শুভ্র_রঙের_প্রেম পর্বঃ২৪
#রুবাইদা_হৃদি
লজ্জা নামক শব্দটা আমার কাছে ভিত্তিহীন মনে হলেও আজ লজ্জায় মিইয়ে মাটির সাথে মিশে যাচ্ছি৷ চোখেমুখে গরম নিঃশ্বাস আমার ভেতরে লজ্জা গুলো ঠিকরে বেরিয়ে পরতে চাইছে৷ আমার নজর নীচু কিন্তু তার??সেটা দেখার জন্য হলেও আমার দিকে ঝুঁকে থাকা ব্যাক্তিটার দিকে তাকাতে হবে৷ তাকাতে গেলেই আমি বরাবর ব্যর্থ৷ শাড়ির কুঁচি খাঁমচে ধরে বড়সড় একটা ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললাম,
–‘ স..স..সরুন আমার গরম লাগছে৷ ‘
উনার মৃদু হাসির শব্দ শুনে আমি লজ্জায় হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললাম৷ ইশ! কেউ দেখে নিলে কি ভাববে??
–‘ আপাদত কেউ এখানে নেই তাই কারো কিছু ভাবার কোনো কথাই আসে না৷ ‘
আমি হাত নামালাম না৷ হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেই বললাম,
–‘ আমি ভার্সিটি এসেছি আপনাকে তো বলি নি জানলেন কি করে? ‘
–‘ কেন আমার হবু শ্বাশুড়ি বলেছে৷ ‘
–‘ মানে.. নে?? আম্মু! ‘ আমি হাত নামিয়ে সোজাসুজি উনার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম৷ উনি জোরে হেসে উঠলেন৷ গাড়ির উপর থেকে এক হাত উঠিয়ে চুল গুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে বললেন,
–‘ টানা একদিন পর সরাসরি দেখতে পেলাম৷ এতো শুদ্ধতা কেন তোমার মুখে? এতো আবেগ কেন তোমার ওই দুই চোখে? ‘
উনার আবেগী কথায় ইচ্ছা হচ্ছে ছুটে পালিয়ে যাই বহুদূর৷ এইভাবে কেউ বলে??
উনারা আমাদের বাসা থেকে দুপুরে খেয়েই বেরিয়ে এসেছিলেন কাল ৷ নীতি ওর বিয়ের দাওয়াত দিতে গিয়েছিলো৷ নীতির বিয়ে ঠিক হয়েছে৷ আর সেই সুবাদেই আমি আজ ভার্সিটি৷ কারণ নীতি আম্মুকে বলেছে, ওর সাথে যেন আমি সর্বক্ষণ থাকি ওর ইচ্ছা এইটা৷ আম্মুও বিনাবাক্যে মেনে নিয়েছে৷ স্নিগ্ধ স্যারকে দেখার পর থেকে আম্মুর ভাবাবেগ বুঝতে পারছি না আমি৷ সেদিনের সেই রাগ এখন নেই৷ আবারও আমার স্বাধীন জীবন ফিরে পেয়েছি৷ তবে নীতি আর আরিফ ভাইয়ার না হওয়া প্রেম টা এভাবেই শেষ হয়ে যাবে ভেবে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক ফুঁড়ে৷
আমি ভার্সিটি তে পাঁ রাখতেই আমাকে একটানে গাড়িতে নিয়ে আসেন উনি৷ ড্রাইভ করে গুলশান ছাড়িয়ে শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে নিয়ে আসেন৷ এখানের রাস্তা একদম ফাঁকা৷ রাস্তার দুই ধারে সারি সারি তাল গাছ আর রেইনট্রি৷ তার থেকে ঢালু নেমেই চাষের জমি৷ ধান চাষের জমি৷ সবুজ ধানের চারা গুলো বাতাসের তালে সমুদ্রের পানির মতো ঢেউ খেলছে৷ ধান খেতের পাশেই কোথাও কোথাও বড় হয়ে যাওয়া হলুদ সরিষা নজরে পরছে৷ কিছু কিছু ক্ষেতে কৃষক কাজ করছে৷ এতো সুন্দর গ্রামীণ ক্ষেত অনেক অনেক দিন পর চোখে পরতেই আমার করা হাজারো প্রশ্নের ঝুঁড়ি এক নিমিষেই থেমে যায়৷ আমি গাড়ির দরজা খুলে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতেই আমাকে আবারো একটানে গাড়ির সাথে মিশিয়ে দাঁড় করিয়ে উনি আমার দুই সাইডে হাত রেখে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠেন,
–‘ আমার শ্বাস আটকে এখন নিজে শ্বাস নিচ্ছো?? এই তোমার একফোঁটা মায়া হয় না আমার জন্য? ‘
আমি মিটমিট চোখে তাকিয়ে থাকতেই উনি আবার বলে উঠেন,
–‘ তোমাকে একদম নতুন বউ লাগছে জানো৷ আজ এতো মোহ কেন পাচ্ছি তোমার মাঝে?? মনে হচ্ছে উঠিয়ে নিয়ে বিয়ে করে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নেই৷ ‘
