মনসায়রী’ ১৫.

‘মনসায়রী’

১৫.
দমবন্ধ হয়ে এলো যেনো দুপুরের। অস্বস্তি আর লজ্জায় গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। সায়র তখনও নিজের বলিষ্ঠ হাতটা চেপে রেখেছে দুপুরের মুখে। দুপুর আর থাকতে না পেরে ধারালো দাঁতে সর্বশক্তি দিয়ে কামড় দিলো সায়রের হাতে। সায়র চাপা চিৎকার দিয়ে সরে গেলো। দুপুর দম ফিরে পেয়ে খুকখুক করে কেশে উঠলো। গলায় হাত ডলতে ডলতে সায়রের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলল,
‘এভাবে মুখ চেপে ধরলে কেনো!’

সায়র হাত ঘষে বিরক্ত কন্ঠে বলল,
‘তো কী করতাম? আপনি তো চিৎকার দিয়ে বাসটাই উড়িয়ে দিচ্ছিলেন! ‘

দুপুর চোখ গরম করে বলল,
‘আমার চিৎকারে বাস উড়ে যেতো!’

‘যেতোই তো!’

সায়রের নির্লিপ্ত উত্তরে দাঁত কটমট করে মুখ ফুলিয়ে বসলো দুপুর। পেছনে থেকে ফারাহ দুজনের কথা শুনে ডেকে বলল,

‘কী হয়েছে দুপুর? ঝগড়া করছো কেনো দুজন?

দুপুর সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ফারাহর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আপু তুমি সিট ছেড়ে পেছনে গেলে কেনো! আর এই উজবুকটা আমার পাশে কী করছে? ‘

ফারাহ হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমতাআমতা করে বলল,
‘ইয়ে মানে, আমার গরম লাগছিলো। বমি করার অভ্যাস আছে বাসে উঠলে। আর ঐ সিটে ফ্যানের বাতাস তেমন লাগে না। তাই আমি সায়রের সাথে সিট এক্সচেঞ্জ করেছি। ‘

দুপুর দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘আমাকে বললে না কেনো! তুমি উইন্ডো সিটে বসতে।’

‘আসলে,তুমি তো ঘুমিয়ে ছিলে। তাই ডিস্টার্ব করতে চাইনি। ‘

‘ঠিক আছে, কিন্তু এই ছেলেটা এখানে কী করছে! এটা তো বিজনেস ট্রিপ তাই না! ‘

ফারাহ থতমত খেয়ে বলল,
‘হ্যা বিজনেস ট্রিপই। কিন্তু, সায়রকে স্যারই আসতে বলেছেন। সায়র তো কখনো কক্সবাজার যায়নি তাই আরকি। ‘

দুপুর বিরক্ত হয়ে ভোঁতা মুখে বসে রইলো। ফারাহ তা দেখে বলল,
‘রাগ করো না লক্ষ্মীটি! আর তো বেশিদূর নয়। আজকে একটু মানিয়ে নাও। ‘

বলে ফারাহ সায়রকে চোখ দিয়ে ইশারা করলো দুপুরের সাথে মানিয়ে চলতে। সায়র থামস আপ করে বোঝালো ঠিক আছে।
দুপুর মহাবিরক্ত। এই ছেলেটার সাথে ওর যতবার দেখা হয়েছে ততবারই কিছু না কিছু অঘটন ঘটেছে। এটাও সত্যি সায়র অনেক সাহায্যও করেছে। কখনো বাসে খারাপ স্পর্শ থেকে বাচিঁয়েছে তো আবার মৃত্যুর মুখ থেকে টেনে এনেছে। তারপরও একে ভালো না লাগার একটাই কারণ। সায়রকে ওর একেবারে অনুভূতিহীন লাগে। এমন এটিটিউডআলা মানুষদের দুই চোখে দেখতে পারেনা দুপুর। এই যে ছেলেটা পাশে বসেছে, একজন মেয়ের সঙ্গে কীভাবে ব্যবহার করতে হয় এটাও জানেনা। মুখ চেপে ধরে একটু আগে মেরেই ফেলছিলো। বেয়াদব কোথাকার।
মুখ বাকিয়ে অন্য পাশে ফিরে রইলো দুপুর৷ পুরো যাত্রাই মাটি হলো। মিনিট পাঁচেক পরই সায়র একটা চিপসের প্যাকেট খুলে দুপুরের দিকে এগিয়ে বলল,
‘নিন, আপনার মুখটা পেঁচার মতো না করে চিপস খেয়ে একটু ভালো করুন। ‘

