মেঘসন্ধি,পর্ব-০১
লেখনীতে:সারা মেহেক
“আয়ান ভাইয়া, আমি আপনাকে ভালোবাসি।” খানিকটা লজ্জা এবং সংকোচ নিয়ে বললো মৌ।
আয়ান এ প্রপোজালটা বেশ সহজ এবং স্বাভাবিকভাবেই নিলো৷ মৌ এর চেহারার লাজুক ভাব দেখে আয়ান এবার শব্দ করে হেসে উঠে বললো,
” এতো লজ্জা পাচ্ছিস কেনো? তোর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে সত্যিকারের প্রপোজ করছিস তুই।” এই বলে আয়ান আবারো হেসে দিলো। তৎক্ষনাৎ মৌ এর মনে পরলো যে, এটা শুধুমাত্র ডেয়ার ছিলো। ফলে তার ঠোঁটের কোনে বিদ্যমান সেই মিষ্টি হাসিটা মূহুর্তেই উবে গেলো। সে জানে, এটা ডেয়ার ছিলো। তবে এটাও সত্য যে, ডেয়ারটা সে মন থেকে করেছে। অর্থাৎ ডেয়ারের জন্য বলা প্রতিটা কথা সে মনের গভীর থেকে বলেছে। কারণ, সে আয়ানকে ভালোবাসে। অনেক আগে থেকেই তার মনে আয়ানের জন্য এ ভালোবাসা তৈরী হয়েছে। কিন্তু একপ্রকার জড়তা থাকায় সে কখনোই নিজ হতে স্বাভাবিকভাবে আয়ানকে এসব বলতে পারেনি৷ সে জানে না আয়ানের মনে তার জন্য আদৌ কোনো অনুভূতি আছে কি না৷ তবে সে জানে, আয়ানের জন্য তার হৃদয়ের অন্তস্থলে গভীর ভালোবাসা আছে।
আজ সন্ধ্যায় জান্নাত এই ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলার আয়োজন করে। সে ইচ্ছাকৃতভাবেই এ খেলার আয়োজন করে। কারণ সে জানে, মৌ আয়ানকে ভালোবাসে এবং সে এটাও জানে, খানিকটা ভয় এবং লজ্জার জন্য মৌ আয়ানকে তার মনের কথা বলবে না। এজন্যই এ উপায় বের করেছে সে।
মৌ’দের বাসার ছাদে মাহতাব, জান্নাত, অহনা, আয়ান এবং মৌ একসাথে ট্রুথ এণ্ড ডেয়ার খেলায় অংশ নেয়। খেলার এক পর্যায়ে মাহতাবের এক কলিগ ফোন করে, কিছু অফিশিয়াল কাগজ নেওয়ার জন্য। সেই কাগজপত্র দেওয়ার জন্যই মাহতাব বাসার নিচে চলে যায়৷ এ সুযোগে জান্নাত বেশ কৌশলে মৌ কে ডেয়ার নেওয়ার কথা বলে। মৌ-ও তেমন কিছু চিন্তাভাবনা না করে ডেয়ার নিয়ে নেয়৷
পরে, জান্নাত আয়ানকে প্রপোজ করার ডেয়ার দিলে মৌ প্রথমেই তাতে আপত্তি জানায়। তবে অহনা এবং জান্নাতের জোরাজুরিতে শেষমেশ সে ডেয়ারটা করতে বাধ্য হয়। এদিকে, আয়ান এ সম্পূর্ণ বিষয়টাকে বেশ সহজ স্বাভাবিকভাবেই নেয়। কারণ, ডেয়ার হিসেবে এসব প্রপোজাল দেওয়া নেওয়ার বিষয়ে সে অভস্ত্য। এজন্য সে মৌ এর করা প্রপোজাল স্বাভাবিকভাবে নিলো। তবে মৌ এর চোখেমুখে সেই লাজুক ভাবটা দেখে খানিকক্ষণ পর সে জিজ্ঞাস করলো,
” মৌ? তুই এতো লজ্জা পাচ্ছিলি কেনো বল তো?”
