রঙ চা
পর্বঃ২৩,২৪
মাহফুজা মনিরা
সকালের নাস্তার জন্য মিনু শেখ নিশুতিকে ডেকে নিলেও পুরো নাস্তাটা একা নিশুতিরই করা লাগে। একা হাতে। নাস্তা বানিয়ে রুমে ফিরে দেখে প্রায়াণ আবার ঘুমিয়ে গেছে। নিশুতির বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস পিছলে পড়ে অজান্তেই। সে চুপচাপ ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে প্রায়াণ জেগে গেছে। একটা কেমন জানি চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
কপালের ভ্রু দুটি কিঞ্চিৎ কুঁচকে নিশুতি জিজ্ঞাসা করে, “কি?”
প্রায়াণ দায়সারাভাবে বললো, “তুমি এটা কেমনে পারলা করতে??”
নিশুতি অবাক হয়। গলায় বিষ্ময় ঢেলে বলে,
“কি করলাম??”
“আমাকে না উঠিয়ে একা ওয়াশরুমে গিয়ে কেমনে ফ্রেশ হইলা তুমি??”
“তো কি হইছে তাতে?”
“আমার কত শখ ছিল বাসর রাতের পরের সকাল টা আমার বউয়ের সাথে একসাথে ফ্রেশ হবো আমি। আর তুমি…!”
হাতে থাকা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে নিশুতি বলে,
“বাসর রাতই হলো না। আবার তার পরেরদিন!” নিশুতির গলায় অভিযোগের ছোঁয়া পায় প্রায়াণ। সে বিছানা থেকে উঠে নিশুতির সামনে এসে দাঁড়ায়। নিশুতির চিবুকে হাত রেখে বলে,
“অভিযোগ খুব?”
নিশুতি মাথা দুলায়। অর্থাৎ ‘না’। কিন্তু তার চোখ বলছে হ্যাঁ ভীষণ অভিযোগ আমার। ভীষউউউউউণ…
প্রায়াণ কিছু বলতে নেওয়ার আগেই নিশুতি বলে উঠে,
“জানো আমার বাসর রাত টা আজীবন মনে থাকবে আমার! সো স্পেশাল। তাই নয় কী?”
প্রায়াণ উত্তর দেয় না। নিশুতির চোখে স্পষ্ট জল কণা চিকচিক করছে। নিশুতি বহু কষ্টে আটকে রেখেছে তা। প্রায়াণের থেকে সরে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। একটা বেগুনি রংয়ের জামদানির শাড়ি পড়েছে সে। প্রায়াণই এসব কিনে এনেছিল কাল তার জন্য..আগাগোড়া নিজেকে একবার দেখে নেয় পরিপাটি ভাবে। বিবাহিত জীবনের আজ দ্বিতীয় দিন তার! অথচ…মনের কোথাও একটা সুখ নেই। সব থেকেও কেমন যেন ফাকা ফাকা লাগছে সব তার কাছে। এরকম টাই বুঝি হওয়ার ছিল! বোধহয়… মনে হয়।
নিশুতিকে আনমনা দেখে প্রায়াণ এগিয়ে আসে তার দিকে একপা দুপা করে….
বেশ হালকা ভাবেই জড়িয়েই ধরে পেছন থেকে প্রথমে…তারপর দুহাতের বন্ধন শক্ত করে নেয় ধীরে ধীরে।
“মন খারাপ?”
“উঁহু।” নিশুতির ছোট্ট জবাব।
“মিথ্যে বলছো। কিছু তো হয়েছে সিউর। বলো আমাকে!”
“বললাম তো কিছুই না।”
নিশুতিকে ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফিরায় প্রায়াণ। নিশুতির চোখে চোখ রাখে। অস্থির কণ্ঠে বলে,
“এবার বলো।”
নিশুতি থমকে দাঁড়িয়ে থাকে। একরাশ বিষন্নতা গ্রাস করছে তাকে। কেমম যেন করে…! নিশুতি ছলছল চোখে প্রায়াণের দিকে তাকায়। কিছু বলতে নেওয়ার আগেই দরজায় নক পড়ে।
প্রেমার গলা,
“ভাইয়া…ভাইয়া আম্মু ডাকে খেতে তোমাদের।”
নিশুতি প্রায়াণের বাহুডোর থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেয়। সে যেন এই কড়াঘাতেরই অপেক্ষায় ছিল। চোখের পানি টুকু চোখ দিয়েই ভেতরে শুষে নিয়ে বললো,
“ফ্রেশ হয়ে খেতে আসো।”
.
