রঙিন_রোদ,পর্ব_২,৩

#রঙিন_রোদ,পর্ব_২,৩
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_২

সোফার এক কোনে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে মৃত্তিকা। কাজী তোড়জোড় করছে কবুল বলার জন্য। ঈশান ভাই কবুল বলেই উঠে চলে গেল।
মৃত্তিকা ঈশানের যাওয়ার দিকে এক ফলক মলিন চোখে তাকালো। সে ভাবেনি এতকিছু হয়ে যাবে।
চোখের পানি পড়তে পড়তে শুকিয়ে গিয়েছে। পাশেই রিনি মৃত্তিকার হাত ধরে বসে আছে। মৃত্তিকা জানে না, মেডিকেলে কী জবাব দিবে। তার চেয়ে বড়ো কথা ঈশান ভাই মৃত্তিকারই মেডিকেলে ক্লাস নেয়। আদিবকে কী জবাব দিবে তা মৃত্তিকা ভেবে পাচ্ছে না, ছেলেটা যদি জানতে পারে মৃত্তিকার বিয়ে হয়ে গিয়েছে তাহলে কী করবে! ছেলেটা মৃত্তিকাকে ছেড়ে থাকতে পারবে তো? না কি কোনো কিছু করে ফেলবে না তো? সবকিছুর মূল ঈশান ভাই। তিনি কেন করলো এমন! তিনি যদি কাল মৃত্তিকার রুমে না আসতো তাহলে আজ কী সুন্দর মৃত্তিকা আগের মতোই থাকতে পারতো!

তখন লুৎফর আহমেদ অনেক্ষন মাথা নিচু করে বসে ছিল। মৃত্তিকার বাবা মারা যাওয়ার পর এই বাড়িতে একমাত্র লুৎফর আহমেদই বোন আর বোনের মেয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। সবার মুখোশ মৃত্তিকার বাবা মারা যাওয়ার দুইদিনের ভেতর বেরিয়ে এসেছিল। সমাজে একা একটি মা-মেয়ে চলার পথে যে কত বাধা আসে তা তখনোই টের পেয়েছিল মৃত্তিকারা। সে সময়ই মৃত্তিকার বড়ো মামা লুৎফর আহমেদ গিয়ে বোনকে নিজের কাছে রাখে। সে থেকে মা-মেয়ে দুইজনকে পরম মমতায় আগলে রেখেছিল লুৎফর আহমেদ। মৃত্তিকার বাবার ইচ্ছে অনুযায়ী মৃত্তিকাকে তাদেরই মেডিকেলে পড়াচ্ছে লুৎফর আহমেদ। মৃত্তিকাও তার বড়ো মামার কথা সবসময় মেনে চলতো তাই তিনি সবার চেয়ে মৃত্তিকাকেই একটু বেশি ভালোবাসতেন। শুধু তাই নয়, লুৎফর আহমেদ মৃত্তিকাকে বিশ্বাস আর ভরসা দুটোই করতেন। কিন্তু আজ! আজ কী তিনি আর বিশ্বাস করবেন মৃত্তিকাকে!
এই বাড়িতে সবার আগে লুৎফর আহমেদের কথা অনুযায়ী চলে। তখন তিনিও হয়ত মৃত্তিকাকে বিশ্বাস করতে পারেনি। সবাই যখন একেক কথা বলছিলো লুৎফর আহমেদ তখনও চুপ ছিল। হঠাৎ করে মাথা তুলে বলে উঠল,’ কাজী ডাকো। ওদের বিয়ে পড়ানো হবে।’
তার এক কথায় সবাই চুপ হয়ে গিয়েছিলো আর পালনও করেছিল।
মৃত্তিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশে বসা লুৎফর আহমেদের দিকে এক ফলক তাকালো। লুৎফর আহমেদ তখনও মাথা নিচু করে ছিলেন। হয়ত বেশি কষ্টই পেয়েছে। মৃত্তিকা কী তার মামাকে বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে! কী থেকে কী হয়ে গেল তা মৃত্তিকা এখনো ভেবে উঠতে পারছে না।
লুৎফর আহমেদ হঠাৎ মাথা তুলে মৃত্তিকার দিকে এক ফলক তাকিয়ে রিনিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
-‘রিনি মা। মৃত্তিকাকে ঈশানের রুমে নিয়ে যা। কিছু খাইয়ে দেয়। কাল সকালে ওর ক্লাস আছে।’

