মন_গহীনে পর্ব_৯/১০/১১/১২

মন_গহীনে পর্ব_৯
#সামান্তা_সিমি

ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিক।সকাল ছয়টা বাজে।বারান্দায় বসে আছি আমি।প্রকৃতিতে শীতের আনাগোনা।ডিসেম্বর মাসে যেমন শীত থাকার কথা তেমন নেই।এবার এত দেরি হচ্ছে কেনো কে জানে।তবে সকালবেলায় কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার উপস্থিতি ভালোই টের পাওয়া যায়।আমার গায়ে একটা পাতলা চাদর।হুহু করে ঠান্ডা হাওয়া চাদর ভেদ করে গায়ে লাগছে।শরীরে হালকা কাঁপুনি টের পাচ্ছি। আর বসে থাকা যাবে না এখানে।মা দেখতে পেলে আবারো বকা লাগাবে।

কয়েকদিন ধরে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় বসে থাকা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
মা আমার এই অভ্যাসটাকে দু চোখে দেখতে পারেন না।এভাবে বারান্দায় বসে থাকলে নাকি ঠান্ডা লাগবে,জ্বর হবে হেনতেন কত কিছু। আমার কাছে এই সময়টা বেশ ভালো লাগে।বাতাস ঠান্ডা হলেও সেখানে একধরনের স্নিগ্ধতা আছে।কিন্তু এতসব কাব্যিক ভাষা মা’কে কে বুঝাবে।
ঝটপট পড়ার টেবিল গুছিয়ে নিলাম।সাতটা বাজতেই আমার মা-বাবা’র দু চোখের মনি তুষার ভাইয়ার আগমন ঘটবে।আজ পনেরদিন পূর্ণ হলো উনি আমায় পড়াচ্ছেন। ভাইয়ার হোমওয়ার্ক করতে করতে আমার রাত দিন খবরও থাকে না।সকাল বিকাল একঘন্টা উনি পড়িয়ে যান।এরপরও ফোন দিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করেন আমি পড়ছি নাকি ঘুমাচ্ছি।ভালো লাগে এসব?জীবনটা আমার শীতের মৌসুমে হাওয়ায় উড়ে আসা শুকনো পাতার মত হয়ে গেছে।
অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে খেতে বসলেও আমার চোখের সামনে ফিজিক্সের সূত্র ভাসে।ঘুমাতে গেলে মাথায় ইন্টিগ্রেশনের সূত্র দৌড়াদৌড়ি করে।মাঝে মাঝে তো লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসি। কতদিন হলো টিভির রিমোট হাতে নেই না।।ভাবলেই কষ্ট কষ্ট ফিল হয়।

ঘড়ির কাটা সাতের ঘরে আসতেই কলিংবেল বেজে উঠল।আমি তাড়াতাড়ি করে ভদ্র এবং শান্ত মেয়ের মত টেবিলে বসে গেলাম।
তুষার ভাইয়া হাই তুলতে তুলতে রুমে ঢুকলেন।চোখমুখ কিছুটা ফুলে আছে।উনি বোধ হয় মাত্রই ঘুম থেকে উঠে এসেছেন।এমনিতে সকালবেলা ভাইয়া এক্সারসাইজ, জগিং কোনোটাই বাদ দেন না।এগুলো শেষ করেই আমাকে পড়াতে আসেন।আজ মনে হয় ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে।
হঠাৎই দেখি তুষার ভাইয়ার হাতে সেই নীল ডাইরিটা। কি ব্যাপার! আজ উনি ডায়রি নিয়ে আসলেন কেনো?কৌতূহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করে বসলাম,

” ভাইয়া এটা সেই ডায়রিটা না যেটা ওইদিন আপনার রুমে দেখেছিলাম?”

তুষার ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।আমিও তাকিয়ে আছি।আজব লোক তো!একটা সাধারণ প্রশ্ন করেছি উত্তর দিয়ে দিলেই তো হয়।এভাবে জহুরির মত চেয়ে থাকার কি মানে!

” হ্যাঁ।ওই ডায়রিটাই।কিন্তু তুই এটাতে হাত দেওয়ার পর থেকে আমি আর কিছুই লিখতে পারছি না।ডায়েরিটার উপর কোনো জাদু টোনা করিস নি তো আবার?”

আমি হতভম্ব। ভাইয়া মাঝেমধ্যে এমন আশ্চর্যজনক কথাবার্তা বলে যে কি উত্তর দেব খুঁজে পাই না।

” কি যা তা বলছেন ভাইয়া।দুনিয়ায় এত কিছু থাকতে খামোকা আপনার ডায়রির উপর জাদু করতে যাব কেন?আর আমি একজন সাধারণ মেয়ে।জাদু করার মত ক্ষমতা আমার নেই।হুহ্!”

তুষার ভাইয়া ডায়রিটা টেবিলের একপাশে রেখে সোজা হয়ে বসলেন।আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে বললেন,

” সাধারণ মেয়ে হয়েই তো তুই আমার উপর অসাধারণ জাদু করে বসে আছিস।তোর কারণে আমার রাতে ঘুম হয় না,ঠিকমতো কাজে মন দিতে পারি না।তুই তো মহা ধুরন্ধর মেয়ে।আমাকে যন্ত্রণায় রেখে দিব্যি আরাম আয়েশে দিন কাটাচ্ছিস।”

” ভাইয়া…আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।একবার বলছেন ডায়রির উপর জাদু করেছি আরেকবার বলছেন আপনার উপর।”

” বুঝতে হবেও না।আজ সব পড়া কমপ্লিট হয়েছে?দিন দিন কিন্তু তুই চরম বেয়াদপ হচ্ছিস।মামী’র থেকে শুনলাম তুই নাকি ভোরে উঠে বারান্দায় বসে থাকিস?প্ল্যান কি তোর?ঠান্ডা লাগিয়ে, জ্বর বাঁধিয়ে বিছানায় পড়ে থাকবি।সবই পড়া ফাঁকি দেওয়ার ধান্ধা তাই না?”

আমি মুখ কালো করে ফেললাম।মা তাহলে এই খবরটাও উনার কাছে সাপ্লাই করে দিয়েছে।দিয়েছে ভালো কথা।এক লাইন বাড়িয়ে বলার দরকারটা কি?আমি ভোরবেলায় কবে উঠলাম।বুঝেছি মা ও এখন আমার শত্রু হয়ে গেছে।কেউ ভালোবাসে না আমায়।

মনে একরাশ অশান্তি নিয়ে বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগলাম।কিছুক্ষণ পরই মা ভাইয়ার জন্য কফি নিয়ে এসে টেবিলের উপর রেখে গেল।
দুটো ম্যাথ কমপ্লিট করার পর টের পেলাম ঘুমে আমার চোখ জড়িয়ে আসছে।কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ফলাফলস্বরূপ এখন চোখ খুলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। আর এমনিতেও অঙ্কের সাথে আমার একটা শত্রুতা কাজ করে।আমি খেয়াল করেছি যখনই অঙ্ক করতে বসি তখনই আমার ঘুমটা বুলেট গতিতে এসে হানা দেয়।গতরাতে না ঘুমানোর কারণে এই মুহূর্তে চোখ দুটো অনায়াসে বন্ধ হয়ে আসছে।
হাই চেপে রাখতে গিয়েও পারলাম না।তুষার ভাইয়ার চোখে চোখ পড়তেই দেখি উনি সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আবার অঙ্কে মনোনিবেশ করলাম।
কিন্তু তুষার ভাই মাঝপথে ব্যাঘাত ঘটালেন।কফির মগটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

