মাতাল হাওয়া,১১ম_পর্ব,১২ম_পর্ব
তাসনিম জারিন
১১ম_পর্ব
তুলি রুমে যেয়ে দরজা লাগিয়ে ঠেস মেরে ফ্লোরে বসে কান্নায় ভেংগে পরলো। এতো যন্ত্রণা কখনো হয়নি তুলির আজ যেমন হচ্ছে। মনে হচ্ছে ধারালো ছুরি দিয়ে নিজেকে আঘাত করে শেষ করে ফেলতে আত্তহত্তা মহাপাপ না হয় আজ তুলির সেটা করতেই ইচ্ছা হচ্ছে এতো কষ্ট এতো যন্ত্রণা সহ্য হচ্ছেনা। কি করে পারলো নিরব তুলিকে এতো সহজে ভুলে যেতে। কান্না করতে করতে ফ্লোরে শুয়ে পরলো তুলি।
ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং ফোনের আওয়াজ পেয়ে তুলি লাফ দিয়ে উঠলো কান্না করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিল নিজেও জানেনা। স্ক্রিনে রায়নার নামটা দেখে নিজেকে যতটুকু সম্ভব স্বাভাবিক করে তুলি ফোন ধরে বললো,
—–“কেমন আছিস রায়না?”
—–“আমি তো ভালো আছি রে তুই কেমন আছিস?”
—–“আমিও ভালো আছি।”
—–“সত্যিই কি ভালো আছিস?”
তুলি কান্না চেপে জবাব দিল,
—-“হ্যা রে!! আচ্ছা বাদ দেয় আমার কথা। তোর কথা বল। কি খবর তোর?”
—–“আমার আর রাকিবের বিয়ে ঠিক হয়েছে রে!!”
—-“কি বলিস?? সত্যি???”
—-“হ্যা রে সত্যি। অবশ্য সব নিরব ভাইয়ের জন্যই হয়েছে। ভাই হেল্প না করলে এতো তারাতারি সব সম্ভব হতোনা।”
—-“ওহ আচ্ছা। তো কিভাবে হেল্প করলো উনি?”
—-“সে এক বিরাট কাহিনী। রাকিবকে কবে থেকেই বলছিলাম ভাইকে জানাতে কিন্তু ওর একই কথা ভিষণ ভয় পায় ও ভাইয়াকে। শেষমেষ অনেক কিছু বুঝিয়ে ভাইয়ের সাথে কথা বলতে পাঠিয়েছি।”
—-“ভয় পাওয়ারই কথা তোর ভাইটা তো শুধু ভাই না আস্তো একটা জল্লাদ। জল্লাদকে তো ভয়ই পাবে তাইনা!!!”
তুলির কথা শুনে রায়না জোরে হেসে দিল। আর বললো,
—-“কার ভাই দেখতে হবেনা!!”
—-“হ্যা দেখছিই তো যেমন খাটাস ভাই তার তেমনি খাটাস বোন। আচ্ছা তো কনভিন্স কেমনে করলো তোর খাটাস ভাইকে রাকিব ভাই??”
—-“শুন তাহলে।”
একমাস আগের ঘটনা। রাকিব নিরবকে একটা রেস্টুরেন্টে ডেকেছে দরকারি কথা আছে বলে। রাকিব ঘামতে ঘামতে শেষ কিভাবে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা। আর নিরবও কেমন রিয়েক্ট করবে জানা নেই। এসব ভাবতে ভাবতেই নিরব চলে এলো। এসে রাকিবের মাথায় টোকা দিয়ে বললো,
—-“কিরে বেটা!!! এতো জরুরি তলব। কেস টেস খাইছস নাকি কোনো??”
