শুভ্র_রঙের_প্রেম পর্বঃ১৭
#রুবাইদা_হৃদি
মুখ গোমড়া করে বসে আছি আমি৷ সামনে একগাদা খাবারের স্তূপ৷ সামনের চেয়ারেই নির্বিকার ভাবে বসে আছেন স্নিগ্ধ স্যার৷ আমাকে বসে থাকতে দেখে শান্ত ভাবে বললেন,
–‘ জলদি খাও৷ ‘
–‘ পিপাসা পেয়েছে খিদে নয়! আর এতো খাবার কে খাবে?? ‘
–‘ কেন তুমি খাবে! ‘ উনার নির্লিপ্ত উত্তর৷ আমি অসহায় চোখে খাবারের দিকে তাকিয়ে আছি৷ খাবার নিয়ে সমস্যা না এতো গুলো ইটালিয়ান ফুড সাথে ভাত তরকারি সব আছে৷ দাম কে দিবে?? আমার কাছে হাতে গোণা দুই হাজার টাকা আছে৷ আমি সিউর বিল অনেক হবে৷
ভীড়ের মাঝে থেকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছেন উনি৷ আমি জুস অর্ডার করতে গেলেই এতো গুলো খাবার অর্ডার করে বসে আছেন! আমি ভেবেছি বোধহয় তার জন্য কিন্তু আমার সমস্ত ভাবনা ভুল প্রমাণিত করে আমাকে খেতে বলছেন৷
–‘ আমি খাইয়ে দিবো?? ‘ বলেই উনি সত্যি সত্যি মুখের সামনে খাবার ধরলেন৷ আমি স্তম্ভিত! চোখ বড় বড় করে পেছনের দিকে পিছিয়ে গিয়ে বললাম,
–‘ ন..না আমি পারবো৷ ‘
–‘ সিউর?? ‘
উনার কথা শুনে হাসি পেলো৷ এমন ভাবে বলছেন যেন আমি কখনো নিজের হাতে খাই নি৷ আমাকে হাসতে দেখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন৷ আমি খাবার নিজের জন্য নিয়ে সাথে উনাকেও একটা প্লেটে দিলাম৷ উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন,
–‘ দুই প্লেট কেন?? ‘
–‘ একটা আপনার আরেকটা আমার৷ ‘
–‘ আমি একটা প্লেটেই খাবো৷ ‘ বিরবির করে বললেন উনি৷ আমি বুঝতে না পেরে বললাম,
–‘ কিছু বলছেন স্যার?? ‘
–‘ এই তোমাকে না বলেছি ক্লাসে রুমের বাউন্ডারির ভেতর স্যার স্যার ডেকে অজ্ঞান হবে কিন্তু বাউন্ডারি ক্রস করার পর ওই ওয়ার্ড আর মুখে আনবে না৷ ‘ উনার রাগমিশ্রিত বলা কথায় কপাল কুঁচকে এলো৷ উক্ত কথা কবে বলেছেন??
