মেঘে_ঢাকা_আকাশ #পর্ব-৩,৪

#মেঘে_ঢাকা_আকাশ
#পর্ব-৩,৪
#আমিনুর রহমান
পর্ব-৩

মিলি আবার আমাকে ফোন দিলো। এবার সে কিছুটা নরম হলো আমার প্রতি। হয়তো বুঝতে পেরেছে আমি ভালো নেই। মিলি আমাকে জিগ্যেস করলো,”কি হয়েছে তোমার?”

আমি কিছু বললাম না। মিলি আবারও জিগ্যেস করলো আমি এড়িয়ে গেলাম। মিলি আমার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে চুপ হয়ে গেলো। আমি তাকে বললাম।

“তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। তুমি সত্যি সত্যি মন থেকে উত্তর দিবে? যদি মন থেকে উত্তর দাও তাহলে আমি কথাটা বলবো না হলে বলবো না।”

তখন মিলি বলল,কি এমন জানতে চাও যে আমাকে এভাবে শপথ করিয়ে নিচ্ছো? খারাপ কিছু নাতো?”

তখন আমি হেসে বললাম।

“ধরে নাও তাই,খারাপ কিছুই জানতে চাইবো।”

আমার হাসি শুনে মিলি খুশি হতে পারলো না। কারণ আমার হাসি সুন্দর না। তাই হয়তো মিলি মন খারাপ করে বলল,
“তোমার হাসিটা আগের মতোই আছে। একটা মানুষ এতো বিশ্রী ভাবে হাসতে পারে তোমার হাসিটা না শুনলে বুঝতাম না।”

আমি আবারও আমার বিশ্রী হাসি হেসে বললাম।

“মিলি এই দুই বছরে কি তুমি কখনো আমাকে মনে করেছো? কিংবা আমার জন্য চোখের জল ফেলেছো?”

মিলি খুব সহজেই বলল।

“তোমাকে মনে করেছি ঠিকই তবে তোমার জন্য কখনো চোখে জল আনিনি।”

আমি অবাক হলাম না কারণ আমি জানতাম মিলির ওতোটা কাছের মানুষ আমি কখনো হতে পারিনি যে আমি তাঁর জীবন থেকে চলে আসাতে সে চোখের জল ফেলবে। কিছু মানুষকে ভালোবাসলেও তাদের কাছের মানুষ হওয়া যায় না,আমিও হয়তো তেমন একজন মানুষকে ভালোবসেছিলাম। আমি কিছুটা সময় নীরব থাকলাম তারপর বললাম।

“আমি চলে যাওয়ার পর কি তোমার জীবনে বিশেষ কেউ এসেছিলো? কিংবা কারো সাথে খুব ভালো থাকার মতো সম্পর্ক হয়েছিলো তোমার?”

আমার এমন কথা শুনে মিলি অনেকটা সারপ্রাইজড হলো,তবুও সে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল।

“তুমি চলে যাওয়ার পর একটা ছেলে আমার জীবনে এসেছিলো। ঠিক তোমার মতো করে হাসতো,তোমার মতো করে কথা বলতো,তোমার মতো করে অভিমান করতো। ওর মাঝে যেনো আমি তোমাকে খুঁজে পেতাম। কিন্তু একসময় ও আমার জীবন থেকে চলে গেলো। কি কারণে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে সেটা আজও আমার কাছে অজানা।”

মিলির মুখ থেকে কথাগুলো শুনে অনেক বেশি খারাপ লাগলো আমার। বুকের বামপাশে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলাম। মনে হলো বুকের ভিতর থেকে ছিন্নভিন্ন হয়ে কোনো কিছু বের হয়ে আসতে চাইছে। নিজের এক সময়কার ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে এরকম কিছু কথা শুনলে কার না খারাপ লাগবে? আমরা ভাবি আমাদের ভালোবাসার মানুষটা হয়তো আমাদেরকে এখনো ভুলতে পারেনি,আমাদের জন্য এখনও মাঝরাতে একাকী নীরবে চোখের জল ফেলে। কিন্ত বাস্তবতা হলো আমাদের প্রিয় মানুষটা আমাদেরকে মনে রাখে না,আমাদের জন্য কাঁদে না। সে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে,অন্য কারো চোখের জল মুছে দেওয়াটাকেই জীবনের সার্থকতা মনে করে,আমাদেরকে মনে করার সময় তাঁর হয় না।

আমি দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে মিলিকে বললাম।

“ছেলেটা বুঝি আমার থেকেও অনেক সুন্দর ছিলো? তোমাকে অনেক ভালো রাখতো?”

