মায়াবতীর_প্রণয়ে,অন্তিম পর্ব
মম_সাহা
বর্ষার মাঝামাঝি সময়।চারপাশের পরিবেশ বেশ শীতল।মিষ্টি দাঁড়িয়ে আছে জানালার পাশে।বাহিরে বৃষ্টি পড়ছে।তার খুব ভিজতে ইচ্ছে করছে কিন্তু ভিজতে পারবে না।কারণ আজ দুই সপ্তাহ যাবত সে বিছানায় পড়ে আছে।খুব অসুস্থতার জন্য বিছানা ছাড়তে পাড়ছে না।আজ কোনো রকম উঠে জানালার পাশে দাঁড়ালো।
মিষ্টি ইদানীং খেয়াল করছে আশেপাশের সব কিছুই তার বেশ সুন্দর মনে হয়।অনেক দিন বাঁচতে ইচ্ছে হয়। অবশ্য অসুস্থতার জন্য মাঝে মাঝে সব কিছু বিরক্ত মনে হয়।আবার একজনের সাথে কত গুলো বসন্ত কাটাবে বলে বাঁচার ইচ্ছেও পোষন করে।
হঠাৎ মিষ্টির কাঁধে কেউ হাত রাখল।মিষ্টি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখল মিঠাই এসেছে।মিষ্টি আস্তে জানালা থেকে সরে এসে বিছানায় এক পাশে এসে বসল।তারপর মিঠাইয়ের দিকে তাকিয়ে নির্জীব কন্ঠে বলল
— কিরে মিঠাই রানী এখানে কি মনে করে হুম?
–আসলে আপু তোমার সাথে একটু গল্প করতে আসছি।কত দিন হলো তোমার সাথে কথা হয় না ভালো করে।
–হ্যাঁ সেটা তুই একদম ঠিকই বলেছিস।অনেকদিন হলো আড্ডা দেওয়া হয় না।
— আচ্ছা আপু তুমি সুস্থ হয়ে নেও তারপর আমরা সবাই মিলে আবার আড্ডা দিবো ঘুরতে যাবো কেমন?
মিষ্টি বোনের উচ্ছাস মাখা কন্ঠ শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা কাত করে হ্যাঁ জানায়।মিঠাই কতক্ষণ চুপ করে থাকে।তারপর সে চলে যায়।
মিষ্টি ভাবে আদ্রের সাথে রাতের ঝামেলার পর আজ আটাশ দিন হতে চলল। সেদিন রাতে সে বাসায় পৌঁছানোর পর দুদিন কোনো খোঁজ খবর ছিলো না আদ্রের তবে কৃষ্ণচূড়া ফুল ঠিকই পাঠিয়েছে। দুদিন পর বিকেলে হঠাৎ এক অচেনা মহিলা আর একটা ছেলে এসে উঠে তাদের বাসায় মিষ্টিকে দেখতে।পরে মিষ্টি জানতে পারে এরা আদ্রের মা আর ভাই।
মিষ্টির বাবা বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় কারণ কয়েকদিন আগেই মিষ্টি বিয়ে নিয়ে কত রাগারাগি করল।মিষ্টিও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে নি।
সেদিন রাতেই আদ্রের মা মিষ্টিকে ফোন করে কান্নাকাটি করল।আদ্র নাকি খাবার খাচ্ছে না।দরজা আটকিয়ে বসে আছে।মিষ্টি উপায় না পেয়ে বাবার কাছে গিয়ে বলল এই পাগল ছেলেটাকেই সে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছে,এই ছেলেটাকেই সে চায়।
মিষ্টির পরিবার অবাক হয়ে যায় প্রথমে তারপর সবাই খুশি মনে মিষ্টির আবদার মেনে নেয়।সেদিন রাতেই ঠিক করা হলো আগামীকাল আংটি পড়ানো হবে।দীর্ঘ পাঁচদিন পর আদ্র মিষ্টির মুখোমুখি হয় সেই সন্ধ্যা বেলা।আংটি বদলের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় শুক্রবারে বিয়ে।
