#মেহের,পর্ব:৩
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
আদ্রিশের দিকে তাকিয়ে মেহের বার তিনেক শুকনো ঢোক গিলল। আদ্রিশ কিছুক্ষণ কপাল কুঁচকে মেহেরের দিকে তাকিয়ে থেকে মন ভোলানো এক হাসি দিয়ে বলল,
“আরে, এভাবে তাকিয়ে আছ কেন সুইটহার্ট? এক্স বয়ফ্রেন্ড থাকতেই পারে। আমারও তো এক্স গার্লফ্রেন্ড আছে। ইভেন, তাকে আমি এখনও অনেক ভালোবাসি। তাই বলে তো বউকে হেলা করব না। এক্স গার্লফ্রেন্ড তার জায়গায়, আর বউ বউয়ের জায়গায়।”
মেহের অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আদ্রিশের দিকে। লোকটা হাসবেন্ড হয়ে ব্যাপারটাকে এত সহজভাবে নিল কীভাবে, তার মাথায় ঢুকছে না। তা-ও আবার ফোনালাপ শোনার পরও! আদ্রিশ দরজা বন্ধ করতেই মেহের চমকে উঠল। খাটের একপাশে জড়োসড়ো হয়ে বসে মেঝেতে চঞ্চল দৃষ্টি বিচরণ করতে লাগল। আদ্রিশ এগিয়ে গিয়ে মেহেরের মুখোমুখি বসল। মেহেরের দিকে হাত বাড়াতেই মেহের দ্রুত মাথাটা পিছিয়ে নিল। তবু আদ্রিশ ঝুঁকে পড়ে মেহেরের চোখে জমে থাকা পানিটুকু ডানহাতের তর্জনী আঙুল দিয়ে মুছে দিলো। গলা ঝাড়া দিয়ে নিচু স্বরে বলল,
“বুঝেছি, তোমার এক্স বয়ফ্রেন্ডের জন্য তুমি খুব কষ্ট পাচ্ছ। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে তার সাথে কথা বললে, কান্নাকাটি করলে। হোয়াট এভার, এরপর থেকে আর এটা কোরো না। তুমি এখন আমার ওয়াইফ। সবসময় এটা মাথায় রাখবে।”
মেহের মাথা নিচু করে বসে রইল। এরপর আদ্রিশ প্রায় মিনিট দুয়েক শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। মেহেরের ভয় আর অস্বস্তি বেড়ে গেল। লোকটার এমন দৃষ্টির সামনে সে মুখ তুলে তাকাতেও পারল না। আদ্রিশ সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
“রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি বসেও তো ফটাফট কথা বললে। এখন জড়োসড়ো হয়ে বসে আছো কেন? ওহ্, বুঝেছি। তোমার লজ্জা পাওয়ারই কথা। আজ তো আমাদের বাসর। ওকে, চলো আমরা বাসর করি।”
মেহের চোখ বড়ো বড়ো করে দ্রুত কিছুটা পিছিয়ে বসে তোতলানো স্বরে বলল,
“এই খবরদার, বাজে বকবেন না। আমার ধারেকাছেও ঘেঁষবেন না বলে দিচ্ছি। আপনাকে আমি স্ব-ইচ্ছায় বিয়ে করিনি। বাবার কারণে বাধ্য হয়েছি।”
আদ্রিশ ভীষণ অবাক হয়ে বলল,
“এসব কী বলছো সুইটহার্ট! আমি জানি এই বিয়েতে তোমার মত ছিল না, তাই বলে বাসর রাতে হাসবেন্ডকে দূরে সরিয়ে রাখবে? এটা কি হিন্দি সিরিয়াল না কি? বিয়ে তো হয়েই গেছে। সারাজীবন তোমায় আমার সাথেই থাকতে হবে।”
মেহের কোনো উত্তর না দিয়ে থমথমে মুখে বসে রইল। আদ্রিশ বিছানায় উঠে মেহেরের পাশে বসতেই মেহের চমকে সরে বসল। আদ্রিশ এগিয়ে গিয়ে খাটের কিছু ওপরে দেয়ালের সুইচ টিপে লাইট অফ করল। সঙ্গে সঙ্গে মেহেরের বুকটা ধক করে উঠল। একহাতে হাঁটুর কাছের শাড়ি, আরেক হাতে বিছানার চাদর খামচে ধরে সে দুরুদুরু বুকে আদ্রিশের পরবর্তি কার্যকলাপ দেখার অপেক্ষায় রইল। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে আদ্রিশ টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়ে বলল,
“তোমার রেস্টের প্রয়োজন, ঘুমাও।”
মেহের হা করে আদ্রিশের দিকে তাকিয়ে রইল। বিয়ের দশদিন আগে থেকেই যে ছেলে বাসর, বাসর করে তার মাথা খেয়েছে। সে কি না আজ বাসর রাতে কাছে আসার চেষ্টা না করে চুপচাপ শুয়ে পড়ল! আদ্রিশের বলা কথাটা যেন মেহেরের কিছুতেই বিশ্বাস হলো না। এ কদিনে আদ্রিশকে সে যতটুকু চিনেছে, তাতে এত সহজে দূরে সরে থাকার ছেলে সে নয়। মেহের ভাবল, এই ছেলেকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। বলা তো যায় না, কখন আবার সুযোগ বুঝে হামলে পড়বে। এর থেকে ভালো সারারাত সে সজাগ থাকবে। মেহেরের ভাবনার মাঝেই আদ্রিশ চোখ বন্ধ করেই বলে উঠল,
“কী হলো? শুতে বললাম না তোমায়? অনেক রাত হয়েছে।”
মেহের কোনো কথাই বলল না। চুপ মেরে বসে আড়চোখে আদ্রিশের দিকে তাকাল। মিনিট খানেক পর আদ্রিশ উঠে বসল। মেহের ঢোক গিলে আবার জড়োসড়ো হয়ে বসল। টেবিল ল্যাম্পের আবছা আলোয় আদ্রিশ মেহেরের দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করে বলল,
“ঘুমাচ্ছ না কেন?”
