#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড),২৩,২৪
#মম_সাহা
পর্বঃ তেইশ
“বাবা,হাঁট থেকে আমার জন্য আজ আলতা আনবে? আমার অনেকদিনের শখ আলতা দিবো।”
এতদিনের মিইয়ে যাওয়া তিস্তা’র রঙিন আবদার শুনে ক্ষাণিক চমকে উঠে আমান শেখ। এতদিন পর মেয়েটা আবদার করলো? কাঠফাটা রোদ্দুর মাথার উপর থাকা স্বত্তেও বাবার হৃদয়ে শীতল স্রোত বইলো। সন্তানের অনাকাঙ্খিত নির্জীবতা কোনো বাবা-মা’ই যে সহ্য করতে পারে না।
বাবা’কে চুপ থাকতে দেখে ঘাবড়ে গেলো তিস্তা। ভুল আবদার করে ফেললো না তো সে? হয়তো ভুল আবদারই। নষ্ট মেয়ের রঙিন আবদার করা মানায়? বিষাদিনী বুবু যতই তাকে পবিত্র বলুক,সবার চোখে তো সে নষ্ট। আচ্ছা, মানুষ কখনো নষ্ট হয়? আর যে পুরুষ নষ্ট করে একজন মেয়ে’কে,সে কখনো নষ্ট হয় না? আমাদের সমাজ টা এত নড়বড়ে কেনো? সব নিয়ম কেমন উলোট পালোট।
তিস্তা ছোট্ট শ্বাস ফেলে। এক বুক হতাশা নিয়ে সে বলে,
“আমার আলতা লাগবে না,বাবা।”
আমান শেখ মেয়ের দ্বিতীয় কথায় বিচলিত হয়। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বলে,
”কেনো, আম্মা? তুমি পড়বা না আলতা? আমি বাজারে গিয়েই কারো হাত দিয়ে পাঠাবো। সুন্দর করে পা সাজিয়ো। আমি রাতে এসে দেখবো। রেশমি চুড়ি আছে তোমার? আচ্ছা, এক মুঠো লাল রেশমি চুড়ি পাঠাবো কেমন?”
সপ্তদশী’র হৃদয় খানা ছলাৎ করে উঠে। বাবা’র কাছে ভুল আবদার করে নি ভেবে আনন্দে টইটুম্বুর হয় হৃদয়ের আঙিনা। জড়িয়ে ধরে বাবা’কে। বাবার বক্ষ মাঝে মুখ লুকিয়ে বলে,
“না। আমার রেশমি চুড়িও নেই। তুমি পাঠিয়ে দিও বাবা।”
আমান শেখ মুচকি হেসে মেয়ে’র মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তন্মধ্যেই তনয়া বেগম রান্নাঘর থেকে এক বাটি পায়েস হাতে নিয়ে উঠোনে আসে। রান্নাঘর থেকে সে অবশ্য সবটুকু ব্যাপার খেয়াল করেছে। মেয়েটাকে আবার আবদারের ঝুলি হতে দেখে শান্তি পায় সে।
মিছে মিছে অভিমান দেখিয়ে বলে,
”হয়েছে বাবা মেয়ের ভালোবাসা? আমি তো কেউ না। পরের মেয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসেছি। আমাকে আর ভালোবেসে কি হবে।”
মায়ের এহেন অভিনয়ে ফিক করে হেসে দেয় বাবা মেয়ে। আমান শেখ ঠাট্টার স্বরে বলেন,
”আসলেই তো। তোমায় ভালোবেসে আর কী হবে? বুড়ি মহিলা।”
তিস্তা এবার শব্দ করে হেসে দেয়। তনয়া বেগম গাল ফুলিয়ে বলেন,
”হ্যাঁ, হ্যাঁ। এখন তো বুড়ি’ই হবো। গ্রামে কত সুন্দর মানুষ দেখেন। আমারে তো বুড়ি’ই লাগবো।”
মায়ের অভিমানী বুলি শুনে খিলখিল করে হাসে তিস্তা। বাবা আবার সে অভিমান ভাঙাতে বলে,
”কে বললো,তুমি বুড়ি? কার বুকে এত বড় কলিজা? কে এই চরম সত্যি কথাটা বললো? তার আজ গ’র্দা’ন নেবো।”
বাবা-মায়ের টক মিষ্টি ঝগড়া দেখে ছোট্ট হৃদয়টাতে শীতল অনুভূতি হয় তিস্তার। চোখ জুড়িয়ে যায়। আপনমনে বিড়বিড় করে বলে,”ভালোবাসা সুন্দর।”
তিস্তার ধ্যান ভাঙে মুখের সামনে পায়েস দেখে। অবাক দৃষ্টিতে মায়ের পানে তাকিয়ে বলে,
“পায়েস! আজ?”
