#রঙিন_রোদ,#পর্ব_১
#নাজমুন_বৃষ্টি
-‘কাল আপনার বিয়ে আর আপনি এই মাঝরাতে আমার রুমে কেন এসেছেন ঈশান ভাই?’
গায়ে হলুদ শেষে শুতেই কিছুসময় পর দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ শুনে গায়ে কোনোমতেই উড়না পেঁচিয়ে ঘুমু ঘুমু চোখে মৃত্তিকা দরজা খুলে এতো রাতে ঈশানকে দেখে চমকে গিয়ে উক্ত কথাগুলো বলে উঠল।
মৃত্তিকার কথায় ঈশানের মাঝে কোনো হেলদোল দেখা দিল না। সে মৃত্তিকার কথার কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন-বোধ মনে করল না। ঈশান মৃত্তিকাকে পাশ কাটিয়ে মৃত্তিকার রুমে ঢুকে যাওয়ার সময় মৃত্তিকা তার পথ আটকে দিয়ে বলে উঠল,
-‘আপনি আমার রুমে কেন আসছেন?’
ঈশান প্রথমে মৃত্তিকার প্রশ্নের জবাব দিতে চায়নি কিন্তু মৃত্তিকার এভাবে পথ আটকে ধরাতে বাধ্য হয়ে কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলতেই সে মৃত্তিকার গায়ে ঢলে পড়ল। ঈশানের হঠাৎ পড়ে যাওয়াতে মৃত্তিকা তাল সামলাতে না পেরে পড়তে পড়তে পাশের দেয়ালটা ধরে কোনোমতেই বাঁচলো। মৃত্তিকা হঠাৎ আথকে উঠল কারণ ঈশানের গায়ে অনেক জ্বর। এই এতটুকু সময়ে জ্বর কোথ থেকে এলো তা মৃত্তিকা ভেবে উঠতে পারলো না। রাতেও তো ঠিক ছিল না কি ঈশানের জ্বর উঠাতে জ্ঞান হারিয়ে সে মৃত্তিকার রুমে এসে গেছে। বাসাভর্তী মেহমান। কারো চোখে এটা পড়লে নিশ্চিত তুলকালাম হয়ে যাবে। এই ভেবে মৃত্তিকা ঈশানের শরীরটা টানতে নিলেই তার ভার সহ্য করতে পারলো না। সে কোনোমতেই টেনে নিয়ে তার ব্যাডে ঈশানকে বসিয়ে দিতেই ঈশান শুয়ে গেল। মৃত্তিকা ঐভাবেই মেঝেতে বসে ঈশানের উদ্দেশ্যে বলল,
-‘আপনার হঠাৎ এতো জ্বর কীভাবে এলো ঈশান ভাই?’
ঈশান পাশ ফিরে মৃত্তিকার মুখের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো। চোখে তার জল চিকচিক করছে। মৃত্তিকা মনে করলো হয়ত জ্বরের ঘোরে কষ্ট পাচ্ছে, তার মায়া হলো ভীষণ।
-‘ একটু অপেক্ষা করুন আমি ওষুধ আনি।’ এই বলে মৃত্তিকা উঠতে নিলেই ঈশান শোয়া অবস্থায় মৃত্তিকার হাত ধরে ফেলে। মৃত্তিকা ঈশানের এমন বাচ্চামো স্বভাব দেখে হেসে দিয়ে বলে উঠল,
-‘ঐতো এই আলমারি থেকেই নিব ওষুধ। ছাড়ুন।’ বলে আলমারির কাছে গিয়ে ওষুধ নিলো। মেডিকেলের ছাত্রী হওয়াই টুকটাক অনেক ওষুধ মৃত্তিকা তার কাছে রাখে। যেকোনো সময় লাগে ভেবে।
মৃত্তিকা পানি এনে ঈশানকে একটু তুলে খাইয়ে দিতেই ঈশান আবার শুয়ে গেল। এবার মৃত্তিকার হুশ এলো। ঈশানকে এইবার ওষুধ খাইয়ে দেওয়ার পর পরই ওর রুমে পাঠিয়ে দিতে হবে ভেবে মৃত্তিকা ঈশানকে ডেকে উঠল,
-‘ঈশান ভাই? উঠুন, আপনি আপনার রুমে যান।’
-‘শোন,আমায় ডিসটার্ব করিস না। আমার ভীষণ মাথা ব্যথা করছে। পারলে একটু টিপে দেয়। তোর ইচ্ছে হলে তুই বোনের রুমে গিয়ে ঘুমা।’ বলেই এক হাত চোখের উপর রেখে পেছন ফিরে শুয়ে পড়ল।
