মায়াবিনী মানবী,পর্ব_১৪,১৫
হুমাশা_এহতেশাম
পর্ব_১৪
একটি শোক সংবাদ! একটি শোক সংবাদ! একটি শোক সংবাদ! মধ্য পাড়া নিবাসী,মধ্য পাড়া নিবাসী। জনাব ওলিদূন আজাদ সাহেব এর কনিষ্ঠ কন্যা জুইঁ আজাদ কালরাত ১ ঘটিকায় ইন্তেকাল করিয়াছেন।ইন্না-লিল্লাহ ওয়া ইন্না-ইলাইহি রজিউন।মরহুমার জানাজা আজ বাদ জুমাআ অনুষ্ঠিত হবে। উক্ত জানাজায় আপনারা সকলে আমন্ত্রিত।
মসজিদের মাইকিং জুইঁর মায়ের কর্ণপাত হতে ই দ্বিতীয় বারের মতো তিনি মূর্ছা গেলেন।কয়েকজন মহিলা এসে ধরাধরি করে তাকে বিছানায় এলিয়ে দিলেন। ঘরময় মেয়েলি চাপা কান্না পরিবেশ কে বিষিয়ে তুলেছে। পাশের রুম থেকে কয়েকজনের মিলিত কোরআন তেলাওয়াতের সুর ভেসে আসছে।কাঠের খাটিয়াটাতে শয়নরত লাশের পাশে থাকা আগরবাতি আর কিছুক্ষণ আগে ছিটিয়ে দেয়া গোলাপজলের তীব্র সুগন্ধি আবহাওয়া কে আরও গুমোটরূপ দান করছে।
বাড়ির ড্রইংরুম থেকে শুরু করে প্রতিটা রুমের কোণায় কোণায় আজ আত্মীয় স্বজন আর পাড়া-প্রতিবেশির ভিড় জমেছে।
কঠোর ওলিদূন আজাদও আজ বাকশূন্য হয়ে দৃষ্টি মাটিতে রেখে কাঠপুতুল এর ন্যায় স্তবদ্ধ হয়ে বসে আছেন।তার শ্বাস প্রশ্বাসের দরুন বারবার কাধ হালকা করে ওঠা নামা করছে।
সন্তান প্রতিটা মা বাবার কাছে ই প্রিয়।মা বাবা পাগল হলেও তারা মা বাবা ই হন।সন্তান ও যদি বদ্ধ উন্মাদ হয় তারপরও সেই সন্তান মা বাবার কাছে কলিজার টুকরো ই হয়।তারা হয় মায়ের নাড়িছেড়া ধন আর বাবার কাছে আবদার করার রাজকন্যা। সেই রাজকন্যা ই যদি বাবার চোখের সামনে সাদা কাফন নামক বস্ত্র গায়ে জরিয়ে খাটিয়ার ওপর শ্বাস ক্রিয়া বন্ধ করে শুয়ে থাকে তাহলে যেকোন বাবাই বাকশূন্য হতে বাদ্ধ হবে।যতই সে কঠোর হোক না কেন।মেয়ের খবর শোনা মাত্র ই ওলিদূন আজাদ যেন বোবা হয়ে গিয়েছেন।অতি শোকে নাকি হয় পাথর। তার বেলায়ও এই কথা টা নির্দ্বিধায় প্রযোজ্য বলে মনে হচ্ছে।
কাল রাতে…
জুইঁ আলআবির দেয়া রকর্ডারটা বুকে জড়িয়ে নিতে ই বিকট শব্দে জুইঁর কানে তব্দা লেগে যায়।কিছু বুঝতে পারার আগেই ঠিক বুকের মধ্যখানে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করে।ধীরে ধীরে সারা শরীর জুড়ে ব্যাথা অনুভব হতে থাকে।এটুকু সময়ের মধ্যে ই জুইঁ নিজেকে সিটের থেকে নিচে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়।ঝনঝন শব্দে গাড়ির কাচ গুলো ভেঙে যায়।যন্ত্রণায় কাতর চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে। চারদিক থেকে আর্তনাদ আর হাহাকারের প্রতিধ্বনি ভেসে আসে জুইঁর কানে। জুইঁর মুখ দিয়ে ও বের হয় আর্তনাদের গোঙানি।ডান হাতের রেকর্ডার টা দুর্বল শক্তি দিয়ে ই চেপে ধরে। কি ঘটেছে তা জুইঁ উপলব্ধি করতে পেরেই মুখ দিয়ে জপতে থাকে-“লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ”।
