মায়াজাল,পর্ব-৩,৪
লেখনীতে : নুসরাত তাবাস্সুম মিথিলা
পর্ব-৩
‘ কীভাবে বুঝলে তুমি আমায় ভালোবাসো ? হতেই পারে আমি তোমার খানিকের মোহ। ‘
‘ না রূথিলা , বিশ্বাস করো আমি তোমার ব্যাপারে সিরিয়াস । ‘
‘ যেখানে কাউকেই বিশ্বাস করতে পারি না রূপ । তোমাকে করতে চাই , কিন্তু পারছি না । ‘
‘ কোনো চাপ প্রয়োগ করব না , তোমার যতটুকু সময় প্রয়োজন তুমি নিতে পার । তবুও আমায় ফিরিয়ে দিও না । ‘
‘ তুমি আমার ব্যাপারে কতটুকুই বা জানো রূপ । আমার ভয়ানক কালো অতীত জানলে তুমি আমায় পরিত্যাগ করবে , আমি নিশ্চিত । ‘
‘ তোমার জীবনের অতীত তো আমি অনেকটাই জানি । এর বাইরেও হয়তো তুমি আরো যন্ত্রণা পুষে রেখেছো । কিন্তু তার জন্য আমি তোমায় পরিত্যাগ করতে যাবো কেন ? ‘
‘ বিষয়টা তুমি যত সহজ করে ভাবছো ততটা সহজ নয় । খুব জটিল একটা বিষয় কিন্তু আমি এ সম্পর্কে তোমাকে কিছু বলতে এই মুহূর্তে চাইছি না । তবে জানবে হয়তো কোনো দিন কিন্তু… ‘
‘ কিন্তু কী রূথিলা ? আর সে যাই হোক আমার তোমাকে চাই । ভালোবাসি আমি তোমায় । প্লিজ ফিরিয়ে দিও না । ‘
‘ ভালোবাসতে পারি এক শর্তে । ‘
‘ বলো কি ? আমি তোমার যেকোন শর্তে রাজি আছি । ‘
‘ কখনো কোনদিন আমায় ঠকাতে পারবে না । ঠিক যেদিন তুমি আমায় ঠকাবে সেদিন আমার কালো অতীত সম্পর্কে জানতে পারবে । তবে সেদিনের পরিণতি তোমার বা আমার হাতের বাইরে । এর জন্য অবশ্য আমি বিন্দু পরিমাণ দায়ী থাকবো না । যদিও সেই পরিণতি সম্পূর্ণ অজানা । ‘
‘ আমি জানিনা এ তোমার কেমন শর্ত । তবে বিশ্বাস রাখো হতাশ করবো না তোমায় । একটু ভরসা করতে পারো । ‘
‘ দেখা যাক । চল বাড়ি ফিরতে হবে । ‘
‘ হুম চল আর উত্তরের অপেক্ষায় অপেক্ষারত রইলাম । ‘
খানিকটা প্রীতিকর হাসি হাসলাম আর কথা বাড়ালাম না । রূপককে আমি রূপ বলে ডাকি । ওর কথা-বার্তার ধরন , আচার-আচরণ সবটাই মনোমুগ্ধকর । যা যেকোনো মানুষকে বিমোহিত , শিহরিত , আন্দোলিত করতে সমর্থ । আমার ওকে খুব ভালো লাগে কিন্তু ভালো লাগাকে প্রশ্রয় দিতে আগ্রহী না । কেননা জীবনের অনেক নিষ্ঠুরতার সাক্ষী হয়েছি এই ২৩ বছরের জীবনে । তবুও কেন যেন রূপককে ফিরিয়ে দিতে মন সায় দিচ্ছে না আবার মস্তিষ্ক ঠিক উল্টো সংকেত দিচ্ছে । মন ও মস্তিষ্কের টানাপোড়েনে আমার অবস্থা জর্জরিত । এ কি দোটানায় পড়লাম , এমন চরম সিদ্ধান্ত হীনতায় আমি কখনো ভুগেছি বলে মনে পড়ছে না । ধ্যান ভাঙলো রূপের ডাকে ।
‘ রূথিলা পৌঁছে গেছি । ‘
‘ আসছি , সাবধানে ড্রাইভ করবে । বাসায় পৌঁছে জানাবে । ‘
‘ যথা আজ্ঞা রূথি পাখি । ‘
_______________
বর্তমানে ,
ঘুম ভাঙলো তার সাইরেনের বিকট শব্দে । এই কিছু পূর্বেই ঘুমিয়েছে সে , সারারাত জেগে থাকার কারণে মাথায় তীব্র যন্ত্রণা অনুভূত হচ্ছিলো । তাই যন্ত্রণা উপশমের জন্য সে একসঙ্গে দুটো ঘুমের ঔষধ খেয়ে নিয়ে ছিল সে । তাই সাইরেনের শব্দ শোনা সত্ত্বেও চোখ মেলতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে । কিন্তু এখন যেন তার সহ্যের সীমা অতিক্রম হয়ে কানে যেন তব্দা লেগে গেছে । বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুচকে চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল সে । আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় বসতেই তার কপাল কুচকে গেল । নিজের স্বপ্ন ভেবে সবটাই উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল সে , তাই চোখ কচলাতে শুরু করল । কিছুক্ষণ পর আবারো চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিল সে । নাহ এটা স্বপ্ন হতে পারে না সে নিশ্চিত । তাই আশেপাশে থাকা পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল সে ,