ঈশান চোখ বন্ধ করে ফেলল। এরপরও মৃত্তিকা অনেক্ষন বকবক করলো কিন্তু ঈশানের গভীর নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে সে এগিয়ে হাত দিয়ে বুঝতে পারলো মানুষটা ঘুমিয়ে পড়েছে।
মৃত্তিকা নিভৃতে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। সে এখন কী করবে! আজ ঈশান ভাইয়ের গায়ে হলুদ ছিল। যার ফলে সম্পূর্ণ বাসা মেহমানে ভরপুর। হলুদ শেষে সবাই যার যার ভরাদ্দকৃত রুমে চলে গিয়েছে বিশ্রাম নেয়ার জন্য।
সে বেরিয়ে যেতে নিলেই মোবাইলের কথা মনে পড়তেই আবার ফিরে আসলো। কিন্তু তার মোবাইল নেওয়া আর হলো না। ঈশান ভাইয়ের এতো বড়ো শরীরের নিচে তার বেচারি মোবাইল-খানা চাপা পড়ে গেছে। উনাকে সরানো দায়। আদিবের সাথে কথা না বললে নিশ্চিত ছেলেটা ভীষণ কষ্ট পাবে। এইজন্যই ছেলেটা ঈশান ভাইয়ের বিয়েতেও আসতে দিতে চায়নি। আচ্ছা থাক, একরাতেরই ব্যাপার তো। কাল সকালে উঠেই রাগ পড়ে যাবে। এখন একমাত্র ভরসা হলো রিনি। ঈশান ভাইয়ের বোন। ওর কাছেই থাকতে যেতে হবে। এতো রাতে অন্য কারো রুমে গেলে একটার পর একটা প্রশ্ন করতেই থাকবে। মৃত্তিকা অগত্যা বাধ্য হয়ে ঈশানের দিকে আরেকবার তাকিয়ে তার গায়ের উপর লেপ টেনে দিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
রিনির রুমে গিয়ে অনেকবার শব্দ করার পরেও মেয়েটা দরজা খুলেনি। হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে। শেষবারের মতো আবারো জোরে দরজা ধাক্কা দিতেই রিনি ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলল। এরপর মৃত্তিকা সব খুলে বলতেই রিনি একবার ভাইকে গিয়ে দেখে এসে শুয়ে পড়লো মৃত্তিকার সাথে।
সারারাত মৃত্তিকার চোখে ঘুম এলো না আদিবের জন্য। ছেলেটা মৃত্তিকাকে ফোন দিয়ে না পেলে নিশ্চিত পাগলের মতো করবে। মৃত্তিকার আদিবের চিন্তায় আর ঘুম এলো না। ছেলেটা একটু পাগলাটে স্বভাবের। মৃত্তিকার জন্য মনপ্রাণ সব দিয়ে ফেলবে। এমনকি নিজের ক্ষতি করতেও ছাড়ে না, এজন্যই এসব থেকে রক্ষা করার জন্য মৃত্তিকা আদিবের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিল। রিনির মোবাইল থেকে আদিবের মোবাইলে কল দেওয়ার পরেও কল ধরলো না। শেষের সময় আদিবের মোবাইল বন্ধ শোনালো। হয়ত রাগে অভিমানে মোবাইল বন্ধ করে ফেলেছে। এই ছেলেটাও না! সবসময় মৃত্তিকাকে চিন্তায় ফেলে রাখবে। এতো কেন ভালোবাসে তা মৃত্তিকা ভেবে পায় না।
রাতের নিস্তব্ধতা কেটে গিয়ে সকালের সূর্যের কিরণের ছড়াছড়ি সম্পূর্ণ বিয়েবাড়িতে। বিয়ে বাড়ির ছোট ছোট বাচ্চাদের হইচই এর মধ্যে এক তিক্ততাপূর্ণ হইচই মিলিত হলো। যেটার কোনো অস্তিত্বও নেই সেটাই সবাই চাপিয়ে দিতে চাইছে ঈশান-মৃত্তিকার ঘাড়ের উপর। ড্রয়ইংয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে মৃত্তিকা। অপমানে চোখের পানি ধরে রাখতে পারছে না সে। শেষমেষ এমন অপবাদ পাবে তা সে কোনোদিন কল্পনাতেও আনেনি। সম্পূর্ণ মেহমানরা মৃত্তিকাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। অপমান আর