জুইরঁ চোখ মেলে রাখতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তাই ধীরে ধীরে নিজ ইচ্ছেয় চোখটা বুজে নিল।চোখ বন্ধ করার সাথে সাথে পুরুষ মানুষের একজোড়া চোখ জুইঁর মস্তিষ্কে বিচরণ করতে লাগলো।কানে তার এখনো রেকর্ডার এর কিছু কিছু কথা বাজছে।জল ভরাট চোখের দুকার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পরলো জল।একে একে বিগত দশদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনা একের পর এক এসে ধাক্কা দিতে লাগলো জুইঁর মস্তিষ্কে।জুইঁর পুরো শরীর অবশপ্রায়।অনেক কষ্টে রকর্ডারের বাটন টা আরেকবারের মতো চেপে ধরলো।সঙ্গে সঙ্গে সেই অতি পরিচিত কন্ঠে কিছুক্ষণ আগের কথা গুলোই পুনরায় বাজতে লাগলো।এতো চিৎকার চেচামেচির মধ্যে হঠাৎ একে একে প্রিয়জনের চেহারা ভাসতে লাগলো।বাবার সেই কড়া কড়া শাসন গুলো মনে পড়তেই জুইঁর ঠোঁট কিঞ্চিৎ পরিমাণে প্রসারিত হলো।তবে এই প্রসারণ বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারল না।মুহূর্তের মধ্যে ই দ্বিতীয় বারের মতো আরেকটা বিকট শব্দ!সঙ্গে সঙ্গেই খুব জোরে ধাক্কা লাগলো যে গাড়ি তে জুইঁ ছিল। এবার জুইঁ মাথায় অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ছেড়ে দিল।নিথর দেহের কালো হিজাব পরিহিত মাথা থেকে গড়িয়ে পরতে লাগলো উষ্ণ লাল রঙা রক্ত।সেই রক্তে লাল হলো নিথর দেহটার মুখমন্ডল।
সব ঘটনার প্রতক্ষ্য সাক্ষী হলো মিসেস পারভীন, সিরাজ সাহেব ড্রাইভার আশরাফুল আর চায়ের দোকানের চাওয়ালা সহ অপরিচিত আরও দু একজন লোক।যারা দোকানটায় বসে বসে চা পান করছিল। চোখের সামনে ই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আলআবিদের গাড়িটাকে দ্রুতগতির যাত্রীবাহী একটি বাস এসে ধাক্কা দেয়।এই রোডে রাতের বাসগুলো বেপরোয়া ভাবে চলাচল করে। ড্রাইভার এর অসাবধানতায় আলআবিদের গাড়ির সঙ্গে ওই বাসটার ধাক্কা লাগে।তবে গাড়িটা ব্রেকফেল ছিল যার জন্য পুরো দোষ ড্রাইভারকেও দেয়া যায় না। শত চেষ্টা চালিয়েও ড্রাইভার ব্রেক করতে পারেনি।দুর্ঘটনা এপর্যন্ত হলেও চলতো কিন্তু ঘটনা টা এপর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকেনি।জুইঁ কে গাড়ি থেকে বের করার আগ মুহূর্তেই অপর পাশ দিয়ে উচ্চ গতি সম্পন্ন আরেকটি মালবাহী ট্রাক এসে দ্বিতীয় বার ধাক্কা দেয় ছোট্ট প্রাইভেট কার টিকে।
ক্ষনিকের মধ্যে এতো বড় দূর্ঘটনার জন্য কেউ কখনোই আগে থেকে প্রস্তুত থাকে না।ওখানে থাকা মানুষ গুলোও প্রস্তুত ছিল না। বাসে থাকা যাত্রীর মধ্যে আহত সংখ্যা ১২ জনের মতো।নিহত সংখ্যা ৬ জন।ঘটনা আসে পাশে ছড়িয়ে পরতেই সামনের হসপিটাল থেকে সাইরেন বাজিয়ে এম্বুলেন্স আসতে শুরু করে।এম্বুলেন্স এর সেই সাইরেন পরিবেশ কে আরও ভয়ংকর রূপ দেয়।একদিকে স্বজন হারানো বেদনাদায়ক চিৎকার আর হাহাকার অন্য দিকে এম্বুলেন্স এর সেই হৃদয় কাঁপানো সাইরেন আর রক্ত রাঙা কিছু লাশ।
