#মেহের,পর্ব:৫
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
বেলকনির রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে শেষ বিকেলের ব্যস্ত প্রকৃতি দেখছে মেহের। মলিন মুখটা জুড়ে একরাশ মায়া ছড়িয়ে আছে। অশ্রুসিক্ত ফোলা চোখ দুটোই বলে দিচ্ছে তার এ কদিনের নীরব অশ্রু বিসর্জনের গল্প। গত তিনটা রাত বুকের ভেতরের অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করেছিল মেহের। বৌ ভাতের অনুষ্ঠানের তিনদিন পর আজ আদ্রিশের পরিবার তাকে নিয়ে সিলেট চলে এসেছে। পরিবার ছেড়ে চলে আসার কষ্টটা পোড়া ঘায়ে নুনের ছিটার মতো মনে হয়েছে তার কাছে। আপনজনদের জড়িয়ে ধরে বুকফাটা আর্তনাদ করেছে সে। সবাই ভেবে নিয়েছে শুধু পরিবার ছেড়ে যাওয়ার কষ্টেই মেয়েটা এমন করেছে। কিন্তু এছাড়াও যে তার মনে এক অসহ্য যন্ত্রণা লুকায়িত আছে, তা কেবল আদ্রিশ আর আরোহীই জানে। স্নিগ্ধর সম্পর্কে জানার পর থেকে মেহেরের কান্না বাঁধ মানছে না। সিলেট আসার পথেও সে থেমে থেমে নিরবে কেঁদেছে। বাড়ি ফিরেই আদ্রিশ বাইরে বেরিয়েছে। আরোহী এসে অনেকক্ষণ অবধি মেহেরের সাথে গল্প করেছে। মেহেরকে নানাভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেছে। মেহের শুধু তার সব কথায় হুঁ, হা করে গেছে। আরোহীর কাজ আছে বলে সে কিছুক্ষণ আগে চলে গেছে। সে চলে যাওয়ার পর মেহের বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে। আদ্রিশের রুমের সাথে লাগোয়া বেলকনিটা বেশ বড়োসড়ো। সেখানে কয়েক রকম ফুল গাছ চোখে পড়ল। তবে একটাতেও এখনও ফুল ফোটেনি। একে তো মনের অবস্থা শোচনীয়, তার মধ্যে এমন একা একা একটুও ভালো লাগছে না মেহেরের। আরোহী বলেছিল তাকে রুম থেকে বেরিয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করতে। তা-ও ইচ্ছে করেনি। আদ্রিশ যাওয়ার সময় বলে গেছে তার ফিরতে সন্ধ্যা হবে। সন্ধ্যা হতে বেশি সময় বাকি নেই। লোকটা সামনে না থাকলেই ভালো। প্রচন্ড অস্বস্তি বোধ হয় তার। লোকটাকে নিয়ে কিছু ভাবতেও পারছে না সে। কাকে ছেড়ে কার কথা ভাববে? বুকে যে ভারী পাথর চাপা পড়ে আছে। ভাবতে গেলেই কান্নারা বাঁধ ভাঙে। জীবন তাকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে এল! না এগোতে পারছে, না পিছোতে। পিছিয়ে যাওয়া আর সম্ভব না। আর এগোতে গেলে সম্মুখে কেবল আদ্রিশ। ওই লোকটাকে কীভাবে ভালোবাসবে সে? তার হৃদয় জুড়ে তো কেবল একজনই ছিল। তার জায়গাটা কি সে দিতে পারবে আদ্রিশকে? লোকটা তো তার ভালোবাসা পাওয়ার আশায় অপেক্ষা করে আছে। কী করা উচিত তার? কোনো প্রশ্নেরই উত্তর মেলে না। গত তিনদিন আদ্রিশ তাকে একা ছাড়েনি। সবসময় নানাভাবে বুঝিয়েছে। মেহের কেবল অবাক হয়। লোকটা এত ধৈর্য কোথা থেকে পেল ভেবে পায় না সে। অথচ দেখে মনে হয় না সে এত ধৈর্য ধারণের ক্ষমতা রাখে। তাকে নিয়ে আদ্রিশের এত প্রচেষ্টা দেখে মেহের আদ্রিশকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। বিভিন্ন ভাবনা মাথার মধ্যে জটলা পাঠালেও, পরক্ষণেই কান্নার শব্দ সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়। হঠাৎ মেঘের গর্জন কানে আসতেই ধ্যান ভাঙল মেহেরের। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল ঘনকালো মেঘের রাজ্য। পরক্ষণেই রিমঝিম বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির ছিটা এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, তবু মেহের এক পা-ও নড়ছে না। আনমনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে। হঠাৎ মেহেরের মনে অদ্ভুত ইচ্ছে জাগল। রুম থেকে বেরিয়ে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখল কেউ নেই। চুপিচুপি চলে গেল সিঁড়ি ঘরে। তারপর ছাদে ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দাঁড়াল। চুপচাপ এক জায়গায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে কতশত ভাবনা ভাবতে লাগল! আর এই ভাবনার মধ্যে যে সে কতটা সময় পার করে দিলো, সে খেয়ালও তার নেই। আদ্রিশ নামক লোকটাকে নিয়ে ভাবতে গেলে কোনো কূল-কিনারা পাওয়া যায় না। এদিকে এই ভয়াবহ বর্ষণ বিলাসের মুহূর্তে স্নিগ্ধকে খুব করে মনে পড়ছে। সেই স্নিগ্ধকে, যে তাকে পাগলের মতো ভালোবাসত। যে তার প্রথম ভালোবাসার অনুভূতি ছিল। আর আজ? কোথায় সেই স্নিগ্ধ, যে বলেছিল তোমাকে ছাড়া আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়? নেই, কোথাও নেই। চারদিকে শুধু হাহাকার। আচ্ছা? জীবনটাই যদি না থাকে, তাহলে তো আর কোনো হাহাকারও থাকবে না, তাই না? সব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মিলবে। চিরদিনের জন্য মুক্তি মিলবে এই অসহনীয় জীবনের থেকে। মুক্তির আশায় উন্মুখ মেহেরের এতক্ষণ ধরে স্থির থাকা পা দুটো আনমনে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। রেলিংবিহীন ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়েও তার অচল মস্তিষ্কে কেবলমাত্র মুক্তি ছাড়া কোনো শব্দই এল না। সে যেন এক মহাঘোর! ঘোরে থেকেই মেহেরের এক পা ছাদ পেরিয়ে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার হাতে টান পড়ল। হেঁচকা টানে মেহেরকে কেউ ছাদের কার্নিশ থেকে সরিয়ে নিল। আকস্মিক ঘটনায় মেহের ভীষণভাবে চমকে উঠল। বৃষ্টির ফোঁটা ভেদ করে সামনে তাকিয়ে আদ্রিশের রক্তবর্ণ চোখ দুটো দেখেই তার হুঁশ ফিরল। মেহের তাকাতেই আদ্রিশ তার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে রাগত স্বরে গর্জে উঠল,
“কী করছিলে তুমি? সুইসাইড করতে যাচ্ছিলে! মরার এত সখ তোমার? এতদিন কী বুঝালাম তোমায়? কোনো কথা তোমার কানে ঢোকেনি? একটা জানোয়ারের জন্য নিজেকে শেষ করতে চাইছো। আমাদের সম্পর্কটা তোমার কাছে কিচ্ছু না? এত সহজে সুইসাইডের ডিসিশন নিয়ে নিলে?”