সেই থেকে একভাবেই দাঁড়িয়ে আছেন উনি৷ আমার হার্টবিট মিনিটে মিনিটে ছন্দ হারাচ্ছে৷ খোলা জায়গা সেই সাথে সামনে থেকে আসা উত্তাল হাওয়া মন প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে৷
ফাগুনমাসে কেমন প্রেম প্রেম বাতাস থাকে আমার মনে হয়৷ আর আজ আমার প্রেমিক পুরুষ আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে একবুক ভালোবাসা নিয়ে৷
–‘ রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? ‘
আমি সামনে তাকিয়ে দেখি সে আমার থেকে কিছুটা দূরে সামনের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ আমি অবাক হয়ে বললাম,
–‘ আপনি না এখানে ছিলেন? ‘
–‘ ছিলাম বুঝি? তোমার লজ্জা কাটলো ? যদি কেটে থাকে আমার কাছে এসে দাঁড়াও৷ ‘
আমি উনার ডাক শুনে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম৷ উনি আমাকে পাশে দাঁড়াতে দেখেই ঘুরে দাঁড়ালেন৷ মায়াময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমার হাত ধরতেই আমি কেঁপে উঠি৷ আমার হাত তার হাতে উঠিয়ে হঠাৎ করেই হাতের পিঠে চুমু দিয়ে বসে৷ ভূমিকম্পের ন্যায় আমার শরীর কেঁপে উঠলো৷ টান দিয়ে হাত সরাতে চাইলেই উনি আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরলেন৷ আমি আবারো মাথা নীচু করে ঠকঠক করে কাঁপছি৷ উনি আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
–‘ সাহস কোথায় রেখে এসেছো আজ? সামান্য স্পর্শে যে হাড়ে কাঁপা-কাঁপি করছো না জানি….!’ মুখ দিয়ে ‘ ব ‘ উচ্চারণ করেও থেমে গিয়ে আড়চোখে আমার দিকে তাকালেন৷ আমি জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টায় আছি৷ উনাকে অতিরিক্ত অক্সিজেন মনে হচ্ছে৷ যার ফলে,শ্বাস আটকে মারা যাওয়ার উপায়৷
–‘ স্ট্রেইট দাঁড়াও একদম নড়বে না৷ ‘
–‘ আপনাকে স্পর্শ করার চেয়ে বিদ্যুতের তার ধরা উত্তম৷ ‘
–‘ বিদ্যুৎতের তারকেই তাহলে ভালোবেসো আমার আর কি দরকার৷ ‘ উনি কন্ঠের গম্ভীরতা ধরে রেখেই বললেন৷ আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েও দৃষ্টি নত করে ফেললাম৷ আমার আঙুলে ছোট সাদা পাথরের আংটি পরিয়ে দিলেন সযত্নে৷ আমি ঘোরে আছি সম্পূর্ণ৷ উনি আবারো আমার হাতে চুমু দিয়ে বললেন,
–‘ ভেবেছিলাম যেদিন তোমার সাথে প্রথম দেখা হবে সেদিন আংটি দিয়ে বলবো,ইউ সিলড ফর মি৷ প্রতিদিন যত্নে রাখা জিনিসটা আমার সবচেয়ে যত্নে গড়া ভালোবাসার কাছে গচ্ছিত করলাম৷ যে শুধুই আমার শুভ্র পরী ৷ আমার এবং আমার৷ ‘
আমি বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি৷ আমার মনের মাঝে ভালোলাগার ঝড় বইলেও বাইরে প্রকাশ পাচ্ছে না৷ আমাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উনার হাসি মুখে কালো অন্ধকার ঘনীভূত হলো৷ আমি কি করবো ভেবে না পেয়ে প্রথমবারের মতো তার বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম৷ অনুভূতি গুলোর সাথে আমার হৃৎপিন্ডের প্রত্যেক টা কম্পন তীব্র ভাবে বেড়ে চলেছে৷ আমি লজ্জায় আর একরাশ আনন্দে কাঁদছি৷ সে ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
–‘ তোমার চোখে পানি মানায় না একদম৷ তাই কান্না করবে না৷ তোমার জন্য বরাদ্দকৃত ভালোবাসা অনেক তাই প্রত্যেক বার এইভাবে কাঁদলে যে চোখের পানি শেষ হয়ে যাবে৷ তখন আবার নতুন ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার জন্য পানি পাবে কোথায় বলো তো?? চোখে তো পানি সংকট দেখা যাবে৷ ইশ! কি ব্যাপারটা হবে তখন৷ ‘
