শীতের রাতের প্রশ্ন

শীতের রাতের প্রশ্ন
লেখকঃ আবির খান।

~ এই… এই যে শুনছেন…একটু উঠবেন প্লিজ…

কনকনে শীতের রাত। কম্বলের উষ্ণতায় বেশ গভীর ঘুমে অতল ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ মাঝ রাতে বউয়ের ডাকে গভীর ঘুমটার সমাপ্তি হলো। তড়িঘড়ি করে উঠে বসলাম। ভাবলাম কিছু হলো নাকি আবার। তাই কিছুটা চিন্তিত স্বরে বউকে জিজ্ঞেস করলাম,

— কি হয়েছে? কোন সমস্যা?

বউ মাথা নাড়িয়ে লাজুক স্বরে বলল,

~ না না কোন সমস্যা নেই। একটা প্রশ্ন ছিল আপনার কাছে, করি?

ওর কথা শুনে ভ্রুকুচকে গেল। এই শীতের রাতে ও কি এমন প্রশ্ন করতে চায় আমার কাছে! খুব অবাক হলাম। তাই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম প্রশ্ন করার। আমি বেশ মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছি বউয়ের মুখখানার দিকে। আর অপেক্ষা করছি ওর প্রশ্নের। এবার বউ মাথা নিচু করে হাত দুটো একসাথে করে আমতাআমতা করে বলে,

~ আচ্ছা আমাদের পাড়ার রহিম চাচার চায়ের দোকানটা কি এখনো খোলা আছে? উনি কি এখনো বসেন? আগের মতো কি এখনো দুধ দিয়ে চা বিক্রি করেন?

বউয়ের প্রশ্ন শুনে আমি পুরো অবাক। অবাক না ঠিক আশ্চর্য হয়েছি বলা যায়। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম রাত ২ঃ৩৪ মিনিট। এই মাঝ রাতে এই প্রশ্নের জন্য বউ আমার ঘুম ভাঙালো? নিশ্চয়ই কোন রহস্য আছে এই প্রশ্নের পিছনে। কিন্তু সেটা কি? আমাকে বের করতেই হবে। এদিকে আমি চুপ করে আছি দেখে বউ আবার বলে উঠে,

~ আপনার মনে আছে, কয়েক বছর আগে এমনই এক শীতের রাতে হঠাৎ করে আপনি আমাকে নিয়ে পাড়ার রহিম চাচার দোকানে চা খেতে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি তো খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। আমি কল্পনাই করতে পারি নি আপনি এমন কিছু করবেন। তবে সেদিন খুব ভালো লেগেছিল। শুধু আপনি আর আমি ছিলাম। দুজন এক কাপ দুধ চা ভাগাভাগি করে খেয়েছিলাম। অনেক সুন্দর একটা মুহূর্ত ছিল তাই না? মনে আছে আপনার?

রুমের ডিম লাইটের হালকা আলোতে আমি কিন্তু বউয়ের উজ্জীবিত উচ্ছ্বাসমুখর নয়নজোড়া বেশ ভালো ভাবেই দেখতেছিলাম। আমি মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম। বউ হেসে আবার বলল,

~ আচ্ছা চাচাটা কি এখনো চা বিক্রি করেন? ওনার হাতের সেই চায়ের স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।
— হয়তো বসে। ঠিক জানি না।
~ ওহ! ইসস, এখন যদি ওনার কাছে যেতে পারতাম। কিন্তু…(বউ চুপ হয়ে গেল)

খেয়াল করলাম ওর চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে। বউ ভেবেছে আমি হয়তো দেখবো না। কিন্তু আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমার বউটা নিরবে অশ্রু ফেলছে। আবার মুহূর্তেই চোখ মুছে হাসিমুখে বলে উঠে,

~ সরি, আমিও কি পাগল তাই না? এই মাঝ রাতে আপনাকে ডেকে আজগুবি প্রশ্ন করছি। সরি সরি। আচ্ছা আপনি ঘুমান। সকালে আবার অফিস আছে।

বলেই ও শুয়ে পড়লো অন্যদিকে ফিরে। আমি ওর প্রশ্নের সব রহস্য বুঝে গেলাম। সময় নিলাম না৷ বেড ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বউ আবার আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখে আমি জ্যাকেট পরছি। ও অবাক হয়ে বলে,