” তোর মতিগতি তো ঠিক লাগছে না আমার।রাতে কি ঘুমাস না নাকি?আবার ভোরবেলা বারান্দায় বসে থাকিস।কাহিনী কি?ভুতে টুতে ধরেছে নাকি তোকে?নে কফিটা খা।আমার তো মনে হচ্ছে ঘুমের চোটে ঢুলতে ঢুলতে চেয়ার উল্টে পড়ে যাবি।তারপর দেখব হাত -পা’য়ে ব্যথা পেয়ে হুলুস্থুল কান্ড করেছিস। জলদি কফির কাপ হাতে নে।”

আমার একবার বলতে মন চাইল আপনার থেকে বড় ভুত আর আছে নাকি।সারাক্ষণ মাথার উপরে বসে কলকাঠি নাড়াতে থাকেন।আপনার জন্য জীবনটা আমার ত্যানা ত্যানা লাগে।
মনের তীব্র ইচ্ছাটা চেপে মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বললাম,

” না ভাইয়া।ওটা মা আপনার জন্য বানিয়েছে। আপনি তো এক চুমুকও খান নি।”

” কফির মগে কি আমার নাম লেখা আছে যে এটা আমাকেই খেতে হবে?মগটা যখন যার হাতে থাকবে সেটা তাঁর হয়ে যাবে।আমি তোর হাতে দিলাম এখন এটা তোর।”

তুষার ভাইয়ার কথা শুনে হেসে দিলাম।আজব মানুষের যত আজব কথাবার্তা।

” এটা কি আপনার তৈরি নিয়ম ভাইয়া?”

” ধরে নে তাই।কিন্তু কফিটা নিয়ে বসে আছিস কেনো?তোকে কি আর শুধু শুধু বাচ্চা বলি?যে মেয়ে কফিকে শরবত বানিয়ে খায় সে কি পরিমাণ নির্বোধ ভাব একবার।”

বিরসমুখে কফির মগটা হাতে নিলাম।উনি আমাকে নিবোর্ধ বলে সেটা নিয়ে আবার আমাকেই ভাবতে বলছে।আর রইল বাকি বাচ্চা। এই শব্দটা শুনতে শুনতে আমার কানের মেশিনে মরিচা ধরে গেছে।তাই এখন আর তত গায়ে লাগাই না।

কফির মগ অর্ধেক খালি হতেই তুষার ভাইয়া এক কান্ড করে বসলেন।তিনি কফির মগটা আমার হাত থেকে একপ্রকার কেড়ে নিয়ে চুমুক বসালেন।
আচমকা ঘটে যাওয়া ঘটনাটায় হতবাক আমি।কিন্তু উনার মুখে কোনো রিয়্যাকশন দেখা যাচ্ছে না।যেন এটা আগেই ঠিক করা ছিল যে অর্ধেক কফি আমার অর্ধেক কফি উনার।
প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

” আপনি আমার খাওয়া কফিটা খাচ্ছেন কেনো?”

তুষার ভাইয়া শান্ত কন্ঠে উত্তর দিলেন,

” তুই হলি একটা কুটিল মেয়ে।কিছুটা স্বার্থপর টাইপ।তোর চোখে ঘুমঘুম ভাব দেখে দয়াবশত কফিটা খেতে দিয়েছিলাম।কিন্তু তুই কি করলি?ঢকঢক করে পুরোটা কফি খেয়েই চলেছিস।আমি কি পুরোটা খেতে বলেছি?একবার তো জিজ্ঞেস করতে পারতিস ভাইয়া আপনি কি কফি খাবেন?”

” আজব তো!আপনি আমার খাওয়া কফিটা কেনো খাবেন?একজনের খাওয়া কফি অন্যজন খায় এটা তো শুনিনি কখনো।”

” ভুলে গেছিস একটু আগেই বলেছিলাম মগ যার হাতে থাকবে কফি তাঁর।এতক্ষণ তোর হাতে ছিল এখন আমার হাতে আছে।হিসেব মতে কফিটা এখন আমার।”

ভাইয়ার হিসাব-নিকাশের ধরণ দেখে আমার মাথা ঘুরে গেল।হোমওয়ার্কের জন্য যে পড়াগুলো ব্রেইনে জমিয়ে রেখেছিলাম সেগুলো উনার বলা কথাটার সাথে মিলেমিশে জগাখিচুরি হয়ে যাচ্ছে। আজকে নির্ঘাত একটা পড়াও দিতে পারব না।তারমানে প্রচুর মার খেতে হবে। জীবনটাই প্যারাময়।



পড়া শেষ করে বিকেলের দিকে নিজের রুমটা গোছগাছ করছি।আমি সাধারণত এসব কাজে কখনো হাত দিই না।ভালো লাগে না এসব করতে।এলোমেলো থাকতে থাকতে সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে।আজ মা’য়ের বকুনিতে অসহ্য হয়ে ঘর গুছানোতে হাত দিলাম।
আমার রুম নাকি গবাদি পশুর খোয়ারের থেকেও খারাপ।এই রুমে থাকতে থাকতে নাকি আমি নিজেও দিন দিন পশুতে পরিণত হচ্ছি।এগুলো আমার শ্রদ্ধেয় মা’য়ের মুখনিঃসৃত বাণী।
রুম গুছানোর একপর্যায়ে মা প্রবেশ করল।নিশ্চয়ই আবার কোনো কাজের অর্ডার দিয়ে বসবে।
আমার অনুমান কে সত্যি করে দিয়ে মা বলল,

” একটু ছাদ থেকে ঘুরে আয় তো নীলাশা।ফুলগাছ গুলোতে আজ পাঁচ ছয়দিন হলো একফোঁটাও পানি দেওয়া হয় না।তুই গিয়ে পানি দিয়ে আয়।”

ছাদে যাওয়ার কথা শুনতেই মন আনন্দে নেচে উঠল।কত্তদিন হয়ে গেল আমি ছাদে যাই না।তুষার ভাইয়ের কড়া নিষেধ ছিল আমি যেন ছাদে পা ও না রাখি।সেদিন ইয়াসির ভাইয়ার ঘটনাটার কারণেই ভাইয়া রেগে এই কথা বলেছিল।কিন্তু এখন তো ইয়াসির ভাইয়া নেই।তাহলে তুষার ভাইয়াও আমাকে আর কিছু বলতে পারবে না।

ছাদে পৌঁছাতেই সাদনান ভাইয়ার সাথে দেখা।উনি ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছিলেন।আমাকে দেখতে পেয়েই দ্রুত কল কাটলেন।দৃশ্যটা কিছুটা সন্দেহজনক মনে হলেও আমি তা পাত্তা দিলাম না। গুনগুন করে গান গাইছি আর গাছে পানি দিচ্ছি।
একটু পরেই সাদনান ভাইয়াকে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম।
উনি সামনে এসে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন,

” কি খবর নীলাশা!অনেকদিন পর দেখা হলো।ছাদে মনে হয় বেশি একটা আসো না।”

মনে মনে বেশ বিরক্ত হলাম।আমি ছাদে আসি না আসি এতে উনার কি!উনাকে কে খবর রাখতে বলেছে।সেদিন তুষার ভাইয়া বলেছিল সাদনান ভাইয়াকে যেন এড়িয়ে চলি।কিন্তু আমি তো গুছিয়ে কোনো কথা বলতে পারি না।কি করে উনাকে এভয়েড করা যায়!
হালকা হেসে বললাম,