মৃত্তিকা চমকে লুৎফর আহমেদের দিকে তাকালো। সে ভাবেনি এতো কিছুর মাঝে এভাবে তার মামা তার খেয়াল রাখবে! তার উপর কালকের ইম্পরট্যান্ট ক্লাসটার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে গিয়েছিল কিন্তু লুৎফর আহমেদ ঠিকই মনে রেখেছে। ড্রয়ইং রুমে থাকা বাকিরাও চমকে তাকিয়ে রইল লুৎফর আহমেদের দিকে। সবাই মনে করেছিল, হয়ত লুৎফর আহমেদও রাগের মাথায় এদের বিয়ের আদেশ দিয়েছিলো। বেশিরভাগ মানুষই খুশি হয়ে হয়ত মনে মনে মৃত্তিকা আর ওর মায়ের উপর ভেংচি কেটেছিল যে এবার মা-মেয়ে যায় কোথায় দেখে নিবে। কিন্তু উল্টো লুৎফর আহমেদ এতকিছুর মাঝেও মৃত্তিকার খবর ঠিকই নিচ্ছে। মৃত্তিকা মনে মনে স্বস্তি ফেলো। তার মানে তার মামা তাকে বিশ্বাস করেছে যে অন্তত মৃত্তিকা এমন কাজ করতে পারে না!

রিনি মৃত্তিকাকে নিয়ে রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সোফা ছেড়ে উঠতেই লুৎফর আহমেদ পেছন থেকে ডাক দিয়ে নিজে মৃত্তিকার সামনে এগিয়ে এলো।

-‘আমি জানি মা। এখন তোর উপর কতটা ভয়ানক প্রেসার পড়ছে। সবাই অন্তত তোদের উপর এমন কিছু চাপিয়ে দিতে চাইলেও আমি জানি তোরা এমন কিছু ভুলেও করবি না। যাক, এসব এখন মাথা থেকে ঝেড়ে নিজের জীবনের দিকে ফোকাস দেয় তোরা। আমি আশা রাখি, তোদের সামনে এগিয়ে যেতে গেলে আর কোনো বাধা আসবে না, নিশ্চিন্তে থাক মা। এখন মনে প্রাণে আমার দুই ছেলে মেয়ে আর আমার বৌমার জন্য দোয়া করি। এখন গিয়ে কিছু খেয়ে শুয়ে পড়। কালকে তোদের ক্লাস আছে। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়।’

মৃত্তিকা ‘হ্যাঁ’বোধক মাথা নাড়লো। রিনি মৃত্তিকাকে ঈশানের রুমে নিয়ে এলো। ঈশান বোধহয় কোথাও বেরিয়ে গিয়েছে। মৃত্তিকা বুঝতে পারলো না। মানুষটা কী মৃত্তিকার উপর রেগে আছে!
রিনি একটা প্লেট আনতেই মৃত্তিকা কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। তার এতো কিছুর মাঝে আর আদিবের খেয়াল ছিল না।

গভীর রাতে ঈশান রুমে ঢুকতেই তার বিছানায় কেউ একজনকে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে থাকতে দেখলো। সে এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিল আজ মৃত্তিকার সাথে তার জীবন আবদ্ধ হয়েছে। সে মুচকি হেসে মৃত্তিকার দিকে এগিয়ে গেলো। এরপর মন ভরে তাকে দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে মৃত্তিকার গায়ে লেপ টেনে দিয়ে নিজেও আরেকপাশে ঘুমিয়ে পড়লো।
.
.
সকালে মৃত্তিকা ঘুমু ঘুমু চোখে হাতড়িয়ে মোবাইল নিয়ে সময় দেখতেই তড়িঘড়ি করে শোয়া থেকে উঠে বসতেই পাশে চোখ যেতেই থমকে বসে রইল সে। পাশের সিঙ্গেল সোফাটাতে ঈশান ভাই বসে ফোন গুতাচ্ছে। মৃত্তিকা এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিল কাল এতো বড়ো ঘটনাটা। মৃত্তিকা উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে মুখে পানির ঝাপ্টা দিয়ে বেরিয়ে আসলো। ঈশান ভাই এখনো ফোনের দিকেই দৃষ্টি দিয়ে আছে। মৃত্তিকা সংকোচ ঠেলে বিষাদ-ভরা কণ্ঠে বলে উঠল,

-‘কী হবে এরপর!’

