মায়াবন_বিহারিনী🖤 #পর্ব_২৫,২৬

#মায়াবন_বিহারিনী🖤
#পর্ব_২৫,২৬
#আফিয়া_আফরিন
২৫

কক্সবাজার থেকে ইমন মায়ার আজকেই ফেরার কথা ছিলো। কিন্তু ইমন বেঁকে বসলো। বললো “ভালই তো লাগতেছে এখানে। আর দুই এক দিন কাটিয়ে যেতে পারলে তো কোন সমস্যা নাই। রোজ রোজ তো আর আসি না, আসছি যখন একেবারে কয়েকদিন ইচ্ছা মত বেরিয়ে তারপর যাবো।”

মায়া আর কিছু বলে নাই। ইমনের মতে সায় দিলো। বাসায় ফোন দিয়ে জানালো ফিরতে আরো দুই দিন লেট হবে।

সকালবেলা খাওয়া-দাওয়া শেষ করে দুজনে নিচে নামলো। পাশেই ঘন বাগান জাতীয় একটা জায়গা দেখে, মায়া বললো, “যাবে ওখানে?”

“কি দরকার সাপ গ্রুপের আড্ডার মধ্যে যাওয়ার? এখান থেকে তো বোঝা যাচ্ছে না ভিতরে কি নাকি আছে!”

“আচ্ছা।”

এমন সময় অঞ্জু নামের সেই মেয়েটি মায়া কে পেছন থেকে ডাক দিলো, “হায় আপু।”

মায়া উল্টো দিক ফিরে তাকালো। অন্জুকে দেখে হাসি দিলো। সেও পাল্টা হাসি দিলো। আজকে বোধহয় সাথে তার মাও আছে। সমুদ্রের তীর ধরে হেঁটে যাচ্ছে তারা। সমুদ্র থেকে কিছুটা দূরে পাহাড়ি উপত্যকায় তাদের বাড়ি।

মায়া ইমন এর দিকে তাকিয়ে বললো, “বাচ্চা টা কি কিউট, তাইনা?”

ইমন আড় চোখে তাকিয়ে বললো, ” আমি ছাড়া দুনিয়া শুদ্ধে সবাই তোর কাছে কিউট।”
.
.
মায়া আর ইমন সমুদ্রের তীর ধরে অনেকক্ষণ যাবৎ হাঁটলো। গত পাঁচ দিনে মায়ার ভয়টা একটু কমে এসেছে। সে নিজেই সমুদ্রের পানিতে পা ভেজাতে যায়। একটু দূরে গিয়ে আবার তীরে ফিরেও আসতে পারে।

বিকেলবেলা মায়া আর ইমন বিচ চেয়ারে বসে ডাবের পানি খাচ্ছিলো। এমন সময় তারা একটা মহিলাকে এদিকে আসতে দেখলো। মহিলাটি হন্তদন্ত হয়ে কাকে যেন খুঁজছে। মায়ার কাছে মহিলাটিকে অতি পরিচিত মনে হলো। তারপর হঠাৎ মনে পড়লো, অঞ্জুর সাথে সকালবেলা এই মহিলাটা কেই দেখেছিল মায়া। ইনি সম্ভবত অঞ্জুর মা।

মহিলাটি হন্তদন্ত হয়ে ইমন আর মায়ার সামনে এসেই থামলেন। জিজ্ঞেস করলেন, “আপা আপনারা এনে ছোট একটা মাইয়ারে দেখতে পাইছেন? এই ধরেন এগারো বারো বছর বয়স।”

মায়া বললো, “অন্জু!”

তিনি কিছুক্ষণ বিষ্ময় নিয়ে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “আপনি আমার মাইয়াডারে চেনেন?”

“জি চিনি। কিন্তু কি হয়েছে অঞ্জুর?”

“দুপুর থেকে খুঁইজা পাইতাছি না আমার ছোট মাইয়াডারে।”

“কোথায় যাবে আর? আশেপাশেই আছে। সকালবেলাই তো দেখলাম ওরে সাথে আপনাকেও।”

মহিলাটি কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করলেন। তারপর মনে পড়তেই বললেন, “ও আপনিই ছিলেন। অঞ্জু কাইল রাইতে আপনার কথা আমারে কইছিলো। আপনি নাকি ওর লগে বালু লইয়া খেলছিলেন।”

“জী।”

“কিন্তু ওরে খুঁইজা পাইতাছিনা‌। আচ্ছা থাকেন আপা, দেখি খুঁইজা পাই কিনা।”

বলেই তিনি চলে গেলেন। মায়া অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। আহা! মেয়েটার জন্য তার কত চিন্তা।

ইমন মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “চল ফিরে যাই আমরা।”

মায়া একটু আনমনা হয়ে বলল, “আচ্ছা অঞ্জু কোথায় যেতে পারে বলোতো?”

“আমি কিভাবে বলবো?”

“তাও ঠিক। আচ্ছা চলো, আমরা একটু খুঁজে দেখি।”

“আমরা খুঁজবো?”