সেদিন আদ্রের খুশি দেখে মিষ্টি অবাক হয়ে ছিলো।আদ্র সবার সাথে হাসিখুশি ভাবে কথা বললেও মিষ্টির দিকে ফিরেও তাকায় না।মিষ্টি আদ্রের রাগের কারণ বুঝতে পেরে অনেক কষ্টে প্রেমিক পুরুষের রাগ ভাঙ্গায়।
দিন ভালো চলছিলো।নিবিড়ের সাথেও দেখা হয়েছিলো।মিষ্টি নিবিড়কে বিয়ের খবর টা দেওয়ার পর নিবিড় কেমন থম মেরে গিয়েছিলো।
দিন ভালোই কাটছিলো।হঠাৎ বিয়ের আগেরদিন মিষ্টি প্রচুর অসুস্থ হয়ে পড়ে।হসপিটালে ছুট লাগায়।অবশেষে বিয়ে পিছানো হয়।মিষ্টির শরীর ভালো হলে বিয়ের অনুষ্ঠান উদযাপিত হবে।
তারপর কেটে গেলো দু সপ্তাহ।মিষ্টির শরীরের কোনো উন্নতি হলো না।এখন প্রায়ই নিবিড়ের সাথে দেখা হয়। নিবিড় যে হসপিটালের ডাক্তার সেই হসপিটালেই মিষ্টির চিকিৎসা চলেছিলো।আর নিবিড়ের তত্ত্বাবধানেই চিকিৎসা হচ্ছে।এখনো রোগ নির্ণয় করা যায় নি।
মিষ্টির ভাবনার মাঝেই কেউ তার মুখোমুখি বসলো।মিষ্টি চোখ উঠিয়ে তাকিয়ে দেখে আদ্র।মিষ্টি নিজের মেলে রাখা পা’টা একটু গুটিয়ে নেয়। আদ্রের দিকে তাকিয়ে হাসি উপহার দিয়ে বলল
-“আদ্র সাহেব যে আজ এত লেট করে আসলেন? অফিসের চাপ বাড়ছে নিশ্চয়ই? প্রতিদিন আসার কি খুব দরকার?”
আদ্র মিষ্টির পা দুটো নিজের কোলের উপর নিয়ে টিপে দিতে দিতে বলল
-“একদমই প্রতিদিন আসা দরকার।ভাবছি আর অপেক্ষা করবো না।কাজী ডেকে কবুল বলে আমার বাসায় নিয়ে যাবো।”
মিষ্টি তড়িঘড়ি পা চাঁপানোর চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয় নি।আদ্র শক্ত করে পা’টা ধরে রাখলো।মিষ্টি বুঝতে পেরেছে আদ্রের সাথে পেরে উঠবে না।তাই সে আবার নিজের মতন বসে পড়ল।তারপর কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল
-“না বিয়েটা আপাতত বন্ধ থাকুক।এমন রোগী বউয়ের দরকার নেই।আপনার ঘরে যাবে একজন সুস্থ বউ।”
মিষ্টির কথার ধরণে ভ্রু কুঁচকে তাকায় আদ্র। তারপর আবার পা টিপাই মনোযোগ দিয়ে বলল
-“আমার কেমন বউ দরকার আমি জানি।আপনার এত না ভাবলেও চলবে মায়াবতী।”
মিষ্টি আদ্রের মুখে মায়াবতী নাম শুনে অবাক হয়ে তাকায়। কারণ আদ্র সবসময় মিষ্টিকে লীলাবতী বলে ডাকে।
মিষ্টির অবাক হওয়ার কারণ বুঝতে পেরে আদ্র মিটিমিটি হেসে দিলো। হাসতে হাসতেই বলল
-” কি মেডাম? মায়াবতী শুনে অবাক হলেন? আমি মনে মনে সবসময়ই আপনাকে মায়াবতী ডাকি।যেদিন আপনাকে প্রথম দেখি সেদিন থেকেই এই নামটা আপনার জন্য বরাদ্দ করেছিলাম।কিন্তু ভেবেছিলাম একদিন সারপ্রাইজ দিবো।কিন্তু আজ বলেই ফেললাম।”
মিষ্টি আদ্রের পাগলামো কথা শুনে অবাক হয়ে যায়। আদ্র হেসে দেয়। মিষ্টিও হেসে দেয়। হঠাৎ আদ্র মিষ্টিকে বলল
-“চলেন আজ আপনাকে আপনার সুখদাতার কাছে নিয়ে যাবো।বেচারা অনেকদিন আপনাকে দেখে না।আমারও ওর সাথে দেখা হয় না কতদিন হলো।আজ অনেক গুলো কাঠগোলাপ নিয়ে ওর সাথে দেখা করব।যাবেন?”
