#রঙিন_রোদ,পর্ব_৫,৬
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৫
মৃত্তিকা সিদ্ধান্ত নিলো আজ আদিবের গ্রামের বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিবে। তার আশা, আদিবকে সে সেখানে পাবে। আদিব তার নিজের পরিচয় ভালোমতো মৃত্তিকাকে কোনোদিন বলেনি। মৃত্তিকা জোর করলেও বলতো না। এমনকি তার বাবা সম্পর্কেও আদিব তেমন কোনো কথা বলতো না। মৃত্তিকার বেশি জোরাজোরির ফলে একদিন বলেছিল ‘তার বাবা মারা গিয়েছে আর তার গ্রামের বাড়ি ঢাকার বাইরে কুমিল্লায়।’ মৃত্তিকা মাঝে মাঝে আদিবকে বুঝতে পারতো না কারণ আদিব স্বয়ং মৃত্তিকাকেও তার পরিবার সম্পর্কে কোনো কথা বলতে চায়তো না, পরিবার সম্পর্কে মৃত্তিকা কিছু জিজ্ঞেস করলেই আদিব কথাটা এড়িয়ে অন্য বিষয়ে কথা বলতো। তবুও একদিন মৃত্তিকা সন্দেহের চোখে চেয়েছিলো বিধায় আদিব তার গ্রামের বাড়ির ঠিকানাটা মৃত্তিকাকে দিয়েছিল। আদিবের সাথে অনেক বুঝাপড়া বাকি আছে মৃত্তিকার। আদিব এতো ছোট বিষয়ে নিরুদ্দেশ হওয়ার মতো ছেলে নয়। আর যদি আদিবের নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনে মৃত্তিকা’ই দায়ী থাকে তাহলে মৃত্তিকা আদিবকে বুঝিয়ে বলবে। মৃত্তিকার কারণে আদিবের এতো সুন্দর ভবিষ্যত নস্ট করার কোনো মানেই হয় না। যদি আদিব তাতেও না মানে তাহলে মৃত্তিকা নিজ থেকেই সরে যাবে। তাই মৃত্তিকা যথারীতি ক্লাস শেষ করে হোস্টেলে এসে ফ্রেস হয়ে নিলো। এতো কিছুর মাঝে মৃত্তিকা তার একটা ক্লাসও মিস দেয়নি। ঈশান আশেপাশে না থাকলেও ঈশানের কথা মৃত্তিকা প্রতি হাড়ে হাড়ে মেনে চলার চেষ্টা করে। নিয়ম অনুসারে প্রতিদিন পড়াশোনা ঠিকঠাক করে। তার মন না মানলেও সে এখন অন্যজনের অর্ধাঙ্গিনী, কোনো ঘরের বউ।
বিকেলের দিকে মৃত্তিকা হোস্টেল থেকে বেরিয়ে পড়লো আদিবের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
মৃত্তিকা হোস্টেল থেকে বেরিয়েই কুমিল্লার বাসে উঠলো। উঠার আগে রিনিকে জানিয়ে দিল কিছু কারণে সে বাইরে যাচ্ছে-পরে এসে সব বলবে। বাসায় কাউকে কিছু না জানাতে।
স্টেশনে এসে মৃত্তিকা বাস ছাড়ার উদ্দেশ্যে দাঁড়ালো।মৃত্তিকা বাস ছাড়ার অনেক আগেই স্টেশনে এসে পড়েছে যার ফলে আরো অনেকক্ষন বাসে বসে থাকতে হবে। এখনো যাত্রী তেমন আসে নাই মাত্র দুয়েকজন যাত্রী এসে বসেছে। মৃত্তিকা আর কিছু না ভেবে বাসে উঠে বসলো। তার সিট্ জানালার পাশে যার ফলে বাইরের সবকিছুই দেখতে পারছে। মৃত্তিকা সিটে বসে চারদিকে তাকিয়ে এতক্ষন কীভাবে বসে থাকবে ভেবে ব্যাগ থেকে ইয়ারফোন নিতে নিতে আনমনে জানালার বাইরে চোখ যেতেই থমকে গেল। তার মনে হলো বাইরে এই মাত্র ঈশান ভাইয়ের মতোই কাউকে জানি দেখেছে মাস্ক পরিহিত। কিন্তু ঈশান ভাই তো দেশের বাইরে, উনি এখানে কীভাবে আসবে! সে