেকে নুজহাত বলে উঠলো,
___ কে বলছেন?

আমি আস্তে আস্তে বললা,
___ লিয়া বলছি।

নুজহাত উৎসুক হয়ে একনাগাড়ে এতো এতো প্রশ্ন জুড়ে দিলো।
___লিয়া কোথায় আছিস, কেমন আছিস,বিয়ে করেছিস,নাকি এখনো পড়ালেখাতেই আছিস? তোর আগের একটা নাম্বার ছিল, সেটা কোথায় রে? জানিস তোর ওই নাম্বারে কতো ট্রাই করি?

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম,
___ পড়ালেখা নিয়েই আছিরে। আর আমার নাম্বার অসংখ্যবার বদল হয়েছে। এইতো সেদিন এই নাম্বারটা নিলাম। আচ্ছা তোর কি খবর? সা’দ কেমন আছে?

নুজহাত এবার কেমন জানি চুপসে গেলো, আস্তে আস্তে বললো,
___ ওর জন্য আমার পড়ালেখা বাদ দিয়েছিলাম। বাচ্চার জন্য আমার রেজিস্ট্রেশনও করা হয়নি।
দুই বছর ভালোই ছিল। কিন্তু গত দুই বছর ধরে ওকে নিয়ে বিভিন্ন কথা শুনি। বাচ্চার বাবা হয়ে সে মেয়েদের পেছনে পড়ে থাকে। এই নিয়ে ঝামেলা চলে প্রায়ই, কয়েকদিন আগেও ঝগড়া করে এখন বাপের বাড়িতে আছি। দেখি কিছু একটা করতে হবে। মেয়ে হওয়াটা সত্যিই ভীষণ দূর্ভাগ্যের। তবে সেটাকে যে তোর মতো কাজে লাগাতে পারে সেই প্রকৃত বীর নারী । ওই বয়সে আমি আবেগে কতো বড় ভুল করেছি সেটা আজ বুঝতে পারি।

আমি ভেবেছিলাম নুজহাত হয়তো খুব সুখে আছে। ওর কথা শুনে আমি অবাক হলাম। আমি ওর জবাবে বললাম,
___সা’দ এখন এমন করে কেন? তোর মতো সুন্দরী বউ থাকতে সে অন্য মেয়ের দিকে কি করে তাকায়?

নুজহাত নালিশের ন্যায় বললো,
___ আমি তো এখন বুড়ি হয়ে গেছি। বাচ্চা সংসার সামলে এখন আর স্মার্ট থাকতে পারিনা। তাই উনার দৃষ্টি আমার উপরে আর আকর্ষিত হয়না। এদিকে সমবয়সী বিয়ে করেছিলাম। যখন কিনা তার সংসারের সংজ্ঞা জানার বয়স হয়নি। এখনো হয়নি ভালো করে। জানিনা কখন হবে!? তবে তুই ভালো করেছিস। তোর মতো বয়সে সমবয়সী বিয়ে করলেও ঝামেলা পোহাতে হবে না, কারণ কম হলেও সংসারের মানে বুঝবে।

আমি চুপ করে শুনলাম। তারপর পরবর্তীতে আবার কথা হবে বলে ফোনটা কেটে দিলাম।
জানালা দিয়ে মুখটা একটু বাইরে নিয়ে তাকালাম। শনশন করে বাতাস বইছে। আমার মুখে একটা অন্য রকম হাসি! সেদিন আমার সাথে যেটা হয়েছে সেটা আল্লাহ হয়তো আমার ভালোর জন্যই করেছিলো। নাহলে নুজহাতের মতো অবস্থা হলে আমি কি করে আজকের আমিটা হয়ে উঠতাম?


