রঙ চা পর্বঃ২১,২২

রঙ চা
পর্বঃ২১,২২
মাহফুজা মনিরা

নিশুতি লজ্জায় প্রেমার হাতে জোরে টিপ্পনী কাটে। প্রেমা বুঝতে পেরে পিউকে বললো,
“অনেক বড় হয়ে গেছিস না?? চল। বাহিরে চল”

একপ্রকার বগলদাবা করে প্রেমা পিউকে নিয়ে বাহিরে যায়। প্রায়াণ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

“আজকালকার ছেলেমেয়ে সো এডভান্স!!”

“হুম।কিছু বলতে চাইছিলা আমায়?”

“হ্যাঁ বলতে চাই।”

প্রায়াণ কিছুটা সিরিয়াস মুডে নিশুতির দিকে তাকায়। তারপর বলে,
“দেখো যেভাবেই হোক না কেনো,এই পরিবারের বউ এখন তুমি। আমার বাবা আমাদের মেনে নিলেও মন থেকে মেনে নেয়নি সেটা আমি বুঝতে পারতেছি আর আম্মু তো মেনেই নিলো না। তোমার এখন প্রথম এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আমার বাবা মায়ের মন জয় করা। বাবার মন জয় করতে বেশি কিছু করতে হবে না। সে নম্র ভদ্র টাইপের মেয়ে পছন্দ করে। আর সেটা তোমার ভেতরেই আছে। তবে মায়ের মন জোগাতে অনেক কষ্ট করতে হবে। কিন্তু সেটা তোমাকে করতে হবে নিশুতি।”

প্রায়াণ এগিয়ে গিয়ে নিশুতির হাতজোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,
“আমার জন্য হলেও করতে হবে।”
নিশুতি স্মিত হেসে বলে,
“তুমি চিন্তা করোনা। আমি জানিনা আমি পারবো কীনা কিন্তু চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?”
প্রায়াণ নিশুতির কথায় সন্তুষ্ট হয়। নিশুতিকে নিজের বুকের মাঝে চেঁপে ধরে বলে,
“আমি জানি তুমি পারবে। তুমি অনেক ভালো একটা মেয়ে। আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমার কপালে সুখ লিখে রেখেছে।”
.
.
সামনে প্রশস্ত নদী….ধীরে ধীরে বায়ুর প্রবাহে বয়ে চলছে। কখনো বা জোরে, কখনো বা আস্তে…ঠিক যেন নম্রতার চোখের ধারার মতোন করে। কখনো ঝুপঝুপ করে ঝরছে কখনো বা ধীর ভাবে…কিন্তু ঝরছেই..

নম্রতার থেকে কিছুটা দূরে শান দাঁড়িয়ে। নম্রতাই ডেকে এনেছে তাকে। শান অফিসের কাজ বাদ দিয়ে সোজা চলে এসেছে নম্রতার ডাকে। কিন্তু আসার পর থেকে একটা কথাও বলছে না সে। শুধু চোখের পানি ফেলছে। এদিকে শানের যে বুকের ভেতরে তোলপাড় হচ্ছে তা কি নম্রতা বুঝবে!
শান একটু এগিয়ে নম্রতার পাশাপাশি দাঁড়ায়। হালকা গলায় বললো,
“কি হয়েছে? এভাবে ডেকে এনে কাঁদছেন কেনো?কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারেন।”
নম্রতা যেন একটা শক্ত কাধ খুঁজে পেলো। শানের কাধ। সে শানের দিকে পুরোপুরি হেলে তার কাধে মাথা রাখে। অশ্রুসিক্ত চোখেই জবাব দেয়,
“আমার ভালোবাসা তার ভালোবাসা কে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে। সে আজ থেকে বিবাহিত।”
শান ঠিকভাবে বোঝে না কথাটা। সে একটু চুপ থেকে বলে,
“বুঝলাম না কিছুই”
নম্রতা এবার শানের কাধ থেকে মাথা সরিয়ে সরু চোখে শানের দিকে তাকায়। সেই অশ্রুসিক্ত চোখ যেন শানের হৃদপিণ্ডের স্পন্দন বাড়িয়ে তিনগুণ করে দিলো। শান ভয় পায়। এতো জোরে হার্টবিট করছে!! যদি শুনে ফেলে নম্রতা তা…!
নম্রতা দায়সারাভাবে আবার বলে,
“প্রায়াণ আমাকে কখনোই ভালোবাসেনি। সে যাকে ভালোবাসে তাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে।”