তখন মিলি বলল।
“সেটা জানি না,তবে তাঁর সাথে যতদিন ছিলাম ততদিন তোমাকে খুব একটা মনে হয়নি আমার। মনে হয়নি বললে ভুল হবে। ও আমাকে তোমার কথা মনে করতে দেয়নি। এর জন্যই হয়তো বা তোমাকে ফোন না দিয়ে থাকতে পেরেছি।”

“তার মানে ওই ছেলেটা যদি তোমার জীবন থেকে চলে না যেতো তাহলে আমাকে কখনো ফোন দিতে না,আমার সাথে যোগাযোগ করতে না। তোমার বিচ্ছেদটাই আমার সাথে যোগাযোগ করতে তোমাকে বাঁধ্য করেছে?”

“হ্যাঁ,এমনটা ধরে নিতে পারো।”

“আচ্ছা বলো তো। আমাদের দুজনের মাঝে এখন তোমার কাকে বেশি মনে পড়ে?”

“তোমাকে মনে পড়ে,ও চলে যাওয়ার পর তোমাকে অনেক মনে হতো,তোমার সাথে অনেকবার যোগাযোগ করতে চেয়েও পারিনি। তোমার নাম্বারটা হারিয়ে ফেলেছিলাম। পরে অনেক কষ্ট করে জোগাড় করেছি।”

“শুনে ভালো লাগলো আমি চলে যাওয়ার পর তুমি অনেক ভালো ছিলে।”

“আমার সাথে ব্রেকআপের পর তোমার জীবনে কোনো মেয়ে আসেনি?”

“সেটা তো তুমি জানো। একারণেই তো আজ আমি নিঃস্ব। যাইহোক এসব কথা বলে নিজের কষ্টটাকে বাড়াতে চাই না। তোমাকে একটা কঠিন প্রশ্ন করি। তোমার জীবনে দুইজন ছেলে এসেছিলে,না? আমি আর ওই ছেলেটা যাকে পেয়ে তুমি আমাকে ভুলে গিয়েছিলে। তুমি কি বলতে পারবে,এই দুজন মানুষের মধ্যে তুমি কাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিলে,মন থেকে নিজের করে চেয়েছিলে?”

“তোমাকে। আমার এখন ওই ছেলেটাকে মনে হয় না কিন্তু তোমাকে মনে হয়। ওই ছেলেটাকে আমি ভুলে গেলেও তোমাকে ভুলতে পারিনি।”

“মিলি,তোমার মন অনেক মিথ্যা বলে। মনকে বুঝাও এতো মিথ্যা বলা ভালো না। সত্য কি জানো? তুমি আমাকে কখনোই ভালোবাসোনি,যদি বাসতে তাহলে কখনোই তুমি দ্বিতীয় কাউকে ভালোবাসতে পারতে না,দ্বিতীয় কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে আমাকে ভুলে যেতে না।”

“মানুষ কি একজনকে ভালোবাসা অবস্থায় অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়ায় না? আমি একটা মেয়ে হয়ে বলছি,তুমি হয়তো জানো না কতো শত মেয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষকে ভুলতে না পেরেও পরিবারের কথা চিন্তা করে অন্য একজন মানুষের সাথে বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে। তারা কি একজনকে ভালোবাসা অবস্থায় অন্য কারো সাথে চিরদিনের জন্য নিজেকে জড়ায়নি?” আমি না হয় রিলেশনে জড়িয়েছি কিন্তু তুমি কি করেছো? তোমার থেকে বয়সে বড় একটা মহিলার সাথে অবৈধ সেক্সুয়াল সম্পর্কে জড়িত হয়েছো। তাহলে বলো তুমি আমাকে কতোটা ভালোবাসতে? যার জন্য এরকম একটা অবৈধ ফিজিক্যাল রিলেশন করতে পেরেছো?”