মেহের মেঝেতে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। আদ্রিশ মেহেরের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করেই তার খুব কাছে চলে এল। হতচকিত হয়ে মেহের দূরে সরে যেতে নিতেই আদ্রিশ তাকে ঠেলে বালিশে শুইয়ে দিয়ে দুপাশে হাত রেখে মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ল। মেহেরের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। ফাঁকা ঢোক গিলে সে ভীতু চোখে আদ্রিশের দিকে তাকিয়ে দেখল আদ্রিশ নেশাতুর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার সাথে দৃষ্টি বিনিময় হতেই মেহেরের শরীর জমে বরফ হওয়ার উপক্রম হলো। আদ্রিশ আরও একটু ঝুঁকে পড়তেই তার গরম নিঃশ্বাস মেহেরের মুখে আছড়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মেহের চোখ জোড়া খিঁচে বন্ধ করে ফেলল। আদ্রিশ নমনীয় কন্ঠে ফিসফিস করে বলল,
“সুইটহার্ট, তুমি কি চাও তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে আমি ডেস্পারেট হই? এই আবছা আলোয় তোমাকে কিন্তু খুব আবেদনময়ী লাগছে।”
মেহের চোখ বন্ধ অবস্থাতেই কাঁপা কাঁপা ধরা গলায় বলল,
“প্লিজ দূরে সরুন। আপনার পায়ে পড়ি, কাছে আসবেন না।”
“চুপচাপ ঘুমাও। না ঘুমালে ঠিক তাই হবে, যা তুমি চাও না”, বলেই আদ্রিশ দূরে সরে মেহেরের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ল।
মেহের ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে ঘাড় কাত করে পাশে তাকাতেই আদ্রিশের গভীর চোখে চোখ পড়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে চোখ সরিয়ে মেহের ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। এতটা দূরত্ব রেখে যখন শুয়েছে তখন নিশ্চয়ই কাছে আসবে না। কিন্তু এমনটা কি সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য? আদ্রিশ কেন যেচে দূরে সরে থাকবে? তার থেকে বড়ো প্রশ্ন, স্নিগ্ধর সাথে কথা বলার ব্যাপারে সে কিছু জানতে চাইল না কেন? হাসবেন্ড হিসেবে তার এ বিষয়ে হাজারটা প্রশ্ন করে জেরা করার কথা। অথচ একটা শব্দও সে জিজ্ঞেস করল না! আবার বলল তার এক্স গার্লফ্রেন্ড আছে, যাকে সে এখনও ভালোবাসে। এক্স গার্লফ্রেন্ডকে এখনও ভালোবেসে থাকলে তাকে বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে লাগার মানে কী? আশ্চর্য! হঠাৎ আদ্রিশের কথায় মেহেরের ভাবনায় ছেদ পড়ল। আদ্রিশ বেশ নিচু স্বরে বলছে,
“চাইলেই আমি তোমার কাছে যেতে পারি। নিজের অধিকার আদায়ের সম্পূর্ণ অধিকার আমার আছে। কিন্তু আমি কাপুরুষ নই। আমি জানি তোমার মন জুড়ে অন্য কারো বাস। আমি পেলে কেবল শরীরটাই পাব। কিন্তু আমি তা চাই না। শুধু শরীর নয়, সম্পূর্ণ তুমিটাকেই আমার চাই। আর তার জন্য আমি অপেক্ষা করব। তবে তোমার জন্য খুব শীঘ্রই দারুণ একটা সারপ্রাইজ আছে। কাল কিংবা পরশু। হয়তো সেখান থেকেই আমাদের নতুন পথচলা শুরু হওয়ার সম্ভাবনা আছে। অপেক্ষা করো।”
মেহেরের বিস্ময় আরও একধাপ বাড়ল। আদ্রিশের কথার কোনো মানেই তার মাথায় ঢুকল না। ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে সে আদ্রিশের দিকে আড়চোখে তাকাল। লোকটা বিপরীত দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। বিস্ময় নিয়েই মেহের কিছুক্ষণ আদ্রিশের কথা নিয়ে ভাবল। কিন্তু কোনো কিছুই সে বুঝতে সক্ষম হলো না। কেমন যেন সব ধোঁয়াশা লাগল। এই লোকটাকে হঠাৎ করেই তার ভীষণ রহস্যময় মনে হলো। গুটিসুটি মেরে শুয়ে মেহের নিঃশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে স্নিগ্ধর কথা ভাবল। রাতটা পার হলেই সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। কালই স্নিগ্ধ এসে তাকে নিয়ে যাবে। আর এই নরক থেকে তার মুক্তি মিলবে।