শান এবার বুঝতে পারে।
ছোট্ট করে জবাব দেয়,”ওহ”

“আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি এমন কিছু হবে জানেন! আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কাকে দেখাবো এই ফাটা বুকের কষ্ট”

শান চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। সত্যি বলতে তার মনে একটা প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কেনো যেনো সে নম্রতা নামের এই মিষ্টি মেয়েটাকে হারাতে চায়না।

নম্রতা আবারো বলে,
“স্কুল,কলেজ,ভার্সিটি জীবনে কোনো বন্ধু করিনি আমি। একমাত্র প্রায়াণের জন্য। ওই আমার সব ছিল। আর ওই আমাকে এভাবে ঠকালো!”

শান নম্রতার কাধে হাত রেখে বলে,
“প্রায়াণ কি আপনাকে কখনো ভালোবেসে ছিল?”

নম্রতা ছোট করে বলে,
“উঁহু।”

“তাহলে অযথা ওকে দোষ দিচ্ছেন। সে তো আপনাকে ভালোবাসেনি,স্বপ্নও দেখাইনি। যদি আপনার সাথে রিলেশন করে অন্য কাউকে বিয়ে করে আনতো তাহলে সেক্ষেত্রে আপনি ঠকতেন। কিন্তু সে তো এসব কিছুই করেনি। আপনাকে সে ঠকাই নি,বরং আপনি আপনার এক তরফা ভালোবাসায় ঠকেছেন। এটাকে মানতে হবে আপনার।বাস্তবতা বড়ই কঠিন মিস নম্রতা।”

নম্রতা চুপ করে থাকে। শানের প্রতিটি কথাই সত্য। সে এর জবাব খুঁজে পায়না। একবার ভাবে,সে দেশ ছেড়ে চলে যাবে তার বাবার কাছে। আবার মনের কিনারায় কোথাও একটা ভরসা খুঁজে পায় মিনু শেখ এর কথায়। সে তো কথা দিয়েছে তাকে..
নম্রতা সাতপাঁচ ভেবে চোখ মুছে মুখে হাসির রেখা টানে। বলে,
“চটপটি খান? আমার সাথে খাবেন আজ?”

শান মাথা হেলিয়ে সম্মতি প্রদান করে। এই মেয়েটাকে হাসলেই ভালো লাগে…কাঁদলে একদমই না…
.
.
প্রেমা দুপুরের রান্নার আয়োজন করছে একা হাতে। তা দেখে নিশুতি এগিয়ে আসে।
“আন্টি কোথায়?”

প্রেমা সরু চোখে,কপাল কুঁচকে বলে,
“কে আন্টি?”

“আরে তোর আম্মু!”

“আমার আম্মু তোর আন্টি?”

নিশুতি জিভ কাটে। বলে,
“হুট করে মা বলাটা কেমন না!”

“কেমন হলেও তোকে বলতে তো হবেই।”

“হুম। অভ্যাস হয়ে যাবে আস্তে আস্তে। এখন বল সে কই? তুই একা সব করছিস কেনো?”

“আম্মু ভীষণ রাগ রে। সে কি এখন এসব রান্না বান্নার আয়োজন করবে? তোর মনে হয়? তাই আমিই…”

“আমিও হেল্প করি তোকে?”

“না তুই যা। আমি পারবো।”

“আমি করবো বলছি না..!”

