#রাজনীতির_রংমহল
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা_০৬
উত্তপ্ত দুপুর,এসির ঠান্ডা পরিবেশের মধ্যে থাকার পরেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালের ডগায়।হাতের আঙুল দিয়ে মুছে নিল ঘামটুকু।একদৃষ্টে ফোনের দিকে তাকিয়ে ভাবনাতে মশগুল হলো পুনরায়।সামান্য পরিচয় দেওয়াতেই যে এমন করবে স্পর্শী সেটা আগে জানলে ক্ষুনাক্ষরেও টের পেতে দিত না পরশ।ফোন আরো পাচ মিনিট আগেই কেটে দিয়েছে অপর পাশ থেকে।ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ছে পরশ।এই যেন কিছু একটা হারিয়ে ফেললো সে।সবকিছু সুন্দরভাবেই তো হচ্ছিলো।ধুর,আজকে ফোন দেওয়াটাই উচিত হয়নি।
পুনরায় মনে মনে স্পর্শীর প্রতি রাগ হলো।এমনিতে তো সারাক্ষণ মুখ চলে অথচ পরিচয় পেয়েই চুপসে গেছে। সময় যত কাটছে ততটাই উদভ্রান্তের মতো হয়ে যাচ্ছে পরশ।উফফফ এ কেমন জ্বালা।নিজেকে কন্ট্রোল করাই দায় হয়ে যাচ্ছে।এমন হলে তো কোনোদিনই ওই মেয়ের সাথে কথা বলাই উচিত হয় নি।মন চাচ্ছে গিয়ে তুলে নিয়ে আসতে।নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে পুনরায় ফোন দিল পরশ।কিয়দংশ পরেই রিসিভড হলো।
সারা শরীর কেমন শীতল হয়ে এলো।বুকের উপর দিয়ে যেন কোনো পাথর সরে গেছে।ঠোট গোল করে সস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।তারপর স্পর্শীর উদ্দেশ্য ধীর কন্ঠে আওড়ালো-
কি ভয় পেয়ে গেলে নাকি আমাকে?নাকি ঘাবড়ে গেছো?ফোন কাটলে কেন?
এটা সত্যি যে এমপি শোনার পরে স্পর্শী কিছুটা অসস্তিতে পড়েছে নিজের পূর্বের বলা কথাগুলোর জন্য।কিন্তু তাই বলে ভয় পাবে?ভীষণ আত্নসম্মানে লাগলো তার।নাকের পাটাতন ফুলিয়ে তেজি কন্ঠে বললো-
কেন কেন?আপনাকে ভয় পেতে যাব কেন?আপনি কোন যুগের আলেকজান্ডার যে আপনাকে শুনে ঘাবড়ে যাব।
স্পর্শীর ত্যাড়া কথা শুনে পুনরায় ক্ষান্ত হলো পরশ।চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বললো-
তাহলে ফোন কাটলে কেন?আগে তো ঠিক’ই কথা বলছিলে।
ভাবনায় পড়ে গেল স্পর্শী।যাই হয়ে যাক না কেন এই লোকের কাছে হার মানা যাবে না।কিন্তু কি বলবে সে এখন?অনেক ভেবে টান দিয়ে বললো-
ওও আমি একটা কথা ভাবছিলাম।
ভ্রু কুচকে নিল পরশ।বললো-
তা কি এমন ভাবছিলে যার জন্য ফোন কাটতে হলো।
মেজাজ বিগড়ে গেল স্পর্শীর।এই লোক তাকে সামান্য ফোন কাটার জন্য জেরা করছে।নিজের এমপি গিরি স্পর্শীর উপর ফলাচ্ছে।একে তো সেকেন্ডের মধ্যে সাবান ছাড়া ধুয়ে রশিতে টাঙিয়ে দেবে স্পর্শী।ত্যাড়া কন্ঠে বলল-
ও আমি ভাবছিলাম আপনি আদোও কোনো এমপি কি’না।আর হলেও কতটা লুচু এমপি যে অচেনা মেয়েদের ফোন দিয়ে বিরক্ত করে।এই বাংলাদেশে আর কি কোনো মেয়ে নেই নাকি।আপনি বেছে বেছে আমাকেই কেন ফোন দিচ্ছেন?হুহ।
বাকরুদ্ধ হয়ে গেল পরশ।এই মেয়ে তার অতো ভালো চরিত্রে সেকেন্ডের মধ্যে দাগ লাগিয়ে দিল।মাত্র দু-বার ফোন করাতেই লুচ্চা বানিয়ে দিলো। কি এমন লুচ্চামি করেছে সে।আর বিরক্ত?উফফফ ভাবতে পারছে না পরশ।কিন্তু পরশের তো রাগ’ও লাগছে না।আশ্চর্য ব্যাপার স্যাপার।দিনদিন সে কেমন কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলছে নিজের উপর। নিজেকে সামলে ধীর কন্ঠে স্পর্শীকে বললো-
অচেনা কাউকে মেসেজ দিয়ে নিজের বাচ্চার বাপ বানিয়ে দিতে পারো তাতে কিচ্ছু হয় না।অথচ সামান্য দুটো কথা বলতেই আমি লুচু হয়ে গেলাম।কি বিচার বলো তো?