দুপুর চোখ বড় করে তাকালো। ছেলেটা কী তাঁকে খোঁচা দিলো! কথার খোঁচা! অসহ্যকর। দুপুর ধাক্কা দিয়ে চিপসটা ফেলে দিয়ে বলল,
‘চুপ করে বসে থাকো! বসের ছেলে দেখে যে কিছু বলবো না। এই ধারণা একদম রাখবেনা! ছোট ছোটোর মতোই থাকো। বড় সাজতে আসবেনা। ‘

দুপুর ভেবেছিলো চিপস ফেলে দেওয়ায় সায়র রাগারাগি করবে। হুমকি ধমকি দিয়ে একাকার করবে। বিপরীতে সায়র কিছুই করলো না। শুধু ওকে অবাক করে দিয়ে হাসলো। পরপরই আরেকটা চিপস খুলে খেতে লাগলো চুপচাপ। দুপুরকে আর সাধলো না। মনে মনে বিরবির করতে করতে জানালার বাহিরে তাকিয়ে রইলো দুপুর। হাই তুলতে তুলতে ঘুমিয়ে পড়লো। এর প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা পর বাস থামলো। এরপর নদীপথের ভ্রমণ শুরু হবে। দুপুর ঘুমের মধ্যে অনুভব করলো কেউ গালে হাত রেখে ফিসফিস করে কিছু বলছে। চোখ খুলে দেখলো সায়র ঝুঁকে কিছু বলছে। ছিঁটকে দূরে সরে গেলো দুপুর। সায়র সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
‘উঠুন, বাস থেমেছে। আমাদের নামতে হবে। ‘

বলে নেমে গেলো সায়র। অনেকক্ষণ বসে থাকায় পা ঝিমঝিম করছে। বাহিরের প্রাকৃতিক ঠান্ডা বাতাস রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ছে।
চোখ বন্ধ করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে সায়র। সবাই খাওয়ার জন্য একটা দোকানে ঢুকেছে। অনেকের আবার প্রকৃতির ডাক এসেছে। যে যার মতো আছে ৷ আধা ঘণ্টা সময় হাতে আছে।
একটা কল আসায় রিসিভ করে কথা বলতে লাগলো। দুপুর সময় নিয়ে বাস থেকে নামলো। বিকেল তখন পাঁচটা। ক্ষুধা পেয়েছে। পেটে ইদুর দৌড়াচ্ছে যেনো। আশেপাশে কাউকেই পেলোনা। বাসের পাশে কে যেনো ফোনে কথা বলছে। গম্ভীর গলা শুনেই দুপুর বুঝলো এটা কে হতে পারে। দুপুরকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সায়র কল কেটে এগিয়ে আসলো। পকেটে এক হাত রাখা। দুপুরের থেকে একহাত দূরে দাঁড়িয়ে বলল,

‘সবাই একটু দূরের একটা দোকানে গেছে। আপনি কিছু খাবেন?’