ঘুম ভাঙতেই মেহের লাফিয়ে উঠে বসল। রাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়াল নেই তার। পাশে তাকিয়ে দেখল আদ্রিশ নেই। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল মেহের। ঘুম থেকে উঠেই লোকটার মুখোমুখি হলে তাকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হত। গতকাল ওই লোকটার সাথে সারারাত একই ঘরে একই খাটে ঘুমিয়েছে ভেবেই তো তার অস্বস্তি লাগছে। কী জানি স্নিগ্ধ কী ভাববে! হামি তুলে মেহের আড়মোড়া ভাঙতেই দেখল বেলকনি থেকে তার ননদ আসছে। মেহেরকে বসে থাকতে দেখে সে হেসে বলল,
“উঠলে তাহলে? আমি আরও তোমার ঘুম ভাঙার অপেক্ষা করতে করতে আধ ঘন্টা কাটিয়ে দিয়েছি বেলকনিতে বসে।”
মেহের লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। বরাবরই তার ঘুম ভাঙতে অনেক দেরী হয়। প্রতিদিন মা চিৎকার চেঁচামেচি করে ঘুম ভাঙায়। আজ কেউ ডাকেনি বলে হয়তো আরও বেশি ঘুমিয়ে ফেলেছে। কয়টা বাজে কে জানে? নতুন বউ এত বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছে শুনলে সবাই কী ভাববে? মেহেরকে মাথা নিচু করতে দেখে আরোহী তার পাশে বসে হাসিমুখে বলল,
“আরে লজ্জা পেতে হবে না। আমাদের বাড়ির কেউ কিচ্ছু ভাবেনি, বুঝেছ? আমি তোমাকে আরও আগে জাগাতে চেয়েছিলাম। তোমার বর সঙ্গে সঙ্গে কড়া গলায় নিষেধ করে দিয়েছি। তাই বাধ্য হয়ে বসে অপেক্ষা করছিলাম। যাইহোক, এখন তাড়াতাড়ি ওঠো। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হও। এখানে শাড়ি-টাড়ি সবকিছু রাখা আছে।”
আরোহীর চোখের ইশারায় মেহের বিছানার কোণে তাকিয়ে দেখল হালকা নীল শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট সব আছে। আরোহী ফের প্রশ্ন করল,
“শাড়ি পরতে পারো, না কি পরিয়ে দিতে হবে?”
“পারি”, ছোট্ট করে উত্তর দিলো মেহের।
আরোহী উঠে দাঁড়িয়ে বলল,“তাহলে দ্রুত পরে নাও। এই রুমে কেউ আসবে না এখন। আমি একটু পরে আসছি। আজ কিন্তু বৌভাত, ভুলে বোসো না আবার।”
মেহের মৃদু হাসল। আরোহীও হাসিমুখে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মেহের বিছানা ছেড়ে নেমে শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। দ্রুত শাওয়ার নেওয়ার পর ভাবল আদ্রিশ এখন রুমে নেই। মনে হয় না এখন আসবে। হয়তো আজ বৌভাত বলে ব্যস্ত আছে। রুমে গিয়েই শাড়ি পরতে সুবিধা হবে। মেহের ব্লাউজ আর পেটিকোট পরে ভেজা চুলে তোয়ালে জড়িয়ে শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এল। দ্রুত হস্তে শাড়ি পরতে শুরু করল। আঁচলটা কোনোরকমে কাঁধে ফেলে কুঁচি গোছাতে ব্যস্ত হলো। দ্রুত কুঁচি দিতে গিয়ে বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মেহের বিরক্ত হয়ে পুনরায় নতুন উদ্যমে কুঁচি দিচ্ছে। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে মেহের ভীষণ চমকে দরজার দিকে তাকাতেই আদ্রিশের স্থির দৃষ্টিতে দৃষ্টি পড়ে গেল। কুঁচি ধরা হাতটা দিয়ে কুঁচিগুলো শক্ত করে পেটের সাথে চেপে ধরে দ্রুত সে বিপরীত দিকে মুখ করে দাঁড়াল। হৃদপিন্ডে হাতুড়িপেটা শুরু হতেই তার গলা শুকিয়ে এল। ভেতর থেকে দরজা আটকানোর শব্দে মেহেরের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। সে ব্যস্ত হয়ে বলল,
“আপনি এখন এখানে কেন? বাইরে যান।”
আদ্রিশ কিছু সময়ের জন্য থমকে গেল। মেহেরের শ্যাম ফরসা উন্মুক্ত কোমরে চোখ পড়তেই সে নিজেকে সামলে নিল। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে ক্লোজেট খুলতে খুলতে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,
“রুমটা আমাদের দুজনের জন্য বরাদ্দ। তাই এই রুমে আসতে নিশ্চয়ই তোমার পারমিশন নিতে হবে না আমায়।”
“আমি শাড়ি পরছি দেখছেন না?”