মেহের প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেও এবার আর নিজেকে সামলাতে পারল না। শব্দ করে কেঁদে উঠল। আদ্রিশের রাগ এতে দ্বিগুণ বেড়ে গেল। মেহেরের বাহু ছেড়ে দিয়ে সে পুনরায় ধমকে উঠল,
“স্টপ ক্রায়িং মেহের। একদম কাঁদবে না। তোমার এই চোখের পানি দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত। এতভাবে তোমাকে বোঝাই, অথচ তুমি বুঝেও বোঝো না। আমাকে কি মানুষ মনে হয় না তোমার? আর কী করব আমি? আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে এতদিনে কী করত ধারণা আছে তোমার? অধিকার ফলানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠত। অথচ আমি চাইছি তুমি যেন নিজ থেকে সবটা বুঝতে পেরে নতুন করে সবকিছু শুরু করো। কিন্তু না, তুমি কি করছো? মরতে চাইছো। বাহ্! ভেরি গুড।”
মেহের দুহাতে মুখ ঢেকে ধপ করে নিচে বসে পড়ল। চুপচুপে ভেজা শাড়িটা শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। আদ্রিশের পরনের শার্টটারও একই অবস্থা। মেহের নিচে বসে মুখ ঢেকে কাঁদছে। আদ্রিশ তার দিকে তাকিয়ে বার কয়েক তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর এগিয়ে গিয়ে মেহেরের বাহু ধরে টেনে উঠিয়ে দাঁড় করাল। এতক্ষণে মেহেরের শরীরে লেপ্টে থাকা শাড়ির দিকে চোখ পড়ল আদ্রিশের। ভেজা ওষ্ঠ জোড়ার দিকে নজর আটকালেও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে নিজেকে সামলে নিল। বুক ফুলিয়ে বড়ো করে দম নিয়ে মেহেরের এক হাত মুঠোবন্দী করে বলল,
“চলো, ঠান্ডা লেগে যাবে।”
মেহের কোনো প্রতিউত্তর না করে চুপচাপ আদ্রিশের সাথে ছাদ থেকে নেমে এল। পরনের ভেজা পোশাক পরিবর্তন করতেই আদ্রিশের মা এলেন। হাতে একটা ট্রে করে দুই কাপ চা নিয়ে এলেন। আদ্রিশ মায়ের হাত থেকে ট্রেটা নিতে নিতে বলল,
“তুমি কেন আনতে গেলে? আমরাই যেতে পারতাম।”
আম্বিয়া খাতুন বললেন,
“আমি আনলে কী সমস্যা? সর তো তুই। বউ মা, কী করছো?”
আম্বিয়া খাতুন আদ্রিশের সামনে থেকে সরে মেহেরের দিকে যেতেই আদ্রিশ বলল,
“যা বাবা, এর মধ্যেই আমার আদর কমে গেল!”
আম্বিয়া খাতুন হাসলেন। মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“এই ভর সন্ধ্যা পর্যন্ত বৃষ্টিতে ভিজলে। এমন কেউ করে? তোমার একা ভালো না লাগলে আমরা আছি তো। আমরা তো ভেবেছিলাম তুমি বুঝি ঘরেই আছো। আদ্রি এসে খোঁজ না করলে তো জানতেও পারতাম না। আমার ছেলেটা কত চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল বলো তো! আর কখনও এমন করবে না।”
মেহের ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাল। আম্বিয়া খাতুন দু-একটা কথা বলে তাড়া দেখিয়ে চলে গেলেন। মেহের ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি চালাতে লাগল। আদ্রিশ ট্রে থেকে একটা কাপ তুলে ঘুরে দাঁড়াতেই ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় চোখ পড়ল। হলুদ আর সাদা রং মিশ্রিত শাড়ি পরিহিতা মেহেরের ভেজা চুল আঁচড়ানোর দৃশ্যটাও তাকে মুগ্ধ করল। এই তুচ্ছ দৃশ্য দেখে আদ্রিশ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল মেহেরের প্রতিবিম্বের পানে। মেহের ভেজা চুলগুলো আঁচড়ে পিঠে ছড়িয়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই আদ্রিশের গভীর দৃষ্টির সাথে দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেল। কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেল সে। মেহেরের অস্বস্তি বাড়িয়ে দিয়ে আদ্রিশ চায়ের কাপটা রেখে এগিয়ে