“হ্যাঁ, পায়েস। এত বছর তো জন্মদিনের সকাল পায়েস খেয়েই পালন করলে। আজ ব্যাতিক্রম হবে কেনো? যতদিন আমি আছি ততদিন এ নিয়ম চলবেই।”
মেয়ের মুখে পায়েস দিতে দিতে তনয়া বেগম বললেন।
তিস্তা’র চোখে অশ্রুকণা ভীড় করলো। মা-বাবা’র নিবিড় ভালোবাসায় কেঁপে উঠলো হৃদয় কোণ। অতি আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বেরিয়ে এলো চোখের জল। মুখে খাবার থাকায় নাকে মুখে হেঁচকি উঠলো তার।
মেয়ের হেঁচকি দেখে ব্যস্ত হলো বাবা। তাড়াতাড়ি কল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলেন। মেয়ের মুখের সামনের জলের গ্লাস ধরে বার কয়েক ফুঁ দিয়ে দিলেন মেয়ের মাথায়।
বাবা’র যত্নে হেঁচকি থামলো কন্যার। তনয়া চোখ রাঙিয়ে বললেন,
“খাবার মুখে কাকে চোখের জল ফেলতে দেখছো তুমি? খাবার অভিশাপ দেয় জানো না? আজ জন্মদিন বলে বেঁচে গেছো। দিন দিন বড় হচ্ছো না ব’ল’দ হচ্ছো?’
“বাহ্,তোমার তো অনেক সাহস হয়েছে দেখছি! আমার সামনে আমার মেয়েকে বকছো? আজ’ই বিতারিত করা হবে তোমাকে এ বাড়ি থেকে। কী বলো, আম্মা?’
আমান শেখের মিছে ধমকে হেসে ফেলে তিস্তা। বাবা’কে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমায় তোমরা এত ভালো ক্যান বাসো, বাবা?’
“ভালোবাসার কোনো কারণ থাকে না, তিস্তা। শুধু এটা মনে রেখো,তোমার বাবা কিংবা আমার প্রাণ ভোমরা তুমি।”
মায়ের কথায় আনন্দে মাথা নাড়ে সে। বাবার স্নেহতলে আর মায়ের আদরের জীবন সব সন্তান বুঝে না। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাওনা হলো বাবা-মা। তাদের একেক টা চাওয়া যেনো সন্তানের সবচেয়ে বড় সুখের জন্য। কিন্তু আফসোস! বেশিরভাগ সন্তান বুঝে না বাবা-মায়ের স্বার্থকতা।
_
শরীরে জড়ানো গাঢ়ো জলপাই আর লাল রাঙা মিশ্রিত শাড়ি। পায়ে টকটকে আলতা লেপিত,হাতেও আলতা দ্বারা আবৃত দারুণ নকশা, চোখে মোটা কাজল,হাতে দুমুঠো রেশমি চুড়ি পড়ে গ্রামের মেঠোপথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে তিস্তা।
বাবা বাজার থেকে আলতা আর এক ডজন রেশমি চুড়ি পাঠানোর পরেই জাঁকজমক ভাবে সেজেগুজে তৈরী হয়েছে তিস্তা। বাবা অবশ্য যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলো বাজার থেকে এসে মেয়ের লাল টুকটুকে সাজ দেখবো, মেয়ে যেন যত্নের সাজখানা মুছে না ফেলে।
প্রতি জন্মদিনে’ই বেশ সাজগোজ করে সে। এবার যে তেমন সাজগোজ করতে পারবে ভাবতে পারে নি সে। কিন্তু বাবা-মায়ের তীব্র ভালোবাসায় আবার আশ্বাস পেয়েছে রমনী। এখন কী আর সে সপ্তদশী আছে? এখন সে হলো গিয়ে অষ্টাদশী’র রঙিন রমনী। তার কী রঙহীনতা মানায়? মানায় না তো।
_
মাস্টারমশাইদে’র উঠোন মাঝে যেনো রঙের মেলা বসেছে। তিনজন কিশোরী আর একজন তেজস্বী নারী’র রঙিন সমাহার। তারা যেন কী বলছে আর হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
প্লাবন সবে বাজার থেকে এসেছে। কিন্তু উঠোনের দৃশ্য দেখে তার চোখ আটকে গিয়েছে। কঙ্কণা,বকুল আর মাস্টারমশাই এর মানবী’র এ কী নতুন সাজ! এ কী রূপ?
