মনসায়রী’ পর্ব-১ লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী

এখনও কী আর আগের মতো খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে দুঃখ বিলাস করো তুমি? হাওয়ায় ভাসা পাখির মতো উড়ো এখনও? হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো কী মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে হেঁসে গড়িয়ে পড়ো? জানি, পারো না। সব চাওয়া কী আর পূরণ হয়! এক জীবনে মানুষের সব চাওয়া পাওয়া পূর্ণতা পায়না। তোমার স্বপ্নগুলো নাকি কোনো একটা ট্রাক এসে পিষিয়ে খেয়েছে। আমি এখনও স্বপ্ন দেখি, হলুদ ফুল বিছিয়ে থাকা রাস্তায় তুমি হাতে দুটো আইসক্রিম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো আমি নীল শাড়ি পড়ে দৌড়ে আসছি তোমার দিকে। দুই কদম পেরোলেই তুমি। ঘুম ভেঙে যায়। কান্না গুলোতে এখন মরিচা ধরেছে। চোখে খরা দেখা দিয়েছে। তুমি তো এখন আর বৃষ্টি হয়ে নামো না। তাই, সবুজ ফসল আর ফলে না আমার চোখে। খরায় চুরচুর করে শুধু স্বপ্নভঙ্গ হয়। একটা ধারালো চাকু বুকের এফোড় ওফোড় করে বের হয়। রক্তটুকু আর বের হয়না। যন্ত্রনার আকারে সমস্ত শরীরে মিশে একাকার হয়ে থাকে। ঢোকের পর ঢোক গিলে হাসতে হয়। আসলে, হাসার নাটক করতে হয়। গালে ব্যাথা ধরে যায় নাটক করতে গিয়ে। বিশ্বাস করো,এখন যদি মিছামিছি হাসার জন্য কোনো শিরপার ব্যবস্থা হতো। আমি স্বর্ণপদকটাই পেতাম। আমার স্বর্ণপদক পাওয়া হয়না, তোমাকে দেখা হয়না, গাল ছুঁয়ে তৃষ্ণা মেটানো হয়না, ঘামে ভেজা চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দেয়া হয়না। তবুও কী আমি বেঁচে নেই? আমাদের তো বেঁচে থাকতে হয়। মরলে এই সুখের বেদনাটুকুর স্বাদ পাবো কী করে। মাঝরাতে হঠাৎ উঠে তোমাকে জড়িয়ে ধরতে না পারার আকুল তৃষ্ণায় ফেটে পড়বো কী করে! তুমি যখন ময়না চাচার দোকান থেকে বৃষ্টি মাথায় করে মালাই এনে দিতে তখন আমি গালভরে হাসতাম। উহু, ওই হাসিতে মিছামিছির খেলা ছিলোনা। আত্মতুষ্টি ছিলো প্রচন্ড। আমি কেমন যেন মালাইয়ের মতো করে গলে গলে পড়ছি। আমি কী কোনো বস্তু বলো! আমার বিক্রিয়া হয় কেনো! তাপ দিলে যেমন ঠান্ডা জিনিস গলে পানি হয়। আমিও নাকি এমন করেই মিইয়ে হাওয়ায় মিশে যাচ্ছি। কিন্তু, আমি তো মানুষ। আমাকে তো বাঁচতে হবে বলো! ‘

এতটুকু লিখে আজকের মতো ডায়েরিটা বন্ধ করে দুপুর। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে টিউশনে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আজকে কেনো যে হঠাৎ ডায়েরি লিখতে ইচ্ছে করলো বুঝতে পারছে না নিজেও। ডায়েরি লিখতে গিয়ে কতগুলো সময় নষ্ট করলো। আজকে বোধ হয় আর খাওয়া হবেনা। খালি পেটেই রোজগার খুঁজতে বের হতে হবে। জামা কাপড় আর পরিবর্তন করার দরকার নেই। মোট তিনটাই সেলাওয়ার কামিজ আছে। দুটো প্রতিদিন বাহিরে পড়ে যায়। আর একটা কোনো অনুষ্ঠান হলে। যদিও সেটাও একবার ছিঁড়ে যাওয়ায় সেলাই করতে হয়েছে। চুলে রাবার দিয়ে বাঁধতে বাঁধতে টেবিলের দিকে নজর যায়। কাঠের আধভাঙা