.
খাওয়া দাওয়ার পাট টা বেশ ঠিকঠাক,কোনো ঘটনাবিহীন ভাবেই চুকে যায়। বেলা ১১ টার দিকে বেশ কিছু মহিলা আসে। প্রায়াণের বউ দেখতে। সম্পর্কে এরা নিশুতির শ্বাশুড়ির ফ্রেন্ড, প্রতিবেশী। নিশুতি লক্ষী বউয়ের মতো সবাইকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায়। নিশুতির হাসিমুখ দেখে সবাই-ই খুশি হয় বেশ। দোয়া করে,সে যেন তার স্বামী সংসার নিয়ে সুখেই থাকে সবসময়। দোয়া শুনে নিশুতি দায়সারাভাবে হাসে শুধু। সে হাসি না জীবন্ত,না প্রানবন্ত। এইসব দোয়া গুলোও তার কাছে মিথ্যে আশ্বাস, জোকস আর সান্ত্বনা ছাড়া কিছুই মনে হয় না।
.
.
নম্রতাকে নিয়ে নিজের রুমে আসে মিনু শেখ। ভালোকরে দরজা টা আটকে দেয় সে। নম্রতা চকিতে বললো,
“কিছু বলবেন আন্টি?”
“আগে খাটে তো বসো। বলার জন্যেই তো ডেকেছি।”
নম্রতা বিছানায় বসে। পাশে মিনু শেখ। ফিসফিস করে বলে,
“আমি প্রায়াণের থেকে নিশুতিকে দূরে দূরেই রাখছি। চিন্তা করো না। বিয়ে করলেই একে অপরের হয়ে গেলো না। নিশুতি আর প্রায়াণের যেন মিলন কোনোদিনও না ঘটে সে দায়ভার আমার। তুমি কোনো চিন্তাই করো না তো। তোমার প্রায়াণ তোমারই থাকবে।”
কথাটা শুনে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে নম্রতা। পরমুহূর্তেই তার অস্থির ভাব কেটে যায়। না চাইতেও একটা সুখের শ্বাস বেরিয়ে আসে বুক চিড়ে।
.
.
কয়েকদিন কেটে যায় এভাবেই। প্রায়াণ আর নিশুতি যতবারই একে অপরের কাছে আসতে গিয়েছে কোনো না কোনো বাহানায় তাদের আলাদা করে দিয়েছে মিনু শেখ। প্রায়াণ সব কিছুই বুঝতে পারে। কিন্তু কিছু বলার মুখ নেই তার। মায়ের বিরুদ্ধে কথা কিভাবে বলবে!
.
ভার্সিটির ক্যাম্পাসে বসে আছে প্রায়াণ। অয়ন আসে দু কাপ চা নিয়ে।
“দোস্ত নে।”
প্রায়াণ কোনো কথা না বলে চুপচাপ তার থেকে চায়ের কাপ টা নেয়। অয়ন প্রায়াণের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলে,
“দোস্ত কোনো প্রবলেম? উদাস দেখাচ্ছে!”
প্রায়াণ নির্লিপ্ত ভাবে বলে,
“না রে কিছু না।”
অয়ন তার হাত খানা প্রায়াণের কাধে রাখে।
“বলতে পারিস আমাকে ভাই। কি হইছে?”
“বিয়ের আজ ১২ দিন হলো। এই পর্যন্ত একটা বারোও নিজের স্ত্রী কে নিজের করে পেলাম না ভাই। কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও বলি, প্রতিটা মানুষেরই একটা জৈবিক চাহিদা থাকে। বিয়ের পর সেই চাহিদা আরো বেড়ে যায় হুট করেই। আর স্ত্রীর সাথে একান্তে কিছু মুহুর্ত কাটাতে চাওয়া কিন্তু পাপ না। আমিও সেই চাওয়া টাই চাইছি। বাট কিছুতেই পাচ্ছি না রে ভাই!” প্রায়াণের বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পিছলে পড়ে।
অয়ন অবাক হয়ে কথাগুলো শুনে। চমকিত হয়ে বললো,
“কেন? তোর বউ-ই কি তোর থেকে দূরত্ব বজায় রাখছে??”
“নাহ।”
“তবে??”