প্রথম দিন থেকে সমস্ত কিছু ভেবেও মনে করতে পারলাম না৷ আমার অবস্থা বুঝতে পেরে ধীর কন্ঠে বললেন,
–‘ নেক্সট টাইম থেকে বলবে না এইটাই বলতে চেয়েছি৷ ‘
আমি ছোট করে,’ ওহহ ‘ বলতেই উনি আমার খাওয়া প্লেট টেনে নিলেন৷ আমি ভড়কে গিয়ে কিছুটা জোরে বললাম,
–‘ আমার প্লেট নিচ্ছেন কেন?? আপনার টা তো আছেই সামনে৷ ‘
আমার কথাকে পাত্তা না দিয়ে একমনে এঁটো খাবার খাচ্ছেন৷ আমি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছি৷ সমস্ত কিছু কেমন অদ্ভুত অনুভূতি আবিষ্কার করছি নতুন করে৷ আমাকে চুপ থাকতে দেখে মুখ উঠিয়ে তাকালেন তারপর বা হাতে চুল গুলো কপাল থেকে উপরের দিকে ঠেলে দিয়ে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
–‘ চেক করে দেখলাম খাবার টা ঠিক আছে কিনা৷ ‘
–‘ ওই প্লেট থেকেও তো চেক করতে পারতেন৷ ‘ আমার উত্তর শুনে ঝাঁঝালো কন্ঠে আবার বললেন,
–‘ আ’ম ইউর টিচার সো,আমি যা করছি সেটা তোমার ভালোর জন্যই করেছি। ‘
আমি উনার কথা শুনে বিরবির করে বললাম,’ আপনার ভার্সিটির বাউন্ডারি ক্র…’
–‘ স্টপ! আর একটা কথাও বলবে না৷ বাকি খাবার টুকু শেষ করো৷ ‘
আমি উনার সামনে থেকে নিজের খাবারের প্লেট নিতে গেলেই রাগী চোখে তাকিয়ে বললেন,
–‘ এইটা আমার তুমি ওইটা খাও! ‘ মুখ দিয়ে আর একটা কথাও উচ্চারণ করতে পারলাম না৷ অগত্যা নতুন প্লেটের খাবার খাচ্ছি আর আড়চোখে উনার দিকে তাকাচ্ছি৷ মনে মনে বললাম, কবে করবেন ভালোবাসা জাহির?? কবে বলবেন আপনিই সেই আমার শুভ্র প্রেমিক?? যে আমার অগোচরে অতিরিক্ত ভালোবেসে ফেলেছে আমায়৷
______________________
প্রত্যেকটা ব্যাচের স্টুডেন্ট অডিটোরিয়ামে হাজির হয়েছে৷ কোলাহলে পরিপূর্ণ অডিটোরিয়াম৷ অতিরিক্ত কথার আওয়াজে চারদিক ভারী হয়ে উঠেছে৷ এই বিশৃঙ্খল পরিবেশে আমার চোখ শুধু একজনকেই খুজে চলেছে৷ আমার চঞ্চল চোখ দুটো দেখে নীতি হাতে খোঁচা মেরে বলল,
–‘ তাকে খুজছিস বুঝি??’
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
–‘ কাকে?? ‘
–‘ ওই ব্যাটা ইংরেজ কে তাই না নীতি?? ‘ রাহাতের উচ্চস্বরে কথার জন্য আশেপাশের কোলাহল থেমে গেলো সাথে কেউ কেউ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে৷ ইচ্ছা হচ্ছে রাহাতের মাথা রড দিয়ে বারি মেরে দু-ভাগ করে দেই৷ আমি নিজের ইচ্ছাকে দমন রেখে ফিসফিস করে বললাম,
–‘ আরেকবার উনাকে ইংরেজ বললে তোর হাড় একটাও আস্ত রাখবো না৷ উনি স্নিগ্ধ! ‘
–‘ ওওওও উনি স্নিগ্ধ কিন্তু আমাদের তো স্যার৷ তোর স্নিগ্ধ৷ ‘
নীতির কথা শুনে রাগী চোখে তাকালেও তোর স্নিগ্ধ শুনে কেমন প্রশান্তি বয়ে গেলো৷ ইশ!লজ্জা কেন পাচ্ছি৷ আমি নিজেকে সংযত করে কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই মাধবী ভীড় ঠেলে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
–‘ কাল তুই হারিয়ে গেলি কি করে?? জানিস আমার কত টেনশন হচ্ছিলো কিন্তু এই নীতির কোনো ভাবান্তর ছিলো না৷ ‘
মাধবীর কথা শুনে নীতি আড়চোখে তাকিয়ে চুল হাতে প্যাচিয়ে বলল,
–‘ স্পেশাল মোমেন্ট গুলোতে আর স্পেশাল মানুষের সাথে আমার বেস্টুকে ছেড়ে দিয়ে আমি রিলাক্স থাকবো না কি তুই থাকবি?? ‘
–‘ তারমানে কাল তুই দেখেছিলি?? ‘ আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করতেই নীতি মাছি তাড়ানোর মতো হাত ঝাকিয়ে বলল,
