মনসায়রী’ ৩.

‘মনসায়রী’

৩.
অপরাহ্নের অভিমানী খেলা চলছে অবিরাম। কখনো মেঘ কখনো আলোর ঝঙ্কারিত রশ্মি। সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে একের পর এক দীর্ঘ শ্বাস ফেললো দুপুর। জীবন ওকে এতোটাই ধোঁকা দিয়েছে, যে এখন আর ভাগ্যে বিশ্বাসই করেনা। আসেনা আর বিশ্বাস। পত্রিকার জন্য ছবি আঁকতে আঁকতে আনমনে কীসব ভাবতে লাগলো। চার্জে লাগানো বাটান ফোনের দিকে আবারো নজর দিলো। ইন্টারভিউ তো ভালোই দিয়েছে কিন্তু কল আসছে না কেনো! এবারও তাহলে হতাশ হতে হবে। মন খারাপ নিয়ে ছবি আঁকায় মনোযোগ দিলো। পেছনে থেকে এক দৌড়ে দিতিয়া এসে দুপুরকে জড়িয়ে ধরলো। দুপুরের মুখে বিস্তর হাসি ফুটে উঠলো। দিতিয়া ওর কোলে মাথা রেখে আদুরে ভঙ্গিতে দুপুরের বিনুনি নিয়ে খেলতে লাগলো। বয়সে অনেকটাই বড় হলেও বোনের কাছে এখনো আঙ্গুল খাওয়া ছোট্ট দিতি রয়ে গেছে। কোথাও থেকে কোনো খবর পেলে সবার প্রথমে নিজের আপুনিকে জানাতেই স্বাচ্ছন্দ্যে বোধ করে দিতিয়া। দুপুর হাত থেকে কাগজ,কলম রেখে দিতিয়ার মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে বলল,
‘কী চাই আমার দিতিপাখির?’
দিতিয়া গালভারী করে হাসলো। সে জানে তাঁকে কোনো জিনিস মা না দিলেও আপুনি ঠিকই দেবে। তাই সব জিনিসেরই আবদার নিয়ে বসে আপুনির কাছে। মন খারাপের সাথে বলল,
‘আপুনি,আমার স্কুলব্যাগটা পুরনো হয়ে গেছে। টিচার বলেছে, নতুন ব্যাগ না নিয়ে আসলে আর ক্লাসে ঢুকতে দেবেনা। ‘
দুপুর কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকলো। দিতিয়া বুঝতে পারলো তার আপুনির কাছে হয়তো পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা নেই। দুপুরের মলিন হয়ে আসা মুখের দিকে তাকিয়ে দিতিয়া নিজের উপরই রেগে গেলো। ইশ! কেনো বলতে আসলো এই কথা। অবশ্য পুরনো ব্যাগটা সত্যিই আর চলছেনা। কালকে চেইন দুটোও নষ্ট হয়ে গেছে। রাস্তায় বই খাতা উপুড় হয়ে ছিটিয়ে পড়েছিলো। বাধ্য হয়েই একপ্রকার দুপুরের কাছে এসেছিলো। পরিস্থিতি সামলাতে দিতিয়া এদিকে বড়ই পটু। হেঁসে বলল,
‘ওওহ আপুনি, আমার এখনই ব্যাগ লাগবেনা। আমি তো তোমার সাথে মজা করছিলাম। ব্যাগ পরে হলেও চলবে। এখন আমার চুলগুলো টেনে দাও তো, বড্ড মাথাব্যাথা করছে। ‘
দুপুর মুচকি হেসে মনে মনে ভাবলো ছোটো দিতিয়াও দিনদিন বড় হয়ে যাচ্ছে। আগে যেই জিনিসের নাম ও একবার নিয়েছে তা পাওয়া না পর্যন্ত সবার ঘুম হারাম করে ছাড়তো। এখন দিতিয়াও জানে টাকা যাদের নেই তাদের কোনো স্বপ্ন দেখতে হয়না।

মাটিতে পাটি বিছিয়ে মিরা বেগম রান্না ঘর থেকে খাবারের হাঁড়ি পাতিলগুলো নিয়ে আসলেন। মিরা বেগমের সাথে তনয়াও হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে লাগলো। পান চিঁবুতে চিবুঁতে মিরার বড় জা মিরাকে দেখে মুখ কালো করে বললেন,