প্রায়াণ এই উত্তরের আর জবাব দেয়না। ব্যাগ কাধে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বাসায় ফিরতে হবে তার।
.
.
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায় প্রায়াণের। খেয়েদেয়ে রুমে এসে দেখে নিশুতি বিছানা গোছাচ্ছে। প্রায়াণ কে আসতে দেখে অভিমান মাখা কণ্ঠে বলে,
“না আসলেও পারতে!.ইদানীং বাহিরেই সময় কাটাও বেশি!”
প্রায়াণ উত্তর দেয় না। চুপচাপ নিজের জায়গায় শুয়ে পড়ে। নিশুতি কিছুক্ষণ অদ্ভুত দৃষ্টিতে প্রায়াণের দিকে তাকিয়ে রয়। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেও বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।
.
.
রাত ১১ টা।
পাশাপাশি শুয়ে আছে দুজনেই। অথচ কারো মুখে কোনো বুলি নেই। নিশুতির হুট করেই ভীষণ কান্না পায়। মনে পড়তে থাকে সিলেট ভ্রমণের সেই দিনগুলির কথা। তখন তো জীবন টা কত রঙিন ছিল অথচ এখন! একদম পানসে লাগছে সব কিছু।
নিশুতি আড়চোখে প্রায়াণের দিকে তাকায়। প্রায়াণ সোজা হয়ে সিলিং এর দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে। মুখটা থমথমে,গম্ভীর…
নিশুতি হালকা অথচ দুর্বল গলায় বললো,
“কিছু হয়েছে তোমার?”
প্রায়াণ এবারো নিশ্চুপ। জবাব নেই কোনো। নিশুতি উঠে বসে। প্রায়াণের কাছে এগিয়ে এসে তার ডান হাত টা প্রায়াণের কপালের উপর রাখতেই প্রায়াণ খেকিয়ে উঠে।
“ছোঁবে না তো। বিরক্ত লাগে!!”
নিশুতির চোখে বিষ্ময়, হতাশা…সে বিমূঢ় হয়ে বসে রয়। প্রায়াণ অন্যপাশ ফিরে শোয়। বলে,
“এখনো এখানে কি? যাও না। প্রতিদিন তো শ্বাশুড়ির সেবা করে কাটাও। আজকেও যাও। এখানে থাকার তো কোনো মানে দেখছি না!”
নিশুতির বুক ভেঙে কান্না পায়। সে ফাকা ঢোক গিলে কতগুলো। ব্যথাতুর কণ্ঠে বললো,
“তোমার মা আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। এতে আমার দোষ?”
প্রায়াণ কঠিন গলায় বলে,
“জানিনা। জাস্ট যাও এখান থেকে। তোমার উপস্থিতি আমার ভালো লাগছে না।”
নিশুতি কষ্ট পায়। গভীর কষ্ট। সে ধীরে ধীরে সরে আসে প্রায়াণের থেকে। তারপর এক ছুটে বেড়িয়ে যায় রুম যায়। যাওয়ার সময় দরজার পাশে দাঁড়ানো মিনু শেখ কেও নজরে পড়ে না তার…
.
.
প্রেমা পড়ছিল রাত জেগে।
হঠাৎ দরজায় নক পড়তে বিরক্তবোধ করে সে। কিন্তু অবাক হয় যখন দেখে নিশুতি দাঁড়িয়ে।
“তুই?”
নিশুতি অশ্রুসিক্ত চোখে বললো,
“তোর সাথে আজ রাত টা থাকতে দিবি??”
চলবে…
________সারপ্রাইজ__________
রঙ চা
পর্বঃ২৪
মাহফুজা মনিরা
“তুই এত রাতে? কি হয়েছে? ভাইয়ার সাথে সব ঠিক তো?”
জলভরা চোখেই নিশুতি আলগা হাসে। হাসি ঠোঁটে রেখেই বলে, “ভেতরে ঢুকতে দিবি না?”
প্রেমা থতমত খায়। “আয় আয়” বলে দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়।
নিশুতি ঘরে ঢুকে বললো,
“তুই কি জানালার পাশে ঘুমোস? আমি আজকে জানালার পাশে ঘুমাবো। ওপাশ ছাড়া আমার ঘুম ভালো হয়না।”
প্রেমা এই প্রসঙ্গ নিয়ে উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করে আবারো।
“কিছু বলিস না কেনো? কিছু হয়েছে?”
