মায়াজাল (ভৌতিক গল্প),পর্ব-৩

মায়াজাল (ভৌতিক গল্প),পর্ব-৩
লামিয়া আক্তার রিয়া

আজ রাতটা যেন অনেক বেশিই নিস্তব্ধ।একটুপর পরই বাইরে থেকে বিদঘুটে আওয়াজ আসছে।ইমু,লিয়া আর সামু একরুমেই বসে আছে।রাতের খাবারও খায়নি ওরা।তিনজনের খাবারই খাটের পাশের টেবিলে রাখা।ইদ্রিস মিয়ার কথামতো দরজা-জানালা ভালোমতো লাগিয়ে নিয়েছে।তিনজনের মনে একটাই চিন্তা,উমা ঠিক আছেতো?



ইদ্রিস মিয়া নিজের ঘরে ধ্যানে মগ্ন।সামনে আগুনের শিখা জ্বলজ্বল করছে।দরজা-জানালা সব বন্ধ।আজকের রাতটা ইদ্রিস মিয়ার কাছে ভয়ঙ্কর লাগছে।বাইরে থেকে আওয়াজ আসছে।জানালায় একটু পরপর কিযেন ধাক্কা দিচ্ছে।পুবের ঘরগুলোর দিকে যাওয়ার মুখেই ইদ্রিস মিয়ার ঘর।ইদ্রিস‌ মিয়া ভয়ে আছেন।ঘরে থাকা‌ মেয়ে তিনটার দায়িত্ব তার।তাদের কোনো‌ বিপদ যেন না হয়।



গভির রাত।ইদ্রিস মিয়া এখনো ধ্যানে বসে আছেন।ইমু,লিয়া আর সামু ঘুমিয়ে গেছে।হঠাৎই বিকট চিৎকারে ওদের ঘুম ভেঙে গেলো।ওরা ধরমর করে উঠে বসলো।

সামু: কি ছিলো এটা?(কাপতে‌ কাপতে)

লিয়া: কি হচ্ছে এসব?কে চিৎকার করলো?

ইমু: বুঝতে পারছিনারে।কি হচ্ছে আমাদের সাথে?

লিয়া: বাইরে সব ঠিক আছেতো?

ইমু: না জানি উমাটা কোথায়।

সামু: ইমু আমার মনে হয় উমা আর নেইরে।আমার প্রচন্ড ভয় করছে।

লিয়া: এই‌ চুপ চুপ।

লিয়ার কথায় সবাই চুপ হয়ে গেলো।বাইরে কেউ হাটছে।ইমু ইদ্রিস চাচা বলার জন্য মুখ খুলতেই লিয়া ওর মুখ চেপে ধরলো।সামু থরথর করে কাপছে।লিয়া ইশারায় ওদের আওয়াজ করতে বারন করে ঘরে থাকা হারিকেনের আলোটা কমিয়ে দিলো।বিদ্যুৎ উমা চলে যাওয়ার কিছুক্ষন পরেই‌ চলে গেছে।

দরজার নিচ থেকে কারো ছায়া দেখা যাচ্ছে।খরম পায়ে কেউ শব্দ করে হাটছে।কয়েকবার দরজার সামনে থেকে পায়চারি করে হঠাৎ ছায়াটা ওদের দরজার সামনে স্থির হয়ে গেলো।আচমকা জোরে জোরে ওদের দরজা কেউ ধাক্কানো শুরু করলো।সামু ভয় পেয়ে ইমুকে জড়িয়ে ধরলো।লিয়াও দ্রুত ইমু আর সামুর কাছে এসে বসলো।দরজাটা মজবুত তাই সহজে ভাঙবেনা।কিন্তু তবুও ভয় ওদের ঘিরে আছে।হঠাৎ যেমন ধাক্কানো শুরু হয়েছিলো ঠিক তেমন হঠাৎই ধাক্কানো বন্ধ হয়ে যায়।ছায়াটাও যেন কর্পুরের মতোই উবে যায়।ওরা শান্ত হয়ে বসে।

কিছুক্ষন পরেই ইদ্রিস মিয়ার গলা পাওয়া গেলো।সাথে আবারও জোরেজোরে দরজা ধাক্কানো।

ইদ্রিস: আম্মু?আম্মু আপনারা ঠিক আছেন?আম্মু আমি ইদ্রিস মিয়া।দরজাটা খুলুন।এখন কোনো ভয় নেই।দরজা খুলুন।

লিয়া উঠে দরজা খুলতে গেলেই ইমু ওর হাত চেপে ধরলো।

ইমু: দরজা খুলবিনা।ইনি চাচা না।(ফিসফিসিয়ে)

ইমুর কথা শুনেই সামু জোরে বলে উঠলো

সামু: আপনি যে সত্যিই ইদ্রিস মিয়া তা কিভাবে বুঝবো?