“হ্যাঁ। প্লিজ চলো। মেয়েটা না অনেক ভালো। কাল কি সুন্দর আমার সাথে গল্প করছিলো। যদি ওর কোন বিপদ আপদ হয়। প্লিজ প্লিজ চলো।”

ইমন মায়ার অনুরোধ ফেলতে পারল না। তাই বলল, “আচ্ছা চল।”

মায়া আর ইমন আশেপাশে অনেক খুঁজলো। কিন্তু কোথাও পেলো না। অঞ্জুর কোন ছবি ও নাই তাদের আছে, যে ছবি দেখিয়ে খোঁজ করবে। এভাবে হাওয়ার উপর কি কখনো কাউকে খোঁজা যায়, নাকি কারো খোঁজ পাওয়া যায়?

হতাশ হয়ে ইমন আর মায়া ফিরে এলো। মায়া রুমে এসো মন খারাপ করে বসে রইলো। ইমন ওর এক হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে এসে বলল, “কি হলো? এমন মুখ কালো করে আছিস কেন?”

“আমার না অঞ্জুর জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে।”

“আচ্ছা? ওকি তোর মায়ের পেটের বোন লাগে, যে এত চিন্তা করতে হবে? এতক্ষণ দেখ, ওর পরিবারের মানুষজন ওকে হয়তো পেয়েও গেছে। তুই অযথাই চিন্তা করে মাথা খারাপ করছিস।”

“পেয়ে গেলে তো ভালই। আচ্ছা চলো না, আমরা ওর বাসায় যাই। একটা খোঁজ তো অন্তত নিয়ে আসি। গতকাল ওর কাছে ওর বাসার এড্রেস শুনেছিলাম। বাকিটা না হয় মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করতে করতে যাব।”

“খবরদার মায়া। রাত হয়ে গেছে। মাথা থেকে এই ব্যাপার একদম সরিয়ে ফেল। এটা আমাদের জন্য একদম নতুন জায়গা। এখানে কে কি রকম আমরা কি তা জানি? এত রাতে বের হবি মানে কি? কত রিক্সের ব্যাপার থাকে, বুঝিস তুই?”

মায়া আর কিছু বলল না। একদিক দিয়ে ইমনের কথা তো ঠিকই।

ইমন দুটো হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, “দেখ ওরা তো এখানে, এই পরিবেশে থেকে বড় হয়েছে। সবটাই ওদের চেনা জানা। অঞ্জু নিশ্চয়ই এতক্ষণে বাসায় ফিরে এসেছে।”

“আচ্ছা।”

ইমন মায়ার মুখটা দুহাতে তুলে বলে, “কি? মন খারাপ এখনো?”

“নাহ।”

“মন খারাপ করে কি লাভ বল?”

“কোনো লাভ নেই।”

“তাহলে?”

মায়া এবার ইমনকে নিজের থেকেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “কিছু না।”

মায়া এবার আচমকাই ইমনের শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলে, গলার একটু নিচের দিকে জোরে একটা কামড় বসায়।

“ওরে বাবারে বাবা! কি করলি কি?”

“দেখলেই তো কি করলাম।”

“বিড়াল তুই?”

“মন চাইলো তাই একটা কামড় দিলাম। এর জন্য বিড়াল হতে হবে কেন?”

“আচ্ছা, আমিও পাল্টা একটা দেই।”

“উহু, একদম না।”

“কেন? তুই দিতে পারলে আমি কেন পারব না?”

“পারবেনা, কারন আমি তোমার বউ।”

“এটা বউয়ের নমুনা?”

“ব্যথা করছে?”

“ব্যথা করলেই কি, না করলেই কি? কেউ তো আর কষ্টটা বোঝেনা।”

“আচ্ছা, তাহলে আরেকটা কামড় দেই?”

“এই এই, খবরদার না। মেরে ফেলবে নাকি?”

“তোমাকে এখন একটা খামচি মারতে ইচ্ছা হচ্ছে। মারি একটা খামচি?”

“উহু! কি শুরু করছিস? মাথা গেছে নাকি? কাল রাতে তো ঘুমাসনি বোধ হয়, ওই জন্যই মাথা হ্যা’ং মারছে। তোর এখন ঘুম দরকার। যা গিয়ে শুয়ে পড়।”

“তুমি ঘুমাবে না?”

“আসছি আমি। তুই যা আগে।”

“না। আমি তোমাকে ছাড়া ঘুমাতে যাবো না। তোমাকে সাথে করে নিয়েই যাব। চলো চলো।”

“এমন পাগলামি করছিস কেন তুই? কি হইছে?”

“কিছু না। তুমি চলো।”

ইমনের কেমন জানি অদ্ভুত লাগলো মায়ার এই ব্যবহার। আর যাই হোক, মায়া তো কখনো নিজে থেকে এমনটা করে না।

মায়া মুচকি হেসে এক দিকে হেলে বলল, “কি হলো যাবে না আমার সাথে? কেন যাবেনা? আমি কি এতটাই খারাপ? আচ্ছা থাক, আমার সাথে তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। আমি একাই চলে যেতে পারবো।”

ইমন তখন ব্যাপারটা ধরতে পারলো। শোন বিকেলের দিকে ডাবের পানি খাওয়ার আগে পাহাড়ী ভা’ং নামক এক ধরনের পানীয় পান করেছিল। সম্ভবত তাতেই মায়ার নেশা হয়ে গেছে। যেটার ইফেক্ট এখন শুরু হয়েছে। এজন্যই তো এমন সন্দেহমূলক আচরণ করছে।

