মিঠে আলোয়,পর্ব_৫
ফায়জা_করিম
“আমি যদি অনন্যকে বিয়ে করতে রাজি হই তাহলে কী তুমি আমাকে একবার অভ্রর সাথে দেখা করতে দিবে বাবা?”
রেজওয়ান সাহেব ফোনের অপর প্রান্ত থেকে সহসাই কোন জবাব দিতে পারলেন না। মিঠাই এতো সহজে অনন্যকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাবে তিনি ভাবেননি। কিন্তু মিঠাই কী সত্যি অনন্যকে বিয়ে করতে রাজি হলো?
“মিঠাই তুমি চাইলে অভ্রর সাথে এমনি দেখা করতে পারো, তার জন্য অনন্যকে বিয়ে করার মতো কোন শর্ত আরোপ করার পক্ষে আমি নই।”
মিঠাই বাবার কথায় অবাক না হয়ে পারল না। কী শুনছে এসব ও? বাবা যা বললো তা কী সত্যি হতে পারে! একেবারে কোন শর্ত ছাড়াই ওর বিজনেস ম্যান বাবা অভ্রর হাতে ওকে তুলে দিতে পারে?
“আমি অভ্রর সাথে দেখা করতে চাই বাবা.. প্লিজ। আমার, আমার অনেক কিছু বলার আছে ওকে.. আমি…।”
“মিঠাই আমি তোমাকে অভ্রর সাথে দেখা করার অনুমতি দিব কিন্তু তার আগে তোমাকে একটা কথা দিতে হবে আমার কাছে।”
“কী কথা বাবা? ”
“অভ্রর সাথে মিট করার পর তুমি কোন ধরনের পাগলামি করতে পারবেনা। তোমার সব ধরনের সমস্যা আমার কাছে খুলে বলতে হবে।”
“পাগলামি বলতে?”
“পাগলামি মানে এমন কিছু যা তোমার ভবিষ্যতকে নষ্ট করে দিতে পারে… ”
“বাবা আমি কী কখনো এমন৷ কিছু করেছি যা তোমার সম্মানকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারে? এট লিস্ট বাইরের মানুষের সামনে?”
“না… কিন্তু আমি স্বীকার করি বা না করি তুমি অভ্রর প্রতি সফট আর এই অতি দুর্বলতা মানুষের স্বাভাবিক বোধবুদ্ধিকে পঙ্গু করে দেয় অনেক সময়। তবে আমি আশা করি আমার মেয়ে হয়ে তুমি এ ধরনের কোন বোকামি করবে না।”
থ্যাঙ্কস বাবা।
তুমি তাহলে কবে আসতে চাইছ?
সামনের মাসের মাঝামাঝি
ওকে আসো আর নিজের যত্ন রেখো।
হমম.. বাই বাবা
বাই মাই সুইট লেডি।
রেজওয়ান সাহেব ফোন নামিয়ে রেখে একটা জরুরি ফোন করলেন সৈয়দপুরে তার কোম্পানির ব্রাঞ্চ অফিসে । ওখানকার ইনচার্জ বদরুল হায়াদারকে কিছু বিশেষ কথা বলার আছে তার।
🍭🍭🍭🍭🍭🍭🍭🍭🍭🍭🍭🍭
আলিশান গাড়িটা যখন একটা সরু গলির মাথায় এসে থামল বিকেলটা তখন মরে গিয়েছে। মিঠাই খুব অস্বস্তি নিয়ে গাড়ি থেকে নামল। বুকটা ধুকপুক করছে.. মনে হচ্ছে বক্ষ পিঞ্জর ভেদ করে ওর কোমল হৃদয়টা মুচমুচ করে ভেঙ্গে পড়বে। কতো বছর পর ও মুখোমুখি হবে অভ্রর… সেই চৌদ্দ পনেরর ঝাপসা চোখ দুটোয় নিজেকে চিনে নিতে পারবে তো মিঠাই?
প্লিজ মিঠাই প্লিজ.. নিজেকে সামলে রাখ… নিজের মনটাকে শক্ত হাতে টেনে ধরল মিঠাই। আগেই রূপকথার পঙ্খীরাজ উড়ানো ঠিক না, একটু রয়ে সয়ে স্বপ্ন দেখ।
মিঠাই আমার মনে হচ্ছে আমার এখানেই থেমে যাওয়া উচিত।
অনন্যর কথায় মনে মনে খুশি হলো মিঠাই। ঠিক বাবার অনুরোধে নয়, খানিকটা বন্ধুত্বের জের ধরেই অনন্যকে সাথে নিয়ে এসেছে মিঠাই, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বাকিটা পথ মিঠাইর একাই ফেস করা উচিত। সব গলিপথ সবার গন্তব্যস্থল নয়।
হমম.. আমি বরং তোমাকে রাতে ফোন দিব, আশাকরি তোমার.. উপপস তোমাদের হ্যাপি হ্যাপি আফটার উই কলিডেডের কাহিনী শুনতে পারবো।
অন্য সময় হলে হয়তো অনন্যর এই কথায় মিঠাই হেসে ফেলত। অ্যানা টুডের এই সিকুয়েলটার প্রতি ওর প্রচন্ড দুর্বলতা আছে কিন্তু এখন… এই মুহুর্তে অনন্যর দুষ্টুমি ওকে স্বাভাবিক করতে পারল না, বরং আরো বেশি নার্ভাস করে দিল।
মাই ব্রেভ গার্ল.. তুমি এখন ফাইট করতে যাচ্ছ না.. এতো ঘাবড়ানোর কিছু নেই।
অনন্য মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই মিঠাইর আত্মবিশ্বাসটা আবার ফিরে আসল। ঠিকিই তো .. ও তো ওর অভ্রর সাথে দেখা করতে যাচ্ছে আর অভ্র ওর সবচেয়ে ভালো বন্ধু, ওর ভালোবাসা।
🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂
অন্তরাকে দেখে মিঠাই পুরো তাজ্জব হয়ে গেল। অন্তরা, অভ্রর ছোট বোন। ছোট থাকতে ওদের সাথে সাথে ঘুরত.. একদম লিকলিকে স্বাস্থ্যের আর এখন কী রাশভারী তার চেহারা। অন্তরার চোখের চশমাটা বলে দিচ্ছে সে ওর সাথে কথা বলতে ততোটা আগ্রহী নয়, যেন মেডিকেলের থার্ড ইয়ারের ছাত্রীর কাছে কোন কালের চেনা মিঠাই তেমন কোন ছাপ ফেলতে পারে না।
তোমার আব্বা ফোন দেয়ার পর তোমার চাচিতো খুশিতে পাগল হয়ে গেল,বলতেছে মিঠাই মামনি এখনো আমাদের মনে রাখসে এটাই তো আমরা ভাবি নাই।
আমার আপনাদের সবাইকে মনে আছে।
হ্যাঁ.. হ্যাঁ.. তাতো বটেই মা।
আঙ্কেল অভ্র..