এসে তার মুখোমুখি দাঁড়াল। মেহের আদ্রিশের দৃষ্টি দেখে ফাঁকা ঢোক গিলল। দ্রুত দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে সামনে থেকে সরে যেতে চাইতেই আদ্রিশ হুট করে দুহাতে তার কোমর ধরে হেঁচকা টানে বুকে টেনে নিল। আদ্রিশের এহেন কান্ডে মেহের ভীষণ চমকে উঠল। হৃদপিন্ডে প্রবলভাবে হাতুড়িপেটা শুরু হলো। নিঃশ্বাসটুকু হঠাৎ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। কম্পিত হাত দিয়ে আদ্রিশের থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করতেই আদ্রিশের ঘোর কাটল। মেহেরকে বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করে সে দুপা পিছিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বড়ো করে দম নিল। অতঃপর বিড়বিড় করে ‘সরি’ শব্দটা উচ্চারণ করে হনহন করে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আদ্রিশের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে মেহেরের চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এল। এতদিনে আজই প্রথম লোকটা তাকে এভাবে স্পর্শ করেছে। তা-ও ঘোরে পড়ে। অন্য কেউ হলে এতদিনে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দিত। মেহের বোঝে, তার প্রতি আদ্রিশের ভালোবাসাটা মিথ্যা নয়। একদিন হয়তো এই মানুষটাকেই তাকে মন থেকে মেনে নিতে হবে। ভালোবেসে সংসার জীবনটা গুছিয়ে নিতে হবে। কিন্তু শুরুটাই তো করা যাচ্ছে না। কীভাবে শুরু করবে ভাবতে গেলেই সব এলোমেলো লাগে। আদ্রিশের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করতে তার লজ্জা লাগে। আবার আদ্রিশ নিজে কিছু বললেও সে লজ্জায় মুখ খুলে কিছু বলতে পারে না, চুপচাপ শুনে যায়। মেহের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। আদ্রিশ তাদের সম্পর্কটা এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে, সে বাঁধা দিবে না। নীরব থেকেও সে সাপোর্ট করবে। এতে যদি সবকিছু গুছিয়ে নেওয়া যায়, তবে তাই হোক। এভাবে তো আর জীবন চলে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেহের এগিয়ে গিয়ে আদ্রিশের রেখে যাওয়া চায়ের কাপটা হাতে নিল। লোকটার কি মন খারাপ হয়েছে? চা না খেয়েই রেখে চলে গেল। হয়তো হয়েছে। হবারই কথা। নিজের স্ত্রীকে একটু ছুঁয়ে যদি সরি বলতে হয়, তবে তা কোন পুরুষের ভালো লাগবে? আর এই লোকটা তো তাকে ভালোবাসে। হয়তো অনেক স্বপ্নও বুনে রেখেছে, যা পূরণ হবার আশায় সে দিন গুণছে। আনমনে চায়ের কাপে চুমুক দিতেই মেহেরের মাথায় এল সুইসাইডের ব্যাপারটা। ঘোরের মধ্যে এভাবে যে সে সুইসাইড করতে যাচ্ছিল, কথাটা মাথায় আসতেই মাথার মধ্যে চক্কর দিয়ে উঠল। সজ্ঞানে থাকলে হয়তো সে কখনোই এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারত না। মানসিক চাপটা সত্যিই খুব ভয়ঙ্কর। মানুষের জীবন এক নিমিষেই এলোমেলো করে দেয়। মেহেরের চা শেষ হওয়ার পরও আদ্রিশ এল না। কিছুক্ষণ রুমে বসে থেকে মেহের নিজেই বাইরে বেরোলো। ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখল আদ্রিশ আর আরোহী টিভি দেখছে। মেহেরকে দেখে আরোহী বলল,
“মেহের, এসো। ভালো হয়েছে তুমি নিজেই এসেছ। আদ্রিকে কতক্ষণ ধরে বলছি তোমাকে ডেকে নিয়ে আসতে। শয়তানটা নড়ছেই না। আমারও উঠতে ইচ্ছে করছিল না। বসো।”
মেহের মৃদু হেসে আরোহীর পাশে বসে পড়ল। আদ্রিশ তার দিকে এক নজর তাকিয়েই আবার টিভিতে মনোযোগ দিলো। একনাগাড়ে এক ঘন্টা টিভি দেখে তবেই আরোহী উঠে পড়ল। মেহের প্রশ্ন করল,
“চলে যাচ্ছেন?”