সিরাজ সাহেব কাঁপা হাতে আতঙ্কে ছেয়ে যাওয়া কন্ঠে আলআবি কে কল করেন। “বাবা তুই তারাতাড়ি আয়।” কম্পিত গলায় এ কথা টুকু বলেছেন। এই তো ঢের।গলা দিয়ে কথা বের হতে চাচ্ছিল না।ড্রাইভার আশরাফুল সিরাজ সাহেব এর থেকে ফোনটা নিয়ে কিছু একটা বলে আবার ফিরিয়ে দিলেন ফোনটা। সিরাজ সাহেবের কর্ণকুহুর হলো না আশরাফুলের বলা কথা।
মিসেস পারভীন এম্বুলেন্সে বসে অঝোর ধারায় কেঁদে যাচ্ছেন। সামনেই জুইঁর নিথর দেহ।দক্ষ বিবেকের সঙ্গে আশরাফুল সবটা সামলাতে ব্যস্ত।
একপায়ে একটা হুডতোলা সেন্ডেল।অপর পা খালি।পড়নে থ্রী-কোয়াটার এর একটা কালো প্যান্ট।গায়ের ধুশোর রঙের শার্টের বোতামের ঠিক নেই।বুকের প্রথম দুই বোতাম রেখে তৃতীয় বোতাম থেকে শার্ট আটকানো।শার্টের শেষ প্রান্তে চোখ দিলেই এপাশ ওপাশ যে ছোটবড় টা ঠিক আন্দাজ করা যায়।হাতার বোতাম গুলোও খোলা। চোখে মুখে তার আতঙ্ক। রয়েছে কিছু হারিয়ে ফেলার ভয়।বারবার হসপিটালের বারান্দার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত হন্তদন্ত হয়ে কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।যাকেই সামনে পাচ্ছে তাকেই ধরে কি যেন বলছে।
আঠাশ-উনত্রিশের এই যুবকটার এই হাল দেখে চল্লিশোর্ধ নার্স রুকাইয়া বেগমের বড্ড দয়া হলো।আজকের এক্সিডেন্টের দরুন অনেকে কেই এখানে
আনা হয়েছে। রুকাইয়া বেগম ধারণা করে নিলেন এই যুবকও হয়তো বা প্রিয়জনের দুঃসংবাদে ছুটে এসেছে এখানে।তিনি এগিয়ে গিয়ে যুবকের সামনে দাঁড়িয়ে পরলেন।আলআবি নার্স বেশে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটিকে দেখা মাত্র ই ব্যস্ত হয়ে বলতে লাগলো…
–আমার মায়াবিনীকে দেখেছেন? ও এখানেই।এখানেই আছে।
তারপর নিজের কাঁধের কাছে হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল…
–এই এতটুকু। আমার কাঁধ অব্দি।দেখেছেন ওকে?
রুকাইয়া বেগমের অনুভূতি স্নায়ু তাকে কিছুটা কষ্টের অনুভূতি প্রেরণ করল।তার মস্তিষ্ক নিঃসন্দেহে বলছে তার সামনে এক প্রেমিক পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে।
চলবে………….
#মায়াবিনী_মানবী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_১৫
রুকাইয়া বেগম আলআবি কে এক্সিডেন্ট এর পেশেন্ট গুলো যে ওয়ার্ডে এসেছে সেখানে নিয়ে গেল।আলআবি হন্তদন্ত হয়ে ওয়ার্ডে ঢুকে এই সীট থেকে ওই সীট জুইঁ কে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পরলো।আলআবির পাগলামি দেখে সন্তানহীন রুকাইয়া বেগমের চোখে জল ধরা দিল।
জুইঁ কে এখানে না পেয়ে আলআবি দরজায় দাঁড়ানো রুকাইয়া বেগমের কাছে ফিরে এসে বলতে লাগলো…
–আমার জুইঁ তো এখানে নেই।ও কি বাড়ি চলে গিয়েছে?