নিশুতি জিদ করে। প্রেমা তার জিদের কাছে হেরে যায়। কাটা মাংস গুলো নিশুতির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“এগুলো রান্না হবে আজ। তুই পারবি করতে?”

নিশুতি গর্ব করে বললো,
“সে আর বলতে! আমিই পারবো। দে আমায়।”

নিশুতি খুব যত্ন সহকারে মাংসের পিস গুলো ধুয়ে নেয়। তারপর মশলা হলুদ মরিচ লবন মাখিয়ে ভাজতে শুরু করে। প্রেমা দেখে বলে,
“একাই পারবি মনে হচ্ছে! তাহলে তুই রান্না কর। আমি আসতেছি।”

প্রেমা বাহিরে আসতেই দেখে প্রায়াণ দাঁড়িয়ে। সে রান্নাঘরেই ঢুকতে নিচ্ছিলো। প্রেমাকে দেখে বলে,
“তোর ভাবী ভেতরে?”

প্রেমা মুচকি হেসে উত্তর দেয়,
“হ্যাঁ রান্না করছে। এত চোখে হারাও কেনো ওকে??”

প্রায়াণ মৃদু হাসে। উত্তর দেয়না। প্রেমা বলে,
“ভাইয়া তোমার সাথে আমার কথা আছে। চলো বারান্দায় যাই?”

“চল।”

দু ভাইবোন মিলে বারান্দায় এসে বসে। প্রেমা প্রশ্ন করে,
“তোরা ধরা পড়লি কি করে ওদের হাতে?”

“কাদের হাতে?”

“যারা তোদের বিয়ে পড়িয়ে দিলো তাদের হাতে।”

প্রায়াণ প্রশ্ন বুঝতে পেরে বলে,
“আমরা তাবু টানিয়ে ছিলাম সারারাত পান্থুমাই ঝর্ণার কাছেই একটা খোলা জায়গায়। সেখান থেকেই সকালে ধরা পড়ি।”

“তারা জানলো কি করে যে তোরা বিবাহিত না?? বলতে পারলি না যে তোরা স্বামী স্ত্রী??”

প্রায়াণ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোর মতো ওত বুদ্ধি কি আমাদের আছে! ছাগল!!. বললেই বিশ্বাস করে নেয়?? ওরা ম্যারেজ সার্টিফিকেট চায়। সেটা না থাকলে বলে উভয়ের বাবা মাকে কল করতে। তখন? কি করতাম,আমি আম্মু আব্বুকে কল করতাম??”

প্রেমা আফসোস করে বলে,
“কত আশা ছিল তোর বিয়ে নিয়ে! অথচ কি হয়ে গেলো। যাক গে,বিয়ে ঠিকভাবে হয়নি তো কি হইছে। বাসর রাত জমিয়ে হবে। বিকেল হলেই ফুল নিয়ে আসবো। আমি নিজ হাতে সাজাবো ভাই।”

বলেই দাত কেলিয়ে হাসতে থাকে প্রেমা। প্রায়াণ চোখ পাকিয়ে বললো,
“খুব পেকেছিস না??বেয়াদব। যা এখান থেকে।”

প্রেমা মুখ বাকিয়ে চলে যায় বারান্দা থেকে। প্রায়াণ একা দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে। আচ্ছা,বাসর রাতে তো স্ত্রী কে উপহার দিতে হয়। না?? প্রায়াণ ভাবতে থাকে কি উপহার দেওয়া যায় তার নিশুতিকে…
.
.
জালাল শেখ চোখ বুজে শুয়ে আছেন। ঘুমাচ্ছেন নাকি জেগে আছেন বলা যাচ্ছে না। মিনু শেখ সেসব জানতেও চান না। সে সোজা গিয়ে দুম করে বসে পড়ে তার পাশে। বিলাপ জুড়ে দেয় কানের কাছে।

