শূন্যতায় অস্তিত্ব (৬ষ্ঠ পর্ব)

শূন্যতায় অস্তিত্ব (৬ষ্ঠ পর্ব)
লেখাঃ তাজরীন খন্দকার

হয়তো তিয়াসের প্রতি আমাকে আরো দূর্বল করার জন্য এটাই সবচেয়ে বড় কারণ ছিল!
কারণ পরেরদিন ঘটলো এক বিষ্ময়কর ঘটনা।
সারাদিন সবাই মন খারাপ করে বসে থাকার পরে বিকালে হঠাৎ তিয়াস রুহির নাম্বারে ফোন করে নুজহাতকে নিয়ে আমাদেরকে নিচে নামতে বললো।

আমরা কিছুটা অবাক হলেও নুজহাতকে নিয়ে গেইটের বাইরে গেলাম। যাওয়ার সাথে সাথে চমকে উঠলাম। সা’দ এবং তার মা-বাবাসহ তিয়াস এখানে দাঁড়িয়ে আছে। নুজহাতকে দেখার সাথে সাথে সা’দের মা তাকে বুকে জড়িয়ে নিলো। সা’দের বাবা সা’দের দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বলতে লাগলো,
___এতো সুন্দর লক্ষী মেয়েটার থেকে দূরে যেতে চাইছিলি? ভাবতেই পারছিনা তুই আমার ছেলে। ভুল করেছিস অথচ সেটাকে নিয়ে সাহস করে বাঁচার চেষ্টা নেই? তুই ভালো করেই জানিস তোর মা-বাবা মেনে নিবে,তাও বলিস নি? কেন রে এরপর আরেকটা মেয়ের সর্বনাশ করার ইচ্ছে ছিল? আজকে যদি তিয়াস আমাদের সব না জানাতো কি হতো মেয়েটার? এখন চল ওদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে হবে।

নুজহাত তিয়াসের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
___তিয়াস তোমার এই ঋণ আমি ভুলতে পারবোনা।

সা’দ এগিয়ে এসে নুজহাতকে সরি বলতে লাগলো।
আর আমার চারপাশটা মূহুর্তেই আবার রঙিন হয়ে উঠলো।
আমি কিনা তিয়াসের মতো একটা ছেলেকে ভুল ভেবে কাল সবখান থেকে ব্লক করে দিয়েছি?
আজকে ওর জন্মদিনে আমাকে সাজতে বলছিল, সেটাও কিনা আমি ভুলে গেছি। এখনো তো সময় আছে! আমি ওদের ভীড় থেকে এক দৌঁড়ে উপরে চলে গেলাম। তারাহুরো করে শাড়ী পরে আর কোনোভাবে একটু সাজগোজ করে আবার নিচে নেমে দেখি আমাদের রুমের বাকিরা রুমের দিকে আসতেছে। আমাকে দেখে ওরা হাসতে শুরু করে দিলো। আমি আঙুল দিয়ে বাইরে দেখিয়ে বললাম,
___ তিয়াস চলে গেছে?

ওরা পেছনে তাকিয়ে বললো এতক্ষণে চলে গেছে হয়তো, কিন্তু সা’দের মা-বাবা আর নুজহাত চলে গেছে। তারপরও আমি শাড়ীর কুচিতে মুঠো করে ধরে গেইটের বাইরে গেলাম। গিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। তিয়াস এখনো বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে সে হাসলো। আর ইশারা করলো এসে বসতে।
আমার হাতে সময় ছিল মাত্র এক ঘন্টা। কেননা সন্ধ্যার পরে আমাকে আবার ভেতরে আসতে দিবেনা।
তাই কাছাকাছি একটা ক্যাফেতে বসলাম।
সেখানে নামার পরে তিয়াস আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে হঠাৎ বসে গেলো। প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি। নিচে তাকিয়ে দেখলাম বাইকে বসে শাড়ীর ভাজ হয়ে উপরে উঠে গেছে। তিয়াস সেটাই ঠিক করে দিচ্ছে।এই ব্যপারটা আমার অসম্ভব ভালো লাগছিলো। তারপর হাত ধরে একটা জায়গায় বসলো আর বললো,
___ তুমি রঙিন শাড়ী না কিনে এমন একটা হালকা রঙের শাড়ী পছন্দ করার পরে আমি অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু এটাতে তোমাকে এতো সুন্দর দেখাচ্ছে সেটা দেখে আমি আবারও অবাক হলাম। এরপর মাত্র ১৫ মিনিটে তুমি শাড়ী পরে তৈরি হয়ে যেতে পারো সেটা দেখে..
সে বলার বলার আগেই আমি বললাম,
___ সেটা দেখে আরো অবাক হয়েছো?

তিয়াস হাসতে হাসতে বললো,
___ হ্যাঁ সত্যি তোমাকে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে। শুনো একটা বুদ্ধি দেই, তোমার বিয়েতেও তুমি লাল,খয়েরী না পরে এমন হালকা রঙের বেনারসি পরবে ওকে?

আমি লজ্জায় হাসলাম। তিয়াস বিষয়টা খেয়াল করলেও কিছু বললো না।
পরক্ষণে খাবার আসলো। আমি খেতে খেতে বললাম,
___আচ্ছা তিয়াস তুমি এখান থেকে বের হয়ে কোথায় ভর্তি হবে?

