মাতাল হাওয়া,১৬ম_পর্ব
তাসনিম জারিন
দেখতে দেখতে তুলি আর নিরবের বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। পুরো বাড়িতে খুশীর আমেজ। রহমান সাহেবও এখন অনেকটা সুস্থ। আজকে নিরব আর তুলির গায়ে হলুদ। রায়না, রাকিব, নিপা, সুমি আর তুলির বান্ধবী সেতুও এসেছে ওদের বিয়ে উপলক্ষে। তুলি হলুদের প্রোগ্রামের জন্য লাল রঙের সোনালী পাড়ের একটা শাড়ী পরেছে। রায়না তুলিকে সাজিয়ে দিচ্ছে। ঠোঁটে যেই লাল লিপস্টিক দিতে নিবে তুলি এক চিতকারে বসা থেকে উঠে দাড়ালো আর বললো,
—– রায়না না লাল লিপস্টিক দিস না প্লিজ।
—- কেনো রে?? তোর শাড়ীর কালার তো লাল তো লাল লিপস্টিক না দিলে সুন্দর লাগবে না তো।
—- সুন্দর লাগার লাগবে না তুই একটা হালকা কালারের লিপস্টিক দিয়ে দে। আমার লাল কালার টা ঠিক ভালো লাগে না।
রায়না তুলির কথায় ভেবাচেকা খেয়ে বললো,
—- আচ্ছা ঠিকাছে দিব না। তুই আগে বস তো। বিয়ের টেনশনে পাগল টাগল হয়ে গেলি নাকি??
তুলি ঢোক গিলে মনে মনে বললো,
—- তুই জানবি কেমন করে!! তোর আস্ত একটা খাটাস ভাই আমাকে হুমকি দিয়েছে যাতে লাল লিপস্টিক কখনো না দেই। বেটা যেই পরিমাণ খাটাস কামড় দিয়েই বসে নাকি কোনো বিঃশ্বাস নেই।
রায়না তুলির ভাবনার মাঝেই চুটকি মেরে বললো,
—- কিরে কই হারিয়ে গেলি?? ওহ!! আমার ভাইয়ের চিন্তায় মশগুল বুঝি??
তুলি চোখ পাকিয়ে বলে উঠলো,
— আমার বয়েই গেছে হুমম!!!!
হাসিঠাট্টার মাঝেই তুলিকে রেডি করানো শেষ হলো। অতিমাত্রায় রূপবতী কন্যা যাকে বলে ঠিক তেমন লাগছে তুলিকে। চোখ ফিরানো দায় হয়ে যাবে যে কেউ দেখলে। রায়না উৎসুক হয়ে খোচা মেরে বললো,
—- তুলি তোকে যা লাগছে না ভাইয়ের তো আজকে নির্ঘাত কিছু হয়ে যাবে।
রায়নার কথা শুনে তুলি লজ্জা পেয়ে চোখ রাঙালো। তুলিকে স্টেজে নিয়ে যাওয়া হলো। স্টেজে যেয়ে নিরবকে দেখে তুলি বাকশূণ্য হয়ে গেল। ভয়ংকর রকমের সুন্দর লাগছে ছেলেটাকে। হলুদ কালারের পাঞ্জাবিতে খুব সুন্দর লাগছে নিরবকে। বরাবরই সুন্দর লাগে লোকটাকে। “ইশ আমার বর টা কি হেন্ডসাম” ভেবেই মুচকি হাসলো তুলি। দুজনকে পাশাপাশি বসানো হয়েছে। নিরব ফিসফিসিয়ে বললো,
—- তোকে দেখে তো মন মাদকতায় ভরে গেছে। এতো সুন্দর লাগছে আমার বৌ টাকে। একটা কাজ খুব ভালো করেছিস ঠোঁটে লাল লিপস্টিক দিস নাই। না হয় বিয়ের আগেই কোনো অঘটন ঘটে যেত।
বলেই নিরব গা কাপিয়ে হাসতে লাগলো। তুলি নিরবের হাতে অনেক জোরে একটা চিমটি কাটলো। অসভ্য ছেলে একটা সবসময় লজ্জা দিবে। নিরব “আহ” করে আর্তনাদ করে উঠলো।
—- এতো জোরে কেউ চিমটি কাটে?? মনে হচ্ছে কোনো জংলী বিল্লি কামড় বসিয়েছে।
তুলি মুখ ফুলিয়ে বললো,
— হ্যা খুব ভালো তো। নিজে যা খুশী বলে লজ্জা দিবে কিন্তু আমি একটু চিমটি কেটেছি তাই জংলী বিল্লির খেতাব পেয়ে গেলাম। বাহ আপনার জুরি নেই।
নিরব হেসে তুলির নাক টেনে দিল। মেয়েটা আসলেই একটা বাচ্চা। অল্পতেই লজ্জা পাবে, অল্পতেই কান্না জুরে দিবে, অল্পতেই হাসবে। এমন একটা বৌয়েরই দরকার ছিল নিরবের। এতো লক্ষী একটা মেয়ে, এতো কিউট একটি মেয়ে দেখলেই মন চায় গাল টেনে দেই। দুজন দুজনের সাথে খুনসুটি করে পুরোটা সময় কাটিয়ে দিল।