“পরো, আমি কি আটকে রেখেছি?”
“আশ্চর্য! আমি কি আপনার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ি পরব?”
“আমি কি তোমার দিকে তাকিয়ে আছি?”
মেহের পড়ল বিপাকে। লোকটা এভাবে সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে সে শাড়ি পরবে কীভাবে? সে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই আদ্রিশ জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
“আমি শাওয়ার নিতে নিতে শাড়ি পরা শেষ করো।”
আদ্রিশ ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করতেই মেহের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যত দ্রুত পারল শাড়ি পরা শেষ করল। দরজায় নক পড়তেই মেহের গিয়ে দরজা খুলে দিলো। আরোহীর হাতে একটা ট্রে। সে মিষ্টি হেসে বলল,
“সবার খাওয়া শেষ। তুমি আর আদ্রি বাকি আছো। সে তার বউকে রেখে খায়নি। নাও।”
আরোহী তার হাতের ট্রেটা মেহেরের হাতে দিয়ে প্রশ্ন করল,
“আদ্রি কোথায়?”
“ওয়াশরুমে।”
“আচ্ছা, ও বেরোলে দুজন একসাথে খেয়ে নিয়ো।”
অগত্যা মেহের মুচকি হেসে ঘাড় কাত করল। আরোহী চলে যেতেই মেহের দরজা আটকে গিয়ে বিছানার ওপর ট্রেটা রাখল। তারপর দ্রুত গিয়ে বালিশের নিচ থেকে নিজের ফোনটা বের করল। আরও এক ঘন্টা আগে আসা স্নিগ্ধর মেসেজ দেখে দ্রুত মেসেজ বক্সে গিয়ে দেখল স্নিগ্ধ লিখেছে,
“গুড মর্নিং জান। আমি এইমাত্র ঢাকার বাসে উঠেছি। আজ বৌভাতের পর তো তুমি তোমার চাচার বাড়ি চলে যাবে, তাই না? তুমি যদি পারো তোমার চাচার বাড়ির এড্রেস দাও, না পারলে চিন্তা কোরো না। আমি লোকেশন ট্র্যাক করে পৌঁছে যাব। ফোন সবসময় সাথে রাখবে। আমি পৌঁছেই তোমাকে জানাব। তারপর তুমি যেভাবে হোক ওই বাড়ি থেকে বেরোবে। আরেকটা কথা, ওই ছেলে তোমার কাছে আসেনি তো?”
মেহের মেসেজের রিপ্লাই দিতে যাবে তখনই ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এল আদ্রিশ। মেহেরকে চমকে উঠতে দেখে সে মেহেরের হাতের ফোনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট এলিয়ে হেসে বলল,
“এক্স বয়ফ্রেন্ড ফোন করেছে না কি?”
মেহের ফোনটা হাতে চেপে ধরে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। আদ্রিশ হাতের ভেজা তোয়ালেটা বেলকনিতে মেলে রেখে এসে বিছানায় আরাম করে বসে বলল,
“তো? এক্স বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালানোর প্ল্যানিং চলছে না কি?”
মেহের ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ঢোক গিলে ভাবল, লোকটা বুঝল কীভাবে? আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ল না কি? এখন যদি ফোনটা কেড়ে নেয়, তাহলে? সে আমতা-আমতা করে বলল,
“এসব কী বলছেন আপনি?”
“কেন? মিথ্যে বললাম বুঝি? আচ্ছা বাদ দাও, এখানে এসে বসো তো। ক্ষুধা পেয়েছে নিশ্চয়ই?”