“তুমি কেমনে পারলা ওদের মেনে নিতে? তোমার কারনে আমার ছেলেগুলো একদম নষ্ট হয়ে গেলো। আজ প্রায়াণ কে মেনে নিলা,তা দেখে আবার বড় ছেলেও না বিয়ে করে নিয়ে আসে এভাবে!!! আর মেয়ে দুইটা তো এখনি গেছে। ছেলে বন্ধুর অভাব নেই তাদের। কবে জানি ওরাও কিছু করে বসে!! তোমার জন্য আমার বান্ধুবীর কাছে আমার মান সম্মান কিচ্ছু থাকলো না। নম্রতার মা যখন এসব শুনবে কি জবাব দেবো আমি ওকে?? আর নম্রতাও বা কি পরিমাণে কষ্ট পাচ্ছে তুমি জানো? ক্যান করলা এমন তুমি??”

জালাল শেখ চোখ বুজেই উত্তর দেয়,
“যার বিয়ে আল্লাহ যেভাবে ঠিক করে রেখেছে তার টা সেভাবেই হবে। এটা নিয়ে এতো চিল্লাচিল্লির কি আছে!!”

“ওহ আমি ফাও কামে চিল্লাইতেছি??? প্রত্যুষের বাপ,তুমি কিন্তু বেশি বলতেছো এখন। আমার কিন্তু রাগ হচ্ছে বলে দিচ্ছি।”

জালাল শেখ এবার শোয়া থেকে উঠে বসেন। কঠিন গলায় বলে,
“ছেলে ভুল করছে দেখে কি ছেলেকে ফেলে দিবো? বন্যার পানি ভাইসা আইছিল ও?? মানুষই বা কি বলবে?? বরং মেনে নিয়েই ভালো করেছি।মানুষের আর বলার মুখ থাকবে না। আর আমার বাকি ছেলেমেয়েরা কি করবে কি করবে না সেটা ওরা বুঝবে।।প্রায়াণ প্রত্যুষ প্রেমা তিনজনেই ভালো বড় হয়েছে। ওরা নিজেদের ভালোমন্দ বুঝতে শিখছে। আমি বিশ্বাস করি,যদি না প্রায়াণ ঝামেলায় পড়তো ও কখনোই এভাবে বিয়ে করতো না। আর কি যেন বললা? তোমার বান্ধুবীর মেয়ে তো আরেক ছেলের বাইকের পেছনে ঘুরে বেড়ায়। আমি কি দেখিনাই? চোখ নাই আমার? আর এখন আসছে ন্যাকা কান্না করতে!! আমার তো নম্রতার থেকে নিশুতি মেয়েটাকেই বেশি ভালো লাগছে। আর প্রায়াণ নিশুতিকে পাশাপাশি মানায়ও ভালো। তুমি ফাও ফাও এতো বকতেছ!!তুমিও চোখ মেলে তাকাও একটু ওর দিকে। তুমিও বুঝতে পারবা নম্রতা কিরকম আর নিশুতি কিরকম। এবার যাও। আমি ঘুমাবো একটু। একদম প্যান প্যান করবা না কানের কাছে।”

জালাল শেখ আবার শুয়ে পড়ে। মিনু শেখ ভোতা মুখে তার পাশেই বসে থাকে। তার এখন কি করা উচিত! তার স্বামীর মতোই সব মেনে নেওয়া…নাকি টিভির ভিলেইন শ্বাশুড়ি সাজা! মিনু শেখ ভাবনায় পড়ে যান।

চলবে….

রঙ চা
পর্বঃ২২
মাহফুজা মনিরা

প্রেমা পিউ ফুল নিয়ে ব্যস্ত। প্রত্যুষ ওদের ডাইরেকশন দিচ্ছে বেড সাজানোর ব্যাপারে। প্রায়াণ একবার রুমে ঢুকতে চাইলে প্রত্যুষ ধমকে উঠে,
“এই ব্যাটা তুই এখানে এসে কি করবি?”

“আমার বাসর ঘর কিভাবে সাজাচ্ছো সেটা দেখবো না!”