রুকাইয়া বেগম জুইঁ নাম শুনে হকচকিয়ে উঠলেন।এই নাম টাই তো তিনি একটু আগে একটা লিস্টে তুলেছেন।এতো বছরের এই পেশায় তিনি কখনো কারো জন্য এতোটা কষ্ট অনুভব করেন নি।ছেলেটার জন্য আজ সত্যি ই তার বড্ড কষ্ট লাগছে।আলআবি কে ইশারা করলেন তার পিছনে পিছনে আসতে।
আলআবি রুকাইয়া বেগমের পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বাবা মাকেও খুঁজে যাচ্ছে।কিছু দূর এগোতে ই কান্নায় জড়জরিত মিসেস পারভীন এর দেখা মিলল।পাশে ই তার বাবা। আশরাফুল ও রয়েছে। কার সাথে যেন কথা বলছে।তাদের ছাড়া আরও অনেক অপরিচিত মুখ আলআবি দেখতে পাচ্ছে।কাউকেই কান্না ব্যাতিত দেখা যাচ্ছে না।
মায়ের এ অবস্থা দেখে আলআবির বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। দৌড়ে গিয়ে মার সামনে দাঁড়িয়ে পরলো।মিসেস পারভীন ছেলেকে সামনে পেয়ে জড়িয়ে ধরে কান্নার গতি আরও বাড়িয়ে দিলেন।আলআবি অজানা কোন এক ভয়ে আঁতকে উঠলো।জুইরঁ অনুপস্থিতিতে আলআবির টনক নড়ে উঠলো।কোনমতে মাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিল। মিসেস পারভীন এর দুই বাজু ধরে কম্পিত গলায় বলল…
–মা জুইঁ?
মিসেস পারভীন কান্নার কারনে কিছুই বলতে পারছে না।রুকাইয়া বেগম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবই দেখছেন।
আলআবি মায়ের জবাবের অপেক্ষা না করে করুন চোখে সিরাজ সাহেব এর দিকে দৃষ্টি দিল।সিরাজ সাহেব হাতের ইশারায় ডানপাশে থাকা দরজা দেখিয়ে দিলেন।আলআবি হুড়মুড়িয়ে দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে ই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পরলো।সামনে এগিয়ে যেতে প্রচুর কষ্ট হচ্ছে তার।মনে হচ্ছে কেউ পায়ের মধ্যে কয়েক টন পাথর চেপে দিয়েছে।
জীবনের চরম সত্যের মুখোমুখি আজ আলআবি।এই সত্য একেবারে ই মেনে নেয়ার মতো নয়।চোখের সামনে তার অনেক গুলো লাশ।এই লাশের মাঝে ই জুইঁ কে দেখা যাচ্ছে। একেবারে প্রথম ট্রলিতেই জুইঁ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।
চেহারা পানশেটে রূপ ধারণ করেছে। সেই শুভ্র রাঙা শাড়ির জায়গায় জায়গায় লাল বর্ণের শুকনো রক্ত লেপ্টে আছে।তবে এখন আর তা লাল নেই।কালচে খয়েরী তে বদলে গেছে।মাথার সেই কালো হিজাব এর স্থানে রয়েছে সাদা বেন্ডেজ। উন্মুক্ত চুলগুলো লুটোপুটি খাচ্ছে সিমেন্ট এর ফ্লোরে। হাত ভরা চুড়ির কোনটা ভালো কোনটা ভাঙা। রক্ত সেখানে ও তার ছাপ রেখে গিয়েছে। ভালো করে পরখ করলেই দেখা যাবে হাতের গভীর ক্ষত কে কেউ সাদা বেন্ডেজে মুড়ে দিয়েছে।
আলআবি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না।হাঁটু গেড়ে সেখানেই বসে পরলো।বিশাল আকৃতির এই মর্গ কাঁপিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠলো আলআবি।মর্গের বাইরে দরজায় সিরাজ সাহেব দাঁড়িয়ে আছে।
কান্নার শব্দে রুকাইয়া বেগম এগিয় আসলেন মর্গের দরজার সামনে। ছলছল নয়নে দুজন মানব দাঁড়িয়ে আছে আলআবির পিছনে।
হুট করে আলআবি হাঁটু মুড়ে বসা অবস্থাতেই হাঁটু ফ্লোরে ঘেঁষে ঘেঁষে পাঁচ ছয় কদম এগিয়ে জুইঁর ট্রলির কাছে গিয়ে জুইঁর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বুকের সঙ্গে চেপে ধরলো।
ভগ্নকণ্ঠে কান্না মিশ্রিত গলায় বলতে লাগলো…
–এই…এই!আমি তো বললাম তিনদিন পর আমি আসছি।আচ্ছা তুমি কি রাগ করেছ কোন কারণে?আমি…আমি কিন্তু তোমার বাবাকে ছবি নিয়ে কিচ্ছু বলব না।আই প্রমিস!আমি তো ভয় দেখানোর জন্য ওগুলো বলেছিলাম। আমি এখন থেকে তোমার সব কথা মেনে চলবো।সত্যি!বিশ্বাস করো।এই…এই!মায়াবিনী একটু চোখ খুলে আমার চোখের দিকে তাকাবে?প্লিজ! তাকাও না?