~ কি করছেন? কই যাচ্ছেন?
— তোমাকে কেন বলবো? চুপচাপ শুয়ে থাকো।

ও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি জ্যাকেট, মাফলার পরে মানিব্যাগ নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে সোজা আমাদের বাসার কাজের মেয়েকে ডাক দিলাম। ও ভয় পেয়ে যায়। আমি ওকে অভয় দিয়ে বললাম, “দরজাটা লাগিয়ে দে। আমি বাইরে যাবো।” আরও বললাম, “তোর ভাবীর কাছে গিয়ে বস। যদি জিজ্ঞেস করে আমি কই, তাহলে বলবি আমি রান্নাঘরে।” ও “আচ্ছা” বললে আমি বেরিয়ে গেলাম। উদ্দেশ্য একটাই, চা আনা। রাস্তায় নেমে মনে হলো এ যেন বরফের শহরে চলে এসেছি। হার কাঁপানো শীত যাকে বলে। তাও এসবে পাত্তা না দিয়ে জগিং করতে করতে রহিম চাচার দোকানের দিকে গেলাম। আমি আসলেই জানি না উনি এখনো বসেন কিনা। তাও মনে এক অজানা বিশ্বাস নিয়ে ছুটছিলাম। জগিং করে আসতে আসতে দেখি রাস্তায় একটা মানুষ তো দূর একটা পশু-পাখিও নেই। মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল প্রতিনিয়ত। জানি না আদও ওনাকে পাবো কিনা৷ কিন্তু আমাকে হার মানা যাবে না। আরও একটু সামনে আগালাম। আসলে মনে করতে পারছিলাম না চাচা কোথায় বসতেন। যাইহো কিছু দূর আসতেই দেখলাম দূর এক কোণায় সম্ভবত একটা ছোট্ট টিনের ছাওনির নিচে আলো জ্বলছে। প্রচন্ড কুয়াশার জন্য ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তাও সেই আলোর দিয়ে ছুটে গেলাম। আলোকে খুঁজতে গিয়ে দেখি সেই রহিম চাচা চাদর গায় দিয়ে বসে আছেন৷ চা বানাচ্ছেন। বিশ্বাস করুন এতটা খুশি আমি আমার জীবনে কখনো হইনি যা এখন হচ্ছি। চাচাকে দেখে পুরনো দিনের সব স্মৃতি মনে পড়ে গেল। উনাকে দেখে বুঝলাম আগের চেয়ে অনেকটা বয়স্ক হয়ে গিয়েছেন। তবে এখন আপাতত উনি আমাকে দেখে অবাক। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলেন,

— ও বাবা তুমি কই থেকে আইলা?
— চাচা আমাকে হয়তো চিনবেন না আপনি। তবে আমি আর আমার বউ আপনার কাছে অনেকদিন চা খেয়েছি। আমার বউয়ের মুখে আপনার চায়ের স্বাদ এখনো লেগে আছে। তার মনে খুব ইচ্ছা জেগেছে আপনার হাতের চা খাবে। তাই আল্লাহর নাম নিয়ে আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে চলে আসলাম।

চাচা আমার কথা শুনে খুব অবাক হলেন। কিছুক্ষণ ভালো ভাবে আমাকে দেখে হাসি দিয়ে বললেন,

— তোমার বউয়ের নাম, জান্নাত তাই না বাবা?

আমি পুরো স্তব্ধ। চাচা জান্নাতের নাম কিভাবে জানলো! আমি বললাম,

— হ্যাঁ। আপনি কিভাবে জানলেন?
— ৪০ বছর হইলো চা বেচি। প্রতিদিন অনেক মানুষ আসে আমার চা খাইতে। তয় তাগো মধ্যে আমি কিছু কিছু মানুষের মুখ আর নাম সহজে ভুলি না। কারণ তাগো মনে ধইরা যায়। তোমার কথা হুইনা আর একটু ভালো কইরা দেইখাই তোমারে চিননা ফেলছি। কারণ এই গভীর রাইতে তুমিই একা আইতা খালি তোমার বউরে নিয়া চা খাইতে। তোমগো দুইডা টিঁয়া পাখিরে দেইখা মনডা আমার জুড়ায় যাইতো। কিন্তু হেরপর হঠাৎ কইরা আসা বন্ধ করলা কেন বাবা? কিছু হইছে?