‘ কী হয়েছে ? আপনারা আমার ঘরে ঢুকলেন কি করে ? আর এভাবেই বা আমার ঘর তছনছ করে রেখেছেন কেন ? ‘
‘ এতোক্ষনে আপনার ঘুম ভাঙলো ম্যাডাম ? আপনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি হয়েছে । ‘
‘ কিসের ভিত্তিতে আপনারা আমায় গ্রেপ্তার করবেন ? ‘
‘ আপনার বিরুদ্ধে ৩টি খুন ও বেআইনি সরঞ্জাম মজুদের অভিযোগ রয়েছে । আপনার বাসায় আমরা একটি রক্তমাখা চাপাতি উদ্ধার করেছি । আমাদের কাছে যথেষ্ট সাক্ষ্য , প্রমাণ রয়েছে আপনার বিরুদ্ধে । এই যে এরেস্ট ওয়ারেন্ট । ‘
‘ চলুন তবে । ‘
‘ আপনি পালানোর বা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন না । ‘
‘ অবাক হলেন বুঝি । ‘
এইকথা বলেই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো সে । উপস্থিত সকল পুলিশ সদস্যরা এতে চরম অবাক হলেন কিন্তু কিছু বললেন না । এরপর মহিলা কনস্টেবল তার হাতে হাতকড়া পড়িয়ে তাকে পুলিশ-ভ্যানে উঠালো । ভ্যানটি ছুটে চললো গন্তব্যের দিকে । ঘটনাটি খবরে শিরোনাম হিসেবে প্রচারিত হচ্ছে । পুরো দেশজুড়ে এই ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করলো । সকলে ভীষণ অবাক এরকম একজন সুপরিচিত ব্যক্তি কর্তৃক এহেন জঘণ্য , ঘৃণীত কাজ কেউ প্রত্যাশা করে নি । দেশজুড়ে মানুষ সংগঠিত হতে থাকলো তার বিরুদ্ধে । সকলের এক দফা , এক দাবি – ‘ সুষ্ঠু বিচার করে উক্ত ব্যক্তিকে ফাঁসিতে ঝুলাতে হবে । ‘ কিন্তু আদতে কী ঘটেছিল তা কি কেউ জানতে চেয়েছে ? আসলেই কি উক্ত ব্যক্তি ফাঁসির উপযোগী অপরাধ করেছে ? আর তার বিরুদ্ধে হঠাৎই এহেন পদক্ষেপ কেন গৃহীত হলো ? এর পেছনে কি কোনো ষড়যন্ত্রের মায়াজাল বিছানো হয়েছে ?
_________
চলবে
মায়াজাল
৪র্থ পর্ব
লেখনীতে : নুসরাত তাবাস্সুম মিথিলা
আসামীকে ৪ দিনের রিমান্ড দিয়েছেন বিজ্ঞ আদালত । গ্রেপ্তারের পরদিনই তাকে আদালতে প্রেরণ করা হয় । সকল অভিযোগের ভিত্তিতে ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয় । তারপর থেকেই আসামীর ওপর নেমেছে অত্যাচারের স্ট্রিম রোলার । তাকে পেটাতে পেটাতে ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে বসে পড়ল মহিলা কনস্টেবল দিশা । এতো পেটানোর পরও একটা মানুষ কি করে মুখে তালা লাগিয়ে রাখতে পারে জানা নেই তার । যেখানে রিমান্ডে পুরুষ মানুষই আর্তনাদে চিৎকার করে জেল কাঁপিয়ে ফেলে সেখানে একজন মেয়ে হয়ে কীভাবে এখনো নিশ্চুপ থেকে সবটা হজম করে চলেছে কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না কনস্টেবল দিশার । এদিকে রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে পড়ে রয়েছে রূথিলা । কিছুক্ষণ পর সিনিয়র অফিসার সাগ্রত এলো । সে দিশার কাছে আপডেট জানতে চাইলে দিশা কোনো উত্তর দিতে পারলো না । তাই সাগ্রত বললো ,
‘ দিশা আপনি এখন আসুন এখান থেকে । আমি দেখছি বিষয়টি । ‘
‘ ওকে স্যার । ‘