“আমি তোমাকে আমার ভালোবাসার প্রমাণ দিতে চাই না কিংবা বিশ্বাসও করাতে চাই না আমি নির্দোষ। যেখানে আমার বাবা মাকেই বিশ্বাস করাতে পারিনি সেখানে তোমাকে বিশ্বাস করিয়ে কি লাভ? এমন না তো যে তোমাকে বিশ্বাস করাতে পারলে সারা দুনিয়ার কাছে আমি আবার আগের মতো বিশুদ্ধ হয়ে যাবো।”

মিলি ফোনটা রেখে দেয়। কেনো এমন করলো জানি না। পরে যখন ফোন দিলাম তখন তাঁর ফোন বন্ধ পেলাম।

এখন প্রায় রাত একটা বাজে। ফুটপাতের মানুষগুলো ঘুমিয়ে গিয়েছে। জনমানবশূন্য স্থানে যেমনটা নীরবতা বিরাজ করে ঠিক সেরকমই নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে এখন। দুই একটা কুকুর মাঝে মাঝে ঘেউ ঘেউ শব্দ করে উঠছে। এছাড়া আর কোনো শব্দ আমার কানে আসছে না। আমার একটু ভয় হতে লাগলো। এতো রাতে একা কখনো এমন অবস্থায় পড়িনি,তাই ভয় হওয়টা অস্বাভাবিক কিছু না। হঠাৎ করেই দূরের একটা বেঞ্চিতে আমার চোখ আটকে গেলো। হলুদ শাড়ী পড়া একটা মেয়ে বসে বসে মোবাইল টিপছে। ভয়টা যেনো আরও তীব্রতর হতে লাগলো। এতো রাতে কোনো মেয়ে তো এখানে থাকার কথা না। তাহলে কি কোনো ভূত পেত্নী? পেত্নীরা কি হলুদ শাড়ী পড়ে? নাকি সাদা শাড়ী পড়ে? পেত্নী হলে নিশ্চয় হলুদ শাড়ি পড়তো না। আমি ভয়ে ভয়ে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলাম। পায়ের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম পা মাটির সাথে লাগানো। তাঁর মানে ভূত হওয়ার কোনো চান্স নেই। ভয়টা কিছুটা হলেও কেটে গেলো।

আমাকে দেখে মেয়েটা দূরে সরে বসল। একটা মেয়ে এতো রাতে একটা ছেলেকে দেখে যতোটা ভয় পাওয়ার কথা মেয়েটা তাঁর বিন্দু পরিমাণ ভয়ও আমাকে দেখে পেলো না। বরং খুব সাহস নিয়ে জিগ্যেস করলো?

“কিছু বলবেন?” এতো রাতে এখানে কি করছেন?”

আমি মেয়েটার এমন প্রশ্ন শুনে থমকে গেলাম। আমি তাঁর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললাম।

“আমি তো একটা ছেলে,তাই এতো রাতে একা ঘোরাটা খুব কমন বিষয়। কিন্তু আপনি একটা মেয়ে হয়ে এতো রাতে এখানে কি করছেন? তাও আবার গায়ে হলুদ শাড়ী।”

তখন মেয়েটা যা বলল তা শুনে কিছুক্ষণের জন্য বোবা হয়ে গেলাম। মেয়েটা বলল।

“আসলে আমি আমার বয়ফ্রেন্ডের জন্য অপেক্ষা করছি। ওর আসার কথা বারোটার সময়। কিন্তু এক ঘন্টা পাড় হয়ে গেলো এখনও আসলো না। তাই বাঁধ্য হয়ে বসে আছি। ও আসলেই ওর সাথে চলে যাবো।”

আমি তাঁর ব্যাপারে ক্লিয়ার হওয়ার জন্য বললাম।

“বিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছেন?”