” পরীক্ষা আসছে তো তাই এত একটা আসা হয় না।আচ্ছা ভাইয়া।মা আবার খুঁজবে আমায়।যাই এখন।”

” দঁড়াও নীলাশা।তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

এবার আমি ঘাবড়ে গেলাম।শীতের বিকাল এটা।তাই কুয়াশা পড়া শুরু হয়ে গেছে।যার কারণে চারদিকটা ধোঁয়াটে লাগছে।তার উপর ছাদে কোনো জনপ্রাণী’র চিহ্নও দেখা যাচ্ছে না।এই সময়ে সাদনান ভাইয়া কি এমন কথা বলবেন!চরম অস্বস্তি নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম।

চলবে…

#মন_গহীনে
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_১০

সাদনান ভাইয়া উশখুশ করছেন।মনে হচ্ছে ভয়াবহ কিছু ঘোষণা করতে চলেছেন।উনার বোধ হয় কথা পেটে আসছে কিন্তু মুখে আসছে না।একটু পরপর চারদিকে নজর বুলিয়ে আমার দিকে অসহায় ভঙ্গিতে তাকাচ্ছেন।উনার চেহারার হাল দেখে আমার নিজেরই বাঁধভাঙা হাসি আসছে।কিন্তু হাসা যাবে না।সাদনান ভাইয়া এখন একটা কিছু নিয়ে সিরিয়াস মুডে আছে।হাসা মানেই বেয়াদপি।
কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই সিড়ির গোড়ায় কয়েকজন মহিলার কথাবার্তার আওয়াজ পাওয়া গেল।এবার আমি নিজেও ছটফট করতে লাগলাম।কেউ যদি এসে দেখে আমি সাদনান ভাইয়ার সাথে একা ছাদে দাঁড়িয়ে কথা বলছি তাহলে তিল থেকে তাল, তাল থেকে আরো বহু কিছু বানিয়ে ফেলবে।এই ক্ষেত্রে পাশের বাসার আন্টিদের তো জবাব নেই।

সাদনান ভাইয়া অতি ব্যস্ততার সহিত বললেন,

” আচ্ছা নীলাশা তুমি আজ যাও।আমারো একটু তাড়া আছে।বায়।”

হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে ছুটতে ভাইয়া অপর পাশের সিড়ির দরজার দিকে চলে গেল।আমিও আর দাঁড়িয়ে না থেকে পা চালালাম।সিড়ির কাছে আসতেই দেখি আমার ভাবনা সত্যি। মহিলাগুলো এই বিল্ডিংয়েরই।আমাকে দেখে উনারা পড়ালেখার হালচাল জিজ্ঞেস করল।কোনোরকমে উত্তর দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে আসলাম।আজকে জোর বাঁচা বেঁচে গেছি।

___________________________

কেটে গেল আরো কতগুলো দিন।
দুপুরে ড্রয়িংরুমে বসে ভাত খাচ্ছি আর টিভি দেখছি।আজ সকাল থেকেই বিল্ডিংয়ে বেশ হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। এর কারণটা খুঁজে পাচ্ছি না।শেষমেষ মায়ের থেকে জানতে পারলাম আজ ৩১ ডিসেম্বর। সেই উপলক্ষে ছাদে হ্যাপি নিউ ইয়ারের পার্টি আয়োজন করেছে।পড়ালেখা নিয়ে আমার দিনগুলো যে কিভাবে কাটছে তার প্রমাণ আজ হাতানাতে পেলাম।বছরের শেষ দিন আজ।অথচ আমার তারিখটাই মনে নেই।

পার্টিতে নাকি প্রধান দায়িত্বে আছে এই বিল্ডিংয়ের ছেলেপুলেরা। যেহেতু পুরো বিল্ডিংয়ে তুষার ভাইয়া এবং সাদনান ভাইয়া সব ছেলেদের থেকে সিনিয়র তাই মূলত উনারাই সবকিছুর তদারকি করছেন।
তুষার ভাইয়া তো সকালে পড়াতে এসেছিলেন।তখন তো পার্টি নিয়ে কিছু বলেন নি।এহ্! কি ঢং।
আমাকে বললে কি এমন হত।
ভাত খাওয়া শেষে মেইনডোর খুলে করিডোরে গেলাম।তখনই পাশের ফ্ল্যাটের অভির সাথে দেখা।বিচ্ছু ছেলেটা এবার সিক্সে পড়ে।আমাকে দেখতে পেয়েই বলে উঠল,

” নীলাশা আপু! আজ কিন্তু খুব জাঁকজমক একটা পার্টি হবে।সাথে হেব্বি খানাপিনা।আর অনেক বাজিও ফাটাবে। তুমি যাবে তো!”

অসহায় মুখ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।পার্টি উপলক্ষে ওদের মনে কত আনন্দ। একমাত্র আমিই বোধ হয় নিরানন্দে আছি।কবে যে পরীক্ষাটা দিয়ে মুক্ত হব।এত পড়ালেখা আর ভালো লাগছে না।একবার পরীক্ষাটা দিয়ে নেই তারপর আমি খাঁচা ভেঙে ছাড়া পাওয়া পাখির মত উড়ে বেড়াব।ভার্সিটি উঠলে তো কিছুটা স্বাধীনতা পাব।তখন তুষার ভাইয়ার ওইসব ধমক,চোখ রাঙানো কিছুই পাত্তা দিব।ভার্সিটি উঠা মানেই তো শুধু চিল আর চিল।আহা!

অভির মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললাম,
” আমার একটা রাগী স্যার আছে জানিস! পড়া না পারলে এত জোরে মারে যে তিন চারদিন পর্যন্ত ব্যথা থাকে।ওই স্যারের পড়া যদি শেষ করতে পারি তাহলেই আমি পার্টিতে যেতে পারব। নাহলে বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকতে হবে।তোরা বাজি ফাটাবি আর আমি জানালা দিয়ে হা করে সেই বাজির ঝলকানি দেখব।”

অভি ঠোঁট উল্টে বলল,
” তোমার স্যার তো দেখি খুবই ভয়ানক।কই আমার স্যার তো এত জোরে মারে না।খুব আদর করে আমায়।”

” সবার স্যার কি আর তোর স্যারের মত! আমার স্যারের মত নির্দয় মনের মানুষ খুব নগন্য।উনার শাসনে বইয়ের পড়া পড়তে পড়তে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। ”

কথাটা বলে অভির দিকে তাকিয়ে দেখি সে আমার পিছনে চোখ বড় বড় করে কিছু একটা দেখছে।কিছু বুঝে উঠার আগেই সে ডেকে উঠল,

” হ্যালো তুষার ভাইয়া।!

পিছনে ফিরতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। তুষার ভাইয়া লিফট থেকে নেমে কখন যে এখানে দাঁড়িয়েছে তা আমার খেয়ালই নেই।আমি তো আশ মিটিয়ে মনের দুঃখ কষ্ট অভির সাথে শেয়ার করতে ব্যস্ত ছিলাম।

তুষার ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে অভিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” অভি তুমি এখন ঘরে যাও।রাতে ছাদে দেখা হবে।”

অভি সুড়সুড় করে চলে গেল।এদিকে ভয়ে আমি অস্থির হয়ে আছি।উনি যদি ওইসময়ের কথাগুলো শুনে থাকে তাহলে!