আবারো বাইরে দূরের ওই দোকানটার দিকে তাকালো কিন্তু এখন খালি! মৃত্তিকা নিজের চোখের ভ্রম ভেবে সিটে বসলো। সারাদিন ঈশান ভাইকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে তার মাথাটাই বোধহয় শেষ! সে মুচকি হেসে আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো বাস ছাড়তে আরো অনেকক্ষন আছে। এখনো যাত্রী পুরোপুরি উঠেনি তাই মোবাইলে প্ৰিয় একটি গান ছেড়ে সিটে হেলান দিয়ে কানে ইয়ারফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে ফেলল। গান শুনতে শুনতে ঝিমুচ্ছে মৃত্তিকা। হঠাৎ মনে হলো তার পাশের সিটে কেউ একজন বসেছে। হয়ত যাত্রী ভেবে সে পাত্তা না দিয়ে গান উপভোগ করতে রইল। বাস বোধহয় ছেড়ে দিয়েছে। চলন্ত বাসে জানালার পাশের সিটে বসে চোখ বন্ধ করে গান শোনার মজায় আলাদা। অনেকক্ষন পরে মনে হলো, কেউ একজন পুরুষালি কণ্ঠে মৃত্তিকার কানের পাশে কথা বলছে। পরপর আওয়াজটা আসতেই মৃত্তিকা বুঝতে পারলো হয়ত কাউকে ডাকছে। কিন্তু আওয়াজটা তার গানের সুর ভেদ করে আরো তীব্র হতেই বুঝতে পারলো পাশের সিটের মানুষটা হয়ত মৃত্তিকাকেই ডাকছে । মৃত্তিকা গান শুনতে গিয়ে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে গেল। নতুন নতুন গানের তালে তার সুন্দর কল্পনার মাঝে কারো এভাবে ডাকাতে সে বিরক্তবোধ হলো। তার এই মুহূর্তে মোটেও চোখ খুলে দেখার ইচ্ছে নেই। কিন্তু পাশের জন দমে যাওয়ার প্রার্থী নয়। সে এক নাগাড়ে ডেকেই চলছে। আশ্চর্য! কারো কাঁচা ঘুমের মধ্যে এভাবে ডাকার কোনো মানেই হয় না! মৃত্তিকা চোখ বন্ধ অবস্থাতেই কান থেকে ইয়ারফোন খুলে নড়েচড়ে বসতেই পাশ থেকে লোকটা আবারো ডেকে উঠল,
-‘হ্যালো মিস!’
মৃত্তিকা অনিচ্ছাসত্ত্বেও আধো আধো চোখ খুলে পাশের জনের দিকে তাকাতেই দেখলো আগন্তুকটি দাঁত বের করে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তা দেখে মৃত্তিকার রাগ যেন তড়তর করে বেড়ে গেল। সে বিরক্তিতে ‘চ’-সূচক শব্দ করলো। মৃত্তিকা ভ্রু কুঁচকে আগন্তুকটির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আগন্তুকটি মিষ্টি করে হেসে জবাব দিল,
-‘মিস,আসলে এই প্রথমবারের মতো কোথাও এতো দূরের জার্নিতে যাচ্ছি। এতো বড়ো রাত জার্নি কাটাতে গিয়ে খারাপ লাগবে ভেবে আপনার সাথে পরিচয় হতে চাচ্ছি।’
মৃত্তিকা আপনমনে বিড়বিড় করে কিছু গালি দিতেই আগন্তুকটি তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
-‘মিস, কিছু বললেন?’
ছেলেটির মুখ থেকে ‘মিস’ শোনার পড় মৃত্তিকার রাগ আরো বেশি বেড়ে গেল। সে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে কোনোরকম নিজের রাগকে কন্ট্রোল করে চিবিয়ে চিবিয়ে জবাব দিল,
-‘আমি মিস নয়, মিসেস।’
-‘ওঃ, আপনি বোধহয় বিরক্তবোধ হচ্ছেন?’