আদ্রিশের কথায় মেহের টের পেল, আসলেই তার প্রচুর ক্ষুধা পেয়েছে। গতকাল রাতে পেটপুরে খাওয়া হয়নি। তাই এখন একটু বেশিই ক্ষুধা পেয়েছে। আদ্রিশ চোখের ইশারায় আবার ডাকতেই মেহের এগিয়ে গিয়ে আদ্রিশের থেকে অনেকটা দূরে বসে পড়ল। আদ্রিশ ট্রে থেকে একটা প্লেট নিয়ে মেহেরের দিকে বাড়িয়ে ধরল। মেহের সেটা নিল। আদ্রিশ নিজের প্লেট নিয়ে খাওয়া শুরু করল। মেহেরও চুপচাপ খেতে লাগল। আপাতত ক্ষুধা নিবারণ করতে পারলেই হলো। আদ্রিশ খেতে খেতে বলল,
“শাড়িতে তোমাকে দারুণ লাগে!”
সঙ্গে সঙ্গে মেহের বিষম খেয়ে কাশি উঠে গেল। আদ্রিশ হাত থেকে প্লেট রেখে দৌড়ে গিয়ে বেড সাইড টেবিল থেকে পানি এনে মেহেরের দিকে বাড়িয়ে ধরল। মেহের পনির গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেল। আদ্রিশ নিজের জায়গায় বসে মেহেরের দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বলল,
“এটুকুতেই বিষম খেলে সুইটহার্ট? তোমার প্রশংসা আমি ছাড়া আর কে করবে?”
মেহের বিরক্তি নিয়ে বলল,
“আপনার প্রশংসার দরকার নেই আমার। চুপচাপ খান তো।”
আদ্রিশ হেসে খাবার মুখে তুলে চিবোতে চিবোতে বলল,
“চাইলে আমি তোমার ফোনটা গত রাতেই জিম্মি করতে পারতাম। কিন্তু আমি তা করব না। যতদিন পর্যন্ত তুমি আমাদের সম্পর্কটা মন থেকে মেনে নিতে না পারছ, ততদিন আমি তোমার ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করব না। তবে তোমায় বুঝতে হবে যে, কোনটা তোমার জন্য সঠিক আর কোনটা ভুল। তুমি হয়তো বুঝতে পারছো না আমার কথা। নো টেনশন, সময়মতো আমি বুঝিয়ে দিব।”
মেহের পুনরায় অবাক হলো। এই লোকের কথার মাথামুণ্ডু বুঝা বড়ো দায়। আদ্রিশের কথার প্রতিউত্তর না করে মেহের খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। সম্পূর্ণ খাবার শেষ না করেই মেহের খাওয়ায় সমাপ্তি টানল। আদ্রিশ দেখেও চুপচাপ নিজের খাবার শেষ করল। পানি খেয়ে উঠে গিয়ে মেহেরের চুল থেকে একটানে তোয়ালেটা খুলে ফেলল সে। কোমরের কিছু ওপর অবধি চুলগুলো সারা পিঠে ছড়িয়ে পড়তেই মেহের ভ্রু কুঁচকে আদ্রিশের দিকে তাকাল। আদ্রিশ মেহেরের কোলের ওপর তোয়ালেটা রেখে বলল,
“ভেজা চুলে এতক্ষণ অবধি তোয়ালে জড়িয়ে রাখবে না। ঠান্ডা লেগে যাবে।”
কথাটা বলেই আদ্রিশ খাবারের প্লেটসহ ট্রেটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মেহের একদৃষ্টিতে সেদিকেই তাকিয়ে রইল। পরক্ষণেই স্নিগ্ধর কথা মাথায় আসতেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
__________________________
পিংক আর গোল্ডেন কালারের একটা ভারী লেহেঙ্গা, গা ভর্তি গহনা আর হালকা মেকআপে সজ্জিত মেহের প্রায় বিশ মিনিট যাবত কমিউনিটি সেন্টারের স্টেজে বসে আছে। তার পাশে আদ্রিশ। তাদের আশেপাশে আদ্রিশের চৌদ্দ গোষ্ঠী সবাই। ফটোশুট চলছে। এই ফটোশুটের পাল্লায় পড়ে মেহের চরম বিরক্ত। তবু আরোহীর অনুরোধে মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে চুপচাপ বসে আছে। একের পর এক আত্মীয়-স্বজন আসছে আর ফটোশুট করছে। আদ্রিশের মামা ভাড়া ফ্ল্যাটে থাকেন। তাই কমিউনিটি সেন্টারেই বৌভাতের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আদ্রিশদের আত্নীয়-স্বজনদের বেশিরভাগই ঢাকার বাসিন্দা। তাই এদিক থেকে তাদের বেশ সুবিধা হয়েছে। মেহেরের বিরক্তির যথেষ্ট কারণ আছে। খাওয়ার আগেও একধাপ ফটোশুট চলেছে। খাওয়ার পরেও রেহাই দিলো না। মেহেরের হাতের মুঠোয় তার মায়ের ফোনটা। অতি সন্তর্পণে সে এতক্ষণ এটা লুকিয়ে