” তোর কি পরিমাণ সাহস! একটা বাচ্চার কাছে আমার নামে কুট কাচালি করছিস?এত শয়তানি বুদ্ধি তোর পেটে?বাচ্চাদের চোখে আমাকে ভয়ংকর বানিয়ে দিচ্ছিস!”

যা ভেবেছি তাই।তুষার ভাইয়া সব কথা শুনে নিয়েছে।মনের কষ্ট গুলোও কারো সাথে ভাগাভাগি করার অবকাশ পাব না আমি।
আর আমি ভুল কি বলেছি?
উনি ভয়ংকর এটা তো সত্যি কথা!বাচ্চাদেরও জানা উচিত তাঁরা যে সারাক্ষণ তুষার ভাই,তুষার আঙ্কেল বলে চেঁচায় তাদের সেই প্রাণপ্রিয় মানুষ আমার সাথে কি নিষ্ঠুর ব্যবহার করে।

আমাকে চুপচাপ দেখে তুষার ভাইয়া বলল,
” এখন ভেজা বেড়াল হয়ে গেছিস তাই না?মুখে কোনো রা নেই।চল ঘরে চল।দুপুর টাইমে বাইরে কি করছিস!তোকে পড়িয়ে চলে যাব।বিকেলে আমার কাজ আছে।”



পড়ার টেবিলে একে একে সব হোমওয়ার্ক তুষার ভাইয়াকে দিলাম। এখন আর উনাকে মারার চান্স দেই না।কাঠের স্কেল সামনেই পড়ে থাকে।কিন্তু উনি মারার সুযোগই পান না।কি করে মারবে! সব পড়া তো আমি কমপ্লিট করে রাখি।

পড়ানো শেষ হতেই তুষার ভাইয়া বলল,
” শোন! রাতে একা ছাদে যাবি না।মামীর সাথে যাবি।নয়ত আমি তুষ্টিকে পাঠাব।বিল্ডিংয়ের সব ছেলেরা আজ ছাদে থাকবে।তাই আগেই বলে রাখি আমি যদি উনিশ-বিশ কিছু দেখি তাহলে তোকে ঘরে এনে তালা মেরে ফেলে রাখব।আমার নজর কিন্তু তোর উপরই থাকবে।”

আমি বাধ্য মেয়ের মত মাথা নাড়লাম।
চেয়ার উঠতে যেতেই আবার বসে পড়লেন তিনি।আমার গাল টেনে বলে উঠল,

” বড্ড আদুরে তুই!”

ভাইয়ার কথা শুনে মুচকি হাসলাম।তাকিয়ে দেখি উনার ঠোঁটেও বাঁকা হাসির ঝিলিক।হাসিমুখে থাকলে উনাকে কতই না সুন্দর লাগে।
হঠাৎ করেই কেনো জানি খুব লজ্জা লাগছে।তাই মাথা নামিয়ে নিলাম।উনিও আর কিছু না বলে চলে গেল।

_______________________

রুমে থেকেই শুনতে পাচ্ছি সাউন বক্সের উচ্চ আওয়াজ যেখানে বিভিন্ন হিন্দি রিমিক্স গান বাজছে।আমার আর ঘরে বসে থাকতে মন চাইছে না।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সাড়ে দশটা বাজে।বিল্ডিংয়ের সবাই মনে হয় এতক্ষণে ছাদে জটলা পাকিয়েছে। শুধুমাত্র আমিই কাঁচুমাচু মুখে একবার মায়ের কাছে যাচ্ছি আরেকবার মেইনডোরের দিকে দেখছি।মা’কে কখন থেকে খুচাচ্ছি ছাদে যাওয়ার জন্য। কিন্তু মা’য়ের নাকি সাউন্ড বক্সের শব্দে মাথা ধরে যায়।এদিকে তুষ্টি আপুরও কোনো পাত্তা নেই।ধুর এবার আমি একাই চলে যাব।

অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে তুষ্টি আপুর দেখা মিলল।আপুর গায়ে হালকা নীল কালারের থ্রি-পিস। আমি লক্ষ্য করেছি আপু যখন যা-ই পড়ুক এত মিষ্টি লাগে!ইস! আপু কত্ত কিউট।

ছাদে পৌঁছাতেই হরেকরকম লাইটের ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে গেল।চারদিকে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।এতবড় ছাদ অথচ কত হিজিবিজি লাগছে।
যার কারণে শীতের রাতের ঠান্ডা কাউকেই কাবু করতে পারছে না।আনাচকানাচে বাচ্চারা যে যেভাবে পারছে গানের সাথে হাত-পা মেলানোর চেষ্টা করছে।
বাহ! কি উৎসবমুখর পরিবেশ।নিমিষেই মনটা প্রফুল্ল হয়ে উঠল।
এত ভিড়ের মাঝেও একজনের দিকে ঠিকই নজর পড়েছে আমার।যার পড়নে কালো ট্রাউজার্স, গায়ে হোয়াইট টি-শার্ট, তারউপর ব্রাউন কালারের জ্যাকেট।হ্যাঁ।উনি আমাদের তুষার ভাইয়া।
ছাদে উপস্থিত সকল ছেলেপুলেদের মধ্যে উনার হাঁটার মুভমেন্ট, কথাবলার স্টাইল সবকিছু আলাদা।যার কারণে অনায়াসেই চোখটা বারবার উনার দিকে চলে যাচ্ছে। আমার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়ানো একঝাঁক মেয়ের দল।ওদের চোখ অনুসরণ করে দেখি ওরা আপাতত তুষার ভাইয়াকে নিয়েই কথা বলছে আর মুচকি মুচকি হাসছে।কিন্তু উনার তো সেদিকে খেয়ালও নেই।নাকি সব দেখেও না দেখার ভান করছে কে জানে।বাহ্! উনি তো দেখি রীতিমতো এই বিল্ডিংয়ের সেলিব্রিটি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চলবে….

[ আজকের পর্বটা কি লিখেছি নিজেও জানি না।বোধ হয় ভালো হয়নি।ছোট হয়ে গেছে তারজন্য দুঃখিত।ভুল হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

#মন_গহীনে
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_১১

ঘড়িতে বাজছে রাত এগারোটা ত্রিশ।সবাই উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করছে নতুন বছরের জন্য।
ছাদের কোলাহল দ্বিগুন হয়ে উঠেছে।আমাদের বিল্ডিংয়ের আশেপাশে আরো কয়েকটা বিল্ডিংয়েও পার্টি হচ্ছে। ওইসব ছাদেও একই দৃশ্য। মোটকথা চারদিকের হট্টগোলে মাথা ধরে যাওয়ার উপক্রম।
আমি আর তুষ্টি আপু ছাদের এককোনায় দুটো চেয়ারে বসে গল্প করছি।গল্পের মুখ্য বিষয় তুষার ভাইয়া এবং তুষার ভাইয়া প্রেম।
একটু আগে হঠাৎ করেই তুষ্টি আপুকে তুষার ভাইয়ার প্রেমিকা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম।জানি না কেন হুট করে প্রশ্নটা মাথায় আসল।
তুষ্টি আপু কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল,