ছেলেটির এমন কথা শুনে মৃত্তিকার খারাপ লাগলো। আসলেই তো, বিনা কারণে ছেলেটির উপর রেগে আছে মৃত্তিকা। তার কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ছেলেটির উপর রাগ দেখাচ্ছে কিন্তু এছাড়া ছেলেটির উপর রাগার মতো আর কিছুই তো সে করেনি। হয়ত বাঁচাল টাইপ ছেলে তাই কথা বলা ছাড়া থাকতে পারছে না। মৃত্তিকারও আর কিছু সময় পেরোলে হয়ত একঘেয়েমি চলে আসতো। থাক, একটাকে অন্তত পেলো। গল্প করে কাটানো যাবে। এই ভেবেই মৃত্তিকা হাসিমুখে ছেলেটির জবাব দিতেই ছেলেটি খুশিতে মৃত্তিকার সাথে গল্প জুড়ে দিল।
-‘কোথায় যাবেন মিস? উপস, মিসেস!’
-‘কুমিল্লা।’
-‘আরে! আমিও।’
ছেলেটি উৎফুল্ল হয়ে একটার পর একটা গল্প জুড়ে দিচ্ছে মৃত্তিকার সাথে। এটা-ওটা বলে হাসাতে চেষ্টা করছে মৃত্তিকাকে। ছেলেটির এমন বাচ্চাপনা দেখে মৃত্তিকা আপনমনেই মুচকি হাসলো। এই ছেলেকে দেখতে খারাপ লাগছে না, ভরসা করা-ই যাই। প্রথমে মৃত্তিকা মনে করেছিল হয়ত ছেলেটা খারাপ হতে পারে। আজকাল-কার যুগে তো কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু এই ছেলেটার এমন বাচ্চাপনা গল্প শুনে মনে হচ্ছে না ছেলেটা খারাপ হবে। তাই মৃত্তিকাও ছেলেটার কথার এটা-ওটা উত্তর দিলো। কিন্তু মৃত্তিকা বুঝতে পারলো না আর কিছু সময় পরেই তার কপালে কত বড়ো বিপদ অপেক্ষা করছে! আসলেই কী তার ভাবনা অনুসারে ছেলেটা ভরসাযোগ্য!
গল্প করতে করতে মৃত্তিকা ঘুম ঘুম ভাব আসতেই ছেলেটি তা বুঝতে পেরে মৃত্তিকাকে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে বলল। এরপর নিজের মোবাইল বের করে কানে ইয়ারফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে বসলো। মৃত্তিকাও জানালাটা খুলে বাইরের দিকে দৃষ্টি দিতে দিতে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো।
.
.
মৃত্তিকা চোখ খুলতেই নিজেকে বদ্ধ অন্ধকার রুমে আবিষ্কার করলো। সে ভ্রু কুঁচকে উঠে বসতেই খেয়াল করলো তার হাত-পা শক্ত কিছুর সাথে বাধা। সে এখানে কীভাবে এলো তা ভাবতে পারলো না। হিসেব মোতাবেক এখন তো তার স্টেশনে থাকার কথা ছিল তাহলে এখানে কীভাবে আসলো সে! কাল রাত ছেলেটার সাথে গল্প করে জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে বাইরে দেখতে দেখতে কখন জানি ঘুমিয়ে পড়েছিল তা খেয়াল করতে পারেনি। এরপর তো আর কিছুই হয়নি। ঘুমানোর পরও তার তো বাসেই থাকার কথা ছিল। এখানে কীভাবে আসলো সে! ঘুমানোর পর কী হয়েছিল মৃত্তিকার সাথে! তার মানে কী তার পাশের মিষ্টবাসি ছেলেটাই এসবের কারণ! মৃত্তিকা আশেপাশে তাকিয়েও কোনো আলোর হদিস পেলো না। সে চিৎকার করতে গিয়েই খেয়াল করলো তার চিৎকার বেরোচ্ছে না, তার মুখে কিছু একটা আটকানো। মৃত্তিকা কোনো আওয়াজ বের করতে গিয়েই গোঙানীর আওয়াজ হলো। তাকে কোনো একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে ফেলা হয়েছে। ঘাড়টা ভীষণ ব্যথা করছে, হয়ত এভাবে একপাশ হয়ে ঘুমানোর ফলে। মৃত্তিকা পেছনের হাতের বাঁধনটা খুলতে চেয়েও খুলতে পারলো না। অনেক শক্ত করে দুইহাত একসাথে বাধা হয়েছে। মৃত্তিকা হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা করতে করতে একসময় দুর্বল হয়ে পড়লো। মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। ঈশান ভাইয়ের চেহারাটা চোখের উপর ভাসছে।আস্তে আস্তে দুর্বলতা গ্রাস করছে। কী করবে সে এখন! কে এখানে মৃত্তিকাকে বাঁচাতে আসবে! কেউই তো জানে না মৃত্তিকার ঢাকার বাইরে আসার ব্যাপারটা! তাহলে কী এভাবেই কাটাতে হবে! এরপর তার সাথে কী হবে ভাবতেই মৃত্তিকার চোখ গড়িয়ে দু’ফোটা অশ্রু বেরিয়ে এলো।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।