সে মায়াকে একহাতে জড়িয়ে ধরলো। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ঘুমে চোখ টলমল করছে। ইমন ওকে নিয়ে লাইট অফ করে দিয়ে, বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো। তারপর চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলো।

মায়া ইমন এর বুক থেকে মুখ তুলে বললো, “তুমি খুব পঁচা। তুমি আমায় একটুও আদর করো না।”

ইমন ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে হেসে ফেললো। এই মেয়ে বলে কি? মাথা বোধহয় একেবারেই গেছে।

মায়া আবার বলে উঠলো, “তুমি কেন আমায় একটুও ভালোবাসো না?”

“ভালোবাসি তো।”

মায়া এইবার উঠে বসে মুখ ঘুরালো।
“না। তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না, আমি জানি।”

ইমন ও উঠে বসে বলল, “তাই? কিভাবে জানলি?”

“সব কি তোমাকে জানাতে হবে নাকি?”

ইমন হেসে ফেলল। বলল, “তোকে যে আমি কি পরিমাণ ভালোবাসি সেটা তুই আন্দাজ ও করতে পারবি না!”

তারপর কপালে ছোট্ট করে একটা চুমু এঁকে দিল।

“আচ্ছা যাই হোক, এখন এত কথার সময় নয়। তোর ঘুম দরকার। কিনা কি খেয়ে বসে আছিস? তার জন্য কি পাগলামি? আর স্বাভাবিক থাকলে ধারে কাছে ঘেঁসতে ও কত কাহিনী, কত লম্প ঝম্প পর্যন্ত করা লাগে।”

ইমন মায়াকে শুইয়ে দিলো। তারপর নিজেও এক পাশে শুয়ে পড়লো।
ইমন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “নে, এখন ঘুমিয়ে পড়।”

মায়া ওকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে পড়লো। ইমন অনেক রাত পর্যন্ত জেগে রইল, মায়ার চুলে বিলি কেটে দিল। এক সময় নিজেও ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো।
.
.
রাতে ঘুমটা দুজনেরই খুব ভালো হলো। ঘুম ভাঙলো প্রায় সকাল দশটার দিকে। ঘুম ভেঙ্গে মায়ার আর রাতের কথা কিছুই মনে ছিল না। ইমন ও কিছু বললো না। বললেই লজ্জা পাবে। কি দরকার?

মায়ার হঠাৎ মনে পড়ে গেল অঞ্জুর কথা। মেয়েটাকে আদৌও বাড়ি ফিরছে। একবার খোঁজ নেওয়া দরকার। ইমনকে বললে যে কি বলে?

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ইমন ঘরে এসে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে বসলো।

মায়া তখন এসে বলল, “আমরা তো কালই ফিরে যাব। চলো না, আজকে ওই দিক থেকে একটুখানি ঘুরে আসি।”

“আচ্ছা যাব। একটু পর যাচ্ছি।”

“কখন?”

“বারোটার পর বের হই। বাইরে রোদ এখন।”

“আচ্ছা।”

মায়া উঠে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। সমুদ্রের পানি দেখতে ভালো লাগছে। সমুদ্রের আবার জোয়ার এসেছে।
পানির ঢেউয়ের কল কল আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
আশপাশ থেকে মাটির সোঁদা গন্ধ ভেসে আসছে। গাছ পালার শেঁওড়া গন্ধ থেকে থেকে পাওয়া যাচ্ছে। সব মিলিয়ে কেমন অদ্ভুত লাগছে। আর ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে, এই সমুদ্র কে কাল তারা বিদায় জানিয়ে ফিরে যাবে তাদের নিজেদের গন্তব্যে।

বেলা গড়িয়ে পড়লে ইমন আর মায়া বের হয়। মায়ার উদ্দেশ্য, সে অঞ্জু দের বাড়ি যাবে। কিন্তু ইমনকে এ কথা বলে নাই। বলেছে, আশেপাশে ঘুরতে যাবে।

তাদের অ্যাপার্টমেন্টের পেছনদিকে সমুদ্রের পার ঘেঁষে অদূড়ে ছোট্ট একটা গ্রাম আছে। ওখানেই সম্ভবত অন্জুদের বাড়ি।

উপত্যকা জাতীয় এক ধরনের এলাকা। উঁচু-নিচু পথ। পাথর বিছানো রাস্তা। এমন রাস্তায় যাদের হেঁটে অভ্যাস নাই, তাদের মিনিটে মিনিটে আছার খাবার সম্ভাবনা আছে। মায়ার অবস্থাও তাই হচ্ছে।

ইমন এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বলল, “কি হচ্ছে কি? জানিস ই তো এই জায়গাটা এমনই। আসতে গেলি কিসের জন্য?”

“তুমি আগে যাও। আমার হাত ধরে তোমার হাঁটতে হবে না। আমি একাই পারবো।”

“হ্যাঁ কত পারো তো তুমি? আছার একটা খাইয়া, মুখ থুবড়ে পড়ে থাকলে বুঝবি কেমন লাগে?”