” ভাইয়া আর আমার মধ্যে সম্পর্কটা খুব সহজ স্বাভাবিক। দুজনেই দুজনের গোপনীয় কথাবার্তা একে অপরের সাথে শেয়ার করি।সেই কারণেই ওর প্রেম নিয়ে অল্প কিছুটা জানি।তিনবছর আগে ভাইয়ার একটা মেয়ের সাথে রিলেশন ছিল।আমি সরাসরি কখনো দেখিনি।ওর মোবাইলে ছবি দেখেছি।দেখতে আহামরি কিছু ছিল না।তবে খারাপও বলা যায় না।আমি তো ভেবে নিয়েছিলাম ওই মেয়েই আমার ভাবী হবে।ওরা মাঝেমধ্যে রেস্টুরেন্টে, পার্কে মিট করত। এগুলা সব আমাকে বলত বাসায় এসে।কিন্তু হঠাৎ করেই ভাইয়া অনেকটা চেঞ্জ হয়ে গেল।আর এটা আমি সহজেই উপলব্ধি করেছি।ভাইয়া ওর প্রেম সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করল।কিছু বলতে চাইত না।তাই আমিও আর জোর করতাম না।আমার যতটুকু মনে হয় ওই মেয়েটার সাথে ভাইয়ার ব্রেকআপ হয়ে গেছে।আর এখন ওর নতুন কোনো রিলেশন আছে কিনা সেটা বলতে পারি না।”

তুষ্টি আপুর কথা শুনে কিছুটা অবাক হলাম।
তবে অবাক হওয়ার কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না।মেয়েটা বোধ হয় উনার অতিমাত্রার রাগের শিকার হয়েছিল।নিশ্চয়ই তুষার ভাইয়া রাগ সামলাতে না পেরে চড় মেরে মেয়ের গাল চ্যাপ্টা বানিয়ে দিয়েছে।সেই কষ্ট অপমান সইতে না পেরে মেয়ে ব্রেকআপ করে চলে গেছে।হিহিহি।
কিন্তু ওই নীল ডায়রিটার লেখাগুলো কাকে উদ্দেশ্য করে লিখা?প্রাক্তনকে নিয়ে!
নাকি উনি আবার নতুন করে কারো সাথে রিলেশনে জড়িয়েছেন।

” এই নীলাশা! চল চল একটু সামনে এগিয়ে যাই।বাজি ফাটাবে এক্ষুনি।আমি আজ ফানুস উড়ানো দেখবই।”

তুষ্টি আপুর চিৎকারে ধ্যান ভাঙলো আমার।ঘড়ির কাঁটা কি তাহলে বারো’য়ের ঘরে উঁকি ঝুকি মারছে!

আপুর হাত ধরে আমি সামনে এগিয়ে গেলাম।
সকলের ধাক্কাধাক্কিতে বেহাল অবস্থা।
হঠাৎ আমার ডানপাশে কারো উপস্থিতি টের পেতেই সেদিকে তাকালাম।সেটা আর কেউ নয়।তুষার ভাইয়া।
উনি এত কাছ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছেন যে আমি পড়েছি বিপাকে।উনি উনার দল ছেড়ে এইখানে কোন রাজকার্য করতে এসেছেন কে জানে।
দুইহাত জ্যাকেটের ভেতরে ঢুকিয়ে তুষার ভাইয়া বললেন,

” তোর গায়ে সুয়েটার কোথায়?শীত ঠান্ডা কোনোটাই লাগে না?”

আমি চটপটে গলায় উত্তর দিলাম,
” সত্যিই লাগে না ভাইয়া।আমি ঠিক আছি।”

” ঠিক তো থাকবিই।দিনে দিনে তোর গায়ের চামড়া গন্ডারের চামড়ায় রূপ নিচ্ছে সেটা তো ভুলেই গেছি।গন্ডারদের কিন্তু শীত লাগে না জানিস তো!”

” ভাইয়াআআআ! আপনি আমায় গন্ডার বললেন?”

তুষার ভাইয়া হাসিহাসি মুখ নিয়ে বলল,
” দুঃখিত।তুই গন্ডার না।তুই হলি মহিলা গন্ডার।আর এভাবে চিল্লাছিস কেনো?মাথার ঘিলু নাড়িয়ে দিবি নাকি।তুই কি জানিস তোর গলার চিৎকার শুনলে খেঁকশিয়ালির হুক্কাহুয়া ডাকের কথা মনে পড়ে।খেঁকশিয়ালির ডাক শুনেছিস কখনো?না শুনলে বল আমি ব্যবস্থা করব।”

একটা সুন্দর মুহুর্ত নষ্ট করে তুষার ভাইয়া কি শান্তি পাচ্ছে কে জানে!রাগে আমি দাঁত কিড়মিড় করছি।উনি আমাকে খেঁকশিয়ালি এবং গন্ডার নাম দুইটা উপহার দেওয়ার জন্যই এখানে এসে দাঁড়িয়েছেন তা ভালোই বুঝে গেছি।পাশ থেকে তুষ্টি আপু কিটকিট করে হেসে উঠছে।
বিড়বিড় করতে করতে বললাম,

” অন্তত এই মুহুর্তে আপনার ছড়াপাঁচালির ঝুলিটা বন্ধ রাখুন ভাইয়া।আমাকে নতুন বছরের আমেজটা উপভোগ করতে দিন।নিজেও করুন।”

” কি সর্বনাশ।ছড়াপাঁচালি কেমন শব্দ? তুষ্টির সাথে থাকতে থাকতে তুই তো ওকে ফলো করা শুরু করে দিয়েছিস।তোদের দুইজনের শব্দ ভান্ডার আবর্জনায় ভরা।মেরামত কর তাড়াতাড়ি। ”

বিরক্তিতে আমার সর্বাঙ্গ ছেয়ে গেল।এই লোকের মাঝেমধ্যে কি হয় বুঝি না।উদ্ভট সব কথাবার্তা।
এবার আপু ঝাঁজালো গলায় বলে উঠল,

” শব্দ নিয়ে গবেষণা করা বন্ধ করো ভাইয়া।তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো!ওই যে দেখো ছেলেগুলো হাত উঁচিয়ে ডাকছে তোমায়।”

তুষার ভাইয়া প্রতিত্তোরে আর কিছু বলার সুযোগ পেলেন না।ফটফট শব্দে বাজি ফুটতে শুরু করল।শীতের রাতের কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশটা মুহুর্তেই বিভিন্ন রঙের আলোতে রঙিন হয়ে উঠল।
ছাদের উপস্থিত ছেলেগুলো দুইদলে ভাগ হয়ে গেছে।একদল সমানে বাজি ফাটাচ্ছে।আরেক দল জানপ্রাণ দিয়ে ফানুস উড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। পরপর তিনটা ফানুসে আগুন ধরে যাওয়ার পর চতুর্থ ফানুসটা ওঁরা আকাশে উড়াতে সক্ষম হলো।
আমি মুগ্ধ চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ফানুস এবং বাজির উড়াউড়ি দেখছি।

হঠাৎই আমার ঠান্ডায় জমে যাওয়া হাতে কোনো শক্ত পুরুষালি হাতের উষ্ণ স্পর্শ পেলাম।
পাশে তাকাতেই দেখি তুষার ভাইয়া অপলক আমাকে দেখছেন।উনার হাতের মুঠোর মধ্যেই আমার হাত বন্দী।হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই উনি উনার আঙুল আমার আঙুলের খাঁজে প্রবেশ করিয়ে হাতটাকে আরো চেপে ধরলেন।আমার ঠান্ডা হাতটা উনার উষ্ণ হাতের উত্তাপটুকু যেন শুষে নিচ্ছে। মুহুর্তেই শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল।বুকের বাম পাশে থাকা হৃদপিণ্ডটা অতিমাত্রায় ধুকপুক করছে।মন বলছে ভাইয়ার এই চাহনি ভিন্ন,তাঁর হাতের এই স্পর্শ ভিন্ন।কিন্তু কেনো ভিন্ন!