ইমু সামুর মাথায় একটা গাট্টা মারলো।

ইমু: তোকে‌ কথা বলতে বলেছে?(ফিসফিসিয়ে)

ইদ্রিস: আম্মু আমিই ইদ্রিস।দেখে যান‌ উমা এসেছে।কিহলো দরজা খুলুন।

ওরা তিনজনই চুপ করে যায়।কিছুক্ষনের মধ্যেই উমার আওয়াজ পায় ওরা।

উমা: ইমু?দরজা খোল।দেখ আমি এসেছি।তোদের ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিলোনা।লিয়া,সামু কিরে দরজা খোল?

ইদ্রিস: আম্মুরা দরজা খুলে ওনাকে ভেতরে নিন।নয়তো যেকোনো সময় বিপদ আসতে পারে।রাতে ঘরের বাইরে থাকা উচিৎ হবেনা।উমাকে ভেতরে নিন।

উমা: কিরে ইমু?এতক্ষন তো কথা বললি এখন চুপ কেন?দরজা খোল।

ইমু: আপনি যেই হননা কেনো আপনি যে ইদ্রিস চাচা বা উমা না তা আমি বুঝে গিয়েছি।(দরজার সামনে এসে)

ওপাশ থেকে এক হিংস্র আওয়াজ এলো।সামু ভয়ে লিয়াকে জড়িয়ে ধরলো।

ওপাশ থেকে: খুব চালাক ভাবিস তুই‌ নিজেকে?কিন্তু এবার আর বাঁচতে পারবিনা।আগেরবার বেঁচে গিয়েছিলি ওই‌ অনুভবের জন্য।কিন্তু এবার তোকে কে বাঁচাবে?তোকে আমার কাছে ধরা দিতেই‌ হবে।(হিংস্রভাবে)

ইমু: কে আপনি?

ওপাশ থেকে বিদঘুটে হাসির আওয়াজ শোনা গেলো।

: তুমি সব ভুলে গেলেও আমি ভুলিনি সুন্দরী।তোমার সেই মনমাতানো রূপ,ভুবনভোলানো হাসি,মিষ্টি কন্ঠ কিছুই ভুলিনি।সব আগের মতোই আছে।শুধু ওই অনুভবটা নেই।তাই আমার রাস্তা একদম পরিষ্কার।তুমিতো আমার হবেই মৃন্ময়ি।(হিসহিসিয়ে)

ইমু: মৃ মৃন্ময়ি কে?

হঠাৎই আজানের আওয়াজ শোনা গেলো।

ওপাশ থেকে: এবার তুমি আমার হবে।নিজের সাথে মিশিয়ে নেবো তোমায়।তুমি নিজেকে সম্পূর্নভাবে আমার করে দেবে।আবার আসবো আমি।

আর কোনো আওয়াজ নেই।এখনো আজানের শব্দ কানে আসছে।দরজার সামনে ছায়াটাও‌ দেখা যাচ্ছেনা।ইমু ধপ করে দরজার সামনে মেঝেতে বসে পরলো।মাথাটা ঝিমঝিম করছে।

ইমু: কে মৃন্ময়ি?অনুভবটাই বা কে?আমি কে?দরজার‌ সামনে কে ছিলো?কি হচ্ছে এসব?কিভাবে বাঁচবো আমি?

ইমুর চোখ দিয়ে পানি পরতে শুরু করলো।লিয়া আর সামু ইমুকে তুলে বিছানায় এনে শুইয়ে দিলো।লিয়া ইমুর চোখ মুছে ইমুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।ইমু ঘুমিয়ে পরলে লিয়া আর সামুও ওর দুপাশে শুয়ে পরলো।



✳✳✳✳✳✳✳✳

সকালে ঘুম থেকে উঠেই আদ্র মায়ের কাছে গেলো।মা সোফায় বসে চা খাচ্ছেন আর পেপার পড়ছেন।আদ্র যেয়ে মায়ের পায়ের কাছে বসে পরলো।আসমা বেগম দেখেও না দেখার ভান করলেন।

আদ্র: মা?

আসমা:…..

আদ্র: কথা বলবেনা আমার সাথে?

আসমা: রত্না(কাজের মেয়ে) আমার শাড়িগুলো ছাদে দিতে বলেছিলাম।দিয়েছিলি?একটা কাজ ঠিক মতো করেনা।আমাকেই এখন ছাদে যেতে হবে।

আসমা বেগম উঠে চলে যেতে নিলেই আদ্র পেছন থেকে মাকে জড়িয়ে ধরলো।আসমা বেগম চুপ করে দাড়িয়ে রইলো।

আদ্র: মা এমন করো না প্লিজ।তুমি কথা না বললে আমি কিভাবে থাকবো বলো?আমার দিকটাও তো একটু বোঝো?