আরো কিছুদূর আগাতেই নারিকেল পাতার ছাউনি দেওয়া কয়েকটা বাড়ি দেখতে পেল ওরা।

ইমন জিজ্ঞেস করল, “আর কোথায় যাবি?”

মায়া কিছু বলল না। ইমনের হাত ধরে সামনে এগিয়ে গেল। কিছুদূর গিয়ে একটা ছোট ছেলেকে চোখে পড়ল। মায়া তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এখানে অঞ্জু নামে কাউকে চেনো?”

ইমন অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালো। তারমানে সে অঞ্জুদের বাসায় এসেছে। তাকে বললে কি হতো? গতকাল রাতে যেতে মানা করেছে, বলে কি এখনো মানা করত নাকি? আজব তো?

সামনে থাকা ছেলেটি বললো, “কেডা আপনারা?”

“আমাদের তুমি চিনবে না। অঞ্জু নামে কাউকে চেনো কি?”

“হয় চিনি।”

“সত্যিই! ওদের বাসাটা দেখিয়ে দিবে আমাদের।”

“কি করবেন?”

“কাল শুনছিলাম মেয়েটাকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। তাই খোঁজ নিতে আসছিলাম।”

“হে আমার বোন।”

মায়া কিছুটা অবাক হলো। পরক্ষণেই মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “ও তাই। তাহলে চলো, নিয়ে যাও তোমাদের বাড়িতে। তোমার বোনকে ফিরছে?”

“হু। আইজ সকালেই ফিরছে। সে তো তার এক বন্ধুর বাড়ি ছিল।”

“ও। তোমার মা অনেক খুঁজছিল ওকে।”

“শুধু খুঁজে নাই। অনেক কান্নাকাটিও করছে।”

“তোমার নাম কি?”

“পার্বত।”

“সুন্দর নাম।”

পার্বত ইমনকে দেখিয়ে বলল, “হে কি আপনার ভাই লাগে?”

মায়া মুখ টিপে হাসলো। ইমন আড় চোখে তাকালো ওদের দিকে।

মায়া বলল, “ওরে কি আমার ভাই মনে হচ্ছে? ওর সাথে কি আমার চেহারার মিল আছে?”

“একটু একটু মিল দেখা যাইতাছে।”

মায়া হাসতে হাসতে বলল, “আগে ভাই ছিল। এখন আর ভাই না।”

হাঁটতে হাঁটতে তারা কিছুক্ষণের মধ্যে অঞ্জুদের বাড়ি চলে এলো। এই বাড়িটা ইটের কিন্তু উপরে নারকেল পাতার ছাউনি দেওয়া। অঞ্জুকে দেখতে পেল দাওয়ায় তার মায়ের কোলে বসে আছে।
মহিলাটির সম্ভবত সারারাত ঘুম হয়নি। বিধস্ত চেহারা। অবশ্য ঘুমাবেই বা কেমনে?
অঞ্জু মায়াকে দেখল। তার মাও দেখল।

মায়ার সামনে এসে কাঁদো কাঁদো মুখে বললো, “মাইয়াডারে পাইয়া পরানডা একদম জুড়াইয়া গেছে। আজ সকালে ফিরছে। ওর লগে এক বন্ধুর বাড়িতে আছিলো। কিন্তু আপনারা এনে?”

“অঞ্জুর খোঁজ নিতে এলাম।”

মহিলাটি হেসে ফেললেন। ইমন আর মায়াকে বেতের মোড়া পেতে বসতে দিলো। অনেকক্ষণ গল্পগুজব করলো ওরা। বেশিরভাগ কথাই তার পার্বত আর অঞ্জু কে নিয়ে।

মায়া হঠাৎ করেই মনে মনে ভাবতে লাগলো, অঞ্জুর মা অঞ্জু আর পার্বতকে নিয়ে কত ভাবে। তাদের কতটা ভালোবাসে।নিজের সন্তানদের ভালোবাসা ছাড়া, ভালো রাখা ছাড়া বোধহয় তার জীবনে দিত্বীয় আর কিছুই নেই।

আচ্ছা, তার যখন ছেলেমেয়ে হবে, সেও কী এমন উতলা হয়ে যাবে? মায়া একবার আড়চোখে তাকালো ইমনের দিকে। মুহূর্তেই লজ্জায় লাল রাঙা হয়ে গেলো মুখখানি। মনে মনে নিজের মাথায়, নিজেই দুটো বারি দিলো। সবেমাএ, বিয়ে হয়েছে এর মধ্যে ছেলেমেয়েদের কথা ভাবতে শুরু করে দিয়েছে। ভাগ্যিস মনের ভেতর টা দেখা যায় না। তাহলে তো সে ইমনের সামনে বোধহয় লজ্জা ঠেলায় আর কোনদিন আসতেই পারতো না।
.
.
.
.
চলবে….

[ কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ ]

#মায়াবন_বিহারিনী🖤
#পর্ব_২৬
#আফিয়া_আফরিন

পরদিন তারা ফিরে এলো ঢাকায়। শুরু হয়ে গেল আবার তাদের কর্মব্যস্ত জীবন, পড়ালেখা, কাজ। সব মিলিয়ে দিন খারাপ যাচ্ছে না, আবার খুব ভালো ও যাচ্ছে না। এই আর কি মোটামুটি পর্যায়ে! জাহানারা বেগম আর আমজাদ সাহেব এখনো ঢাকায় আছেন। তবে ২-১ দিনের মধ্যে ফিরে যাবেন তাই মায়া আর ইমনকে বলল, দুই দিনের জন্য যেন এখানে এসে থেকে যায়।

তারা আর কেউ অমত করলো না।
সকাল সকাল রেডি হয়ে চলে এলো।
ইমন আর মায়া তাদের বিয়ের পর, এই প্রথম এলো এই বাসায়। দুজনকে একসাথে দেখে ওই বাড়ির সকলে প্রচন্ড খুশি। সবচেয়ে বেশি খুশি বোধয় হলেন মায়ার খালামণি ইলারা। তিনি তো এক কথায় বলতে গেলে ইমনকে একেবারে জামাই আদর করলেন। অবশ্য ঘুরেফিরে তো জামাই ই হচ্ছে।

মায়াকে বললেন, “ইমনের সাথে বিয়ে করে একটা কাজের কাজ করেছিস। তোদের দুজনকে একসাথে দেখে ভালোই লাগতেছে। মানাইছে বেশ।”

ওরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।
.
.
ইলারা রাতের খাবার তৈরি করছিলেন। ওই সময় মায়া এলো রান্না ঘরে। তিনি মায়া কে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “জামাই কি চা খাবে এখন? চা বানিয়ে দিব?”

মায়া কিছুক্ষণ হা হয়ে তাকিয়ে থাকলো। তারপর হাসতে হাসতে বলল, “চা না হয় পরে দিও। কিন্তু তুমি ওকে জামাই জামাই করছো কেন?”

“জামাই মানুষ সে, তাকে কি বলবো?”

“কেন আগে তার নাম ধরে ডাকতে না। এখনো তাই ডাকবে।”

“আগে কি ও জামাই ছিল? জামাই যখন হয়েছে, জামাই ডাক তো শুনতেই হবে।”

“দেখো তোমাদের মুখে জামাই ডাক শুনলে ও নিজেই লজ্জা পাবে।”

“লজ্জা পাবে আবার কি কথা?”

মায়া হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। খালামনির মুখে জামাই ডাকটা বেশ হাস্যকর শোনাচ্ছে।
মায়া হাসতে হাসতে বলল, “যা ইচ্ছা হয় ডাকো। আর কি তাতে?”

মায়া চলে গেলো।
.
.
ইলারা অনেকক্ষণ ধরে রাতের খাওয়ার জন্য সবাইকে ডাকছেন। কিন্তু কারো কোন পাত্তা নেই, অর্থাৎ কেউ বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না। মায়া আর ইমন এখানে আসছে শুনে তার দুই মেয়ে এবং জামাইও চলে এসেছে। তারা সবাই মিলেই গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসেছে, যেহেতু অনেকদিন পর দেখা। শেষমেষ ইলারা রুমে গিয়ে সবাইকে ডেকে নিয়ে এলেন।

ইমনকে গিয়ে বললেন, “জামাই তুমি খেতে এসো।”

ইমন হা হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “হ্যাঁ যাচ্ছি।”

ইমনের মুখের অবস্থা দেখে সবাই হেসে ফেলল। রাতে সবাই খাওয়া-দাওয়া শেষে ছাদে উঠলো। খোলা আকাশ, জোছনার আলো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এক সাইডে সবাই গোল হয়ে বসে পড়ল।

ইমন আর মায়া একসাথেই বসলো। গল্প করার কোনো এক ফাকে ইমন মায়ার দিকে হেলে বলল, “যাবি না?”

“কোথায়?”

“ঘরে।”

“এখানে সবাই বসে গল্প করছে, আমরা অযথা ঘরে গিয়ে কি করবো?”

“ঘরে গিয়ে কি করবো সেটা তো আর এখানে বলা যাচ্ছে না, ঘরে চল তারপরেই দেখিস।”

“ফাজিল কোথাকার! আমি যাব না। তুমি গেলে যাও, গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। কেউ তোমাকে ডিস্টার্ব করবে না।”

“তোকে ছাড়া?”

“হ্যাঁ। একদিন আমাকে ছাড়া থাকলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হবে তোমার?”

“হ্যাঁ, শুধু মহাভারত কেন? ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আমেরিকা সব অশুদ্ধ হবে।”

“হোক!”

ইমন বুঝলো মায়া যাবে না। তাই চুপ করে গেল। কথা বললেই অযথা কথা বাড়বে। কি দরকার কথা বাড়ানোর?

সে দুই হাত ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। আজ বোধহয় পঞ্চমীর চাঁদ উঠেছে। জোছনার আলো ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ইমন মায়ার দিকে তাকালো, খিল খিল করে হাসছে মেয়েটা। এতঝ হাসি হাসি কোথা থেকে? এমন উচ্ছ্বাসময় হাসি হেসে বুকের ব্যথা ধরানোর কোন মানে হয়?