তখন মেয়েটা কপাল কুচকে বলল।

“এটাও বলতে হবে? কাপড়চোপড় দেখে বুঝতে পারছেন না? বাবা মা জোর করে বিয়ে দিচ্ছিলো তাই যাকে ভালোবাসি তাঁর সাথে পালিয়ে যাওয়ার জন্য বিয়ের আসর থেকে চলে এসেছি।”

আমি জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম।

“ওহ! আপনার বয়ফ্রেন্ডকে ফোন করেন। দেখেন কোথায় আছে। তাহলেই তো হয়।”

তখন মেয়েটা আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল।

“ফোন খোলা থাকলে কি আর এভাবে বসে থাকতাম। সেই কখন থেকে ফোন দিচ্ছি ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। আমার কথা বাদ দিন। আপনি এতো রাতে এখানে কেনো? আপনারও কি আমার মতো সেম কেইস নাকি? গার্লফ্রেন্ডকে ভাগিয়ে নিয়ে যাবেন?”

আমি বললাম,

“না না,এমন কোন কিছু না।”

তখন মেয়েটা বলল।

“তাহলে কেমন কিছু? মানে কি জন্য এতো রাতে এখানে এভাবে তলপাতলপি নিয়ে ঘুরতেছেন?”

আমি যখন মেয়েটাকে কিছু বলতে যাবো। ঠিক তখনই কিছু মানুষ এসে আমাদের দুজনকে ঘিরে ফেলে। একজন পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের যুবক আমার কলার চেপে ধরে। মেয়েটাও প্রচন্ড ভয় পেতে লাগলো।

চলবে……………

#মেঘে_ঢাকা_আকাশ
#পর্ব-৪
#আমিনুর রহমান

আমি ছেলেটাকে ধাক্কা দিয়ে নিজেকে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে বললাম।

“আসলে আপনারা যা ভাবছেন তা না,আমি এই মেয়েটাকে চিনিও না। একটু আগেই তাঁর সাথে পরিচয় হয়েছে। আপনারা হয়তো ভেবেছেন আমি ওর বয়ফ্রেন্ড বাট এটা আপনাদের ভুল ধারণা। আমি ওর বয়ফ্রেন্ড না,বিশ্বাস না হলে মেয়েটাকে জিগ্যেস করেন।”

আমার কথা শুনে মনে হলো সবাই মঙ্গল গ্রহ থেকে পৃথিবী গ্রহে অবতরণ করলো। তাদের রিঅ্যাকশন দেখে বুঝা যাচ্ছে এই মেয়ের বয়ফ্রেন্ডের ওপর তাদের কতোটা রাগ জমা আছে। এজন্যই বুঝি কোনো কথাবার্তা না বলে এভাবে কলার চেপে ধরেছে। একজন তো বলেই ফেলল।

“এই সালা মিথ্যা কথা বলতেছে,নিজেকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যা বলতেছে। ওদের দুজনের এটা আগে থেকেই প্ল্যান ছিলো,ধরা পড়লে এসব বলবে। ও যদি স্পৃহার বয়ফ্রেন্ড নাই হবে তাহলে এতো রাতে ওর সাথে বসে গল্প করছে কেনো? ওর ব্যাগ দেখেই বোঝা যাচ্ছে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সবরকম প্রস্তুতি নিয়ে বের হয়েছে। কাজেই ওরে বিশ্বাস করা যাইবো না। পিঠে কিছু পড়লেই সব সত্য বলবে।”

তাহলে মেয়েটার নাম স্পৃহা। মেয়েটার সাথে কথা বললেও তাঁর নামটা জানা হয়নি। তবে আমি তাঁর নাম নিয়ে না ভেবে কিছু বলবো বলে ঠিক করলাম কিন্তু তার আগেই পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বছরের একজন বয়স্কো লোক বলে উঠলো।

“এতো কথা বলার দরকার নেই। বাসায় নিয়ে চল। ওর জন্য আমার মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেছে৷ ছেলে পক্ষের কাছে আমার মাথা হেড হয়ে গেছে। মেয়ে ভাগিয়ে নেওয়ার শাস্তি ওকে পেতে হবে।”