—-“দূর দোস্ত!! কেস খামু কেন তোর লগে কি একটু টাইম কাটাইতে পারি না হাজার হোক তুই আমার জানে জিগার দোস্ত।”
—–“দেখ এতো ভনিতা করার দরকার নাই যা বলার বলে ফেল। আমার বেশি একটা টাইম নাই। সো কুয়িক।”
নিরবের কথা শুনে ঢোক গিললো রাকিব। কি দিয়ে যে কি শুরু করবে বুঝতে পারছেনা। আমতা আমতা করে বললো,
—-“যে কথাডা কমু মামা ওইডা শুইনা আমারে মাইরা হসপিটালে পাডাইস না। আমার জীবনের একটা সত্যি কথা মামা তোরে আমি অনেক ভয় পাই।”
নিরব ব্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,
—-“এখন কি বলবি কিছু?? নাইলে আমি উঠলাম।”
—-“চেতস কেন মামা!! কইতাছি তো।”
—-“জলদি বল।”
—-“আমি তোর বইন রায়নারে অনেক ভালবাসি দোস্ত। বিয়া করতে চাই। রায়না আংকেল আন্টিরে বলার সাহস পাইতাছেনা। তুই যদি একটু হেল্প করস দোস্ত অনেক উপকার হয়।”
নিরব রাকিবের কথা শুনে কিছুটা চমকালো। রাকিব ওর বোনকে ভালোবাসে অথচ ও কিছু টের পেলোনা। যাই হোক রাকিব খুব ভালো ছেলে তা নিরব ভালো ভাবেই জানে। রাকিব যে ওর বোনকে খুশি রাখবে তা নিরবের ভালো করেই জানা আছে। নিরব একটা গম্ভীর ভাব নিয়ে বললো,
—“আচ্ছা আমি দেখছি বেপারটা। যদি কোনোদিন আমার বইনের চোখ থিকা পানি পরে তোরে খালে চুবামু বেটা!!!”
রাকিব নিরবের কথা শুনে লাফ দিয়ে যেয়ে জড়িয়ে ধরলো নিরবকে।
—-“দোস্ত আমি জানতাম তুই না করবি না। তুই যে আমার জানে জিগার দোস্ত তা প্রমাণ কইরা দিলি।”
—“ধুর বেটা ছাড়!!! তোর আচরণ আমার অনেকটা গে টাইপ লাগে। তুই সত্যিই সবদিক দিয়া পুরুষ তো?? আমার তো সন্দেহ লাগে। দেখ আগে ভাগে কইয়া দে কোনো সমস্যা থাকলে বইন বিয়া দিমু না।”
রাকিব নিরবের কথায় দুষ্ট হাসি দিয়ে বললো,
—-“আজকে তুমি যাই কও না কেন মামা!! আমি রাগ করমুনা। আমার আজকে আনন্দের সীমা নাই।”
—“দূরে গিয়া মর শালা!!”
—“বন্ধু এই কথা কিন্তু উল্টা কইলা শালা কিন্তু তুমি এখন থিকা আমার আমি না।”
এই কথা বলে রাকিব হাসতে লাগলো। রায়না নিরবের চাচাতো বোন হয়। নিরব এরপর চাচা চাচির সাথে কথা বলে সব ঠিক করলো। এতক্ষণ রায়নার কথা শুনে তুলি অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। কতদিন পরে যে এতো হাসলো নিজেও জানেনা। নিরবকে ও যতটা ফাজিল ভাবে তার চেয়েও মারাত্মক রকমের ফাজিল ও। রায়না তুলিকে বললো,
—“দেখ তুলি!! আমার বিয়ে সো তোকে এটলিস্ট ৪-৫ দিন আগে তো আসতেই হবে। আমার সব ফাংশন এটেন্ড করতে হবে আমি কোনো কথা শুনতে চাইনা। ঠিক আছে???”
—“রায়না আমার কথা তো শুন!!!”
—“না না আমি কোনো কথা শুনতে চাইনা। আসতে হবে ব্যস আসতেই হবে।”
তুলি আর না পেরে বললো,
—“আচ্ছা বাবা আসবো। এখন খুশি!!”