তিয়াস চিবুতে চিবুতে বললো,
___ দেখা যাক।

আমি উৎসুক হয়ে বললাম,
___আমরা দেশের আর কোথাও চেষ্টা করবোনা। চট্রগ্রামেই থেকে যাবো। কি বলো? পাবলিক ইউভার্সিটিতে না আসলে প্রাইভেট কিংবা ন্যাশনালে থাকবো। কিন্তু আমরা চট্টগ্রামে থাকবো কেমন?

তিয়াস আমার দিকে কেমন করে তাকিয়ে বললো,
___ প্রীলি। এতো এডভান্স চিন্তা করো না। দেখা যাক কি হয়। তাছাড়া আমার বাবার চাকরির মেয়াদ বেশিদিন নেই। এরপর অন্য চাকরির সুবাদে অসংখ্য জায়গায় এমনকি বিদেশেও যেতে পারে।

আমি তিয়াসের এই কথার অর্থ তখন ধরতে পারিনি।
আর জিজ্ঞাসাও করিনি তার বাবা কিসের চাকরি করে।

তারপর কিছুক্ষণ কথা বলে আমরা তারাহুরো করেই চলে আসলাম। সন্ধ্যার আগে আগে রুমে এসে পৌঁছালাম। আমাকে দেখে সবাই এসে পাশে বসে বললো,
___কিরে তোদের প্রেমটা তাহলে হয়েই গেলো?

আমি লাজুক হাসিতে বললাম,
___নারে কিছু বলতে পারিনা।

রুহি বললো,
___সেও কি কিছু বলে না? কিংবা তুই কিছু বুঝতে পারিস না?

আমি না সূচক মাথা নাড়লাম। তারা হাহুতাশ করতে করতে আবার সরে গেলো।

ইয়ার ফাইনাল চলে গেলো। আমি কোনো রকম পাশ করছি। বাবাকেও রেজাল্ট জামাইনি। এর মধ্যে পড়ালেখার অজুহাতে বাড়িতেও বেশি যাইনি।
অন্যদিকে নুজহাতকে সবাই মেনে নিয়েছে। সা’দও আর এখন ভালো হয়ে গেছে। তবে নুজহাত হোস্টেলেই বেশি থাকে।

দেখতে আরো কয়েক মাস চলে গেলো। নুজহাত তাদের বাসায় এখন,কারণ ওর বেবি হওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। সব ঠিকঠাক কিন্তু আমার যাবতীয় পরিক্ষার রেজাল্ট খারাপ। তবে তিয়াসের প্রতি আমার ভালোবাসা আরো তীব্রতর। কারণ তিয়াসের সাথে পরিক্ষার আগে আগেই অন্য রকম একেকটা ঘটনার সম্মুখীন হই, যেটা তার প্রতি আমাকে এতটা দূর্বল করে যে আমি সারাক্ষণ তাকেই ভাবতে থাকি।

এতদিন অপেক্ষা করেছি সে নিজে কিছু বলবে। কিন্তু বলছেনা। এখন তো অন্তত আমার পড়ালেখা করা দরকার। এখন যদি না বলি হয়তো আর বলা হবে না। ২০ দিন পরে নির্বাচনী পরিক্ষা। নুজহাতকে নিয়ে সবাই চিন্তায় আছে,পরিক্ষা দিতে পারবে কিনা।

এদিকে আমি রুমের সবার সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে ঠিক করে ফেললাম আমি নিজেই তিয়াসকে প্রপোজ করবো!
এভাবে বলবো বলবো করে সময় মূহুর্ত সব এলোমেলো করলে তো আর হবে না । একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া দরকার।

সেদিন ছিল মেঘলা আকাশ, সকাল থেকে সারা আকাশ জুড়ে মেঘেদের আলোরণ। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। চারদিক নিরব,রাস্তায় আজ গাড়ীদের যানজটও তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। অথচ তিয়াস কেন জানি আগেরদিন জানিয়ে দিয়েছে আমি তার সাথে বিকাল ৩ টায় যেন দেখা করি। একটা রেস্টুরেন্টে আসার কথা বলছে।
আর আমি গত ৫ মাস থেকে ক্লাস থ্রির বাচ্চাকে পড়িয়ে কিছু টাকা সঞ্চয় করে ওর জন্য একটা রিং কিনেছিলাম। সেটা দিয়েই প্রথম শুরু হয়েছিল আমার টিউশন জীবন। আর প্রথমবার কারো জন্য উপহার কেনা। জানিনা মেয়েদের পক্ষ থেকে ছেলেদেরকে এইরকম উপহার দেওয়াটা কতটা যুক্তিযুক্ত! কিন্তু অন্য রকম একটা আবেগ থেকেই আমি এটা করেছিলাম। ভেবেছিলাম এই দেখাতেই ওকে প্রপোজ করে ফেলবো।