ইমনের মাথায় একটা দুষ্টু আইডিয়া এলো। সে নিজের এক হাত পেছন দিক দিয়ে ঘুরিয়ে, মায়ার কোমরে হাত রাখলো। ইচ্ছা ছিল শুধুমাত্র ফাইজলামি করার।
কিন্তু সেটা হলো না। মায়া বুঝতে পারে নাই, এটা ইমনের হাত। তাই সে চিৎকার করে লাফ দিয়ে উঠে গেল। ইমন সাথে সাথে হাত সরিয়ে নিল। উপস্থিত সবার দৃষ্টি মায়ার দিকে। সবাই জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছে।

ইমন ও উঠে দাঁড়ালো। মায়ার খালাতো বোন মিলা বলল, “কি হলো? চিৎকার করলি কেন এভাবে?”

ততক্ষণে বিষয়টা মায়ার বোধগম্য হলো। এখানে তো আর সেটা বলতে পারবে না।
তাই বলল, “বুঝলাম না। তেলাপোকা ছিল মনে হয়।”

“ওহ।”

ইমন বললো, “তেলাপোকা না। দেখ কোন গলা কাটা ভূত নাকি?”

মায়া ভয় পেয়ে আশেপাশে তাকালো। তার আবার ভূতে এলার্জি আছে।
মায়া রিঅ্যাকশনে সবাই হেসে ফেলল। বললো, “যা ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। অনেক রাত হয়ে গেছে।”

তারপর সবাই নিজেদের ঘরে চলে এলো। ইমন ঘরে এসে লাইট অফ করতেই মায়া বলে উঠলো, “প্লিজ, লাইটটা আজকে অফ করোনা। ভয় লাগে, ভুত আছে মনে হয় এখানে।”

ইমন ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, “কারে ভয় লাগে? আমারে নাকি ভূতেরে?”

“ইশশশ, তোমাকে কেন ভয় লাগবে? ভূত।”

“লাইট অফ করি।”

“একদম না প্লিজ। তোমার দোহাই লাগে। এই বাড়ির পেছনে কেমন শুনশান জঙ্গল। বাবারে বাবা, আজকে রাতে আমার আম্মুর সাথে থাকা লাগতো।”

“যা এখন।”

“চুপ থাকো। এখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। তুমি দয়া করে কথা না বাড়িয়ে গিয়ে শুয়ে পড়ো।”

“লাইট জালানো থাকলে আমার ঘুম আসে না।”

“তাহলে জেগে থাকো।”

“রাত জেগে ঝগড়া করিস না তো। এমনিতেই ঘুম ধরছে। মাথা ব্যথা করতেছে।” বলেই এমন লাইট অফ করে এসে শুয়ে পড়লো।
মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “খবরদার আলো জ্বালাবিনা।”

মায়া মুখ গোমড়া করে এসে পাশে শুয়ে পড়ল। মায়ার অবস্থা দেখে ইমন মুখ টিপে হাসছিলো। ফোন বের করে একটা ভূতের সাউন্ড মৃদু ভলিউম এ চালিয়ে দিলো।
মা ততক্ষণে ওই দিক ফিরে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই সাউন্ডটা কানে যেতে হালকা নড়েচড়ে উঠলো।
ইমন যখন বুঝতে পারল মায়া ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন সে ফোনের সাউন্ড টা অফ করে দিল। এই রাতের বেলা অযথাই ভয় দেখিয়ে হার্ট অ্যাটাক করানোর কোন মানেই হয় না। পরে তার কপালে এসব দুঃখ এসে উজাবে।
.
.
.
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সবাই ফটাফট নাস্তা করে নিল। মায়ার খালাতো বোন শিলা প্ল্যান করলো, সবাই যেহেতু একসাথে হয়েছে অনেকদিন পর; তাই একটু পিকনিকে যাবে।
ইমনকে বললে, সে জানিয়ে দিলঝ সে যাবে না। তার নাকি যেতে ইচ্ছা করছে না।

মিলা ইমনকে গিয়ে বলল, “এই ইমন ভাই, এসব আবার কি কথা? শা’লি দের কথা শুনতে হয়। আমাদের সাথে যেতেই হবে তোমাকে।”

“তোমরা যাওনা তোমাদের বর দেরকে নিয়ে।”

“আমরা তো আমাদেরই বর দের নিয়েই যাবো। জামাইকে ছাড়া কি কখনো আমরা যাবো? কিন্তু মায়া, ও কেন ওর জামাইকে ছাড়া যাবে? আমরা নিজেরা নিজেরা আনন্দ করবো, ও কি চেয়ে চেয়ে দেখবে?”

“দেখুক সমস্যা কোথায়। কিন্তু আমি কোথাও যাচ্ছি না। ফাইনাল ডিসিশন জানিয়ে দিলাম।”

“নিষ্ঠুর তুমি একটা।”

ইমন যাবে না শুনে ইলারা ও মেয়ে আর জামাইদের কোথাও যেতে দিলেন না। বললেন, “বাসায় যে আমি কষ্ট করে রান্না বান্না করি, তা তোদের ভালো লাগেনা? আদারে বাদারে সারাদিন ঘোরাঘুরি করে কি সব ছাই’পাস খাস?”

শিলা মুখ গোমরা করে উত্তর দিল, “কে বলেছে তোমায় বাসায় রান্নাবান্না করতে?”