দুপুর মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘হুম। ‘

‘আমার সাথে আসুন৷ ‘

সায়রের পেছনে পেছনে গুটিগুটি পায়ে হাঁটতে লাগলো দুপুর।
ঘুম ভেঙে ক্ষুধা পেটে আর অযথা ঝগড়া করার ইচ্ছে হলোনা।
সায়র একটা ভালো হোটেলে ঢুকলো। দুপুর বসে একটা স্যান্ডউইচ আর এক কাপ চা অর্ডার দিলো। চা খেলে শরীরটা ভালো লাগবে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সায়রের দিকে তাকলো। সায়র তখন কফি খাচ্ছে। অনেক গরম হওয়ায় ধোঁয়া ওঠা কফি ফু দিয়ে খাচ্ছে। বাতাসে কোঁকড়া চুল গুলো দুলে উঠছে। এক হাতে কফির কাপ আর অন্য হাতে মোবাইল। চোখে সাদা ফ্রেমের চশমা। ভালো লাগছে দেখতে। বলতে হয় ছেলেটা মনকাড়া সুদর্শন। একটু অন্যরকম ধরনের। দুপুরকে তাকাতে দেখে সায়র মোবাইলে নজর রেখেই বলল,

‘আমার দিকে তাকানোর আরো সময় পাবেন, এখন চা টা ঠান্ডা হয়ে যাবে না খেলে। ‘

দুপুর ভড়কে গিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। ধুর! কখন যে এভাবে তাকিয়েছে সে নিজেও বুঝতে পারেনি। কী একটা লজ্জায় পড়তে হচ্ছে এখন। নিজের সমবয়সী হলে কথা ছিলো। বয়সে ছোট একটা ছেলে কীভাবে কথায় কথায় লজ্জা দিচ্ছে ওকে। সায়রের দিকেই আর তাকাবেনা বলে ঠিক করলো।হোটেল থেকে বেরিয়ে ওরা বাসের কাছে গেলো। সবাই এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। এবার নদীপথের ভ্রমণ।

দীর্ঘ একটা পথ পাড়ি দিয়ে কক্সবাজার পৌঁছালো সবাই। অফিসের একজনকে আগেই পাঠানো হয়েছিলো এখানের খোঁজ নেয়ার জন্য। ওদেরকে রিসিভ করে নিয়ে যাওয়া হলো। রিসিপশন থেকে চাবি নিয়ে ক্লান্ত শরীরে যে যার রুমের দিকে গেলো। দুপুরের কাঁধ ব্যাথা করছে। এতো বড়ো একটা ব্যাগ টানতে টানতে হাত ছিঁড়ে যাচ্ছে ব্যাথায়। মাঝে সায়র একবার এসে বলেছিলো ব্যাগটা তাঁকে দিতে ৷ কিন্তু, দুপুর বলেছে কোনো দরকার নেই। দরকার নেই বলার পর সায়র গমগম করে গেছে। দুপুর আড়চোখে তাকিয়েছে বেশ কয়েকবার। দরকার ছিলো, খুব দরকার ছিলো। কেমন ছেলেরে বাবা! জোর করেও তো নিতে পারতো নাকি! আসলে ছেলেটার ঘটে কোনো বুদ্ধি নেই৷ হাবা যেনো কোথাকার। অগত্যা নিজেই টানতে টানতে রুমে গেলো।
রুমের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো দুপুর। কতো সুন্দর করে সাজানো ঘরটা! আবার অদ্ভুতও লাগছে এতো গোলাপ ফুল কেনো বিছানায়! তাও আবার লাভ শেপ করা। দরজা বন্ধ করে বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। একটা নীল রঙের র্যাপিং করা বক্স রাখা। দুপুর কৌতূহলবশত সেটা হাতে নিলো। র্যাপিং খুলে একটা শপিং ব্যাগ বের হলো। এটা কী রে বাবা! সবাইকেই কী এভাবে সারপ্রাইজ দেয়া হয় হোটেলে! ধীরে ধীরে ব্যাগটা খুলতেই দুপুর যা দেখলো তাত চমকে গিয়ে চিৎকার করে উঠলো। চোখ বড় করে তাকিয়ে রইলো সেটার দিকে।

চলবে-
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here