বিকেলে ছাতা নিয়ে বের হয়ে গেলাম। আমি রেস্টুরেন্টে পৌঁছাতেই দেখলাম আলাদা একটা জায়গা আগে থেকেই সাজানো। যার মধ্যখানে তিয়াস দাঁড়িয়ে আছে। এটা দেখে আমার মনে হচ্ছিলো তিয়াসই বুঝি আমাকে আগে প্রপোজ করবে। তবুও আমি যেহেতু ভেবে এসেছি তবে আমিই আগে করবো। তাছাড়া একজন আগে করলেই হলো। আমি হাসিমাখা মুখে ওর কাছাকাছি গিয়ে রিংটা বাড়িয়ে বললাম,
___যেদিন তোমায় প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই আমার মধ্যে সবচেয়ে অচেনা অনূভুতিরা ভীড় করেছিল। তখন বুঝতে পারিনি এটা কি,তবে এর কিছুদিন পর থেকেই আমি বুঝতে পারি আমি তোমাকে ভালোবাসি। এতদিন বলতে চেয়েও আমি পারিনি, অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু আমি প্রতিবার প্রতিনিয়ত, প্রতিটা সময় ব্যর্থ হয়েছিলাম। তাছাড়া আমি জানি তুমিও আমাকে…

বলার আগেই তিয়াস আমার কাঁধ বরাবর একটা ধাক্কা দিয়ে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,
___দীপ্তি তুমি এসে গেছো!

আমি রিংটা হাতের মুঠোতে পুরে পেছনে তাকিয়ে দেখি দীপ্তি। বর্তমানে আমাদের ক্লাসের ভালো রেজাল্ট করা ছাত্রী। সকল শিক্ষকদের চোখের মণি।
যেটা আমার থাকার কথা ছিল। কিন্তু তিয়াসকে পাওয়ার পর থেকে আমার স্থান পরিচয় এমনকি পুরো দুনিয়া বদলে গেছে। তিয়াস গিয়েই ওকে হালকা জড়িয়ে বলতে লাগলো,
___কতক্ষণ ধরে ওয়েট করছি বলোতো।

দীপ্তি মৃদু হাসি টানিয়ে বললো,
___সবাইকে নিয়ে আসতে এতো দেরি হয়ে গেলো। তাছাড়া আজকে দিনটাও কেমন যেন।

পেছনে তাকিয়ে দেখি সত্যি আমাদের ক্লাসের অনেকেই এখানে উপস্থিত। তারাও সবাই ক্লাস টপার।এসব দেখে এমন মেঘলা ঠান্ডা দিনেও আমার সারা শরীর ঘেমে একাকার। আমি বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছে। তবে আঁচ করছিলাম আমি ভীষণভাবে ঠকে যাচ্ছি।

আমার সামনে বসে তিয়াস দীপ্তিকে হাঁটু গেড়ে বসে প্রপোজ করছিল। মনে হচ্ছিল আমার কলিজাটা ছিড়ে ভেতরে শনশন করে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকার পুরো শক্তি আমার হারিয়ে গেছে।
সামনে রাখা বিরাট কেকটার ঢাকনা খুললো। যেখানে লিখা
“Five Years Together ”

দীপ্তির হাসির রেশ থামছিলই না। সে কেক কাটলো।
একে অপরকে খাওয়াচ্ছে। কিন্তু আমার মাথায় যাচ্ছিলোনা ওদের পরিচয় ৫ বছর ধরে হলে এখন পর্যন্ত আমি কেন জানলাম না? প্রায় দেড় বছরেরও অধিক সময় ধরে তিয়াসের সাথে আমার পরিচয়। অথচ আজ পর্যন্ত কিচ্ছু বললো না। এসব কিছু না বুঝলেও এটা বুঝতে পারছিলাম তিয়াস আমাকে এখানে অপমান করতে ডেকেছে।
দীপ্তির গাল ঠোঁট কেক লেগে নাজেহাল সে হাত উপরে তুলে ওয়াশরুমের দিকে ছুটলো। তখনি তিয়াস সবাইকে উদ্দেশ্য করে আমার দিকে আঙুল করে বললো,
___গাইজ গাইজ, আজকে একটা মজার ব্যপার ঘটেছে। প্রীলি আমাকে প্রপোজ করেছিল। হাতে একটা রিং ছিল মেবি, ওহহো তোরা চলে আসায় ততটা খেয়াল করতে পারিনি।

তিয়াসের কথা শুনে বাকি সবাই হুহু করে হেসে উঠে একজন বললো,
___আরে কোটিপতি বাবার সুন্দরী ক্লাস টপারের বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে এইরকম নিম্নবিত্ত পরিবারের গেঁয়ো ব্যাকবেঞ্চার স্বপ্ন দেখে? মাই গড।

তিয়াস একজনের কাঁধে হাত রেখে বললো,
___থাক এসব নিয়ে আর কিছু বলিস না। বেচারি আর ক্লাসে প্রথম হওয়ার ক্ষমতা এমনিতেই রাখছেনা। এরপর এই বিরহবেদনা কাটাতে গিয়ে হতে পারে পরিক্ষায় দুটো সমানমাপের শূন্য নিয়ে আবার পাশের চেষ্টা করছে। তাই সত্যটা বলেই দেওয়া দরকার।