রাগ লাগল স্পর্শীর।সেদিন কোন কুক্ষণে যে এমপির নাম্বারে মেসেজ দিতে গেছিলো কে জানে।আল্লাহ জানে আরো কতদিন ঝারে এই লোকে।নিজেকে সংযত করে ভীষণ সিরিয়াস হলো। বললো-
আচ্ছা একটা কথা বলুন তো।আপনি একজন এমপি মানুষ। বিশাল বড়সড় আপনার ব্যাপারস্যাপার। অথচ আপনি আমাকে নিয়ম করে ফোন দিচ্ছেন, দেখা করছেন,শাসন করছেন।কেন বলুন তো?সামথিং সামথিং নাকি হ্যা?
খুক করে কাশি উঠে গেল পরশের।টেবিলের উপর থেকে পানির বোতল খুলে ঢকঢক করে খেল।এ মেয়ে এতো নির্লজ্জ কেন?সব কথা গড়গড় করে মুখের উপর বলতে হবে এমন কোথাও লেখা আছে নাকি।কিছু তো বুঝেও বসে থাকা যায়।মুখে বললো-
তেমন কোনো ব্যাপার না।
-উহুমউহুম তা বললে তো চলবে না নেতা মশাই।আমি একজন মেয়ে। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় বলছে আপনি আমার প্রেমে হাবু-ডুবু,উহুম না ডুবেন নি এখনো তবে সাতার কাটার জন্য পুরো জ্যাকেট/ট্যাকেট পড়ে রেডি আছেন।কি তাইতো?
ঠোট কামড়ে হেসে দিল পরশ।কি সাংঘাতিক মেয়ে।এর সাথে কিছু লুকানো যাবে না।এই ত্যাড়া মেয়ের সাথে ত্যাড়ামি’ই করতে হবে।চেয়ার থেকে উঠে জানালার কাছে গেল।আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো-
হ্যা,তো । তাতে কি এমন হয়েছে?এমপিদের কি কাউকে পছন্দ হতে পারে না।তারা কি প্রেম করতে পারে না,বিয়ে করে বাচ্চা-কাচ্চা ও আনতে পারে না।নাকি শুধু তুমি’ই বিয়ে ছাড়া মেসেজে বাচ্চা আনা থেকে শুরু করে ক-ঘন্টার মধ্যে ডেলিভারি পর্যন্ত করাতে পারো।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল স্পর্শী। এমা এই এমপি দেখছি এখন অন্য সুরে গান গাইছে।নানা,যতটা ভোলাভালা সে ভেবেছে ততটাও সুবিধার এ নয়।একটু বুঝে শুনে কথা বলতে হবে।মুখে বললো-
না,আমি কি সেটা বলেছি নাকি।অবশ্যই পারে।দেশের এমপি-মন্ত্রীরা যদি বউ-বাচ্চা ছাড়া সিংগেল লাইভ পার করে তাহলে ভবিষ্যতে তাদের বংশধর গুলো আসবে কোত্থেকে।কিন্তু আমি বলছিলাম কি নেতা মশাই,এত্তো এত্তো মেয়ে থাকতে আমি’ই কেন?
এবারের উত্তর দিতে সময় নিলো না পরশ।চট করে বলে উঠলো-
হ্যা,সেটা তো আমি’ই ভাবছি।তুমি’ই কেন?পুরোটা আবেগের বয়স কাটিয়ে এলাম অথচ কেউ একটু টলাতেও পারেনি সেখানে তোমার মতো একটা ভয়ংকর মেয়েই কেন?