#রঙিন_রোদ
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৬
মৃত্তিকা জানে না, এখানে কতদিন তাকে এভাবে আটকে রাখবে! আস্তে আস্তে তার দেহ’র ভার ছেড়ে দিচ্ছে, দুর্বলতা গ্রাস করছে। আজ কয়েকদিন ধরে সে এভাবেই বদ্ধ রুমে কাটাচ্ছে। কোনো আলোর হদিস পাচ্ছে না এখানে। শুধু খাওয়ার সময়ে একজন এসে খাবার দিয়ে যায়, তখন দরজা দিয়ে একটু আলো ঢুকে। সেই আলোতেই মৃত্তিকার খাবার শেষ করতে হয়। প্রথম কয়েকদিন পালানোর চেষ্টা করেও পালাতে পারেনি। হাত-পা সবসময় বেঁধে রাখে। এখন আর পালানোর মতো ক্ষমতা তার নেই। সে এই কয়েকদিনে বুঝতে পেরেছে, এখান থেকে পালানো অনেক কঠিন। সে জানে না, এভাবে তাকে এখানে আটকে রেখে তাদের কী এমন কার্যসাধন হবে! এই কয়েকদিনে এখানকার কোনো মানুষকেই সে দেখেনি। শুধু খাবারের সময় একজনই আসতো, সেও মাস্ক পরিহিত। মৃত্তিকা এখন বুঝতে পারছে, ঢাকার বাইরে এই অচেনা জায়গায় কাউকে না বলে আসাটা তার সবচেয়ে বোকামি। এখন আর কিছুই তার হাতে নেই। মৃত্তিকা আস্তে আস্তে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। সে এখন তার জীবনের আশা ছেড়ে দিছে।আদিবের কাছ থেকে হয়ত আর ক্ষমা চাওয়া হবে না। তার একমাত্র মা হয়ত মৃত্তিকাকে না পেয়ে পাগলপ্রায়। তিনি তো এমনিই নরম মনের, এর উপর তার মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ শুনলে কী করে থাকবে! তা ভাবতেই মৃত্তিকার খারাপ লাগছে। অন্তত মা’কে বলে আসা উচিত ছিল। রিনিকে শুধু বলছিল, মৃত্তিকা একটি কাজে ঢাকার বাইরে যাচ্ছে -পরে এসে সব বলবে। মৃত্তিকা চোখ বন্ধ করতেই ঈশানের চেহারাটা তার চোখের উপর ভাসতে লাগলো। মৃত্তিকা বিড়বিড় করে উঠল,’ঈশান ভাই।’ ঈশান ভাইয়ের কথা ভাবতে গিয়েই তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে তার ঈশান ভাইয়ের কথা অমান্য করেছে। তিনি মৃত্তিকাকে প্রয়োজন ছাড়া কোনো কাজে হোস্টেল থেকে বের হতে বারণ করেছিল। ঈশান ভাই কী জানে! মৃত্তিকার নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে! তিনি কী মৃত্তিকাকে খোঁজতে আসবে!
হঠাৎ বাইরে থেকে কয়েকজনের আওয়াজ আসতেই মৃত্তিকা বুঝতে পারলো তাকে আটকে রাখা এই রুমটিতেই বোধহয় আসছে। তাহলে এতদিনে মৃত্তিকা তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে হয়ত জানতে পারবে। মানুষগুলো রুমে ঢোকার আগেই দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পড়লো। একজন আগে আগে ঢুকে মৃত্তিকার চোখ বেঁধে দিল। এরপর পর বাকি মানুষগুলো ঢুকলো। মৃত্তিকা পায়ের আওয়াজ শুনে বুঝতে পারলো এখানে অনেকজন। ভয়ে তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। এই লোকগুলো এখন মৃত্তিকার সাথে কিছু করতে আসলেও মৃত্তিকা পেরে উঠবে না। মৃত্তিকা দুর্বলভাবে তাদের কথোপকথন শুনতে লাগল।
-‘এইটাকে কী করা যায়।’
-‘ঈশানের বউ নাহ? এটাকেই তো খুজছিলাম। সে ধোঁকা দিছিলো আমাদের।’
-‘কী করা যায়!’