এতক্ষণ আমি তিয়াসের অন্য কাউকে ভালোবাসাটা দাঁড়িয়ে শুনতে পারলেও এই মূহুর্তে আমি আর নিতে পারছিনা। মনে হচ্ছে আমি আজকের পরে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই পোষণ করবো না।আমার প্রচন্ড জোরে চিৎকার দিয়ে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু আমি ভেতরের মৃত্যুটাকে নিশ্চিত করে তখনও চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনে যাচ্ছি।
তিয়াস বলছে,
___দীপ্তি কে জানো? এই শহরের বিরাট বিজনেসম্যান দিলীপ খানের মেয়ে। শুধুমাত্র আমার জন্য সে এই কলেজে ভর্তি হয়েছে। পরিক্ষার পরে আমরা একসাথে আমেরিকা চলে যাবো। দীপ্তিকে তুমি বুঝতে পারো নাই, কিন্তু সবাই জানে দীপ্তি কখনো কোনোকিছুতে সেকেন্ড হয়না। সেটা হোক দূর্নীতি, অন্যায় কিংবা অভিনয়ের ছলে। কিন্তু কলেজে এসে একমাসেই দীপ্তির চেহেরা মলিন হয়ে গিয়েছিল তোমার জন্য, সে আশাহত হয়ে গিয়েছিল তার পূর্বকার রেকর্ড তোমার জন্য ভেঙে যাবে। কারণ তুমি ক্লাসে খুব ব্রিলিয়ান্ট বলে ঘোষিত হয়ে যাচ্ছিলে,কিন্তু আমি সেটা কি করে দিতে পারি বলো? দীপ্তি আমার জীবন। আমাদের পরিচয় ৫ বছরের! তাইতো প্রতিটা পরিক্ষার আগে আমার পক্ষ থেকে তোমার জন্য বিশাল বিশাল সারপ্রাইজ থাকে। কিন্তু বিশ্বাস করো সব দীপ্তির জন্য।

তাকিয়ে দেখলাম দীপ্তি আসতেছে। আমি চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলাম। তখন তিয়াস আস্তে আস্তে বললো,
___ইচ্ছেটা তোমার। বিরহশোকে নেতিয়ে যেওনা। তাছাড়া আমার এই এক্টিংয়ের মনে হয়না আর কোনো দরকার আছে। কারণ তুমি এতো অল্প সময়ে কিচ্ছু পারবেনা। ভ্যাঁ ভ্যাঁ! (মুখ ভাংচিয়ে বললো)

আমি বাম হাতে মুখ মুছতে মুছতে বললাম,
___আমি প্রীলিয়া হাসান যদি রক্ত মাংসে গড়া মানুষ হয়ে থাকি তাহলে আমি নির্বাচনীতে নয়, বোর্ড পরিক্ষায় সর্বোচ্চ গ্রেট এনে দেখিয়ে দিবো। শুধু তোমার মতো একটা বিশ্বাসঘাতক প্রতারককে নিজের মুখ দেখাতে চাইবোনা।

বলেই আমি পা বাড়ালাম। তবে পেছনে শুনতে পেলাম দীপ্তি বলছে,
___ তিয়াস প্রীলিয়া মুখ দেখাতে চাইবেনা বললো কেন?

এরপর কি বলেছে আমি শুনিনি। তবে আমি আজ নিজের সর্বনাশের কথা শুনেছি। নিজের ভুলের জন্য নিজের এতো বড় অধঃপতন টের পেয়েছি।
তবে এই চ্যালেঞ্জ কেন করলাম আমি বুঝতে পারছি না। আমার পক্ষে স্বাভাবিক বেঁচে থাকা সম্ভব কিনা সেটাই সন্দেহের। সেখানে কিনা এমন একটা চ্যালেঞ্জ করে বসলাম।
আমাকে কেউ আজ এভাবে ঠকালো! আমার জন্য এটাই বুঝি প্রাপ্য ছিলো। কারণ আমিও যে আমার পরিবারকে ঠকিয়েছি। বাবার এতো কষ্টের টাকায় পড়ালেখা না করে একটা ছেলের জন্য উতলা হয়ে উঠেছিলাম। আমার জন্য এটা উচিত শিক্ষা ছাড়া আর কি?

চলবে……

শূন্যতায় অস্তিত্ব (৭ম পর্ব)
লেখাঃ তাজরীন খন্দকার

বাবার এতো কষ্টের টাকায় পড়ালেখা না করে একটা ছেলের জন্য উতলা হয়ে উঠেছিলাম। আমার জন্য এটা উচিত শিক্ষা ছাড়া আর কি?