মাস্টারমশাই অবাক কণ্ঠে বলে,
“সবাই এভাবে সেজেগুজে বসে আসিছ যে? আজ কোনো উৎসব আছে?”
রমনীদের আলোচনায় ভাঁটা পড়ে। গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠে সামান্য কেঁপে উঠে বিষাদিনী। যার ফলে কঙ্কণা’র পা’য়ে ভীষণ যত্নে আঁকতে থাকা আলতার সরু দাঁগটা বেঁকে যায়।
বিষাদিনী সামান্য বিরক্ত হয়। ভ্রু যুগল কুঁচকে সন্দিহান কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
“কেনো? উৎসব না থাকলে বুঝি সাজা যায় না? মেয়েরা বারো মাসই সাজতে পারে। এর জন্য উৎসবের প্রয়োজন হয় না।”
বিষাদিনী’র কাঠ কাঠ উত্তরে বিরক্ত হয় প্লাবন। বকুল আর কঙ্কণা চুপ হয়ে যায়। মাস্টারমশাই’কে তারা যথেষ্ট সম্মান করে। আর মাস্টারমশাই এর সামনে এমন সাজগোজ নিয়ে থাকতেও অস্বস্তি অনুভব হয় তাদের। তাই তারা মিনমিন কণ্ঠে বিষাদিনী’র উদ্দেশ্যে বলে,
“আজকে বলো না মাস্টারমশাই’কে,আমাদের যেন ছুটি দেয়। আমরা আজ পড়বো না। পুরো গ্রাম ঘুরবো।”
“হ্যাঁ, তোমরা আজ ঘুরবো। এটা আবার প্লাবন দা’কে বলার কী আছে? আজ তিস্তার জন্মদিন উপলক্ষে সবার ছুটি।”
বিষাদিনী’র কথায় প্লাবন ভ্রু কুঁচকে বলে,
“দু’দিন পর না তোদের পরীক্ষা? আর আজ না পড়ে তোরা ঘুরবি? আর,ওর জন্মদিন হয়েছে তো কী হয়েছে? এ জন্য পড়াশনা কেনো শিকেয় তুলবি?”
মাস্টারমশাই’র শক্ত জবাবে বোঝা গেলো আজ ছুটি মিলবে না। তিস্তা সামান্য মন খারাপ করলো। মুখখানা ছোট করে বললো,
“তবে কী আজ,ছুটি নেই?”