আমি আবারও বললাম।
“আপনাদের ভুল হচ্ছে। আমি সেই ছেলে নয়। আপনাদের মেয়েকে জিগ্যেস করুন। আমি না হয় বাঁচার জন্য মিথ্যা বলতে পারি,আপনাদের মেয়ে তো আর মিথ্যা বলবে না। তাই ওনাকে জিগ্যেস করুন। তাহলেই সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে,আপনাদের ভুলটাও ভেঙে যাবে।”

আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে ভয়ে কাঁপছে। একটা মেয়ে নিজের বাবাকে এতোটা ভয় পেতে পারে জানা ছিলো না আমার। ভয়ের চোটে এই মেয়েটার মুখ দিয়ে কোনো কথায় বের হচ্ছে না। আমি মেয়েটাকে অনেকবার বলার পরেও সে কোনো কথা বলল না। মেয়ের বাবাকেও অনেক বুঝালাম কিন্তু তারা আমার কথাগুলো বিশ্বাস করলো না। তাদের মেয়েকে ভাগিয়ে নিতে চেয়েছিলাম আমি,এটা মনে করেই তারা আমাকে তাদের সাথে নিয়ে গেলো। আমারও ক্ষমতা ছিলো না এতোগুলা লোকের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার। তাই বাঁধ্য হয়েই তাদের সাথে যেতে হলো। অবশ্য একদিক থেকে ভালোই হয়েছে আমার জন্য। এখন অন্তত থাকা খাওয়ার চিন্তাটা আর করতে হবে না। যেখানে যাচ্ছি সেখানে নিশ্চয় থাকা খাওয়ার কোনো সমস্যা হবে না? মেয়ের পরিবার দেখে অন্তত এটাই মনে হলো। তারা অনেক প্রভাবশালী এবং টাকা পয়সার কোনো কমতি নেই। তবে ওখানে যাওয়ার পর আমার কি অবস্থা হবে সেটা ভাবতেই ভিতরটাতে ভয় কাজ করছে। কারণ এই মানুষগুলোকে দেখে খুব হিংস্র মনে হচ্ছে।

একটা অন্ধকার রুমে আমাকে আটকে রাখা হয়েছে। জানালা দিয়ে একটু একটু করে আলো বাতাস আসছে। তবে সেটা অন্ধকারকে গ্রাস করতে পারছে না। কিছু সময় পর কেউ একজন এসে দরজটা খুলে আমাকে বাড়ির সবার সামনে নিয়ে গেলো। বুঝতে পারলাম এটা যৌথ ফ্যামিলি। মেয়ের বাবা মা,চাচা চাচাী,দাদা-দাদি সবাই আমার দিকে কেমন করে যেনো তাকিয়ে আছে। হয়তো তারা বিশ্বাস করতে পারছে না তাদের মেয়ে আমার মতো একজন ছেলের সাথে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলো৷ কিন্তু আসল সত্যটা তারা এখনো জানে না। আমার সামনে অনেকগুলো মানুষ দাঁড়ানো থাকলেও আমি স্পৃহা মেয়েটা বাদে কাউকে চিনতে পারছি না। আমার মনে হলো এবার হয়তো আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিবে। আমি যে মেয়েটার কিছু হই না সেটা সবাইকে বোঝাতে পারবো। কিন্তু এমন হলো না। স্পৃহার বাবা আমার দিকে না তাকিয়ে স্পৃহাকে প্রশ্ন করতে লাগলেন।

তিনি স্পৃহাকে বললেন।

“আমার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে না করে এই ছেলেটার সাথেই তুমি পালিয়ে যেতে চেয়েছিলে? তোমার পছন্দটা খুব বাজে। এই ছেলের মাঝে কি এমন আছে যাকে দেখে তুমি তাঁর সাথে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলে?”

তখন স্পৃহা বলল।

“না বাবা,ওকে আমি চিনি না। ওর সাথে আজকে রাতেই প্রথম দেখা হয়েছে আমার।”

তখন তাঁর বাবা বললেন।

“তুমি ছেলেটাকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যা বলছো তাই তো? যদি সত্য বলো তাহলে এই ছেলেটাকে মেরে হাত পা ভেঙে দিবে সে জন্য ভয় পাচ্ছো?”