আয়ানের প্রশ্ন শুনে মৌ চুপসে গেলো। আমতাআমতা করে বললো,
” এমনিই আয়ান ভাইয়া।”
” এমনিই আবার লজ্জা পায়……” আয়ানকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অহনা বললো,
” উফ, ভাইয়া….তুমিও না…..এটুকু কি বুঝো না যে ও মেয়ে? একজন মেয়ের পক্ষে প্রপোজ করা এমনিই একটু ডিফিকাল্ট। কারণ, মেয়েরা লাজুক স্বভাবের হয়। সেখানে দুই দুইটা মানুষের সামনে ও প্রপোজ করেছে। তো লজ্জা পাওয়া তো স্বাভাবিক ব্যাপার তাই না?”
” বাট ইটস এ ডেয়ার। নট ইন রিয়েলিটি। ”
” আহহা, ভাইয়া। হোক ডেয়ার বা হোক রিয়েলিটি। প্রপোজ করা বহুত ডিফিকাল্ট ব্যাপার, এটাই মেনে নাও।”
অহনার কথাবার্তা শুনে আয়ান সন্দেহের সুরে জিজ্ঞাস করলো,
” তুই কিভাবে জানিস যে, প্রপোজ করাটা খুব ডিফিকাল্ট? হুম?”
অহনা এবার রাগান্বিত স্বরে বললো,
” তুমি এমন কেনো ভাইয়া? শুধু সন্দেহ, সন্দেহ আর সন্দেহ করা আমার উপর। এ ছাড়া আর কাজ নেই তোমার।”
আয়ান, অহনার মাথায় একটা গাট্টা মেরে বললো,
” অফিসের কাজগুলো তো তুই করে দিস, তাইনা?”
অহনা প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে যাবে, এর আগেই জান্নাত তাকে থামিয়ে বললো,
” এসব ঝগড়া বাদ দাও। আয়ান, তুমি মাহতাবকে ফোন করে বলো দোকান থেকে চিপস, চকলেট কিনে আনতে। কতদিন পর সবাই একসাথে বসে আড্ডা দিচ্ছি। একটু খাওয়াদাওয়া না হলে চলে নাকি!”
আয়ান হেসে বললো,
” তা ঠিক বলেছো ভাবী। আমি এখনই মাহতাবকে ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি।” এই বলে আয়ান পকেট থেকে ফোন বের করে ছাদের এক কোনায় চলে গেলো।
আয়ান চলে যেতেই জান্নাত আর অহনা মিলে মৌ কে ঘিরে ধরলো। অহনা মৌ’র বাহুতে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
” শেষমেশ আমার ভাইকে প্রপোজটা করেই ফেললি। উফ….এখন শুধু অপেক্ষা সেই দিনটার যেদিন তুই আমার ভাবী হয়ে বাড়িতে প্রবেশ করবি। আহা…..” অহনার কণ্ঠে প্রকাশ পেলো দারুণ উচ্ছ্বাস। খুশিতে গদগদ হয়ে সে মৌ’কে জড়িয়ে ধরলো।
মৌ এর চোখেমুখে এ মূহুর্তে প্রকাশ পাচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু পাওয়ার পর আনন্দের ঝলক। সে জানে, আজ জান্নাত এমন ডেয়ার না দিলে সে কখনোই সাহস করে আয়ানকে এসব বলতে পারতো না। অবশ্য, আজকে আয়ানকে নিজের অনুভূতির কথা জানাতে পেরে সে কিছুটা হলেও সাহস অর্জন করেছে। এজন্য মনে মনে সে বেশ খুশি হয়েছে। মৌ’র চোখেমুখে এ হাসিখুশি ভাব দেখে জান্নাত মলিন মুখে বললো,
” এতো খুশি হচ্ছো কেনো মৌ? তুমি আয়ানকে বলেছো যে, তুমি তাকে ভালোবাসো। কিন্তু সে তো তোমাকে কিছু বলেনি। আবার তুমি যে ওকে ভালোবাসার কথা বলেছো, সেটা কেমন পরিস্থিতিতে বলেছো তা কি একবার ভেবে দেখেছো? আয়ান তো এখনও ভাবছে যে, তুমি শুধুমাত্র তোমার ডেয়ারটা সম্পূর্ণ করেছো।
তুমি শুধু নিজের মনের কথাটা ওর সামনে প্রকাশ করে একটু হালকা হয়েছো। ব্যস……”