আলআবি একহাতে জুইঁর হাত ধরে অন্য হাতের বাহুতে চোখ মুছে নিল।তারপর আবার জুইঁর হাত নিজের দু’হাতে আঁকড়ে ধরে বলতে লাগলো…
–আর কখনো কোন কিছুতে তোমাকে জোর করবো না। প্রমিস!তুমি তো বলেছিলে আবার আমাদের দেখা হবে।দেখা তো হয়েছে। কিন্তু তুমি আমার সাথে কথা বলছো না কেন?একবার আমার সাথে কথা বলো না!প্লিজ একবার আমার হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরো।ধরো না!
আলআবি জুইঁর হাত ছেড়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পরলো। পরমুহূর্তেই আবার ঝুঁকে জুইঁর মুখোমুখি হলো।দু’হাতে জুইঁর শীতল গাল সন্তপর্ণে আঁকড়ে ধরলো।আলআবির চোখের জল টপটপ করে জুইঁর মুখমন্ডলে পড়ছে।আলআবি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বলতে লাগলো…
–এই মেয়ে তুমি কথা বলছো না কেন?এতো অভিমান কেন তোমার? আমি তোমার কন্ঠস্বর না শুনে তো থাকতে পারি না।কেন বোঝনা তুমি? আমার কষ্ট হয় তো।এখনো কথা বলবে না?
আলআবি জুইঁর মাথা তুলে বুকে জড়িয়ে ধরলো।বিলাপ করতে করতে হাউমাউ করে উচ্চ শব্দে কেঁদে উঠলো।
পিছনে আলআবির বাবা নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।যা বোঝার তিনি বুঝে গিয়েছেন।রুকাইয়া বেগম এই করুন দৃশ্য আর দেখতে পারলেন না।তৎক্ষনাৎ মর্গ ত্যাগ করলেন।উচ্চ শব্দে কান্নার আওয়াজে আশরাফুল আর মিসেস পারভীন সিরাজ সাহেব এর পাশে এসে দাড়াতেই হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সম্মুখীন হলেন।ছেলের করুন দশায় মিসেস পারভীন নিজের কান্না ভুলে অবাক নয়নে ছেলেকে পরখ করে যাচ্ছেন। ছেলের এমন কান্না সে আর কখনোই দেখেন নি।
সিরাজ সাহেব এগিয়ে গেলেন ছেলেকে সামলাতে। বাবার ছোঁয়া পেয়ে বাবাকে ছোট বাচ্চাদের মতো জড়িয়ে ধরে চোখের জল বিসর্জন দিতে দিতে বলল…
–ওতো জানে আমি ওকে কতোটা ভালোবাসি। ও বুঝেও কেন না বোঝার ভান করছে?ওকে আমার সাথে একটু কথা বলতে বলো।প্লিজ বাবা! একটু কথা বলতে বলো।
আজ মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন সিরাজ সাহেব। ছেলেকে কি বলে সান্ত্বনা দিবে তা জানা নেই।আলআবি কে কোনমতেই মর্গ থেকে বের করা যাচ্ছে না। আলআবি জুইঁর মাথা নিজের বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। কারো সঙ্গে কথাও বলছে না।
সিরাজ সাহেব আর আশরাফুল অনেক কষ্টে একজন ডাক্তার কে ম্যানেজ করে আলআবি কে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করায়। ভোর ৬ টা নাগাদ জুইঁর লাশ যশোর পৌঁছায়।
ক্যালেন্ডার বলছে আজ শুক্রবার।অর্থ্যাৎ জুমাবার।আলআবির ঘুম একটু আগেই ভেঙেছে।সময় তখন ঠিক ১২ টা।ঘুম ভাঙতেই একে একে সব মনে পড়তে থাকে আলআবির।আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সে এখন যশোরে।নিজ ঘরেই শুয়ে আছে। নিশ্চুপ হয়ে কতখন বসে রইলো বেডের উপর।
ধীরপায়ে বেডের থেকে নেমে পরলো।পুরো বাড়িতে কাউকেই খুঁজে পেল না।কাউকে না পেয়ে জুইঁ দের বাসায় ঢুকে পরলো। আলআবির মা বাবা আলআবি কে এখানে দেখে আঁতকে উঠলেন।তাদের মনে হচ্ছে ছেলে এখানে ও পাগলামি করবে। কিন্তু তাদের ভুল প্রমাণ করে আলআবি নির্বাক হয়ে এক দৃষ্টিতে জুইঁর খাঁটিয়ার পানে চেয়ে রইল।