‘তোর মেয়ে কই? নবাবজাদী এখনো বুঝি ঘরে বসে আছে। বলি কাজ-টাজও তো শেখাতে পারিস। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে তো দুদিনও সংসার করতে পারবেনা। ‘
মিরা বেগম আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে বললেন,
‘আমার মেয়েকে নিয়ে তোমার অতো ভাবতে হবেনা ভাবী। আমার মেয়ে যা পারে তা-ই আলহামদুলিল্লাহ। ‘
ফারজানা বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
‘যাহ বাবা, আজকাল ভালো বললেও দোষ হয়ে যায়। ‘
‘আমার মেয়েকে বিয়ে দিলে তোমরা তো আবার না খেয়ে মরবে। তাই কাজ শেখাচ্ছি না। তাহলে আজ থেকে বরং কাজ শিখানো শুরু করি,পরশু বিয়ে দেবো। ‘
‘ওও, তাহলে তোর মেয়ের ওই দুটো টাকার খোঁটাটা দিয়েই দিলি। দেওরঝি মানে তোর স্বামী মারা যাওয়ার পরও যে আমার শিপু তোদের আয়-রোজগার করে একটা বছর খাওয়ালো। ওসব কিছুই না এখন! ভালো খুব ভালো। আজ আমার শিপু প্যারালাইস না হলে কী আর আমাকে এতো কথা শুনতে হতো! ‘

কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে তিনি আঁচলে মুখ চেপে মরাকান্না জুড়ে দিলেন। মিরা বেগম বিরক্তি নিয়ে কাজ করতে লাগলেন। বড় জা বলে সম্মান করলেও যখন ফারজানা বেগম অতিরিক্ত কথা শোনাতে থাকেন তখন মিরা বেগমও ছাড় দেন না। এক কথা দুই কথায় ঝগড়া লেগে যায় পুরোদমে। দুজনের চিল্লাপাল্লায় ভেতরের ঘর থেকে হুইলচেয়ার চালিয়ে শিপু বাহিরে আসলো। মায়ের হা হুতাশ আর কান্নায় বুক থেকে এক ভারি দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো। আর সহ্য করতে না পেরে নিজের মা’কেই ধমকিয়ে বলল,
‘আহা মা! থামো প্লিজ। রোজ রোজ এসব আর সহ্য হয়না আমার। তুমি আর একবার এমন করলে আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরবো বলে দিলাম। ‘
কথা বলতে বলতে শ্বাসকষ্ট উঠে গেলো প্রায়। মুখে হাত চেপে কাঁশতে লাগলো অনবরত। তনয়া নিজের স্বামীর এই অবস্থা দেখে ছুটে এলো পানি নিয়ে। শিপুকে পানি পান করিয়ে মাথার তালুতে ঘষে দিলো। ছলছল চোখে বলল,
‘আপনি এমন অলক্ষুণে কথা বলছেন কেনো? চলুন ঘরে চলুন। ‘
শিপু বিরক্ত হয়ে ধমক দিয়ে বলল,
‘তোমাকে আমি বলেছি আদিক্ষ্যেতা করতে! যত্তসব পাগল ছাগল আমার কপালেই জুটে। ‘
আকস্মিক চিৎকার তনয়া ফুপিয়ে কেঁদে চলে গেলো নিজের ঘরে। শিপু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে মিরাকে বলল,
‘চাচী খাবার দাও। ক্ষুধা পেয়েছে আমার। ‘
মিরা বেগম হকচকিয়ে মাথা নাড়িয়ে খাবার বাড়লেন। ফারজানা বেগমও কান্না থামিয়ে খেতে বসলেন। যত যা-ই হয়ে যাক খাওয়া দাওয়া তিনি ত্যাগ করতে পারবেন না। দিতিয়াও গোসল করে দৌড়ে এসে খেতে বসলো। সবাই খাচ্ছে এমন সময় দুপুর ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। মা’কে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘আম্মা, আমি একটু বের হচ্ছি। ‘