প্লাবন “না” বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। তার মানবী’কে সে সরাসরি কীভাবে না বলবে? মেয়েটার মন খারাপ হবে না? ছোট্ট মনটা’কে কষ্ট দেওয়া কী প্রেমিক পুরুষের সাজে? যতই হোক, সে সবার আগে আদর্শ প্রেমিক। আর আদর্শ প্রেমিক কখনো প্রেয়সীর মনোক্ষুণ্ণ করতে পারে না।
অবশেষে প্লাবনের মুখো ভঙ্গি বদলালো,সাথে জবাবও বদলালো। ছোট কণ্ঠে বললো,
“আচ্ছা, যা আজ তোদের ছুটি।”
মাস্টারমশাই’র একটা কথায় উচ্ছ্বাসে ভরে উঠলো পরিবেশ। কঙ্কণা,বকুল দৌড়ে মাস্টারমশাই’কে পাশ কাটিয়ে বাহিরে চলে গেলো। উদ্দেশ্য তাদের মধুসখী’র ঘাট। বিষাদিনী আপু আজ তাদের এত সুন্দর সাজিয়ে দিয়েছি নিজের শাড়ি,অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে। তা গ্রামবাসী’কে না দেখালে হবে? আর দেখাতে হবে না তাদের বাড়ির মানুষকে,একটা বাহিরের মেয়ে আপন না হয়েও কেমন খেয়াল রাখছে তাদের। কেমন পাঁচদিনের মাঝে সপ্তদশীদের দুনিয়া পাল্টে ধূসর থেকে রঙিন করেছে।
বকুল’রা বেরুতেই তিস্তা উঠে দাঁড়ালো। বিষাদিনী আলতা রাখার জন্য নিজের ঘরে প্রবেশ করলো। তিস্তা মাস্টারমশাই’র পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় তার পথ আগলে দাঁড়ালো মাস্টারমশাই। পাঞ্জাবী’র পকেট থেকে একটা ছোট্ট কাগজের প্যাকেট বের করে তিস্তা’র হাতে দিলো। অবাক হলো তিস্তা। বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
“কী এটা!”
“খুললেই দেখতে পাবি। এটার অপূর্ণতা আছে শরীরে। তাই নিয়ে এলাম।”
“আচ্ছা।”
ছোট্ট বাক্যব্যয় করে তিস্তা বেরিয়ে যেতে নিলেই প্লাবন শীতল কণ্ঠে ডাক দিয়ে বললো,
“অষ্টাদশী’র স্রোতস্বিনী, শুভ জন্মদিন। জন্মদিনের প্রেমময় শুভেচ্ছা নিও।”
তিস্তা থামকালো। তুমি! মাস্টারমশাই তাকে তুমি বললো! শরীরে বয়ে গেলো শিহরণ। এই অনুভূতির সাথে সে পরিচিত না। নতুন অনুভূতি। ভালোবাসলে বুঝি প্রেমিকের কথায় এমন শরীরে শিহরণ বয়! তুমি ভাষাটাও বুঝি এত মিষ্টি লাগে?
লজ্জায় লাল হয় গাল, পশম দাঁড়িয়ে যায়। বাকশক্তি লোপ পায়। উত্তেজনায় কাঁপে শরীর।
তিস্তার কাহিনী দেখে হাসে মাস্টারমশাই। নিবিড় হাসি। ছোট্ট কণ্ঠে আদুরে মাখা শব্দে বলে,
“তোমার অষ্টাদশী’র জীবনের জন্য দোয়া রইলো। সবটা সুখকর হোক। আর অনুভূতি প্লাবনময় হোক।”
তিস্তা আর দাঁড়ায় না। তার লজ্জা লাগছে। ভীষণ লজ্জা। ছুটে চলে যায় মাস্টারমশাই’র সামনে থেকে। কাঁপা কাঁপা পায়ে ছুটতেও পারছে না ঠিকমতন। প্লাবন হাসে। সাবধানী কণ্ঠে বলে,
“ধীরে যাও।”
ততক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে বিষাদিনী। গুনগুনিয়ে গায়,
“ভালোবেসে সখী,নিভৃতে যতনে,
আমার নামটি লিখো তুমি, মনেরও মন্দিরে।”
প্লাবন পাত্তা দেয়না সে গান। অগ্রসর হয় ঘরের দিকে। বিষাদিনী নিজের বড় বেণীটা কোমড়ে ফেলে বেশ তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,
“শাড়িটা তো শহর থেকে এনেছিলেন তাই না,প্লাবন দা? তিস্তাকে দারুণ মানিয়েছে। তা মেয়েটার মনে যে এত রঙ লাগাচ্ছেন, টিকিয়ে রাখতে পারবেন তো প্রেম? দেখবেন,বিষাদিনী’র বিষাদই না আবার শেষমেশ জুটে। অমন একটা শাড়ির জন্য হলেও,আমার আপনাকে চাই, প্লাবন দা।”
বিষাদিনী আর দাঁড়ায় না। গটগট পায়ে বেরিয়ে যায়। প্লাবনের কপালে পড়ে চিন্তার ভাঁজ। বিষাদিনী মেয়েটা তার কাছে কেমন অস্বচ্ছ। তিস্তাকে এর সাথে মিশতে দেওয়া যাবে না। ওষুধ রোগ সারানোর জন্য দারুণ জিনিস কিন্তু সুস্থ শরীরের জন্য বিষ। আর বিষাদিনী সেই ওষুধ।
_
মধুসখী’র ঘাটে চার নারী’র রমরমা আড্ডা। এর মাঝে তিস্তা’র পায়ে নূপুরের শব্দ। মাস্টারমশাই এর তরফ থেকে উপহার।
কঙ্কণা আর বিষাদিনী’র সক্ষ্যতা যেন একটু বেশিই। একজনের প্রতি আরেকজনের প্রেম যেন আকাশ ছোঁয়া।এতে অবশ্য কারো কোনো মাথা ব্যাথা নেই।
হঠাৎ মধুসখী’র ঘাটে উপস্থিত হলো ক্লান্তময় প্লাবন। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“তিস্তা,তাড়াতাড়ি তোর বাড়ি চল।”
তিস্তা অবাক হলো। সাথে উপস্থিত সবাই। বিস্মিত কণ্ঠে তিস্তা বললো,
“কেনো, মাস্টারমশাই?”