প্রত্যুষ চোখ গোল গোল করে বললো,
“তর কি একটুও লজ্জা শরম নাই? নিজের বাসর ঘর নিজে সাজাইতে চাস! বেয়াদব। যা এইনতে..”

প্রায়াণ ধমক খেয়ে ফিরে আসে। গজগজ করতে করতে এসে ড্রয়িংরুমে বসে। নিশুতি আগে থেকেই ওখানে বসা ছিল। কিছুক্ষণ বাদে নাকি পার্লার থেকে লোক আসবে। নিশুতিকে বউ সাজাতে৷ সেই অপেক্ষায় আছে নিশুতি।
প্রায়াণ কে দেখে মুচকি হেসে বলে,
“আসলেই তোমার কান্ডজ্ঞান নেই? নিজের বাসর ঘর কেউ নিজেই সাজাতে যায়! বলো।”

“আমি চাই। ওরা যদি ঠিকঠাক ভাবে না সাজায় তখন? পুরো বাসর রাত টাই নষ্ট হবে!!”

“বাসর ঘর সাজানোতে বুঝি বাসর রাত কেমন হবে সেটা নির্ভর করে?”

প্রায়াণ ভ্রু কুঁচকে বললো,
“তো?”

নিশুতি অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে,কিছুটা লজ্জা মাখা গলায় বলে,
“তুমি কি আমাকে আদর করাতে ব্যস্ত থাকবা নাকি বাসর ঘর খুটিয়ে দেখতে!”

প্রায়াণ থতমত খায়। নিশুতি নিজেই কথাটা বলে জিভ কাটে বারংবার। ইশ! কিই না বলে ফেললো সে! এই নির্লজ্জের সাথে থাকতে থাকতে নিজেরও লজ্জা কমে আসছে বোধহয়।

প্রায়াণ কিছু বলতে যাবে তার আগেই কলিং বেল বেজে উঠে। নিশুতি পড়িমরি করে উঠে যায়। একটা তো অজুহাত পাওয়া গেলো। এই লজ্জাজনক অধ্যায় থেকে নিজেকে বাঁচানোর!

দরজা খুলতেই ইফতি তড়িঘড়ি করে ভেতরে ঢোকে। অনেকদিন পর ভাইকে দেখে নিশুতির চোখে জল ছাপিয়ে উঠে ধীরে ধীরে। কিন্তু অভিমানী স্বরে বলে,
“না আসলেও পারতি! সকাল থেকে অপেক্ষা করছি। এখন সময় হলো বুঝি আসার”

ইফতি কান ধরে দুহাতে। অনুনয়ের সুরে বলে,
“একটা ফ্রেন্ড এক্সিডেন্ট করছে সকালে। ওকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম আর কি করে জানবো তুই আজকে আসবি! বাসায় আসার পর মায়ের থেকে সব শুনে ছুটে এলাম এখানে। সরি আপু।”

নিশুতি হাসি হাসি মুখ করে বলে,
“ইটস ওকে।”

“প্রায়াণ ভাইয়া কই?”

পেছন থেকে প্রায়াণ বলে,
“এই যে আমি।”

ইফতিকে নিয়ে সোফায় বসে নিশুতি। ইফতি অবিশ্বাসের সুরে বলে,
“এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমার যে প্রায়াণের জন্য তুই বাসা থেকে পালানোর ডিসিশন নিছিলি সেই প্রায়াণই তোর হাজবেন্ড এখন!!”

নিশুতি জবাব দেয়,
“আমিও তো কখনো ভাবিনি আমি কাউকে ভালোবাসতে পারবো,বা তার সাথেই বিয়ে হবে আমার। বাট হয়ে গেছে!”