-‘অন্য মেয়েগুলোকে যেমন করা হয় , এটার সাথেও সেটাই হবে। এটাকে একটু স্পেশালভাবে পাঠানো হবে।’
এরপর পরই সবাই হেসে উঠল। মৃত্তিকা কিছুই করতে পারলো না, চুপচাপ শোনা ছাড়া। সেখান থেকে সেদিনের বাসে মৃত্তিকার পাশে বসা ছেলেটারও আওয়াজ শুনতেই মৃত্তিকা যা বুঝার বুঝে ফেলল।
-‘তবে তাই হোক।’
-‘এইটাকে শেষবারের মতো এখানে ভালোমতো খাইয়ে দেয়। এরপর এতো ভালো খাবার নাও পেতে পারে।’
-‘বস, মেয়েটা কয়দিন ধরে তেমন কিছু খাচ্ছে না। শুধু পানি ছাড়া।’
-‘আজকের রাতে ওর ফ্লাইট। না খেলেও জোর করে খাইয়ে দিবি। বসের টার্গেট বলে কথা। এইটা আমাদের জন্য অনেক মূল্যবান সম্পদ। এটার যেন কোনো ক্ষয়-ক্ষতি না হয়। এরপর ৩২নাম্বার রুমের মেয়েগুলোকে খাইয়ে দিবি। খাওয়ার পর স্পেশাল পানীয় খাইয়ে দিবি।’
-‘আচ্ছা ভাই।’
এরপর পর রুমটা আগের মতোই নিস্তব্ধ হয়ে গেল। হয়ত লোকগুলো চলে গিয়েছে। এই লোকগুলোর কথোপকথন শুনে মৃত্তিকা বুঝতে পারলো – সে খুব বিশ্রী ভাবে ফেঁসে গিয়েছে। হয়ত এই ফাঁদ থেকে আর বেরও হতে পারবে না। ৩২নাম্বার রুমে আরো মেয়ে আছে তার মানে নারী পাচার! মৃত্তিকার গা রাগে রিরি করে উঠল। আরো অনেক অসহায় মেয়ে এখানে আটকে আছে। ওদের মনের অবস্থা হয়ত আরো করুণ। মৃত্তিকার নিজের চিন্তা হচ্ছে না কিন্তু মেয়েগুলোর জন্য বড্ড কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা,ওরা ঈশান ভাইয়ের কথা কেন বললো! ঈশান ভাই কী ওদের চেনা-পরিচিত! তাহলে ঈশান ভাই কী জানতে পারবে মৃত্তিকা এখানে আটকে পড়েছে! ঈশান ভাই কী মৃত্তিকাকে বাঁচাতে আসবে! না, উনি কীভাবে আসবে! উনি তো এই দেশে নেই! তাহলে কী মৃত্তিকা শেষবারের মতো আর কাওকেই দেখতে পারবে না! মৃত্তিকা ডুকরে কেঁদে উঠলো। তার মা, বড়ো মামা, ঈশান ভাই, রিনি-আদিব সবার কথা ভীষণ করে মনে পড়ছে।
দরজা খোলার আওয়াজে মৃত্তিকার কান খাড়া হয়ে গেল। বুঝতে পারলো কেউ একজন তার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। মৃত্তিকা ভেবেছিলো খাবার নিয়ে আসা লোকটাকে সুযোগ বুঝে মেরে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করবে, বাকিটা কপালে যা লেখা থাকে তাই হবে। লোকটা এসে মৃত্তিকার চোখ খুলে দিতেই মৃত্তিকা নিরাশ হলো। আজ লোক একসাথে দুইটা আসছে। হয়ত আজকে শেষদিন বিধায় একটু বেশিই সিকিউরিটি রাখছে। মৃত্তিকা খেতে না চাইলে একটা লোক এসে তার গাল টিপে ধরলো। বাইরের পরপুরুষ মৃত্তিকার গায়ে হাত দেওয়ায় মৃত্তিকা আটকা অবস্থায় গা দিয়ে লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে লোকটার মুখের উপর থুথু দিল। এতে লোকটা রেগে গর্জন করে মৃত্তিকার দিকে এগিয়ে আসতেই অন্যজন লোকটাকে আটকে ফিসফিস করে কিছু একটা বলতেই লোকটা শান্ত হয়ে গেল কিন্তু মৃত্তিকা লোকটার চোখ দেখে বুঝলো ওর চাপা রাগ তবুও কমেনি।