প্লাবনের যেন উত্তর দেওয়ার সময় নেই। তিস্তা’র হাত ধরে ছুটতে থাকে তিস্তার বাড়ির দিকে। তাদের পিছে পিছে ছুটে বাকি তিনজনও। তিস্তার বাড়ি’র কাছে আসতেই ভীষণ ভীড়ের দেখা মেলে। ভীড় ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই আৎকে উঠে তিস্তা।
বাড়ির ছোট উঠান জুড়ে খাটিয়া। সাদা কাপড়ে মোড়ানো কে যেন শুয়ে আছে সেথায়।
#চলবে
#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড)
#মম_সাহা
পর্বঃ চব্বিশ
তিস্তা’র সামনে সাদা কাপড়ে মোড়ানো লা’শ খানা। তবুও তিস্তার মুখে দুঃখের কোনো রেশ নেই। সে ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে উঠোনের এক কোণায়। তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকা বকুল অব্দি কেঁদেকেটে ভাসাচ্ছে অথচ মেয়েটা কাঁদছে না। কী আজব! মেয়েটা কী পাথর হলো?
উঠোনের মাঝে নেতিয়ে আছে আহ্লাদী। এতক্ষণ সে গড়াগড়ি খেয়ে কেঁদেছে। আর দেহে কুলচ্ছে না কাঁদাকাটি। আহ্লাদী’কে ধরে বসে আছে দাদী। মেয়েটা’র পেটে তিন মাসের সন্তান অথচ তার স্বামী আজ খাটিয়া’তে ঠাঁই পেয়েছে। কী দুর্ভাগ্য! হাহ্!
গ্রামের লোক কত স্বান্তনা দিলো। মেয়েটা সবসময় শান্ত শিষ্ট থাকতো। আহারে মেয়েটার কপাল পুড়লো শেষমেশ!
বোন জামাইয়ের লা’শ দেখার পরও তিস্তা’র হেলদোল না দেখে অবাক হয় বিষাদিনী। সবার অগোচরে ফিসফিস করে বলে,
“তুমি কাঁদছো না যে? খারাপ লাগছে না দুলাভাই’র জন্য?”
তিস্তার ভাবলেশহীন উত্তর,
“নাহ্ তো।”
বিষাদিনী অবাক হয়। তারপর নিজেকে সামলে নেয়। সন্দিহান কণ্ঠে বলে,
“কেনো? বাজে লোক ছিলো নাকি সে?”
এবার অবাক হওয়ার পালা তিস্তার। বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে অঢেল বিস্ময় নিয়ে বলে,
“তুমি জানলে কীভাবে, বুবু?”
“নারী আমি। পুরুষের প্রতি একজন নারী’র ঘৃণা’র দৃষ্টি, বুঝতে পারি আমি। আমারও এমন দৃষ্টি আছে কোনো না কোনো পুরুষের জন্য। তোমায় না বুঝলে হবে?”