ছাতাটা এখনো হাতে ভাঁজ করা অবস্থাতেই আছে। আমি ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে হালকা ভিজে ভিজে নিজের গন্তব্যের দিকে হাঁটছি। খুব করে ইচ্ছে হচ্ছে এখন যদি প্রচন্ড বেগে বৃষ্টি নামতো। বৃষ্টির পানিতে চোখেরজলগুলোও একাকার হয়ে যেতো।
নিজের ভুলগুলি হয়তো কিছুটা ধুয়েমুছে সাফ হতো। কিন্তু আমার ইচ্ছেগুলো যে আজ থেকে অপূর্ণতার কুফায় পড়ে গেছে। কে জানে আজীবন এভাবেই ঠেকতে হয় কিনা!
সেদিন প্রচন্ডবেগে বৃষ্টি না আসলেও কাক ভেজা ভিজে জ্বর ঠিকি এসেছিল। সেই যে গিয়ে বিছানায় উপুর পড়ে ছিলাম আর উঠিনি। রুমের বাকিরা ভেবেছে আমি ঘুমাচ্ছি, কিন্তু কাউকে বুঝানোর সাধ্যি ছিল না সেদিন সারারাত আমি এক মিনিটের জন্যও ঘুমাতে পারিনি। রাতে না খাওয়ার জন্য শুয়ে শুয়ে শুনেছিলাম শুভা, দিয়া,রুহি আমাকে বকতেছে। হুমকি দিচ্ছে বাবাকে বলে দিবে। এমনটা ওরা প্রায়ই করে।

সেদিন খুব ভোরে উঠে ফাঁকা বারান্দায় আকাশের দিকে তাকিয়ে খুব কেঁদেছিলাম। দুইদিকে প্রতারণা, একদিকে আমি প্রতারিত হয়েছি আর অন্যদিকে আমি আমার পরিবারকে দিয়েছি! আমার বেঁচে থাকার কোনো দরকার আছে? সত্যিই কি আমার জীবনটা আর কখনো সার্থক হওয়া সম্ভব? আমি আমার পরিবারের সামনে কি করে যাবো? বাবা আমাকে নিয়ে কতো স্বপ্ন দেখতো। আমার ভাইটা তো পড়ালেখার দ্বারেকাছেও নাই। সব স্বপ্ন তো বাবা আমার উপরেই ছেড়ে দিয়েছে। তাহলে আমি এই পোড়ামুখ নিয়ে কি করে যাবো! তার চেয়ে আমার মৃত্যুটা! এটা ভাবতেই আমার বুক কেঁপে ওঠছিল। না না তাহলে আমার মা, দাদু ঠিক থাকতে পারবেনা। বাবা তো কোনোভাবেই আমাকে ছাড়া ভালো করে বাঁচতে পারবেনা।
তাহলে আমার কি করা উচিত?
এতো কম সময়ে আমি করে পারবো? এর মধ্যে আমি চ্যালেঞ্জটা কেন করলাম? সত্যি যদি রেজাল্ট খারাপ হয় তাহলে আমি এতোগুলো মানুষের কাছে আরো বেশি হাসির পাত্র হয়ে যাবো! কি করবো আমি? কি করবো?
দুইহাতে নিজের চুল মুঠো করে ধরে নিজেকেই প্রশ্ন করছিলাম!

সারাদিন চলে গেলো কিচ্ছু খাইনি রাতের দিকে জ্বরের পরিমাণটা কমলো। এক গ্লাস পানি খেয়েছিলাম মনে আছে। কারো কোনো প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই, খাওয়ানোর জন্য তাদের আকুতিও আমার কানে পৌঁছেনি। তারা সবাই বুঝতে পারছে নিশ্চয়ই তিয়াসের সাথেই কিছু হয়েছে। কিন্তু কি হয়েছে তা কেউ জানেনা। তিয়াস তাদের সাথেও কথা বলার সবরকম ওয়ে বন্ধ করে দিয়েছে।

পরেরদিন সকাল সাড়ে এগারোটার দিকে দাড়োয়ান চাচা আমার নাম ধরে অনেক্ষণ ধরে ডাকতেছে। কিন্তু দূর্বল শরীর নিয়ে উঠার মতোও কোনো শক্তি ছিলনা। আমি হাত দিয়ে ভর করে করে কোনোভাবে ফ্রেশ হয়ে আস্তে আস্তে নিচে গেস্ট রুমে গেলাম। সবকিছু ঝাপসা দেখছিলাম। দুইদিনের না খাওয়া, হতাশাগ্রস্ত, আর কান্নায় ফোলানো চেহেরার দিকে তাকাতেই আমার খুব পরিচিত একটা কণ্ঠে লিয়া বলে একটা চিৎকার শুনলাম।
আমি চোখে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে বললাম,
___বাবা তুমি এখানে?

বাবা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে কান্না শুরু করে দিলো। বাবার কান্নায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছিলো।
আমি সইতে পারছিলাম না। আমি ফোঁপাতে ফোপাঁতে বললাম,
___বাবা আমাকে ক্ষমা করে দাও তুমি। তোমার মেয়ে হওয়ার কোনো যোগ্যতা আমার নেই। আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি বাবা। আমার কোনো যোগ্যতা নেই তোমার স্বপ্ন পূরণ করার! আমার আর কিচ্ছু করার নেই!