প্রায়াণ বলে উঠে,
“আসলে ভাগ্য কাকে কখন কোন পরিস্থিতিতে ফেলে সেটা কেউ আগাম জানে না।”

ইফতি আর কথা বাড়ায় না এই বিষয়ে। নিশুতির হাতে হাত রেখে বলে,
“যাইহোক এবার তুই সুখে থাক আপু। এটাই হলো মূখ্য চাওয়া।”

নিশুতি ইফতির চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলে,
“যাকে ভালোবাসছি আমি তাকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে পেলাম। আমার ভাইটাও আমার পাশেই থাকবে। যখন ইচ্ছা দেখতে পারবো,কথা বলতে পারবো। আমি সুখে থাকবো না তো কে থাকবে বল!”

প্রতিউত্তরে ইফতি কিছুই বলে। দায়সারাভাবে হাসে শুধু।

কিছুক্ষণ বাদে পার্লার থেকে দুজনে মহিলা আসে। নিশুতি তাদের কে নিয়ে প্রেমার ঘরে যায়। ড্র‍য়িং রুমে বসে থাকে প্রায়াণ আর ইফতি। দুজনে কিছু কথাবার্তা বলে ইফতি বিদায় নেয়।
.
রাতের রান্না টা মিনু শেখই করে। খুব আয়োজন করে। এবং তাকে বেশ হাসিখুশিও দেখাচ্ছে। নম্রতা ও এসেছে অবশ্য কিন্তু মিনু শেখ ডেকেছে বিধায়।
যখন নিশুতির বউ সাজ শেষ, নম্রতা তাকে দেখতে যায়। এবং তাকে দেখেই নম্রতার চোখ ছাপিয়ে জলের কণা চিকচিক করে উঠে। তবুও বেশ কষ্টে নিজেকে দমিয়ে রাখে নম্রতা। হাসিমুখে নিশুতির সাথে দুটো কথা বলে রান্নাঘরে ফিরে আসে আবার।
এসেই নিঃশব্দে কেঁদে ফেলে। মিনু শেখ খেয়াল করে তা। কিন্তু নম্রতাকে স্বান্তনা দেয়না। স্বান্তনা সে আর দিবেও না। যা করবে সোজা করেই দেখাবে।

অনেক ঝামেলার পর,নিজের বোনদের কেই টিপস দিয়ে রাত সাড়ে ১১ টায় প্রায়াণ বাসর ঘরে ঢুকে। রুমের দরজা আটকে দোয়াদরুদ পড়ে নিজের বুকে নিজেই ফু দেয় বারকয়েক। তারপর মুখে হাসি রেখে নিশুতির দিকে এগিয়ে যায়।

ফুলেল বিছানায় নিশুতি এককোনায় চুপচাপ ‘দ’ ভঙ্গিতে বসা। প্রায়াণের আগমন বার্তা পেতেই সে নড়েচড়ে বসে। ভেতরটা কাঁপছে তার। যতই পরিচিত হোক, বাসর রাতে প্রতিটা মেয়েরই একটা আলাদা ভালোলাগা,আলাদা অনুভূতির সৃষ্টি হয়।
নিশুতির মনেও সেই অনুভূতিরা নাড়াচাড়া দিয়ে উঠেছে। নিশুতি খেয়াল করে তার পা দুটো তিরতির করে কাঁপছে ধীরে ধীরে। প্রায়াণের চোখে পড়বে ভেবে নিশুতি তার পাজোড়া শাড়ির ভেতরে আলগোছে ঢুকিয়ে নেয়।
.
প্রায়াণ এসে নিশুতির সামনে বসে। খ্যাঁক খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করে নেয় দুইবার। যেন সে গান গাইতে শুরু করবে এখুনি!
পাতলা ঘোমটার তল থেকে নিশুতি প্রায়াণকে দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে।
প্রায়াণের ভেতরে ভেতরে বেশ নার্ভাস লাগলেও সে নিজের ঠাঁট বজায় রাখার চেষ্টা করে চলছে অনবরত।

নিশুতি হালকা গলায় বললো,
“তুমি কি গান গাইবা?”