রেখেছে। তার মা দেখে ফেললে হয়তো চেয়ে বসবে। তার বড়ো বোনটা আসেনি। বোনের জন্য তার খুব কষ্ট হচ্ছে। না চাইতেও সে তার বোনকে মানসিক আঘাত করেছে। এটা ভাবলেই তার কান্না চলে আসে, সাথে আদ্রিশের ওপরেও প্রচন্ড রাগ ওঠে। আত্মীয়-স্বজনরা অনেকেই ইতোমধ্যে বিদায় নিতে শুরু করেছে। হয়তো কিছুক্ষণ পরেই এখান থেকে মুক্তি মিলবে। মেহের অপেক্ষা করছে, কখন চাচার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হবে। আদ্রিশ মেহেরের মুখের অবস্থা দেখে মুখ টিপে হাসছে। মেয়েটার এই অল্পতেই বিরক্তি আর রাগে গাল ফোলানোর স্বভাবটা বেশ ভালোই লাগে তার কাছে। আত্মীয়-স্বজন সবাই বিদায় নেওয়ার পর মেহেররাও কমিউনিটি সেন্টার থেকে বেরোনোর সুযোগ পেল। গাড়িতে উঠে বসে তবেই মেহের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তখন বিকেলের শেষভাগ। মেহেরের চাচার বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা পৌনে সাতটা বেজে গেল। চাচার বাড়িতে এসে মেহেরের চাচাতো-ফুপাতো বোনরা মেহের আর আদ্রিশকে একটা রুমে দিয়ে এসেছে ফ্রেশ হওয়ার জন্য। সাথে বলেও গেছে, তাদের ফ্রেশ হওয়ার পর আবার সবাই মিলে আড্ডা বসাবে। আদ্রিশ এসেই লাগেজ থেকে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়েছে। এদিকে মেহের ড্রেসিং টেবিলের সামনে অসহায় মুখে বসে আছে। এই সাজ পালটাতে কারো সাহায্য দরকার ছিল। অথচ সবগুলো চলে গেল। বাধ্য হয়ে মেহের তার কাজিনদের ফোন করল। অথচ একজনও এল না। সবাই না কি ব্যস্ত তাদের আড্ডার ব্যবস্থা করতে। বিরক্ত হয়ে মেহের বড়ো বোনকে ফোন করল। মাইশা দরজা বন্ধ করে চুপচাপ ঘরে বসে ছিল। বোনের ফোন পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল। মাইশাকে দেখেই মেহের ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। মাইশা ছোটো বোনের মাথায় পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে গলায় বলল,
“কেমন আছিস বোন?”
“ভালো না আপু। আমি তোমার মনে কষ্ট দিয়েছি, তাই না?”
“ধুর বোকা! কে বলেছে কষ্ট দিয়েছিস?”
মেহের মাইশাকে ছেড়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখে বলল,
“আমি জানি তুমি কষ্ট পেয়েছ। তোমার আগে আমার বিয়ে হয়ে গেল।”
“তাতে কি? আমার ছোট্ট বোনটার এত ভালো একটা বরং হয়েছে, শ্বশুরবাড়ি হয়েছে, নতুন সংসার হয়েছে। আমি খুব খুশি হয়েছি বোন। এখন বল তো, কেন ডেকেছিস?”
“দেখো না, শয়তানগুলো আমাকে রুমে ফেলে রেখে চলে গেছে। চেঞ্জ করতে একটু হেল্প তো দরকার।”
“বর থাকতে অন্য কাউকে লাগবে কেন?” মুখ টিপে হেসে বলল মাইশা।
মেহের তাড়া দেখিয়ে বলল,
“ধুর! হেল্প করো তো।”
মাইশা মেহেরের চুল থেকে ক্লিপ খোলার সময় আদ্রিশ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এল। আদ্রিশকে দেখে মাইশা কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ল। আদ্রিশ বুঝতে পেরে মুচকি হেসে বলল,
“আপনি বড়ো আপু?”
মাইশা মৃদু হেসে মাথা ঝাঁকাল। আদ্রিশ হাসিমুখেই প্রশ্ন করল,
“কেমন আছেন আপু?”
“ভালো, আপনি?”
“আলহামদুলিল্লাহ্। আপনাকে তো গতকাল বা আজকের প্রোগ্রামে দেখলাম না।”
“আমি আসলে হৈ-হুল্লোড় খুব একটা পছন্দ করি না। তাই বাড়িতেই চুপচাপ থাকি।”
“ওহ্। আচ্ছা আমি বাইরে যাচ্ছি।”
আদ্রিশ রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই মাইশা বলল,
“ছেলেটা খুব ভালো। বিয়ের আগেও দেখেছিলাম আমাদের বাড়িতে যাওয়ার পর। কথাবার্তা খুব সুন্দর। মেনে সংসার করবি, বুঝলি?”