“না বাবা,আমি সত্যি বলছি।”

তখন তাঁর বাবা বললেন।

“তোমার কথা বিশ্বাস করবো না এবং তুমি যা ভাবছো সেটাও করবো না। এই ছেলেটাকে কেউ ধরবে না,ছুবে না। এই ছেলের সাথেই তোমার বিয়ে হবে। না হলে আমার পছন্দ করা ছেলেকেই তোমার বিয়ে করতে হবে। তুমি সিদ্ধান্ত নাও কি করবে। প্রতিষ্ঠিত একজন ছেলেকে বিয়ে করে আরাম আয়েশে বেঁচে থাকবে নাকি এরকম একটা চালচুলোহীন ছেলেকে বিয়ে করে অভাব অনটনে দিন কাটাবে?”

আমি আর কিছু বুঝতে না পারলেও এটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারলাম এরা কেউ আমাকে নিজ থেকে কিছু জিগ্যেস করবে না। যা বলার আমাকেই বলতে হবে। আমি তাদের বাপ মেয়ের কথার মধ্যে নিজেকে ঢুকিয়ে বললাম।

“আপনাদের সমস্যা কি? নিজেরাই যা ইচ্ছে বলে যাচ্ছেন। আমার কথা শোনার কোনো প্রয়োজনই মনে করছেন না। আর এই যে ম্যাডাম আপনি এভাবে ভয়ে ভয়ে কথা বলছেন কেনো? আর এই যে আপনি কি বাংলা বোঝেন না? আপনার মেয়ে এতো করে বলার পরেও কেনো বিশ্বাস করছেন না যে আমি তাঁর বয়ফ্রেন্ড না। আর তাছাড়া আপনি বললেই তো আর আপনার মেয়েকে আমি বিয়ে করবো না। যাকে চিনি না,জানি না তাকে বিয়ে করার কোনো প্রশ্নই আসে না। তাই এসব নাটক না করে আমাকে যেতে দিন।”

তখন তিনি তিরস্কারের সুরে বললেন।

“তোর রাজী হওয়াতে কিছু যায় আসে না। আমার মেয়ে রাজী হলেই হবে। তাকে বেছে নিতে হবে সে কাকে বিয়ে করবে। আমার পছন্দ করা ছেলেকে নাকি তোকে।”

আমার কথার কোনো গুরুত্বই দিলো না কেউ। সবশেষে মেয়েটা বিয়ে করার জন্য আমাকেই বেছে নিলো৷ আমাকে বেছে নেওয়ার কারণটাও আমার মস্তিষ্কটা আঁচ করতে পারলো না। এখন শুধু একটা কথায় মনে পড়ছে। বিপদ যখন আসে চারদিক থেকেই আসে৷ আমি চাইলেও এতো এতো মানুষকে ফাঁকি দিয়ে এখান থেকে পালাতে পারবো না। পরের দিন বাঁধ্য হয়েই বিয়েটা করতে হলো আমাকে। আমি কখনো ভাবিনি আমার বিয়েটা এভাবে হবে৷ যে মেয়েটার সম্পর্কে আমি কিছুই জানলাম না তাঁর সাথেই আজ বিয়ে হলো আমার। এটাই বুঝি নিয়তির খেলা। আল্লাহ যা চাইবে সেটার ওপরে আমাদের মানুষের কোনো হাত নেই। ভাগ্যের ওপর কারো হাত নেই সেটার প্রমাণ আমি নিজে।

বিয়ে করার সময় কবুল কথাটা মুখ দিয়ে বের হচ্ছিলো না। কবুল বলার সময় নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ মনে হলো। যার পাশে কেউ নাই,একজন মানুষও নাই যাকে আপন ভাবতে পারি। যার সাথে বিয়ে হচ্ছে সেও তো আপন না। বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর সবাই চলে গেলো। আমাকে আর মেয়েটাকে একটা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। বুঝলাম এটা আমাদের বাসর ঘর। চারদিকে কাচা রজনীগন্ধার সমাহার। বিছানার প্রতিটি কোণায় কোণায় গোলাপের সুভাষ। কিছুক্ষণ পর এই বিছানাটাতে আমাকে ঘুমাতে হবে তাও আবার একটা মেয়ের সাথে। এটা যেনো বিশ্বাসই হচ্ছিলো না। মনে হচ্ছিলো কোনো স্বপ্ন দেখছি৷ কিন্তু না এটা কোনো স্বপ্ন না,বাস্তবেই আমার সাথে এটা হচ্ছে। নিজের বাসরটা এমন হবে কখনো ভাবিনি। মেয়েটা দরজা লাগিয়ে দিয়েই আমার পাশে এসে বসলো আর বলল।