পরদিন নিরব আর তুলির বিয়ের প্রোগ্রাম। আজ সালেহা বেগম আর রহমান সাহেব ভিষণ ব্যস্ত একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা। কারো যাতে আপ্যায়নে কমতি না পরে। পার্লার থেকে লোক এনে সাজানো হলো তুলিকে। লাল একটা ভারি কাজ করা শাড়ী পরেছে। নিরব বেশি সাজ পছন্দ করে না তাই হালকা সাজ দিয়েছে। কোনো অপ্সরী থেকে কম লাগছে না তুলিকে। নিরব সাদার মধ্যে একটা শেরোয়ানি পরেছে দারুণ হেন্ডসাম লাগছে ওকে। দুজনের বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলো খুব ভালো ভাবে। বিয়ে বাড়িতে ওদের দুজনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই। দুজনের জুটি খুব সুন্দর মানিয়েছে। সবাই মন ভরে দোয়া দিয়ে গেল। বিয়ের নিয়মকানুন শেষে সবাই তুলিকে নিরবের রুমে বসিয়ে দিয়ে গেল। এইরুমে আরো কতবার এসেছে কিন্তু আজ অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। আজ থেকে এইরুম আর এইরুমের মালিক দুটোই তুলির নিজের ভাবতেই এক অজানা ভালো লাগা মন ছুয়ে গেল। তুলি বসে বসে নিরবের অপেক্ষা করতে লাগলো। অপেক্ষা অবসান করে নিরব রুমে এলো। এসেই ওয়াসরুমে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে এসে তুলিকে বললো,
—- এই সাজগোজ মুছে ফ্রেশ হয়ে আয়। এতো ভারি জিনিস পরে কিভাবে আসিস এতক্ষণ?? আমি কফি নিয়ে বারান্দায় আছি। ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় চলে আসিস।
তুলির সত্যি বলতে নিজেরো অনেক অস্বস্তি লাগছিল এই ভারি গয়না গাটি শাড়ী পরে থাকতে। নিরব বলাতে যেন প্রাণ ফিরে পেল। দম বন্ধ হয়ে আসছিল এইগুলো পরে। উঠে ফ্রেশ হতে যেতে নিলে নিরব পিছন থেকে বলে উঠে,
—- তুলি একটা নীল শাড়ী পরিস।
তুলি মাথা নাড়িয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল। একটা গাড়ো নীল শাড়ী পরে ভের হয়ে এলো। নিরব হুট করে পিছনে তাকিয়ে থমকে গেল। তুলির চুল থেকে ফোটা ফোটা পানি পরছে, মুখে কোনো কৃত্তিমতার সাজ নেই একদম ন্যাচারাল লাগছে, স্নিগ্ধ লাগছে খুব। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে নিরব। ইশারায় তুলিকে বারান্দায় যেতে বললো। তুলি আলতো পায়ে বারান্দায় হেটে গেল।
— নে কফি টা খা। ধকল গেছে অনেক আজ সারাদিন। সতেজ লাগবে।
নিরবের কথা শুনে তুলি কফি হাতে নিল। নিরব মুগ্ধ গলায় বলতে লাগলো,
— জানিস তুলি!! আমার জীবনে কখনো ভালোবাসা আসবে ভাবিও নি। কিন্তু তুই আমার জীবনে “মাতাল হাওয়া” এর মতো এলি। আমার জীবনটাকে মাদকতায় ভরিয়ে দিলি। তোর হাসির মাঝে আমি মাতাল হই, তোর লজ্জার মাঝে আমি মাতাল হই, তোর কান্নার মাঝে আমি মাতাল হই, তোর মাঝে আমি আজীবন মাতাল হতে চাই। দিবি কি আমায় সেই অধিকার??
তুলি আলতো হেসে মাথা নাড়লো আর বললো,
— তুমি কিন্তু আমায় এখনো তুই বলছো নিরব ভাই।
— যতদিন তুই আমায় ভাই ডাকবি ততদিন আমি তুই ই ডাকব।
— আচ্ছা চেষ্টা করব ভাই না ডাকার। আসলে অনেক দিনের অভ্যাস তো তাই একটু টাইম লাগবে। কিন্তু তুমি আমাকে তুই বলবে না।
— আমারো তো অনেক দিনের অভ্যাস বল। তবে আমিও চেষ্টা করব তুই না বলার। কিন্তু সামলে উঠতে না পারলে সমস্যা আছে???
তুলি হালকা হেসে মাথা নাড়লো যার মানে আজীবন তুই ডাকলেও সমস্যা নেই। নিরব তুলিকে কাছে টেনে নিয়ে তুলির চুলে নাক ডুবালো। মাতাল করা ঘ্রাণ নিরবকে পাগল করে দিচ্ছে। নিরব কাপাকাপা স্বরে বলে উঠলো,
—– এই যে মেডাম!! আমি যে দিন দিন পাগলের খাতায় নাম লিখাচ্ছি দেখছেন না আপনি??
তুলি মুচকি হেসে জবাব দিল,
—- তা তো দেখতেই পাচ্ছি সাহেব। তো আমায় এখন এই পাগলকে ঠিক করার জন্য কি করতে হবে??
—- একটু ভালোবাসা দিতে হবে।
তুলি নিরবের কথা শুনে লজ্জায় মাথা নামালো। নিরব আবার বলে উঠলো,
— কি হল দিবি না আমায় একটু ভালোবাসা??
তুলি লজ্জায় মাথা নামিয়ে ইশারায় হ্যা বোধক জবাব দিল। নিরব আর দেরি না করে হেচকা টানে তুলির কোমড় জরিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। তুলি আবেশে নিরবের চুল খামছে ধরলো। দুজন দুজনার ভালোবাসায় মত্ত হয়ে গেল। নিয়ে গেল উত্তাল ঢেউয়ের ভালোবাসার সাগরে যেখানে থাকবে শুধু ভালোবাসা আর ভালোবাসা।
সমাপ্তি।