উনার বেখেয়ালি কথা শুনে আমি চোখে মুছে আলতো হাতে ধাক্কা দিলাম তার বুকের মাঝে৷ উনি আমার কাজ দেখে হো হো শব্দে হেসে উঠলেন৷ আমি আবারো তার হাসির প্রেমে পরলাম৷ চোখেমুখে আছড়ে পরছে সমস্ত খুশি আর সেই খুশির ভাগীদার একমাত্র আমি এবং শুধুই আমি৷
________________________
–‘ এখনো সময় আছে নীতি! তুই আরিফ ভাইয়াকে বল তোর বাসায় প্রস্তাব দিতে৷ ‘
–‘ সব ঠিক হয়ে গেছে৷ সামনে সপ্তাহে ফাইনাল সব কিছু এখন আমি পিছিয়ে যাবো?? ‘
–‘ তুই পাঁ বাড়িয়েছিস বুঝি? তোর ফ্যামিলি বিশেষ করে তোর মামা তোকে ঠেলে দিচ্ছে৷ তুই আরিফ ভাইয়াকে বলে দেখ উনি ব্যবস্থা করবেই৷ কারণ উনি তোকে ভালোবাসে নীতি৷ শুনতে পারছিস? ‘
নীতি আমার কথা শুনে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো৷ ওর কান্নার আওয়াজে শপিংমলের অনেক আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছে৷ আমি বিব্রতবোধ করলাম৷ নীতিকে একহাতে ঝাপটে ধরে বললাম,
–‘ বি কুল নীতি৷ সব ঠিক হবে৷ প্লিজ কান্না থামা৷ ‘
–‘ কিচ্ছুটি ঠিক হবে না৷ তোর ভালোবাসার মতো আমার ভালোবাসাটা কেন পরিণতি পাচ্ছে না হৃদি বলতে পারবি?? ‘ নীতি ভাঙা গলায় বলতেই আমার তীব্র কষ্ট হলো৷ উনি সেই জায়গা থেকে আমাকে নীতির কাছে মানে ভার্সিটি তে নামিয়ে তার এনজিওয়ের কাজে চলে গেছেন৷ আর আমরা সেখান থেকে শপিংয়ে এসেছি নীতির জন্য৷ ওকে নিয়ে ফুড কর্ণারে এসে বসলাম৷ আমি ওর কান্নারত মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের অবস্থান ভেবেই শিউরে উঠলাম৷ মাঝে একটা দিন ভেবেছি তাকে পাবো না সেটা ভেবেই আমার চারিপাশ অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিলো আর নীতি?ও কত দিন ধরে এই সব সহ্য করে যাচ্ছে৷ টিস্যু পেপার দিয়ে ওর চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললাম,
–‘ আমি চেষ্টা করবো একবার?? ‘
নীতি পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে আমি ভরসার কন্ঠে বললাম,
–‘ উনাকে বলে দেখতেই পারি আমার মনে হয় সে কিছু একটা করতে পারবে৷ কিন্তু তার আগে আরিফ ভাইয়ার এড্রেস আর ফোন নাম্বার দে আমায়৷ ‘
–‘ উনি চট্রগ্রাম থাকেন শুনেছি কিন্তু ফোন নাম্বার তো নেই৷ ‘
–‘ তুই আরিফ ভাইয়ার বাসায় যাবি এখুনি নাম্বার আর এড্রেস জোগাড় করে আবার জলদি ব্যাক করবি৷ ‘
–‘ মানে কি হৃদি?? কি করতে চাচ্ছিস বল তো তুই?’
–‘ সময় হলেই দেখতে পাবি জানু৷ এইবার দৌড় লাগাও৷ জলদি যা আর এখানেই ফিরে আসবি৷ ‘
নীতি অবাক চোখে তাকিয়ে রয়েছে আমি ওর হাত ধরে দাঁড় করিয়ে সিএনজি ভাড়া করে উঠিয়ে দিলাম একপ্রকার জোর করে৷ ও আর কিছু বলার আগেই সিএনজি ছেড়ে দেয়৷ আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মুচকি হেসে ফোন হাতে নিয়ে ডায়াল করলাম আমার উনার কাছে৷ ফোন রিসিভ হতেই গম্ভীর ভাবে বললাম,
–‘ আপনার শুভ্র পরী উড়ে চলে যাচ্ছে যদি ধরতে চান দৌড়ে চলে আসুন৷ আপনার জন্য বরাদ্দকৃত সময় ধার্য করা হলো পনেরো মিনিট এর মাঝে মিরপুর স্টেডিয়ামের সামনে না আসতে পারলে আর তার দেখা পাবেন না…! ‘
বলেই মোবাইল রেখে দিয়ে পায়চারি তে লেগে পরলাম৷ আমার উক্ত ফোনকল পেয়েই পাক্কা এক ঘন্টা পর উনি আমার সামনে দাঁড়াতেই বুক কেঁপে উঠে আমার…
চলবে….
মন্তব্য করবেন সকলে♥