থেমে,
শোনো মেয়ে,তোমাকে আমার একটু পছন্দ হয়েছে।তাই বলে আবার উড়তে শুরু করো না।
রাগ লাগলো স্পর্শীর।নাকের পাটাতন ফুলিয়ে বেশ ঘন করে শ্বাস নিলো।উড়ো না মানে কি?সে কি ভাবছে?সে তাকে পছন্দ করেছে বলে কি স্পর্শী ধন্য হয়ে গেছে নাকি।একটুও না।স্পর্শী তো এখন একে বাজিয়েই দেখবে।একদম প্রেমে নাকানিচুবানি খাইয়ে দিশেহারা করে দেবে।প্রথম প্রথম এত্তো ভালো কথা বলবে যে এই নেতাকে একদম তার নেওটা বানিয়ে দেবে আর উদ্দেশ্যে সফল হওয়ার পরপর’ই একদম সিম’ই অফ করে দেবে।এমনিতেই এই সিম’টা রাহুল ভাইয়া জানার কারনে চেঞ্জ করতে হবে। নিজের মনোবাসনাকে পুরণ করার জন্য বেশ গুছিয়ে কিছু প্রেমবাক্য মুখের কাছে আওড়ালো স্পর্শী।ফোনটাকে মুখের কাছে এনে বেশ সুরেলা কন্ঠে বললো-
নেতামশাই শুনুন………
এরইমধ্যে ওপাশ থেকে ফোন’টা টুট টুট করে কেটে গেলো।আশ্চর্যে হা হয়ে গেল স্পর্শী।তার মুখের উপর ফোনটা কেটে দিলো। কত্ত বড় সাহস?কই স্পর্শী তো কখনো কাটে না,বরং কথা বলতে না ইচ্ছে করলেও ভদ্রতাস্বরুপ কথা বলে।তাহলে সে এমন কেন করলো?কত্ত কষ্ট করে কিছু প্রেমময় বাক্য মনে করলো,স্পর্শী নিশ্চিত এইভাবে পাচ মিনিট কথা বললেই ওই এমপি তার প্রেমে বর্ষার কাদা- পানিতে পিছলে পড়ার মতো আছড়ে পড়তো।কিন্তু,এটা কি হলো?প্রেমে তো পড়লোই না বরং ফোনটা’ই কেটে দিলো।পুনরায় নিজে থেকে দু-বার ফোন দিলো।কিন্তু ফোনটা বন্ধ আসছে।আর কক্ষনো ফোন ধরবে না এই লোকের।কথাও বলবে না।রেগে ঝামটা মেরে বিরবির করে গালি দিলো পরশকে।তারপর পাটি হাতে নিয়ে উঠে ছাদ থেকে নিচে নেমে গেলো।
_____
স্পর্শীর সাথে কথা বলা অবস্থায় সামনে তাকাতেই দেখলো দরজা দিয়ে পাভেল ভেতরে ঢুকছে।তৎক্ষনাৎ তাড়াহুড়ো করে ফোন কেটে বন্ধ করে পকেটে ভরে রাখলো।কেননা,পাভেল একটাবার বিষয়টা আচ করতে পারলেই বিশাল কেলেংকারি বাধিয়ে ফেলবে।সবে মাত্র নিজের অনুভূতি টাকে বুজতে পেরেছে পরশ।এবারে স্পর্শীকেও বোঝার সূযোগ দিতে চায়।তাড়াহুড়ো করে কোনো কাজ করে পরবর্তীতে পস্তানোর বান্দা তো সে নয়।
সবসময়ের উৎফুল্ল থাকা ভাইটা’কে চিন্তিত দেখে ভ্রু কোচকালো পরশ। পাভেলের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই বললো-
ভাই,আমার খুব টেনশন হচ্ছে।
–কোন ব্যাপারে?