এবার সাগ্রত এগিয়ে রূথিলার নিকটে গেল । এরপর ওকে উঠিয়ে চেয়ারে বসালো । রূথিলা সাগ্রতের সাহায্যে অনেক কষ্টে উঠে বসল । সারা শরীরজুড়ে তার অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে , দাঁতে ঠোঁট আঁকড়ে যন্ত্রণা নিবারণের ব্যর্থ চেষ্টা চালাতে ভুলেনি রূথিলা । খানিক নিরবতা পালনের পর সাগ্রত রূথিলাকে জিজ্ঞেস করলো ,
‘ আপনার নাম কী ? ‘
‘ আপনি জানেন না বুঝি ? ‘
‘ মিস কথা বাড়াতে চাইছি না , যা জিজ্ঞাসা করেছি তার জবাব দিন । ‘
‘ আমি আরজে আর.টি । ‘
‘ আমি আপনার পুরো নাম জানতে চেয়েছি সংক্ষেপে না । ‘
খানিকটা হেসে রূথিলা জবাব দিল ,
‘ রূথিলা তাবাস্সুম । ‘
‘ আপনি কেন সত্যি কথা বলছেন না ? ‘
‘ আমার কিছু বলার নেই । ‘
‘ আপনি এভাবে অপরাধের সাথে জড়ালেন কীভাবে ? ‘
‘ জানা নেই । ‘
‘ প্লিজ এমন করবেন না । ‘
‘ বলুন কী জানতে চান ? ‘
‘ আপনার অতীত সম্পর্কে । ‘
‘ বেশ তবে তাই হোক । ‘
__________
সেদিন রূপকের কথাটা বহুবার ভেবেছিলাম । আমি ৬দিন সময়ও নিয়েছিলাম । অবশেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম । আমিও অনুভব করতে সমর্থ হলাম যে – ‘ আমি ভালোবাসি আমার রূপককে । প্রচণ্ড পরিমাণে ভালোবাসি । ‘ তারপর একদিন ওর দেয়া সময় শেষ হলো । আমরা দেখা করলাম একটি রেস্টুরেন্টে ।
‘ রূথি পাখি কী সিদ্ধান্ত নিলে দীর্ঘ ৭ দিন , ১৬৮ ঘণ্টা , ১০০৮০ মিনিট , ৬০৪৮০০ সেকেন্ড চিন্তা করার পর । ‘
‘ রূপ আমি রাজি তোমার প্রস্তাবে , ‘ খানিকটা লাজুক হেসে বললাম ।
‘ সত্যি বলছো তো ? ‘
‘ হুম । ‘
‘ চলো আমরা কালকেই বিয়েটা সেরে ফেলি । তারপর দুজনে চুটিয়ে প্রেম করবো । ‘
‘ এই আস্তে কথা বলো , সবাই আমাদের দেখছে । ‘
‘ দেখুক, দেখতে দাও । বলো তুমি কী রাজি ? কথা ঘুরাবে বা প্যাঁচাবে না । শুধু বলো হ্যাঁ বা না । ‘
‘ হ্যাঁ । আমি তোমার প্রস্তাবে রাজি । ‘
‘ আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে রূথিলা বলে বোঝাতে পারব না । ‘
‘ হয়েছে এখন থামো । ‘
পরদিন সকালে ,
‘ রূপক পাগলামি করো না । এখন আমার ক্লাস আছে তারপর দুটো টিউশন আর বিকেলে শো আছে । সন্ধ্যায় আবার বিয়ে । এখন আমি তোমার সাথে দেখা করতে পারব না । রাতে আমায় মন ভরে দেখো । ‘
‘ বেশ তবে তাই হবে । আজ সারারাত তোমায় দেখব । ‘
‘ আচ্ছা এখন রাখি কাজ আছে অনেক । ‘
‘ আমার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ । ‘
‘ আহা রাগ করছো কেন ? বোঝার চেষ্টা কর । ‘
‘ আচ্ছা রাগ করবো না । ‘
সেই সন্ধ্যায় আমি বিয়ের সাজে নিজেকে সাজিয়ে ছিলাম । খুবই অনাড়ম্বরভাবে আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল । যেহেতু আমাদের পরিবার বলতে কেউ নেই । কিছু বন্ধু-বান্ধব , কিছু পরিচিত জন , আর রূপকের খালামনি ও তার পরিবারের উপস্থিতিতে আমাদের বিয়েটা সম্পন্ন হয় ।
______________
‘ কী হলো থামলেন কেন ? তারপর ? ‘
‘ আমি পানি খাব । শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে । ‘
‘ দিশা তাড়াতাড়ি এখানে আসুন । ‘
দিশাকে ডাকার সাথে সাথেই সে ছুটতে ছুটতে উপস্থিত হলো এবং বলে উঠলো ,
‘ স্যার কিছু হয়েছে ? কোনো দরকার ? ‘
‘ ওনার বোধহয় কষ্ট হচ্ছে আপনি সাহায্য করুন , পানি খাওয়ান । আমি আসছি , প্রয়োজন হলে আমায় ডেকে নেবেন । ‘
‘ জ্বী , স্যার । ‘
দিশা ৩ বছর যাব্ৎ সাগ্রতের সাথে কর্মরত । কখনো কারো প্রতি এতো যত্নবান বা কোমল আচরণ করতে দেখে নি । বিষয়টি দিশাকে বেশ অবাক করল ।
_________
চলবে