তিস্তা থামকায়। বিষাদিনী’র প্রতি তার ভালো লাগা আরও দ্বিগুণ বাড়ে। হঠাৎ করেই বাড়ির পরিবেশে তার বিতৃষ্ণা জন্মায়। সবার অগোচরে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। মাস্টারমশাইটা অকারণেই তাকে ধরে নিয়ে এলো এখানে। এর চেয়ে মধুসখী’র ঘাট বেশি ভালো ছিলো।
তিস্তা বেরিয়ে যেতেই তর পিছে পিছে বিষাদিনীও বেরিয়ে যায়। তিস্তাকে সে যতটা চিনেছিলো, মেয়েটা যে এত পাষাণ হবে সে ভাবে নি। যতই হোক,নারী শরীরেে অপমানের আঁচড় কেটেছিলো সে মানুষ। দয়ামায়া না থাকাটাই তো স্বাভাবিক।
গ্রামের পথে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছে তিস্তা আর বিষাদিনী। কথা’র এক পর্যায়ে বিষাদিনী অদ্ভুত স্বরে বললো,
“তোমার দুলাভাই কীভাবে মারা গিয়েছে, শুনেছো কিছু?”
“হ্যাঁ। হৃদরোগের কারণে। তবে,শ’য়’তা’ন গো শাস্তি এমন ভাবেই দেন সৃষ্টিকর্তা।”
“শাস্তি টা সৃষ্টিকর্তা দিলো না তার সৃষ্টির সেরা জীব দিলো সেটা পরিষ্কার না আমি।”
বিষাদিনী’র কথায় অবাক হয় তিস্তা। ভ্রু কুঁচকে বলে,
“মানে!”
“ও কিছু না। আচ্ছা, তুমি নাহয় তোমার দুলাভাই’কে অপছন্দ করতে। কিন্তু তোমার আপু? তাকে তো তুমি ভালোবাসো, তার দুর্দিনে তোমার এত কাঠিন্যতা মানায়? আর তাছাড়া,তার তো কোল জুড়ে অন্য কারো আগমনী বার্তা বইছে।”
“আপা তো আমার দুর্দিনে দাঁড়ায় নি,বুবু। অবশ্য এ নিয়ে আমার রাগ নেই। এখন ওখানে আমার দমবন্ধ লাগছিলো। আমার এত কান্নাকাটি ভালো লাগে না। ভয় হয় কেবল। হৃদয় মাঝে কেমন ভয়ঙ্কর প্রলয় হয়। কাউকে দেখাতে পারি না। তাই ছুটে চলে এসেছি। মানুষটাকে আমি অপছন্দ করতাম ঠিকই, কিন্তু কখনো চাই নি সে আমার আপা’র সুখ কেড়ে নিয়ে মৃত্যু’র মুখ দেখুক। তবুও উপরওয়ালার ইচ্ছে বুঝি অন্য কিছু ছিলো।”
বিষাদিনী ছোট্ট শ্বাস ফেললো। এতটুকু মেয়েও চায় নি কখনো, তার সাথে খারাপ আচরণ করা ব্যাক্তিটা মারা যাক। কিন্তু সে,এত বড় মেয়ে হয়েও প্রতিনিয়ত নিজের বাবার মৃত্যু কামনা করতো। বাবা হয়তো তার জীবনে নোংরামির আঁচড় কাটে নি। কিন্তু সহজ সরল মেয়েদের যে ক্ষতি করতো। যতই সে বাবা হোক, আগে তো তাকে মানুষ হতে হবে। মানুষ রূপে অ’মানু’ষ হয়ে বেঁচে থেকে আদৌও কোনো লাভ আছে?
বিষাদিনী আর তিস্তা’র নিরব মুহূর্তের মাঝে হাজির হয় দারুণ এক সুপুরুষ। তিস্তাকে দারুণ রঙিন রূপে দেখে পুরুষটা এগিয়ে আসে। মিষ্টি স্বরে বলে,
“ভালো আছেন, তিস্তা?”
তিস্তা অবাক নাহয়ে পারে না। এতদিন পর এ মানুষটার সম্মুখে পরবে ভাবে নি। এ মানুষটার কাছ থেকে অনেক কিছু জানা বাকি তার।
তিস্তাকে চুপ থাকতে দেখে মাহিন আবার প্রশ্ন করলো,
“চিনতে পারেন নি আমায়?”