মিষ্টি আদ্রের এমন প্রস্তাবে জেনো আকাশের চাঁদ পেলো।কতদিন দেখা হয় না ছেলেটার সাথে। যেই ভাবনা সেই কাজ।আদ্র আর মিষ্টি অনেক গুলো কাঠগোলাপ নিয়ে সুখদাতার উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
_________
মিষ্টি আর আদ্র আলী মানে সুখদাতাকে তাদের জায়গায় মানে যেখানে থাকে সবসময় সেখানে না পেয়ে আশেপাশের মানুষের থেকে ঠিকানা নিয়ে আলীর বাসার উদ্দ্যেশে রওনা দেয়।
“কিরে সুখদাতা কেমন আছিস?”- আলী নিজের পিছে কারো কন্ঠ শুনে ফিরে তাকালো। মিষ্টিকে দেখে সে ছুটে এসে মিষ্টির কোমড় জড়িয়ে ধরলো। মিষ্টিও হাসি মুখে আলীকে জড়িয়ে ধরলো।
আলী মিষ্টির দিকে তাকিয়ে অভিমানী সুরে বলল
-” তুমি এতদিন আসো নাই ক্যান পরী?তুমি জানো তোমার কথা আমার অনেক মনে পড়ছে।”
মিষ্টি আলীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
-“সরি রে সুখদাতা।আমি তো একটু অসুস্থ ছিলাম তাই তোর কাছে আসতে পারি নি।তোকে ফুলও দিতে পারি নি। তুই কি রাগ করেছিস? তোর বান্ধবী কি রাগ করেছে?”
বান্ধবীর কথা শুনে ছোট্ট আলী ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে দিলো। মিষ্টি আর আদ্র ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো।মিষ্টি আলীকে শান্ত করতে করতে বলল
-“অনেক রাগ করেছে তোর বান্ধবী তাই না?চল আমি তোর সাথে গিয়ে ওর রাগ ভাঙাবো।চল।”
মিষ্টির কথা শুনে আলী চোখ মুছলো।উচ্ছ্বাস কন্ঠে বলল
-“তুমি ওর রাগ ভাঙাতে পারবে পরী?”
মিষ্টি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানাতেই আলী মিষ্টির হাত ধরে কোথাও নিয়ে যায়। আদ্রও তাদের পিছু পিছু যায়। হাঁটতে হাঁটতে তারা একটা কবরস্থানের সামনে এসে দাঁড়ায়। মিষ্টি অবাক হয়ে বলল
-“কিরে তুই আমাদের এখানে কেনো নিয়ে আসছিস?”
আলী মিষ্টির হাত ছেড়ে একটা কবরের সামনে এসে বসে।কবরটার উপরে একটা তাজা আর কতগুলো বাঁসি কাঠগোলাপ আছে।মিষ্টি কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে গিয়ে আলীর পাশে বসে।আলীর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলল
-“কার কবর এটা সুখদাতা?”
আলী কতক্ষণ অনবরত কবরটার উপর হাত বুলিয়ে টলমল চোখে বলল
-“তুমি যার জন্য আমাকে কাঠগোলাপ দিতে পরী এটা তারই কবর।”
মিষ্টির হাত থমকে যায়। আদ্রও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে
-“কি বলছো আলী?এটা তোমার বান্ধবীর কবর? কীভাবে এমন হলো?”