পাভেল কিছুক্ষণ নিরব রইলো।তারপর পরশের দিকে তাকিয়ে বলল-
সোভাম সরদারের বিষয়টা নিয়ে।আরে ওরা তো এমন চুপ থাকার লোক না।কিন্তু দেখ,এখনো বেশ আনন্দে আছে যেন কিছু হয়’ই নি।আজকে ভার্সিটি থেকে আসার পথে দেখা হলো।ওর লোকজন নিয়ে ওদিকটায়’ই যাচ্ছিলো কি কাজে।আমাকে দেখে বেশ ত্যাড়ামি করে হাসছিলো।মানে আমি বুঝলাম না,হাসির কি আছে।
থেমে,
দাতে দাত চেপে,
ওর ওই বিদঘুটে হাসি দেখে তো আমার গা জ্বলে যাচ্ছিলো।ইচ্ছা করছিলো এক পাঞ্চ মেরে দাত গুলোই ফেলে দেই।শালার,ওই জানোয়ার টাকে দেখলেই আমার গায়ের রক্ত টগবগ টগবগ করে ফুটতে থাকে।তুই ভাবতো আমি নিজেকে ঠিক কিভাবে কন্ট্রোল করেছি,ওই শালা আমাকে দেখে দাত কেলাচ্ছিলো।
পরশ চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো।তারপর পাভেলে’র দিকে তাকিয়ে বললো-
ওরা চায়’ই তো এটা।যাতে আমরা নিজে থেকে কোনোভাবে আক্রমন করি।আর সেই ইস্যু টাকে নিয়ে একদম বেশ ভালো ভাবে ঝামেলা বাধাতে পারে।আমি তোদের বলেছি না,এই ক’টা মাস একটু ধৈর্য ধর।দলের ছেলেদের ও একদম গা কামড়ে থাকতে বলবি।ওরা প্রথমে অনুষ্ঠানে বম রেখেছে।ওরা কোনো প্রমাণ না রাখলেও নিশ্চিত জানতো আমরা ওদের দায়ী করবো।এক্সাটলি এই বিষয়টার জন্যই ওরা বম রেখেছে।যাতে তোরা রেগে গিয়ে ওদের সাথে ঝামেলায় জড়াস। যখন দেখলো তোরা নিজেদের’কে সামলে আছিস তখন বিভিন্ন ভাবে তোদের উশলে দেবে।কিন্তু সাবধান!আমি যেন শুনি না আমার দলের কেউ মারামারি-বা এই ধরনের কোনো ঝামেলায় জড়িয়েছে।নির্বাচন শেষ হলেও এখনো তার রেশ কাটেনি। ক’টা মাস যাক,সবকিছু ঠান্ডা হোক,তারপর ওর ব্যাবস্থা আমি করবো।
পরশ পুনরায় পাভেলের দিকে তাকালো।এখনো দাত কামড়ে আছে।এই বয়স টাতে রক্ত গরম থাকে।নিজেকে সামলানো খুব মুশকিল হয়ে যায়।শান্ত স্বরে বললো-
খিদে পেয়েছে।
আহা,খিদের কথা বলা মাত্রই যেন পাভেল নিজের রুপে ফিরে এলো।পেট চেপে ধরে সোফার উপর শুয়ে পড়লো।কাতর কন্ঠে বলল-
খুউউউব।
–আচ্ছা,তাহলে তুই বাড়ি যা।
—তুই ও চল।একসাথে যাই।কাজ তো নেই তেমন।
হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো পরশ। তারপর সম্মতি দিয়ে দুজনেই অফিস থেকে বেরিয়ে গেল।
________
দুপুরবেলা,খাবার টেবিলে বসতেই স্পর্শীর অসস্তি হচ্ছে।এমনটা তো এর আগে হয় নি।পাশে তাকাতেই দেখলো রাহুল ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।টেবিলের বাম দিকের চেয়ারে বসে আছে খালু আব্দুর রহমান,রাহুল আর ডানদিকে স্পর্শী আর বিপাশা।খালা-খালুর বেশ আদরের একমাত্র ছেলে রাহুল।কোনো মেয়ে নেই বিধায় বেশ আদর করে সবাই স্পর্শীকে। কিন্তু এই আদর গুলো এখন গায়ে কাটার মতো বিধছে। দিন দিন ভাই রুপি রাহুলের দৃষ্টি যেন নোংরা হচ্ছে।ভীষণ ভাবে হাস-ফাস করতে লাগলো খাবার টেবিলে বসে।শেষে বাধ্য হয়ে রাহুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
তোমার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে ভাইয়া?আমাকে এর আগে কখনো দেখো নি?এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
বাকরুদ্ধ হয়ে গেল রাহুল। স্পর্শী যে বাবার সামনেই এমন ভাবে নাকানিচুবানি খাওয়াবে তা ক্ষুনাক্ষরেও বুজতে পারেনি।আবদূর রহমান খাওয়া রেখে স্পর্শীর দিকে তাকালো।তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো-
চলবে?
রিসপন্স ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।গল্পটা কি কোথাও ভালো লাগছে না আপনাদের?নিরব পাঠকরাও সাড়া দিবেন প্লিজ।