–‘ অবশ্যই৷ ‘
ওর নির্বিকার উত্তরে আমি স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছি৷ নীতি আর আমার কথোপকথন বুঝতে না পেরে রাতার আর মাধবী একসাথে বলে উঠলো,
–‘ মানে?? ‘
–‘ মানে টানে কিছুই না৷ ইটস সিক্রেট৷ ‘
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি আর ওরা দুইজন না বুঝে৷ এই জন্যই তো বলি মহাশয় এতো আপডেট পাচ্ছে কোথায়৷
অডিটোরিয়ামের স্পিকারে চেনা কন্ঠের সালাম শুনে আমি মূহুর্তে জোরে জোরে বলে উঠলাম,
‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম! ‘
আমার জোরে জবাব টা সারা অডিটোরিয়াম জুড়ে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে বারবার৷ নীতি আমার হাত চেঁপে ধরতেই হুশ ফিরে৷ সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছেন অবাক চোখে৷ এর মধ্যে তিন জন মানুষ হাসছে৷ স্নিগ্ধ, পরশ স্যার আর নীতি৷ লজ্জায় মনে হচ্ছে ভীড়ের মাঝে হারিয়ে যাই আর কেও খুজে না পাক৷
স্পিকারের সামনে দাঁড়িয়ে এখনো উনি তাকিয়ে আছেন বাকি সবাই তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আবার আমার দিকে তাকালো আমি এক পা এক পা করে পিছিয়ে রাহাতের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বললাম,
–‘ দোস্ত আমাকে কভার করে দাঁড়া৷ কেউ যেন আমাকে দেখতে না পায়৷ মশা-মাছি কেউ না৷ প্লিজ হেল্প মি! ‘
আমার আকুল আবেদনে রাহাত কভার করে দাঁড়াতেই আমি ওর হাতের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম সে এখনো তাকিয়ে আছে৷ ইশ! সবাই কি ভাবছে?? ধরা পরে যাবো তো৷
নিজের মনের কথা গুলো শুনে মাথায় থাপ্পড় মেরে বললাম,’ কেউ দেখে নি কেউ বুঝে নি! কিন্তু তোর কাঁপা-কা পি দেখে না হওয়া প্রেম সবাই নিজেদের মতো উপন্যাস তৈরি করে ফেলবে গাঁধি৷ ‘
সব কিছু আবার স্বাভাবিক৷ আমি হাঁফ ছাড়লাম।রাহাত সন্ধিহান চোখে তাকাচ্ছে৷ আমি আবার ওর থেকে লুকানোর চেষ্টায় আছি৷
ভিসি স্যারের বক্তব্যে সবাই আবার ব্যস্ত হয়ে উঠলো৷ প্রতি বছর স্টাডি ট্যুর হয় এইবারও হবে৷ পাঁচ দিনের ট্যুর হয় প্রতি বছর৷ গত বছর আমি অসুস্থ ছিলাম বিধায় যেতে পারি নি৷ তবে এইবার যাবোই যাবো৷ ভিসি স্যার তিনটা জায়গা সাজেশন দিলেন,
‘ সিলেট, বান্দরবন আর কক্সবাজার টু সেন্টমার্টিন৷’
থার্ড ইয়ারের বড় আপু আর ভাইয়ারা বান্দরবন সাজেস্ট করলো৷ তাদের উপর কথা বলার সাহস আমাদের জুনিয়র দের নেই৷ ফোর্থ ব্যাচের সেমিস্টার ফাইনালের জন্য তারা যাবে না৷ এই মূহুর্তে সব দায়িত্ব থার্ড ব্যাচের৷ তাদের সাথে সহমত পোষণ করলেন ভিসি স্যারও৷ মূহুর্তেই আমার মন খারাপ হয়ে গেলো৷ ধূর! এইবারও যাবো না৷ আমি সব সময় সমুদ্র বিলাসী! নীল স্বচ্ছ পানি নিজের আপন মনে হয়৷ একরাশ মুগ্ধতা কাজ করে৷
সবাই রাজি হলেও উত্তেজনা থামিয়ে দিয়ে স্নিগ্ধ স্যার স্পিকারের সামনে এসে আবার বললেন,
–‘ সমুদ্র মানে,স্বচ্ছতা! সেই স্বচ্ছতা আর মুগ্ধতার ভীড়ে নিজেদের মতো সৌন্দর্য খুজে বেড়ানোর মাঝেও আনন্দ আছে৷ আবার ধরো,এই বিশাল সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ তোমাদের জীবনেও নতুন রঙ বয়ে আনতে পারে৷ আমার জানামতে তোমাদের আগের ব্যাচ গুলো বান্দরবন ঘুরে এসেছে৷ আর থার্ড ইয়ার তোমরা ও তো গিয়েছিলে তাই না??’