জান্নাতের যুক্তিপূর্ণ কথাবার্তা শুনে মৌ এবং অহনার ঠোঁট থেকে হাসি উবে গেলো। মূহুর্তেই তাদের চোখেমুখে থমথমে এক ভাব দেখা গেলো। অহনা নিচু গলায় বললো,
” জান্নাত ভাবী ঠিক বলেছে মৌ। ভাইয়া তো এখনো ভাবছে যে, তুই তাকে প্রপোজ করে ডেয়ারটা কমপ্লিট করেছিস যাস্ট। তুই সরাসরি সত্যটা না বলা পর্যন্ত কোনো সলিউশনে আসা যাচ্ছে না।”
মৌ এবার চিন্তিত স্বরে বললো,
” তা অবশ্য ঠিক বলেছিস। কিন্তু আয়ান ভাইয়াকে সরাসরি মনের কথা বলার মত সাহস আর নেই আমার।”
অহনা বললো,
” তাহলে ভাইয়াকে ভুলে যা তুই। ”
মৌ এর চোখেমুখে এবার নেমে এলো বিষাদের ছায়া। সে মুখ কালো করে বলল,
” এ আমার দ্বারা সম্ভব না।”
অহনা হালকা ঝাঁঝালো গলায় বললো,
” এটাও তোর দ্বারা সম্ভব না। আবার ভাইয়াকে প্রপোজ করাও তোর পক্ষে সম্ভব না। তাহলে তোর দ্বারা সম্ভব কি বল তো?”
মৌ কোনো প্রকারের জবাব না দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। জান্নাত ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে মৌ কে বললো,
” দেখো মৌ….. তুমি যদি সিরিয়াসলি আয়ানকে তোমার মনের কথা বলো তাহলে আয়ানের মনের কথাটাও তুমি জানতে পারবে। ”
জান্নাতকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে অহনা দৃঢ়চিত্তে বলে উঠলো,
” তুই এতোদিন ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করেছিস। অর্থাৎ ভাইয়া আদৌ তোকে পছন্দ করে কি না সেটা জানতে চেয়েছিস, শুনতে চেয়েছিস। কিন্তু আলটিমেটলি তুই কিছুই জানতে পারিসনি।
এখন, ভাইয়ার মনের ভেতরকার খবর জানার জন্য তোর মনের কথা ওর সামনে তুলে ধরতে হবে। এতে ভাইয়াও তার মনের অবস্থা তোকে বলে দিবে। এ কাজটা করলে আমরা এটলিস্ট একটা কনক্লুশনে পৌঁছাতে পারবো। না হলে তুই আর কতদিন ভাইয়াকে এভাবে মনে মনে পছন্দ করে যাবি? ”
এই বলে অহনা থেমে মৌ এর দিকে তাকালো। মৌ তখন কিছু ভাবতে ব্যস্ত। অহনা আবারো বললো,
” ভাইয়াও যদি তোকে পছন্দ করে তাহলে তো দুই বাড়ির সবাইকে এ ব্যাপারে বলে বিয়ের আয়োজন করা যেতে পারে। কিন্তু বাই এনি চান্স….ভাইয়ার জবাব না হলো। তখন কি হবে?”
অহনার এ প্রশ্নে মৌ এর মুখটা মলিন হয়ে এলো। সে মিনমিন করে বললো,
” এ ব্যাপারে কিছু ভেবে দেখিনি আমি। ”
অহনা খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললো,
” আহহা…. এতোদিন ভাবিস নি। কিন্তু এখন ভাবতে হবে। ভাইয়ার জবাব না হলে তুই নিজের পথে চলে যাবি। পিছনে ফিরেও তাকাবি না। আমি চাই না তুই এসব নিয়ে সারাজীবন পরে থাক। তুই অবশ্যই একটা বেটার ফিউচার ডিজার্ভ করিস। বুঝতে পারছিস আমার কথা?”
মৌ হালকা মাথা নাড়িয়ে বললো,
” হুম।”
” তাহলে ২/১ দিনের মধ্যেই এসব ব্যাপারে ক্লিয়ার হবি। ওকে?”
মৌ নিচু স্বরে বললো,
” ওকে।”
অহনা এবার জোর গলায় বললো,
” এভাবে ওকে বললে হবে না। সাহস সঞ্চয় কর। বুঝছিস?”