এবার একটু বিরক্তিই বোধ হয় নিশুতির। সে কপালে ভাঁজ ফেলিয়ে,নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে,
“আমি এসেছি বলে কি তোর সমস্যা হচ্ছে? রাতে বিএফ এর সাথে ভালো করে কথা বলতে পারবি না এটাই ভাবছিস?”
প্রেমা হতবাক হয়। বিষ্মিত গলায় বলে, “এসব কি আবোলতাবোল বলছিস?”
“তো বলবো না তো কি করবো? যেভাবে প্রশ্নের উপর প্রশ্ন করতেছিস,যেন এসে তোকে বেশ ঝামেলায় ফেলে দিলাম।”
প্রেমার একটু রাগ হয়। আবার ঐ শান্ত নয়নের নিশুতির দিকে তাকাতেই তা উবে যায় হাওয়াই মিঠাইর মতোন।
ছিপছিপে শ্যাম বর্ণের মেয়েটার চোখে একধরনের “কেমন লাগা” ভাব আছে। তাকালেই বুকের মাঝে একটা অদ্ভুত চাপা শান্তি বয়ে যায় ছলছল করে।
প্রেমা আড়ষ্টতা ছাড়িয়ে নিশুতির দু হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। একটা চাপা আর্তনাদ করে বলে উঠে,
“উল্টো পাল্টা বকবি না। তুই জানিস না তুই আমার কত ভালো ফ্রেন্ড? তুই আসাতে আমি বিরক্ত হবো ভাবিস কিভাবে? পাজি মেয়ে।”
নিশুতি মুচকি হাসে। প্রশস্ত ঠোঁটে বলে, “এমনিই বললাম। একটু ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করলাম। বুঝিস না ক্যান বাল!”
“তোর মতো ওত পাকনা আমি না। তাই বুঝিনা অত।”
“হু ব আকার ল। বাল।”
বলেই খিলখিল করে হেসে উঠে নিশুতি। এতক্ষণে মনের ভেতর থাকা চাপানো কষ্টের পাথর টা একটু একটু করে গলে যাচ্ছে। মনের আকাশে জমা মেঘ কাটছে ধীরে ধীরে।
দুই বান্ধুবী বেশ অনেক্ক্ষণ গল্প করে। আর একটু পর পরই খিলখিল করে হেসে উঠে নিশুতি। কি প্রাণোচ্ছল সে হাসি! হাসির শব্দ দরজার ওপাশে কান পেতে থাকা প্রায়াণেরও কানে বিদ্ধ হয়।
নিশুতি চলে আসতেই প্রায়াণের বোধোদয় হয়। সে বুঝতে পারে কত বড় ভুল সে করে ফেললো। নিজের মায়ের উপর জমা রাগ টা তার ওমন মিষ্টি বউটার উপর দিয়ে কোন আক্কেলে যে তুলতে গেলো! তারপর নিজেই আসে দৌড়ে কিন্ত নিশুতির এই জীবন্ত হাসি শুনে তার আর ইচ্ছে করে না নিশুতিকে ডাকতে। থাক না আজকের রাত টা দু বান্ধুবী একই সাথে। করুক না মন খুলে গল্প…এতে যদি নিশুতির মনের মেঘ সরে যায়। তবে তাই বেশ..!