মিরা বললেন,
‘এই ভরদুপুরে কোথায় যাচ্ছিস! আর ভাত খেয়ে বের
হ। ‘
‘না আম্মা, ভার্সিটিতে যাচ্ছি তো। কয়েকটা বান্ধবীর সাথেও দেখা করতে হবে। ‘
ব্যাগে কিছু কাগজপত্র রাখতে রাখতে ব্যস্ত ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে বেরিয়ে যাচ্ছিলো দুপুর৷ শিপু গম্ভীর গলায় বলল,
‘দাঁড়া দুপুর। ‘
দুপুর শিপুর দিকে প্রশ্নেসূচক দৃষ্টিতে তাকালো। শিপু ওকে হাত দিয়ে ইশারা করে পাশে বসতে বললো। দুপুর আলতো পায়ে এসে শিপুর পাশে বসলো। শিপু ভাত মাখিয়ে দুপুরের মুখের সামনে ধরে বলল,
‘হা কর দেখি। ‘
দুপুর ভড়কে গেলো। এটা যদিও নতুন নয়। আগে ছোটোবেলায় প্রায়ই দুপুর আবদার করতো শিপুর কাছে এসে ওর হাতে খাওয়ার। শিপুও বাহিরে রাগ দেখিয়ে ঠিকই খাইয়ে দিতো। দিনে একবার শিপুদার হাতের ভাতের লোকমা পেটে না গেলে পেট ভরতো না দুপুরের। আগে তো খুব আদুরী ছিলো। এখন কারো হাতে খেতে গেলে একটা অস্বস্তি কাজ করে। এমনকি মায়ের হাতে খেলেও। হালকা হেঁসে বলল,
‘শিপুদা, আমি বাহির থেকে এসে খেয়ে নিবো। ‘
শিপু বকা দিয়ে বলল,
‘মার খাবি দুপুর? এতো বেশি বুঝিস কেনো! চুপচাপ হা কর। ‘
অগত্য হা করে লোকমাটা মুখে নিলো দুপুর। অনেকদিন পর সেই পুরনো স্মৃতিতে সিক্ত হয়ে মনটা কেমন করে উঠলো ওর। চোখ মুছে উঠে যেতে নিলেই, শিপু বলে উঠলো,
‘এক লোকমা খেতে নেই। আরেকটু খা। ‘
আরেকটু আরেকটু বলে পাঁচ ছয় লোকমা খাওয়ালো দুপুরকে। দুপুরের দেখাদেখি দিতিয়াও আবদার করলো শিপুর হাতে খাওয়ার। শিপু মুচকি হেসে ওকেও খাওয়াতে লাগলো। দুপুর নাইনুকুর করে উঠলো শেষে। মিরা বেগমের মনে পড়লো তনয়াও সকাল থেকে কিছু খায়নি। তিনি শিপুকে বললেন,
‘তনয়াকেও ডেকে আনি। তনয়া তো একা আর খেতে চাবেনা। তুই ওকেও খাইয়ে দিস। ‘
বলেই গলা উঁচু করে ডাকতে নিলেন তনয়াকে। শিপু হাত বাড়িয়ে মিরাকে থামিয়ে বলল,
‘চাচী, তনয়াকে তোমার সাথে নিয়ে বসো। এখন তো আমারও খাওয়া প্রায় শেষই। ‘
দুপুর খাওয়া শেষ করে মিষ্টি হেঁসে বেরিয়ে গেলো। আজকে পুরনো কথা গুলো মনে পড়ায় একটা আলাদা ভালো লাগায় মন ভরে আছে। যদিও ভার্সিটিতে গিয়ে সেই ভালো লাগা কতটুকু টিকবে তা জানেনা নিজেও। দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো দুপুর। দিতিয়াকে তখনও মাঝে মাঝে দুই এক লোকমা খাইয়ে দিচ্ছে শিপু। ঘরের দরজার আড়াল থেকে সবটাই দেখলো তনয়া। একদফা কেঁদে চোখমুখ লাল হয়ে ছিলো তার। আড়ালে দাঁড়িয়ে সব কথাই শুনেছে সে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিস্তেজ কন্ঠে বলল,
‘আপনি তো সবার বেলায়-ই বড় দায়িত্ববান শিহাব। শুধু আমার বেলাতেই কেনো এই অবিচার?’