লজ্জায় মৃত্তিকা মাথা তুলতে পারছে না। পাশেই রিনি দাঁড়িয়ে সবাইকে বোঝাতে ব্যস্ত কিন্তু কেউই রিনির কথা মাথায় তুলছে না কারণ এই বাসায় মৃত্তিকা যতবার আসতো ততবারই রিনির সাথেই সবসময় থাকতো সে যার ফলে সবাই ভাবছে রিনি মিথ্যে বলে মৃত্তিকাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। ঈশান এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। এর ভেতরেই সবাই যার যার মতামত দিয়ে ফেলেছে। ড্রয়ইং রুমের এক কোনায় মৃত্তিকার মা রুমি আহমেদ তার একটা মাত্র অস্তিত্ব মৃত্তিকাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি জানেন, তার মেয়ে এমন নই। তার পুরোপুরি বিশ্বাস আছে তার মেয়ে এমন কিছু ভুলেও করবে না কিন্তু এখানে তার কথা কেউ বিশ্বাস করার মতো নেই। এতদিনের আশ্রয়স্থল তার বড়ো ভাই ঈশানের বাবা লুৎফর আহমেদও বিশ্বাস করে নিচ্ছে যে তার বোনের মেয়ে এমন। এসব ভাবতেই রুমি আহমেদ ডুকরে কেঁদে উঠল, তার এতদিনের ভরসা স্থলও বোধহয় হারানোর পথে।
মৃত্তিকার এখন নিজেকে একটা পুতুল বৈ আর কিছু মনে হচ্ছে না, কেউই তার কথা শুনতে চাচ্ছে না। শেষবারের মতো বাড়ির সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো ঈশান-মৃত্তিকার বিয়ে দিবে। এই কথাটা কানে যেতেই মৃত্তিকা চমকে মাথা তুললো। এটা কিছুতেই হতে পারে না। তার আর আদিবের সম্পর্ক আছে। মৃত্তিকার কিছু হলে আদিব নিজেকে নিজে শেষ করে দিবে আর তার চেয়ে বড়ো কথা মৃত্তিকা- আদিব এঁকে অপরকে ভীষণভাবে ভালোবাসে।
মৃত্তিকার এখন সকালে ওই রুমে যাওয়াটা নিতান্তই বোকামি মনে হচ্ছে। সম্পূর্ণ রাত আদিবের চিন্তায় ঘুম না আসাতে ভোর ফুটতেই সে চুপিচুপি ওই রুমে মোবাইল আনার উদ্দেশ্যে গিয়েছিল। রুমে গিয়ে তখনও ঈশানকে ঘুমানো অবস্থায় দেখেছিলো। মৃত্তিকা চুপিচুপি মোবাইল নিয়ে রুম থেকে বের হতে নিতেই ঈশানের চাচি আরশীর মা দেখে ফেলে। যার ফলে মুহূর্তের মধ্যে পুরো বাসার মানুষ এক জায়গায় হয়। ঈশানদের পরিবার যৌথ হওয়াই সবাই এক বাসায়ই থাকে। যার কারণে আজ ঘটনাটা সবার বিপরীতে চলে গেল।
মৃত্তিকার এতো সব ভাবনার মাঝে ঈশানের হবু বউ অর্থাৎ ঈশানের চাচাতো বোন মৃত্তিকার সামনে এসে দাঁড়ালো।
-‘তোমার নূন্যতম লজ্জাও করেনি? আরেকজনের হবু বরের সাথে একই রুমে রাত কাটাতে? ছি! কথাটা বলতে আমার মুখে বাঁধছে। এতো চরিত্রহীন ভাবিনি আমি তোমায় মৃত্তিকা।’
-‘আ,, আপু! আমার কথাটা প্লিজ একবার শু…’
মৃত্তিকা কিছু বলতে নিতেই ঈশানের হবু বউ আরশি হাত উঁচু করে থামিয়ে দিল। আরশি মৃত্তিকার চরিত্র নিয়ে কথা বলতেই মৃত্তিকার চোখ দিয়ে অঝোরে ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। আরশি মৃত্তিকাকে চুপ থাকতে দেখে আরো কিছু বলে সুযোগ বুঝে থাপ্পড় মারার উদ্দেশ্যে হাত তুলতেই ঈশান এসে ধরে হাতটা ছুড়ে মারলো। ঈশানের চোখ মুহূর্তের মধ্যে লাল আঁকার ধারণ করলো। সে ভাবেনি পানি এতদূর গড়াবে!
চলবে