প্রায়াণ ধীর পায়ে আবার নিজের রুমে চলে যায়। তার উপস্থিতি একেবারেই জানান দেয় না ওদের।
নিজের রুমে এসে বারান্দায় চলে যায় প্রায়াণ। আজ রাত টা না ঘুমালে একটুও ক্ষতি হবে না। আকাশে চাঁদ নেই। তবে চাঁদের আলোর অভাব পূরণ করছে ছোট বড় হাজার হাজার তারা মিলে। অন্তরীক্ষ কি ভীষণ সুন্দর! প্রায়াণ কতক্ষণ মুগ্ধ হয়ে ঐ আকাশ দেখে। বায়ুতে শীত রাজা সদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ প্রায়াণের ঠান্ডা লাগছে না মোটেও।একটা গা ছাড়া গা ছাড়া ভাব এসে ঘিরে ধরলো তার চারিপাশে। ঠান্ডা অথচ শক্ত ফ্লোরের উপর হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে শুয়ে পড়ে প্রায়াণ। কিছুক্ষণ ওভাবেই শুয়ে থেকে একটা সিগারেট জ্বালে। রাত টা আজ এই সিগারেট আর কিছু এলোমেলো স্মৃতির ভিড়েই হারিয়ে যাক।
__________________________________________
কুয়াশার মায়াজাল বেধ করে একটা পেলব আলোয় প্রকৃতি ভরে উঠছে ধীরে ধীরে। নিশুতি মিটিমিটি করে তার চোখজোড়া খুললো। প্রতিদিন এর মতোই তার বাম পাশে ঘুরে তাকায়। প্রায়াণের জায়গায় প্রেমাকে দেখতে পেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস আছড়ে পড়ে বুকের পাড়ে। জামা ঠিক করে নিয়ে উঠে বসে নিশুতি। অবিচ্ছিন্ন,এলোমেলো চুলগুলো পেঁচিয়ে হাত খোপা করে নেয়। তারপর কিছুক্ষণ প্রেমার ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।
বিছানায় প্রায়াণ নেই। নিশুতির কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। এত ভোরে কই যাবে লোকটা! নিশুতি উঁকি ঝুকি মেরে বাথরুম দেখে নেয়। নাহ,নেই সেখানেও। বালতির পানি একদম স্থির। মেঝে শুকনো। সারা রাতেও যে কারো পা পড়ে নি বাথরুমে নিশুতি তা বুঝতে পারে।
বেলকনিতে উঁকি দিতেই নিশুতি চমকে যায়। গুটিশুটি মেরে প্রায়াণ ঘুমিয়ে আছে। ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছে। সারা রাত কি এখানেই ছিল ছেলেটা! নিশুতি ঘুম ভাঙা চোখে একগুচ্ছ প্রশ্নের মেলা। সে তড়িঘড়ি করে প্রায়াণ কে ডাকতে ব্যস্ত হয়ে যায়।
“শুনতেছো? ঐ ব্যাটা। উঠো। প্রায়াণ….এই প্রায়াণ….উফফফ!!”
নিশুতির ধাক্কাধাক্কিতে প্রায়াণের ঘুম ভেঙে যায়। ঢুলু ঢুলু ভাবে উঠে বসে সে। একটা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকায় নিশুতির দিকে। নিশুতি চোখ গরম করে তাকায়। প্রায় চিৎকার করে বলে,
“তুমি এখানে ঘুমাইছো কালকে?? তোমার কি হাটুর তলে বুদ্ধি? এই ঠান্ডায় এইখানে ক্যান আইসো?? ঐ বলো। ক্যান আইসো??”
প্রায়াণ উত্তর দিলো না। হাসলো শুধু। প্রায়াণের পাশেই এলোমেলো ভাবে সিগারেট এর টুকরো ছড়ানো ছিটানো। নিশুতি গর্জে উঠলো,
“তুমি সিগারেট খাইছো??”
প্রায়াণের হাসি নিমিষেই মিলিয়ে গেলো। নিশুতি একপ্রকার টানতে টানতে প্রায়াণকে এনে ছুড়ে মারে বিছানার উপর। হাত পা জমে ঠান্ডা হয়ে গেছে তার। বিছানা থেকে কম্বল উঠিয়ে কম্বল চাপা দেয় প্রায়াণ কে। চুলগুলো জোরে জোরে টানতে টানতে বলে,
“এখন ঘুমা। ঘুম থেইকা উইঠা ল। তোর সিগারেট আমি বাইর করমু!!”
প্রায়াণ নড়েও না। হুমকির ঠ্যালায় চোখ অফ করে দ্রুত। এবং খানিকবাদেই তার গাঢ় শ্বাস শুনতে পায় নিশুতি।
ফ্রেশ হয়ে ঝাড়ু এনে সিগারেট এর খোসা,টুকরো সব ঝাড়ু দিয়ে ফেলায়। এরপর বের হয়ে যায় নাস্তা তৈরির উদ্দেশ্যে..