“চুপ। দেবোনা কানের নিচে এক থাপ্পর।”

শিলা চুপ করে গেল। এভাবে নিজের জামাই, বোন জামাইদের সামনে মা থাপ্পড় দিলে লজ্জার আর শেষ থাকবে না।

তবে প্ল্যান একেবারে বিফলে যায়নি তাদের। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর অন্য আরেকটা প্ল্যানে গেল। বিকালে মোড়ের মাথায় করিম চাচার স্পেশাল ফুচকা আর পানিপুরি খেতে যাবে।
বিকালের প্ল্যানে ইমন ও সায় দিল।
.
.
দুপুরে খাওয়া-দাওয়া বেশ কিছুক্ষণ পর তারা সবাই বেরিয়ে গেল। কিন্তু তখনও সেই করিম চাচার দোকান খুলে নাই। অগত তারা আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ইমন আর মায়ার রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা গোলাপ ফুলের দোকান দেখতে পেল। ইমন দুটো গোলাপ ফুল নিয়ে মায়ার মাথার খোপায় নিজ হাতে গুঁজে দিলো।

তারপর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “মুখটি তোমার রক্ত জবা ফুলের মতো, চাঁদের মত হাসি! ওগো পুষ্পরেনু, হ্রদ কোষ এক মনে, সযত্নে গুনছে তোমার এলোকেশি!”

মায়া দাঁত কপাটি বের করে হেসে ফেলল। ইমন বললো, “আচ্ছা তুই শাড়ি পরিস না কেন? জানিস লাল শাড়ি, চোখে হালকা কাজল, হালকা একটু মেকআপ আর খোঁপায় গোলাপ রজনীগন্ধার ছোয়ায়, উফ আমি তো পুরাই খুন হয়ে যেতাম।”

“তুমি খুন হয়ে যাবে দেখেই আমি শাড়ি পড়ি না। তুমি খুন হয়ে গেলে আমার কি হবে বলতো? মূলত আমার শাড়ি না পরার জন্য প্রত্যক্ষভাবে তুমি দায়ী!”

মায়ার রসিকতায় ইমন হেসে ফেললো। এমন সময় শিলা মায়া কে ফোন দিয়ে বলল, “তোরা কোথায়? আমরা এখানে আসছি। তাড়াতাড়ি চলে আয়।”

মায়া আর ইমন উল্টোদিকে হাটা দিলো।

মিলা মায়ার মাথার ফুল টা দেখলো। দেখেই বলল, “ওমা কি সুন্দর ফুল! ইমন তোকে কিনে দিল বুঝি?”

“হ্যাঁ।”লাজুক হেসে জবাব দিল মায়া।

শিলা বলল, “তোর দুলাভাই কখনো বলতে পারবেনা, সে আমাকে জীবনেও একদিন ফুল কিনে দিয়েছে। এই সাত বছরের বিবাহিত জীবন, সাত বছরের অ্যানিভার্সারিতে একবারের জন্য একটা ফুল গিফট করে নাই। কিপটা কোথাকার!”

শিলার হাজবেন্ড রাহাত বললো, “হ্যাঁ কিপটাই আমি। সাতটা অ্যানিভার্সারিতে তোমায় সাতটা শোনার আংটি গিফট করেছি। একটা ডায়মন্ডের নাকফুল দিয়েছি গত বছর। কিপটা হলে পকেটের টাকা খরচ করে এসব দিতাম?”

মায়া আর ইমন একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসলো।

মিলা বলল, “আমাকেও কখনো একটাও ফুল দেয় নাই। গত দুই বছরের অ্যানিভার্সারিতে শুধু কেক কিনে খাওয়াইছে।”

ওর হাজব্যান্ড সাহেব বলল, “লে ঠেলা! এখন আবার আমাকে নিয়ে পড়লে কেন?”

শিলা বলল, “ইমন তুই ই ভালো রে। কত সুন্দর বউকে ভালোবেসে তার মাথায় গোলাপ গুঁজে দিস। দিস ইজ এ কিউট লাভ!”
মিলাও শিলার কথায় সাঁই দিল।
সাহেদ আর রাহাত দুইজন দুই দিক থেকে ইমনের পিঠে চাপড় দিয়ে বলল, “তুমিই জিত্তা গেছো ভাই!”
.
.
.
ইমন ফুচকায় একদম ঝাল খেতে পারে না। কিন্তু মায়ের সাথে চ্যালেঞ্জ নিয়ে পাক্কা ৩২ টা ফুচকা খেলো, টকটকে কাঁচা মরিচ দিয়ে। ফর্সা চোখ মুখ লাল বর্ণ ধারণ করল নিমিষেই। ঝালে ফুঁসতে ফুঁসতে বাড়ি ফিরল রাত নয় টায়। পানি খাওয়ায় ঝাল আরো উল্টো বেড়ে গেছে।
মায়া ঘরে ঢুকে দেখল ইমনের চোখ মুখ এখনো লাল টুকটুকে।

সে বলল, “অযথাই আমার সাথে জেদ দেখাতে গিয়ে নিজের কি অবস্থা করেছে, বলোতো?”