ঈশানের কাছ থেকে কোনো জবাব না আসাতে অপমানে মাথা নিচু করে ফেলল মৃত্তিকা। শুধু শুধু কেন বলতে গেল এমন কথা! এভাবেও যে সবকিছু আর আগানো সম্ভব নয় মৃত্তিকার পক্ষে। তার চেয়ে বড়ো কথা, এই মানুষটার সাথে তার সংসার ভাবা মোটেও আশাযোগ্য নই। মৃত্তিকা হতাশ হলো ঈশানের কোনো উত্তর না পেয়ে। এরপর তৈরী হয়ে ক্লাসের উদ্দেশ্যে রুম থেকে বের হতে নিতেই পেছন থেকে ঈশানের গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে থেমে গেল।

-‘আমাদের এই বিয়ে হয়ে যাওয়াটা অনাকাংক্ষিত। আমিও ভাবিনি এভাবে বিয়েটা হয়ে যাবে আর তুইও হয়ত ভাবিসনি। আমাদের নিজেদের মধ্যে সময় নেওয়া দরকার। তুই আগের মতোই থাক। পারলে হোস্টেলে থাকতে পারিস আগের মতোই। এগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পড়ায় মনোনিবেশ কর। সামনে আমারো বাইরে যেতে হবে। এটা একটা এক্সিডেন্ট। আর তার চেয়ে বড়ো কথা, কাল এই আরশির সাথে আমার বিয়েটা হতো না। আমার ক্যারিয়ার এখনো পড়ে আছে আর তোর পড়াশোনা। আমি বাইরে চলে যাব এই কয়েকদিনের ভেতর। তোর এই বাসায় থাকার প্রয়োজন নেই, তুই হোস্টেলেই থাকিস।’ বলে ঈশান ভাই ফোন পকেটে পুরে উঠে দাঁড়ালো।

মৃত্তিকা কিছু বলার উদ্দেশ্যে মুখ খুলতেই ঈশান আবারো ফিরে বলে উঠল,’ মেডিকেলে তোর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। ইতিমধ্যে অনেকেই হয়ত জেনে গেছে। সেদিকেরটা আমি ম্যানেজ করে নিব। তুই তোর পড়াশোনার দিকে ফোকাস কর।’ বলে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল ঈশান ভাই।

ঈশান ভাই বেরিয়ে যেতেই মৃত্তিকা ধপ করে বসে পড়লো সোফাতে। এরপর পরই রিনি ঢুকলো। রিনি মৃত্তিকার পাশে বসলো।

-‘চিন্তা করিস না। তুই প্যাকিং করে নেয়। ভাই তোরে আজই চলে যেতে বলেছে হোস্টেলে। এই বাসায় থাকা তোর জন্য ভয়ঙ্কর আর তার চেয়ে বড়ো কথা ভাই তোকে এতো সাধনার পর পেয়েছে, হারাতে…’ রিনির কথার মাঝেই মৃত্তিকা তার দিকে তাকাতেই সে থেমে গেল। মৃত্তিকা ভ্রু কুঁচকে রিনির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
-‘মানে!’

-‘ওহ কিছু নাহ। তুই প্যাকিং করে নেয়। ভাই মনে হয় কাল-পরশুর মধ্যে দেশের বাইরে চলে যাবে।’

মৃত্তিকা ‘হ্যাঁ’বোধক মাথা নেড়ে সব প্যাকিং করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। দুইদিন আগেও সে একই ব্যাগ নিয়ে হোস্টেল থেকে এসেছিলো ঈশান ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে অথচ আজ কত তফাৎ। আজ সে বিবাহিত! মানতে না চাইলেও এটাই নিয়তি। আজ থেকে সে ঈশান ভাইয়ের অর্ধাঙ্গিনী।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

#রঙিন_রোদ
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৩

ক্লাসে যেতেই মৃত্তিকাকে দেখে অনেকের মধ্যে কানাকানি শুরু হয়ে গিয়েছে। মৃত্তিকা ঢুকতে ঢুকতেই এসব বুঝে গিয়েছে। আর সবাই কানাকানি করবেও বা না কেন! ঈশান স্যারের সাথে মৃত্তিকার বিয়ে বলে কথা। মৃত্তিকা এসবের দিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পড়লো।

-‘কিরে মৃত্তিকা! এসব কী শুনছি?’ মৃত্তিকার পাশের জন বলে উঠল।

-‘ তোর না কি ঈশান স্যারের সাথে বিয়ে হয়ে গিয়েছে? কীভাবে? আর তুই তো কাল ঈশান স্যারের বিয়ে খেতে গেছিলি!’