আমি চোখেমুখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে উনার দিকে তাকাতেই কানের কাছে ফিসফিস করে উঠলেন,

” হ্যাপি নিউ ইয়ার নীল!আমার হাতের ভাঁজে তোর হাত আবদ্ধ থেকেই নতুন বছরটা শুরু হোক।”

অবুঝের মত এখনো তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি।প্রায়ই উনার কিছু কিছু কথার অর্থ উদ্ধার করতে পারি না আমি।তেমনভাবে এখনও পারছি না।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে তুষার ভাইয়া বললেন,

” কিরে! আমার মুখে বাড়তি একটা নাক গজিয়েছে নাকি আরো চারটা চোখ উঠেছে।এভাবে রসগোল্লার মত চোখ দিয়ে কি দেখছিস?আমাকে হ্যাপি নিউ ইয়ার বলবি না?”

আমার হাত এখনো উনার হাতের মধ্যে আটকে আছে। উনার চোখেমুখে একধরনের স্নিগ্ধতা বিরাজ করছে।কোনো কিছু নিজের করে পাওয়ার আকুলতা চেহারায় ফুটে আছে।তুষার ভাইয়াকে সত্যি এখন তুষারের মত শুভ্র লাগছে।
নিজের মনের কথা শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম।
আজ কি আমি এই লোকটার চোখের ভাষা পড়ে নিতে পারছি?এত ক্ষমতা আমার কিভাবে আসলো।
আচ্ছন্নের মত বললাম,

” হ্যাপি নিউ ইয়ার, তুষার ভাইয়া!”

_________________________

হরদমে বাজি ফাটানো শেষে এবার বিরিয়ানি খাওয়ার ধুম পড়ে গেল।বিরিয়ানির গন্ধে চারদিক মৌ মৌ করছে।
যাদের অতিমাত্রায় ক্ষুধা পেয়েছে ওঁরা নিজেদের প্লেট নিয়ে ইতিমধ্যে খেতে বসে গেছে।
আমি আর আপু এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছি।বিরিয়ানির গন্ধ নাকে লাগতেই আমার ক্ষিধে টা যেন লাফিয়ে উঠল।তুষার ভাইয়ার কড়া নির্দেশের জন্য এখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা লাগছে।নাহলে কখন খেয়েদেয়ে বাসায় চলে যেতে পারতাম।একটু আগেই উনি এসে বলে গেছেন উনি নাকি খাবার নিয়ে আসবে।ওখানে নাকি অনেক ছেলে।
আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছিল।ছেলে আছে তো কি হয়েছে।আমরা তো খাবার আনতে যাব।এমন তো না যে ছেলেদের সিগন্যাল দিতে যাব।লোকটা পারেও বটে।

হঠাৎই তুষ্টি আপুর ফোন বেজে উঠায় সে আমার থেকে কিছুটা দূরে চলে গেল।এবার আমি একা হয়ে গেলাম।

” তুমি এখানে কেনো নীলাশা?খাবে না?”

সাদনান ভাইয়ার আওয়াজ পেতেই চমকে উঠলাম।আপু যাওয়ার সাথে সাথেই উনি হাজির তারমানে দূর থেকে আমার উপর নজর রাখছিল!বারবার আমার সাথে কথা বলতে আসার উদ্দেশ্যটা কি সেটাই ঠাওর করতে পারছি না। ছেলেটাকে আমার এত একটা পছন্দ হচ্ছে না।তাই দায়সারাভাবে উত্তর দিলাম,

” জ্বি। আপু আসলেই খাব।”

সাদনান ভাইয়া এবার বেশ স্পষ্ট ভাষায় বলতে লাগল,
” সেদিন তো ছাদে তোমাকে কথাটা বলতে পারলাম না।তাই এখন বলতে চাইছি। আজ নতুন বছরের প্রথম প্রহর।আমার মনে হয় এখনই কথাটা বলার উপযুক্ত সময়।”

খুব অস্বস্তিতে ভুগছি আমি।আপু যে গেল আর আসার নাম নেই।সাদনান ভাইয়ার কোনো কথা শুনতে আমি আগ্রহ বোধ করছি না।পেটের ভেতর ক্ষিদের চোটে আগুন জ্বলছে।কিন্তু উনাকে তো মুখের উপর বলতেও পারছি না চলে যান আমার ক্ষিদে পেয়েছে, আমি এখন খেতে যাব।

সাদনান ভাইয়া গলা খাদে নামিয়ে বলতে লাগলেন,
” আই এম ইন লাভ উইথ ইউ নীলাশা! অনেকদিন থেকেই কথাটা বলার চেষ্টা করছি।আজ বলতে পেরে খুবই ভালো লাগছে।প্লিজ একসেপ্ট মাই লাভ!”

আমি মাথা ভনভন করে ঘুরতে লাগল।জীবনে এই প্রথম কেউ সরাসরি এভাবে প্রপোজ করে বসল।এই লোক আমাকে পছন্দ করে এটা তাহলে তুষার ভাইয়া আগে জানত।যার জন্য আমাকে বলেছিল সাদনান ভাই থেকে দূরে থাকতে।

ঠিক তখনই সাদনান ভাইয়ার পেছনে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তুষার ভাইয়ার দিকে নজর পড়ল আমার।হায় হায়! এবার নিশ্চয়ই একটা বড় ঝামেলা হতে চলেছে।আল্লাহ! সব ঝামেলা কি আমার ঘাড়ে এসেই ঠাই নেয়?
তুষার ভাইয়ার চাহনি ঠিক লাগছে না আমার।এমনভাবে দেখছেন আমাকে যেন লবণ মশলা ছাড়াই কাঁচা গিলে খাবেন।
তুষার ভাইয়া রাগী গলায় বলে উঠলেন,

” সাদনান, তোকে আমি বলেছিলাম নীলাশার আশেপাশেও থাকবি না।তুই সব জেনেও ওকে প্রপোজ করে বসে আছিস?কেনো ওর দিকে হাত বাড়াচ্ছিস!”

সাদনান ভাইয়া তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
” হ্যাঁ সব জেনেও ওকে প্রপোজ করেছি আমি।ভালোবাসি ওঁকে আমি।তোর তো কোনো কিছুর অভাব নেই।টাকা, বাড়ি-গাড়ি, চেহারা সবই তো আছে।তুই চুটকি বাজালেই মেয়েরা লুটিয়ে পড়বে।তাহলে আমার আমার আর নীলশার মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে কেনো দাঁড়াবি!”