ইমন কথা বলল না। খাটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইল। মায়া রান্নাঘর থেকে গিয়ে এক চামচ চিনি নিয়ে এসে, ইমনের মুখের সামনে ধরে বলল, “এটা খাও। ঝাল কমে যাবে।”

চিনি খেয়ে সত্যি বোধ হয় ঝাল কমলো। ইমন স্বাভাবিক হয়ে বসে বললো, “এতক্ষণ দিবি না? আমি দম খিচরে বসে ছিলাম।”

“ঠিক হইছে। আমার সাথে চ্যালেঞ্জ কেন নিতে চাও?”

ইমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে।
.
.
.
.
রাত প্রায় বারোটা ছুই ছুই। সবাই আড্ডা দিয়ে উঠলো। যে যার ঘরে ঘুমাতে যাবে। ইমন মায়াকে আগেই পাঠিয়ে দিল ঘরে। ঘরের লাইট জালানোই ছিল।
এই ঘরের দুটো জানালা। পিছন দিক দিয়ে একটা জানালার পিছনে ইমন এসে দাঁড়ালো। তাকে ঝাল ফুচকা খাওয়ানোর ছোটখাটো একটা প্রতিশোধ নিতেই হবে। ইমন জানালাটা একটু খুলে দিয়ে, মায়াকে দেখল খাটে বসে মোবাইল টিপছে। সে পকেট থেকে নিজের ফোন বের করে ভুতের একটা শো শো টাইপের সাউন্ড দিয়ে জানালার কাছে মোবাইলটা রাখলো।

আচমকা এমন শব্দে ভড়কে গেল মায়া। সে আশেপাশে তাকালো, ভীতু দৃষ্টিতে। ইমন আগেই বাইরে থেকে রুমের দরজা লাগিয়ে এসেছিলো।

মায়া আস্তে আস্তে খাট থেকে নামলো। তার আগে একবার খাটের নিচ থেকে উঁকি দিয়ে দেখে নিলো কেউ আছে কিনা! আওয়াজ ক্রমাগত জোরালো হচ্ছে।

মায়া দরজা খুলতে নিল, কিন্তু দরজা খুলছে না। সে এখন মোটামুটি শিওর হয়েই গেছে, এটা ভূতের ই কান্ড! দরজা খুলছে না দেখে মায়া জোরে চিৎকার করতে লাগলো। ইমন পরে গেল মহা ফ্যাসাদে। এমন চিৎকার করতে থাকলে তো বাড়ির সব লোকজন এক হয়ে যাবে। আর হলোও তাই। সবাই এসে ওই রুমের সামনে দাঁড়ালো। দেখলো দরজা বাহির থেকে লাগানো। দরজা খুলতেই ভিতরে ঢুকে মায়াকে দেখলো।

মায়া ওদেরকে দেখা মাত্রই কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো, “ভূত; ভূত!”

“কোথায় ভূত?”

শব্দটা সবাই লক্ষ্য করল। মিলা কিছু বুঝলো, সে শব্দটা ধরে সামনে এগিয়ে গেল। জানালার কাছে গিয়ে থেমে, মোবাইলটা দেখতে পেয়েই শক্ত করে হেসে দিলো।
ফোনটা হাতে নিয়ে মায়াকে বলল, “দেখ তোর বরের কান্ড এটা!”

ততক্ষণ এই এমন এসে পড়েছে ঘরে। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। ইমন ও উত্তরে পাল্টা হাসি দিচ্ছে।

মায়া কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল, “আমি আর থাকবোই না তোমার সাথে। তুমি আস্ত একটা ভূত!”

মিলা বলল, “ভূতের সাথেই থাকতে হবে তোকে। যাই হোক থাক তোরা। রাতের বেলা আমাদের ঘুমের আর বারোটা বাজাস না।”

বলে সবাই চলে গেল। ইমন দরজা লাগিয়ে মায়ার পাশে বসে ওর হাত ধরলো। মায়া হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “খবরদার আমার কাছে আসবে না। আস্ত ভূত কোথাকার!”

“ভয় পেয়েছিলি? আমাকে যখন ঝাল ফুচকা খাওয়াইসিস, তখন আমার কেমন লাগছিল?”

“তোমাকে কে মাথার দিব্যি দিয়েছিল খাওয়ার জন্য? এখন আমার যদি কিছু হয়ে যেত? আমি যদি ভয়ে হার্ট অ্যাটাক করতাম?”

মায়া নিজেই এমন কে জড়িয়ে কান্না করে দিল। পুনরায় বলল, “তুমি এমন কেন?”

ইমন কান ধরে বলল, “আর কোনদিন এমন হবে না। প্রমিস!”

“আচ্ছা।” তারপর আবার হেসে বলল, “পুরো ব্যাপারটা তে আমি ভীষণ ভয় পেলেও, দারুন ইনজয় করেছি।”

ইমন হেসে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তারপর চোখের পাপড়িতে খুব যত্ন করে একটা চুমু খেলো। পরম আবেশে মায়া চোখ বন্ধ করলো।

হঠাৎ মনে হলো, এভাবেই ইমনের বুকে মাথা রেখে হেসে খেলে এক জীবন অনায়াসেই কেটে যাবে।
.
.
.
.
.
চলবে…..

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here