—“হ্যা অনেক খুশি।”
তুলি ফোন রেখে ভাবলো ওখানে গেলে মানে নিরবের সামনে বার বার পড়া। যতই ও নিরবের থেকে দূরে যেতে চায় তোত ই যেন কাছে চলে যায়। আল্লাহ পাক এ কেমন নিয়তি লিখে রেখেছে ওর কপালে। যা হওয়ার হবে সেটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে অনেকক্ষণ কান্না কাটি করার ফলে প্রচন্ড মাথা ধরেছে তুলির তাই এখন শাওয়ার নিতে যাওয়া দরকার। তুলি উঠে ওয়াসরুমে চলে গেল।
চলবে…………
মাতাল হাওয়া
১২ম_পর্ব
তাসনিম জারিন
সময় পেরিয়ে রায়নার বিয়ের সময় চলে এলো। তুলিকে রায়না জোর করে বিয়ের ৪ দিন আগে নিয়ে এলো। রায়নার মা বাবা ও তুলিকে খুব পছন্দ করে। উনার ভাই যে কেন তুলিকে পছন্দ করে না তা ভেবে পায় না রায়নার বাবা। তুলি আসাতে উনারা অনেক খুশি হলো। রায়নার মা বাবার নাম রাশেদ সাহেব আর রাশিদা বেগম। কি সুন্দর মিল দুইজনের নামের তাই না??? রাশেদ সাহেব তুলিকে দেখে বলে উঠলো,
—- তুলি মা তুমি এসেছ আমি অনেক খুশি হয়েছি। তা কেমন আছো মা??
—- জি আংকেল আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
— হ্যা মা ভালো আছি।
রাশিদা বেগম তুলিকে যেয়ে জরিয়ে ধরে বললো,
—— মা কেমন আছিস তুই? কবে থেকে তোকে দেখিনা বল!! একটু এসে তো দেখা করা যায় এই মা টার সাথে নাকি???
—- আন্টি সরি!! আসলে কলেজ নতুন জব সবনিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলাম। এখন আমি আমার আন্টির কাছে চলে এসেছি এখন এতোগুলা ভালোবাসা দিব।
তুলি রাশিদা বেগমকে জরিয়ে ধরে আদরমাখা কন্ঠে বললো। রাশিদা বেগম তুলির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
—– যা এখন ফ্রেশ হয়ে নে। সন্ধায় আবার প্রোগ্রাম শুরু হয়ে যাবে এখন একটু রেস্ট নিয়ে নেয়।
—- আচ্ছা আন্টি।
মেহেদি, সংগীত, হলুদ আর বিয়ে এই নিয়ে ৪ দিনের প্রোগ্রাম। এতগুলো দিন নিরব ভাইয়ের সামনে থাকতে হবে ভেবেই তুলির গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। নিরব ওর সামনে এলেই পুরনো ব্যাথাগুলো জেগে উঠবে। তুলি মনে মনে ভাবছে যতকিছুই হোক আমি নিরব ভাইয়ের সামনেই যাবনা তাহলেই হলো। ভাবতে ভাবতে হুট করে নিরবকে সামনে দেখে তুলি চমকে উঠে। একটা কথা আছে না “যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়” এই উক্তিটা পুরো মিলে যায় তুলির সাথে কেন জানি। নিরব তুলিকে ওর দিকে ফেলফেল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে,
—– আমি কি আগের থেকেও অনেক সুদর্শন হয়ে গেছি নাকি?? এমন ভাবে তাকিয়ে আছিস যেন এখনই আমার চরিত্র হরণ করবি। অবশ্য আমি মানুষ টাই এমন যে মেয়েরা একবার দেখলে চোখ সরাতে পারে না।
তুলি নিরবের কথা শুনে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল। এইলোকটা আসলেই একটা মুখকাটা। যা মুখে আসে তাই বলে। একটু ভাববেও না যে আমি কত লজ্জা পাচ্ছি। কিসব লুচু লুচু কথাবার্তা বলছে ফাযিল লোক একটা। ইচ্ছা করে আমাকে সবসময় লজ্জা দিবে। নিরব তুলির ভাবনা দেখে চুটকি বাজিয়ে জিজ্ঞেস করল,
—– মনে মনে আমাকে বকা শেষ হলে নিচে চলেন মহারানী। মা তোর জন্য অপেক্ষা করছে নিচে।
—- হুম চলেন।