বাবা আমার দুই গালে হাত রেখে বললো,
___, আমার মেয়ে কোনো ভুল করবেনা। আমার বিশ্বাস আছে তোর উপর মা। বাবা সব কথা পরে শুনবো। এখন চল বাইরে যাবো। আগে তুই খাবি।

তারপর বাবা আমাকে নিয়ে একটা খাবার হোটেলে গেলো। ভাত-মাছ দিয়ে আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিলো। তারপর আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ধিরে ধিরে বলল,
___ এই প্রথমবার আমার মেয়েকে আমি এভাবে এতোটা ভেঙে পড়তে দেখেছি। তোকে আমি দুইবার কাঁদতে দেখেছিলাম, প্রথমবার তোর দাদা মারা যাওয়ার পরে, আর দ্বিতীয়টা আমি তোকে একদিন বকা দিয়েছিলাম বলে। তুই সেদিন ভীষণ কান্না করে বলেছিলি তোর মা হাজার মারলেও তুই ততটা কষ্ট পাস না, যতটা তুই আমার একটা বকাতে পাস। সেদিনের পর আমি তোকে কখনো বকা দেইনি। বল বাবা আর কখনো তোকে কোনো কারণে বকেছি?
এবারও তুই যত বড় ভুলই করিস আমি তোকে বকবোনা মা। প্লিজ তুই আর কান্না করিস না। জানিস রুহি যখন আমাকে ফোন করে বললো, দুইদিন ধরে তুই না খেয়ে শুধু কান্না করিস। তখন আমার পৃথিবীটা কতো অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল? আমি জানিনা এতটা পথ আমি কি করে আসলাম। পুরো রাস্তায় এটাই মনে হয়েছে আমি কবে পৌঁছাবো। আমি পারছিলাম না উড়ে উড়ে চলে আসি। এখন বাবাকে বল কেন তুই এতটা ভেঙে পড়েছিস? যেই কারণই হোক বাবা তোকে কিচ্ছু বলবোনা।

আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
___ বাবা কলেজে ভর্তি হওয়ার একমাস পর থেকে আমি পড়ালেখার আদৌ কাছেও নেই! এই বয়সে দশ পাঁচটা মেয়ে যেই ভুল করে আমিও ঠিক সেটাই করেছি,কিন্তু আমি খুব মারাত্মক পরিসরে প্রতারিত হয়েছি। এখন আমার কাছে তোমার স্বপ্ন পূরণ করার রাস্তাও নেই আর ভুল শোধরানোরও!
মাঝখান থেকে আমি বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ করে ফেলেছি, তার কিঞ্চিৎ কাছে ঘেঁষাও আমার পক্ষে সম্ভব না।

তারপর তিয়াসের ব্যপারে ফার্স্ট থেকে লাস্ট সব বললাম। আগে স্কুলেও কেউ প্রপোজ করলে আমি বাবাকে বলে দিতাম। বাবা আমাকে সুন্দর করে বুঝাতো। কিন্তু এই প্রথমবার এই কথাটা বলতে এত দেরি করেছি। বললে হয়তো ভুলটা এতো দূর গড়াতোনা। আমার সাথে এটা হওয়ার ছিল বলেই হয়তো আমি এতটা গোপনীয়তা রাখতেও শিখে গেয়েছিলাম।
আমার পুরো কথা শুনে বাবা মোটেও ঘাবড়ালোনা। বাবা বুঝতে পারছে আমি তিয়াসের থেকেও বেশি আফসোস করছি বাবার স্বপ্নের জন্য! বাবা এবার একটা মুচকি হাসি টানিয়ে বললো।
___ আমার গর্ব হচ্ছে এটা ভেবে যে তুই শেষ পর্যন্ত ওকে চ্যালেঞ্জ করতে পেরেছিস! এই না হলে আমার মেয়ে? আমি জানি তুই পারবি। তোর মেধা নিয়ে আর কারো সন্দেহ থাকলেও তোর বাবার মনে কোনো সন্দেহ নেই। তোকে এইটুক বয়স থেকে আমি চিনি মা। তুই পারবি এবং তোকে পারতেই হবে। এবার থেকে তুই এটা ভাব্বিনা এটা তোর বাবার জন্য করছিস। এবার ভাবতে শিখ তোর ক্যারিয়ার তোর নিজের জন্য। তোর সাথে প্রতারণা করে যেই মেধাকে দমিয়ে রাখতে চেয়েছিল সেটাকে এবার দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দিবি। চুনকালি মেরে দে বিশ্বাসঘাতকদের মুখে! শুধু নিজের যোগ্যতার জন্য তুই এটা করবি। এতটা বড় হবি যখন তোকে রিজেক্ট করার ক্ষমতা ওর মতো ছেলের থাকবেনা। যদি থাকে সেটা তোর থেকে থাকবে।

আমি বাবার দিকে শুধু তাকিয়ে আছি। বাবার প্রতিটা কথা আমার দূর্বলতাগুলোকে একদম গভীরভাবে তীর ছুড়ে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিলো। আমার মধ্যে আবার উদয় হলো মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার তীব্র আকুলতা। স্বপ্ন জাগলো যোগ্য হয়ে উঠার। বাবার কথামতো ততটা যোগ্য হতে হবে যতটা হলে আমার কাছে কেউ রিজেক্ট হবে!

বাবা হুট করেই বললো,
___তোর ফোন কি হয়েছে লিয়া?