” সাদনান…”

তুষার ভাইয়া সাদনান ভাইয়ার কলার চেপে ধরল।উচ্চ শব্দে সাউন্ড বক্স বাজার কারণে কেউ এপাশটায় এত খেয়াল করছে না।
ভয়ে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।তাঁরা দুইজন কি নিয়ে এভাবে দ্বন্দ্ব যুদ্ধ লেগে গেল আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।
সাদনান ভাইয়া তুষার ভাইয়াকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেন না।তখনই কয়েকটা ছেলে ঘটনাটা দেখতেই ছুটে আসলো।ওরা বহুকষ্টে তুষার ভাইয়াকে ছাড়িয় আনল।দুজনেই রাগে ফুঁসছে। ছেলেগুলো সাদনান ভাইয়াকে টেনে অপর পাশে নিয়ে যেতেই তুষার ভাইয়া আমার দিকে হিংস্র চাহনি দিলেন।ভয়ে আমার কলিজা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। সাদনান ভাইয়ার রাগ এবার তাহলে আমার উপর ঝাড়বেন!

কিছু বুঝে উঠার আগেই ভাইয়া আমার হাত টেনে সিড়ির দিকে নিয়ে গেলেন।এত জোরে ধরেছেন মনে হচ্ছে হাতটা এক্ষুনি ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে।ব্যথা সহ্য করতে না পেরে হালকা আর্তনাদ করে উঠলাম।

” হাতটা মনে হয় দু টুকরো হয়ে যাচ্ছে ভাইয়া।ছাড়ুন।আমি নিজে থেকেই হাঁটতে পারব।”

আমার চিৎকার কানে তুলছেন না তিনি।তুষার ভাইয়া এখন রাগের উচ্চ সীমানায় পৌঁছে গেছেন।উনার এই রূপটাকে আমি বরাবরই ভয় পেয়ে এসেছি।রাগে উনার ফর্সা চেহারাটা রক্তিম হয়ে উঠেছে।

চলবে…

#মন_গহীনে
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_১২

হিড়হিড় করে টানতে টানতে তুষার ভাইয়া আমায় লিফটের ভেতর নিয়ে গেলেন।
ছাদের হিমশীতল বাতাসে এমনিতেই আমার হাত-পা গুলো ঠান্ডা হয়ে ছিল।এখন তো আরো শিথিল হয়ে গেছে।
উনি দুইহাত মুঠ করে সটান দাঁড়িয়ে আছেন।বড়সড় একটা ঢোক গিলে বললাম,

” ভাইয়া..আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেনো?প্লিজ শান্ত হন!”

ভয়াবহ দুটো জলন্ত চোখ নিয়ে ভাইয়া আমার দিকে ফিরলেন।রক্ত হিম হয়ে আসলো আমার।
উনি সর্বশক্তি দিয়ে আমার দুইকাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে উঠলেন,

” তুই কি তাহলে আমায় হাসতে বলছিস?আমার এখন হাসা উচিত ?শুনলি না ওই হ্রামি কি বলল!সে তোকে ভালোবাসে!আমার সামনে এটা বলার সাহস কোথায় পেল?বারবার না করা সত্বেও সে তোর আশেপাশে ঘুরঘুর করেছে।আমাকে বলছে তৃতীয় ব্যক্তি!এরপরও তুই আমায় বলছিস শান্ত হতে!

এবার আমার অবস্থা আরো করুণ হয়ে গেল।কাঁধের হাড়গোড় বোধ হয় কটমট শব্দে ভাঙতে শুরু করেছে।কিন্তু যে করেই হোক আমার এখন ভাইয়াকে শান্ত করতে হবে।

” সাদনান ভাইয়া ভালোবাসে বলেছে তো কি হয়েছে! আমি তো আর উনার কথায় রাজি হয়ে যাই নি।তাহলে কেনো আপনি শুধু হাইপার হচ্ছেন ভাইয়া!”

তুষার ভাইয়া হাত দিয়ে আমার দুইগাল টিপে ধরলেন।আমি হতবাক হয়ে গেলাম।উনি এমন সাইকোর মত ব্যবহার কেনো করছেন!উনার রাগের চোটে আমি ব্যথায় জর্জরিত হয়ে যাচ্ছি তা কি তিনি বুঝতে পারছেন না!

” সে তোকে ভালোবাসি কেনো বলবে?হুম? ওর হয়ে সাফাই গাইছিস?দোষ তো তোরও কম নয়।আমি না করার পরও তুই সাদনানকে কথা বলার সুযোগ দিয়েছিস।কিছুদিন আগে বিকেলে ছাদে ওর সাথে দেখা হয়েছিল।তখনও কথা বলেছিস আর আজও। কেনো এড়িয়ে যেতে পারিস নি ওকে?আমার তো মনে হয় ছেলেদের থেকে এইসব বাক্য শুনে তুই চরম মজা পাস।আনন্দ হয় তোর তাই না যার জন্য সাদনান তোকে ভালোবাসি বললেও তোর কোনো খারাপ লাগা নেই।”

তুষার ভাইয়ার এমন নিকৃষ্ট কথাগুলো আমার কানে শূলের মত বিঁধে গেল।দুটো কথার দ্বারা উনি আমায় কত নিচে নামিয়ে দিলেন!কি এমন বলেছি আমি?কেউ আমাকে ভালোবাসি বললে সেখানে আমার কি ই বা করার আছে।আমি তো আর কাউকে সেধে নিয়ে আসি না।
শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে তুষার ভাইয়াকে ধাক্কা মেরে বললাম,

” আপনি একজন উন্মাদ ভাইয়া।বদ্ধ উন্মাদ।আপনার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে।এত গুলো খারাপ কথা আপনি আমাকে বলতে পারলেন?যেখানে আমি কোনো দোষই করিনি!কেনো আপনি আমাকে দুচোখে দেখতে পারেন না?আমি আপনার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি?আজকের পর থেকে আমার চোখে আপনার অবস্থান টা কোথায় নেমে গেছে তা আপনি ভাবতেও পারবেন না।এতদিন শত বকা দিলেও,রাগ দেখালেও আপনাকে আমি সম্মানের চোখে দেখতাম।কিন্তু আজ যা করলেন এরপর তো নয়ই।”

লিফট চার তলায় পৌঁছাতেই আমি বড় বড় পা ফেলে নেমে গেলাম।তুষার ভাইয়া আমার দিকে অপরাধী চোখ নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন।থাকুক তাকিয়ে।মুখে যা আসে তা বলে দিলেই হয়ে গেল তাই না?আমাকে কি মানুষ মনে হয় না উনার?আমি ছোট বলে আমার মধ্যে কোনো খারাপ লাগা নেই?রাগ উঠলেই যা তা শুনিয়ে দেবে আর আমি চুপ করে তা হজম করে নিব সেটা হবে না।
.

ঘরে ঢুকতেই ড্রয়িংরুমে মা’য়ের মুখোমুখি হয়ে গেলাম।মা বসে বসে টিভিতে সিরিয়াল দেখছিলেন।আমাকে দেখতে পেয়েই জিজ্ঞেস করল,

” কিরে তোদের পার্টি শেষ?গানের আওয়াজ তো এখনো শোনা যাচ্ছে। তোরা কিভাবে পারিস ঘন্টার পর ঘন্টা এত শব্দের মধ্যে বসে থাকতে।আমার তো ঘরে থেকেই মাথা ধরে গেছে।”

মা’য়ের কথার কোনো উত্তর দিলাম না।চুপচাপ জুতোগুলো সু কেবিনেটের ভেতর ঢুকিয়ে রাখলাম।মা এবার বলে উঠল,

” তোর কি হয়েছে রে?মুখটা দেখতে অন্ধকার লাগছে কেনো?”