মেহের কোনো উত্তর দিলো না। ‘ওই এক্সিডেন্টটা না হলে আজ তোরও সাজানো গোছানো একটা সংসার থাকত রে আপু’, কথাটা গলায় এসেও আটকে গেল।
_____________________
আড্ডা চলছে জমজমাট। মেহেরের পুরো কাজিন গোষ্ঠী সবাই মিলে আড্ডা বসিয়েছে প্রায় এক ঘন্টা আগে। কিছুক্ষণ আগে আদ্রিশের ইম্পর্ট্যান্ট ফোন আসায় সে আড্ডা থেকে বেরিয়ে গেছে। এদিকে মেহের চরম বিরক্তি নিয়ে গাল ফুলিয়ে বসে সবার তামাশা দেখছে। সেই সকালে চাচার বাড়ির এড্রেস দেওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত স্নিগ্ধ মেসেজ বা কল করেনি। অপেক্ষা করতে করতে সে হাঁপিয়ে পড়েছে। বারবার ফোন চেইক করছে। এরইমধ্যে ফোন ভাইব্রেট করতেই মেহের চমকে উঠল। দ্রুত ফোন অন করে দেখল স্নিগ্ধর মেসেজ। স্নিগ্ধ তাকে বাড়ি থেকে বের হতে বলছে। মেহের রিপ্লাই দিলো সে কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছে। তারপর কিছুটা নড়েচড়ে বসে সবার উদ্দেশ্যে বলল,
“শোনো, তোমরা আড্ডা দাও। আমার মাথাটা খুব ধরেছে। আমি রুমে যাচ্ছি।”
কেউ তাকে ছাড়তে রাজি হলো না। শেষে মেহেরের এক চাচাতো ভাইয়ের বউ বলল এই বিয়ের কারণে মেহেরের ওপর অনেক ধকল গেছে। তাই তাকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। আড্ডা থেকে বেরিয়ে মেহের হাঁফ ছাড়ল। স্নিগ্ধ বলেছে শুধু গহনা ছাড়া আর কিচ্ছু নিতে হবে না। স্নিগ্ধর নতুন চাকরি। এখন সংসার গোছাতে গেলে টাকার প্রয়োজন। এত টাকা সে এখন কোথায় পাবে? মেহের আগে থেকেই সব গহনা একটা সাইড ব্যাগে গুছিয়ে রেখেছিল। এক ছুটে রুমে গিয়ে সেটা নিয়ে বেরিয়ে এল সে। বড়োরা সবাই রাতের খাবার গোছাতে ব্যস্ত। তাই ড্রয়িংরুম ফাঁকা। পা টিপে টিপে সে ড্রয়িংরুম পেরিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল। চাচার বাড়িতে দারোয়ানের ঝামেলা নেই। তাই সে খুব সহজেই বাড়ি থেকে বেরোতে পারল। রাস্তায় নামতেই গেইটের অদূরে দাঁড়ানো স্নিগ্ধকে দেখেই খুশিতে মেহেরের চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। কালো প্যান্ট, অফ-হোয়াইট টি-শার্ট আর গোছানো চুলে স্নিগ্ধকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। দুটো মাস পর ভালোবাসার মানুষটাকে সামনে দেখে সে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ল। ছুটে গিয়ে স্নিগ্ধর সামনে দাঁড়িয়ে ধরা গলায় বলল,
“দুটো দিন আগে কেন এলে না স্নিগ্ধ? আমি তো ভেবেছিলাম আমি বুঝি তোমাকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলেছি।”
স্নিগ্ধ মেহেরের কথায় কান না দিয়ে তাড়া দেখিয়ে বলল,
“এসব কথা পরে বলা যাবে জান। এখন আমাদের এখান থেকে পালাতে হবে। কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। চলো। গহনা এনেছ?”
“হ্যাঁ, এই তো। নাও”, শাড়ির আঁচলের নিচ থেকে সাইড ব্যাগটা বের করে স্নিগ্ধর দিকে এগিয়ে ধরে বলল মেহের।
স্নিগ্ধ বাঁধা দিয়ে বলল,
“আমাকে দিতে হবে না। তোমার কাছেই রাখো। রাজশাহী পৌঁছে এগুলো কাজে লাগাব।”
মেহের মাথা দুলিয়ে বলল,
“আচ্ছা।”
“চলো”, মেহেরের এক হাত মুঠোয় নিয়ে বলল স্নিগ্ধ।
এর আগে কখনও স্নিগ্ধ মেহেরকে স্পর্শ করেনি। বলতে গেলে এটাই তার প্রথম স্পর্শ। এই হাতটা ধরে নতুন পথচলার কথা ভেবে মেহেরের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল। এই মূহূর্ত থেকেই হয়তো পথচলা শুরু। স্নিগ্ধর হাতে হাত রেখে ঘুরে দাঁড়িয়ে কয়েক পা এগোতেই হঠাৎ মেহেরের পা থেমে গেল। সম্মুখে দৃষ্টি পড়তেই স্নিগ্ধর হাত থেকে আপনা-আপনি তার হাতটা খসে পড়ল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল না তার। সম্মুখে একদল পুলিশের সঙ্গে দণ্ডায়মান স্বয়ং আদ্রিশ। মেহের ফাঁকা ঢোক গিলে স্নিগ্ধর দিকে তাকাল। কিন্তু একি! চোখের পলকে স্নিগ্ধ তাকে রেখে অন্যদিকে ছুটল। বেশিদূর যেতে পারল না। তার আগেই কয়েকজন পুলিশ দৌড়ে গিয়ে তাকে আটকে ফেলল। আদ্রিশ এগিয়ে গিয়ে পুলিশদের সাথে কী যেন কথা বলছে। স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়েও কিছু একটা বলছে। স্নিগ্ধ পালটা কোনো জবাব দিচ্ছে না। মেহেরের মস্তিষ্ক হঠাৎ করেই ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। স্নিগ্ধকে টেনে পুলিশের গাড়ির দিকে নিয়ে যেতে দেখেই মেহেরের হুঁশ ফিরল। সে ছুটে গিয়ে পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“একি! এসব কী হচ্ছে? আপনারা ওকে অ্যারেস্ট করছেন কেন?”