এরপর অনেকদিন বাড়ি যাইনি। এর মধ্যে তিয়াস আমার অনেক খোঁজ করেছিলো নাকি। কিন্তু সন্ধান পায়নি। এরপর তারও পরিক্ষা তাই চট্টগ্রাম চলে গেছে। আমিও আমার পরিক্ষা ভালোভাবেই দিলাম।
পরিক্ষার শেষে আমি একটা কোচিং সেন্টারে প্রতি সপ্তাহে তিনদিন ক্লাস নেওয়ার দায়িত্ব নিলাম।
সেই কোচিংটা ইউনিভার্সিটির মেধাবী শিক্ষার্থীদের দিয়েই পরিচালিত হয়। আগে জয়েন করতে বললেও পরিক্ষার জন্য করা হয়নি।
এর ফাঁকে বাড়িতে একবার গিয়েছিলাম। তবে আমার ইচ্ছে এখন কোচিং+ টিউশনের যে টাকা পাবো তা দিয়ে একটা বাসা ভাড়া করবো। তারপর সবাইকে নিয়ে এখানেই থাকবো। এর সাথে বিসিএস প্রিপারেশন। এরপর কোনো চাকরি হয়ে গেলে বাবাকে কোনো কাজ করতে দিবোনা।

কিন্তু কোচিংয়ের পঞ্চমদিনের মাথায় একটা বিপাকে পড়ে গেলাম ইয়াসকে দেখে। সেও এই কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছে। আমি ওকে না দেখার ভান করে থাকলেও ভীষণ আতংকে ছিলাম। কারণ আবারও তিয়াস আমার সন্ধান পেয়ে যাবে৷

আমার ভয়টা যেমন ছিল, কার্যকারীতা ঠিক তেমন হলো। পরেরদিন কোচিং শেষ হতেই দেখি তিয়াস বাইরে অপেক্ষা করছে। চোখের চশমাটা এঁটে আমি পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে সে আমাকে বলে,
___কাল থেকে আমিও এখানে জয়েন করছি। আমার কোনো কথা তো শুনবেনা অন্তত কংগ্রেস জানাতে পারো প্রীলি ম্যাম!

আমি কি ভেবে তিয়াসকে বললাম,
___ তোমার কি মনে হচ্ছে তাহলে আমি এখানে থাকব? দেশে আর কোথাও জায়গা নেই? আর তাছাড়া তুমি আমার পিছু নিয়েছো কেন? কি করতে চাও তুমি? আর কিই বা বলতে চাও?

তিয়াস এবার একটু অনুনয়ের সঙ্গে বললো,,
___বিশ্বাস করো প্রীলি আমি তোমাকে অপমান করার আগে বুঝতে পারিনি তুমি আমার জীবনে কতটা জুড়ে ছিলে। কিন্তু চলে যাওয়ার পরে মনে হয়েছে তুমি আমার কাছে অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছো, আমি তোমার শূন্যতায় নিজের অস্তিত্ব ……

তার আগেই আমি আঙুল উঁচিয়ে জোরে জোরে বললাম,
___জাস্ট শাট আপ। এতো সস্তা এক্সকিউজ নিয়ে আমার সামনে কীভাবে আসলে? ছি! আর তোমার কি মনে হচ্ছে এতো বছর পরে তোমার মতো একটা জঘন্য মানুষের পরে আর কেউ আমার জীবনে আসতে পারেনা? আর কারো প্রতি আমার ভালোবাসা জন্মাতে পারেনা? প্রায় ৫ বছরেও কি সঠিক মানুষের দেখা মিলবেনা?

আমার কথাগুলো শোনার সাথে সাথেই তিয়াস কেমন পেছাতে লাগলো। সে এটা হয়তো কোনোভাবেই মানতেই পারছেনা। ভেবেছিল ওর শোকে আমার ভেতর এতোটাই পাথর হয়ে গেছে যেখানে কিনা আর কারোর অস্তিত্ব নেই! কিন্তু সে ভাবতে পারছেনা এই ধারণা সঠিক নাও হতে পারে!

চলবে….

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here