” কিছুনা মা।ঘুম পাচ্ছে। ”

” তাহলে যা শুয়ে পর।তোর বাবা অনেকক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে গেছে।আমি তো এই সিরিয়ালটা দেখার জন্য বসে আছি।তুই যা।”

রুমে এসে হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।মনটা বিষিয়ে আছে।নতুন বছরের দিনেই তুষার ভাইয়া আমার সাথে এমনটা করতে পারল।কোথায় ভাবলাম হাসি-খুশি মুড নিয়ে আজ রাতটা কাটাব।কিন্তু তা আর হলো কই।তুষার ভাইয়ার বলা তিক্ত কথাগুলো মনে হতেই কান্না পাচ্ছে।

ঘুমে চোখটা লেগে এসেছিল তখনই দরজায় ঠকঠক শব্দে জেগে গেলাম।মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল।উফ্! কেউ আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিবে না নাকি যত্তসব!
দরজা খুলতেই দেখি মা রাগী চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছেন।আজ কি সবাই আমার সাথে রাগ দেখাবে?অন্তত নতুন বছরটাতে ছাড় দেওয়া যায় না!

” এই ফাজিল মেয়ে! তুই তখন উপর থেকে খেয়ে আসিস নি!তাহলে কি করতে গেছিলি ওইখানে?তুষার ফোন করে না বললে তো জানতেই পারতাম না যে তুই না খেয়ে আছিস।জলদি ডাইনিংয়ে গিয়ে বস।ডিম ভেজে দিব। ফ্রিজে ডাল আছে।এত রাত করে অন্য কিছু বানাতে পারব না।জ্বালিয়ে মারবে এই মেয়ে আমায়!”

কথাগুলো বলতে বলতে মা কিচেনে ঢুকে গেল।আমি যে রাতে খাইনি এই কথাটাই তো আমি ভুলে গেছি।অবশ্য ভুলে যাওয়ারই কথা।পেটের খিদের থেকে মনের কষ্ট অনেক বেশি।আর আমি সেই কষ্টে আক্রান্ত এক রোগী।কিন্তু তুষার ভাইয়ার আমার জন্য এত দরদ দেখানোর কি দরকার ছিল।আমি না খেলে উনার কি আসে যায়!উনার জন্যই আমার বিরিয়ানি খাওয়া মিস হয়ে গেল।এখন আমাকে ডিম দিয়ে ভাত গিলতে হবে।

ডাইনিংয়ে খেতে বসে মাকে একটা ভয়াবহ কথা বলে বসলাম।আমি জানি এই কথাটা শুনলে মা আগুনের মত জ্বলে উঠবেন।আর হলোও তাই।
মাকে বলেছিলাম আমার জন্য নতুন টিচার ঠিক করে দিতে।কারণ আমি আর তুষার ভাইয়ার কাছে পড়তে ইচ্ছুক না।আমার এই বক্তব্য শুনে মা বলল,

” কেনো তুষারের কাছে পড়তে কি সমস্যা? ওর কাছে পড়ছিস বলেই তো মাত্র দেড়মাসের মধ্যেই এত এগিয়ে গেছিস!তুই কিসের ভিত্তিতে পড়বি না বলছিস সেটা আমি বুঝতে পারছি না।”

” মা আমি পড়ব না উনার কাছে ব্যস্! ভালো লাগে না।”

” তোমার ভালো লাগা না লাগা দিয়ে কোনো কাজ নেই আমার।তুমি ওর কাছেই পড়বে।তুষারকে পড়াতে না করলেই তুই পড়ায় ঢিল দিয়ে দিবি।তোকে কি আর চিনি না আমি।আর কত কেয়ার করে তোকে ছেলেটা।তখন খাস নি বলে ফোন করে আমায় বলল।”

মা’য়ের সাথে কথার যুদ্ধে হেরে গিয়ে মনটা আরো বিষন্ন হয়ে গেল।কেউ আমার কথার দাম দেয় না,কেউ আমার খারাপ লাগা-ভাল লাগার পাত্তা দেয় না।



পরদিন সকালে তুষার ভাইয়া যথাসময়ে পড়াতে আসলেন।আমি যন্ত্রের মত উনাকে সব হোমওয়ার্ক দিয়ে গেছি।একবারের জন্যও চোখ তুলে তাকাই নি।তবে বেশ বুঝতে পারছিলাম উনি আমার দিকে অপলক চেয়ে ছিলেন।কিছু একটা বলতেও গিয়েও যেন মাঝপথে আটকে যাচ্ছিলেন।কি জানি হয়তোবা আমার মনের ভুলও হতে পারে।
পড়া শেষ হতেই ভাইয়া বলে উঠলেন,

” কথা বলবি না?তাকা আমার দিকে।”

আমি তখনো নিচের দিকে তাকিয়ে আছি।
উনার চোখে চোখ মেলানোর কোনো ইচ্ছে নেই আমার।
আমাকে চুপ দেখে আবার বললেন,

” নীল!”

আমি কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেলাম।কি করুণ গলায় ডাকছেন উনি!এভাবে ডাকলে না তাকিয়ে থাকা যায় না।তাকাবো না তাকাবো না ভেবেও হুট করেই উনার চোখে চোখ রাখলাম।
সাথে সাথেই আমি শকড্!
ভাইয়ার চেহারা কেমন ফ্যাকাশে লাগছে।মনে হচ্ছে কেউ উনার শরীরের রক্ত শুষে নিয়ে উনাকে এমন সাদা বানিয়ে দিয়েছে।কি আশ্চর্য!
মাথার চুল এলোমেলো।আজ কি চিরুনি লাগাতে ভুলে গেছেন?চোখগুলোও লালচে।সারারাত না ঘুমালেই একটা মানুষকে এমন ভয়ঙ্কর দেখায়।তাহলে কি ভাইয়া রাতে ঘুমায় নি!ইস! কি মায়াবী চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে।
ভাবলাম একবার জিজ্ঞেস করি কাহিনী কি!কিন্তু কালকের ঘটনা মনে পড়তেই নিভে গেলাম।উনার ব্যপারে খোঁজ নেওয়া কি দরকার!
তুষার ভাইয়া নীরব মুখে উঠে চলে গেলেন।আমার একটু খারাপ লাগল।বেশি ওভারএক্টিং করে ফেলেছি কিনা কে জানে!



সারাটা সকাল একটা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে কেটে গেল।কেনো জানি সব রাগ গিয়ে ওই সাদনান চামচিকা টার উপর পড়ছে।এই শয়তান ছেলেটার জন্যই এতসব ঘটে গেল।আমাকে নাকি ভালবাসে।হাহ্!একদিন না দুদিন সামনাসামনি দেখা হয়েছে আর এরমধ্যেই ভালোবেসে ফেলেছে।কয়েকদিন আগেই তো সাত তলার তিন্নি মেয়েটা বলল উনি নাকি কার সাথে প্রেম করছেন।এরমধ্যেই ব্রেকআপ হয়ে গেল আর আমাকে প্রপোজ করে বসে আছে! এদের মনে কি রেডিমেড ভালোবাসা থাকে নাকি বুঝি না!যাকেই ভালো লাগবে তাকেই ভালোবাসা বিতরণ করে বেড়ায়।উফ!সব ঝামেলা আমার মাথার উপরই কেনো ঘাপটি মেরে বসে থাকে বুঝি না।ঝামেলার আমাকে এত পছন্দ!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here