নিচে যেয়ে তুলি সালেহা বেগম আর রহমান সাহেব কে সালাম দিল। রহমান সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এই মেয়েটার সাথে উনার অনেক রাগ জমে আছে। রাগ করে না হয় কিছু কথা বলেছিল তাই বলে বাসা ছেড়ে চলে যেতে হবে?? যতই কটু কথা বলুক না কেন মেয়েটাকে তো উনি কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। একটা পোষা পাখি পাললেও তার জন্য মায়া জন্মে যায় আর তুলিকে তো উনি মেয়ের মতোই মানুষ করেছে। মায়া তো অনেক করে তুলিকে উনি কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে পারেনা। হুট করে নিরবের মুখে এমন কথা শুনে উনি বুঝে উঠতে পারেনি যে কি করা উচিৎ কিভাবে রিয়েক্ট করা উচিৎ তাই এভাবে বলেছে বাবা হয়ে শাসন করতেই পারে তাই বলে বাসা ছেড়ে চলে যাবে এটা কেমন কথা। না বলবে না উনি কথা এই মেয়ের সাথে। সালেহা বেগম তুলিকে কাছে টেনে নিয়ে বসালো আর বললো,
—- নিজের কোনো খেয়ালই রাখিস না মনে হয়। কত শুকিয়ে গেছিস বলতো।
তুলি হেসে সালেহা বেগমকে জরিয়ে ধরে বললো,
—- খালামনি!! তুমি যে আমাকে অনেক ভালোবাস তাই তোমার এমন মনে হচ্ছে যে আমি শুকিয়ে গেছি কিন্তু তেমন কিছুই না আমি একদম ঠিক আছি। ফিট এন্ড ফাইন।
তুলি শাওয়ার নিয়ে রেডি হতে লাগলো। আজকে মেহেদী প্রোগ্রাম। তুলি একটা সবুজ শাড়ি পরেছে, হালকা কিছু গয়না পরেছে, হালকা সিম্পল মেকাপ করেছে, ঠোঁটে গাড়ো লাল লিপস্টিক দিয়েছে ব্যস আর কিছু না। এতেই যেন তাকে পরির মতো লাগছে যে কেউ দেখলেই বলে উঠবে অসম্ভব রূপবতী একজন মেয়ে। তুলি নিজেকে দেখে বললো,
—- নাহ তুলি খারাপ লাগছে না তোকে বরং অনেক সুন্দর লাগছে। কিন্তু আফসোস যাকে দেখাতে চাই সে তো এখন অন্য কারো।
এইসব ভেবে একফোঁটা জল গরিয়ে পরল তুলির চোখ থেকে। নিপা, সুমি ডাকতে আসলে তুলি নিজের চোখের জল মুছে ওদের সাথে নিচে চলে গেল। তুলি নিচে নামতেই একজোড়া চোখ যেন আটকে গেল ওর পানে। তুলিকে দেখে নিরবের যে কতগুলো হার্টবিট মিস হলো তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সবুজ কালার শাড়ী, গারো লাল কালারের ঠোঁট যেন তুলিকে কোনো অপ্সরী থেকে কম মনে হচ্ছেনা নিরবের। মনে মনে নিরব বলে উঠলো,
—– এইমেয়ে আজকে আমাকে পাগল করে ছাড়বে মনে হচ্ছে। ভয়ংকর রকমের কিছু করে ফেলতে ইচ্ছা হচ্ছে। এতো সুন্দর করে কেন সাজতে হবে ওকে!!!
তুলি নিচে নেমে নিরবকে দেখে চোখ আটকে গেল ওর। সবুজ কালার পাঞ্জাবিতে স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে অনেক। খোচাখোচা দাড়ি, হাতে ঘড়ি, চুলগুলো অনেক গুছিয়ে সাজানো, সাথে মুখের মুচকি হাসিতো আছেই বড়সড় রকমের একটা ধাক্কা খেল তুলি নিরবকে দেখে। ও বুজে পায়না এইছেলেটা এতো সুন্দর কেন।দেখলেই মনের ভিতর হাতুড়ি পিটানো শুরু হয়ে যায়। এসব যখন ভাবছিল তখন নিরব এসে গম্ভীর গলায় বললো,
—– আর কখনো যদি লাল লিপস্টিক দিয়েছিস তো একদম কামড় দিয়ে ঠোঁট কেটে ফেলব। ফাযিল মেয়ে একটা মাথাটা নষ্ট করে দিল।
নিরবের কথা তুলির মাথার উপর দিয়ে গেল। কি বলে গেল এটা কামড় দিবে মানে??? বুঝতে পেরে তুলির লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। অসম্ভব রকমের লুচু ছেলে একটা। লজ্জায় লাল নীল হতে হতে স্টেজে চলে গেল তুলি।
চলবে…………..