“কেনো?”বিষ্ময় নিয়ে বললো প্রায়াণ।

” যেভাবে খ্যাঁক খ্যাঁক করছো তাই আস্ক করলাম।”

প্রায়াণ লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বলে, “ওহ।”

তারপর আবার দুজনেই চুপচাপ। নিশুতিই বলে,
“কিছু বলবা নাকি এভাবেই চুপ করে বসে থাকবা?”

প্রায়াণ নড়েচড়ে উঠে বলে,
“হ্যাঁ বলবো তো। আসলে এই প্রথম তো বাসররাত আমার তাই একটু কেমন যেন লাগছে!”

ঘোমটার তল থেকে মুখ বের করে,নিশুতি অবাক হয়ে বললো,
“মানুষের কি বারবার বাসর রাত হয়? আমার কি দ্বিতীয় বার হচ্ছে নাকি? আজব!!”

প্রায়াণ আবারও নিজের বোকাবোকা কথার জন্য লজ্জা পায়। সে আর কোনো কথা বলে না। আস্তে আস্তে নিশুতির পাশ ঘেঁষে বসে। এবার লজ্জা চেপে ধরে নিশুতিকে। সে আবার ঘোমটার ভেতর মুখ লুকিয়ে ফেলে। স্থির হয়ে বসে থাকে।
প্রায়াণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“আজকে আমি এমন কিছু করতে চাই যাতে তোমার এই রাত টা স্মরণীয় হয়ে থাকে আজীবন।”

নিশুতি জবাব দেয়,
“প্রতিটি মেয়ের কাছেই তার বাসররাত স্মরণীয় রাত।”

“তবুও আমি একটু অন্যরকম কিছু করতে চাই।”

“ঠিক আছে। অনুমতি দিলাম।”

প্রায়াণ উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে বারান্দার দিকে এগোয়। ঠিক তখনি দরজায় কষাঘাত পড়ে। একবার দুইবার না…অনেকবার। প্রায়াণ বিরক্তবোধ করে। নিশুতি বলে,
“খুলে দেখো কে।”

“প্রেমা পিউ বোধহয়। জ্বালাতে আসছে। বাদ দাও তো।”

“আহা একবার খুলেই তো দেখো!”

নিশুতির কথায় প্রায়াণ গিয়ে দরজা খুলে। দেখে তার মা দাঁড়িয়ে।
নরম গলায় বললো,
“ডিস্টার্ব করলাম তোদের বাবা?”

“না মা! কিছু হয়েছে?এত রাতে!”

“আসলে আমার গা ব্যথা করছে খুব। ভাবলাম নিশুতিকে কিছুক্ষণের জন্য নিয়ে যাই। একটু গা গতর টিপে দিবে আমার। তুই রাগ করবি নাতো? এরপর থেকে সারাজীবনের জন্য তো নিশুতি তোরই।”

প্রায়াণ কিছু বলার আগেই নিশুতি বিছানা ছেড়ে নামে। তাদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
“না না আন্টি। মানে মা। সমস্যা নেই। চলুন আমি আপনার শরীর টিপে দিচ্ছি।”

প্রায়াণ বাধা দেয়।
বলে,
“প্রেমা পিউ আছে তো মা! ওদের দিয়ে…”

“ওরা ঘুমাচ্ছে তো। কেনো নিশুতিকে নিলে সমস্যা??”