ক্যাম্পাসে ঢুকে কাজলকে একটা কল দিলো দুপুর৷ মেয়েটার সাথে অনেক দিন দেখা হয়না। ভাবতে ভাবতেই কোথা থেকে দৌড়ে আসলো কাজল। দুপুর বলে চিৎকার করে এসে জড়িয়ে ধরলো। কাজলের পিছনে পুরো বাঁদরবাহিনী দাঁড়িয়ে আছে। কাজলের পর একে একে রুশা, মিহা, রিয়াদ,দিহান, আকাশ এসে জড়িয়ে ধরলো। দুপুরের চোখে পানি এসে গেলো সবাইকে একসাথে দেখে। দুপুরের ফোলা গালদুটো জোরে জোর টেনে দিয়ে কাজল বলল,
‘এতদিন পর মনে পড়লো আমাদের কথা? ‘
দুপুর চোখ মুছে মলিন হেঁসে বলল,
‘মনে তো প্রতিদিনই পড়ে তোদের কথা। কিন্তু কাজের এতো চাপ যে আসার সময়ই পাইনা। ‘
অনেক দিন পর সঙ্গে অনেক সময় নিয়ে আড্ডা দিলো দুপুর। আগে যাদের সঙ্গে প্রতিদিনই অর্ধেকটা সময় কাটিয়ে দিতো অনায়াসে। আজ তাদের সঙ্গেই দেখা হলো ছয় মাস পর। আড্ডার মাঝে আকাশ বলল,
‘দুপুর,কালকে যেখানে ইন্টারভিউ দিলি সেখান থেকে কোনো কল এলো?’
দুপুর মুখ গোমড়া করে বলল,
‘নারে, এই চাকরিটাও হবেনা সম্ভবত। ‘
‘ মন খারাপ করিস না তো। কিছু একটার বন্দবস্ত হয়েই যাবে। ‘
তবুও মনটা খারাপ হয়ে থাকলো দুপুরের। চিন্তা করতে লাগলো, সামনের মাসের এতো খরচ কী করে চালাবে। মিহা ওর মন খারাপ বুঝতে পেরে ওকে হাসানোর জন্য বলল,
‘জানিস দুপুর, এখন ছেলেরা আমাকে কতো পাত্তা দেয়! তুই থাকতি বলে ছেলেরা মৌমাছির মতো তোর আশেপাশে গুনগুন করতো। আমি কিন্তু তোর সব ছেলে ফ্যান নিয়ে নিয়েছি! হুহ। ‘
দুপুর হেঁসে ফেললো মিহার কথার ভঙ্গিতে। মিহা চমৎকার একটা মেয়ে। বাকি সবার সাথে ওর পরিচয় ভার্সিটি থেকে হলেও, একমাত্র মিহাই কলেজ লাইফের ফ্রেন্ড। একসময় জুতোটা পর্যন্ত দু’জন মিলিয়ে পড়তো। টাকার তো অভাব ছিলো না। সপ্তাহে একবার অঢেল কেনাকাটা করা অভ্যাস ছিলো। এখন কাপড় মিলিয়ে পড়ার অতো শৌখিনতার সময় কোথায় দুপুরের? মিহার কথাতে দিহান মিহার মাথায় ঠুয়া মেরে বলল,
‘তোরে ক্যাডা পাত্তা দিসেরে! তুই তো একটা লুচ্চি মাইয়া। দুপুরের পা ধোঁয়া পানি খাইস। কই গোলুমোলু মিষ্টি একটা মাইয়া দুপুর। আর কই শেওড়াগাছের পেত্নী তুই! ‘
মিহা ন্যাকা কান্না করে দিহানের পিঠে তিন চারটা কিল বসিয়ে দিলো। ওদের হাসিঠাট্টার মাঝে দুশ্চিন্তারা যে কোথায় পালালো! দুপুর ওদের সবাইকে দেখে খুব খুশি হলো। দেড় ঘন্টা পর সবাই যে যার মতো বিদায় নিয়ে চলে গেলো। দুপুর ব্যাগটা এক হাতে শক্ত করে চেপে ভবনের ভেতরে ঢুকলো। আজকে মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার শেষ ডেট। এজন্যই মূলত দুপুর এখানে এসেছে। প্রতি পরীক্ষাতেই স্কলারশিপ পাওয়ায় তেমন একটা খরচ দিতে হয়না। কিন্তু, শেষের একটা পরীক্ষায় কাজের অনেক চাপ থাকায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। তাই রেজাল্ট খুব একটা খারাপ না হলেও, স্কলারশিপ মিস গেছে। আজকে নিজের জমানো ব্যাংক একাউন্ট থেকে ডিপোজিটে রাখা সবগুলো টাকা তুলে নিয়েছে দুপুর। যদিও তা খুব বেশি না। গত সাত মাসের জমানো কয়েকটা টাকা।