একজন পুলিশ বলল,
“ওনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে ম্যাডাম। পথ ছাড়ুন।”
“না। আগে বলুন, কিসের অভিযোগ? আর কে করেছে? আমি স্ব-ইচ্ছায় ওর সাথে চলে যাচ্ছিলাম। এতে ওর কোনো দোষ নেই।”
আরেকজন পুলিশ বলল,
“আমাদের কাজে বাঁধা দিবেন না। আপনার যা জানার আপনার হাসবেন্ডের থেকে জেনে নিন।”
পুলিশগুলো স্নিগ্ধকে গাড়িতে ওঠাতে নিতেই মেহের খপ করে স্নিগ্ধর হাত ধরে ফেলল। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
“এসব কী হচ্ছে স্নিগ্ধ? তোমাকে আটকে রাখলে আমার কী হবে? আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না। প্লিজ ওনাদের বলো তুমি নির্দোষ।”
স্নিগ্ধ মাথা নিচু করে আছে, একটিবার মুখ তুলে তাকালও না প্রেয়সীর দিকে। মেহের এতে আরও উত্তেজিত হয়ে উঠল। স্নিগ্ধর শার্ট খামচে ধরে জোর গলায় বলে উঠল,
“কিছু বলছো না কেন তুমি? আমি তোমাকে ছাড়া মরে যাব। বলেছিলাম না? বলো তুমি কোনো অপরাধ করোনি।”
পুলিশগুলো মেহেরের থেকে জোরপূর্বক স্নিগ্ধকে ছাড়িয়ে ঠেলে গাড়িতে উঠিয়ে নিল। মেহের আটকাতে পারল না। মেহেরের কান্নার গতি বাড়ছে। পুলিশের গাড়ি স্টার্ট করতেই মেহের উন্মাদের মতো গাড়ির পেছনে ছুট লাগাতে লাগল। এতক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে আদ্রিশ চুপচাপ গম্ভীর মুখে মেহেরের কীর্তিকলাপ লক্ষ্য করছিল। মেহের ছুট লাগাতে যেতেই সে খপ করে মেহেরের হাত টেনে ধরে আটকে দিলো। এতে মেহেরের মাথায় প্রচন্ড রাগ চেপে বসল। এক ঝটকায় আদ্রিশের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চিৎকার করে উঠল,
“সমস্যা কী আপনার? কী করলেন এটা? ওকে কেন ধরিয়ে দিলেন? ওর সাথে কী শত্রুতা আপনার? বউ হারিয়ে ফেলার ভয়ে এত বড়ো একটা সর্বনাশ করলেন, তাই না? খুব ক্ষতি হয়ে যেত আপনার? আরে আপনার থেকে অনেক বেশি ক্ষতি আমাদের হয়েছে। আমাদের এতদিনের ভালোবাসা, স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দিয়েছেন আপনি। আমি বাঁচব না ওকে ছাড়া। বিশ্বাস করুন। মরে যাব আমি, মরে যাব।”
পাগলের মতো চেঁচিয়ে কথাগুলো বলতে-বলতে মেহেরের মাথাটা হঠাৎ ঘুরে এল। এ কদিনের মানসিক চাপে মাথাটা প্রচন্ড ভার ভার লাগল। দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভবপর হয়ে উঠছে না। আদ্রিশ মেহেরের দুহাত ধরে টেনে তাকে কাছে টেনে নিল। সঙ্গে সঙ্গে মেহের ঢলে পড়ল আদ্রিশের বুকে। দুর্বল শরীরটা আর সামলাতে পারল না। অশ্রুসিক্ত চোখ দুটোও ক্লান্তিতে মুদে এল।
চলবে………………🍂