__________________________________________
বেলা ১০ টা। বাসায় নিশুতি,মিনু শেখ,প্রায়াণ আর প্রত্যুষ। আজ প্রত্যুষের অফিস নেই। তবুও বাসায় লেপটপে অফিসেরই কিছু কাজ করছিল বসে বসে। ঠিক তখনি বেল বাজে। প্রত্যুষ উঠতে নিলে নিশুতি রান্নাঘর থেকে বের হতে হতে বললো,
“আমি খুলছি ভাইয়া।”
দরজা খুলে দেখে নম্রতা আটসাট হয়ে দাঁড়িয়ে।
নিশুতি দরজা থেকে সরে ভেতরে আসার আমন্ত্রণ জানায়। নম্রতা মুখে হাসি ফুটিয়ে ভেতরে এসে সোজা মিনু শেখ এর ঘরের দিকে চলে যায়। নিশুতি তার যাওয়ার দিকে একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বেশ অনেক্ষণ। তার কাছে মেয়েটাকে ভালোই লাগে আগাগোড়া। কিন্তু তবুও মনটা খামচে ধরে মাঝে মাঝে। মনে হয় যেন মেয়েটা মুখোশ পড়ে থাকে প্রতিনিয়ত। আর এর মুখোশ এর ওপাশের চেহারা টা খুব ভয়ংকর। খুউউউব….
নিশুতির ঘোর কাটে প্রত্যুষের কথায়।
“ওভাবে কি দেখছো আপু?”
প্রত্যুষের এই একটা জিনিস বেশ মন কাড়ে নিশুতির। ছোট বড় সবাইকে সম্মান এবং শ্রদ্ধা দিয়ে কথা বলে প্রত্যুষ ছেলেটা।
নিশুতি ঠোঁটে আলগা হাসি ফুটায়। বললো,
“কই ভাইয়া। কিছুনা।”
“আমি দেখছি। নম্রতার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছিলা!”
“না ভাইয়া। তেমন কিছু না।”
“এদিক আসো তো আপু। সোফায় বসো।”
নিশুতি বাধ্য মেয়ের মতো প্রত্যুষের আদেশ পালন করে। চুপটি করে সোফায়,প্রত্যুষের থেকে বেশ খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে বসে।
প্রত্যুষ কোলের উপর থেকে লেপটপ সরিয়ে নিশুতির দিকে সোজাসুজি ঘুরে বসে।
“নম্রতা প্রায়াণের বাগদত্তা ছিলো। এটা জানো তো?”
নিশুতি মাথা কাত করে। অর্থাৎ সে জানে।
প্রত্যুষ আবার বলে,
“অথচ প্রায়াণের স্ত্রী এখন তুমি। সেক্ষেত্রে নম্রতাকে দেখলে তোমার একটু কেমন কেমন লাগতেই পারে। স্বাভাবিক। তবে আমি তোমার একটা ডাউট ক্লিয়ার করতে চাই। প্রায়াণ কিন্তু কখনোই নম্রতার ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড ছিল না। ইন ফ্যাক্ট,ও কোনো মেয়ের উপরেই কখনো ইন্টারেস্ট প্রকাশ করেনি। হি হ্যাজ আ লটস অফ গার্লস ফ্রেন্ড। বাট দে আর অনলি ফ্রেন্ড, নাথিং এলস। বুঝছো?”
নিশুতির একটু গর্ব গর্ব লাগে। বুক ফুলে যায় প্রায়াণের প্রতি। যে ছেলেটা এত শিক্ষিত, এত ভালো, অথচ কখনো কোনো মেয়ের সাথে তার তেমন কিছুই ছিল না আর না সে কারো প্রতি আগ্রহী ছিল। সেই ছেলেটা নিজ থেকেই তার জীবনে এসে তার জীবন সঙ্গী হয়েছে।
প্রত্যুষ আবারও বললো,
“যখন ফার্স্ট টাইম আমি জানতে পারি যে প্রায়াণ লাভ ইউ। তোমাদের রিলেশন আছে। আমি জাস্ট অবাক হই। কত সুন্দরী,কত হাইফাই লেভেলের মেয়েরা প্রায়াণ কে চেয়েছে অথচ প্রায়াণ ছিল ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সেই কিনা তোমার মতো একজন কে…আমি তোমাকে ছোট করে বলছিনা। জাস্ট কথার কথা বলছি। কিন্তু এখন বুঝতে পারতেছি কেনো প্রায়াণ তোমাকে ভালোবাসছে। কারন তোমার ভেতরে কেমন যেন একটা জিনিস আছে। বুঝলা নিশুতি? দেখলেই তোমার উপর মায়া,ভালোলাগা সৃষ্টি হয়ে যাবে যে কারোরই। যাইহোক,আমি শুধু এখন এটুকুই দোয়া করি,তোমরা সুখে থাকো। শান্তিতে থাকো আপু।”