“না চেনার কী আছে? আমার জীবনে দারুণ ক্ষতির কারণ হলেন গিয়ে আপনি। আপনাকে না চিনলে হবে?”
তিম্তার কাঠ কাঠ জবাবে সামান্য ভড়কে গেলো মাহিন। কিন্তু সে উত্তর দেওয়ার আগেই হঠাৎ তার নজর গেলো তিস্তা’র পাশে দাঁড়ানো রমনী’র দিকে। বিস্ফোরিত কণ্ঠে সে বললো,
“বিষাদিনী, আপনি!”
বিষাদিনী মাহিনের দিকে তাকালো। মাহিনের অবাক দৃষ্টি দেখে সামান্য হাসলো। খুব স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ, আমি। কেমন আছেন, ডাক্তার সাহেব?”
“এইতো,ভালো। আপনি?
“আমি তো সবসময়ই ভালো থাকি,তাই না? তা,এখন কী গ্রামেই থাকেন?”
“না,না,সদরে থাকি। মাঝে মাঝে আসি।”
“তো,আমাদের বাড়িতে যাবেন। আপনার কথা এখনো অনেকে আলোচনা করে।
“হ্যাঁ, যাবো সময় করে।”
“তিন-চার বছরেও আপনার সময় হয়ে উঠে নি!”
বিষাদিনী’র প্রশ্নে হাসে মাহিন। প্রশ্নটা এড়িয়ে বলে,
“আপনি আগের চেয়ে বেশিই সুন্দর হয়েছেন।”
“তখন বুঝি ভীষণ অসুন্দর ছিলাম?”
এহেন প্রশংসায়ও আর পাঁচটা মেয়ের মতন লজ্জায় কুঁকড়ে যায় নি বিষাদিনী। স্বাভাবিক ভাবো আরও টুকটাক কথা হলো দু’জনের মাঝে। তিস্তা কেবল হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। তার বোধগম্য হলো না ব্যাপার টা। দু’জন দুই মেরুর প্রাণী হয়েও পরিচিত কীভাবে?
অবশেষে বিষাদিনী’র আলাপ আলোচনা শেষ হলো। মাহিনকে বিদায় জানিয়ে সে তিস্তা’র হাত ধরে আবার হাঁটা ধরলো গ্রামের পথ ধরে। তিস্তা ফিরে চাইলো মাহিনের দিকে। মাহিন এখনো তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মাহিনের দৃষ্টিতে কেবল মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে। উপচে পড়া মুগ্ধতা। কিন্তু কার জন্য সে মুগ্ধতা? বিষাদিনীর নাকি তিস্তার?
মাহিনের থেকে বেশ কিছুটা দূরে যেতেই বিষাদিনী’র কিছু মনে পড়লো। থেমে গেলো তার পা। হঠাৎ সন্দিহান কণ্ঠে সে তিস্তাকে বললো,
“তুমি তখন ডাক্তার সাহেব মানে মাহিনকে কী বললে? তোমার দারুণ ক্ষতির কারণ সে কীভাবে?”
তিস্তারও এবার হুঁশ হলো। সে বিষাদিনী আর মাহিনের আলোচনায় এতই মত্ত হয়েছিলো যে নিজের প্রশ্ন গুলো ছুঁড়তে পারে নি মাহিনের দিকে। তিস্তাকে চুপ থাকতে বিষাদিনী আবারও প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“বললে না, কী ক্ষতি?”
“আমার চরিত্র নষ্ট হওয়ার মিথ্যে খবরটা উনিই ছড়িয়ে ছিলো, বুবু। অথচ আমার সাথে তেমন কিছুই হয় নি।”
বিষাদিনী ভারী অবাক হলো। বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
“তার মানে? সবাই যা বলে, তোমার সাথে আসলে তা ঘটে নি?”