অভ্র আসতেছে.. এই সামনের মোড়ের দোকানেই গেছে।
জি… মিঠাইের মনে হলো সময় এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে.. ঘড়ির কাঁটাগুলো আসলে চলছে না। সময়হীনতার জগতে চলে আসেনি তো ও.. ওই যে অনন্য সারাক্ষন ছাইপাশ কী সব বলতে থাকে ওর কানের কাছে।
ভাল আছে মিঠাই?
ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সতর্ক করার আগেই হাত থেকে পার্সটা খসে পড়ল মিঠাইর। অভ্র.. কতোদিন পর দেখল ও অভ্রকে.. একদম চেনাই যাচ্ছে না। শুধু হাসিটা দেখে মনে হচ্ছে ও অভ্র।
হ্যাঁ.তুত.. তুমি ভাল আছ?
এইতো.. কিন্তু তুমি হঠাত এতোদিন পরে কোথা থেকে আমাদের ঠিকানা খুঁজে পেলে? ”
অভ্রর হাতে কাগজে মোড়ান একটা ব্যাগ আর এক প্যাকেট মিষ্টি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কাগজের প্যাকেটে ফল জাতীয় কিছু আছে। খাবারগুলো সম্ভবত মিঠাইর জন্যই নিয়ে এসেছে অভ্র।
“পেলাম খুঁজতে খুঁজতে, ” মিঠাইর চোখ দুটো তখন হন্য হয়ে সেই চোখ দুটোকে খুঁজছে… আসলে মায়া খুঁজছে। এক সময় ওখানে অনেক অনুভূতি পুঞ্জীভূত হয়ে থাকত ওর জন্য।
“তা এখন কোথায় কী করছ? তোমার তো শুনলাম এম এস কমপ্লিট প্রায়, এরপর কোথায় জব করবে? দেশে নিশ্চই ফিরছো না।”
মিঠাইর কাছে এসব প্রশ্ন এখন অতিরঞ্জিত লাগছে…এসব প্রশ্ন কী এখনই করা জরুরি? এখন কী অভ্রর ওকে এটা জিজ্ঞেস করা উচিত না মিঠাই এতোদিন ওকে ছেড়ে কেমন ছিল? ওর কী বলা উচিত না… মিঠাইকে ও চায় কিনা… মিঠাইর জন্মদিনগুলো ওর মনে আছে কিনা?
কিন্তু অভ্র এসবের কিছুই ঠিক করে জানতে চাইল না.. সব কেমন খাপছাড়া। যেন তুমি এসেছ এতোদিন পরে.. আমাদের ঘরে বসো, খাও তারপর সবার সাথে গল্প করে বিদায় হও। মিঠাইর দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল অভ্রর ব্যবহারে।
মনিরুল চাচী একগাদা খাবার জিনিস আনলেন ট্রে ভরে। অন্তরাকেও টেনে আনলেন জোর করে মিঠাইর সাথে গল্প করার জন্য, কিন্তু মেয়েটা যেন মিঠইকে ঠিক দেখতেই পারছিলনা.. দ্রুত খেয়ে দেয়ে ওখান থেকে সরে গেল। মিঠাই ওকে কোন প্রশ্ন করারও সময় পেল না।
এতো আদর আপ্যায়ন কিন্তু সবটাই কেমন অস্বস্তিকর লাগলো মিঠাইর কাছে। কিন্তু এমনটা তো ও চায়নি.. মন শুধু খারাপই হলো ওর এখানে এসে। কিন্তু অভ্রর পরিবারের কেউ আসলে কোন খারাপ ব্যবহার করেনি ওর সাথে। অন্তরার আচরনও ওর কাছে কোন ম্যাটার করে না.. কিন্তু অভ্রর আচরনে ও সেই পুরোনো অভ্রকে খুঁজে পাচ্ছে না… এটা মিঠাইকে খুব যন্ত্রনা দিতে লাগল।
অভ্র কেবলই দেশের কথা, দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা, রাজনীতি… এসব নিয়ে আলোচনা করছে.. এসবের কিছুই মিঠাইর মনোযোগ কাড়তে পারছেনা।
চলবে……