মৃত্তিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। যেই বিষয়টা আড়ালে রাখতে চেয়েছিল সেটাই হলো। দেয়ালেরও কান আছে কথাটি আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মৃত্তিকা। মৃত্তিকা কিছু বলার উদ্দেশ্যে মুখ খুলতেই ঈশান ক্লাসরুমে ঢুকতেই মুহূর্তের মধ্যে সবাই চুপ হয়ে গেল। মৃত্তিকা একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ক্লাসে মনোযোগ দিল। ঈশান ভাই সবসময় গম্ভীরভাবেই থাকে যার ফলে সবাই উনাকে ভয় পায়, এই সবার মধ্যে মৃত্তিকাও আছে। আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ঈশান ভাই প্রতিদিনের ন্যায় ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে যেতে নিতেই আবারো সবার কানাকানি শুরু হয়ে গেল। সবার এই কানাঘুষার ব্যাপারটা তিনি বুঝতে পেরে পেছন ফিরে আবারো ক্লাসে ঢুকে মৃত্তিকাকে দাঁড় করিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
-‘অনাকাঙ্খিতভাবে মৃত্তিকা আমার ওয়াইফ। আশা রাখি, কেউ ওকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করে বিভ্রান্ত করবে না। পড়াশোনা করতে এসেছো সবাই, পড়াশোনার দিকেই ফোকাস দাও। গুড লাক।’ বলেই বেরিয়ে গেল ক্লাসরুম ছেড়ে। এরপর পরই শোনা গেল ঈশান ভাই আর ক্লাস করাতে আসবেনা। উনি দেশের বাইরে চলে যাবেন। মৃত্তিকার একটু খারাপ লাগলেও পাত্তা দিলো না। হয়ত এতদিন দেখতে দেখতে মায়া জন্মে গিয়েছে। মৃত্তিকার হঠাৎ আদিবের কথা মনে পড়লো। সে আশেপাশে তাকিয়ে কোথাও আদিবের চিন্হও দেখতে পেল না। ছেলেটা কী আজকে ক্লাস করতে আসেনি! কিন্তু সে তো ক্লাস মিস দেওয়ার মতো ছেলে নয়। মৃত্তিকা ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে আদিবের নাম্বারে কল লাগাতেই ওইপাশ থেকে বিরক্তিকর আওয়াজটা কানে বাজলো। মোবাইল বন্ধ। মৃত্তিকার চিন্তা হতে লাগলো। সে আদিবের ভালো বন্ধু কয়েকজন থেকে জানতে পারলো সে অসুস্থ। ‘আদিব অসুস্থ’ কথাটি শুনতেই মৃত্তিকার বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব হলো। মৃত্তিকার একটু মাথা ব্যথা হলেই ছেলেটা প্রাণ দিয়ে দেয় অথচ আদিব আজ দুইদিন ধরে অসুস্থ কিন্তু মৃত্তিকা কোনো খোঁজই নিতে পারলো না। মৃত্তিকা ক্লাস শেষ করে হোস্টেলে ফিরে ফ্রেস হয়ে আদিবের নাম্বারে আবারো কল দিল কিন্তু এবারও আগের মতোই বন্ধ শুনালো। মৃত্তিকা আদিবের কয়েকজন বন্ধুকে ওর খোঁজ নিয়ে জানাতে বলল। তারা এসে জানালো আদিব আগে থেকে একটু সুস্থ আর কাল ক্লাসে আসবে। এটা শুনেই মৃত্তিকা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক, একটা চিন্তা কমলো মাথা থেকে।