বাবার সাথে এখান থেকে বের হয়ে বললাম,
___বাবা পরশুদিন বৃষ্টিতে ভিজে আমার ফোনটা নষ্ট হয়ে গেছে।

এটা শুনে বাবা নিজের হাতের ফোনটা থেকে নিজের সিম খুলে আমার হাতে দিলো। আর বললো,
___এটা রাখ আপাতত। পরে বাবা দামী ফোন কিনে দিবো। এখন আয় তোকে একটা সিম তুলে দিবো।

আমি চুপ করে হাতে নিলাম। মানা করলাম না, এতে বাবা আবার রাগ করতে পারে। বাবা আমাকে একটা নতুন সিম কিনে দিলো।

তারপর সেখান থেকে একটা রিকশায় উঠে আমাকে নিয়ে হোস্টেলের সামনে আসলো। বাবা আমাকে ভেতরে যেতে ইশারা করলো। আমি বাবার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললাম,
___বাবা মা’কে কিছু বলোনা প্লিজ।

বাবা মুচকি হেসে মাথা নাড়লো। আমি বাবার দিকে তাকাতে তাকাতে ভেতরে চলে আসলাম।

সেখান থেকে গিয়েই বই নিয়ে বসে গেলাম।
এতোদিন পরে আমার রুমমেটরা আবারও আমাকে দেখে অবাক হলো। তারা বুঝলো না কি হচ্ছে আমার সাথে। তবে আমি বুঝতে পারছিলাম আমার কি হওয়া উচিত।
রাতদিন পাগলাটে পড়ালেখা যাকে বলে! এমনো রাত সারারাত বইয়ের মধ্যেই আমি। সকাল কখন হয়েছে সেটাই খেয়াল করতে পারিনি।

যেখানে বিরহশোকে আমার এলোমেলো হওয়ার কথা ছিল, সেখানে আমি এখন পড়ালেখায় এলোমেলো। নিজেকে গুছানোর জন্য ৫ মিনিট সময়ও যেন আমি অপচয় করতে চাইতাম না। বিভিন্ন সমস্যা লিস্ট করে স্যারদের থেকে সমাধান করে নিতাম। ক্লাসের প্রথমদিকে যে শিক্ষকরা আমাকে খুব ভালোবাসতো তারা আমার পূনরায় মনোযোগে প্রচন্ড খুশি ছিল, আমার প্রতি ভীষণ হেল্পফুল ছিল। যেকোনো সমস্যা হলে আমি এনি টাইম উনাদের থেকে সমাধান পেতাম। তিয়াসের কথা মনে করার জন্য আমার কাছে এক সেকেন্ড সময়ও ছিল না। তবুও মাঝে মাঝে খেয়াল করতাম আমার চোখ ঝাপসা হয়ে উঠছে। ডান হাতে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে বাম হাতে চোখ মুছে দিতাম।

১৫ দিনের পরে নির্বাচনী পরিক্ষা ছিল। এরপরে আমার রেজাল্ট যখন এগারোতম স্থানে তখনি পুরো ক্লাস অবাক হয়ে গেছিলো। তবে দীপ্তিই প্রথম হয়েছে। তিয়াসের রেজাল্ট শুনেও আমি অবাক হয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম সে অনেক অমনোযোগী কিন্তু সেও পনেরোতম স্থানে। হয়তো নাটক করতে গিয়ে সে আমাকে এমনটা বুঝিয়েছে যে সে পড়ালেখা বলতে কিছুই করে না। আসলে সেও এতোদিন কম হলেও পড়ালেখা করেছে।
রেজাল্টের দিন তিয়াস আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল কিন্তু আমি শুনিনি।

ফাইনালের আগে আগে আমার প্রিপারেশনের উপর ভরসাটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, স্যারদের টার্গেট আবারও আমার উপর। পরিক্ষার ১০ দিন আগে ইংরেজি স্যার এমনিতেই আলাদাভাবে একটা পরিক্ষা নিয়েছিলো যেখানে শুধু সর্বোচ্চ নাম্বার নয় অবিশ্বাস্য নাম্বার পেয়েছিলাম। সেদিন আমি দীপ্তির চেহেরায় কালো মেঘ দেখেছিলাম। যা ছিলো প্রথমবার আমার চোখে তৃপ্তির ঘোর।

এরপরের দিন তিয়াস আমার সাথে কথা বলতে বিভিন্নভাবে রুমমেটদের সাথে কন্টাক্ট করার চেষ্টা করে। কিন্তু আমি পূর্ব সচেতন করে দিয়েছিলাম আমার ব্যপারে কোনো কথা বলার চেষ্টা করলে আমি এই রুম ছেড়ে অন্য রুমে চলে যাবো। আমি ভালো করেই জানি তিয়াস আবারও মনোযোগ এড়ানোরচেষ্টা করবে।
তাই ওরাও তিয়াসকে যতটা সম্ভব ইগ্নোর করলো।

ওদের মধ্যেও গত দুইমাস ধরে অদ্ভুত পরিবর্তন আসছে, ফোন রেখে পড়ালেখা করে। হতে পারে পরিক্ষা এগিয়ে আসছে বলে তারাও পড়ালেখার গুরুত্বটা বুঝতে পারছে, অন্যথায় আমাকে দেখে তাদেরও পড়তে ইচ্ছে হয়। এটা সত্যি পড়ালেখার ক্ষেত্রে একজনের আগ্রহ অন্যজনকেও টানে।