“আসলে সরি,এমনটা হবে বা কখনো হতে পারে ভাবিনি৷ আমার দোষ কি বলেন? দোষটা তো আপনারাই,আপনিই নিজ থেকে আমার সাথে কথা বলতে এসেছিলেন। আপনি যদি কথা বলতে না আসতেন তাহলে আপনার সাথে আমি কথা বলতাম না,গল্পও করতাম না। আর আপনাকেও এমন অবস্থায় পড়তে হতো না। যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে তাঁর থেকে আপনিই বেটার,লোকটা অনেক বয়স্কো। তাই আপনাকেই বেছে নিয়েছি।”

আমি মেয়েটার কথা শুনে চারশত বিশ ভোল্টের একটা সকড্ খেলাম। এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরেও মেয়েটা কতো সহজে সরি বলে দিলো। আমার সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছে এজন্য তাঁর মন খারাপের কোনো চিহ্নই দেখতে পেলাম না তাঁর চোখেমুখে। তাহলে এই মেয়ে কি স্বাভাবিক না? কোনো সমস্যা আছে? স্বাভাবিক হলে তো এমন একটা বিয়েতে তাঁর খারাপ লাগার কথা কিন্তু তাঁর তো লাগছে না।

আমি কিছু বলবো তাঁর আগেই মেয়েটা বলল।

“আমার মনে হয় আবিরের বড় কোনো সমস্যা হয়েছে৷ না হলে এমনটা তো করার কথা না। আবির আমাকে ওর নিজের থেকেও বেশি চায়। ওর না আসার পেছনে কোনো কারণ আছে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজকে আবার পালাবো আমি। আপনাকে বিয়ে করার এটাও একটা কারণ। আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন যেটা ওই লোকটা করতো না। সবাই ভেবেছে বিয়ে যেহেতু হয়ে গিয়েছে তাই আর আমাকে নিয়ে কোনো ভয় নেই। এই সুযোগটাই আমি কাজে লাগাতে চাই।”

আমি তাঁর কথা শুনে বললাম।

“পাগল নাকি আপনি? পালাবেন মানে? যদি পালাবেনই তাহলে বিয়ে করলেন কেনো? আবার আমাকে বিপদে ফেলতে চাইছেন? আপনি চলে গেলো তো মনে হয় আমাকে আর বাঁচিয়ে রাখবে না।”

তখন মেয়েটা চাপা হাসি হেসে বলল।

“হ্যাঁ ঠিক বলেছেন আমার বাবা খুব রাগী মানুষ। বাসর ঘরে নিজের বউকে ধরে রাখতে পারেননি,পালিয়ে গেছে এটা শুনলে নিশ্চিত আপনাকে মেরে ফেলবে।”

অনেক সময় পর মেয়েটা বলল।

“আপনার ব্যাগ কোথায়? আমি তো আগেই সবকিছু গুছিয়ে রেখেছি। আপনি তাড়াতাড়ি আপনার ব্যাগ রেডি করুন। এখনই আমাদের কে পালাতে হবে। এখন বাসার সবাই ঘুমিয়ে গেছে।”

আমি তাঁর কথা শুনে কিছু বলতে পারলাম না তাঁর দিকে হা করে তাকিয়ে রইলাম। আমার এভাবে তাকানো দেখে সে বলল।

“হা করে তাকিয়ে আছেন কেনো? বাসর করবেন নাকি? বিছানায় কোলবালিশ আছে ওটার সাথে বাসর করুন। শখ কতো! আমার সাথে বাসর করবে। যদি মরতে না চান তাহলে আমার সাথে আসুন। আর যদি বাঁচার ইচ্ছা না থাকে তাহলে কোল বালিশের সাথে বাসর করেন।”

চলবে………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here