পরদিন আদিব গেট দিয়ে ঢুকতেই মৃত্তিকা দৌড়ে এগিয়ে গেল। ছেলেটাকে কেমন জানি অগোছালো লাগছে। হয়ত অসুস্থতার জন্য দুর্বলতা গ্রাসঃ করেছে। আদিব মৃত্তিকার সাথে তেমন কোনো কথা বলেনি। এমন কোনো দিন নেই যে আদিব মৃত্তিকার সাথে কথা বলেনি অথচ আজ কী এমন হলো মৃত্তিকার সাথে কথা বলছে না! আদিব মৃত্তিকাকে একদিন না দেখলেই পাগলের মতো আচরণ করে অথচ আজ! কেমন চুপ হয়ে গিয়েছে ছেলেটা! মৃত্তিকা মনে করলো হয়ত অসুস্থ তাই। কিছুসময় পর আদিব নিজে থেকেই শান্ত কণ্ঠেই সামনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলে উঠল,
-‘তোমার না কি বিয়ে হয়ে গিয়েছে মৃত্তি? বলো না, এটা মিথ্যে। তুমি আমার আগের মৃত্তিই আছো। বলো না, এসবকিছু মিথ্যে।’ বলতেই বলতেই আদিব মৃত্তিকার দিকে ফিরে উত্তেজিত হয়ে উঠল।

মৃত্তিকা হঠাৎ থমকে গেল আদিবের এমন আচরণে। তার নিজেরও এতক্ষন খেয়াল ছিল না সে যে বিবাহিত সেটা।

-‘আদিব, এটা একটা দুর্ঘটনা। কীভাবে যে হয়ে গেল আমি নিজেও ভাবতে পারিনি।’

-‘আচ্ছা, কিছু হবে না। তুমি ঈশান স্যারকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। আমাদের মাঝে কেউ আসবে না। আমরা এরপর পরই বিয়ে করে অনেক দূরে কোথাও চলে যাবো মৃত্তি।’বলতে বলতেই মৃত্তিকার দু’হাত আদিব নিজের হাতের মাঝে আবদ্ধ করে নিলো।

-‘তুমি যেটা ভাবছো সেটা কোনোদিনও সম্ভব নয় আদিব। আর আমি আগেও বারবার করে বলেছিলাম, এই সম্পর্কের পরিণতি ভালো হবে না। আর এখন এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল আদিব,এখন আমি বিবাহিত।’ বলেই হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে আদিব আরো জোরে হাত ধরে রইল মৃত্তিকার। তার একটায় কথা, সে মৃত্তিকার হাত ছাড়বে না।

মৃত্তিকা আশেপাশে তাকিয়ে নিম্ন কণ্ঠে আদিবকে বলে উঠল,
-‘আদিব, হাত ছাড়ো। আশেপাশের মানুষ তাকিয়ে আছে।’

-‘আমি ছাড়বো না। সবাই তাকিয়ে থাকুক মৃত্তি। তুমি আমার ছিলে আর থাকবে। তোমাকে আমি ছাড়তে পারবো না মৃত্তি। তুমি তো বলছো এই বিয়েটা নিছক দুর্ঘটনা তাহলে চলো না, আমরা বিয়ে করে নিই।’ আদিব আরো জোরে মৃত্তিকার হাত চেপে ধরলো। ব্যথায় মৃত্তিকার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো কিন্তু সেদিকে আদিবের হুশ নেই। আদিব যেন আজ উঠেপরে লেগেছে -মৃত্তিকাকে নিজের মতো করে পাওয়ার।
মৃত্তিকা ব্যথাকাতর চোখে আদিবের দিকে তাকিয়ে রইল। এই ছেলেটাই এতদিন তার চোখের পানি সহ্য করতে পারতো না অথচ আজ কেমন সাইকো রূপ ভর করছে! মৃত্তিকা আজ আদিবের এমন পাগলাটে আচরণ মেনে নিতে পারছে না। আদিবের এমন আচরণের সাথে মৃত্তিকা পরিচিত নয় সে আর কোনোদিন আদিবের এমন রূপ দেখেনি। সে বুঝতে পারছে না, আদিব হঠাৎ করেই এমন উদ্ভট আচরণ কেন করছে! এদিকে হাতের তীব্ৰ চাপের ফলে হাত ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে ফেলল মৃত্তিকা। হঠাৎ তীব্ৰ শব্দে চোখ খুলতেই দেখলো আদিব মৃত্তিকার হাত ছেড়ে দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে আর সামনে ঈশান ভাই রক্তচক্ষু দৃষ্টি দিয়ে আদিবের দিকে তাকিয়ে আছে। আদিবকে পরপর দুইটা থাপ্পড় মেরে চিৎকার করে বলে উঠল,
-‘তোর সাহস হয় কী করে! মৃত্তিকাকে স্পর্শ করার! তোর এই হাত আজ আমি ভেঙে ফেলবো।’ বলেই আবারো এগিয়ে গিয়ে পরপর দুইটা লাথি দিল আদিবকে। আদিব সহ্য করতে না পেরে ছিটকে পড়ে গেল।
মৃত্তিকা এখনো স্তব্ধ। কী থেকে কী হয়ে গেল সে ভাবতে পারছে না। হুশ ফিরতেই সে ঈশানের পথ আগলে ধরলো ততক্ষনে আরো কয়েকজন সিনিয়র এসে ঈশানকে থামিয়ে ফেলল। ঈশান এখনো রেগে আদিবের দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েকজন এসে আদিবকে তুলে নিয়ে গেল।