আরোহী মুচকি হেসে বলল,
“হ্যাঁ, ফোন রুমে রেখে এসেছি। ও বোধ হয় এতক্ষণে ফোন করে অস্থির হয়ে গেছে।”
“ও?” বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে উচ্চারণ করল মেহের।
আরোহী ঠোঁটের কোণের হাসিটা দীর্ঘ করে বলল,
“আমি থেমে থাকিনি মেহের। প্রথমদিকে থেমে গিয়েছিলাম, পরে সামলে নিয়েছি। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে গত দুই মাস ধরে।”
“আগে তো বললেন না।”
“খেয়াল ছিল না। সময় করে তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিব।”
“আচ্ছা।”
আরোহী ড্রয়িংরুম থেকে চলে যেতেই মেহের দোটানায় পড়ল। আদ্রিশ তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। এখন তার রুমে চলে যাওয়া উচিত, না এখানেই বসে থাকা উচিত ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। মিনিট পাঁচেক পর হঠাৎ আদ্রিশ বলে উঠল,
“সরি।”
মেহের ভ্রুকুটি করল। আবার সরি কেন? এখন তো আদ্রিশ কোনো ভুলও করেনি। মেহের প্রশ্ন করল,
“কেন?”
“তখন ওভাবে বকাবকি করার জন্য”, মেহেরের দিকে না তাকিয়েই বলল আদ্রিশ।
মেহের মলিন হেসে বলল,
“সরি বলছেন কেন? আপনি তখন ওখানে না গেলে এতক্ষণে হয়তো আমি এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতাম।”
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আদ্রিশ হুট করে টিভি বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। তারপর কোনো দিকে না তাকিয়ে দ্রুত পায়ে ড্রয়িংরুম থেকে চলে গেল। মেহের অবাক হয়ে শুধু তাকিয়ে রইল। লোকটা বোধ হয় আজ একটু বেশিই রেগে আছে। কিছুক্ষণ চুপ মেরে বসে থেকে মেহের নিজেও উঠে রুমে চলল। রুমে ঢুকে দেখল আদ্রিশ ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় বসে আছে। মেহের রুমে এসেছে টের পেয়েও সে ফিরে তাকাল না। মেহের গিয়ে বিছানার অপর পাশে বসে বালিশের পাশ থেকে নিজের ফোনটা বের করল। দুদিন আগে এই ফোনটা তাকে আদ্রিশ দিয়েছে। এখনও ভালোভাবে ফোনটা ঘেঁটে দেখাও হয়ে ওঠেনি। মেহের চুপচাপ বসে গেমসে মনোযোগ দিলো। তারপর কতক্ষণ কেটে গেল খেয়াল নেই তার। আদ্রিশকে হঠাৎ শুয়ে পড়তে দেখে মেহেরের মনোযোগে বিঘ্ন ঘটল। দ্রুত প্রশ্ন করল,
“ডিনার করবেন না?”
আদ্রিশ চোখ বন্ধ করে উত্তর দিলো,
“উঁহু।”
“কেন?”