ভেবেছিলো এই টাকা দিয়ে বাসা ভাড়া দিবে। কিন্তু এমন সময় মিহা কল দিয়ে জানালো আজই শেষ তারিখ ভর্তি হওয়ার। আর যদি দুপুর মাস্টার্সে ভর্তি না হয় তাহলে তো ভালো কোনো চাকরিও পাবেনা। অন্তত ইন্টারভিউতে বলতে তো পারবে মাস্টার্সে অধ্যায়নরত। কাউন্টারের লাইনে দাঁড়িয়ে প্রচুর ঘামছে দুপুর। আশেপাশে এতো হট্টগোল করছে। অনেক সিনিয়র জুনিয়রের আনাগোনা। অনেক দিন তো হলো ভার্সিটি আসেনা। তাই, অনেক গুলো নতুন মুখ দেখছে। আবার পুরনো অনেককেই নতুন বলে মনে হচ্ছে। দুপুর চুপচাপ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলো। সামনে পেছনে দুদিকেই ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে ওর। এতো ছেলেদের মাঝে অভ্যস্ত না দুপুর। পড়াশোনার মাধ্যমেই কয়েকটা ছেলের সঙ্গে পরিচয়। তারা হলো রিয়াদ, দিহান আর আকাশ। যাদের সঙ্গে ভাই বোনের মতো সম্পর্ক। প্রায় এক ঘন্টা রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। এতো রোদ যে পায়ের তলাটা পর্যন্ত পুড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই শরীরটা খারাপ হতে লাগলো দুপুরের। মাথা ঘুরিয়ে একবার পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিলো। অবশেষে ওর সামনের জনের কাজ শেষ হলো। কাউন্টারের মহিলাটাকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি ভর্তির ফিস বললেন। দুপুর শুকনো ঢোক গিলে ব্যাগ থেকে টাকা বের করে গুণতে শুরু করলো। তারপর দেখলো দুই হাজার টাকা শর্ট। ভুল হলো কিনা ভেবে আবারো গুনতে লাগলো। কিন্তু পরেরবারও একই। ভুল হয়নি, কারণ দুপুর এই কয়টা টাকাই নিয়ে এসেছে। দুপুর কী করবে এই মুহূর্তে ভেবে পাচ্ছে না। কান্না এসে গেলো। কিন্তু কান্না করলে তো চলবে না। কান্না চাপানো গলায় মহিলাটিকে বলল,
‘আপনি একটু অপেক্ষা করবেন, আমি একটু যাবো আর আসবো। এই টাকাগুলো রাখুন, বাকি দুই হাজার একটু পরই নিয়ে আসছি। ‘
মহিলাটি কিছু একটা ভেবে বললেন,
‘ঠিক আছে, তবে তাড়াতাড়ি করুন৷ আর এক ঘন্টার মধ্যেই আজকের মতো কাউন্টার বন্ধ হয়ে যাবে। ‘
দুপুর অসহায় চোখে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে চলে আসলো। কল করলো মিহাকে। মিহার কল বন্ধ আসছে। একে একে সবার মোবাইলেই কল করলো। কিন্তু, ভাগ্য এতো খারাপ যে কেউই ওর ফোন ধরলো না। মূলত সবাই তখন একইসাথে ছিলো। ঘুরতে বের হওয়ায় জায়গাটায় নেটওয়ার্কও ছিলো না। দুপুরের পুরো শরীর কাঁপছে। কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা। নিজেকে শেষমেষ সামলাতে না পেরে কোণায় একটা সিঁড়িতে বসে মুখ ঢেকে হুহু করে কেঁদে উঠলো। কেন জীবন বারবার ওর সাথেই এমন করে! কেনো একটু সুখে থাকতে চাইলেই ধোঁকা দিয়ে চলে যায় সুখপাখি? আধা ঘণ্টা ধরে মুখ চেপে