টেবিলটার উপরে সারি সারি পত্রিকা গুলো বিছিয়ে আছে। সবগুলোতেই কার্টুন আঁকা শেষ। শুধু একটা বাকি আছে। ওটার থিম কিছুতেই মাথায় আসছিলো না। দুপুর কোনোরকম রেডি হয়ে পত্রিকা গুলো ব্যাগে ভরে নেয়। আর হ্যান্ডব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিলো। টাকা পয়সা বলতে খুচরা দশ টাকার তিন চারটে নোট। মাসের আটাশ তারিখ। টাকা পয়সা নেই বললেই চলে। কালে ভাদ্রে রিকশায় আসা যাওয়া করে। পা দুটোই সম্বল। কাজীপাড়ার এই ছোট্ট গলি থেকে হাঁটতে শুরু করে রোজ তারপর বকুল ফুলের মাঠ পর্যন্ত এই হাঁটা চলতেই থাকে। কখনো কখনো ক্লান্ত হয়ে ঝিমিয়ে পড়লে ব্যাগে থাকা ইমারজেন্সি পানির বোতলটাই ভরসা। টাকা দিয়ে বাহিরের জিনিস খাওয়ার বিলাসিতা করার সময় কোথায়। মাথায় কাপড় টেনে গেটের চাবিটা হাতে করে ছোট কুটুরে ঘর থেকে বের হয়ে বড় ঘরটাতে ঢুকলো। মোট চারটে ঘর। একটা বাথরুম আছে। আর কোনো রকম একটা দুই চুলো বসানো রান্নাঘর। যদিও এটা এক পরিবারের থাকার বাড়ি। কিন্তু, দুটো পরিবারের লোক বাস করে। দুপুর গলা হাঁকিয়ে মা’কে ডাকলো। মিরা ছুটে আসলেন রান্নাঘর থেকে। দুপুরের মুখের দিকে তাকিয়ে তার শুষ্ক চোখদুটো ভিজে আসলো। লজ্জাও পেলেন তিনি। বড় ভাবীর সাথে ঝগড়া করেও তিনি চুলায় ভাত বসাতে পারেননি। অনেক তর্ক বিতর্কের পর তিনি থম মেরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এখন তো মেয়ে কাজ করতে বেরিয়ে যাবে। ভাত চাইলে কী বলবেন। কষ্টে কাচুমাচু মুখ করে রইলেন৷ দুপুর আগেই মা চাচীর তর্কের গলা শুনছিলো। মনে মনে হাসলোও। আজকে তো এমনিতেই খেতো না সে। ভালোই হয়েছে। মায়ের কাছে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,

‘আম্মা, আজকে বোধ হয় আমার আসতে একটু দেরি হবে। পত্রিকা গুলো জমা দিয়ে আসবো। ‘
মিরা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন,
‘ নতুন কাজ নিয়েছিস আবার! ‘
দুপুর জুতা পায়ে দিয়ে বলল,
‘না আম্মা, কাজ পাওয়া কী আর এতোই সহজ! পত্রিকায় ছবি আঁকার কাজটাই তো কতো হাতে পায়ে ধরে নিলাম। দেখি, যদি মানিক আঙ্কেলকে বলে লেখার কাজটা নিতে পারি কিনা। একটু কষ্ট হলেও, মাসে চার হাজারের কম দেবে না। দরজা আটকিয়ে দাও। আর বাসা ভাড়া চাইতে আসলে বলবে গত মাস আর এই মাসেরটা একসাথে এক তারিখে দিয়ে দেবো। ‘
মিরা আঁচল দিয়ে চোখটা মুছে নিলেন। চব্বিশ বছরের মেয়েটাকে এখনও বিয়ে দিতে পারলেন না তিনি। পরপর দুটো মেয়ে হয়েছিলো বলে শ্বাশুড়ি অনেক ধরণের কথাই শুনাতেন। কিন্তু, মেয়েটাই যে ছয় সাত জন মানুষের দায়িত্ব এক হাতেই সামলাবে। তা কে ভেবে রেখেছিলো! ভাবেনি কেউই। অথচ, না ভাবা জিনিসটাই ঘটছে তিনটে বছর ধরে।