–‘ হ্যাঁ! ‘ সবাই সমস্বরে জবাব দিতেই উনি হাসলেন৷ সূর্যের আলো আর তার হাসি মিলিয়ে একাকার করে দিলো৷ বুকের মাঝে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেলো আমার৷ উনি আবার বললেন,
–‘ তাহলে আমরা সমুদ্রের উত্তালতায় নিজেদের বিলীন করি?? কি বলো?? ‘
উনার কথার রেশে প্রত্যেক স্টুডেন্ট রাজি হতেই আমার মনের মাঝেও উত্তালতার ঢেউ বয়ে গেলো৷ দূর্বলতা আছে আমার সেই সমুদ্রের মাঝে৷ এইবার পালা বাসায় রাজি করানো৷ ভেবেই মন খারাপ হয়ে গেলো৷ আমি সিউর আম্মু যেতেই দিবে না৷ অসহ্য!
____________________________
–‘ আমাদের গার্ড দিবেন কে জানিস?? ‘
আমি ব্যাগে কাপড় ঢুকিয়ে বিরক্তি চোখে তাকিয়ে বললাম,
–‘ আমি জানবো কীভাবে?? আম্মুকে রাজি করাতে করাতে জান শেষ প্রায়৷ আব্বু না রাজি হলে যেতেই পারতাম না ভেবেই ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছি৷ ‘
–‘ ডিপ্রেশন থেকে বের হও জানু! তোমাকে যে নিউজটা দিবো শুনে লাফাবে তুমি৷ ‘
নীতির হেয়ালি করা কথায় আমি মহা বিরক্ত! ওর কথায় কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে চুপ মেরে ব্যাগ গোছাতে লেগে পরলাম৷ আমার কোনো ভাবান্তর না দেখে আমার পাশ ঘেষে আহুলাদি সুরে বলল,
–‘ নিউজ শুনে খুশি হলে কি দিবি আমাকে?? ‘
–‘ জামাই সহ এক ডজন বাচ্চা ফ্রি দিবো নিবি??’
আমার কথা শুনে নীতি চোখমুখ কুঁচকে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো৷ ওর বাচ্চা ফেস দেখে আদর আদর পেলো। আমি ওর মুখে ঘুরিয়ে ইনোসেন্ট ফেস করে বললাম,
–‘ কি হয়েছে বেবি?? রাগ করেছো?? ফিডার এনে দিবো?? ‘ আমার কথা শুনে নীতির রাগ আরো একধাপ বেড়ে গেলো৷ আমার পিঠে দুম করে কিল বসিয়ে দিয়ে রেগে বেরিয়ে গেলো৷ আমি সশব্দে হেসে উঠে পেছন থেকে ডেকে উঠতেই ও ঘুরে আমার দিকে তোয়ালে ছুড়ে মেরে বলল,
–‘ কাল তোমার জম আসবে বেবি! ওয়েট এন্ড ওয়াচ৷ ‘
ওর কথা শুনে একদম পাত্তা দিলাম না৷ ভোরে উঠে জম না জমের রাজার সাথে দেখা হবে কে ভেবেছিলো?? আল্লাহ শেষ বারের মতো হেল্প চাইছি! হেল্প মি!
চলবে…..