“এমনি।”
মেহের কিছু একটা ভেবে চট করে বিছানা থেকে নেমে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আরোহী আর আম্বিয়া খাতুন ডিনার রেডি করছিলেন। মেহেরকে দেখে আম্বিয়া খাতুন ডেকে বললেন,
“মেহের, আদ্রিকে ডেকে আনো তো মা।”
“উনি আসবেন না মা।”
“কেন? ডিনার করবে না?”
“জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল করবে না। শুয়ে পড়েছে।”
আম্বিয়া খাতুন রান্নাঘরে যেতে যেতে বললেন,
“আরোহী, তুই ডেকে দেখ তো একবার।”
আম্বিয়া খাতুন রান্নাঘরে যেতেই মেহের দ্রুত এগিয়ে গিয়ে আরোহীকে বলল,
“আপু, শোনো।”
“কিছু বলবে?” প্রশ্ন করল আরোহী।
মেহের আমতা-আমতা করে বলল,
“আসলে আপু, উনি হয়তো আমার ওপর রেগে আছেন।”
“কেন?”
মেহের ইতস্তত বোধ করল। ওসব ঘটনা আরোহীকে বলতে দ্বিধা লাগল। আরোহী মেহেরের মনের কথা না বুঝলেও মৃদু হেসে বলল,
“আদ্রির খাবার রুমে নিয়ে যাবে?”
অগত্যা মেহের মাথা ঝাঁকাল। আরোহী বলল,
“সেটা বললেই হত। দাঁড়াও দিচ্ছি। তোমারটাও নিয়ে যাও। একসাথে খেয়ে নিয়ো।”
মেহের কিছু বলল না। আরোহী খাবারের ট্রে এগিয়ে দিতেই মেহের সেটা নিয়ে সোজা রুমে চলে গেল। বেড সাইড টেবিলে ট্রেটা রেখে ভাবতে লাগল, আদ্রিশ কি ঘুমিয়ে পড়েছে? নড়াচড়াও তো করছে না। মেহের গলা ঝেড়ে কিছুটা জোরে বলল,
“ঘুমিয়ে পড়েছেন?”
প্রথম ডাকেই আদ্রিশ ফিরে তাকাল। প্রশ্ন করল,
“কী হয়েছে?”
“ওই, আপু খাবার দিয়েছে আপনার জন্য”, ইতস্তত করে বলল মেহের।
আদ্রিশ ভ্রুকুটি করে বেড সাইড টেবিলের দিকে তাকাল। তারপর উঠে বসে হুট করে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“আপু দিয়েছে, না তুমি গিয়ে এনেছ?”
মেহের এই প্রশ্নের জবাব দিলো না। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। সে হাত ধুয়ে আসতেই আদ্রিশও বিনা বাক্যে গিয়ে হাত ধুয়ে এল। মেহেরের কান্ড দেখে সে মনে মনে হাসল। মেহের আদ্রিশের দিকে খাবারের প্লেট এগিয়ে নিজেও নিল। খাওয়ার পুরো সময়টা দুজনের একজনও একে অপরের সাথে কথা বলল না। এক প্রকার নীরবতা চলল। খাবার শেষ করে মেহের নিজেই আবার গিয়ে খাবারের প্লেট রেখে এল। এসে দেখল আদ্রিশ শুয়ে পড়েছে। ডিম লাইট জ্বালিয়ে মেহের বিছানায় উঠে বসল। আদ্রিশ এবারও পূর্বের ন্যায় তার দিকে ফিরেও তাকাল না। ঘুমায়নি নিশ্চয়ই, ইচ্ছে করেই তাকাচ্ছে না। মেহের আদ্রিশের দিকে এক নজর তাকিয়ে তাদের মধ্যকার দূরত্বটা পরখ করল। ভেতর থেকে আপনা-আপনি একটা তপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মেহের আদ্রিশের বিপরীত দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই নিদ্রা এসে ভর করল।
চলবে………………🍂