চাচার কথা শুনে চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছিল। আড়ালে নিজেকে ঠিক করে নিলাম। তারপর বললাম,

— সময় হয় না চাচা। তবে আসবো আবার কোন একদিন। দোয়া করবেন।
— আচ্ছা আচ্ছা আইসো। খাড়াও তোমার চা’ডা বানায় দি।

এরপর চাচা খুব ভালো করে চা বানিয়ে দিল। আমি ওনাকে একটু দাম বাড়িয়েই দিলাম। চাচা নিতে না চাইলেও জোর করেই দিলাম। চাচা খুশি হলেন। আমি আবার বাসার দিকে রওনা হলাম। খুব ভালো লাগছিল। তবে সাথে মনটায় একটা গভীর ব্যথা অনুভব করছিলাম। দ্রুত বাসায় এসে বেল দিতেই কাজের মেয়েটা দরজা খুলল। আমি ভিতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলাম জান্নাত কি করে? ও বলে উঠলো,

~ ভাইয়া ভাবীতো অস্থির হইয়া আছে। আপনি তার কাছে দ্রুত যান৷ আমি অনেক কষ্টে থামায় রাখছি।
— আচ্ছা আচ্ছা তুই যা ঘুমা। আমি দেখছি।
~ মরিয়ম কে আসছে? (জান্নাত রুম থেকে জিজ্ঞেস করছিল)

আমি দ্রুত রান্নাঘরে গিয়ে বড়ো একটা চায়ের কাপে গরম গরম চা ঢেলে জান্নাতের কাছে নিয়ে আসি। জান্নাত আমাকে দেখা মাত্রই অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

~ এই আপনি কই ছিলেন? মরিয়ম বলল রান্নাঘরে, তাহলে এই রাতে বেল দিল কে? কে এসেছে?
— আহহা! শান্ত হও। এই দেখো কি এনেছি।

রুমের লাইটটা জ্বলছিল। জান্নাত অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে আমার হাতে একটা কাপ। ও কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

~ কাপে কি?

আমি হাসি দিয়ে ওর সামনে বসে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম,

— এই নেও তোমার সেই রহিম চাচার দুধ চা। এটা আনতেই বাইরে গিয়েছিলাম।

জান্নাত একবার আমার দিকে, একবার চায়ের দিকে তাকাচ্ছে। ও কোন ভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। আমি খেয়াল করলাম, ওর চোখ দুটো অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে। মসৃন সাদা গাল দুটো অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে। আমি তা মুছে দিয়ে বললাম,

— উহুম কান্না করলে হবে না। আসো সেদিনের মতো আজও চা’টা ভাগাভাগি করে খাবো।

জান্নাত মনকাড়া একটা হাসি দিয়ে মাথা নাড়িয়ে আচ্ছা বলল। এরপর আমরা দুজনে একসাথে রহিম চাচার দুধ চা খেলাম। জান্নাত প্রতি চুমকে খুব খুশি হচ্ছিল। লজ্জাসিক্ত হাসি দিচ্ছিল। আমি মনের গভীরে এক অজানা শান্তি অনুভব করছিলাম। এই শান্তি আপনি কোটি টাকার বিনিময়েও পাবেন না৷ চায়ের শেষ চুমুকটা দিয়ে খাওয়া শেষ করে জান্নাত আস্তে করে বলে উঠে,

~ আজ আমার পা দুটো আগের মতো ভালো থাকলে হয়তো আমি আর আপনি সেই আগের দিনের মতো একসাথে বসে চা খেতে যেতে পারতাম তাই না?

সময় যেন থমকে যায়। আমি চুপ করে আছি। কারণ ওর এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারবো না৷ একটা বিপদে পড়ে জান্নাত ওর পা দুটো হারিয়ে ফেলে। মানে প্যারালাইজড হয়ে যায়। সেদিনের পর থেকে জান্নাত খুব দরকার ছাড়া আর বাইরে যেতে পারে না। এই চার দেয়ালের মাঝেই ওর জীবনটা আবদ্ধ হয়ে যায়। তাই মাঝে মাঝে একজন স্বামী কিংবা একজন প্রেমিক হিসেবে ভালবাসার মানুষটাকে খুশি করার জন্য তার প্রতিটি না বলা আবদার গুলো পূরণ করার চেষ্টা করি। নাহলে হয়তো ওর কাছে জীবনটা বোঝার মতো লাগবে।

— সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here