দুপুর জোরে জোরে পা ফেলে হাঁটছে। এই রাস্তাটা বেশ সুনসান নীরবতা পালনকারী। দুই একটা কুকুর খেউ খেউ করে উঠছে। বেশি ভালো জায়গা না। কেমন যেন গা ছমছম করে ওঠে। দুপুরের মনের অচতনে আসা চিন্তাটাই সত্যি হলো। টং দোকানটার সামনে দিয়ে পার হতে নিলেই পথরোধ করে দাঁড়ালো এলাকার মাস্তান রাদিন। হাতে আধপোড়া সিগারেট। একটু পর পর ঠোঁটে প্রবেশ করিয়ে বিশ্রী ভঙ্গিতে ধোঁয়া ছাড়ছে দুপুরের মুখে। দুপুর বুকের আঁচলটা টেনে জড়োসড়ো হয়ে নেয়। ঘনঘন শ্বাস ফেলে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করে। রাব্বিকে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে নেয়। নেহাৎ এই রাস্তাটা ছাড়া আর যাওয়া আসার পথ নেই, তাই বাধ্য হয়ে আসতে হয়। নাহলে, এই মাস্তানের মুখও দর্শন করতে চায়না দুপুর। রাদিন দুপুরের হাতের কবজি টেনে বললো,
‘দুপু কাল আসলি না যে! জানিস কতক্ষণ দাঁড়ায়ে অপেক্ষা করসি। ‘
দুপুর জবাব দেয়না। থুতনি একেবারে নত করে চোখমুখ খিঁচে হাঁটতে থাকে। রাদিন একপাটি দাঁত বের করে হেঁসে বলল,
‘ জবাব দেস না ক্যা? নাকি নতুন নাগর পাইসোস? নাম কী নাগরের? ‘
দুপুর নির্বিকার হয়ে থাকে। রাদিন রেগে যায়। দুপুরের প্রকৃতপক্ষে এখন আর আগের মতো কান্না পায়না। আগে খুব কান্না পেতো। বুক চাপড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করতো। একবার সন্ধ্যার দিকে ঘর থেকে বের হয়েছিলো। চাল শেষ। তাই বের না হলে চলছিলো না। রাদিন দলবল নিয়ে পথ আঁটকে পিঠে নোংরা হাত দিয়ে স্পর্শ করেছিলো। সেই ভয়ে সাতদিনের জ্বরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো বিছানায়। আট দিনের দিন বাধ্য হয়ে বের হতে হয়েছে। রোজগারের একমাত্র মাধ্যমও যদি আয় করা বন্ধ করে দেয় সংসার চলবে কী করে! দুপুর মনে মনে যত ভয়ই পাক। আগের মতো আর চিল্লায় না। রাদিনের থেকে হাত ছাড়িয়ে নেয় দুপুর। রাদিন পিছেপিছে আসতে নিলে, দুপুর কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘খবরদার রাদিন,আর এক পা এগুলে খুব খারাপ হবে। ‘

থেমে যায় রাদিন। দুপুরের কন্ঠে কী যেন একটা ভয় পাইয়ে দেয়। উল্টো পথে চলে আসে সে। দুপুর স্বাভাবিক ভাবেই আধা ঘণ্টার রাস্তা হেঁটে হেঁটে পত্রিকা অফিসে পৌঁছালো। ‘দৈনিক খবর’ অফিসটার দুই তলায় গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে দুপুর।
গলা প্রচুর শুকিয়ে আছে। পানির বোতলটা আজকে ব্যাগে নিতে ভুলে গেছে। নিজেকেই মনে মনে বকে সে। দিন দিন চূড়ান্ত মনভুলা মানুষে পরিণত হচ্ছে বুঝি। সামনে দিয়েই একজন লোক চা, শরবত নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। যদিও ফ্রি, তবুও দুপুরের সাহস হয়না পানি চাওয়ার। একদিন পত্রিকা জমা দিতে এসে মানিক আঙ্কেল ওকে চা খেতে দিয়েছিলো। প্রথম চুমুক দেয়ার পরই অফিসের বড় একজন কর্মকর্তা মানিক আঙ্কেলকে চড় দিয়ে বলল,
‘কু’ত্তার বাচ্চা, চা কী এখানে মাগনা পেয়েছিস! যে যাকে তাকে মনমতো চা খাওয়াস। কালকেও একজনকে ফ্রিতে কেক খাইয়েছিস। ছোট’লোকের দল।’
দুপুরের তখন লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিলো। মানিক আঙ্কেলও নিচু পদের কর্মকর্তা। স্পোর্টসের লেখালেখির দায়িত্ব তার উপরে। এখানে উচ্চপদস্থ লোকের জোর চলে। দুপুর সবসময় মুখকে সামলে রাখে। মরে যাওয়া ভালো। তবুও, এক বিন্দু পানি চাওয়া যাবে না। মানিক আঙ্কেল আসলেন। স্নেহসুলভ হাসি দিয়ে বললেন,