প্রতিদিন বাবা-মার সাথে একবার অল্প কথা বলা ছাড়া বাকি পুরোটা সময়ই আমার পড়ার সাথে কাটে।
দেখতে দেখতে পরিক্ষা চলে আসলো। সেবার ডে ডিউটিতে ছিল একজন নতুন ম্যাজিস্ট্রেড, যার ডিউটি ব্যবস্থায় প্রথম দিনেই পুরো হলের স্টুডেন্টের কলিজা শুকিয়ে গিয়েছিল। আর যারা টাকা পয়সা দিয়ে দূর্নীতিবাজি পরিক্ষার চিন্তায় বসে ছিলো তারা কলম কামড়ানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারলোনা।
সবদিকে বেখেয়াল হয়ে আমি সবগুলো পরিক্ষা ভালোভাবেই দিলাম। কেননা আমার কোনোদিকে খেয়াল করার দরকার ছিলো না।
পরিক্ষার উপরে আমার সর্বোচ্চ ভালো রেজাল্টের ভরসাটা ছিল। তবুও ভেতরে ভয় ছিল। কেননা আমি জানিনা ভাগ্য আমাকে এর যথাযথ মূল্য দিবে কিনা।

এখান থেকে পরিক্ষা দিয়ে বের হয়ে সোজা ঢাকা চলে গেলাম। সেখানেই এডমিশন প্রিপারেশন নেওয়া শুরু। আমি বাবাকে বলে দিয়েছিলাম চট্টগ্রাম বাদে দেশের সবখানে ভর্তির জন্য ট্রাই করবো। বাবাও সম্মত ছিল। এডমিশন কোচিংয়ের জন্য বাবাকে প্রচুর টাকা ঋণ করতে হয়েছিল।
তবে সেটার জন্য বাবার আফসোস ছিল না। উনার ভরসা ছিল আমি ভালো কিছু করবো।

যখন রেজাল্ট বের হয়েছিল তখন আমি বাড়িতে আসছিলাম। দুই রাখাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে চেয়েছিলাম আমার চেষ্টার ফলস্বরূপ যেন আমার স্বপ্নটা পূরণ হয়।
হ্যাঁ সেদিন আমার আর্জি মঞ্জুর হয়েছিল। বোর্ডের সেরা কলেজ থেকে সেরা রেজাল্ট আমার হয়েছিল। খুশিতে সেদিন বাবা পুরো এক ঘন্টা কান্না করেছিলো। সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম মা-বাবারা সন্তানের সফলতায় কতটা খুশি হয়। আমার মা দাদু বারবার আমার কপালে চুমু খাচ্ছিলো।
আমার ছোট ভাইটা সারা গ্রামে তার বোনের রেজাল্ট নিয়ে গর্ব করছিলো।

তাদের সবার খুশিতে আমি জীবনের দেড়টা বছরের জন্য গভীর অনুশোচনা করছিলাম। আর পরবর্তীতে বুঝতে পেরেছি বলে নিজেকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম। যদি আমি ওখানেই থেমে যেতাম তাহলে আজকে সবার খুশিটা আমি কি করে দেখতে পেতাম?


তারপর আলহামদুলিল্লাহ আমি যেখানে প্রথমবার এডমিশন পরিক্ষা দিয়েছি, সেখানেই সুযোগ পেয়ে গেছি। তাই অন্য কোথাও আর চেষ্টা করিনি। চেয়েছিলাম এরপর তিয়াসের সাথে আমার দেখা না হোক। কিন্তু সেটা হয়েছিল। প্রশংসা পত্রের জন্য কলেজে গিয়েছিলাম। সেদিন আবার প্রশংসনীয় রেজাল্টের জন্য একটা অনুষ্ঠান ছিল। যেখানে ১৫ জনকে পুরষ্কার দিবে কলেজ কর্তৃপক্ষ। দীপ্তির রেজাল্ট সেটার আওতায় ছিল না। আমি ওর পরিক্ষা নিয়ে সংশয় করেছিলাম, সে ক্লাস পরিক্ষাতে আসলেই কি নিজের মেধার জোরে প্রথম হতো নাকি অন্য কারণ ছিল! নাহলে ফাইনালে এতো খারাপ করলো কি করে?

পুরো অনুষ্ঠানে তিয়াস আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর অনুষ্ঠান শেষে পুরষ্কার নিয়ে গেইটের বাইরের দিকে যেতেই তিয়াস দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে পেছনে এসে আমাকে বললো,
___প্রীলি তুমি আমার সাথে ৫ মিনিট কথা বলবে?

আমি না শোনার ভান করে গেইটের বাইরে পা রাখলাম। তিয়াস ওখানে দাঁড়িয়েই আরেকটু জোরে বললো,
___ তোমার চুল কোথায়? এতো ছোট আর অল্প হলো কি করে?

আমি পেছনে না তাকিয়েই বললাম,
___চুলও চলে গেছে বেঈমানের মতো!

তখনি দেখলাম বাবা রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তখন বাবা প্রথম দেখেছিলো তিয়াসকে। আর আমি চেয়েছিলাম শেষবার দেখতে! কিন্তু হয়ে উঠেনি…

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here