আসমা: ছাড়ো সাফওয়ান।আমার কাজ আছে।তোমার সাথে কথা বলার সময় আমার নেই।

আদ্র: তাই নাকি?তাহলে আমি গেলে আমাকে মিস করবেনা তাইনা?তাহলে আজই চলে যাই।তুমি এখানেই থাকো।

আসমা বেগম নিজেকে ছাড়িয়ে আদ্রের দিকে ফিরলো।

আসমা: তুই কি বুঝবিনা তুই‌ আমার জন্য কি?কেন এমন করছিস বাবা?

আদ্র: তুমি আমার কথা শুনছোনা মা।তোমার সুস্থতা আমার কাছে আগে।আমাকে এখানে একা রেখে তুমি লন্ডন যেতে চাওনা।কিন্তু তোমাকে যেতেই‌ হবে।তোমার কিছু হলে আমার কি হবে মা?তুমি বোঝোনা তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি?

আসমা: তাই বলে চলে যাবি?

আদ্র: মা তুমি লন্ডন থেকে আসো তারপর আমিও চলে আসবো এখানে আবার।কিন্তু তুমি না থাকলে বাসায় আমার ভালোলাগবেনা।এমনিতেই ঢাকাশহরের দমবন্ধ পরিবেশ ভালোলাগছেনা আর।

আসমা: তুই আসবিতো আমার কাছে আবার?(আদ্রের গালে হাত দিয়ে)

আদ্র: আসবো মা।আগে তুমি সুস্থ হয়ে ফিরে এসো।আমি বাবাকে বলেছি টিকিট বুক করতে।তুমি কালকেই যাচ্ছো লন্ডন।

আসমা: তোকে মিস করবো বাবা।

আদ্র: আমিও মা।(আসমাকে জড়িয়ে)

আসমা বেগম রাগ ভুলে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো।সানভির জারিফ দূরে দাড়িয়ে দেখছে ওদের।মুখে প্রশান্তির হাসি।তিনিও এগিয়ে গেলেন।

সানভির: বাহ্ বাহ্ এখন মাকে পেয়ে বাবাকে ভুলেই গিয়েছে।ভালোই আমি কে যে মনে রাখবে?

আদ্র: দেখছো মা তোমার বরটা কি জ্বলছে?এই রত্না,ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে আয়তো।

রত্না: কেন ভাই?কার কি হইছে?(ছুটে এসে)

আদ্র: তোর কাকা জ্বলে যাচ্ছে।

রত্না: কাকা?কই জ্বলতাছে?খারান এহনি বরফ আনতাছি।

সানভির: ওই‌ থাম।তুইও‌ শুরু করলি?

রত্না: আমি কি করলাম কাকা?ভাই তো কইলো আপনার জ্বলতাছে।আপনার কষ্ট হইতাছে?আমি বরং বালতিতে কইরা ঠান্ডা পানি লইয়া আই।

রত্নার কথায় আসমা আর আদ্র শব্দ করে হেসে দিলো।রত্না হা করে তাকিয়ে রইলো।

রত্না: হাসেন কেন আম্মা?ভাই কিতা অইছে?

আদ্র: আরে বোকা আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরেছি তাই বাবার হিংসে হচ্ছে।সেজন্য বললাম বাবার জ্বলছে।

এবার রত্নাও হেসে দিলো।

রত্না: আরে আগে কইবেন না ভাই?এই‌ জ্বলাতো এমনে কমবোনা।কাকারে ফ্রিজে ঢুকাইতে হইবো।আমগো বড় ডিপফ্রিজটায় ঢুকামু।খারান ওইডা খালি করি।আইচ্ছা কাকারে ওইখানে ঢুকান যাইবোনা?(ভাবার ভান করে)

আদ্র: হ্যা হ্যা খুব যাবে।চল আমি তোকে হেল্প করি।বাবার মাথা না ঢুকলে ঘার বাকিয়ে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখবো।নো প্রবলেম। তাও যদি জ্বলা কমে।

সানভির বাদে সবাই আরেক দফা হাসলো।

সানভির: আমাকে নিয়ে মজা হচ্ছে?দাড়া তোদের দেখাচ্ছি।

আদ্র আর রত্না ভো দৌড়।সানভিরও পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে।আর আসমা বেগম হাসতে হাসতে সোফায় বসে পরেছেন।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here