মৃত্তিকা নিজেই খাবারের প্লেট এগিয়ে নিয়ে খেতে লাগলো। সে বুঝতে পারলো, এখন খেতে না চাইলে লোকগুলো তার গায়ে হাত দিতে চাইবে কিন্তু মৃত্তিকার জীবন থাকতে এমন কিছু সে মোটেও হতে দিবে না। সে ঈশানের অর্ধাঙ্গিনী। একমাত্র ঈশানই ছুঁতে পারবে মৃত্তিকাকে।
মৃত্তিকা খাওয়া শেষ করতেই অন্য একটা লোক তাকে একটি গ্লাস এগিয়ে দিল। মৃত্তিকা বুঝতে পারলো, এই পানীয় জাতীয় এটাতেই সব ভেজাল। কিছুক্ষন আগে ওই লোকগুলোর মুখ থেকে শুনেছিল, খাওয়ার পর স্পেশাল পানীয় খাওয়াতে। হয়ত এই পানি খেয়েই সবাই জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। যাতে রাতে তাদের মেয়েগুলোকে পাচার করতে কোনো অসুবিধা না হয়। মৃত্তিকা কোনোমতেই খাবে না এই পানি। কিন্তু লোকগুলো বারেবারে তার দিকে এগিয়ে আসছে। যেন সুযোগ পেলেই মৃত্তিকার শরীরে হাত দিতে চাচ্ছে। মৃত্তিকা তার আটকানো চেয়ার দিয়ে একজনকে ধাক্কা দিতেই অন্যজন এসে তার মুখ আটকে ধরতেই আরেকজন পানিগুলো তার মুখে ঢেলে দিল এতে মৃত্তিকা না চাইতেও খেতে হলো। লোকগুলো মৃত্তিকাকে আগের মতো আটকে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
মৃত্তিকা আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়ছে। চোখগুলো বারেবারে খুলে রাখতে চাইলেও ব্যর্থ হচ্ছে। তার চোখ গড়িয়ে অঝোরে ধারায় পানি পড়ছে। তার বুঝি শেষবারের মতো পরিবারকে আর দেখা হলো না! সে বুঝি হেরে যাচ্ছে! মৃত্তিকাকে বাঁচাতে ঈশান ভাই কী আসবে না!
চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে মৃত্তিকার নাকে একটি সুগন্ধ আসতেই সে তাড়াতাড়ি চোখ খুলে উত্তেজিত হয়ে উঠল। মৃত্তিকা আপনমনেই বিড়বিড় করে অস্থির দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালো।
-‘ঈশান ভাই।’ বলে বিড়বিড় করে আশেপাশে কিছু খুঁজতে লাগলো। চারদিকে তাকিয়ে সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু তার আশা এখানে ঈশান ভাই আছে। এই পারফিউমের সুগন্ধটা একমাত্র ঈশান ভাইয়ের কাছ থেকেই আসে। মৃত্তিকা যেন আশার আলো খুঁজে পেলো। তার ঠোঁটে আপনা-আপনি হাসি ফুটে উঠলো। তার মন বলছে, এখানে আশেপাশে কোথাও ঈশান ভাই আছে। কিন্তু অনেকক্ষন হয়ে যাওয়ার পরেও যখন মৃত্তিকাকে কেউ নিতে আসলো না তখন সে হতাশ হয়ে পড়লো। হয়ত একই পারফিউম এখানের মধ্যে কেউ একজন ব্যবহার করে। আর তার চেয়ে বড়ো কথা, ঈশান ভাই এদেশেই নেই। এসব ভাবতেই মৃত্তিকার আশার আলো নিভে গেল। দুর্বলতা তাকে আরো বেশি গ্রাসঃ করে নিলো। পানীয় জাতীয় ওষুধটার হয়ত কাজ হয়ে যাচ্ছে।
মৃত্তিকার চোখ বন্ধ হয়ে পড়ে যাওয়ার সময় ঝাঁপসা চোখে দেখল তার রুমটার দরজা দিয়ে আলো ঢুকছে। হয়ত কেউ একজন এসেছে। আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ হয়ে গেল ওর। তাহলে কী হার মেনে নিলো সে!
#চলবে ইন শা আল্লাহ।