প্রায়াণ আর রাও করে না। নিশুতিকে চলে যায় মিনু শেখ।
প্রায়াণ বারান্দায় এসে সিগারেট ধরায়। মায়ের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। কিন্তু কিছু বলারও তো জোঁ নেই..
.
.
রাত ২ঃ৩০ এ নিশুতি নিজের রুমে ফিরে আসে। এতক্ষণ যাবত শ্বাশুড়ির হাত পা টিপতে টিপতে সে বড্ড ক্লান্ত। নিশুতি এসে দেখে প্রায়াণ এলোমেলো ভাবে ঘুমিয়ে আছে বিছানার উপর। নিশুতি আর প্রায়াণ কে জাগায় না। তার গায়ে কম্বল দিয়ে নিজেও একপাশে ঘুপটি মেরে শুয়ে পড়ে। ধীরেধীরে তলিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে….
.
.
সকালের মিষ্টি রোদে শহর টা ভরে উঠছে ধীরে ধীরে। জানালার ফাক গলে সেই রোদ এসে পড়ে নিশুতির চোখে। নিশুতির ঘুম ভেঙে যায়। পিটপিট করে চোখ খুলতেই সে নিজেকে প্রায়াণের বাহুডোরে আবিষ্কার করে। এক অদ্ভুত ভালো লাগায় মনের কার্নিশ ছেয়ে যায়।
ঘুমন্ত অবস্থায় প্রায়াণ কে একটা ছোট নিষ্পাপ বাচ্চার মতো লাগে একদম। গভীর দুটি চোখে,ঘন মোটা দুটো ব্রু..মাঝে ছোট্ট একটা তিল। নাকটা বেশ মোটা। নিশুতি বিরবির করে বলে,
“সবখানে নাক গলাও বুঝি বেশি? তাই তোমার নাক গলে গলে মোটা হয়ে গেছে প্রায়াণ বাবু।”
তারপর নিজেই একা একা হেসে উঠে। চওড়া ঠোঁট দুটি চোখে পড়তেই নিশুতির লোভ লাগে৷ সে প্রায়াণের মুখের সামনে তার হাত দিয়ে মাছি তাড়াবার মতো করে কয়েকবার। নাহ,প্রায়াণের হুশ নেই। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। নিশুতি সুযোগ পায়। তার বাসি ঠোঁট জোড়া দিয়ে প্রায়াণের ঠোঁটে আলতো করে স্পর্শ করতেই প্রায়াণ দু’হাতের মাঝে নিশুতিকে চেঁপে ধরে। নিশুতি চমকে উঠে। ঠোঁট সরিয়ে নেয় দ্রুত। চোখ বড়বড় করে বললো,
“তুমি ঘুমাও নি??”

“ঘুমিয়েছিলাম তো।যেভাবে ঠোঁট রেপ করতেছো আমার! তাতে আর ঘুম থাকে?”

নিশুতি লজ্জা পায়। প্রায়াণকে ঠেলে সরিয়ে দিতে নেয়। প্রায়াণ অতই নিশুতিকে নিজের মাঝে আঁকড়ে ধরে।
“তো ম্যাডাম।আমার নাক মোটা? আমি নাক গলাই খুব??”

নিশুতি জিভ কেটে বলে,
“এটাও শুনছো তুমি?”

“সব শুনছি। সউউউউব। বাজে মেয়ে,পঁচা মেয়ে। নিজের জামাইয়ের মোটা নাক নিয়ে মজা করো!”

নিশুতি মজা পায়।
আহ্লাদী গলায় বলে,
“থাক থাক। কান্না কলে না ভাবু। মেলা তেকে কেলনা কিনে দিবো তোমাকে…”

“তবে রে..দুষ্টু মেয়ে…”

প্রায়াণ বেশ শক্ত করে চেঁপে ধরে নিশুতিকে। এভাবেই চলতে থাকে দুজনের খুনশুটি বেশ কিছুক্ষণ। আবারো কড়াঘাত পড়ে দরজায়।
নিশুতি প্রায়াণ কে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মাথায় ওড়না টেনে দরজা খুলে দেখে মিনু শেখ দাঁড়িয়ে। নাস্তা বানাতে নিশুতির সাহায্য প্রয়োজন তার। ডাকতে এসেছে তাই…
নিশুতি একবার প্রায়াণের দিকে তাকায়। তারপর চুপচাপ বের হয়ে যায় শ্বাশুড়ির সাথে। প্রায়াণ একা বিছানায় শুয়ে থাকে। সন্দেহ লাগছে তার…তার মা কি নিশুতিকে ঘরের বউ মেনে নিয়ে এসব করাচ্ছে…নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে প্রায়াণের থেকে দূরে রাখার জন্য…!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here