আলআবি নিজ কাঁধে করে জুইঁর খাঁটিয়া কবর পর্যন্ত নিয়ে যায়।জানাজায় ও শরিক হয়।নিজহাতে ওলিদূন আজাদ মেয়ে কে কবরে চিরনিদ্রায় রেখে আসেন।
এরমধ্যে আলআবি একটা টু শব্দ ও করেনি।জুইঁ কে কবর দিয়ে এসে নিজ রুমে আলআবি ভাংচুর শুরু করে। চিৎকার করতে লাগে।মিসেস পারভীন ছেলের রুম থেকে ঝনঝন করে কোনো কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে দৌড়ে ছেলের রুমে চলে আসেন।এসে দেখেন জানালার কাচ ভেঙে নিচে পড়ে আছে। আলআবি চুপচাপ বেডে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। পায়ের থেকে রক্ত চুয়ে চুয়ে পড়ছে।মিসেস পারভীন হন্তদন্ত হয়ে আলআবির পা ধরে বেডে তুললেন। পায়ে বিঁধে যাওয়া কাচ ছাড়িয়ে রক্ত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করলেন।আলআবি নিরবে সব দেখে গেল।হঠাৎ করে আলআবির ফিক করে হেঁসে দিল।মিসেস পারভীন আলআবির দিকে তাকাতেই আলআবি বলল…
–পায়ের তো ব্যান্ডেজ করলে।এবার এখানে ব্যান্ডেজ করবে কিভাবে।
আলআবি হাত দিয়ে বুকের বা পাশে ইশারা করলো।ছেলের এই বেহাল অবস্থা দেখে মিসেস পারভীন নীরবে কাঁদতে লাগলেন।আলআবি তখন হুট করে মায়ের কোলে মাথা রেখে বলল…
–মা একটু শান্তি তে ঘুমাতে চাই।তোমার গায়ের ঘ্রাণ নিয়ে ঘুমালে খুব শান্তি তে ঘুমাতে পারি।
আর কথা না বাড়িয়ে আলআবি চোখ বুজলো।
পরিশিষ্ট :
আলআবি আর কখনো ঢাকা ফিরে আসেনি।নিজেকে পুরোপুরি বদলে ফেলে।নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। প্রতিদিন জুইঁর কবর যিয়ারত করে।জুইঁর মা বাবা কেও আর এ বাড়ি ছেড়ে যেতে দেয়নি।জুইঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেই টেপরেকর্ডার টাও আর পাওয়া যায় নি।বেনজিকে ও যশোর নিয়ে এসেছে আলআবি। নিজেদের বাড়ির পাশেই একটা নার্সারি করেছে। দিনরাত সেখানেই কাটে আলআবির।খাবার সময় হলে মা এসে খাবার দিয়ে যায়।জুইঁর বান্ধবী সাদিয়ার বিয়ে হয়েছে তার পছন্দের মানুষ সাদমান এর সাথে। এইতো কিছু দিন আগেই সাদমান এক কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছে। আলআবি আর সিরাজ সাহেব এর সম্পর্কও ভালো হয়ে আসছে।কঠোর ওলিদূন আজাদ ও এখন আর কঠোর নেই।তবে এতোদিনে ও হদিস মেলেনি সজল আর আলআবির চাচার।আজও আলআবি প্রতিবছরের মতো জুইঁর জন্য সাদা শাড়ি,চুড়ি আর নিজ হাতে নিপুনতার সাথে শিউলি ফুলের মালা বানিয়েছে।এই ৪ বছরে এমন শাড়ি,চুড়ি চার বার কিনেছে।
৩০০ পৃষ্ঠার উপন্যাসটা শেষ করে বইটা বন্ধ করে দিল জায়েফ এহমাদ। বই বন্ধ করতেই ধবধবে শুভ্র বর্ণের মলাট যুক্ত বইয়ের উপরে কালো কালিতে ভেসে উঠলো –
“নিভৃতে প্রস্থান”
“আলআবি মাশরুখ”
লেখক এর জায়গায় আলআবি মাশরুখ নামটা দেখে ঠোঁট বাকিয়ে হেসে উঠলো জায়েফ।পকেট থেকে ফোনটা বের করে বারান্দায় গিয়ে রেলিং এর উপর সমস্ত ভর ছেড়ে দিল।ডায়ালে একটা নাম্বার উঠিয়ে কল কাউকে কল করল।ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই
চলবে………….