মৌ হালকা হেসে কিছুটা জোর গলায় বললো,
” ওকে।”
মৌ এর কথা শুনে জান্নাত আর অহনা মৃদু হাসি দিলো। ততক্ষণে আয়ান কথা বলা শেষে আবারো তাদের আড্ডায় যোগ দিয়েছে। এতক্ষণ পর আয়ানকে আসতে দেখে জান্নাত জিজ্ঞাস করলো,
” কি ব্যাপার আয়ান? এতক্ষণ কার সাথে কথা বলছিলে?”
আয়ান হালকা হেসে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে বললো,
” মাহতাবের সাথে কথা বলা শেষ হতেই অফিসের এক কলিগ ফোন দেয়। তার সাথেই কথা হচ্ছিলো এতক্ষণ। ”
জান্নাত প্রত্যুত্তরে আর কিছু বললো না। হঠাৎ মাঝারি ধরণের বজ্রপাতের শব্দে ছাদে উপস্থিত চারজন মানুষ অল্পবিস্তর কেঁপে উঠলো। আয়ান মৃদু হেসে বললো,
” বৃষ্টি হবে হয়তো। অনেকক্ষণ ধরেই বজ্রপাতের আওয়াজ শুনছি। আগেরগুলো আস্তে হলেও এবারেরটা একটু জোরেই হলো।”
আয়ানের কথা শেষ হতেই আবারো বজ্রপাতের আওয়াজ শুনতে পেলো সবাই। জান্নাত এবার খানিকটা ভীত হয়ে বললো,
” আমার মনে হয় আমাদের নিচে চলে যাওয়া উচিত। আজকালকার তো বজ্রপাত বেশ ভয়ংকর। ”
আয়ান জান্নাতের সাথে তাল মিলিয়ে বললো,
” এটাই ঠিক। চলো সবাই উঠি।”
এই বলে আয়ান, জান্নাত এবং অহনা উঠে পরলো। কিন্তু মৌ নিজের জায়গায় স্থির বসে রইলো। জান্নাত জিজ্ঞাস করলো,
” কি ব্যাপার মৌ? বসে আছো কেনো? বাসায় যাবে না?”
মৌ মিষ্টি হেসে বললো,
” না ভাবী। আজকে বৃষ্টিতে ভিজবো আমি। অনেকদিন যাবত বৃষ্টিতে ভেজা হয়না।”
আয়ান এবার একটা ধমক দিতে উদ্যত হতেই হুট করে ঝমাঝম বৃষ্টি নামতে শুরু করলো। বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ার ভয়ে তারা তিনজনে মৌ কে না নিয়েই দৌড়ে ছাদ থেকে বেরিয়ে গেলো। এদিকে মৌ দু চোখ বুজে আকাশের পানে মুখ দিয়ে বৃষ্টির টপটপ ফোঁটাগুলো নিজের মধ্যে সমাহিত করছে। বৃষ্টির ঠাণ্ডা ছোঁয়ায় থেকে থেকে কেঁপে উঠছে সে। ওদিকে বজ্রপাতের কান ফাটানো আওয়াজে হৃদয়ে হালকা ভয়ের স্রোত জেগে উঠছে। তবে এসবই তার বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছাকে প্রতিহত করতে পারেনি। সে তো এখন মনের আনন্দে বৃষ্টিতে ভিজছে।
কিছুক্ষণ যেতেই সে পা দুটো একত্র করে হাত দুটো প্রসারিত করে ছাদে শুয়ে পরলো। এভাবে বৃষ্টিবিলাস করতে বেশ ভালো লাগছে তার। অন্য রকম এক ধরণের আনন্দ অনুভব হচ্ছে।
হঠাৎ মৌ খেয়াল করলো, তার চোখেমুখে বৃষ্টির ফোঁটা পরছে না। অথচ শরীরের নিচের অংশ দিব্যি বৃষ্টিতে ভিজছে। এমনটা হওয়ার কারণ বুঝতে না পেরে সে চোখ খুললো। সাথে সাথে নিজের মাথার উপর একটা ছাতা দেখলো সে। এতে সে চমকে উঠে শোয়া থেকে বসে পরে। মনে প্রশ্ন নিয়ে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে আয়ান রাগান্বিত চাহনি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এতে মৌ মোটেও ভয় পেলো না। উল্টো রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভালোলাগার এক উষ্ণ ছোঁয়া অনুভব করলো সে।
চলবে?