আলী এবার আবার ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে দিলো।কাঁদতে কাঁদতেই বলল
-“পাঁচদিন আগে আমি আর টুনি রাস্তায় হাঁটছিলাম।পরী তো কাঠগোলাপ দিতে আসতো না।একটা ভাইয়া দিয়ে যেতো।এই যে কবরের উপর এখনো দিয়ে যায়। ঐদিনও ওই কাঠগোলাপ টা নিয়ে টুনি খুশিতে লাফাতে লাফাতে হাঁটছিলো।ওর কাঠগোলাপটা ওর হাত থেকে একটু ছিটকে পরে যায়। টুনি ওটা উঠাতে যায় আর একটা বড় ট্রাক টুনির কাঠগোলাপ আর টুনিকে পিষিয়ে দিয়ে চলে যায়। ”
মিষ্টির কলিজা ধপ করে উঠলো।এত কিছু ঘটে গেলো সে জানলোও না।হঠাৎ মিষ্টি অনুভব করলো তার শ্বাস নিতে প্রচুর কষ্ট হচ্ছে।আদ্র মিষ্টির দিকে তাকিয়ে দেখে মিষ্টির নাক মুখ দিয়ে রক্ত ঝড়ছে।আদ্র মিষ্টিকে কয়েকবার ডাকলো। কোনো সাড়া না পেয়ে তাড়াতাড়ি পাঁজা কোলে ছুটে গেলো গাড়ির দিকে।মিষ্টি অস্পষ্ট স্বরে বলল
-“ছুটে কাজ নেই আদ্র সাহেব।আপনার দশাও সুখদাতার মতন হবে।”
আদ্র মিষ্টির কথা বুঝলো কি বুঝলো না ছুট লাগালো হসপিটালে।
_________
কেটে গেছে পাঁচ বসন্ত।আদ্র কাটিয়েছে পাঁচটা বসন্ত মিষ্টিকে ছাড়া।প্রতিদিনের মতন আজও আদ্র পুরোনো সেই জায়গা টাই এসে দাঁড়িয়েছে। যেই জায়গাটা আলীর প্রিয় বান্ধবী শুয়ে আছে।শুধু আলীর প্রিয় বান্ধবী না আদ্রেরও প্রিয় মানুষ, আদ্রের মায়াবতী।
হ্যাঁ সেদিন আদ্র মিষ্টিকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার জানায় মিষ্টি ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে ছিলো।অনেক চেষ্টা করেও মিষ্টিকে আর ধরে রাখতে পারে নি তারা।
মিষ্টির মৃত্যুর পর শোক নেমে আসে মিষ্টির পরিবারে।মিষ্টির এ দশা মেনে নিতে না পেরে মিষ্টির বাবাও স্ট্রোক করে মিষ্টির মৃত্যুর দুদিন পর।পুরো পরিবারটা সামলিয়েছে আদ্র।ঐসময় টা আদ্র পাথর হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মিষ্টির পরিবারের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেয় সে।এখন অবশ্য মিঠাই ই সব করে।
এই পাঁচবছরে এমন একটা দিন নেই যে আদ্র এই কবরস্থানে আসে না।প্রতিদিন মিষ্টির কবরে এসে কৃষ্ণচূড়া ফুল রেখে যায়।অনেক রাত অব্দি এখানে থাকে।
অবাক করা ব্যাপার হলো টুনির কবরেও প্রতিদিন কে জেনো কাঠগোলাপ রেখে যায়। আলী তো এ শহরে থাকে না।সে তার গ্রামে চলে গেছে।মাঝে মাঝেই একটা পাগলকে পুরো কবরস্থান পরিষ্কার করতে দেখা যায়।
রাত তিনটে,,আদ্র মিষ্টির কবরের পাশে শুয়ে আছে।মনে হচ্ছে তার জেনো এ পৃথিবীর সাথে কোনো সম্পর্ক নেই।
অবাক করা ব্যাপার হলো টুনির কবরের পাশে ঐ পাগল এসে শুয়ে আছে।
দূর থেকে এ দৃশ্য দেখে চোখের জল মুছছে নীড়।মেডাম মারা যাওয়ার পর সে তার স্যারকে আর আগের মতন পায় নি।বেঁচে থাকতে হবে বলেই বেঁচে আছে এমন ভাব।
নীড় প্রতিদিনই তার স্যারের পিছুপিছু আসে।বড্ড ভয় হয় স্যারকে নিয়ে। আর সে এটাও খেয়াল করেছে আরেকটা পাগলও এ কবরস্থানে থাকে।সবসময় মিষ্টির আর টুনির কবরস্থান টা পরিষ্কার করে।টুনির কবরে কাঠগোলাপ রেখে দেয়।পাগলটাকে তার বড্ড পরিচিত লাগে।
নীড় নিজের গন্তব্যে হাটাঁ শুরু করে।ভেবে অবাক হয় তার স্যার মায়াবতীর প্রণয়ে একবারে কাঠ হয়ে গেছে। প্রণয় বুঝি একেই বলে।দুই দেহ থাকবে আর প্রাণ থাকবে একটা।তাই তো একজন চলে গেলে আরেকজন প্রাণহীনার মতন বেঁচে থাকে।
আজ পাঁচবছর হতে চলল।নিবিড় হসপিটালের উদ্দেশ্যে বের হয়ে ছিলো তড়িঘড়ি। তারপর আর নিবিড়কে খুঁজে পায় নি তার পরিবার।
সমাপ্ত