নিশুতি মুগ্ধ হয়। অভিভূত হয়। মিষ্টি গলায় বলে,
“দোয়া করবেন ভাইয়া।”
__________________________________________
কালকে রাতে প্রায়াণ আর নিশুতির ঝগড়ার কথাটা শুনতেই নম্রতার মুখে একটা পৈচাশিক হাসি ফুটে উঠে। সে গদগদ হয়ে মিনু শেখ এর গলা জড়িয়ে ধরে দু হাতে…
বলে,
“আন্টি ইউ আর জাস্ট অসাম…লাভ ইউ আন্টি।”
__________________________________________
দুপুরের আজান পড়বে আর কিছুক্ষণ বাদেই। প্রায়াণ ঘুমিয়ে এখনো। নিশুতি রান্নাবান্না শেষে ঘরে যায় তার। উল্টো হয়ে এলোমেলো ভাবে প্রায়াণ কে ঘুমাতে দেখে মুচকি হাসে সে।
গুচ্ছ গুচ্ছ কিছু অবিন্যস্ত চুল প্রায়াণের খোলা কপালের বেশ খানিকটা জুড়ে..বিচরণ করছে।
নিশুতি আঙুলের ডগা দিয়ে সরিয়ে দেয় সেসব। একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে যায় মাথায়। প্রায়াণের মোটা নাক টা চেপে ধরে আঙুল দিয়ে। ভীষণ টাইট করে।
শ্বাস নিতে না পেরে গলা কাটা মুরগীর মতো হাসফাস করতে করতে উঠে যায় প্রায়াণ। নিশুতি ভারি মজা পায়। বাচ্চাদের মতো হাতে তালি দিয়ে সে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে।
প্রায়াণ উঠে বসে বিছানায়। হাত দিয়ে নাক ডলতে থাকে। কপট রাগী চোখে নিশুতির দিকে তাকায়। মেয়েটা দিন দিন বদের হাড্ডি হচ্ছে। নিশুতি সে দৃষ্টি লক্ষ করে চুপসে যায়। পরমুহূর্তেই একটা ভাব আনে শরীরে। কর্কশ গলায় বলে,
“গোসল করে নামাজে যাও।”
বলেই উঠে যেতে নেয় প্রায়াণের পাশ থেকে। প্রায়াণ নিশুতির হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে নিজের কাছে।
“রাঙা পরী। কোথায় যাও?”
প্রায়াণের আহ্লাদী গলা।
নিশুতি মুখ ঝামটে বলে,
“জাহান্নামে।”
“ছি ছি! এসব কি কথা। এগুলো বলতে নেই সোনা।”
নিশুতির মাথাটা নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরে প্রায়াণ। নিশুতি মোচড়াতে মোচড়াতে উঠে পড়ে।
ঝাঁঝ গলায় বললো,
“ঢং মারাবা না। সরো তো।”
প্রায়াণ হতবিহ্বল।
হালকা গলায় বললো,
“ঢং মারাবা না? এটা কী ধরণের ভাষা নিশুতি??”
নিশুতি আগের মতোই ঝাঁঝালো গলায় বললো,
“বাল ধরণের কথা। ছাড়বা তুমি আমারে??”
নিশুতির চোখ দিয়ে আগুন ঝরে পড়ছে। এই মুহুর্তে তার কাছে ক্ষমতা থাকলে সে চোখ দিয়েই অগ্নিবর্ষণ করতো প্রায়াণের উপর। প্রায়াণ ভয় পায়। নিশুতিকে ছেড়ে কাঁদোকাঁদো গলায় বলে,
“এ কেমন বউ। একটু আদর তো করেই না,আবার করতেও দেয় না। খালি বকা দেয়।”
নিশুতি বিছানা গুছাতে গুছাতে বললো,
“ঢং না দেখাইয়া যাইয়া গোসল করো।”
তারপর একটু চেঁচিয়ে বললো,
“নামাজের ওয়াক্ত চলে যাবে পরে।”
প্রায়াণ চেঁচানির ঠ্যালায় দু’হাতে কান চেপে ধরে। ব্যস্ত গলায় বললো,
“যাচ্ছি যাচ্ছি।”
প্রায়াণ চলে যেতেই নিশুতি আবার খিলখিল করে হেসে উঠে। বেশ শব্দ করে…
চলবে….