‘দুপুর মা, লেখা শেষ? ‘
দুপুর স্মিত হেসে বলল,
‘হ্যা আঙ্কেল। ‘
মানিক আঙ্কেল পত্রিকা গুলো নিয়ে দেখলেন সব ঠিকঠাক আছে কিনা। তারপর দুপুরের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘বাড়ির সব ঠিক তো? ‘
দুপুরের মুখ মলিন হয়ে আসে। ঠোঁট চেপে বলল,
‘ আঙ্কেল, আপনি তো জানেনই শিপুদার চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার দরকার হয় প্রতিমাসে। দিতির পড়ার খরচ। এবার ও তো সেভেনে উঠলো। কতকিছু লাগে। মা ছেঁড়াফাটা শাড়ি পড়ে থাকে। তনয়া ভাবিও মুখ ফুটে বলে না, কিন্তু আমি জানি ঘরে এক মাস হলো মাংস রান্না হয়না। এই নিয়ে কত কষ্ট পায়। আমি তো কিছুই করতে পারিনা। অকর্মা মেয়ে একটা! ‘
মানিক আঙ্কেল মাথা নাড়িয়ে বললেন,
‘না মা, নিজেকে কেনো দোষারোপ করো না। তিনটে বছর ধরে এতবড় বাড়িটা তো তুমিই চালাচ্ছো। আমার বন্ধুটা আজ বেঁচে থাকলে সুন্দর একটা সংসার হতো তোমার। নিয়তি অনেক নিষ্ঠুর। ‘
দুপুর অনুনয়ের চোখে তাকিয়ে বলে,
‘আঙ্কেল, কার্টুন আঁকা ছাড়া আর কিছুর জন্য কোনো পোস্ট খালি নেই? শুনেছিলাম ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে লেখার জন্য লোক খুঁজছে। চার হাজার টাকা মাইনে। কাজটা আমাকে দেয়া যায় না? ‘
মানিক আঙ্কেল স্বান্তনা দিয়ে বললেন,
‘ চিন্তা করো না। আমি হেডের সঙ্গে কথা বলবো তোমার জন্য। ‘
দুপুর কৃতজ্ঞের চোখে তাকিয়ে বিদায় নেয়। বাবা নেই এখন। গত হয়েছেন তিনেক বছর আগে। রেখে গেছেন কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার মধ্যে মানিক আঙ্কেল একজন। যদি এই কাজটা না পেতো। তাহলে নাম খেয়েই মরতে হতো।
দুপুর অফিসের বাথরুম থেকে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে আঁচল দিয়ে মুখ মুছে নেয়। এখানে থেকে সোজা অনিককে পড়াতে যেতে হবে। অনিকের মা’কে বলবে বেতনটা একটু তাড়াতাড়ি দিতে। বাড়িওয়ালা রোজ এসে মা চাচীকে গালাগালি করে যায়। ভালো লাগে না দুপুরের। যতদ্রুত সম্ভব টাকাগুলো দিয়ে দিবে। সামনের মাসে আবার রোজা। সব জিনিসের দাম আগুনের মতো হয়ে যায়। রোজার মাসে এক্সট্রা একটা টিউশনি নিতে হবে। অনিকদের বাড়ির সামনে আসতেই ছোট একটা মেয়ে লাল টুকটুকে গোলাপ ফুলের তোড়া নিয়ে আসলো। এক পিস দশ টাকা করে বিক্রি করছে। দুপুর আলতো হেঁসে মেয়েটাকে বলল,
‘ফুল দিয়ে আমি কী করবোরে?’
মেয়েটা বুদ্ধিমানের মতো বলল,
‘ক্যান! আপনের ভালোবাসার মানুষ নাই? ভালোবাসার মানুষরে ফুল দিবেন। ‘
দুপুর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চলে আসলো। মেয়েটা সামনে চলে গেলো বিক্রি করতে। দুপুর ওদিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল,
‘ভালোবাসা হলো বড়লোকদের জিনিস। গরীবদের জন্য তো বিলাসিতা। ভালোবাসা দিয়ে মন ভরে, পেট ভরে না। এমন জিনিস কিনে এই দুপুর কী করবে? ‘

চলবে-
‘মনসায়রী’ পর্ব-১
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।
২৩/০৪/২০২২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here