“নাহ্। আমাকে কেবল পাঁচদিন অন্ধকার একটা ঘরে আটকিয়ে রেখেছিলো। এছাড়া কিছুই করে নি। কিন্তু গ্রামের মানুষ সেটা বিশ্বাস করে নি একমাত্র এই ডাক্তারের জন্য। উনিই আমাকে পরীক্ষা নীরিক্ষা করে বলেছিলো আমার সাথে খারাপ কিছু হয়েছে।”
বিষাদিনী সামান্য হোঁচট খেলো বোধহয়। ডাক্তার সাহেব মিথ্যে কেন বলেছে? নিশ্চয় এর ভিতরে কাহিনী আছে।
_
রাত নেমেছে চারপাশে। তিস্তা বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে কেবল পড়তে বসেছে। হারিকেনের আলোটা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে পড়ায় মনোনিবেশ করেছে মাত্র। হঠাৎ তার ঘরে ধীর গতিতে কেউ প্রবেশ করলো। তিস্তা সামান্য চমকে তাকাতেই দেখলো একদম সাদা ধবধবে শাড়ি পড়া তার আপা।
তিস্তা নিজের বোনের দিকে তাকিয়ে আবারও চোখ নামিয়ে নিলো। সাদা শাড়িতে আপাকে কেমন ভয়ঙ্কর লাগছে! তিস্তার ভাবনার মাঝে আহ্লাদী’র কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
“কিরে,কথা বলবি না আমার সাথে?”
তিস্তা চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললো,
“ওমা,কথা কেন বলবো না? তুমি বসো এখানে।”
“না না। বসতে আসি নি। তোরে একটা দায়িত্ব দিলে পালন করতে পারবি?”
তিস্তা ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কী?”
“আমার সন্তানকে তুই মানুষ করতে পারবি?”
আপার কথায় তিস্তা বিচলিত হলো। আপার মাথায় কী অন্য কিছু ঘুরছে? তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে আপাকে জড়িয়ে ধরলো তিস্তা। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো,
“নাহ্, পারবো না। তুমি থাকতে আমি মানুষ করতে যাবো কেন? কীসব বলছো আপা!”
“আচ্ছা, তুই আগের মতন আমায় ভালোবাসিস তো? নাকি আর মনে পড়ে না আমায়?”
“আমি তোমাকে সবসময় ভালোবাসি, আপা। এমন করে বলছো যে!”
আর উত্তর দেয় না আহ্লাদী। কেবল মনে মনে কী যেন ভাবে।
_
আজকে থেকেই তিস্তার মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু। মাস্টারমশাই আর বিষাদিনী’র সাথে তিস্তা, কঙ্কণা,বকুল পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। তিস্তা তার সাথে নিজের মাকে আনতে ভুলে নি। চোখ গুলো ফুলে ঢোল হয়ে আছে মেয়েটার।
আজ দিন দুই যাবত সে কারো সাথে কথা বলছে না। কিন্তু যতটুকু মনে হয় মেয়েটা খুব কাঁদছে। কিন্তু কেনো?
প্লাবনের ক্ষানিকটা খটকা লাগে। ওর দুলাভাই যেদিন মারা গেলো, মানে গত তিনদিন আগেও মেয়েটা ঠিক ছিলো। কিন্তু হঠাৎ করে কী হলো মেয়েটার? তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে কেনো?
স্কুলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সবাই। প্লাবন সবাইকে ভালো করে বুঝিয়ে দিচ্ছে। তিস্তা তাদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। প্লাবন বকুল আর কঙ্কণাকে বুঝিয়ে তিস্তার দিকে গেলো।
প্লাবনকে দেখে তিস্তা মুখটা ঘুরিয়ে নিলো। প্লাবন বেশ অবাক হলো তিস্তার আচরণে। এমন করছে কেনো মেয়েটা?
প্লাবন অবাক কণ্ঠে বললো,
“এমন করছিস কেনো তুই? কথা বলছিস না যে আমার সাথে? আমি কিছু করেছি?”
তিস্তা তবুও চুপ৷ প্লাবনের একটু রাগ উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“বে’য়া’দ’ব হয়েছিস? একটা কথা জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতে হয় জানিস না? কী হয়েছে তোর? নাটক করছিস কেনো?”
“আমার কিছু হয় নি। আপনি আমার সামনে আর কখনো আসবেন না। চলে যান এখান থেকে।”
প্লাবন তাজ্জব বনে গেলো। এ কেমন কথার ধরণ মেয়েটার!
#চলবে