নিরুপায় হয়ে বসে রইলো। যেই ভাবলো, হয়তো উপরওয়ালা চায়না আর পড়াশোনা করুক দুপুর। কষ্টে ভেঙে চৌচির হওয়া শরীর আর মন নিয়ে উঠে গেলো। টাকা গুলো ফেরত নিয়ে আসার কথাও ভাবলো। যেই কাউন্টারের দিকে আগাবে, হঠাৎ করেই মাথা ঘুরিয়ে চোখে মুখে অন্ধকার দেখলো। টাল সামলাতে না পেরে ওখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো। নিভু নিভু চোখে শুধু এতটুকু দেখলো কে যেনো ওর মাথাটা কোলে তুলে নিয়েছে। মিষ্টি একটা মনকাড়া সুবাস নাকে এসে লাগছে। গোলকধাঁধার মতো সেই ঘ্রাণে ডুবে চোখ বুজে পুরোপুরি জ্ঞান হারালো দুপুর।
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন ভার্সিটির রেস্ট রুমে শোয়া অবস্থায় দেখলো। পিটপিট চোখে তাকিয়ে রইলো। হুঁশ ফিরতেই লাফিয়ে উঠে বসলো। কোমড় সমান চুলগুলো খোঁপা খুলে পড়ে আছে। গায়ের ওড়নাটা ভালো করে বুকে জড়িয়ে নিলো। তাকিয়ে দেখলো চারপাশে রিয়াদ, দিহান, মিহা, কাজল সবাই দাঁড়িয়ে আছে। ওই জায়গা থেকে বেরিয়ে দুপুরের এতোগুলো কল দেখে সবাই ভয় পেয়ে ছুটে এসেছে। দুপুরকে সবাই জিজ্ঞেস করলো এখন কেমন লাগছে। দুপুর শক্ত মূর্তির মতো মাথা নেড়ে বললো, এখন তার ভালো লাগছে। হঠাৎ মনে পড়লো, এতক্ষণে হয়তো একঘন্টা শেষ হয়ে গিয়েছে। বেড থেকে উঠতে গিয়ে দেখলো কাউন্টারের মহিলাটা নিজেই রুমে এসেছে। তিনি হাস্যজ্জ্বল মুখে বললেন,
‘তোমার ব্যাগপত্র ফ্লোরে পড়া ছিলো। নাও দেখে নাও, চেক করে।’
দুপুরের সেদিকে খেয়াল হলো না। সে করুন চোখে তাকিয়ে বলল,
‘এক ঘন্টা কী শেষ আপু?আমি আর ভর্তি হতে পারবো না? ‘
এহেন কথায় তিনি মৃদু হেসে বললেন,
‘আবার কীসের ভর্তি? তোমার ভর্তির কাজ শেষ তো। ‘
দুপুর আশ্চর্য হয়ে বলল,
‘শেষ মানে? টাকা তো দুই হাজার কম ছিলো। আর ভর্তি করালো কে?’
‘আরে! ঐ যে সুন্দর করে ছেলেটা তোমাকে কোলে তুলে এখানে এনে শোয়ালো। সেই ছেলেটাই তো বলল, তোমার থেকে নাকি সে দুই হাজার টাকা ধার নিয়েছিলো। এখন সেটাই সে পরিশোধ করতে চায়। ওই ছেলেটাই সবটাকা দিয়ে তোমার কাগজপত্র দেখে ফর্ম ফিল আপ করে দিলো। ‘
এবার অবাকের চূড়ায় পৌঁছে গেলো দুপুর। কাকে সে দুই হাজার টাকা ধার দিয়েছিলো! এমন কিছুই তো মনে পড়ছেনা। দুপুর বলল,
‘আপু, আপনার কী ছেলেটার নাম মনে আছে?’
‘কী যেনো বলল! ওহ হ্যা, সায়র দেওয়ান। ‘
‘কীসে পড়ে জানেন?’
‘হ্যা,আজই অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে ভর্তি হয়ে গেছে। তোমার থেকে দুই তিন ইয়ার জুনিয়র হবে। ‘

চলবে-
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।
শব্দসংখ্যা-২১৫৬।

[পাঠকরা, কষ্ট করে দুইটা লাইনে নিজের ভালো লাগা, খারাপ লাগা গুলো জানাবেন। নাহলে, আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব না গল্প আপনাদের কাছে কেমন লাগছে। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here