আদিব চলে যাওয়ার পরেও ঈশান কিছু সময় রেগে দাঁড়িয়ে রইল। আশেপাশের সব মানুষ জড়ো হয়ে তাকিয়ে থাকতেই মৃত্তিকার অস্বস্তি হলো। ঈশান আশেপাশে তাকিয়ে সবাইকে ধমক দিতেই মিনিটের মধ্যে সম্পূর্ণ মাঠ খালি হয়ে গেল। এরপর মৃত্তিকার দিকে ফিরতেই মৃত্তিকা গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে রইল।

-‘ওই ছেলের আশেপাশেও যেন আর না দেখি তোকে। ক্লাসে যা।’ বলেই ঈশান গাড়িতে উঠে পড়লো।
মৃত্তিকা ঈশানের গাড়িটি যাওয়ার দিকে মলিন চোখে তাকিয়ে রইল। তার আদিবের জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে। ছেলেটা হঠাৎ এমন আচরণ কেন করলো মৃত্তিকা ভাবতে পারছে না। সেদিন আর ক্লাস করার মুড ছিল না বলে মৃত্তিকা হোস্টেলে ফিরে এলো। দিনটা বিতৃষ্ণাই কাটলো।

সারারাত আর ঘুম এলো না। মোবাইল হাতে নিয়েই বুঝতে পারলো আদিবের সাথে যোগাযোগ করার সব পথ ও বন্ধ করে দিয়েছে। ওর মোবাইলটাই বন্ধ। হয়ত রেগে আছে ভীষণ। মৃত্তিকা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।

পরদিন যথারীতি ক্লাস করে আসতেই খেয়াল হলো আদিবের ব্যাপারটা। আদিব আজ আর আসেনি ক্লাসে। মৃত্তিকা মোবাইল নিয়ে দেখলো আদিবের নাম্বার তখনো বন্ধ। হয়ত রাগ পড়ে গেলে খুলবে ভেবে মৃত্তিকা আর মাথা দিলো না। কিন্তু দিন যতই যায় তার চিন্তা ততই বাড়ে। আদিব এরপর আরেকদিনও ক্লাসে আসেনি। ঈশান ভাইয়ের সাথেও এরপর আর দেখা হয়নি মৃত্তিকার। তার মাথায় আদিবের চিন্তা বেশি ঘুরপাক খাচ্ছে। তাই একদিন সিদ্ধান্ত নিলো মৃত্তিকা আদিবের বাসায় গিয়ে দেখে আসবে।

আদিবের বাসার সামনে গিয়ে তালা দেখে সে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইল। এই বাড়িতে আদিবের সাথে আরেকবার আসা হয়েছিল যার ফলে বাসা চিনতে কষ্ট হয়নি। মৃত্তিকা আদিবের বাসায় আসাতে কী খুশিই না হয়েছিল ছেলেটা, সম্পূর্ণ বাড়ি মাথায় তুলেছিল এটা-ওটা দেখাতে মৃত্তিকাকে। আদিবের মাও ছেলের খুশিতে এটা-ওটা রান্না করে খাইয়েছিল মৃত্তিকাকে। আদিব আর ওর মা মিলে তাদের ছোট্ট সংসার। আদিব টিউশন করে কষ্ট করে লেখাপড়া করছে। মাঝে মাঝে মৃত্তিকাও আদিবকে এটা-ওটা দিয়ে সাহায্য করত। ছেলেটা নিতে চায়তো না কিন্তু মৃত্তিকা জোর করে দিতো। মৃত্তিকা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদিবের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। আশেপাশে তাকিয়েও কাউকে দেখতে না পেয়ে ফিরে আসলো হোস্টেলে। বাড়ি ছেড়ে যাবেই বা কোথায় ছেলেটা! ছেলেটার কী হয়েছে হঠাৎ করে তা মৃত্তিকা বুঝে উঠতে পারলো না।

#চলবে ইন শা আল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here